(১৮ জুলাই ১৯০৯ - ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২)
একজন শক্তিমান বাঙালি কবি ও লেখক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক। তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ বইটির জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিশ শতকে যেসব বাঙালি কবি একটা নতুন দিগন্তের অন্বেষণে নিমগ্ন হয়েছিলেন, ঠিক সেই সময়ে বাংলা কাব্যভুবনে প্রবেশ ঘটে কবি বিষ্ণু দে-র। তাঁর আত্মগত স্পর্ধিত উচ্চারণে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল এক নতুন ডাইমেনশন। রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্য, পাশ্চাত্য মনন এবং স্বীয় প্রতিভার রসায়নে গড়ে উঠল এক নতুন কাব্যশরীর।
১৯০৯ সালের ১৮ জুলাই কলকাতার কলেজ স্কোয়ার অঞ্চলের এক বনেদি পরিবারে বিষ্ণু দে-র জন্ম। পিতা অবিনাশচন্দ্র দে এবং মাতা মনোহারিণী দে। আদি নিবাস ছিল হাওড়ায়। তার পিতা অবিনাশ চন্দ্র দে ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। বিষ্ণু দে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট এবং সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল-এ পড়াশোনা করেন । ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর বঙ্গবাসী কলেজে আইএ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে সাম্মানিক ইংরাজি বিষয়ে স্নাতক হন সেন্ট পল্স কলেজ থেকে। এরপর ১৯৩৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম এ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি রিপন কলেজে (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) যোগদান করেন শিক্ষক হিসেবে। এরপর তিনি ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ান। এরপর তিনি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজেও অধ্যাপনার কাজ করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ইংরাজীতে এম.এ.র ছাত্রী প্রণতি রায়চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয় । বেটোফেনের নাইন্থ সিম্ফনির মাধ্যমে তাঁদের পরিচয় ক্রমে গাঢ় হয়। পরে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর তাঁকে বিবাহ করেন।
১৯২৩ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে যে সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কবি বিষ্ণু দে তার একজন দিশারী। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় তার অবদান বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে। ১৯৩০ সালে কল্লোলের প্রকাশনা বন্ধ হলে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় পত্রিকায় যোগদান করেন এবং সেখানে একজন সম্পাদক হিসাবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেন। তিনি নিরুক্তা নামের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন। তার কবিতার মূল উপজীব্য হল মানুষ, তার সংগ্রাম ও রাজনীতি, সেখানে সমকালীন জীবনের, দেশ ও কালের, রাজনীতি ও সমাজের প্রতিধ্বনি। প্রথমদিকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দুই সংস্কৃতিরই প্রভাব পড়েছে তার লেখায়। দেশীয় পুরাণ, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পসাহিত্য থেকে ইউরোপীয় ক্লাসিক ও আধুনিক শিল্প সাহিত্যের প্রভাব এবং পরে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, তেভাগা-আন্দোলন ইত্যাদি থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরের ঘটনাবহুল জীবন ও আন্দোলন তার কবিতায় সরাসরি ছায়া ফেলেছে।
তিনি বামপন্থী দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এছাড়া কবি টি এস এলিয়টের রচনাশৈলী এবং ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছড়ানো এই জীবন নামে একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন। এছাড়াও অনুবাদের কাজ করেছেন। তার অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে আছে এলিয়ট, পল অ্যালুয়ার ও মাও-ৎ-সেতুঙের কবিতা।বিষ্ণু দে'র সঙ্গে শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ শাহেদ সোহরাওয়ার্দী ও শিল্পী যামিনী রায়ের বন্ধুত্ব ছিল। তিনি অঙ্কন শিল্পের উপর কিছু বই রচনা করেন, যেমন আর্ট অফ যামিনী রয়(সহযোগে) দ্য পেন্টিংস অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর (১৯৫৮) এবং ইন্ডিয়া অ্যান্ড মডার্ন আর্ট (১৯৫৯)। তিনি ক্যালকাটা গ্রুপ সেন্টার, সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন, প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ, ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েসন, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছবিও আঁকতেন।
সাহিত্যে তার অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, নেহরু স্মৃতি পুরস্কার, এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এছাড়া তিনি সোভিয়েত ল্যান্ড অ্যাওয়ার্ড পান।
আধুনিক কবিদের মধ্যে দুর্বোধ্যতার অভিযােগে সর্বাপেক্ষা বেশী অভিযুক্ত যিনি, তার নাম বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২)। এলিয়ট যেমন বিশ্বাস করতেন- "Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion",- বিষ্ণু দে-ও তেমনি কবিতায় কল্পনাবিলাস বা ভাববিলাসকে প্রশ্রয় দেন নি কখনও, মনন ও পাণ্ডিত্যের শিল্পিত প্রকাশ হিসাবেই তিনি ব্যবহার করেছে তার কবিতাকে। তাই সেই পাণ্ডিত্য ও মননের ভার তাঁর কবিতাকে করেছে সাধারণ পাঠকের কাছে দুরূহ এবং কবি হিসাবে বিষ্ণু দে হয়ে উঠেছেন আধুনিক কবিদের মধ্যে দুর্বোধ্যতম কবি।
দায়িত্বপূর্ণ লেখনী অসার আত্মপ্রকাশের গরজে অস্থির নয় বলেই তাঁর লেখা অল্পবিস্তর অসরল'
বিষ্ণু দে সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একবার এই মন্তব্য করেছিলেন | বলেছিলেন,
”ছন্দোবিচারে ‘তাঁর অবদান অলোকসামান্য' এবং কাব্যরসিকের ‘নিরপেক্ষ সাধুবাদই বিষ্ণু দে-র অবশ্যলভ্য।'
বিষ্ণু দে আধুনিক কাব্যজগতে অস্তিবাদি কবি হিসাবে চিহ্নিত। যদিও রাবীন্দ্রিক অস্তিবাদ থেকে বিষ্ণু দের অস্তিবাদে মৌলিক পার্থক্য আছে। নীহারিকার অস্পষ্টতা থেকে যেমন জন্ম নেয় দীপ্যমান নক্ষত্র, তেমনি আধুনিক যুগের ক্লান্তি, জিজ্ঞাসা, নৈরাশ্য, সংশয় থেকেই কবিতায় তৈরি হয়েছে বিশ্বাসের ধুবজগৎ। সমসাময়িক হলেও সুধীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন থেকে বিষ্ণু দে-র দর্শন ভিন্ন মেরুবর্তী। আবার, অমিয় চক্রবর্তীর অস্তিবাদের থেকে বিষ্ণু দে-র অস্তিচেতনার প্রধান পার্থক্য সূচিত হয় তখন, যখন দেখি অমিয় চক্রবর্তীর মতাে আত্মভাবনার কেন্দ্রে এই অস্তিচেতনার জন্ম হয় না; বিষ্ণু দে-র অস্তিচেতনা জাগ্রত হয় সচেতন সামাজিক সমবায়ের পথে।
