ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গোখলে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ স্তর পর্যন্ত সম্পর্ক স্থাপন করে গোখলে কেবলমাত্র ভারতের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিতই করে তোলেননি, তাদের অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সরকারি কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজনীতির আধ্যাত্মিকীকরণ, সমাজ সংস্কার ও বিশ্বজনীন শিক্ষায় দৃঢ় বিশ্বাসের দ্বারা অনুপ্রেরিত হয়েছিলেন তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার মহাত্মা গান্ধী। তবে গান্ধীজি তার পাশ্চাত্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ধ্রুপদি উদারবাদের আদর্শকে পরিত্যাগ করলেও ১৯৫০ সালের ভারতীয় সংবিধানে যে ওয়েস্টমিনিস্টার ধাঁচের সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, তা ছিল গোখলেরই চিন্তার ফসল
(মে ৯, ১৮৬৬ - ফেব্রুয়ারি ১৯, ১৯১৫)
১৮৬৬ সালের ৯ মে মহারাষ্ট্র এর কোটালুকে জন্ম। উচ্চবর্ণীয় চিৎপবন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও, গোখলের পরিবার ছিল অপেক্ষাকৃত দরিদ্র। তবুও তারা বাল্যকালে গোখলেকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন যাতে ভবিষ্যতে তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে করণিক বা ছোটোখাটো পদাধিকারীর পদ লাভ করতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রথম প্রজন্মের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন গোখলে। ১৮৮৪ সালে এলফিনস্টোন কলেজ থেকে তিনি স্নাতক হন। গোখলের শিক্ষা তার পরবর্তী কর্মজীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অবহিত হয়েছিল পাশ্চাত্য রাজনৈতিক ধ্যানধারণার সঙ্গে। এই সময় জন স্টুয়ার্ট মিল ও এডমন্ড বার্কের চিন্তাভাবনা তাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের নানা দিকের কঠোর সমালোচনা করলেও, কলেজ জীবনের শিক্ষা থেকে পাওয়া ইংরেজদের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ আমৃত্যু বজায় ছিল।
১৮৮৯ সালে গোখলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ লাভ করেন। তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক মহাদেব গোবিন্দ রানডে। বাল গঙ্গাধর তিলক, দাদাভাই নওরোজি, বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপৎ রাই, অ্যানি বেসান্ত প্রমুখ সমসাময়িক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভারতীয়দের হাতে অধিকতর শাসনক্ষমতা দেওয়া ও আইনসভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের সংখ্যা বৃদ্ধির পক্ষে বক্তব্য রাখেন। রাজনৈতিক আদর্শের বিচারে তিনি ছিলেন মধ্যপন্থী নেতা। তিনি মনে করতেন, আবেদন-নিবেদন নীতিতে চললে ভারতীয় অধিকারগুলি আদায়ের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের সম্ভ্রম পাওয়া সহজ হবে। গোখলে আয়ারল্যান্ড সফর করেন এবং তারই উদ্যোগে আইরিশ জাতীয়তাবাদী নেতা আলফ্রেড ওয়েব ১৮৯৪ সালের জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। পরের বছর গোখলে তিলকের সঙ্গে কংগ্রেসের যুগ্মসচিব নিযুক্ত হন। অনেক দিক থেকেই গোখলে ও তিলকের প্রাথমিক জীবন সংক্রান্ত নানা মিল ছিল। তারা দুজনেই ছিলেন চিৎপবন ব্রাহ্মণ (যদিও তিলক ছিলেন ধনী); দুজনেই এলফিনস্টোন কলেজে পড়াশোনা করেন; দুজনেই ছিলেন গণিতের অধ্যাপক; এবং দুজনেই ছিলেন ডেকান এডুকেশন সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তবুও কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পর ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের উপায় সংক্রান্ত প্রশ্নে উভয়ের মধ্যে মতপার্থক্য প্রকট হয়ে পড়ে।
১৮৯১-৯২ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সরকারের এজ অফ কনসেন্ট বিল নিয়ে তিলকের সঙ্গে গোখলের মতপার্থক্য প্রকট হয়।
গোখলে ছিলেন উদারপন্থী সংস্কারক। তিনি হিন্দুধর্মের সংস্কার কল্পে বাল্যবিবাহ প্রথা রদ করতে চেয়েছিলেন। বিলটির বিষয় ছিল সামান্যই – এই বিলে প্রাপ্তবয়স্কতার মাপকাঠি দশ বছর থেকে বাড়িয়ে বারো বছর করা হয়েছিল। কিন্তু তিলক বিষয়টিকে হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন। তিলক মনে করতেন এই ধরনের সংস্কার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকারের হাতে না হয়ে স্বাধীনতার পর ভারতীয়দের নিজেদের হাতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তিলকের বিরোধিতা সত্ত্বেও, সেদিন গোখলে ও তার সহকারী সমাজ সংস্কারকদের জয় হয়েছিল এবং বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে বিলটি আইনে পরিণতও হয়েছিল।
