পরপারে রবীন্দ্রনাথ
পর্ব -৩
(২২ শে শ্রাবণ স্মরণে রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত সংকলন।)
¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶¶
Doinik Sabder Methopath
Vol -95 . Dt - 10.8.2020
২৫ শ্রাবণ ১৪২৭.সোমবার।
££££££££££££££££££££££££££££££££
পরপারে রবীন্দ্রনাথ ও এক বিদেশিনী
শ্রী রণজিৎ দাস
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
" তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুন হাতে
সরল জীবন
এই প্রবঞ্চনা নিয়ে মহত্বের করেছ চিহ্নিত
তার তরে রাখনি গোপন রাত্রি।"
রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন তার শেষ কবিতা। ১৯৪১ সালের ৩০ জুলাই. অপারেশন টেবিলে যাবার ঘন্টা তিনেক আগে। অসুস্থ, জীবন পীড়িত কবি নিজ হাতে লেখার ক্ষমতা হারিয়েছেন । তখন কবির পাশে বসে ছিলেন শ্রীমতি রানী চন্দ। তিনি কবিতাটি লিখেছিলেন শুনে শুনে। লেখা শেষ হলে কবি বললেন-
" রানী কিছু গোলমাল আছে পরে ঠিক করব খন। "
কিন্তু শেষ রচনা সংশোধন করার সময় এলোনা কবির। এরপর পট পরিবর্তন হতে লাগলো দ্রুত ।অপারেশনের দুদিন পরে অর্থাৎ ৩রা আগস্ট কবির অবস্থার চরম অবনতি ঘটলো। ৫ ই আগস্ট থেকে কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন কবি। ৭ ই আগস্ট ১৯৪১ সাল বাংলা বাইশে শ্রাবণ ১৩৪৮ , ১২.১০ মিনিটে কবির সমস্ত যন্ত্রণার অবসান হলো। রবি অস্তমিত হলেন।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সংবাদ দুজন বিদেশীনিকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। এদের একজন আর্জেন্টিনার দুহিতা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এবং অন্যজন জাপান দুহিতা টোমি ওয়াডা। ভিক্টোরিয়া প্রচারের আলোয় এসেছেন বহুবার কিন্তু ওয়াডা প্রচার পাননি সেভাবে। সুতরাং আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব টোমি ওয়াডার বিষয়ে।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সংবাদ টোমি র কাছে পৌঁছে ছিল অনেক পরে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই বিদেশিনীর চিঠি আদান-প্রদান হতো প্রায়ই। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। হিরোশিমায় যখন বোমা পড়ে তখন তিনি ভেবেছিলেন গুরুদেব হয়তো এতে ভীষণ কষ্ট পাবেন। কিন্তু পরে জেনেছিলেন গুরুদেব তার আগেই প্রয়াত হয়েছেন। প্রবল আঘাত পান তিনি ।স্মৃতিমেদুরতায় ভুগতে থাকেন তিনি ।ফিরে যান আগেকার স্মৃতিতে।
সালটার ১৯১৬ ।রবীন্দ্রনাথ এসেছেন জাপানে। কবিকে সেই প্রথম দেখা তার। তখন তার বয়স কুড়ি বছর। কলেজ ছাত্রী। রবীন্দ্রনাথ সেই কলেজেরই বক্তৃতা দেবেন। কলেজের মেয়েরা এক্সকারশনে যাবে কারুইজাওয়া পাহাড়ে। কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে সঙ্গী হলেন রবীন্দ্রনাথ ।পাহাড়ে কয়েকদিনের সঙ্গ, কুড়ি বছরের ওই তরুণীকে আচ্ছন্ন করে দিল। রবীন্দ্রনাথের বিদায়ের ক্ষণে চোখে জল। দেশে ফিরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এক চিঠি- কত কথা কত আনন্দঘন মুহূর্তের স্মৃতি মনে পড়ে তার।
সালটা১৯১৯ । রবীন্দ্রনাথ গেছেন আমেরিকায় । ওয়াদা তখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী । খবর পেয়ে উপস্থিত রবীন্দ্রনাথের হোটেলে। আরো ঘনিষ্ঠ হলেন। এরপর কেটে গেছে কয়েকটা বছর। ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন এক দীর্ঘ চিঠি। চিঠির শেষে লিখলেন- " তোমার বন্ধু রবীন্দ্রনাথ".