উত্তর-তিরিশের কবিদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কবি হিসাবে বিষ্ণু দে-র কাব্যরচনার সূত্রপাত বুদ্ধদেব-জীবনানন্দের সমকালে। বুদ্ধদেব বসুর 'প্রগতি' পত্রিকায় তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন। শ্যামল রায় ছদ্মনামে 'কল্লোল' ও 'মহাকাল' পত্রিকাতেও তার কবিতা প্রকাশিত হত। পরে তিনি সুধীন্দ্রনাথের 'পরিচয়' গােষ্ঠীতে যােগ দেন। এবং এই সময়েই তিনি এলিয়টের দ্বারা অণুপ্রাণিত হন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'উর্বশী ও আর্টেমিস' ১৯৩৩-এ প্রকাশিত। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল - 'চোরাবালি' (১৯৩৭), 'পূর্বলেখ' (১৯৪১), 'সাত ভাই চম্পা' (১৯৪৫), 'সন্দীপের চর' (১৯৪৭), 'আবিষ্ট' (১৯৫০), নাম রেখেছি কোমল গান্ধার ১৯৫০), 'আলেখ্য' (১৯৫৮), 'তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ' (১৯৬০), 'স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ' (১৯৬১), 'সেই অন্ধকার চাই' (১৯৬৫), 'সংবাদ মূলত কাব্য' (১৯৬৬), 'রুশতী পঞ্চাশতী' (১৯৬৭), ‘ইতিহাসে ট্র্যাজিক উল্লাসে' (১৯৬৯), 'রবি-করােজ্জ্বল নিজ দেশে' (১৯৭১), 'ঈশস্য দিবা নিশা' (১৯৭৪), 'চিত্রূপ মত্ত পৃথিবীর' (১৯৭৫), 'উত্তরে থাকো মৌন' (১৯৭৭), 'আমার হৃদয়ে বাঁচো' (১৯৮০) ইত্যাদি। অর্থাৎ সংখ্যাগত দিক থেকে তার গ্রন্থ ও কবিতার সংখ্যা সুপ্রচুর সন্দেহ নেই।
আধুনিক অন্যান্য কবিদের মতো বিষ্ণু দে-রও প্রধান সমস্যা রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করার সমস্যা। তিনি বুঝেছিলেন বাংলা কাব্যের মুক্তি রবীন্দ্র অনুসরণে নেই। তাই অস্তিবাদ ও আনন্দ সন্ধানী কবি হলেও বিষ্ণু দে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থেই রাবীন্দ্রিক কাব্যাদর্শে ছেদ টেনেছেন-হেথা নাই সুশােভন রূপদক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বস্তুত বিষ্ণু দে রবীন্দ্র-বিরােধী ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের অক্ষম অনুসরণ ও পুনরাবৃত্তির সংক্রমণ থেকে তিনি বাংলা কবিতাকে মুক্তি দিতেই ভিন্ন পথের সন্ধান করেছেন। সাহিত্যের ভবিষ্যৎ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন—তার (রবীন্দ্রনাথের) নক্ষত্রবিহারী প্রতিভা বাংলার রসালাে মাটিতে মানুষ আমাদের প্রাত্যহিক ব্যস্তবতায় বিরাজমান থেকেও বহু উর্ধ্বে স্বয়ং সম্পূর্ণ। তাই রবীন্দ্রনাথের নক্ষত্রবিহারী প্রতিভাকে শ্রদ্ধা জানিয়েই আধুনিক যুগের উপযােগী এলিয়ট-পন্থা অনুসরণে সার্থকতা খুঁজেছেন। কিন্তু এলিয়টের ‘ওয়েষ্ট ল্যাণ্ড’-এর ধারণার মধ্যেও পরিবর্তনের অন্ধুর ছিল। পরে এলিয়টও ঐতিহ্যানুসরণের ধারাতেই জীবন সম্পর্কে গভীর প্রত্যয়ে উপনীত হয়েছেন। কিন্তু বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাস স্থাপনের ফলে বিষ্ণু দে-র জীবন সম্পর্কিত দর্শন [[এলিয়টের}] দর্শনের থেকে পৃথক হয়ে যায়। যদিও একথা স্বীকার্য এলিয়টের তিনটি কাব্য লক্ষণকেই বিষ্ণু দে প্রথম জীবনে অনুসরণ করেছেন সেগুলি হলঐতিহ্যানুসরণ, বিশ্ববীক্ষা ও নিরাসক্তি। এই আদর্শ অনুসরণের কঠিন পরীক্ষায় প্রথম দিকে যথাযথ উত্তীর্ণ হতে না পারলেও পরে বিষ্ণু দে তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর বীভৎসতা বিষ্ণু দে-কে পীড়িত করেছে। মানুষেরই জান্তব প্রবৃত্তি যেভাবে মানবতাকে নিগ্রহ করেছে তা কবিকে অস্থির করে তুলেছিল। যুগােচিত সংশয়, ক্লান্তি, হতাশা ও জিজ্ঞাসায় গ্রস্ত কবি রবীন্দ্রনাথের আনন্দময় দর্শনকে স্বীকার করতে পারেন নি। তাই তিনি প্রথম দিকের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা-পঙক্তিকে ব্যবহার করেছেন রাবীন্দ্রিক ভাবাবেশ ছিন্ন করার ব্যঙ্গ-কুঠার হিসাবেই। 'উর্বশী ও আর্টেমিস’ থেকে 'চোরাবালি' পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধরসকে ভাঙার প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথেরই উজ্জ্বল পঙক্তি-ব্যবহারের দৃষ্টান্ত দেখা যাবে।
প্রথম পর্বের এই কবিতাগুলিতে যুগ-যন্ত্রণা ক্লিষ্ট কবি চিরন্তন আদর্শ ও মূল্যবােধ সম্পর্কে সংশয়ী। সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক প্রীতি, প্রেম-ভালবাসা বা ঈশ্বর-বিশ্বাস—ইত্যাদির প্রতি তাঁর আস্থা তখন বিনষ্ট। তাই এলিয়টের মতাে তার কবিতাতেও উঠে আসে 'চোারাবালি, 'ফণীমনসা' ইত্যাদি প্রতীক। যেমন—
”'চোরাবালি ডাকি দূর-দিগন্তে কোথায় পুরুষকার।'
'চোরাবালি' কাব্যগ্রন্থের ‘ঘােড়সওয়ার’ কবিতাটি বিষ্ণু দে-র কবিমানসের এক প্রতিনিধি স্থানীয় কবিতা। চোরাবালির চিত্রকল্পে কবির ব্যক্তিগত শূন্যতাবােধ ও যুগগত অসহায়তা ব্যঞ্জিত। কিন্তু যুগগত যন্ত্রণা বিষ্ণু দে-কে কর্মহীন উদ্যোগহীন নৈরাশ্যের দিকে ঠেলে দেয় না। অস্তিবাদী কবি এই নৈরাজ্যময় বন্ধ্যাভূমি থেকে কামনার আবেগতপ্ত ভূমিতে উত্তরণের তীব্র আর্তি ব্যক্ত করেন, প্রবল এক ঘােড়সওয়ারকে আহ্বান করে—
”'চোরাবালি ডাকি দূর দিগন্তে
কোথায় পুরুষকার ?
হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মাের!
আয়ােজন কাপে কামনার ঘোর
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার?'
ঘােড়সওয়ার' কবিতাটির অর্থ বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে করেছেন। এদিক থেকে বিষ্ণু দের এই উল্লেখযােগ্য কবিতাটি বহু পঠিত ও বহু আলােচিত। এটি নিঃসন্দেহে রূপক কবিতা। বন্ধ্যা বা বন্দিনী কন্যা এবং অশ্বারােহী কন্যা এবং অশ্বারােহী এক রূপকথার নায়ককে নিয়ে গড়ে ওঠা এই কবিতার বিচিত্র ব্যাখ্যা হয়েছে। এটি নারী-পুরুষের মিলন-কামনার প্রেম কবিতা হিসাবে যেমন আলােচিত, তেমনি ভক্তভগবানের সম্পর্কের কবিতা হিসাবেও গৃহীত। কিন্তু জনজাগরণের যােজনার ফলে কবিতাটিকে প্রেম কবিতা বা অধ্যাত্মকবিতা হিসাবে গ্রহণ করা কষ্টসাধ্য হয়। ঘােড়সওয়ার যেন তখন প্রতিভাত হয় জন-সমুদ্রের মাঝখানে জেগে ওঠা নেতৃত্বের প্রতীক হিসাবে। প্রতিকূল পরিবেশ থেকে, যুগগত বন্ধ্যাত্বকে মােচন করবেন সেই জননায়ক, যা জনজাগরণ ছাড়া অসম্ভব। এখানেই মার্কসবাদে দীক্ষিত কবির চেতনাটি ফ্রয়েড-ইয়ুং-এলিয়টের প্রভাব ছাড়িয়ে যেন স্বকীয় ঔজ্জ্বল্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিষ্ণু দে কবি; আরাে মনে রাখতে হবে এই কবি মার্কসবাদী। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ তখন নানা আন্দোলনের পটভূমিতে লােকসাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছিল। বিষ্ণু দে স্পেনীয় কবি লােরকার মতাে সমকালীন তীব্র সংঘাতপূর্ণ ঘটনাগুলিকে লােককথা-বূপকথা প্রভৃতির চিত্রকল্পে প্রকাশ করেছেন। যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষকে উদ্ধারের জন্য মার্কসীয় তত্ত্বেই তিনি সম্ভাবনার বীজ অঙ্কুরিত হতে দেখেছেন। ঘােড়সওয়ার’ কবিতার জনসমুদ্রে জেগেছে জোয়ার' জাতীয় ছবি আঁকা ছাড়াও কবি অন্যত্র লিখেছেন শ্রমজীবী মানুষের কর্মগীতি—
”'আমরা ভেনেছি ধান, আমরা ভেঙেছি গম
জোয়ার বজরা আর শষ্য অড়হর
আমরা তুলেছি পাট আমরা বুনেছি শাড়ি গড়েছি পাথর।'
রােমান্টিকতাকে আঘাত করে তিনি চিনিয়ে দেন শ্রমজীবী মানুষের ভিন্নতর জীবনচর্যার বাস্তবতা—
”'বধু নেই, সে গিয়েছে আউযের বিলে, বর নেই, বর কোথা জগদ্দলে মূনিয মিছিলে।'
ঐহিত্যচেতনা বিশেষ দেশকালে বদ্ধ নয় বলেই বিশ্ব-পুরাণ অনায়াস ভঙ্গিতে উঠে আসে তার কবিতায় এবং তারই ফলে সাধারণ পাঠকের কাছে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে দুর্বোধ্য। ট্রয়লাস, ক্রেসিডা, ওফেলিয়া, হেলেন, অথবা কাসান্দ্রা, এলসিনাের ইত্যাদির পাশেই উঠে আসে উর্বশী, নচিকেতা, চাদ বণিক, কৌরব, শর্মিষ্ঠা যযাতি ইত্যাদি ভারতীয় প্রসঙ্গও।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষ্ণু দে অস্তিবাদী, তাই এই বন্ধ্যা-মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়েও তিনি বৃষ্টির প্রার্থনায় পরামর্শ দিয়েছেন আকাশে তাকাও। এসেছে বৃষ্টি, কপিল গঙ্গা ইত্যাদি চিত্রকল্প যা নতুন সরসতার, নবজীবনেরই দ্যোতনা নিয়ে আসে। আর তখনই তিনি দেখেন রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাবয়ব। সেখানে তিনি পেয়ে যান-
”'একাধারে বাঁশি ও তূর্যের, কুসুমে ও বর্জে তীব্র যার সদা ছন্দায়িত প্রাণ।'
বিষ্ণু দে নাগরিক কবি, প্রেমের তীব্র আবেগ অনুভূতিও তাঁর ছন্দোবন্ধ ও শব্দবন্ধে অসাধারণ কাব্যরূপ নিয়েছে। তিনি যুগযন্ত্রণাকে অস্বীকার না করেও অস্তিবাদী এবং সেই অস্তিবাদের উৎস মার্কসবাদী চেতনা। তাই তিনি শেষাবধি সমবেত মানুষের সংগ্রামী ভূমিকার মধ্য দিয়ে যুগাস্তরের স্বপ্ন দেখেন। তবু তার প্রথম ও প্রধান ত্রুটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দুর্বোধ্যতা। তাই গণসংগ্রামের প্রতি তার আস্থা কবিতায় উচ্চারিত হলেও গণসংগ্রামের সহায়ক শক্তি হিসাবে তাঁর কবিতা মানুষের কাছে পৌছয় না।
রচিত বই :
ছড়ানো এই জীবন (আত্মজীবনী)
উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩২)
চোরাবালি (১৯৩৮)
পূর্বলেখ (১৯৪০)
রুচি ও প্রগতি (১৯৪৬)
সাত ভাই চম্পা
সাহিত্যের ভবিষ্যৎ (১৯৫২)
সন্দীপের চর (১৯৪৭)
অন্বিষ্ট (১৯৫০)
নাম রেখেছি কোমল গান্ধার (১৯৫০)
তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮)
রবীন্দ্রনাথ ও শিল্প সাহিত্য আধুনিকতার সমস্যা (১৯৬৬)
মাইকেল রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জিজ্ঞাসা (১৯৬৭)
ইন দ্য সান অ্যান্ড দ্য রেন (১৯৭২)
উত্তরে থাকে মৌন (১৯৭৭)
সংবাদ মূলত কাব্য
সেই অন্ধকার চাই
সেকাল থেকে একাল (১৯৮০)
আমার হৃদয়ে বাঁচো (১৯৮১)
স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ (জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ১৯৭১)
১৯৬৩-তে প্রকাশিত স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ কাব্যগ্রন্থে বতর্মান ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে কবি বিগত অতীত আর অনাগত ভবিষ্যৎকে যেন একসূত্রে গ্রথিত করেছেন। এ-কাব্যগ্রন্থে একশর বেশি কবিতায় কালের মাপকাঠিতে বিষ্ণু দে স্বদেশ ও বিশ্বের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকতার পরস্পরবিরোধী অথচ পারস্পরিক সমন্বিত ঘটনাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র অন্বেষায় রত হয়েছেন। কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতা। আধুনিককালের সমুজ্জ্বল স্বদেশপ্রেম কবিতায় পরিণত হয়েছে। সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রকট করে তিনি লিখলেন –
বিবাহের সকলই প্রস্তুত,
এমনকী বরযাত্রী এসে গেছে, শুধু বর নেই।
(স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ, পৃ ২২৭, তদেব)
তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮) কাব্যগ্রন্থের নামকরণেই বিষ্ণু দে-র অন্তস্থিত প্রশ্নটির সুর এবং নেতিবাচক উত্তরটি ধরা পড়ে। অর্থাৎ কবি যেন বলতে চান, রবীন্দ্রনাথ কেবল পঁচিশের অষ্টপ্রহরে সীমায়িত হতে পারেন না। তাঁকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হলে আনুষ্ঠানিকতা থেকে সরে আসতে হবে, করতে হবে প্রকৃত আত্তীকরণ। তবেই সমাজের বৃত্তে প্রবাহিত হবে দখিনা বাতাস। তাই তিনি এই ধনতান্ত্রিক পৃথিবীর অসুস্থ বলয়ে রবীন্দ্রনাথের সত্যসুন্দরের রেজারেকশন চেয়ে লিখলেন –
তোমার আকাশ দাও, কবি দাও
দীর্ঘ আশি বছরের
আমাদের ক্ষীয়মাণ মানসে ছড়াও
সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো।
(তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ, পৃ ১৬৪)
অর্থাৎ বিশ্ব-পরিভ্রমণ সেরে কবি তাঁর আপন ভূখণ্ডের ওপরেই খুঁজে পেতে চেয়েছেন শান্তির নীড়। ‘এ দেশ’ কবিতায় তিনি আপন অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশকে ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি উপাচার দিয়ে তাই পুজো করেছেন –
এদেশ আমার চেনা দেশ
আমারই আপন সত্তা, অফুরন্ত-এর গাছে ঘাসে
আমার চোখের মুক্তি, প্রত্যহ টিলায় আনাগোনা।
সুতরাং এ-কথাট সুস্পষ্ট যে, বিষ্ণু দে-র প্রেক্ষণভূমি অবস্থিত হয়েছে দেশীয় মৃত্তিকার ওপর, কিন্তু তার প্রেক্ষণবিন্দু ছিল ওই অতলান্তিকের ওপর। তবুও খণ্ডবিশ্বের মাঝেই তিনি সন্ধান করেছেন শাশ্বত বোধিবৃক্ষ। তাই এলিয়ট, এলুয়ারের আবেগকে ছেড়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর শরণ রবীন্দ্রবিশ্বের উদ্দেশে। তাই বিশ্ব-পরিভ্রমণে ক্লান্ত, অভিজ্ঞ পথিকের হৃদস্পন্দনে বাজে আজো তাঁর ঘরে ফেরার গান –
হয়তো বা নিরুপায়
হয়তো বা বিচ্ছিন্নে যন্ত্রণাই বতর্মানের ইতিহাস
বালিচড়া মরা নদী জলহীন পায়ে পা
অথচ বৈশাখী হাওয়া বাংলার সমুদ্রের
আমার মুকুলে ফল
রাশি রাশি বেলমল্লিকায়
বাগানে বিরল আজ কালেরই বাগান।
(অন্বিষ্ট, পৃ ২৯৫, কবিতা সমগ্র-এক, বিষ্ণু দে)
মৃত্যু - ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে।
=====!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!======
No comments:
Post a Comment