Wednesday, 28 October 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

বাংলার পট : ঐতিহ্য ও বহুমাত্রিকতা

                                   তরুণ কুমার কর্মকার

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Doinik Sabder Methopath

Vol-175. Dt -29.10.2020

১২ কার্তিক,১৪২৭. বৃহস্পতিবার

================================


ভারতবর্ষে চিত্রকলার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। সৃষ্টির একেবারে প্রথম দিকে গুহাবাসী মানুষ দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য ছবি এঁকে যে-কলার সৃষ্টি করেছিল তারই রেশ পরম্পরা বাহিত হয়ে আজকের মানুষের হাতে হয়েছে আরো সমৃদ্ধ ও শিল্পিত। এই পরম্পরার মধ্যে ঘটে গেছে অনেক বদল, পালাবদলের ইতিহাসে অনেক ছাপ রয়ে গেছে তার রেখায়। কিন্তু এই চলমানতার মধ্যেও মূলসুর পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি আর সেখানেই থেকে গেছে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। শিল্পকলার মূলত দুই রূপ, নাগরিক বা রাজন্যবর্গের দ্বারা পরিচালিত শিল্পকলা আর লৌকিক বা জনসাধারণের মধ্যে প্রবহমান শিল্পকলা। অজন্তা, ইলোরা, সাঁচি, অমরাবতী বা বিভিন্ন মঠ চৈত্যগুলোতে সেই সমস্ত অভিজাত বা বণিক শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় চিত্র গড়ে উঠেছে, যেখানে পণ্য পরিবহনের ফাঁকে আশ্রয় নেওয়া যাত্রীদের ক্লান্তি ও ভার লাঘব হতো। কেননা ‘এইসব গুহাগুলি দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত পণ্য ও বাণিজ্য চলাচল প্রসূত অন্তর্দেশীয় শুল্ক আদায়ের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হত। উপরন্তু পণ্যবাহী দলগুলি যাতে এই সব গুহার আশ্রয়ে বিশ্রাম করার এবং সেই সঙ্গে ধর্মশিক্ষা ও সাধনার সুযোগ পায়।’

 অপরদিকে লৌকিক চিত্রগুলিতে থাকত বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনির ঘরোয়া আমেজ, যা গ্রামে গ্রামে পরিবেশিত হয়ে আপামর জনসাধারণকে সাহিত্যরসে উদ্বুদ্ধ করত। ভারতবর্ষে বহু প্রাচীনকাল থেকেই যে এই লৌকিক চিত্রকলার প্রচলন ছিল তার নিদর্শন হলো পটচিত্রগুলো। ওড়িশার বাসুদেবপুর, রঘুরাজপুর, বিহারের জিতবারপুর, ঝাড়খ–র দুমকা বা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় পটের প্রচলন দেখা যায়। এমনকি ভারতের বাইরে মিশর, ইসরায়েল, চিন, জাপান, তিববত, নেপাল প্রভৃতি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় পটের প্রচলন লোকসাহিত্যের সেই নৃতাত্ত্বিক দিকটিকে তুলে ধরে, যেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভব যে একই সংস্কৃতি থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংস্কৃত সাহিত্যের দিকে তাকালে পটের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয়। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, বৌদ্ধ সংযুক্তনিকায়, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাণভট্টের হর্ষচরিত, বিশাখা দত্তের মুদ্রারাক্ষস, ভাসের প্রতিমানাটক থেকে শুরু করে কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলা, মালবিকাগ্নিমিত্র, ভবভূতির উত্তররামচরিত সে-সাক্ষ্যই বহন করে চলেছে। এমনকি বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলোতে বা চৈতন্য আমলেও পটের যে সুখ্যাতি ছিল তা রূপ গোস্বামীর বিদগ্ধমাধব থেকে জানা যায়।
বাংলার পটগুলো নিছক ছবির ভা-ার নয়। অন্যান্য জায়গার পটের সঙ্গে বাংলার পটের মৌলিক পার্থক্য হলো, এই পটগুলো গান গেয়ে পরিবেশিত হতো। তবে আকার, উপকরণ ও ছবির দিক থেকে অন্যান্য পটের সঙ্গে কিছুটা সৌসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। আকৃতিগত দিক থেকে পট মূলত দুই প্রকার। এক. জড়ানো পট বা দীঘল পট, যেখানে আড়াআড়িভাবে কখনো বা লম্বালম্বিভাবে ছবি আঁকা থাকে। দুই. চৌকো পট বা একটি ছবি নিয়ে আঁকা পট। কালীঘাটের পট চৌকো পট হিসেবে পরিচিত, যদিও চৌকো পট আয়তাকার, বর্গাকার বা গোলাকার হয়ে থাকে। জড়ানো পট বা দীঘল পটের সঙ্গে গান যুক্ত থাকে। পটুয়ারা গান গেয়ে পটের কাহিনি বলে যান। এই জড়ানো পট উচ্চাঙ্গের বা উৎকৃষ্ট মানের রসযুক্ত। বিষয়গত দিক থেকে পটকে পৌরাণিক লীলা কাহিনিমূলক, পাঁচ কল্যাণী বা পাঁচ মিশালি কাহিনির সংমিশ্রণ নিয়ে রচিত পট ও গোপালন বিষয়ক – এই তিনভাগে ভাগ করা যায়। পরবর্তীকালে আরো বিষয় সংযোজিত হয়। তবে কালীঘাটের পটের বিষয় বিচিত্র। জেলাভিত্তিক পটের বিষয় আলাদা হয়ে থাকে, যেমন মেদিনীপুর জেলার পটের বিষয় বিভিন্ন। রামায়ণ থেকে সিন্ধুবধ, রামের বনবাস, সীতাহরণ, সেতুবন্ধন, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, রাবণবধ ইত্যাদি মহাভারত থেকে দাতাকর্ণ, হরিশচন্দ্রের কাহিনি, সাবিত্রী সত্যবানের কথা, ভাগবত থেকে কৃষ্ণের জন্মকথা, ননি চুরি, কালীয়দমন, নেŠকাবিহার, বস্ত্রহরণ ইত্যাদি পুরাণ থেকে শিব-পার্বতীর কথা, সতীর দেহত্যাগ, অসুর বধ, শিবের শাঁখা পরানো, মঙ্গলকাব্য থেকে মনসার কথা, বেহুলা লখিন্দরের কথা, কমলেকামিনীর কথা, শ্রীমন্ত সদাগরের কথা, তাছাড়া চৈতন্য কথা, সত্য নারায়ণের কথা, জগন্নাথের কাহিনি ও যমপট ইত্যাদি। 



বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর এলাকায় বিষ্ণুপুরি পট ও বেলিয়াতোড় এলাকায় বেলেতোড়ি পট পাওয়া যায়, যার বিষয় হলো যম পট, জগন্নাথ পট। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় সিঞ্চবোঙা, মারাংবুরু পট, দুর্গাপট, লক্ষ্মীপট, দশাবতার পট দেখানো হতো। মুর্শিদাবাদের পটের বিষয় একই, তবে ঘরানার ছাপ আছে, নকশার কাজেও স্বাতন্ত্র্য লক্ষিত হয়। পুরুলিয়ার আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে চক্ষুদান পট খুবই উলেস্নখযোগ্য। এই পটে দেখা যায় পটুয়ারা মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে এই পট দেখাতেন, পটে ব্যক্তির চোখ আঁকা থাকত না ফলে তাঁরা বলতেন, চোখের অভাবে ব্যক্তিটি মৃত্যুলোকে খুবই কষ্ট পাচ্ছে তাই উপযুক্ত পারিশ্রমিক নিয়ে তাঁরা চক্ষুদান করে ব্যক্তির আত্মার শান্তির ব্যবস্থা করতেন। বীরভূমের পটে যমপট বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পটে বিভিন্ন বিষয়ের শেষে যমপট থাকবেই যার বিষয় হলো মৃত্যু-পরবর্তী কর্মফল ভোগ। এছাড়া অন্যান্য জেলায় রামলীলা বা কৃষ্ণকথা, বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি, শিব মাহাত্ম্য, চৈতন্যলীলা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পটগুলো অঙ্কিত হয়েছে। অপরদিকে চৌকো পটে গান থাকে না আর বিষয়েও বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়, যেমন দুর্গা, কালী, গণেশ, লক্ষ্মী, শিব প্রভৃতি দেব-দেবী থেকে শুরু করে পশুপাখি, সবুজ রঙের বাঘ, মাছের ছবি, এমনকি উনিশ শতকের ইংরেজ আমলের নববাবু সমাজ ও তাদের ভ্রষ্টতা, পানাহার, বারবণিতা গমন ইত্যাদি নানা সামাজিক বিষয় নিয়ে এই চৌকো পট আঁকা হয়েছে।
উপকরণের দিক থেকে পটগুলো প্রাচীন ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে।



 পট মূলত কাপড়ের ওপর আঁকা ছবি আর লোকসাহিত্য হিসেবে উপকরণগুলো শিল্পীকেই সংগ্রহ করে নিতে হয়, তাই বিভিন্ন দেশজ সহজলভ্য উপাদানকেই তাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের শিল্পে। কাপড় রং করার জন্য দেশি নীল, এলামাটি, খড়িমাটি, গেরিমাটি, সিন্দুর, হলুদ, ভুসা কালি, প্রদীপের কালি, গাছের পাতা, শিম বীজ, হিঞ্চে শাক, পাকা তেলাকুচা ইত্যাদির ব্যবহার হতো আর বেলের আঠা, তেঁতুলের বীজকে আঠা হিসেবে লাগানো হতো। পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিমের আঠা দেওয়া হতো। রং গোলার জন্য ব্যবহৃত হতো নারকেলের মালা। তুলি হিসেবে কাঠবেড়ালির লোম, ছাগলের লোম, বেজির চুল ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীকালে কাপড়ের বদলে কাগজের পট এবং রঙের ক্ষেত্রে ফেব্রিক বা কেমিক্যাল রং ব্যবহৃত হয়।



পটুয়া সংগীতগুলোর মূল্য অপরিসীম। ছবির সঙ্গে যে-গান গাওয়া হতো তাতে ফুটে উঠত বাঙালি হৃদয়ের সুর। কাহিনিগুলোর যে যে অংশ বাঙালি মনের সঙ্গে মিল আছে সেই অংশগুলোকে নির্বাচন করে দরদভরা গলায় তা দর্শকের কাছে পরিবেশন করা হতো। তাই অধিকাংশ কাহিনিই হয়ে উঠেছে বাঙালির নিজস্ব কাহিনি। কাশীরাম দাসের মহাভারত বা কৃত্তিবাসী রামায়ণ যেমন বাঙালির ঘরের কথাকে কাব্যে তুলে ধরেছে, তেমন এই সমস্ত পটুয়া সংগীতগুলো কোন প্রাচীনকাল থেকে লোকমুখে প্রচারিত হয়ে সুখ-দুঃখের কথাকে আপন করে নিয়ে কথকতায় ভরা গ্রামবাংলার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। সেজন্যই পটুয়া গানের সংগ্রাহক গুরুসদয় দত্ত তাঁর পটুয়া সঙ্গীত গ্রন্থে বলেছেন, ‘ধর্ম্ম, দর্শন ও পুরাণের মূল তত্ত্বগুলি যে বাঙালি হিন্দু সমাজের গণ-জীবনে অতি সহজভাবে অনুসঞ্চারিত হইয়া দৈনন্দিন ভাব ও চিন্তাধারার অঙ্গীভূত হইয়াছিল তাহার একটি বিশেষ পরিচয় আমরা এই পটুয়া সঙ্গীতের মধ্যে পাই।’২ তাই দেখা যায়, পটের দেব-দেবীরা বাঙালি গৃহস্থের মতো আচরণ করে। কৃষ্ণের অবতার পটে রাধা কৃষ্ণকে অনুরোধ করে বলে –
গাছ হতে নাম ঠাকুর পেড়ে দাও ফুল
ডাল ভেঙ্গে প’ড়ে মরবে শূন্য হইবে কুল।


রাধার কেশ পরিচর্যার বর্ণনায় ভেসে ওঠে গৃহস্থ বাঙালি বধূর ছবি –
কেশ গুলি আঁচুড়িয়ে করেন গোটা গোটা
কেশের মাঝে তুলে দিছে সিন্দুরের ফোঁটা।

পটুয়ারা ছবির সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে গানের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতেন। মূল ঘটনাটি ছবিতে আঁকা থাকত কিন্তু কাহিনির যত অগ্রগতি ঘটত তার সঙ্গে তাল মেলাবার জন্য ছবিতে যেগুলো উলেস্নখ নেই তা তারা বিশ্লেষণ করে দিতেন, যা অনেকটা নাটকের সংলাপের মতো হতো। ‘রামণ্ডলক্ষ্মণ’ পটে সেরকম একটি বর্ণনা রয়েছে –
(আজ) সূপর্ণখা নয়ন বাঁকা আড় নয়নে চায়
(আজ) বিয়ে কর বিয়ে কর বলে লক্ষ্মণের কাছে যায়।
লক্ষ্মণ বলে আমি চৌদ্দ বছর খেদা রাখবো না কি নিদ্রা যাব না
পোড়ামুখী আমার সম্মুখ থেকে বিদায় হ।
ওই কথা শুনে সেদিন একটা দুবর্ববাক্য বলিল
ক্রোধ করে, বিমুখ হয়ে রাবণের ভগ্নীর সেদিন নাসিকা কাটিল।



‘সিন্ধু বধ’ পটে বাঙালি মাতৃহৃদয়ের ছবি ফুটে উঠেছে, ‘কে এলি বাপ সিন্ধুক এলি বলরে বচন/ মা বলিয়া ডাকরে বাপ জুড়াক রে জীবন।’

দাম্পত্যজীবনের ছবি পাওয়া যায় ‘শঙ্খ পরান পালা’গুলোতে।
শিব-পার্বতীর সংসারের দুঃখ-দারিদ্র্য ও তার মাঝে রসিকতাপূর্ণ বাক্যালাপ যেন সকল বাঙালি কবির কাছে আলোচ্য ও উপভোগ্য বিষয়। গৌরীর শাঁখা পরবার সাধ হয়েছে তাই স্বামীকে আবদার করে ‘আঙ্গা উলি’ অর্থাৎ রাঙা রুলি কিনে দেওয়ার জন্য; কিন্তু শিব জানে তার সংসারের হাল, তাই গৌরীকে জ্ঞানের কথা শোনায় –
রূপাসোনা পর গৌরী আকালে বিচে খাবি
আঙ্গা উলি শঙ্খ পরে কোন সরগে যাবি।



স্বামীর মুখ থেকে এ-কথা শোনামাত্র গৌরী আর ঠিক থাকতে পারেনি। নারী অভিমানে ঘা পড়তেই সে মুখরা হয়ে উঠেছে আর এতই উগ্র হয়েছে যে তার রেশ মা-বাপ পর্যন্ত গিয়ে থেমেছে –
মর মর ভাঙ্গর বুড়ো চক্ষক্ষ পড়ুক ছানি
চোকে না দেখতে পাবি হীরে লাল কুচুনী।
চোখ খাক তোর মাতা পিতা চোক খাগা তোর খুড়ো
জেনেশুনে বিয়ে দিলে লাঠি ধরা বুড়ো।

একথা বলেই গৌরী ছেলেপিলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাপের বাড়ির উদ্দেশে। বাধ্য হয়ে শিবকেও যেতে হয় এবং শাঁখা পরিয়ে তবে নিস্তার পাওয়া যায়। কিন্তু এইভাবে সংসার চলে না, তাই বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য গৃহিণী পরামর্শ দেয় ভিক্ষা ছেড়ে চাষাবাদ করতে। নিত্যদিনের চালের ব্যবস্থা করা সাধারণ মানুষের কাছে খুবই কষ্টকর। আর সেই জীবনসংগ্রামের ছবি যেন পটের মাধ্যমে কিছুটা উপস্থাপিত হয়েছে। তাই ‘চাষপালা’তে উত্তম গৃহিণীর মতো গৌরী বলে –
ভুঁই এ লাগাও মুগ-মুশুরী পগারে লাগাও কলা
নৈবেদ্য বাড়বে ঠাকুর ধর্ম্ম সেবার বেলা।

অবশেষে শিব চাষ করে উত্তম ধান ফলায়; কিন্তু বাড়ি ফিরতে চায় না। কেননা তার নতুন বাতিক এখন মাছ ধরায়, তাই দুর্গাকেও যেতে হয় বাগদিনী সেজে মাছ ধরতে। ‘শিবের মাছ ধরা’ পটে সেই দৃশ্য ফুটে উঠেছে। অপরদিকে গোপালন পটে গরুর উপকারিতা বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গরু-সেবার জন্য কেবল বাড়ির বউদেরই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই নীলবতী সাতদিনে সাত বউকে বলেছে –
সাত বউকে ডাক দিয়ে কহে নীলবতী
গরু বাছুর সেবা কর তোমরা নিত্যি নিত্যি।

নারীদের এই পরিশ্রমের মধ্যে তাদের বেদনার কথাও গানের মধ্যে পাওয়া যায় –
বউ বলে নিগরুর ঘরে যদি মোর বিবাহ হইত
তবে কেন সোনার শঙ্খয় গোবর লাগিত।



পরবর্তীকালে পটগুলোতে বিভিন্ন বিষয় যোগ হতে থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পটের বিষয়বস্ত্তও পালটাতে শুরু করে। জীবিকার তাগিদে পটুয়াদের বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয়কে কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো বাধ্য হয়ে গ্রহণ করতে হয়। তাই পৌরাণিক পটের পাশাপাশি ঐতিহাসিক, সমাজ সচেতনতামূলক, জীবনীমূলক, ধর্মগুরু বিষয়ক, শিক্ষামূলক, স্বাস্থ্যমূলক, পরিবেশ সচেতনতামূলক, রাজনৈতিক প্রচারবিষয়ক পটের প্রচলন হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহ, অসহযোগ আন্দোলন, নেতাজি, গান্ধীজি, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, ক্ষুদিরাম, মাতঙ্গিনী, পণপ্রথা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, কুসংস্কার, সাক্ষরতা, পালস পোলিও টীকাকরণ, শিশুকল্যাণ, কুষ্ঠ, এইডস, বৃক্ষরোপণ, ভোটযুদ্ধ, কালোবাজারি, সুন্দরবন, গাজীপীরদের মাহাত্ম্য, ট্যাক্স প্রভৃতি বিষয়কে নিয়ে গান রচিত হতে থাকে। তবে এসব গানের সুর পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে রচিত পটের সুরের থেকে আলাদা। সচেতনতামূলক গানগুলোর সুর যেন ঘোষকের মতো। কোথাও কবিগানের চটুলতা, কোনো গানে বাউলের সুর, চারণকবিদের মতো উদাত্ত সুর, ফকির-দরবেশের সুর, আবার কীর্তনগানের মতো ভক্তিরসের আমেজও পাওয়া যায়। পটুয়ারা যেহেতু না-হিন্দু না-মুসলিম, তাই তাঁদের গানে মিশ্র সংস্কৃতির সহাবস্থান লক্ষ করার মতো। ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে হিন্দু-মুসলমানদের নিয়ে
যে বিভেদ দেখা যায় তা তাঁরা মেনে নিতে পারেন না, তাই প্রশ্ন তোলেন –
ভারতবর্ষ সবার দেশ, সবার সে যে ঘর।
হিন্দু মুসলিম সব জাতি কেহ নাই পর \
মন্দির মসজিদ নিয়ে আজ প্রশণ কেন দেশে।
হিংসা কেন দাঁড়াল আজি সবার দ্বারে এসে \

বাংলার পটের এসব বিভিন্ন দিক সংযোজিত হতে থাকে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতক থেকে। ইংরেজদের আগমন, জমিদারি ব্যবস্থার অত্যাচার ও মিথ্যা জৌলুস, বাবুসমাজের নীতিহীনতা, নাগরিক বৈভবের কলুষতা ইত্যাদি বিষয় সাহিত্য-গানে-ছবিতে প্রতিফলিত হতে থাকে। কালীঘাটের পটচিত্রে তাই দেখা যায় ছবিগুলোর ভিন্নমাত্রা। রাজা সাধন চৌধুরী কর্তৃক বর্তমান কালীঘাট মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর জনসমাগম ও সেই উপলক্ষ্যে জীবিকার জন্য পটুয়ারা পট আঁকতে শুরু করেন, যা একসময় বিভিন্ন জেলাতেও রপ্তানি হতে শুরু করে। এসব পটে দেব-দেবীর ছবির পাশাপাশি ব্যঙ্গাত্মক সমাজচিত্র ছিল লক্ষ করার মতো। দেব-দেবীর সাজসজ্জা ছিল সাহেব-মেমদের মতো। এছাড়া নারী জাতির অবমাননা, বাইজিবিলাস, ভ্রষ্টাচারী গুরু ইত্যাদি বিষয়ও অঙ্কিত হতো। সামাজিক বিষয়কে প্রতীকের মাধ্যমে দেখানো হতো এই পটে, যেমন বিড়ালের মুখে চিংড়ি মাছের মোটিফ বা সিংহের মুখে মানুষ, বিড়ালের বিবাহ, বুলবুলির লড়াই ইত্যাদি। কালীঘাটের পটে রঙের ব্যবহার ও অঙ্গসৌষ্ঠব ছিল আকর্ষণীয়। এ-ব্যাপারে অশোককুমার রায় ‘কালীঘাটের পটচিহ্ন’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কিছু অবয়বধর্মী কালীঘাট পট সংগ্রহ আছে যাতে ভারতীয় শৃঙ্গার, সোভারী, দেহসৌষ্ঠব দর্শককে যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ করে।’


 ফলে কালীঘাটের পট একটি ভিন্নমাত্রা যোগ করে।
বাংলার এই লোকায়ত সংস্কৃতি আপামর জনসাধারণের শুধু মনোরঞ্জনই করেনি, পাশাপাশি বিভিন্ন দিককেও তুলে ধরেছে। একদিকে যেমন এই শিল্প লোকশিক্ষার সহায়ক হয়েছে, তেমন তাতে ধরা পড়েছে পৌরাণিক কাহিনির বাঙালি রূপ, নারীর অবহেলিত জীবন, পুরুষতান্ত্রিকতা, মনস্তত্ত্ব, নৈতিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি, আবার তার সঙ্গে সাধারণ দর্শক-শ্রোতা পেয়েছে ছবি দেখার সুযোগ, গল্প শোনার আমেজ, নাটকের আনন্দ ও সুরের আবেশ। তবে বাঙালির এই ঐতিহ্য যুগের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে। ভিন্ন সাংস্কৃতিক আবহে ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে এই পরম্পরা। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক অবস্থানের জন্য পটুয়ারা
পেশা বদল করতে শুরু করেছেন। অর্কেস্ট্রা, ডিজে ও প্রমোদমূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পেরে তাদের ভিন্ন পথ বেছে নিতে হচ্ছে। ডেবরার বাঘাবেরিয়া গ্রামের ফুলজান চিত্র কর জানাচ্ছেন, ‘একসময় রাত জেগে পটের গান গাওয়া হতো; কিন্তু এখন ছেলেমেয়েরা কলেজে পড়াশোনা করছে, তাই তারা পট নিয়ে গ্রামে ঘুরে গান শোনাতে অনিচ্ছুক।’ তবে সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে বা ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে ডাক আসে বলে তিনি জানিয়েছেন। অনেক জায়গায় সরকারি ভাতাও দেওয়া হয়ে থাকে প্রতিমাসে। কিন্তু ক্রমেই নষ্ট হতে চলেছে এই সংস্কৃতি। অবশ্য অনেক পটশিল্পকে বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত করে ক্রাফটের মাধ্যমে তাদের শিল্পকলা ফুটিয়ে তুলে বাণিজ্যের কাজে লাগানো হচ্ছে, ফলে জীবিকা অর্জনের পথ কিছুটা হলেও সুগম হচ্ছে। তবে এ-ব্যাপারে সরকারকেই আরো এগিয়ে আসতে হবে। পেইন্টিং বা ডিজাইনিংয়ের ক্ষেত্রে শিল্পীদের সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে পটশিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে হবে, তাহলে হয়তো যোগ হতে পারে আরো একটি মাত্রা। আর তখনই বিশ্বকবির ভাষায় সকলে বলে উঠতে পারব –
এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর।
পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর,
সুন্দর হে সুন্দর।



∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Tuesday, 27 October 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য


ভারতের জন্য নিবেদিত প্রাণ।

ভগিনী নিবেদিতা

=================================

Doinik Sabder Methopath

Vol - 173.Dt -28.10.20

১০ কার্তিক,১৪২৭.বুধবার

÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷


উনবিংশ শতাব্দীর ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরােধা স্বামী বিবেকানন্দ। আর ভারতমাতার পায়ে তারই শ্রেষ্ঠ উপহার ভগিনী নিবেদিতা। নিবেদিতা আপন সেবাধর্মে, মমতায়, ত্যাগে ও দরদে দেশবাসীর ভগিনী রূপে আখ্যাত। স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ভারতে এসে ভারতবাসীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দেশবাসীর প্রকৃত ভগিনীর আসনে চির প্রতিষ্ঠাতা।

ভগিনী নিবেদিতার জন্ম হয় উত্তর আয়ারল্যান্ডে। তিনি তাঁর পিতা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেলের নিকট এই শিক্ষা পান যে, মানব সেবাই ঈশ্বর সেবা। পিতার কথা তাঁর পরবর্তী জীবনেও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি সঙ্গীত ও শিল্পকলার বোদ্ধা ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দশ বছর তিনি শিক্ষকতা করেন। শিক্ষিকা হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শিক্ষকতা করতে করতেই তিনি বুদ্ধের শিক্ষা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই সময়ই স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। বিবেকানন্দের বাণী তাঁর জীবনে এতটাই গভীর প্রভাব বিস্তার করে যে, তিনি ভারতকে তাঁর কর্মক্ষেত্ররূপে বেছে নেন। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য নারী যিনি ভারতীয় সন্ন্যাসিনীর ব্রত গ্রহণ করেছিলেন।

১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি কলকাতায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি নানা মানবকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সকল বর্ণের ভারতীয় নারীর জীবনযাত্রার উন্নতির লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরজগদীশচন্দ্র বসু ও তার স্ত্রী অবলা বসুঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরওকাকুরা কাকুজো প্রমুখ তৎকালীন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছিলেন নিবেদিতার বন্ধুস্থানীয়। রবীন্দ্রনাথ তাকে "লোকমাতা" আখ্যা দেন। ভারতীয় শিল্পকলার সমঝদার নিবেদিতা ভারতের আধুনিক চিত্রকলার সৃজনে অন্যতম অনুপ্রেরণার কাজ করেন। নন্দলাল বসু এই কথা একাধিকবার স্মরণ করেছেন। জীবনের শেষ পর্বে নিবেদিতা স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা স্থাপিত হয়। এই সময় ব্রিটিশ সরকার যাতে রামকৃষ্ণ মিশনকে অযথা উত্ত্যক্ত না করে, সেই কথা ভেবে মিশনের সঙ্গে তিনি তার "আনুষ্ঠানিক" সম্পর্ক ত্যাগ করেন।

প্রথম জীবন

১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডানগ্যানন শহরে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেল ছিলেন ধর্মযাজক। মায়ের নাম ছিল মেরি ইসাবেলা। মাত্র দশ বছর বয়সে মার্গারেটের বাবা মারা যান। তারপর তাঁর দাদামশাই তথা আয়ারল্যান্ডের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী হ্যামিলটন তাঁকে লালনপালন করেন। মার্গারেট লন্ডনের চার্চ বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর হ্যালিফ্যাক্স কলেজে তিনি এবং তাঁর বোন মেরি পড়াশোনা করেছিলেন।

১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে, সতেরো বছর বয়সে শিক্ষাজীবন শেষ করে মার্গারেট শিক্ষিকার পেশা গ্রহণ করেন। দুবছরের জন্যে কেসউইকের একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ান। এরপরে একে একে রেক্সহ্যামে (১৮৮৬), চেস্টারে (১৮৮৯) এবং লন্ডনের উইম্বলডনে (১৮৯০) তিনি শিক্ষকতা করেন। কিছুদিন পরে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে উইম্বলডনে নিজে 'রাস্কিন স্কুল' উদ্বোধন করেন। তিনি এই স্কুলে নতুন শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবহার করেন। পাশাপাশি নানা পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে ও গির্জার হয়ে নানা সেবামূলক কাজও শুরু করেন। তিনি একজন ওয়েলশ যুবকের কাছে বিবাহের প্রতিশ্রুতি পান, কিন্তু তিনি অচিরে মারা যান।

স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ

১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে লন্ডনে এক পারিবারিক আসরে মার্গারেট স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যা শোনেন। বিবেকানন্দের ধর্মব্যাখ্যা ও ব্যক্তিত্বে তিনি মুগ্ধ এবং অভিভূত হন। তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তরের ক্লাসে উপস্থিত থাকেন। তারপর বিবেকানন্দকেই নিজের গুরু বলে বরণ করে নেন।

ভারতে

১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি স্বদেশ ও পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে মার্গারেট চলে আসেন ভারতে। এই সময় বিবেকানন্দের কাছে ভারতের ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, জনজীবন, সমাজতত্ত্ব, প্রাচীন ও আধুনিক মহাপুরুষদের জীবনকথা শুনে মার্গারেট ভারতকে চিনে নেন। ভারতে আসার কয়েক দিন পর রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী সারদা দেবীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এরপর ২৫ মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ তাকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দেন। তিনিই মার্গারেটের নতুন নাম রাখেন ‘নিবেদিতা’।

মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য নিবেদিতা উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনে নিজবাসভবনেএকটি মেয়েদের স্কুল খোলেন (বর্তমানে নাম রামকৃষ্ণ সারদা মিশন ভগিনী নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়)। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের কলকাতায় মহামারী দেখা দিলে তিনি স্থানীয় যুবকদের সহায়তায় রোগীদের সেবাশুশ্রূষা (সেবা করেন) ও পল্লী-পরিষ্কারের কাজ করেন।

১৬ নম্বর বোস পাড়া লেন, ভগিনী নিবেদিতার বাড়ি

১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই নিবেদিতার পরম গুরু স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যু হয়।

ভারতীয়দের প্রতি অবদান

এরপর তিনি ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের নিয়মানুসারে ধর্ম ও রাজনীতির সংস্রব ঠেকাতে সংঘের কেউ রাজনীতিতে জড়াতে পারতনা। তাই মিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক পরিত্যাগ করতে হয় নিবেদিতাকে। যদিও সারদা দেবী ও রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাঁর আমৃত্যু সুসম্পর্ক বজায় ছিল। তিনি ভারতবর্ষে প্লেগ দমনে উদ্যোগী হন।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতে শুরু করেন নিবেদিতা। এই সময় অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। এসবের পাশাপাশি নিবেদিতা মডার্ন রিভিউ, দ্য স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার পত্রিকা, ডন, প্রবুদ্ধ ভারত, বালভারতী প্রভৃতি পত্রিকায় ধর্ম, সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল 'কালী দ্য মাদার', 'ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ', 'ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজম', 'দ্য মাস্টার অ্যাজ আই শ হিম' ইত্যাদি।

মৃত্যু

সারদা দেবীর সাথে ভগিনী নিবেদিতা

ভারতের গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ায় অতিরিক্ত পরিশ্রম করার ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন নিবেদিতা। হাওয়া বদলের জন্য জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দার্জিলিঙে বেড়াতে যান নিবেদিতা। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর দার্জিলিঙে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪৪ বছর।

প্রভাব

ভগিনী নিবেদিতা ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী মহিলাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর বই মাতৃরূপা কালী পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর "ভারতমাতা" ছবিটি আঁকেন। বিধাননগরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ২০১০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ভবনটি নিবেদিতার নামে নামাঙ্কিত। তামিলনাড়ুর চেন্নাইতে ভগিনী নিবেদিতার প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিটির নাম রাখা হয়েছে সিস্টার নিবেদিতা অ্যাকাডেমি। তাঁর নামে একাধিক বিদ্যালয় ও কলেজের নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৬৮ সালে ভারত সরকার তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে ৪.০৬ X ২.২৮ সেন্টিমিটারের একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

ব‌ই

ক্রেডল টেলস ফ্রম হিন্দুইজম বইটির ১৯১৩ সংস্করণের প্রচ্ছদ।
কলকাতার বিবেকানন্দ সোসাইটিতে ভগিনী নিবেদিতার মূর্তি

ভগিনী নিবেদিতার বইগুলির মধ্যে দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ (এই বইতে নিবেদিতা ভারতীয় সংস্কৃতি ও রীতিনীতি সম্পর্কে পাশ্চাত্যে প্রচলিত নানা ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করেন), মাতৃরূপা কালীস্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছিস্বামীজির সহিত হিমালয়ে,[১৩] ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজমস্টাডিজ ফ্রম অ্যান ইস্টার্ন হোমসিভিল আইডিয়াল অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিটি, হিন্টস অন ন্যাশনাল এডুকেশন ইন ইন্ডিয়াগ্লিম্পসেস অফ ফেমিন অ্যান্ড ফ্লাড ইন ইস্ট বেঙ্গল - ১৯০৬ উল্লেখযোগ্য।

১৯১০-১১ খ্রিস্টাব্দে দ্য মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত দ্য এনশিয়েন্ট অ্যাবে অফ অজন্তা বইটি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার লালমাটি প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত হয়।

ইংরেজি রচনাবলী :

  • প্রথম খণ্ড: দ্য মাস্টার অ্যাজ আই স হিম; নোটস ফ্রম সাম ওয়ান্ডারিং; কেদারনাথ অ্যান্ড বদ্রনারায়ণ; কালী দ্য মাদার। আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৮০৪০-৪৫৮-০
  • দ্বিতীয় খণ্ড: দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ; অ্যান ইন্ডিয়ান স্টাডি অফ লাভ অ্যান্ড ডেথ; স্টাডিজ ফ্রম অ্যান ইস্টার্ন হোম; লেকচার্স অ্যান্ড আর্টিকল। এএসআইএন B003XGBYHG
  • তৃতীয় খণ্ড: ইন্ডিয়ান আর্ট; ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজম; রিলিজিয়ন অ্যান্ড ধর্ম; অ্যাগ্রেসিভ হিন্দুইজম। আইএসবিএন ৯৭৮-১-১৭৭-৭৮২৪৭-০
  • চতুর্থ খণ্ড: ফুটফলস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি; সিভিক আইডিয়াল অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিটি; হিন্টস অন ন্যাশনাল এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া; ল্যাম্বস অ্যামং উলভস। এএসআইএন B0010HSR48
  • পঞ্চম খণ্ড: অন এডুকেশন; অন হিন্দু লাইফ, থট অ্যান্ড রিলিজিয়ন; অন পলিটিল্যাল, ইকোনমিক্যাল অ্যান্ড সোশ্যাল প্রবলেমস; বায়োগ্রাফিক্যাল স্কেচেস অ্যান্ড রিভিউ। এএসআইএন B0000D5LXI
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
                  আলোচনা পর্ব -১৪


                          ============✓✓✓✓✓=============
               Doinik Sabder Methopath
                Vol -162.Dt -16.10.20
                  ২৯ আশ্বিন,১৪২৭.শুক্রবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷✓✓✓✓✓÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

                      অনুগল্প বা ফ্লাশফিকশন সম্প্রতি সাহিত্যের জনপ্রিয় শাখা হয়ে উঠেছে। গত পাঁচ বছর ধরে ব্রিটেনের সাহিত্যজগতে ‘ন্যাশনাল ফ্লাশফিকশন ডে’ উদযাপিত হয়ে আসছে। নিউজিল্যান্ডেও অনুরূপভাবে জাতীয় অনুগল্প দিবস পালিত হয়। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের বিপ্লব, ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তায় বর্তমানে গল্পের এই ক্ষুদে কাঠামো বা ফর্মটি নিয়ে হৈ চৈ হলেও এটি একেবারে নতুন কিছু না- মুখে মুখে বলা গল্প-ঐতিহ্যে (ওরাল ট্রাডিশন) বহু যুগ থেকে চলে আসছে। পশ্চিমে ঈশপের গল্প, ভারতবর্শে জাতক কিংবা লোকমুখে প্রচলিত গোপাল ভাড়ের গল্পও আকারে বেশ ছোট ছিল। গ্রিম ভাইদ্বয় যে ফোক-টেলস সংগ্রহ করেছিলেন তার বেশির ভাগই ছিল অনুগল্পের আকারে। এসব গল্পে সংক্ষিপ্ত আখ্যানে গুটিকতক চরিত্র ও ঘটনার ভেতর দিয়ে গল্পটি শেষ হয়।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অনুগল্পের প্রধানতম লেখক হলেন বনফুল (১৮৯৯-১৯৭৯)। বর্তমান বিশ্বে অনুগল্প লিখে ‘ম্যান অব বুকার’ পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন লেখক লিডিয়া ডেভিস (জ. ১৯৪৭)। ডেভিসের গল্পের দৈর্ঘ্য এক লাইন থেকে শুরু করে দু-তিন পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তার গল্পকে আদর্শ অনুগল্প বা ফ্লাশফিকশন বলা যায়। ছোটগল্পের পাশাপাশি অনুগল্প লিখে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন আরেক মার্কিন কথাসাহিত্যিক রবার্ট ওলেন বার্টলার (জ. ১৯৪৫)। তবে বার্টলার এবং ডেভিসের অনেক আগে ছোটগল্পের পাশাপাশি অনুগল্প লিখে বিখ্যাত হয়েছেন জাপানের প্রথম নোবেলজয়ী লেখক Yasunari Kawabata (১৮৯৯-১৯৭২)। অনুগল্প লিখেছেন কাফকা, হেমিংওয়ে, আর্থার সি ক্লাক, রে ব্রাডবুরি, নগিব মাহফুজ, ডোলান্ড বার্থলেম, আমব্রুস বিয়ার্স, কেট শপা, শেখবের মতো প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকরাও।
উল্লেখ্য যে, অনুগল্প সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে আমেরিকায়। সেখানে অনুগল্প এখন ছোটগল্প থেকে কিছুটা সরে এসে সাহিত্যের স্বতন্ত্র বিভাগ (genre) হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু হয়েছে।
অনুগল্পে বেঁধে দেওয়া কোন আকার না থাকলেও কেউ কেউ মনে করেন এটি ১০০ শব্দের মধ্যে শেষ হওয়া চায়, আবার কেউ কেউ ১ হাজার শব্দের নিচে যে কোনো গল্পকে অনুগল্প বলে মনে করেন। যেমন আমেরিকান কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১) প্রায় নয়শ শব্দে ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’ অনুগল্পটি লিখেছেন; আবার তিনি একটি অনুগল্প লিখেছেন মাত্র ছয় শব্দে : ‘For sale: baby shoes, never worn.’ আবার হন্ডুরাসের লেখক Augusto Monterroso (১৯২১-২০০৩) ‘সাত শব্দের এপিক’ বলে বিখ্যাত ডাইনোসর গল্পটি লিখেছেন : ‘Upon waking, the dinosaur was still there’। প্রখ্যাত মেক্সিকান লেখক এডমান্ড ভালাদেস (১৯১৫-১৯৯৪) বারো শব্দে লিখলেন দ্য সার্চ গল্পটি : Those maddened sirens that howl roaming the city in search of Ulysses। একটা অসমাপ্ত বাক্য, কিন্তু গল্প! তবে অনুগল্প নিয়ে যেন একটু বাড়াবাড়িই করে ফেললেন মেহিকোর লেখক Guillermo Samperio (জ. ১৯৪৮)। তিনি ‘Fantasma’ নামে একটি গল্প লিখলেন যেখানে শিরোনামের পর একটিও শব্দ লেখা হয়নি। শিরোনাম আর একটি খালি পৃষ্ঠা!
অনুগল্পের এই শব্দসীমাকে চীনা সাহিত্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে ‘স্মোক লং’ ফিকশন বলে। অর্থাৎ একটি সিগারেট শেষ করতে যে সময় লাগবে তার ভেতর এ গল্প শেষ হয়ে যাবে। এটিকে মাইক্রো ফিকশন, পোস্টকার্ড ফিকশন, ন্যানো ফিকশন, সাডেন ফিকশন, সুপার শর্ট ফিকশন কিংবা শর্ট শর্ট স্টোরি নামেও ডাকা হয় বিভিন্ন দেশে।
অনুগল্পে অল্পকথনের ভেতর দিয়ে অনুভবের বিষয়টি উঠিয়ে আনা হয়। প্রখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭)-এর মতো অনেক কবি ক্ষুদে গদ্য-কবিতা (prose poetry) লিখেছেন যেগুলোকে অনুগল্প হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। অন্যদিকে হালের জনপ্রিয় মার্কিন কবি ও গল্পকার স্টুয়ার্ট ডাইবেক (জ. ১৯৪২)-এর অনেক অনুগল্প গদ্য-কবিতা হিসেবে কবিতার কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বোঝা যায়, কবিতা এবং ছোটগল্প দু’য়ের বৈশিষ্ট্যই অনুগল্পে বিদ্যমাণ। যে কারণে মার্কিন কথাসাহিত্যিক জয়েস ক্যারল ওয়াটস (জ. ১৯৩৮) বলছেন, অনুগল্প ‘often more temperamentally akin to poetry than to conventional prose, which generally opens out to dramatize experience and evoke emotion; in the smallest, tightest spaces, experience can only be suggested।’
কবিতার মতো অনুগল্পকে নানামাত্রিক অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। একটি কাব্যিক দ্যোতনা বা ভাবমুদ্রা এখানে থাকে। ভাষা হয় ঘন, রূপকাশ্রিত। ফলে মার্কিন কবি ও কথাসাহিত্যিক গ্রেস পালে (১৯২২-২০০৭) বলছেন, ‘অনুগল্প কবিতার মতোই ধীরে পড়া উচিত।’ অন্যদিকে অনুগল্প গল্পের মতোই সমাজ বাস্তবতার কোনো সুপ্ত চেতনাকে ইঙ্গিত করে। চরিত্র থাকে, কথোপকথন (ডায়লগ) থাকে। একটা চমৎকার সমাপ্তিও থাকে। কেবল বলাটা হয় দ্রুত- বিদ্যুৎ চমকের মতন ঝলক দিয়েই শেষ। এক মুহূর্তে বর্ণিত বাস্তবতার এক ঝলক দেখে নেয়া।

অনুগল্পের সঙ্গে গল্পের মূল পার্থক্যটা হল, গল্প তৈরি হয় কতগুলো মুহূর্ত নিয়ে; এখানে কতগুলো ঘটনা কতগুলো দৃশ্যকে আশ্রয় করে প্রকাশ ঘটে। আর একটি সার্থক অনুগল্পে একটি বিশেষ মুহূর্ত একক দৃশ্যপটের ভেতর দিয়ে উপস্থাপিত হয়। কিছু পরিষ্কার করে বলা হবে না, কেবল একটা ইঙ্গিত দিয়েই ছেড়ে দেয়া হবে। উপন্যাস এবং ছোটগল্পের সঙ্গে তুলনা করে আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক লুইসা ভেলেনজুয়েলা (জ. ১৯৩৮) বলছেন : ‘I usually compare the novel to a mammal, be it wild as a tiger or tame as a cow; the short story to a bird or a fish; the micro story to an insect (iridescent in the best cases)।’
ফ্লাশফিকশন শরীর গঠনে ‘পোকা’ সদৃশ হওয়ার কারণে শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে অতি মিতব্যয়ী হওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের গল্পে টানটান উত্তেজনা থাকবে। শুরু হতেই শেষ হয়ে যাবে। ছোটগল্পের শেষে চমক (whip-crack end) থাকতেও পারে নাও থাকতে পারে, তবে অনুগল্পে সেটি মৃদুভাবে থাকলে ভালো হয়। যেমন : বনফুলের ‘নিমগাছ’ গল্পে বনফুল নিমগাছের উপকারী দিকগুলো এবং মানুষের তার প্রতি যে নিষ্ঠুর আচরণ করে সেটি বলতে বলতে হঠাৎ করে থেমে গল্পকথক বলে দিলেন, পাশের বাড়ির বৌটিরও একই দশা। গল্প শেষ। এটা মৃদু চমক। ধাক্কাটা আরো তীব্রভাবে এসেছে আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক Julio Cortázar (১৯১৪-১৯৮৪)-এর Continuity of the Parks গল্পে। এখানে এক ব্যস্ত ব্যবসায়ী একটি উপন্যাস পড়ছেন তন্ময় হয়ে। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে নায়ক-নায়িকা পার্কে দেখা করছেন। আসার সময় গাছের ডালের আচড়ে নায়কের মুখে কেটে গেছে। নায়িকা কিস করে রক্তপাত বন্ধ করছে। নায়ক বলছে এভাবে আর লুকিয়ে দেখা করতে পারবে না। এবার কিছু একটা করা উচিত। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলো আজই নায়িকার স্বামীকে তারা দুজনে মিলে খুন করবে। পরিকল্পনা মতো নায়িকার বাড়ি গেল। দরজায় কুকুর ছিল তাদের দেখে ডাকল না। সামনে হল রুম, তারপর করিডোর, তারপর একটা সিঁড়ি। চাকু হাতে প্রেমিক। প্রেমিকার স্বামী তখন চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি উপন্যাস পড়ছেন। গল্প শেষ। অর্থাৎ শুরুতে যে ব্যবসায়ী পাঠক গভীর মনোযোগের সাথে উপন্যাস পড়া শুরু করেছিলেন। তিনি উপন্যাসটি শেষ করতে না করতেই স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমের বলি হচ্ছেন। বাস্তব আর ফিকশন মিশে এক হয়ে গেল। মজাটা এখানেই।
২.
অনুগল্পের একটা বড় অংশ লেখা হয়েছে ‘কথারূপক বা ফেবল’ ও ‘উপরূপক বা প্যারাবল’ হিসেবে। মোটাদাগে ফেবলের সঙ্গে প্যারাবলের পার্থক্য হল, ফেবলে সরাসরি হিউম্যান বা মানবচরিত্র থাকে না, কিন্তু প্যারাবলে থাকে। বর্তমান গদ্যে সংকলিত গল্পগুলোর মধ্যে জেমস থার্বার রচিত ‘খরগোশ, যারা সকল সমস্যার কারণ ছিল’ গল্পটি আধুনিক ফেবল। রচনাকাল আগস্ট ২৬, ১৯৩৯। সাধারণত ফেবলের চরিত্ররা হয় জীবজন্তু বা পশুপাখি। এই গল্পের চরিত্ররা হল খরগোশ, নেকড়ে ও প্রতিবেশি অঞ্চলের জীবজন্তুরা। লেখক মানবজগতের কোনো বিশেষ বিষয় বা দিক তুলে আনতে এ ধরনের গল্প লিখে থাকেন। সাধারণত এ ধরনের গল্প শিশুদের জন্য লেখা হয়ে থাকে। তবে বড়দের জন্যও কেউ কেউ ফেবল লিখে থাকেন। যেমনটি জেমস থার্বার করেছেন। সমাজ বা রাষ্ট্রের কিছু বিষয় সমালোচনা করার জন্যে প্রতীকী উপস্থাপনের পথ বেছে নেন। ফেবলের সব সময় একটা নীতিবাক্য বা মোরাল থাকে। এ গল্পের মোরালে বলা হয়েছে- run, not walk, to the nearest desert island. গল্পটির আরো অনেক অন্তর্নিহিত অর্থ আছে। এটি লেখা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাককালে। গল্পকার থার্বার হয়ত খরগোশ বলতে জার্মানির ইহুদিদের বুঝিয়েছেন। আর নেকড়েরা হল নাজি। কিংবা খোরগোশদের সঙ্গে উনিশ শততে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের তুলনা চলে। ক্ষমতাসীনরা হল নেকড়ে। আরও ব্রডভাবে বিশ্বের যেকোনো সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুর অবস্থাকে খরগোশের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায়। আর সংখ্যালঘুরা হল নেকড়ে। গল্পটিকে সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় এলিগরি হিসেবেও দেখার সুযোগ আছে। পৃথিবীর বহু ধর্ম ও ক্ষুদ্র ভাষাভাষি নৃগোষ্ঠী খরগোশদের মতো কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
প্যারাবলের যথার্থ উদাহরণ হল এখানে সংকলিত কাফকার ‘আইনের দরজায়’ গল্পটি। কাফকা বড় গল্পের পাশাপাশি বেশকিছু প্যারাবল রচনা করেছেন। ‘বিফোর দ্য ল’ বা ‘আইনের দরজায়’ গল্পটি কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাসে আছে। উপন্যাসের মূল চরিত্র কে প্রিস্টকে গল্পটি শোনায়। আইনের দরজায় প্যারাবলে একটি লোক জ্ঞান অর্জন করতে চায় এবং আইনের কাছে আসতে চায়। কিন্তু আসতে দেওয়া হয় না। সে অপেক্ষা করতে করতে মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে জানতে পারে, আইনের এই দরজাটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারণ এটি শুধু তার জন্যেই বানানো ছিল। এই হল আপাত গল্পটা। প্যারাবল সব সময় আপাত গল্পের ভেতর অন্য একটা গল্প লুকিয়ে রাখে। এই গল্পতেও সেটা আছে। গল্পের প্রধান দুটি চরিত্র হল দারোয়ান ও গ্রাম থেকে আসা একটি লোক। এখানে আইনকেও আমরা একটি চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এখন এই তিন চরিত্রকে আমরা অ্যালিগরিক্যাল বা রূপক ধরে নিয়ে ভিন্ন কতগুলো সীদ্ধান্তে আসতে পারি। এক ধরনের ব্যাখ্যা আমরা ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাসে কে এর সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে করতে পারি। কে-কে একদিন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়। কে তার অপরাধ জানে না। তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়া পর নিজের অপরাধের সন্ধান চালাতে হয়। তাকে তার জন্য নির্ধারিত আইনের দরজায় যেতে হয়।
সাধারণভাবে আমরা গল্পটিকে একটি রাজনৈতিক-সামাজিক অ্যালিগরি হিসেবে ভাবতে পারি। আমাদের শেখানো হয়, আইনের দরজা সব সময় খোলা, সকলের সমান অধিকার সেখানে। বিচারকের পেছনে এর প্রতীক হিসেবে দেখা যায়, একটি দাঁড়িপাল্লা ধরে আছে চোখ বাধা এক ব্যক্তি। দাঁড়ির পাল্লা দুইদিকে সমান। অর্থাৎ আইন কোনো মানুষ দেখে বিচার করে না। সবাই তার কাছে সমান। কিন্তু বাস্তবজীবনে আমরা ঠিক তার উল্টোটাই ঘটতে দেখি। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা সব সময় আইনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে মুক্তি পেয়ে যায়, আর নিরাপরাধ অসহায় ব্যক্তিরা দিনের পর দিন আইনের পথে হেঁটে পায়ের জুতা ক্ষয় করে ফেলে। এই গল্পেও সেটা হয়েছে। গ্রামের মানুষটি জানতো আইনের কাছে সবার সব সময় যাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু সে আইনের দ্বারমুখে আটকে যায়। এখানে প্রবেশ করতে হলে শক্তি নিয়ে প্রবেশ করতে হবে। এক একজন দারোয়ান বসে আছে, হয় তাদের খুশি করে নয়ত পরাজিত করে আইনের কাছে যেতে হবে। অর্থাৎ আইনের কাছে পৌঁছানোর পথ হল আইন অমান্য করা! এটাই এই গল্পের আয়রনি।
এর সঙ্গে অস্তিত্ববাদি চেতনাও জড়িত। গল্পটি মুক্ত চেতা বা ফ্রি উইলের ওপর জোর দিয়েছে। একজন ব্যক্তি তার নিজের ভবিষ্যতের জন্যে নিজেই দায়ী। আইনের দরজায় গল্পটি যে জিনিসটির প্রতি ইঙ্গিত দেয় সেটা হল, উদ্দেশ্যহীন জীবন নিরর্থক বা অযৌক্তিক। গল্পে গ্রাম থেকে আসা লোকটির ওপর সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়- হয় সে অপেক্ষা করবে নয় সে দরজার ভেতর প্রবেশ করবে। লোকটি অপেক্ষা করার সীদ্ধান্ত নেয়। এ থেকে তার সিদ্ধান্ত না নিতে পারার কারণে জীবনটি অর্থহীনভাবে কেটে যায়। তার মৃত্যুর পর দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রতিটা ব্যক্তির জন্যে একটা মুক্তির পথ থাকে, সেটা তাকে বেছে নিতে হয়। কষ্ট শিকার করে অর্জন করতে হয়। নিজের অদৃষ্টের দিকে তাকিয়ে থেকে অনিবার্যভাবে মুক্তি আসবে না।


 

নির্বাচিত অনুগল্প

 

খরগোশ, যারা সকল সমস্যার কারণ ছিল
জেমস থার্বার

সবচেয়ে অল্প বয়সী শিশুটার মনে আছে- নেকড়ে অধ্যুষিত এলাকায় খরগোশদের একটা পরিবার বাস করতো। নেকড়েরা জানিয়ে দিলো যে, খরগোশদের জীবন-যাপনের রীতি-নীতি তাদের পছন্দ না। এক রাতে ভূমিকম্পের কারণে একদল নেকড়ে মারা পড়লো। আর দোষ গিয়ে পড়লো খরগোশদের ঘাড়ে। কেননা সবার জানা যে, খরগোশরা পেছনের পা দিয়ে মাটি আচড়িয়ে ভূমিকম্প ঘটায়। আরেক রাতে বজ্রপাতে নেকড়েদের একজন মারা পড়লো। আবারো দোষ গিয়ে পড়লো ঐ খরগোশদের ওপরে। কারণ সবাই জানে যে, লেটুস পাতা যারা খাই তাদের কারণেই বজ্রপাত হয়। একদিন খরগোশদের সভ্য ও পরিপাটি করার জন্যে নেকড়েরা হুমকি দিলো। ফলে খরগোসরা সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা নিকটবর্তী দ্বীপে পালিয়ে যাবে। কিন্তু অন্যান্য জন্তু-জানোয়াররা যারা খানিক দূরে বসবাস করতো তারা ভর্ৎসনা করে বলল- তোমরা যেখানেই আছ বুকে সাহস বেঁধে সেখানেই থাকো। এ পৃথিবীটা ভিতু-কাপুরুষদের জন্যে নয়। যদি সত্যি সত্যি নেকড়েরা তোমাদের ওপর আক্রমণ করে আমরা এগিয়ে আসবো তোমাদের হয়ে।
কাজেই খরগোশরা নেকড়েদের পাশে বসবাস করতে থাকলো। এরপর এক ভয়াবহ বন্যা হল, সেই বন্যায় আবার নেকড়েদের অনেকেই মারা পড়লো। এবারও যথারীতি দোষ গিয়ে পড়লো ঐ খরগোশ পরিবারের ওপর। কারণ সবাই জানে যে, যারা গাজর কুরে কুরে খায় এবং যাদের বড় বড় কান আছে তাদের কারণেই বন্যা হয়। নেকড়েরা দল বেঁধে খরগোশদের, তাদের ভালোর জন্যেই, ধরে নিয়ে গেল এবং তাদের নিরাপত্তার জন্যেই তাদের একটি অন্ধকার গুহার ভেতরে আটকে রাখলো।
যখন কয়েক সপ্তাহ ধরে খরগোশদের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। সাড়া শব্দ না পেয়ে অন্যান্য জন্তু-জানোয়াররা নেকড়েদের কাছে জানতে চাইলো খরগোশদের ব্যাপারে। নেকড়েরা জানালো যে, খরগোশদের সাবাড় করা হয়ে গেছে। যেহেতু তারা সাবাড় হয়ে গেছে সেহেতু এটা এখন তাদের একান্ত নিজেদের বিষয়। কিন্তু অন্যান্য জন্তুরা হুমকি দিয়ে জানালো, যদি খরগোশদের খাওয়ার উপযুক্ত কোনো কারণ না দেখানো হয় তাহলে তারা সব একত্রিত হয়ে নেকড়েদের বিপক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সুতরাং নেকড়েদের একটি যুৎসই কারণ দশাতেই হল। তারা বলল- খরগোশরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল এবং তোমরা ভালো করেই জানো যে পলাতক-কাপুরুষদের জন্যে এ দুনিয়া না!

 

আইনের দরজায়
ফ্রানৎস কাফকা

আইনের দোরগোড়ায় অপেক্ষমান এক দারোয়ান। এই দারোয়ানের কাছে গ্রাম থেকে আগত এক লোক এসে প্রবেশ অনুমতির প্রার্থনা করে। কিন্তু দারোয়ান বলে যে, সে তাকে ঠিক এই মুহূর্তে ভেতরে ঢুকার অনুমতি দিতে পারছে না। লোকটা ক্ষণিক ভেবে জিজ্ঞাসা করে, খানিক পরে ঢুকতে দেওয়া যায় কিনা। ‘তা সম্ভব’, দারোয়ান বলে, ‘তবে এই মুহূর্তে নয়’। যেহেতু আইনের দরজাটা খোলায় আছে এবং দারোয়ান এক পাশে সরে আছে, উৎসুক লোকটি উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা চালায়। এটা দেখে হেসে উঠে দারোয়ান বলে- ‘যদি তোমার এতই ইচ্ছে হয়, আমার বাধা না মেনে ভেতরে চলে যেতে পারো। তবে মনে রেখ, আমি ক্ষমতাবান। এবং আমি হচ্ছি সবচেয়ে নিচুপদের দারোয়ান। ভেতরে হল থেকে হলে একজন করে দারোয়ান আছে। প্রত্যেকে তার আগের জনের থেকে শক্তিধর। তৃতীয় দারোয়ানের চোখেই আমি চোখ রাখতে পারি না।’ গ্রাম থেকে আসা লোকটি এতসব জটিলতার কথা ভেবে এখানে আসেনি। সে ভেবেছে, নিশ্চয় আইনে সবার সব সময় সমান প্রবেশাধিকার আছে। কিন্তু এখন সে যখন দারোয়ানকে আরও কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করল- ফারের কোট পরা, লম্বা সরু নাক, লম্বা-পাতলা-কালো তাতারদের দাড়ি, সে সিদ্ধান্ত নিল- সে বরং অপেক্ষা করবে। দারোয়ান তাকে একটা মুড়া দিয়ে দরজার একপাশে বসার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। সে ওখানে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বসে কাটিয়ে দেয়। মাঝে সে বেশ কয়েকবার ভেতরে প্রবেশের জন্যে আর্জি করেছে। প্রতিবারই দারোয়ান কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করেছে, জানতে চেয়েছে তার বাড়ি-ঘর সম্পর্কে, আরও অন্যান্য সব বিষয় নিয়ে। এগুলো খালি পদস্ত লোকদের একটু ভাব ধরে কিছু কথা বলার মতোই। এবং প্রতিবারই শেষ করেছে এই বলে যে, এখনও তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার সময় আসেনি। লোকটি তার ভ্রমণের জন্য যতকিছু সঙ্গে এনেছিল, দামি অদামি সব, আস্তে আস্তে ঘুষস্বরূপ দারোয়ানকে দিয়ে দিল। দারোয়ান প্রতিবারই এটা গ্রহণ করে বলেছে- ‘আমি শুধু এটা গ্রহণ করছি, যাতে তুমি নিজেকে নিজে বলতে পারো সব চেষ্টা তুমি করেছিলে।’ এই অনেকগুলো বছরে দারোয়ানের দিকে লোকটির মনোযোগ প্রায় আটকে গিয়েছিল। সে অন্যান্য দারোয়ানদের কথা ভুলেই গিয়েছিল। এই প্রথম দারোয়ানকেই তার কাছে আইনের পথে মূল বাধা বলে মনে হচ্ছিল। শুরুর বছরগুলোকে সে তার মন্দ ভাগ্যকে গাল-মন্দ করছিল- ভীষণ রেগে আর উচ্চবাচ্যে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে খালি নিজেকে তার অসন্তুষ্টি বিড়বিড় করে জানান দিচ্ছিল। বাচ্চা বনে যায় সে। দারোয়ানকে এতটা কাল ধরে দেখতে দেখতে তার কোর্টে বসা মাছিগুলোও পরিচিত হয়ে ওঠে। মাছিগুলোর কাছেও সে বিনতি করে দারোয়ানের মন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার জন্যে। শেষমেশ তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে। সে বুঝে উঠতে পারে না, তার আসে পাশে ঐগুলো অন্ধকার নাকি চোখের ধোকা। তবে ঐ অন্ধকারের ভেতর থেকেই সে উপলব্ধি করতে পারে, আইনের দরজা থেকে একটা অনির্বান দীপ্তি ভেসে আসছে। আর বেশি দিন বাঁচবে না সে। মৃত্যুর আগে, এতদিন ধরে সংগৃতি সকল অভিজ্ঞতা তার মাথায় জড় হয়ে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়- একটা প্রশ্নে যেটা সে এখনও দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করেনি। সে হাত নাড়িয়ে দারোয়ানের দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করে, যেহেতু উঠে দারোয়ানের কাছে যাওয়ার মতো শক্তি আর অবশিষ্ট নেই তার দেহে। দারোয়ানকে এগিয়ে আসতে হল। তাকে ঝুকে আসতে হয় কেননা দুজনের শরীরের উচ্চতার ফারাকে অসুবিধা হচ্ছিল। ‘এখন আবার তুমি কি জানতে চাও? দারোয়ান জানতে চাইল। তোমার তৃপ্তি কোনোদিনই মেটানো সম্ভব না। প্রত্যেকেই তো আইনের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে’। লোকটি বলল, ‘এটা কি করে সম্ভব হল যে এতকাল ধরে আমি ছাড়া আর কেউ আইনের কাছে যাওয়ার জন্যে এলো না?’ দারোয়ান বুঝতে পারলো যে, লোকটি তার জীবনের চরম সীমায় চলে এসেছে। সে আর ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছিল না, দারোয়ান কানের কাছে চেঁচিয়ে বলল, ‘যেহেতু এই দরজা শুধু তোমার জন্যে তৈরি করা হয়েছিল, সেহেতু আর কেউ ভেতরে ঢুকতে পারত না। আমি এখন এটা চিরকালের মতো আটকে দিতে যাচ্ছি।’

 

নিমগাছ
বনফুল

কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। খোস দাদ হাজা চুলকুনিতে লাগাবে। চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ। কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে। এমনি কাঁচাই..... কিংবা ভেজে বেগুন- সহযোগে। যকৃতের পক্ষে ভারী উপকার। কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক...। দাঁত ভালো থাকে। কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুশি হন। বলেন- নিমের হাওয়া ভাল, থাক, কেটো না। কাটে না, কিন্তু যত্নও করে না। আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে। শান দিয়ে বাধিয়েও দেয় কেউ- সে আর এক আবর্জনা। হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরনের লোক এলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙ্গলে না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু। বলে উঠলো, বাঃ কি সুন্দর পাতাগুলো.....কি রূপ। থোকা থোকা ফুলেরই বা কি বাহার....এক ঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাঃ! খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল। কবিরাজ নয়, কবি। নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভেতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে। ওদের বাড়ীর গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্মী বউটার ঠিক এই দশা।

 

বার্লিন
ম্যারি বয়লি ও’রেইলি

একটি ট্রেন হামাগুড়ি দিয়ে বার্লিন ছেড়ে আসছিল। ট্রেনের প্রতিটা বগি নারী ও শিশুতে গিজগিজ করছিল। সুস্থ-সবল দেহের পুরুষ মানুষ সেখানে ছিলো না বললেই চলে। একজন বয়স্ক মহিলা ও চুলে পাক ধরা সোলজার পাশাপাশি বসে ছিলেন। মহিলাটিকে বেশ রুগ্ন ও অসুস্থ দেখাচ্ছিল। তিনি গুনে চলেছেন- ‘এক, দুই, তিন’, ট্রেনের মতোই আপন ধ্যানে স্বল্প বিরতি দিয়ে। ট্রেনের একটানা ঝিক্ঝাক্ শব্দের ভেতরেও যাত্রীরা তার গণনা দিব্যি শুনতে পাচ্ছিল। দুটি মেয়ে বিষয়টি নিয়ে হাসাহাসি করছিল। বলাই বাহুল্য, তারা মহিলার গণনা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিল। মেয়ে দুটোকে উদ্দেশ্য করে একজন মুরব্বী গোছের লোক বিরক্তিসূচক গলা খ্যাঁকানি দিয়ে উঠলে কক্ষটিতে এক ধরনের হালকা নীরবতা এসে ভর করলো।
‘এক, দুই, তিন’- মহিলাটি শব্দ করে গুণলেন, যেন পৃথিবীতে সেই একমাত্র বাসিন্দা। মেয়ে দুটি আবারও খুকখুক করে হেসে উঠলো। বোঝা গেল তারা হাসিটা চেপে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়েছে। পাশে বসা বয়স্ক সোলজার সামনের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে ভারী গলায় বললেন- ‘শোনো মেয়েরা, আশা করি আমার কথাগুলো শোনার পর তোমরা আর হাসবে না। এই অসহায় মহিলাটি আমার স্ত্রী। কিছুক্ষণ আগেই আমরা যুদ্ধে আমাদের তিন সন্তানকে হারিয়েছি। যুদ্ধের সম্মুখভাগে অগ্রসরের আগে আমি তাদের মাকে একটা বিকারগ্রস্ত চিকিৎসাকেন্দ্রে রাখতে যাচ্ছি।’
কক্ষটিতে ভয়ঙ্কর নীরবতা এসে ভর করলো।

 

কিভাবে সে প্রায়শই ঠিক ছিল
লিডিয়া ডেভিস

প্রায়ই আমি ভাবি যে আমরা কি করবো না করবো এ ব্যাপারে তার ধারণাটা ভুল এবং আমারটাই ঠিক। যদিও আমি জানি, আগে তার অনেক সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল। এবং ভুল আগে আমিও খানিকটা করেছি। কাজেই আমি তাকে ঐ ভুল সিদ্ধান্তটা নিতে দিই; নিজেকে বোঝায়, যদিও আমি তখনো মনে করি না যে তার ভুল সিদ্ধান্ত কখনো সঠিক হতে পারে। পরে দেখা গেলো, আগেও এমন হয়েছে, তার সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল। মোটের ওপর তারপরও তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। কিন্তু তা ভুল ছিল প্রকৃত অবস্থাভিন্ন অন্য কোনো পরিস্থিতির জন্যে। সেই একই সিদ্ধান্ত আবার সঠিক ছিল এমন সব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যেগুলো আমি কখনই পরিস্কারভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।

 

কথা
স্বপ্নময় চক্রবর্তী

আমি বনগাঁ লাইনের গোবরডাঙা শ্যামসুন্দর বিদ্যামন্দিরের মাস্টার। চারটে ছ’য়ের ডাউন বনগাঁ লোকালে উঠে বাড়ি ফিরি। একটা নির্দিষ্ট কামরা আছে আমাদের। মছলন্দপুর থেকে দুজন মাস্টারমশাই ওঠেন। ওই দুজনের জন্য জায়গা রাখি।
যে কামরায় উঠি, সেই কামরার জানালার ধারে মুখোমুখি সিটে একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা বসেন। ভদ্রলোক বই পড়েন, ভদ্রমহিলাও বই পড়েন। ভদ্রলোকটি কী বই পড়েন আড়চোখে দেখেছি। রামকৃষ্ণ কথামৃত, ভারতের সাধক, চৈতন্যচরিতামৃত এইসব। ভদ্রলোকটির বয়েস ষাটের মতো, ভদ্রমহিলারও প্রায় ওরকম। ভদ্রলোকের মাথায় টাক, ভদ্রমহিলার মুখে শ্বেতির চিহ্ন। ওরা দুজনে একই কামরায়, একই ট্রেনে বহুদিন। ভদ্রমহিলাও পড়েন। নব কল্লোল, বুদ্ধদেব গুহ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা। কোনোদিনই কথা বলতে দেখিনি ওদের। ভদ্রমহিলা হৃদয়পুর স্টেশনে নেমে যান। স্টেশনে ট্রেনটা ঢুকবার একটু আগে ভদ্রমহিলা সিট ছেড়ে উঠে রোজই বলেন- এসে গেলাম, আসি। আবার কাল কথা হবে কেমন?
ভদ্রলোক বই থেকে চোখ তুলে বলেন- হ্যাঁ, আবার কাল কথা হবে।

 

ক্ষুধা‬
ভাস্কর চৌধুরী

তিনটে লোক কোদাল আর শাবল হাতে রাতে বাড়ি ফিরছে। তারা কৃষক। সহজ সরল মানুষ। বাড়িতে মাঝরাতে ভাত পাবে এমন আশা নেই অথচ পেটে ক্ষিধে। তারা একে অন্যকে বললো- কি করি রে ? খিদা যে। আরেকজন বললো- ঘরে ভাত নাই। বলতে বলতে এক মহাজনের বাড়িতে এলো। শীতের রাত। নিশ্চয় কেউ জেগে নেই। সীমানা দেয়ালটা নরম ইটের। একজন বললো- চল সিঁদ কাটি। তারা সিঁট কাটতে বসলো। ধীরে গুতো দিতেই দু-চারটে ইট সরে গেলো। তখন তাদের একজন ইট ধরে রাখে আরেকজন কাটে। প্রায় অল্পতেই ফাঁক পাওয়া গেলো। রান্নাঘরটা উঠোনে মাঝখানে। খড়ের ছাউনি। ভেজানো কপাট। বিড়ি খাওয়া ম্যাচ জ্বালিয়ে তারা ভাতের হাঁড়ি পেলো। ডালিতে পেঁয়াজ মরিচ। মুচিতে লবণ তারা একটা করে থালা নিয়ে নিঃশব্দে পান্তা ভাত পেঁয়াজ দিয়ে নিঃশব্দে খেলো। পেট টুবটুব করছে। তারা যেমন এসেছিলো, রান্না ঘরে শেকল তুলে দেয়ালে ফুটো দিয়ে বেরিয়ে গেলো। একজন বললো- আহা, বড় খিদা ছিলো রে। আরেকজন বললো- চুরি করিনি। চাইলেই দিতো। এতো রাইতে কে ডাকে ? তৃতীয়জন বমি করতে করতে বললো, কামটা ঠিক হইছে কি?
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆


দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
                 পাশাঙ্কুশা একাদশী মাহাত্ম্য 
============√√√√√√√√√==========
Doinik Sabder Methopath
Vol -173.Dt -27.10.2020
৯ কার্তিক,১৪২৭. মঙ্গলবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷||||||||||||÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বর্ণিত আছে। যুধিষ্ঠির বললেন- হে মধুসুদন! আশ্বিন শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি?
.
তদুত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে রাজেন্দ্র! আশ্বিনের শুক্লপক্ষীয়া একাদশী ‘পাশাঙ্কুশা’ নামে প্রসিদ্ধা। কেউ কেউ একে পাপাঙ্কুশাও বলে থাকেন।
.
এই একাদশীতে অভিষ্ট ফল লাভের জন্য মুক্তিদাতা পদ্মনাভের পূজা করবে। শ্রীহরির নাম-সংকীর্তন দ্বারা পৃথিবীর সর্ব তীর্থের ফল লাভ হয়। বদ্ধ জীব মোহবশত বহু পাপকর্ম করেও ভগবান শ্রীহরির শরণাপন্ন হয়ে প্রণাম নিবেদনে নরকযাতনা থেকে রক্ষা পায়। 
.
এই একাদশীর মহিমা শোনার ফলে নিদারুণ যমদণ্ড থেকে মুক্তি লাভ হয়। শ্রীহরিবাসর ব্রতের মতো ত্রিভুবনে পবিত্রকারী আর কোন বস্তু নেই। হাজার হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ এবং শত শত রাজসূয় যজ্ঞ এই ব্রতের শতভাগের একাংশের সমান হয় না। এই ব্রত পালনে স্বর্গবাস হয়। মুক্তি, দীর্ঘায়ু, আরোগ্য, সুপত্নী, বন্ধু প্রভৃতি অনায়াসে লাভ করা যায়।
.
-হে রাজন! গয়া, কাশী এমনকি কুরুক্ষেত্রও শ্রীহরিবাসর অপেক্ষা পূণ্যস্থান নয়। হে ভূপাল! একাদশী উপবাস ব্রত করে রাত্রি জাগরণ করলে অনায়াসে বিষ্ণুলোকে গতি হয়। এই পাশাঙ্কুশা ব্রতের ফলে মানুষ সর্বপাপ মুক্ত হয়ে গোলোকে গমন করতে সমর্থ হয়।
.
এই পবিত্র দিনে যিনি স্বর্ণ, তিল, গাভী, অন্ন, বস্ত্র, জল, ছত্র, পাদুকা দান করেন, তাকে আর যমালয়ে যেতে হয় না। যারা এসকল পুণ্যকার্য করে না, তাদের জীবন কামারশালার হাপরের মতো বিফল। নিষ্ঠার সাথে এই ব্রত পালনে উচ্চকুলে নিরোগ ও দীর্ঘায়ু শরীর লাভ হয়। 
.
অত্যন্ত পাপাচারীও যদি এই পুণ্যব্রতের অনুষ্ঠান করে তবে সেও রৌরব নামক মহাযন্ত্রনা থেকে মুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠসুখ লাভ করে।কৃষ্ণভক্তি লাভই শ্রী একাদশী ব্রতের মুখ্য ফল। তবে আনুষাঙ্গিকরূপে স্বর্গ, ঐশ্বর্যাদি অনিত্য ফল লাভ হয়ে থাকে।

একাদশী কি এবং তা কেন পালন করা হয় -

পদ্মপুরাণে একাদশী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। একসময় জৈমিনি ঋষি তার গুরুদেব মহর্ষি ব্যাসদেবকে জিজ্ঞেস করলেন, হে গুরুদেব! একাদশী কী? একাদশীতে কেন উপবাস করতে হয়? একাদশী ব্রত করলে কী লাভ? একাদশী ব্রত না করলে কী ক্ষতি? এসব বিষয়ে আপনি দয়া করে বলুন।
মহর্ষি ব্যাসদেব তখন বলতে লাগলেন- সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর ভগবান এই জড় সংসারে স্থাবর জঙ্গম সৃষ্টি করলেন। মর্ত্যলোকবাসী মানুষদের শাসনের জন্য একটি পাপপুরুষ নির্মাণ করলেন। সেই পাপপুরুষের অঙ্গগুলি বিভিন্ন পাপ দিয়েই নির্মিত করলেন। সেই পাপপুরুষের অঙ্গগুলি বিভিন্ন পাপ দিয়েই নির্মিত হলো। পাপপুরুষের মাথাটি ব্রহ্মহত্যা পাপ দিয়ে, চক্ষুদুটি মদ্যপান, মুখ স্বর্ণ অপহরণ, দুই কর্ণ- গুরুপত্নী গমন, দুই নাসিকা- স্ত্রীহত্যা, দুই বাহু- গোহত্যা পাপ, গ্রীবা- ধন অপহরণ, গলদেশ- ভ্রুণহত্যা, বক্ষ- পরস্ত্রী-গমন, উদর- আত্মীয়স্বজন বধ, নাভি- শরণাগত বধ, কোমর- আত্মশ্লাঘা, দুই ঊরু- গুরুনিন্দা, শিশ্ন- কন্যা বিক্রি, মলদ্বার- গুপ্তকথা প্রকাশ পাপ, দুই পা- পিতৃহত্যা, শরীরের লোম- সমস্ত উপপাতক। এভাবে বিভিন্ন সমস্ত পাপ দ্বারা ভয়ঙ্কর পাপপুরুষ নির্মিত হলো।
পাপপুরুষের ভয়ঙ্কর রূপ দর্শন করে ভগবান শ্রীবিষ্ণু মর্তের মানবজাতির দুঃখমোচন করার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। একদিন গরুড়ের পিঠে চড়ে ভগবান চললেন যমরাজের মন্দিরে। যমরাজ ভগবানকে উপযুক্ত স্বর্ণ সিংহাসনে বসিয়ে পাদ্য অর্ঘ্য ইত্যাদি দিয়ে যথাবিধি তাঁর পূজা করলেন।
যমরাজের সঙ্গে কথোপকথনকালে ভগবান শুনতে পেলেন দক্ষিণ দিক থেকে অসংখ্য জীবের আর্তক্রন্দন ধ্বনি। প্রশ্ন করলেন এ আর্তক্রন্দন কেন?
যমরাজ বললেন, হে প্রভু, মর্তের পাপী মানুষেরা নিজ কর্মদোষে নরকযাতনা ভোগ করছে। সেই যাতনার আর্ত চীৎকার শোনা যাচ্ছে।
যন্ত্রণাকাতর পাপাচারী জীবদের দর্শন করুণাময় ভগবান চিন্তা করলেন আমিই সমস্ত প্রজা সৃষ্টি করেছি, আমার সামনেই ওরা কর্মদোষে দুষ্ট হয়ে নরক যাতনা ভোগ করছে, এখন আমিই এদের সদ্‌গতির ব্যবস্থা করব।
ভগবান শ্রীহরি সেই পাপাচারীদের সামনে একাদশী তিথিরূপে এক দেবীমূর্তিতে প্রকাশিত হলেন। সেই পাপীদেরকে একাদশী ব্রত আচরণ করালেন। একাদশী ব্রতের ফলে তারা সর্বপাপ মুক্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ বৈকুণ্ঠ ধামে গমন করল।
শ্রীব্যাসদেব বললেন, হে জৈমিনি! শ্রীহরির প্রকাশ এই একাদশী সমস্ত সুকর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সমস্ত ব্রতের মধ্যে উত্তম ব্রত।

একাদশী ব্রত নিয়ে কিছু কথা :

1) একাদশী ব্রত সর্বোত্তম। শ্রবণ, স্মরণ, কীর্তন ইত্যাদি নবধা ভক্তির পরই একাদশীর অবস্থান।।
(2). শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর লীলা বিলাসের প্রথম থেকেই একাদশী ব্রত পালনের উপর জোর দিয়েছিলেন।।
(3). মোট ছাব্বিশটি একাদশী আছে। প্রতি মাসে দুটি একাদশী হলে বছরে চব্বিশটি। কিন্তু যে বছর পুরুষোত্তম, অধিমাস বা মলো মাস, সেই মাসে পদ্মিনী ও পরমা নামে আরও দুটি একাদশীর আবির্ভাব হয়।।
(4). আট বছর থেকে আশি বছর বয়সের যে কেউই এই একাদশী পালন করতে পারে।।
(5). জন্ম মৃত্যুর অশৌচে কখনোই এই একাদশী পরিত্যাগ করতে নেই।
(6). শুধু এই একাদশী পালন করেও মানুষ শনির প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে পারে।।
(7). একাদশীর ব্রত পালনে যে ফল লাভ হয় অস্বমেধ, রাজশূয় ও বাজপেয় যজ্ঞের দ্বারাও সেই ফল লাভ হয় না।
(8). ভুলক্রমে একাদশী ভঙ্গ হয়ে গেলে ক্ষমা ভিক্ষা করে তা চালিয়ে যাওয়া উচিৎ।
(9). একাদশীর দিনগুলো হলো চরিত্র সংশোধনের দিন। পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যাচার, ক্রোধ, দুশ্চিন্তা এবং সকল প্রকার কলহ বিবাদ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।।
(10). এইদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে মঙ্গল আরতি করতে হয়। মা এবং বোনেরা এই সময় রজচক্রের মধ্যে থাকলেও একাদশী পালন করতে পারবেন।।
(11). একাদশীর দিন ক্ষৌরকর্মাদি নিষিদ্ধ।।
(12). অহংকার বশত একাদশী ব্রত ভঙ্গ করলে তাকে নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়।
(13). শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তদের একাদশীর দিন নূন্যতম পঁচিশ মালা জপ করতে বলেছেন।।
(14). অনাহারে থেকে হরিনাম করে, হরিকথা বলে ও রাত্রি জাগরণ করে মালা জপ করতে হয়।।
(15). একাদশীতে শ্রাদ্ধ আসলে তা এইদিন না করে দ্বাদশীতে শ্রাদ্ধ করা উচিৎ।।
(16). এই উপাচার শুধু বৈষ্ণবের জন্য নয়, সনাতন ধর্মাবলম্বী সকলেরই এই ব্রত পালন করা অবশ্য কর্তব্য।
(17). পরিশেষে, বলব, একাদশীর উপবাস মানে কি। লুনার সাইকেলের এগারতম দিনে হয় এই উপবাস। উপ মানে হলো নিকটে আর বাস মানে হলো অবস্থান করা। অর্থাৎ, শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষের এগারতম দিনে পরমেশ্বর ভগবানের সাথে অবস্থান।। সুতরাং, এই দিন শুধু না খেয়ে থাকলেই হবে না, ভগবানের নাম জপ করতে হবে ও সকল পাপাচার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে।। হরেকৃষ্ণ।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Monday, 26 October 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ। বিজয়া

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
                     সম্প্রীতির কবিতা
 বিজয়াদশমীর প্রণাম প্রীতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন
=================================
                Doinik Sabder Methopath
                Vol -171. Dt -26.10.20
              ৮ কার্তিক, ১৪২৭.সোমবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
বিন্দু বিন্দু 
মহাদেব চক্রবর্তী 

শিকড় থেকে উপড়ে ফেলা চারাগাছ 
এখানে সেখানে নিতান্ত অবহেলায় 
খুঁজে যায় মাটির সন্ধান ।
মাটি যদিও পাওয়া গেল অভাব 
খাদ্য পানীয় আর নির্মল বাতাস 
প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা জীবন 
বার বার আছড়ে পড়েছে প্রবল ঝড়
মোচড় দিয়ে গেছে প্রত্যেক বার
স্থির লক্ষ্যে ছাড়েনি কখনও হাল 
এক থেকে দুই চার আট অগুনন 
ছোট মাঝারি বড় বীজ থেকে গাছ 
ডাল পালা মাথা নুইয়ে জানায় সেলাম ।


+++++++++++++++++++


বার্তা ছড়ায় বাতাস
     চন্দনা ঘাঁটী।

পেঁজা তুলোর মেঘ ছাওয়া গগন খুশিতে ভরা
কাশ শিউলির ঝরা আভাষ -মা আসছে ত্বরা।
এবার এসে দেখবি কি মা,অতিমারি করোনা ঝড়?
ছোঁয়াছুঁয়ির বিধিনিষেধ আর এই আনন্দহীন ঘর!
তবু সন্তানেরা সাজায় মণ্ডপ ,ষষ্ঠী বোধনে ডাকবে
সপ্তমীতে কলাবৌ-স্নান,পূজায় গণেশ পাশে থাকবে।
ঝাঁঝ কাঁসর ঢাকে পূজা সপ্তমীতে,পূজকের মুখে মাক্স
করুণ আঁখিতে তাকিয়ে মা,ফেলছে ভয়ে   দীর্ঘশ্বাস।

দুরত্ব বিধি মানতে গিয়ে চঞ্চল -মন যায় দূরে
অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি পায় না মা,অন‍্য চরণে ঘুরে!
নিশি অবসানে আসিবে নবমী সন্ধিপূজার সমাপনে
ভক্ত প্রাণ আকুলি বিকুলি যেয়ো না,থেকো আলাপনে।

ভরা‌ সংসারে এসে মা তুই,কি দেখলি এই ধরায়
ভয় ভক্তি ভরা মণ্ডপে-সন্তানেরা কেন অশ্রু ঝরায়?
দানধ‍্যান মেলা উৎসব সবকিছু কেমন ফাঁকা
অন্ন বস্ত্র‍ বিতরণ নেই সবে ক্ষতের চিহ্ণ আঁকা!

আর ক"টা দিন থেকে যা মা,নিওনা বিদায় দশমীতে
রাবণ পুড়ানো দেখব না আজ কোলাকুলি সারি নিভৃতে।
আশায় আশায় রই ,পুরাবে বাসনা প্রকৃতি আবার হাসবে
রাম রাবণের যুদ্ধ শেষে,করোনা যুদ্ধ থামবে।


---------০-------০------০--------০-------০-------০

সম্প্রীতির বন্ধন 
   গোবিন্দ মোদক 

মনে পড়ে ছোটোবেলার সেই সে গ্রামের কথা,
সবাই মিলে একই সাথে থাকার ব্যাকুলতা !
রাম আর রহিম একই সাথে পাঠশালাতে যেতো, 
একটা আম কুড়িয়ে পেলে দুই ভাইয়েতে খেতো ! 
ভোরের মধুর আজান-ধ্বনিতে ভাঙতো সবার ঘুম, 
চাষের মাঠে, মাছ ধরাতে কাজের বড়ই ধুম !
সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরেতে বাজতো কাঁসর-ঘন্টা, 
রাম, রহিম আর জনসনের উদাস হতো মনটা !
রবিবার এসে গেলেই গির্জায় উপাসনা, 
সেসব কথা মনে পড়লেই মন হয় আনমনা !
ঈদ, মহরম হলেই আমন্ত্রণ পেতো হিন্দু ভাই, 
পুজোর ঠাকুর দেখতো সবাই বাছ-বিচারটা নাই !
সত্যনারায়ণের শিন্নি পেতো আমিনা, জাহানারা,
পীর-দরগায় করতো মানত সারা হিন্দুপাড়া !
থাকতো সবাই মিলেমিশে যেন ভাই ভাই, 
সম্প্রীতির এই বন্ধনেতে দিন যে কেটে যায় !
রাম, রহিম, জনসন ----- সবার রক্তই লাল ,
সম্প্রীতির এই স্নেহবন্ধন থাকুক চিরকাল !!ঞ

+++++++++++++++++++




প্রতীকি
প্রসাদ সিং


মোমবাতির দিকে তাকিয়েছিলাম একমনে 
রাষ্ট্রের কথা মনে পড়লো 
আসলে সব খেলা কেনা সংখ্যাগরিষ্ঠতার 
এদেশের কিস্যু হবে না বলে আপনি ঘুমোন 
ওদিকে রাষ্ট্রই আপনার বালিশে তুলো গুঁজে দেয় 
নাকের তেল টা আপনার নিজের পায়ের

কাশ্মীরের তুলো বগলের চুলে মিশে যায় এখানে 
মোমবাতির নীচের অন্ধকারটা গাঢ় হচ্ছে রোজ 
রাষ্ট্র শুধু প্রতীকি উন্নয়ন করে চলেছে 

-+++++++++++++++++++++++

সম্প্রীতি
নন্দিনী সরকার

বন্ধন শুধু কথায় হয় না মনেতে বাঁধতে হয়,
হৃদয় মিলনে মানুষের কাছে সম্প্রীতি ধরা দেয়।

"সবার উপর মানুষ সত্য " সবচেয়ে দামী কথা,
মুচি ,মেথর ,দলিত ,বেনে ,সবার একই ব্যাথা।

দুর্গা ,কালী ,নানক ,কবীর , মহম্মদের তরজা
জন্ম থেকে এগুলো দিয়েই মানুষকে করে কব্জা।

মনের মিলনে পরের তরে যদি কেউ ঝাঁপ দেয়,
শাসকের তবে ভয় বেড়ে যায়, বুক দুরু দুরু হয়। 

বিজ্ঞাপনের ভুল বুঝিয়ে শত্রু খাড়া ক'রে--
হাত পা কাটলে একই রক্ত ক্ষত থেকে ঝরে পরে!!

ফুল ,লতা পাতা ,আকাশ, বাতাস, ঝর্নার গান গাও-মানুষের তরে আমরা মানুষ এটা যদি ভুলে যাও

কিসের সমাজ কিসের শিক্ষা কোথায় বিবেক বলো ??
তার চেয়ে ভাই হাতে হাত রেখে মিলনের পথে চলো 
সীমানা, আইন, যুদ্ধ, বিভেদ যাতে হানাহানি চলে---
অস্ত্র বেচে মুনাফা লোটা আসলে একেই বলে।

সভ্য মানুষ সামনে বাড়ো ,হিংসা দ্বেষ ভুলে,
মানবতা দিয়ে গোঁড়ামিকে আজ সাগরেই ছুঁড়ে ফেলে।

+++++++++++++++++++++

মানুষ পরিচয় 
 পার্থ সারথি চক্রবর্তী 

শরতের কাশফুল আর শিউলির সমাহার।
আকাশের সাদা মেঘেরা নরম ইশারায় 
কানে কানে বলে, ভেজাও-
আমায় ভেজাও ভালবাসার শান্তিধারায় ।
মিটিয়ে দাও মানুষে মানুষে দূরত্ব, 
বেঁধে দাও এক বিশ্বাসের সুতো দিয়ে,
গড়ে দাও এক চিরস্থায়ী সাঁকো ।

মানবতার বন্ধন যেন ভুলিয়ে দেয়-
                                     সব ভেদাভেদ।
একটাই পরিচয়ে যেন বাঁচি সবাই-
                                     মানুষ, শুধু মানুষ।
আমায় মানুষ করে দাও, মা-
                                       শুধুই মানুষ ।

++++++++++++++++++++

 বিজয়া দশমী
নীতা সরকার

শেষ হলো নবমী
আজ বিঁজয়া দশমী। 

মা দুর্গা আজ মর্ত্য ছেড়ে
যাবেন কৈলাসে গজে চড়ে। 

আকাশে বাতাশে
বিষাদের সুর ভাসে। 

সকলের হ্নদয় ভারাক্রান্ত
নয়ণও অশ্রু ভারাক্রান্ত। 

বিদায় জানাই মাকে
বরণ করে তাঁকে। 

শঙ্খ ঘন্টা বাজিয়ে
উলুধ্বনি দেয় ভরিয়ে। 

সিঁদুর পরাণ কপালে
মিষ্টান্ন দেন মুখে। 

জয় মা দুর্গা বলে 
বলেন কানে কানে--

সবাইকে সুস্থ রেখো
আবার তুমি এসো। 

সবশেষে কোলাকুলি, প্রণাম
মিষ্টান্ন দিয়ে বিঁজয়া করলাম।

+++++++++++++++++++±+

খিদে
ফটিক চৌধুরী

দিন এভাবে যাপিত হলে
                               খিদে পাবে না কোনদিন
খিদে পাওয়ার জন্য মানুষ অনেক পথ হাঁটবে
                       রাস্তা খুঁজে পাবে না কোনদিন
খিদে কে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে
                          কেউ জানে না। কাকে বলি ?
কেউ আছে মন্দির মসজিদ নিয়ে
                 কেউ এগোচ্ছে চেয়ারের অঙ্ক কষে।
নাকি নীরব মোদি? বিজয় মাল্য?
                            তারাই তো আসল পরিযায়ী
বরং আম্বানীদের বলি : তোমরা তো
                                       সব কিছু তৈরি করো
একটু খিদে তৈরি করে দাও না।

+++++++++++++++++++++++++++++++++
মানুষের কথা।
দুর্গাদাস মিদ্যা।

না কোনো দেবতার কথা বলবো না
          বলবো মানুষের কথা
             যে মানুষ বাড়িয়েছে
                পৃথিবীর সম্মান।
        অচল অটল পৃথিবীর বুকে
      যে বা যারা দিয়েছে প্রাণের সন্ধান
              সেই মানুষের কথা শোনাতে চায় প্রাণ।
               ভালোবেসে যারা ফলিয়েছে ফসল
                  সোনার মাটিতে
               ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে শুধু সৈন্য সমাবেশ
                নয় উড়িয়েছে যাঁরা শান্তির পারাবত
                  এই সুনীল আকাশে আমি
                  তাঁদের কথা বলতে চাই ভালোবেসে।  
                 বুদ্ধ চৈতন্য অথবা যীশু
                   মানব শিশুকে যাঁরা দেবত্ব করেছেন
                     দান আমি আজ তাঁদের কথা
                     বলবো। না কোনো দেবতার কথা
                       নয় মানুষ হয়ে আমি পেতে
                         চাই মানুষের পরিচয়।  
+++++++++++++++++++++++++

বিভূতি 
লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল 

বায়ুর সাথে নিশ্বাস মিশে গেলেই বৃষ্টিপাত ঝমঝম , 
অতীব সঙ্গমে এই চোখে থাকে অচিন্ত্য অবস্থান ; 
জোরে জোরে শ্বাস নিলে সে দূর থেকে সুদূরে - 
অতল মন্ত্রে শূন্য নামে পৃথিবীময় হৃদয়গুহায়  

যত চন্দন ও শালুকের রিয়েলিজম তার ভেতরেই 
সন্ধিকাল , নিয়মিত শুদ্ধতা ও ক্রমে সাদা -  
রূপ তার নিঝুম আর সুক্ষতর ফসফরাস -সে অন্তি :  
পাখিটির নিরাশ্রয় আকাশ নিয়ে দেখে নেয় দীপ্তির গুণিতক - 

++++++++++++++++++++++





Sunday, 25 October 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ।অনুনাটক

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
                       অনু নাটক 

     মহানবমীর প্রীতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন

$$$$$$$$$$$$$$✓✓✓✓$$$$$$$$$$$$$
                 Doinik sabder methopath
                Vol -170.Dt -25.10.2020
                 ৭ কার্তিক,১৪২৭. রবিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷|||||||÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷


পুজোর ভালো-মন্দ 
  গোবিন্দ মোদক 

                 (কুশীলব: দুই বন্ধু রাজু ও রবি)

রাজু : সে তুই যাই বলিস ভাই, পুজো মানেই অপচয় ! এই যে এতো টাকার প্যান্ডেল, আলোকসজ্জা, বাজি-পটকা পোড়ানো --- তারপরেই তো বিসর্জন ! ব্যাস, সবকিছুর জলাঞ্জলি !
রবি : তোর ভাবনাটা ঠিক নয়, ভাই ! তুই শুধু অপচয়ের কথাই ভাবছিস, অথচ এই পুজোর কতো গুরুত্ব জানিস ! আমাদের এই আর্থ-সামাজিক পটভূমিকায় একটা পুজোয় যে লেনদেন হয় আর "এনরোলমেন্ট অফ মানি" অর্থাৎ যতোবার টাকার আবর্তন হয়, তাতে করে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুত হয় !
রাজু : আরে রাখ তোর বইয়ে পড়া ডায়লগ !
রবি : ডায়লগ নয় রে ভাই ! এই দেখ, তাহলে কথাটা ভেঙেই বলি --- একজন কুমোর ঠাকুর তৈরি করলে একজন শ্রমিক তাকে মাটির যোগান দিয়ে কিছু পয়সা পায়। কিছু বিচুলি বা খড়, বাঁশ, দড়ি, রঙ, সাজ ইত্যাদি বিক্রি হয়। শোলাশিল্পীরা সাজ তৈরি করে কিছু পয়সা পায় --- এরা সবাই সেই টাকা দিয়ে জামা-কাপড়, সাজের জিনিস, খাবার-দাবার ইত্যাদি কেনে, যানবাহন চড়ে, আমোদ-আহ্লাদ করে। পুজো প্যান্ডেলে বহু শ্রমিক কাজ করে, আলোক-শিল্পী, মণ্ডপ-শিল্পী ---- এরা সবাই দু'টো পয়সা পায়। ঢাকী, বাজনদার, পুরোহিতরাও কিছু রোজগার করে --- সেই রোজগারের অর্থ তারা খরচ করে বলে সেই টাকা অর্থনীতিতে বারবার আবর্তিত হয়।
রাজু : আর কিছু ?
রবি : আরও আছে। পুজোতে বেলুনওয়ালা, বাজি-পটকার স্টল, তেলে-ভাজা, খাবারের স্টল, ফুল-দশকর্মার দোকান থেকে শুরু করে সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরের মানুষ কিছু না কিছু রোজগার করে। আর এই রোজগার অর্থনীতিতে আবার ফিরে এসে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। কাজেই পুজোর এই পরোক্ষ অবদানসমূহকে কিছুতেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

+++++++++++++++++++++++
অপেক্ষা 
 পার্থ সারথি চক্রবর্তী 

( কুশীলব-১৷ মিত্তির বাবু, এক পৌড়। ২৷ শোভা, মিত্তিরের পুত্রবধূ। ৩৷ ভাষ্কর, মিত্তিরের ছেলে। ৪৷ রনি, মিত্তিরের নাতি।)



মিত্তির বাবুর মেজাজ ক'দিন ধরে খ্যাপা। পুজোর কটা দিন মাইকে চিৎকার, রাস্তাঘাট বন্ধ। আড্ডাও নেই ।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে পৌছে-
' বৌমা, একটু চা দাও তো। '
'আসছি বাবা।' ব'লে শোভা এক কাপ চা আর খবরের কাগজ এগিয়ে দিল।
রিটায়ার করার পর গত পাঁচ বছর সকালে এভাবেই শুরু হয় মিত্তিরের।
' তাড়াতাড়ি দাও। আজ আবার মেট্রো কম।' জামা পড়তে পড়তে ভাস্কর তাড়া দেয়। শোভা ব্রেকফাস্ট সাজায়। 
'তোর অফিস আজই লাস্ট? ' জানতে চায় মিত্তির ।
' না বাবা। কালও আছে। এত ভীড়! তুমি আর আজ বেড়িও না।'
' না না। কোথায় আর! ভাল্লাগে না! এত আলো, গান । কিন্তু প্রাণ পাই না! আমাদের সময় ......'।
'বাবা প্লিজ ।' ভাস্কর থামায়। বিলক্ষণ জানে, নাহলে বাবা আবার শুরু হয়ে যাবে ....।
 এমন সময় ঠুসঠাস ক্যাপ ফাটাতে ফাটাতে নিচে আসে একমাত্র নাতি রনি। তার ভীষণ আনন্দ!
'আচ্ছা বাবা আজ আপনার পছন্দের ব্রেকফাস্ট। লুচি তরকারি। ' শোভা মুচকি হেসে বলে।

মিত্তিরের হাসি ফোটে। অনেক অসুবিধা হয় বই কি । ওষুধ আনা, বাইরে যাওয়া । ভীড়, চেঁচামেচি । তাও এই ক'দিন একটু নিয়মের শিথিলতা। 

পছন্দের খাওয়া। নাতির সঙ্গে খেলা। খালি একটু ভাষ্করের জন্য চিন্তা!

কত কত মানুষ তো এই ক'টা দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকে সারা বছর।


++++++++++++++++++++++++
আসুরিক
ফটিক চৌধুরী

মা দুগ্গা : এবার খুব বাজে অবস্থা গনশা। বাজার খারাপ ।বেওসা একদম লাটে উঠেছে। 

গনেশ : তুমি তো বাজারের কথা বলছ, আমি কি করে যাই বলো তো ? আমি তো মাস্ক পরতেই পারব না? তাই না কেতো! খুব রিস্কি হয়ে যাবে।

কার্তিক : ঠিক বলেছিস দাদা। এবার ক্যানসেল হলে ভালো। মহালয়ার একমাস পর পুজো।সেজে গুজে যাব, মাস্ক পরে? সুন্দর মুখটাই ঢাকা!

লক্ষ্মী : আমার তো হাড় হিম করা অবস্থা। ভাঁড়ার শূন্য।

সরস্বতী : আমারও তো স্কুল কলেজ বন্ধ। সব অনলাইনে? কী জবাব দেব ওখানে গিয়ে!

মহিষাসুর : তোমাদের দিন শেষ। দশভূজার সব অস্ত্রই ভোঁতা। যা ভাইরাস ছেড়েছি না? ভালোর দিন শেষ। এখন আমাদের রাজত্ব।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆


শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ।‌ একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। Dt -26.11.2024. Vol -1059. Tuesday. The blogger post in literary e magazine.

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়   (২৬ নভেম্বর ১৮৯০ — ২৯ মে ১৯৭৭)  একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ.  মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্...