১৯০৫ সালে গোখলে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি তার এই নবলব্ধ ক্ষমতা তার দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী তিলকের ক্ষমতা খর্ব করার কাজে ব্যবহার করেন। ১৯০৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির মনোনয়ন থেকে তিলকের নাম বাদ দেওয়া হয়। ফলে কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। গোখলে ও তিলক যথাক্রমে নরমপন্থী ও চরমপন্থী গোষ্ঠীর নেতৃত্বদান করতে থাকেন। এই চরমপন্থীদেরই পরবর্তীকালে বলা হত উগ্র জাতীয়তাবাদী। তিলক গণআন্দোলন ও প্রত্যক্ষ বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের ডাক দেন। অন্যদিকে গোখলে সংস্কারপন্থীই থেকে যান। কংগ্রেস দলও এই বিবাদের জেরে দুটি শাখায় ভেঙে গিয়ে এক দশকের জন্য অকার্যকর হয়ে পড়ে। তবে ১৯১৫ সালে গোখলের মৃত্যুর পর দুই শাখা আবার পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিল।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম যুগের একজন বিশিষ্ট নেতা হলেও প্রাথমিকভাবে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের থেকে সমাজ সংস্কারে অধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। তিনি মনে করতেন, এই ধরনের সংস্কার বিদ্যমান ব্রিটিশ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমেই সম্ভব। এই জাতীয় চিন্তাভাবনার ফলে তিলকের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতৃবর্গের সঙ্গে তার শত্রুতা বৃদ্ধি পায়। তবে এই ধরনের বিরোধিতায় নিরুৎসাহিত না হয়ে সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে তার সমগ্র রাজনৈতিক কর্মজীবনেই তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতার পরিবেশে প্রত্যক্ষভাবে সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন।
১৮৯৯ সালে গোখলে বোম্বাই প্রাদেশিক আইনসভায় নির্বাচিত হন। এরপর ১৯০২ সালে নির্বাচিত হন ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে। সেখানে এক পরম প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরূপে তার পরিচিত হয়। বার্ষিক বাজেট বিতর্কগুলিতে তিনি তার প্রতিভার সাক্ষর রেখে যান। ব্রিটিশদের মধ্যে গোখলের প্রতি সম্ভ্রম বৃদ্ধি পায়। সেক্রেটারি অফ স্টেট লর্ড জন মর্লের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি লন্ডনে নিমন্ত্রিতও হন। ১৯০৯ সালে প্রবর্তিত মর্লে-মিন্টো সংস্কারের খসড়াও এই সফরকালেই রচিত হয়েছিল। ১৯০৪ সালে নববর্ষ সম্মান তালিকায় গোখলে একজন সিআইই (কমপ্যানিয়ন অফ দি অর্ডার অফ দি ইন্ডিয়ান এমপায়ার) নিযুক্ত হন। এটি ছিল সাম্রাজ্যের প্রতি তার আনুগত্যের একটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন গোখলে। ১৯১২ সালে গান্ধীজির আমন্ত্রণে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেন। এই সময় তরুণ ব্যারিস্টার গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত ছিলেন। গোখলে তাকে নিজ প্রজ্ঞা, ভারত সম্পর্কিত জ্ঞান ও ব্যক্তিগত সহায়তা দান করে ভারতীয়দের সংঘবদ্ধ করতে সাহায্য করেন। ১৯২০-এর দশকে গান্ধীজি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক দিকপাল নেতা রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। নিজের আত্মজীবনী আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ গ্রন্থে গান্ধীজি গোখলেকে তার গুরু এবং সহায়ক বলেছেন। গান্ধীজির মতে তিনি ছিলেন প্রশংসনীয় নেতা ও দক্ষ রাজনীতিবিদ। গোখলের চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে গান্ধীজি বলেন তিনি ছিলেন “pure as crystal, gentle as a lamb, brave as a lion and chivalrous to a fault and the most perfect man in the political field”।[৮] গোখলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ সত্ত্বেও গান্ধীজি রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের উপায় হিসেবে পাশ্চাত্য প্রতিষ্ঠান নির্ভরতার ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি শেষ অবধি গোখলের সারভেন্টস অফ ইন্ডিয়া সোসাইটির সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলি জিন্নাহেরও আদর্শস্থানীয় ব্যক্তি তথা রাজনৈতিক গুরু ছিলেন গোখলে। ১৯১২ সালে জিন্নাহ "মুসলিম গোখলে" হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
জীবনের শেষভাগেও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন গোখলে। এই উদ্দ্যেশ্যে তিনি একাধিক স্থান ভ্রমণ করেন। ১৯০৮ সালে ইংল্যান্ড সফরের পাশাপাশি ১৯১২ সালে গান্ধীজির আমন্ত্রণে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও যান। এরই সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে সারভেন্টস অফ ইন্ডিয়া সোসাইটি, কংগ্রেস ও আইনসভার কাজও চালিয়ে যান। অতিরিক্ত পরিশ্রমে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ১৯১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হয়।
###############################
No comments:
Post a Comment