১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন চীন ভ্রমণে গেছেন তখন ওয়াডার আমন্ত্রণ জাপানে আসার। রবীন্দ্রনাথ সে আমন্ত্রণ উপেক্ষা করেননি ।গেছিলেন জাপানে । সেই সময়কার এক কৌতুককর স্মৃতি এখনো তার মনে গেঁথে আছে । - সেবারে জাপানের এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথই ইংরেজিতে বক্তৃতা দিচ্ছেন। দিচ্ছেন তো দিচ্ছেন আর থামতে চাইছেন না । ভালো ইংরেজি জানার জন্য দোভাষীর কাজ করছিলেন ওয়াদা। রবীন্দ্রনাথ একটানা বক্তব্য দেওয়ায় ইংরেজি থেকে জাপানি ভাষায় তরজমা করার অবকাশ পাচ্ছিলেন না। শেষে রবীন্দ্রনাথের পেছনে জেব্বা র একটু টান দেন ওয়াদা। কবি বক্তৃতা থামান। শুরু হয় জাপানি তরজমার কাজ। সভা শেষ হলে রবীন্দ্রনাথ খুব খুশি, হাসতে হাসতে বললেন- " তুমি দেখছি আমার মত কবিকে পকেট এ পুরে ফেলেছো - "This is young girl puts the great poet in her own pocket and carries him along whatever she wishes."
বিয়ের সময় ওয়াদা রবীন্দ্রনাথের কাছে চেয়েছিলন আশীর্বাদ। রবীন্দ্রনাথ তার বিবাহিত জীবনে সুখ শন্তি কামনা করে লিখেছিলেন এক চিঠি সঙ্গে উপহার হিসেবে সিল্কের কাপড় নিজে হাতে আঁকা এক মেয়ের ছবি।ফ্রেমে বাঁধানো সেই চিঠি। সেই ছবি আজও ওয়াডার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। জ্বলজ্বল করছে ওর ১৯৩৬ সালে শান্তিনিকেতনে তার এবং রবীন্দ্রনাথের একই সঙ্গে উপস্থিতির উজ্জ্বল মুহূর্তগুলো । মনে পড়ে প্রতিমা দেবী ও নন্দিতা কৃপালিনী সাহচর্য। আরো চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য দেখার দুর্লভ অভিজ্ঞতা।
আজ সব অতীত। গুরুদেব নেই ।একমাত্র মেয়ে যুদ্ধে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। আজও একা বড় একা। এক নিঃসীম শূন্যতার পেয়ে বসে, পাশে এসে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ। তাই বৃদ্ধ বয়সে অ শক্ত শরীরে হাতড়ান রবীন্দ্রনাথের চিঠি গুলো। দেখেন উল্টেপাল্টে। তার কাঁপা কাঁপা হাতে, ঝলসা চোখে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে চলেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি । সঙ্গে ভাঙ্গা গলায় গুনগুন করে বেরিয়ে আসে রবি ঠাকুরের গানের দু কলি -
শুধু তোমার বাণী নয় হে বন্ধু হে প্রিয়
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও। -------------_০০-----------------
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ ইচ্ছে দুটি পূরিত হয়নি
শ্রী শিশির বাগ।
কবি , সম্পাদক ও গদ্যকার
সারা জীবন ব্যাপী যে মানুষটি আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনদের মৃত্যুর মিছিল প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই তিনি নিজের মৃত্যুর পূর্বে শোকে কাতর হয়ে পড়বেন- তা কখনোই কাঙ্ক্ষিত ছিল না এবং বাস্তবিক তা ঘটে ও নি। কিন্তু অনস্বীকার্য বিষয় হলো মৃত্যুর আগে যেখানে মানুষের শেষ ইচ্ছা পূরণ করা বহু দেশ ও জাতির একটি প্রচলিত রীতি, এমনকি কখনও কখনও ফাঁসির আসামিকে ও তার শেষ ইচ্ছা পূরণের সুযোগ দেয়া হয় ।সেখানে আমাদের দুর্ভাগ্য এটাই যে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তার শেষ ইচ্ছার কোনটাই পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
প্রাথমিক - চিকিৎসা বিষয়ক। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই কবিরাজি চিকিৎসা উৎসাহী ছিলেন এবং এই চিকিৎসা পছন্দ করতেন। জীবন সায়াহ্নে যখন কবি গুরুতর অসুস্থ। তথ্য অনুসারে কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ কে ডেকে আনা হয়। তিনি চিকিৎসা আরম্ভ করেন এবং তাতে যথেষ্ট ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছিল । বিমলানন্দ এবং তার সহকর্মী কমলাচন্দ্র ঘোষের তত্ত্বাবধানে কবিরাজি ঔষধপত্র এ কবি জ্বর নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। ঘুম হচ্ছিল। খিদেও বেড়ে ছিল।
কিন্তু এইরকম একটা সময়ে অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারেরা সিদ্ধান্ত নেন যে কবিকে অপারেশন করাটাই দরকার। সেইমতো ডাক্তার জ্যোতি প্রকাশবাবু ৯ জুলাই কবির কানে কথাটি তোলেন । শুনেই কবির মন খারাপ হয়ে যায়। এরপর তিনি বারবার বিভিন্নজনের কাছে এ সম্পর্কে অনাগ্রহ ও সম্মতির হীন কথা জানান। ২৯ জুলাই তারিখে অর্থাৎ মৃত্যুর প্রায় এক মাস আগে নির্মলকুমারী মহলানবিশ কে জানিয়েছেন -
" দেখো রানী , আমি কবি। আমি সুন্দরের উপাসক। বিধাতা আমার ই দেহখানা সুন্দর করে গড়েছিলেন ।এখান থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এই দেহখানা তেমনি সুন্দর অবস্থাতেই ফিরিয়ে দিতে চাই। গাছ থেকে শুকনো পাতা যেমন ঝরে যায় । পক্ক সুপারির ফল যেমন বৃন্ত থেকে আপনি খসে পড়ে। আমারও ঠিক তেমনি ভাবেই সহজে বিদায় নেবার ইচ্ছা চিরকাল। কেন, ওরা যাওয়ার আগে আমাকে ছেঁড়া খোড়া করে দিতে চাচ্ছে। বয়স তো ঢের হয়েছে আর কদিনই বা মানুষ বাঁচে। কাজেই ছেড়ে দিক না আমাকে। ফুলের মত ফলের মতো শুকনো পাতার মতো আমার স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি ঘটুক।"
কিন্তু আমরা জানি কবির এই ইচ্ছার কোনো মর্যাদা দেওয়া সে সময় সম্ভবপর ছিল না। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ বা অন্য কেউ সে যুগের প্রখ্যাত ডাক্তারবাবুদের ওপর কথা বলতে পারেননি ।ডাক্তার নীলরতন সরকারের আপত্তিও টেকে নি ।কবির ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপারেশন হয়েছিল এবং সজ্ঞানে অপারেশন করার তীব্র যন্ত্রণা ব্যথা বেদনা অনুভব করেছিলেন তিনি। ৩০ শে জুলাই অপারেশন. ৭ ই আগস্ট মহাপ্রয়াণ।
কবি'র অপর ইচ্ছা টি ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি । সেটি হল কবি পূর্ব উল্লিখিত স্নেহের পাত্রী রানী চন্দকে একসময় বলেছিলেন - " তুমি যদি আমার সত্যি বন্ধু হও , তাহলে দেখো, আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে" জয় বিশ্বকবি কি জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, বন্দেমাতরম - এরকম জয় ধ্বনি মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে, আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায় আমার ছেলেমেয়েদের মাঝখানে। সেখানে জয়ধ্বনি থাকবে না, উন্মত্ততা থাকবেনা ,থাকবে শান্ত প্রকৃতির সমাবেশ .. প্রকৃতিতে মানুষ মিলে দেবে আমাকে শান্তির পাথেয়।"
কিন্তু আমরা দেখেছি কবির মৃত্যুর পর সেখানে আত্মীয় বা বন্ধুর স্থানীয় এমন কেউ ছিলেন না যার জোরালো আদেশে কবির মৃতদেহ শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। প্রশান্তচন্দ্র তখন পীড়িত, কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ভেঙে পড়েছেন । কাজে উন্মত্ততার মাঝখান দিয়ে জয়ধ্বনি দিতে দিতে কবির মরদেহ কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশান ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল।
কাজেই কবির শেষ ইচ্ছে দুটির, কোন রুপ পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
তথ্যসূত্র : বাইশে শ্রাবণ , নির্মলকুমারী মহলানবিশ -মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স.
---------------০০০----------------
রাখি পূর্ণিমা
শ্রী প্রাণনাথ শেঠ
সম্পাদক, ছড়াকার ও গদ্যকার
পত্রীবাবুর সমস্ত রাগ গিয়ে পরল, অ্যালার্ম ঘড়িটার ওপর। ভাবটা এমন 5 টায় এলার্ম সেট করেছি বলে পাঁচটা থেকেই চিল চেচাতে হবে ।
রাত একটায় মেঘবল্লরী লিটল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ ও প্রচ্ছদ শিল্পী দেখা শেষ হয়েছে। সকাল সাড়ে ছটায় সাউথ বেঙ্গল ননস্টপ বাসে কলকাতা যাওয়ার কথা। সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে বৈঠকখানা রোডের প্রেসে জমা দিতে হবে। না হলে, বাইশে শ্রাবণ সংখ্যা বের করা অসম্ভব। এখন সবে পাঁচ টা আরো অন্তত আধঘন্টা ঘুমিয়ে নেওয়া যেতই , চোখ দুটো বেশ কর কর করছে। অ্যালার্ম ঘড়িটার নাকে একটা আলতো ত্যা বড়া মেরে ফাঁকা বালিশটাকে জড়িয়ে বিছানা নিলেন নবীন পত্রী মহাশয়।
বাসের হর্নে ধড়পড়িয়ে উঠে পড়েন তিনি । অবাক কান্ড ঘড়িতে তখন ভোর তিনটে ।তাহলে একটু আগে এলাম ঘড়ি টা পাঁচটার বিচ্ছিরি আওয়াজ উড়ছিল- সেটা কি স্বপ্ন ?ঘুমকাতুরে শরীরটা এলিয়ে দিতে গিয়ে এলাম ঘড়িটায় আটকে গেল চোখ. হ্যাঁ, ঠিক দেখছে. ওই পাঁচটা পাঁচ মিনিটে তো এলাম টা বন্ধ করেছিল সে. সহসা একটা হিম স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সারা শরীরে. একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ তৈরি হল । ভৌতিক কোন ব্যাপার কিনা !সে কিছুই ভাবতে পারছেনা . গুলিয়ে যাচ্ছে তন্দ্রায়।
দেওয়ালে ক্যালেন্ডারের ঘষটানোর শব্দে সম্বিত ফিরল নবীন পত্রী র । কোথা থেকে এলো এত বাতাস ।অন্ধকার ঘরে রেডিয়ামের মতো ভাস্বর শুধু দেওয়ালের ক্যালেন্ডার ।কোথা থেকে এলো এত আলো! বাইরে চোখ পড়তেই অবাক হলেন তিনি বিস্ময় এ। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে উঠোন তুলসী তলা - চরাচর। এবার নজরে এলো দুদিন আগে আলমারি থেকে সাজানো প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এর " রবীন্দ্র জীবনকথা" বইটি খোলা অবস্থায় পড়ে আছে বিছানায় পরম যত্নে বইটি সোজা করে ধরলেন. আশ্চর্য আলোয় প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠল অক্ষরগুলো।
" জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবির অস্ত্রোপচার " হতে। শেষবারের মতো কবি নামিয়ে রাখলেন তার কলম। বিদেশি বন্ধুর কাছ থেকে উপহার চাওয়া শখের ঘড়িটা বের করে দম দিয়ে , পড়ার টেবিলে রেখে - চোখ মুছলেন কবি। কচিকচিক করে উঠলো ও পত্রীবাবুর চোখ ও । তবুও তিনি পড়তে শুরু করলেন ।
"তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী ।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে
..........................................
.…......................................
চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আবার। পুরো কবিতা পড়া হলো না। চোখ মুছে তাকালেন ক্যালেন্ডারের দিকে...…. কালো স্কেচ পেনে গোল করা আছে, ১৯৪৭ সালের ৭ ই আগস্ট তারিখ টি।আর ছোট করে লেখা ২২ শ্রাবণ. তারও নীচে লাল অক্ষরের বড় বড় করে লেখা- " রাখি পূর্ণিমা"।
----------_---_-০০০০----------------
তোমার সৃষ্টির পথ : প্রসঙ্গ মৃত্যু ভাবনা
শ্রী জয়দেব মাইতি
কবি ও সম্পাদক
মৃত্যুঞ্জয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ - তার সাহিত্যকর্মে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনস্মৃতি কে প্রতিভাত করেছেন। প্রকৃতি প্রেম জীবন ভাবনার সুখ দুঃখের কাহিনী নানা ভাবে ফুটে উঠেছে তার লেখনীতে।
জীবনের বড় একটা সময় রবীন্দ্রনাথ পরিবারের বহুজনের বিদায় পর্ব কে নিজের চোখে দেখেছেন ।অনুভব করেছেন - মৃত্যু আসলে জীবন চেতনার একটি রেখা মাত্র . যা সহজে লঙ্ঘন করা যায় না। আবার মুহূর্তে পেরোনো যায়।
কবির সেই অন্তরের অনুভূতি ধরা দেয় তার লেখনীতে -
দুঃখের আঁধার রাত্রি ঝরে ঝরে
এসেছে আমার ঘরে।
পরাজয় নিশ্চিত জেনে, তবুও বিশ্বাসে হৃদয়ের সাহসে এগিয়ে চলেছেন নিরন্তর -
যতবার জয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস
ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।
অনর্থ পরাজয়ের গ্লানি তবুও কবি কে থামাতে পারেনি । অসম্ভব মানসিক শক্তি আর দৃঢ়তা কবিকে করেছেন অপরাজেয়। কবি নিজেই নিজের সৃষ্টির সত্ত্বাকে ঈশ্বরের সত্ত্বার সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রশ্ন করেছেন- এই অভিপ্রায় এর অর্থ কি?
কবি যখন জীবন সাযাহ্নে- তার শেষ কবিতাখানি" তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি।"( ৩০ শে জুলাই,১৯৪১), তিনি নিজেই যেন প্রশ্ন খানি করেছেন- ঈশ্বরের কাছে -
" তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী। "
আসলে এ যেন নিজেকে নতুনভাবে জানার অদম্য প্রচেষ্টা। না হলে কবির এত দুঃখ যন্ত্রণা কিভাবে এক নিমেষে মিলিয়ে যায় - চরম অশ্রু তলে। বিচিত্রতা য় ভরে ওঠা জীবন সুখের উত্থান-পতনে কিভাবে তিনি জানতে চান - এ নিতান্ত ছলনা ছাড়া আর কি ?
আবার তিনি চরম বাস্তববাদী হয়েও বলেছেন -
" মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে।
সরল জীবনে
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্বের করেছ চিহ্নিত।"
কবি বাস্তবের বিশ্বাস দিয়ে চরম সত্যকে মেনে নিয়েছেন - সাবলীলভাবে। স্বীকার করেছেন প্রবঞ্চনার দ্বারা সত্যকে উদ্ধার করা যায়।
কবি আবার স্বীকার করলেন - অন্তরের আলো দ্বারা সত্যিকারের বিশ্বাস আ সে। ঋদ্ধ হয় আত্মার আত্মা। সহজ বিশ্বাসে সে হয়ে উঠে চির উজ্জ্বল।
সে যে চির স্বচ্ছ
সহজ বিশ্বাসে সে যে
ক রে তারে চির সমুজ্জ্বল।
পাশাপাশি তিনি এ-ও স্বীকার করেছেন বাইরে যে যত কুটিল হোক না কেন অন্তরের ঋজুতা তাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে -করে গৌরবান্বিত.
" আপন আলোকে ,- ধৌত অন্তরে অন্তরে
কিছুতে পারেনা তারে প্রবঞ্চি তে।"
কবি আপন ভাবনাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়ে বলেছেন নিজের সত্তা দিয়ে যে নিজেকে যত বেশি পরিক্রমা করতে পেরেছেন তিনি কোন কিছু থেকে বঞ্চিত হননি দেরি হলেও নিজের প্রাপ্য তিনি পেয়েছেন।
" অনায়াসে যে পেয়েছে - ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।"
আসলেই কবি জীবনের ঘাত প্রতিঘাত কে ঈশ্বরের ছলনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। যে সহে সে রহে। এই ধারণায় স্বীকারোক্তি যেন নিজের তাই তো কবি কবিতার শেষ পংক্তিতে বলেছেন- সহজে হাসিমুখে যিনি ঈশ্বরের ছলনাকে সহ্য করতে পেরেছেন জীবনের সঠিক মুহূর্তেই তিনি পেয়েছেন শান্তির অক্ষয় অধিকার লালিত্যময় সুখ।
জীবন সায়াহ্নে রবি কবির এই লেখনি
যেন তার জীবনের ইতিহাসকে তুলে ধরে মৃত্যু ভাবনা কে জয় করে এ যেন জন্ম-জন্মান্তরের জন্য বাঁচার এক অনন্ত আকুতি।
-------------------০0০০০-------------------
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ
সৌরভ কুমার ভূঁইয়া
কবি সম্পাদক ও গল্পকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শিলাইদহের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। শিলাইদহে ছিল ঠাকুরবাড়ির জমিদারি ।জীবনের নানা সময় মিলিয়ে এক দশকেরও বেশি সময় তিনি কাটিয়েছিলেন, এই শিলাইদহে পদ্মার বুকে নৌকায় এবং ওখানকার কুঠি বাড়িতে বসে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। পিরামিড আকৃতির ইট-কাঠের তৈরি তিন তলা এই বাংলোটির 11 একর জায়গা জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ফুল ফলের বাগান ও দুটি বড় বড় পুকুর । পূর্বের বাড়িটি বর্তমানে সংস্কার করা হয়েছে এবং বাড়িটি হেরিটেজ বিল্ডিংএর মর্যাদা পেয়েছে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ বাড়িটি রবীন্দ্র অনুরাগী তথা পর্যটকদের কাছে একটি দর্শনীয় স্থান।
বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায় অবস্থিত শিলাইদহ। এই শিলাইদহ নামকরণের ইতিহাস রয়েছে। শিলাইদহের পূর্বনাম ছিল খোরশেদপুর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এখানে জমিদারি পত্তন করেছিলেন । তার পূর্বে শেলী(Shelly) নামে একজন উপনিবেশ পত্তনকারী ওখানে নীলকুঠি স্থাপন করেছিলেন ।ওখানে গদাই ও পদ্মা নদীর সঙ্গমস্থলে একটি গভীর জলঘূর্ণি বা দহ সৃষ্টি হয়েছিল। যা পরে shellydaha নাম হয় আরো পরে বাংলা উচ্চারণে তা শিলাইদহ। পরবর্তীকালে এই নামেই গ্রামটি পরিচিত হয় খোরশেদপুর নাম বদলে শিলাইদহ হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এই জমিদারির অধিকারী হন এবং জমিদারি দেখভালের জন্য ১৮৮৯ সালে নভেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ প্রথম শিলাইদহে আসেন। তবে এখানে তিনি সব থেকে বেশি সময় ১৮৯০-১৯০১ কাটিয়েছেন ।প্রায় দীর্ঘ এক দশকে তিনি শান্ত-স্নিগ্ধ শিলাইদহের কুঠিবাড়ি তে বসে কিংবা পদ্মায় নৌকা বসে লিখেছেন অসংখ্য অবিস্মরণীয় লেখা । শুধু তাই নয় এখানে থাকার সময় স্যার জগদীশ চন্দ্র বোস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরী, মতিলাল মজুমদার প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিরা নিয়মিত তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন।
শিলাইদহের শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি যে সাহিত্য সৃষ্টিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল, তা তার পিতৃস্মৃতি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যেখানে তিনি লিখেছেন -" বাবার গদ্য ও পদ্য দু'রকম লেখারই উৎস যেমন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে, এমনটা আর কোথাও হয়নি । এই সময় তিনি অনর্গল কবিতা প্রবন্ধ গল্প লিখে গেছেন- একদিনের জন্য কলম বন্ধ হয়নি। শিলাইদহের যে রূপবৈচিত্র, তার মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন লেখার অনুকূল পরিবেশ।"
শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল । এখানে বসে তিনি অসংখ্য কবিতা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং চিঠিপত্র লিখেছেন। শিলাইদহ সম্পর্কে তার অনুভূতির কথা ব্যক্ত হয়ে উঠেছে বিভিন্ন মানুষকে লেখা তার চিঠিপত্রে।১৩৪৬ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে শিলাইদহ নিবাসী শচীন্দ্রনাথ অধিকারী কে এরকমই একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন - " আমার যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্যরস সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মাপ্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে সেখানে আমার যাত্রাপথ আজআর সহজগম্য নয়, কিন্তু সেই পল্লীর স্নিগ্ধ আমন্ত্রণ সরস হয়ে আছে আজও আমার নিভৃত স্মৃতি লোকে সেই আমন্ত্রণের প্রত্যুত্তরে অশ্রুতিগম্য
করুন ধ্বনি তে আজও আমার মনে গুঞ্জরিত হয়ে উঠেছে সেই উপলক্ষে পল্লীবাসীদের আজ জানিয়ে রাখলাম " উক্ত বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার শিলাইদহ তার হৃদয়ের কতখানি স্থান জুড়ে ছিল এখানে তিনি যেসব কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন সেগুলি হল -মানসী(বঙ্গবীর), সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি , কথা ও কাহিনী, কল্পনা ,ক্ষণিকা, খেয়া , বলাকা কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা এবং নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থ মোট ১০০ টি কবিতার ৯০ টি তিনি লিখেছিলেন. কবিতা ছাড়া গীতাঞ্জলির অধিকাংশ গান গীতিমাল্য গীতবিতান এর বেশ কিছু গান তিনি এখানে রচনা করেন নাটকের মধ্যে চিরকুমার সভা চিত্রাঙ্গদা রাজা অচলায়তন গল্পগুচ্ছের বেশকিছু গল্প মেঘ ও রৌদ্র ক্ষুধিত পাষাণ দুর্বুদ্ধি শুভদৃষ্টি নষ্টনীড় প্রভৃতি। উপন্যাস চোখের বালি গোরা ঘরে বাইরে চতুরঙ্গ এছাড়া তিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধও চিঠি লিখেছিলেন ।শিলাইদহের অপরূপ প্রকৃতি এখানকার পল্লী জীবন ও পদ্মার প্রতি তার তীব্র অনুরাগ এর ছবি ফুটে উঠেছে ছিন্নপত্রাবলীর চিঠি গুলিতে.১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। ১৯১২ সালে এই শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ শুরু করেন ।এছাড়া পল্লী জীবনের উন্নতি ও কৃষি কাজের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। সেইসঙ্গে পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর নামে এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের জীবনে কতোখানি স্থান জুড়ে ছিল । তার লেখা একটি চিঠির কয়েকটি কথা উদ্ধৃত করে এই লেখা শেষ করব। ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে শচীন্দ্রনাথ অধিকারী কে তিনি লিখেছিলেন -" মনে পড়ছে সেই শিলাইদহের কুঠিবাড়ি। তেতলার নিভৃত ঘরটি আমের বোলের গন্ধ আসছে বাতাসে পশ্চিমের মাঠ পেরিয়ে বহুদূরে দেখা যাচ্ছে বালুচরে রেখা আর গুনটানা মাস্তুল দিনগুলো অবকাশে ভরা সেই অবকাশ এর ওপর প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে রঙিন পাখাওয়ালা কত ভাবনা আর কত বাণী। কর্মের দায় ছিল তারই সঙ্গে আর হয়তো মনের গভীরে ছিল অনন্ত আকাঙ্ক্ষা পরিচয়হীন বেদনা সব নিয়েছিল যে আমার নিভৃত বিশ্ব শেয়ার চলে গিয়েছে বহুদূরে আমার শিলাইদহের কুঠি পদ্মার চর সেখানকার দিগন্তবিস্তৃত ফসলকে ও ছায়া নিবিড় গ্রাম ছিল সেই অভাবনীয় কে নিয়ে যার মধ্যে আমার কল্পনার ডানা বাধা পায়নি।"
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment