জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
=============√√√√√√√√============
Doinik Sabder Methopath
Vol -126. Dt - 12. 09.2020
২৬ ভাদ্র,১৪২৭. শনিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷!!!!!!!!!!!!÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
১২ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণায় অবস্থিত কল্যানীর নিকটবর্তী ঘোষপাড়া অঞ্চলের মুরারীপুর গ্রামে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মামার বাড়িতে জন্মান | এছাড়া, তাঁর পৈত্রিক বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরে ছিলো |
তাঁর বাবার নাম ছিলো শ্রী মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম ছিলো মৃনালিনী দেবী | তাদের দুজনের ৫টি সন্তান ছিলো, যার মধ্যে বিভূতিভূষণই ছিলেন সব থেকে বড় |
শোনা যায় তাঁর বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন, একজন সংস্কৃতের প্রখ্যাত পন্ডিত | সংস্কৃতে তাঁর অসাধারণ পান্ডিত্ব থাকার জন্য তাঁকে শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত করা হয় |
বিভূতিভূষণ তাঁর বাবার কাছেই প্রথম পড়াশোনা শেখেন এবং নিজের গ্রাম আর পাশের গ্রামের অন্য কয়েকটা পাঠশালা থেকেও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন |
এরপর তিনি পাঠশালার পাঠ শেষ করে ভর্তি হন বনগ্রাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে | সেখানে নাকি তিনি একজন অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসাবে পড়াশোনা করার সুযোগ পান |
ছোটবেলা থেকেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পড়াশোনার বেপারে ভীষন মনোযোগী ছিলেন | তাইতো, তিনি একসময় হয়ে ওঠেন ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র |
এইভাবে, তাঁর পড়াশোনা বেশ ভালোই চলতে থাকে | পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের মাধ্যমে তিনি একের পর এক ক্লাস উর্তীর্ণও হতে থাকেন কিন্তু যখন তিনি অষ্টম শ্রেণীতে ওঠেন,তখন হঠাৎই শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয় |
বাবার এইভাবে হঠাৎ চলে যাওয়া, ছোট্ট বিভূতির মনে ভীষণ কষ্ট দেয় | আর কষ্ট হওয়াটাই যে স্বাভাবিক, কারণ ছোটবেলায় তাঁর বাবাই তাঁকে পড়াশোনা শেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন আদর, আবদার পূরণ করতেন |
এত সবকিছু ঘটে যাওয়ার পরও ছোট্ট বিভূতিভূষণ নিজের পড়াশোনা কিন্তু চালিয়েই যান | ১৯১৪ সালে তিনি তাঁর এনট্রান্স পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পান এবং তারপর ভর্তি হন রিপন কলেজে যার বর্তমানে আজ নাম সুরেন্দ্রনাথ কলেজ |
সেখানে আই.এ পরীক্ষায়ও তিনি ভালো ফল করেন আর আবার ফার্স্ট ডিভিশন পান এবং তারপর ১৯১৮ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ পরীক্ষায়ও ডিস্টিইংশন সহ পাশ করেন |
এরপর তিনি আবার মাস্টার্স আর Law নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হন কিন্তু কোর্সের মাঝপথে তাঁকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়, যত সম্ভব আর্থিক কারণেই |পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি প্রথমে জাঙ্গীপাড়ার একটি স্কুলে ও পরে সোনারপুরের হরিনাভি স্কুলে শিক্ষকতা প্রদান করেন ।তাছাড়া মাঝে অবশ্য কিছুদিন গোরক্ষিণী সভার প্রচারক, খেলাৎ ঘোষের বাড়িতে সেক্রেটারি এবং গৃহশিক্ষক রূপে কাজ করলেও তিনি সারাজীবন শিক্ষকতাই করেন ।
আগেই তোমাকে বলেছিলাম যে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হুগলী জেলার জাঙ্গীপাড়ার একটি স্কুলে পড়াতেন | সেখানেকার নাম করা স্কুল দ্বারকানাথ উচ্চবিদ্যালয়ে ১৯১৯ সালে পড়ানোর সময় বসিরহাটের মোক্তার, শ্রীকালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে গৌরী দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয় |দুর্ভাগ্যবশত তাঁর প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবী, বিয়ের ঠিক এক বছর পরেই মারা যান রোগের কারণে | স্ত্রীয়ের অকাল মৃত্যুতে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একেবারে মর্মাহত হয়ে পরেন এবং গভীর শোক পাওয়ার ফলে তিনি কেমন যেন পাগলের মত হয়ে যান |এরফলে বেশ কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রায় সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন শুরু করেন |বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাটশিলার বাড়ি এইসব দেখে তাঁর পরিবারের লোকেরা, আবার তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা শুরু করে দেন | অনেক পাত্রী খোঁজা খুঁজির পর অবশেষে ১৯৪০ সালের ৩রা ডিসেম্বর তারিখে, বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে রমা দেবীর সাথে তিনি পুণরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন |রমা দেবীর সাথে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিয়ের ৭ বছর পর অবশেষে তাঁর ঘরে একটা পুত্র সন্তানের জন্ম হয় | যার নাম রাখা হয় তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় |
