(২৬.১০. ১৮০১ –- ১০-৬-১৮৭৭)
ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার এক অগ্রগণ্য সমাজপতি। তিনি ঠাকুর পরিবারের
জোড়াসাঁকো শাখার নীলমণি ঠাকুর এর পুত্র, দ্বারকানাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা এবং প্রসন্নকুমার ঠাকুরের জ্ঞাতিভ্রাতা।পরবর্তীকালে তিনি কলকাতার বটতলা অঞ্চলে পারিবারিক সম্পত্তির অধিকারী হন।
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের সঙ্গে তিনি ইন্ডিয়ান রিফর্মার পত্রিকা চালু করেন। এছাড়া হরকরা ও ইংলিশম্যান পত্রিকায় তিনি "হিন্দু" ছদ্মনামে লিখতেন.
মিঃ শেরবোর্নের গ্রামার স্কুলে তাঁর ইংরেজি শিক্ষার সূত্রপাত হয়; এই বিদ্যালয়ে তিনি কয়েক বছর অধ্যয়ন করেন। তাছাড়া, বাংলা, সংস্কৃত এবং ফার্সীও তিনি বাড়িতে শেখেন। তিনি বাণিজ্যিক ও ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত কাজ শেখেন মেসার্স আলেকজাণ্ডার অ্যাণ্ড কোম্পানির ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে।
১৮২৯ সালে রমানাথ ঠাকুর ইউনিয়ন ব্যাংকের দেওয়ান হয়েছিলেন। ব্যাংক উঠে যাওয়া পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন। যৌবনে রমানাথ ছিলেন রামমোহন রায়ের ভাবাদর্শের অনুগামী এবং ব্রাহ্মসমাজের প্রথম অছিদের অন্যতম। যে সকল ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। জীবনের শেষ দশ বছর তিনি উক্ত সংঘের সভাপতিত্বও করেছিলেন।
নরমপন্থী দল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন ও ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন এই যুগে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। বিপিনচন্দ্র পালের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে কলকাতার ছাত্রসমাজ এই জাতীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ গ্রহণ করত। এই সব দলের নেতৃস্থানে ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস পাল, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রমানাথ ঠাকুর, দিগম্বর মিত্র, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও লালমোহন ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ.
রমানাথ ঠাকুর ছিলেন হিন্দুমেলার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। রমানাথ ঠাকুর ছিলেন পাশ্চাত্য শিল্পকলার একজন সমঝদার এবং চিত্রকলার সংগ্রাহক। সেযুগে পাশ্চাত্য শিল্প কলকাতার সমাজে বিশেষ কেউ বুঝত না; চিত্র সংগ্রহও ছিল এক বিরল শখ।
১৮৬৬ সালে রমানাথ বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। আইন পরিষদে তিনি রায়তদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। তাই তাকে “রায়তবন্ধু” আখ্যা দেওয়া হয়। পৌর বিষয়গুলিতে তিনি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছিলেন। মূলত তারই উদ্যোগে কলকাতার নিমতলা শ্মশানঘাটটি তার আদি ঠিকানাতেই রেখে দেওয়ার একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৮৭৩ সালে তিনি ভাইসরয়ের কাউন্সিলে নির্বাচিত হন এবং “রাজা” উপাধি পান। ১৮৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় তার অবদানের জন্য লর্ড নর্থব্রুক তাকে “কম্প্যানিয়ন অফ দ্য স্টার অফ ইন্ডিয়া” উপাধি প্রদান করেন। ১৮৭৭ সালের দরবার ঘোষণাপত্রে বড়োলাট লর্ড লিটন তাকে “মহারাজা” উপাধি প্রদান করেন.
১৮৭৫-এ মহামান্য মহারাণী তাঁকে দি মোস্ট এগজলটেড অর্ডার অব দি স্টার অব ইণ্ডিয়া খেতাবে ভূষিত করেন। মাননীয় প্রিন্স অব ওয়েলসকে বেলগাছিয়া ভিলাতে অভ্যর্থনা জানাতে যে জাতীয় অভ্যর্থনা সমিতি গঠিত হয়, তাঁকে তার সভাপতি নির্বাচিত করা হয়; সমিতির সুশৃঙ্খল ও মর্যাদাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি জানিয়ে প্রিন্স অব ওয়েলস তাঁকে একটি অঙ্গুরীয় উপহার দেন। মহামান্যা মহারাণী ‘ভারত সম্রাজ্ঞী’ পদবী গ্রহণ উপলক্ষ্যে ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটন ১৮৭৭ এর ১ জানুয়ারী রমানাথকে মহারাজা খেতাবে ভূষিত করেন। উদার শিক্ষানীতির প্রবক্তা রমানাথকে যুক্তিযুক্তভাবেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মনোনীত করা হয়। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তিনি অছি এবং বা কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য ছিলেন। কি দানে আর কি ধর্মমতে, তাঁর মধ্যে কোন সাম্প্রায়িদক বা সংকীর্ণতা ছিল না।
বহুমূত্র রোগে দীর্ঘকালে ভোগবার পর ১৮৭৭-এর ১০ জুন তিনি ঐ রোগেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। এই দুঃখজনক ঘটনা প্রসঙ্গে লর্ড অনারেবল রায় কৃষ্ণদাস পাল বাহাদুর, সি আই ই-কে লেখেন :
প্ৰিয় মহাশয়,
কর্নেল বার্নকে লিখিত আপনার পত্রে আমাদের বন্ধু মহারাজা রমানাথ ঠাকুর বাহাদুরের মৃত্যু সংবাদ পাইয়া মর্মাহত হইলাম। ইহা কেবলমাত্র আমার ব্যক্তিগত দুঃখ নহে, আপনার ও তাঁহার অসংখ্য গুণমুগ্ধেরও শোক তাঁহাদিগের এই শোকে আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাইতেছি। তাঁহার মৃত্যুতে সরকার ও বাংলার জনগণ জ্ঞানী, সৎ ও বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা হারাইল। তাঁহার পরিচিত আর কেহ (বোধ হয়) তাঁহার মৃত্যুতে আমার মতো দুঃখ পায় নাই।
ইতি
ভবদীয় চির বিশ্বস্ত
(স্বা) লিটন।
=========={{{∆∆∆∆∆∆}}}===========
No comments:
Post a Comment