(জন্ম: ২৮ জুলাই, ১৯১১ - মৃত্যু: ২০ জুলাই, ১৯৭৪)
বাংলা গানের ইতিহাস বেশ পুরনো। শুরু সেই চর্যাপদ থেকে। এদিক থেকে চর্যাপদাবলী বাংলা সাহিত্যের নয় শুধু, বাংলা গানেরও আদি উৎস। সেদিনের গানের ধারা যেমনই হোক না কেন, পদাবলীকারগণ যে-গান রচনা করেছিলেন তার বৈশিষ্ট্য ও গঠন পদ্ধতির আলোচনা আছে লোচন প–তের রাগতরঙ্গিণী ও শার্ঙ্গদেবের সঙ্গীতরত্নাকর (১২১০-৪৭) গ্রন্থে।১ এ-পদগুলোতে উনিশটি রাগিণীর উলেস্নখ আছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দে বারোটি রাগিণীর মধ্যে চর্যাপদের চারটি২ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আটটি রাগিণীর উলেস্নখ আছে।৩ এছাড়া, বঙ্গদেশের লোকেরা যে-গান গাইতেন, তার সুর ও তাল এবং বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। এমনকি, এ-দেশে আসার পর আর্যরা কী ধরনের গান ও বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন, তার কোনো খবর পাওয়া যায় না। তবে আর্যদের ধর্ম স্থানীয় ধর্ম ও আচার-আচরণের সঙ্গে মিলেমিশে যেমন একটা নতুন রূপ নিয়েছিল, গানের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এক্ষেত্রে যেসব রাগরাগিণীর উদ্ভব হয়েছিল, তা জানা না গেলেও, ‘বঙ্গাল’ ও ‘ভাটিয়ালি’র মতো রাগিণীর নাম জানা যায়, যা চর্যাপদাবলীতে উলেস্নখ আছে। এছাড়া, রাগরাগিণীর বেশিরভাগই ছিল দেশজাত ও জাতিজাত, এবং এই রাগরাগিণীগুলো যে অনার্য জনগোষ্ঠী থেকে আর্য সংগীতের মধ্যে প্রবেশ করেছিল তার প্রমাণ আছে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম থেকে সপ্তম শতকের দিকে সংগীতশাস্ত্রী মতঙ্গ-রচিত বৃহদ্দেশী গ্রন্থে। মতঙ্গ বলেন : চতুঃস্বরাৎ প্রভৃতি না মার্গঃ, শবর-পুলিন্দ-কাম্বোজ-বঙ্গ-কিরাত-বাহ্ণীক-অন্ধ্র-দ্রাবিড়-বর্ণাদিষু প্রযুজ্যতে। অর্থাৎ চার স্বরযুক্ত সংগীত মার্গ শ্রেণির মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। এগুলোর অনুশীলন ছিল শবর, পুলিন্দ, কম্বোজ, বঙ্গ, কিরাত, বাহ্ণীক, অন্ধ্র, দ্রাবিড় প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে।৪ এ-সকল জনগোষ্ঠীর নামে সুরের নাম ছিল শবরী (সাবরী, স্রাবেরী), আন্ধ্রী, পুলিন্দিকা, আভীরী (আহিরী) ইত্যাদি, এবং অন্যান্য দেশজাত ও জাতিজাত রাগ যেমন, গান্ধার (কন্দাহার থেকে জাত), কলিঙ্গদেশ থেকে জাত কলিঙ্গড়া (কালেঙড়া), গুর্জর থেকে গুর্জরী, বাংলাদেশ থেকে বঙ্গালরাগ, গৌড় থেকে গৌড়ী, মহারাষ্ট্র থেকে মহারাষ্ট্রী, দক্ষিণদেশ থেকে দাক্ষিণাত্য, দ্রাবিড় জাতি থেকে দ্রাবিড়ী, সিন্ধুদেশ থেকে সৈন্ধবী, মালবদেশ থেকে মালব বা মালবী রাগ আর্য সংগীতধারাকে শুধু নয়, সর্বভারতীয় সংগীতধারাকে পুষ্ট করেছে।৫ এরপর ভাটিয়ালি, কীর্তন, পাঁচালি গান, খেউড়, আখড়াই, হাফ-আখড়াই, শাক্তপদাবলী, বাউল, তর্জা, টপ্পা, ঠুংরি, ধ্রম্নপদ, কবি প্রভৃতি গানের ধরনের মধ্যে প্রেম, সাধনা, যুক্তি-তর্ক, শস্নীল-অশস্নীলতা অনুষঙ্গ করে বাংলা গানের হয়েছে বিবর্তন। এই বিবর্তনে শরিক হয়েছেন অনেক গুণিজনের মধ্যে কলকাতায় আগত অনেক ওসত্মাদ। তাঁরা হিন্দুসত্মানি গান, শাস্ত্রীয় সংগীত ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কলকাতায় আসেন। সে-সময় যাঁরা বিভিন্ন ধরনের গান গাইতেন, তাঁরা উত্তর ভারত থেকে আগত ওসত্মাদদের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে বিশেষ তালিমপ্রাপ্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে দাশরথি, শ্রীধর কথক, গোপাল উড়ে ও মধু কাণ প্রধান। এছাড়া, কলকাতায় থাকার সুবাদে যাঁরা গান শিখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৭৯৪-১৮৪৬) ছিলেন অন্যতম। এঁদের মধ্যে রামমোহন গান লিখতেন। এ-সময় শাস্ত্রীয় সংগীতকে নতুন করে প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে পাথুরিয়াঘাটার শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪) বাড়ির ওসত্মাদ ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীকে দিয়ে প্রথম স্বরলিপি করান ও তা প্রচার করেন। প্রায় একই সময়ে স্বতন্ত্রভাবে আকারমাত্রিক স্বরলিপির উদ্ভাবন করেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬)। এ-পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫) যে-পদ্ধতি সৃষ্টি করেন, তা আজকের দিনেও স্বরলিপির আদর্শ।
রবীন্দ্রনাথের দুবছর পরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), চার বছর পরে রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০), দশ বছর পরে অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪), আটত্রিশ বছর পরে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) আর সতেরো বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২)। তাঁরা সবাই ছিলেন গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। রবীন্দ্রনাথের গানের শিক্ষক ছিলেন যদু ভট্ট, বিষ্ণু চক্রবর্তী, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, শ্যামসুন্দর মিশ্র। এঁরা প্রধানত ধ্রম্নপদ গাইতেন। ধ্রম্নপদ গানে চারটি স্তবক, যাকে বলা হয় ‘তুক’ অর্থাৎ স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ।৬ রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানের ভুবনে চার তুকের গান রচনায় যে-স্থায়ী আসন গড়েছিলেন, কাজী নজরুল ইসলাম৭ সেই ধারার ছিলেন সফল গীতিকার। শুধু গীতিকারই নন, আধুনিক বাংলা গানের জনকও।৮ তিনিই সে যুগের সেরা কম্পোজার কমল দাশগুপ্তকে (১৯১২-৭৪)৯ নিয়ে আসেন গ্রামোফোন কোম্পানিতে (১৯৩২ সাল); এবং তাঁর হাতেই সৃষ্টি হয় বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। তাঁর অসাধারণ সুর আর গায়কীর গীতিসুধায় সেদিন যে-আবহ সৃষ্টি হয়েছিল তার মূলেই ছিলেন কমল দাশগুপ্ত এবং পরোক্ষভাবে প্রণব রায়, যুথিকা রায় ও জগন্ময় মিত্র। এ-কথা একটু জোর দিয়েই বলা যায়, ‘নজরুল-পরবর্তী দশকে কমল দাশগুপ্তের সুর আর প্রণব রায়ের কথাই ছিল বাংলা গানের প্রধান ধারা।’
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী, প্রসিদ্ধ সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকে গ্রামোফোন ডিস্কে তার সুরে গাওয়া বহু গান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। গানগুলোর গীতিকার ছিলেন প্রণব রায় এবং কণ্ঠশিল্পী ছিলেন যুথিকা রায়। সাঁঝের তারকা আমি, আমি ভোরের যুথিকা প্রভৃতি গান আজও সমাদৃত। তার কয়েকটি রাগাশ্রিত, কীর্তনাঙ্গ
এবং ছন্দ-প্রধান গানও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
শৈশবকালে বড় ভাই অধ্যাপক বিমল দাশগুপ্তের কাছে খেয়াল গান দিয়ে সঙ্গীত জীবন শুরু করেন। ডি. এল. রায়ের পুত্র দিলীপ রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে (কানা কেষ্ট) এবং ওস্তাদ জমিরউদ্দিন খাঁর কাছে খেয়াল, ঠুমরী, দাদরা ও গজলের তালিম গ্রহণ করেন তিনি. তার বাবার নাম তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত। বড় ভাইয়ের নাম সুবল দাশগুপ্ত। ক্রীড়াজগতের স্বনামধন্য পঙ্কজ গুপ্ত সম্পর্কে তার মাতুল হন।
১৯৫৫ সালে বাংলাদেশের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম নজরুল সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ফিরোজা বেগমকে বিয়ে করেন কমল দাশগুপ্ত। তখন তার বয়স ছিল ৪৩ বছর। বিয়ের চার বছর পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তার নাম রাখা হয় কাজী কামাল উদ্দীন। তাদের সংসারে তিন সন্তান - তাহসিন, হামিন ও শাফিন রয়েছে।
১৯৪৬ সালেও কমল দাশগুপ্ত তখনকার সময়ে সাঁইত্রিশ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছেন সরকারকে। সবসময় গাড়ি ব্যবহার করতেন। কিন্তু শেষ জীবনে এসে তিনি দেউলিয়া এবং নিঃস হয়ে পড়েন। ঢাকায় তিনি একটি মুদির দোকান দেন। ২০ জুলাই, ১৯৭৪ সালে প্রায় অযত্নে-অবহেলায় ও বিনা চিকিৎসায় ঢাকায় এই গুণী শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহু জনপ্রিয় গানে তিনি সুরারোপ করেছেন। ১৯৩৪ সাল থেকে স্বাধীনভাবে কাজী নজরুল ইসলামের গানের সুরারোপ করতে থাকেন। প্রায় তিনশো নজরুলগীতির সুর রচয়িতা ছিলেন কমল দাশগুপ্ত।
২৩ বছর বয়সে হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গীত-পরিচালক ও সুরকার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। কলাম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানিতেও কর্ম সম্পাদন করেন। তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি যিনি উর্দু ভাষায় কাওয়ালি গান পরিবেশন করেন। এইচএমভিতে এক মাসে তিপ্পান্নটি গান রেকর্ড করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। হায়দ্রাবাদের নিজামের গোল্ডেন জুবিলির বিশেষ গান রেকর্ড করেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি'র মার্চিং সং তার সুরে রেকর্ড করা হয়। রেকর্ডসংখ্যক গানে সুর করার জন্য ১৯৫৮ সালে এইচএমভিতে তার সিলভার জুবিলি অনুষ্ঠিত হয়। তার সুরারোপিত গানের ডিস্কের সংখ্যা প্রায় আট হাজার।
রেডিও অডিশন বোর্ডের প্রধান ছিলেন তিনি। স্বরলিপির শর্টহ্যান্ড পদ্ধতির উদ্ভাবক হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন। আ-কার মাত্রিক পদ্ধতি ও স্টাফ নোটেশন পদ্ধতি স্বরলিপি স্থাপনে সিদ্ধহস্তের অধিকারী ছিলেন কমল দাশগুপ্ত।
প্রায় ১০ বছর তিনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) অবস্থান করেন। ১৯৭২ সালে কলকাতায় বঙ্গ-সংস্কৃতি-সম্মেলন-মঞ্চে কমল দাশগুপ্তের ছাত্রী ও সহধর্মিণী হিসেবে ফিরোজা বেগম ছিলেন মুখ্যশিল্পী। তাদের উভয়ের দ্বৈতসঙ্গীত সকল শ্রোতা-দর্শককে ব্যাপকভাবে বিমোহিত করেছিল।
বাংলা চলচ্চিত্রের সুরকার হিসেবেও প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন কমল দাশগুপ্ত। তুফান মেল, শ্যামলের প্রেম, এই কি গো শেষ দান—চলচ্চিত্রসমূহের গানগুলো এককালে বিপুল সাড়া তুলেছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ছবিতে তার সুরসৃষ্টি স্মরণীয়। সঙ্গীত-পরিচালক হিসেবে তার শেষ ছবি ছিল বধূবরণ। প্রায় আশিটি ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি।
হিন্দি আধুনিক সঙ্গীত - 'গীত' প্রচারে তার অবদান অপরিসীম। ভজন গানে বিশেষ দক্ষ ছিলেন। বাংলা-হিন্দি-উর্দু-গজল, ভজন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, নাত, হামদ, নজরুলগীতিসহ সঙ্গীতের সকল শাখায় সমান দক্ষতার অধিকারী ছিলেন কমল দাশগুপ্ত।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে মি. এলিস জনসন নামীয় একজন আমেরিকান চিত্র-পরিচালক কর্তৃক তাঁর ওয়ার প্রপাগান্ডা ছবির জন্য কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকে আবহ সঙ্গীত গ্রহণ সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
রেডিও বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের প্রধান সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি।
শৈলেন রায়, বাণীকুমার, সুবোধ পুরকায়স্থ, মোহিনী চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত, অনিল ভট্টাচার্য-রচিত গানে সুর সৃষ্টির মাধ্যমে কমল দাশগুপ্ত শুধু জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি২৬, সৃষ্টি করেন বাংলা গানের একটি নতুন ধারা। এঁদের গান ছাড়া তিনি সুর দিয়েছেন পদাবলী কীর্তনে; মীরা, কবির ও সুরদাসের ভজনে; হিন্দি-উর্দু গীতিকবি প–ত মাধুর, ভূষণ, কামাল আমরোহি, মহম্মদ বক্স, ফৈয়াজ হাশমি, রাজেশ্বর গুরু, মুনির আলম, হসরত জয়পুরির গীত, গজল ও ভজনে। মীরার ভজনে সুরারোপ করার জন্যে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সম্মানসূচক Doctorate of Music উপাধি প্রদান করে।২৭ এছাড়া, তিনি সুর দিয়েছিলেন হায়দরাবাদের নিজামের গোল্ডেন জুবলির বিশেষ সংগীতে ও ভারতীয় রণসংগীত ‘কদম কদম বারহায়ে যা’ গানে। আমেরিকার ফিল্ম ডিরেক্টর এলিস জনসনের War Propaganda ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব।
তিনি সর্বমোট সাত হাজার গানে শুধু সুর নয়, তা শিখিয়ে শিল্পীর কণ্ঠে রেকর্ডও করিয়েছিলেন।২৯ বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান-প্রণেতা তাঁর সুরারোপিত গানের সংখ্যা আট হাজার বলে উলেস্নখ করেন।৩০ তিনি একসময় বাংলা ও হিন্দি ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেন। বাংলা একাডেমি চরিতাভিধানে এ-সংখ্যা ৮০টি৩১ বলা হলেও আসাদুল হক ২৪টির বেশি বলতে পারেননি।৩২ আর আবুল আহসান চৌধুরী বাংলা (১৮টি) ও হিন্দি (পাঁচটি) মিলিয়ে মোট ২৩টির উলেস্নখ করেছেন।৩৩ তিনি বাংলা ছবির সংগীত-পরিচালক হিসেবে চারবার ও হিন্দি ছবির জন্যে একবার, মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন।
৩৪ সেই শিল্পীসত্তার একজন কমল দাশগুপ্ত বিরল সুরস্রষ্টা হিসেবে মানুষের হৃদয়ভূমিকে নাড়িয়ে দিয়ে যাননি শুধু, বাংলা গানের জগতে রীতিমতো স্থায়ী আসন পেতে আছেন। তাঁর সুরারোপিত এরকম কিছু গান : ‘আমি ভোরের যূথিকা’ (যূথিকা রায়), ‘সাঁঝের তারকা আমি’ (ওই), ‘শতেক বরষ পরে’ (ওই), ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন’ (ওই), ‘মেনেছি গো হার মেনেছি’ (জগন্ময় মিত্র), ‘আমি ভুলে গেছি তব পরিচয়’ (ওই), ‘তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন’ (ওই), ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে’ (ওই), ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’ (ওই), ‘আমার দেশে ফুরিয়ে গেছে ফাগুন’ (ওই), ‘পৃথিবী আমারে চায়’ (সত্য চৌধুরী), ‘যেথা গান থেমে যায়’ (ওই), ‘কথার কুসুমে গাঁথা’ (বেচু দত্ত), ‘মোর হাতে ছিল বাঁশি’ (গৌরীকেদার ভট্টাচার্য), ‘তোমার জীবন হতে’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়), ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের দেশে’ (তালাত মাহমুদ) ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর সুরারোপিত শ্রেষ্ঠ বাংলা গান : ‘এই কি গো শেষ দান’, ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে’, ‘চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়’, ‘দু’টি পাখি দু’টি নীড়ে’, ‘গভীর নিশিথে ঘুম ভেঙ্গে যায়’, ‘আমার যাবার সময় হলো’, ‘তুমি হাতখানি যবে রাখো মোর হাতের ‘পরে’, ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে’, ‘আমি বনফুল গো’ ইত্যাদি। তাঁর স্বকণ্ঠে গাওয়া ‘আজো কাঁদে কাননে’, ‘জগতের নাথ কর পার’ অসাধারণ গান।৩৫ ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে মান্না দে কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রণব রায় ও সুবোধ পুরকায়স্থের কথায় যথাক্রমে কণ্ঠ দিয়েছিলেন ‘কতদিন দেখিনি তোমায়’ ও ‘হার মেনেছি গো হার মেনেছি’ গান দুটিতে।৩৬ তিনি সুর সৃষ্টির পাশাপাশি বেশকিছু গানও রচনা করেন। তার মধ্যে ‘মম যৌবন সাথী বুঝি এলো’, ‘বিফলে যামিনী যায়’, ‘কে আজি দিল দোলা’ গান তিনটি সুরারোপ করে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে রেকর্ডও করা হয়।
বলতে গেলে তাঁর (কমল দাশগুপ্ত) সংগীত জীবনের শেষ অধ্যায়ে কবি শ্রীমোহিনী চৌধুরীকে কেন্দ্র করে তাঁর সুর রচনার আর এক পর্যায়ের সূচনা হয়েছিলো মাত্র, যার পূর্ণ বিকাশ আর হয় নি। চতুর্থ দশকের মধ্যভাগ থেকে শ্রীমোহিনী চৌধুরী তাঁর গানে
গণ-বিক্ষোভ এবং গণ-মানসের যে ছাপ এঁকেছেন আর কোনও গীতিকারের গানে তা পরিলক্ষেত হয় নি। তার জন্যই শ্রীমোহিনী চৌধুরী রচিত ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘জেগে আছি একা জেগে আছি কারাগারে’, ‘তখন ভাঙেনি প্রেমের স্বপন খানি’, ‘যাদের জীবন ভরা শুধু আঁখিজল’, ‘ভেঙেছে হাল ছিঁড়েছে পাল’, ‘নাই অবসর – বাজায়ো না বীণাখানি’ – সুর করার সময় কমল দাশগুপ্ত গানের ভাবের দিকে লক্ষ্য রেখেই সুর করেছেন।৩৭
এ-বিষয়ে অভীক চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য,
মোহিনী চৌধুরী ব্যক্তিগত প্রেম ভালোবাসার অনুপ্রেরণায় প্রতিবাদী সত্তাকে খুঁজেছেন। আবার – কোনও গানে মানুষের দুঃসহ অবস্থায় তাদের মনে নিয়ে এসেছেন প্রেমময় স্মৃতি রোমন্থনের অনুভূতি। … কমল দাশগুপ্তের অসামান্য সুররচনায় এবং যথাযথ যন্ত্রানুষঙ্গের প্রয়োগে গানগুলি অন্যমাত্রা পেয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমেই আসে সত্য চৌধুরীর গাওয়া ‘পৃথিবী আমারে চায় …’ গানটির কথা। সুরারোপে ছন্দের ব্যবহারের তো তুলনা নেই। তার সঙ্গে অভিনব যন্ত্রানুষঙ্গ। গানটির প্রতিটি প্রিলুড ও ইন্টারলুড মিউজিক শেষ হচ্ছে ক্ল্যারিওনেটজাত এক সুরের রেশে, যা ঠিক রণক্ষেত্রে বিউগলের মত শোনায়। এ
যেন অন্তর বাহির – দুই ক্ষেত্রেই রণভেরী। এছাড়া, মোহিনী-কমল এই যুগলসৃষ্টির আরও কিছু উজ্জ্বল নমুনা … ইত্যাদি উজ্জ্বল হয়ে আছে বাংলা গানের দুনিয়ায়।
যে কমল দাশগুপ্ত ১৯৪৬ সালে সাঁইত্রিশ হাজার টাকা আয়কর দেন, গাড়ি ছাড়া চলতেন না, সেই কমল যূথিকার প্রত্যাখ্যান৩৯, পারিবারিক সংকট ও নাথ ব্যাংকে লালবাতি জ্বলায় পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে পড়েন। বাড়ির বিশ্বস্ত পরিচারক অবশিষ্ট যেটুকু জমা ছিল তাও নিয়ে একদিন উধাও হয়ে যায়। আর্থিক ও মানসিকভাবে কমল দাশগুপ্ত যখন সর্বহারা ও বিপর্যস্ত, তখন ফরিদপুরের মেয়ে ফিরোজা বেগম অসমবয়সী এ-মানুষটির হাত ধরে শুধু জাগিয়ে তোলেননি, জড়িয়ে নিলেন নিজের জীবনের সঙ্গে। ১৯৫৫ সালে যখন কমল-ফিরোজার বিয়ে হয়, তখন কমলের বয়স ছিল ৪৩ বছর।৪০ বিয়ের চার বছর পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর নাম হয় কাজি কামাল উদ্দিন। কলকাতায় তাঁদের সন্তান তাহসীন, হামিন ও শাফিনের জন্ম হয়। ১৯৬৭ সালে তাঁরা ঢাকায় চলে আসেন।৪১ মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌলা এ-আগমনের সময় উলেস্নখ করেছেন ১৯৬৫ সাল। তিনি তাঁদের আগমন উপলক্ষে যশোর সীমান্তে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।৪২ তৎকালীন পূর্ব পাকিসত্মানে আসার পর তাঁর কোনো জায়গা হলো না যেন। এ-বিষয়ে আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, ‘একদিকে কলকাতা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ঢাকাও তাঁকে গ্রহণ করে নি। সেই সময় সরকারও তাঁর প্রতি প্রসন্ন ছিল না। কোনো প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসে নি তাঁর মেধা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর জন্যে। আমাদের লজ্জা ও দায় এই যে, কমল দাশগুপ্তকে জীবিকার জন্যে শেষজীবনে ঢাকায় একটা মুদিখানার দোকান খুলতে হয়েছিল।’
বৃহত্তর যশোর জেলার কালিয়ার বেন্দা গ্রামের এই মানুষটি, বঙ্গদেশের একজন কৃতী শিল্পী ও সুরকার কমল দাশগুপ্তকে অনাদরে-অবহেলায়, এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই মাত্র ৬২ বছর বয়সে নীরবে চলে যেতে হলো না-ফেরার দেশে।
∆∆\\\\\\\\\\\\\\∆∆∆∆∆\\\\\\\\∆∆∆\\∆∆\
No comments:
Post a Comment