১৯২১ সালে প্রবাসী পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প “উপেক্ষিতা” প্রকাশ পায় এবং এই গল্পের মাধ্যমেই বিভূতিভূষণের সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত ঘটে | যখন তিনি ভাগলপুরে থাকতেন, তখন তিনি পথের পাঁচালী লেখা শুরু করেন, সেই সময়টা ছিলো ১২৯৫ সাল | আর তাঁর, এই অনবদ্য উপন্যাসটা লেখা সমাপ্ত হয় তার ঠিক ৩ বছর পর অর্থাৎ ১৯২৮ সালে |
পথের পাঁচালী হলো তাঁর লেখা সবচেয়ে সেরা উপন্যাস। এই উপন্যাস লেখার মাধ্যমেই তিনি চারিদিকে খ্যাতি অর্জন করেন | এই উপন্যাসটা আসলে নিস্চিন্দীপুর গ্রামকে আশ্রয় করে অপু ও দুর্গার শৈশবকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে |পথের পাঁচালীর পরবর্তী অংশের নাম হলো “অপরাজিতা” | এই উপন্যাসে আছে অপুর কোলকাতা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে জীবন যাপন, অপর্ণার সাথে বিয়ে এবং স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছেলে কাজলকে নিয়ে ফিরে আসার ঘটনা |
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দুটো গ্রন্থেই তাঁর নিজের ব্যক্তিগত জীবনের আভাস রয়েছে |“পথের পাঁচালী” এই উপন্যাসকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে বাংলা তথা ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় একটি অসাধারণ সিনেমা তৈরী করেন এবং এই সিনেমার মাধ্যমেই তিনি তাঁর পরিচালকের জীবন শুরু করেন |তাছাড়া পথের পাঁচালীর জন্যই তিনি ১৯৯২ সালে অস্কার পুরস্কার পান, যা সকল ভারতবাসীর কাছে খুবই গৌরবের বিষয় |
সত্যজিৎ রায় কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি | তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত অপরাজিত ও অশনি সংকেত এই দুই উপন্যাসকে নিয়েও সিনেমা তৈরী করেছিলেন |
তাঁর পরবর্তী সবচেয়ে সেরা উপন্যাস হলো চাঁদের পাহাড়, যেটা একটা এ্যাডভেঞ্চার বিষয়ক কাহিনী | এই উপন্যাসের পটভূমিকা দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন জঙ্গলের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে |শঙ্কর নামের একটি বাঙালী ছেলের আফ্রিকায় কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়া, সেখানে আলভারেজের সাথে আলাপ, সেইসাথে বুনিপের আক্রমণ এবং শেষে হীরের খনির খোঁজ, সব মিলিয়ে এক অসাধারণ গল্প দিয়ে সাজানো এই উপন্যাস | যা আজও বাঙালী বই প্রেমিকদের ভীষনভাবে আকৃষ্ট করে তোলে |
অবশেষে ১লা নভেম্বর, ১৯৫০ সালে ঝাড়খন্ডের ঘাটশিলায় তাঁর নিজের বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যান |জানা যায়, মৃত্যুর ঠিক পরের দিন দুপুরবেলায় সুবর্ণরেখা নদীর ওপরে “পঞ্চপাণ্ডব ঘাটে” তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছিলো |
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ:
উপন্যাস
*পথের পাঁচালি (১৯২৯)
*অপরাজিত (১ম ও ২য় খণ্ড, ১৯৩২)
*দৃষ্টিপ্রদীপ (১৯৩৫)
*আরণ্যক (১৯৩৯)
*আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০)
*বিপিনের সংসার (১৯৪১)
*দুই বাড়ি (১৯৪১)
*অনুবর্তন (১৯৪২)
*দেবযান (১৯৪৪)
*কেদার রাজা (১৯৪৫)
*অথৈজল (১৯৪৭)
*ইছামতি (১৯৫০)
*অশনি সংকেত (অসমাপ্ত, বঙ্গাব্দ ১৩৬৬)
*দম্পতি (১৯৫২)
গল্প-সংকলন
*মেঘমল্লার (১৯৩১)
*মৌরীফুল (১৯৩২)
*যাত্রাবাদল (১৯৩৪)
*জন্ম ও মৃত্যু (১৯৩৭)
*কিন্নর দল (১৯৩৮)
*বেণীগির ফুলবাড়ি (১৯৪১)
*নবাগত (১৯৪৪)
*তালনবমী (১৯৪৪)
*উপলখন্ড (১৯৪৫)
*বিধুমাস্টার (১৯৪৫)
*ক্ষণভঙ্গুর (১৯৪৫)
*অসাধারণ (১৯৪৬)
*মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৪৭)
*আচার্য কৃপালিনী কলোনি (১৯৪৮; ১৯৫৯ সালে ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব’ নামে প্রকাশিত)
*জ্যোতিরিঙ্গণ (১৯৪৯)
*কুশল-পাহাড়ী (১৯৫০)
*রূপ হলুদ (১৯৫৭,মৃত্যুর পর প্রকাশিত)
*অনুসন্ধান (১৯৬০,মৃত্যুর পর প্রকাশিত)
*ছায়াছবি (১৯৬০,মৃত্যুর পর প্রকাশিত)
*সুলোচনা (১৯৬৩)
কিশোরপাঠ্য
*চাঁদের পাহাড় (১৯৩৮)
*আইভ্যানহো (সংক্ষেপানুবাদ, ১৯৩৮)
*মরণের ডঙ্কা বাজে (১৯৪০)
*মিসমিদের কবচ (১৯৪২)
*হীরা মাণিক জ্বলে (১৯৪৬)
*সুন্দরবনের সাত বৎসর (১৯৫২)
আরো পড়ুন: বিদ্যাসাগরের জীবনী
ভ্রমণকাহিনী ও দিনলিপি
*অভিযাত্রিক (১৯৪০)
*স্মৃতির রেখা (১৯৪১)
*তৃণাঙ্কুর (১৯৪৩)
*ঊর্মিমুখর (১৯৪৪)
*বনে পাহাড়ে (১৯৪৫)
*উৎকর্ণ (১৯৪৬)
*হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮)
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment