Sunday, 4 October 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

=============!!!!!!!!!!!==============
                       আলোচনা পর্ব -৬

পূজা কেন্দ্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক

÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷!!!!!!!!!!!!÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
                Doinik Sabder Methopath
               Vol -151. Dt- 05.10.2020
                ১৮ আশ্বিন,১৪২৭. সোমবার
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
“তুমি এলে শুভঙ্করি ! বাড়ে আরও দায়...” 
                                   অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী 


একশো দেড় শো বছর আগে এই বাংলাদেশে একটি চল ছিল, শারদীয় দুর্গাপূজাকে বিষয়বস্তু করে গদ্যে-পদ্যে নানাবিধ রচনা প্রকাশিত হত। কখনও এগুলোতে থাকত ব্যঙ্গ, কখনো বা নির্মল হাস্যরস। কখনও এ সব রচনা দুর্গোৎসবের সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হত, কখনও বা লেখকেরা এ গুলি স্বতন্ত্র পুস্তিকা হিসেবে ছাপিয়ে বিলি করতেন। পূজাবিষয়ক সাহিত্যের এই ধারা এখন লুপ্তপ্রায়।

হুতোম পেঁচা, শ্রী দশ অবতার,বা টেকচাঁদ ঠাকুর প্রমুখের রচিত নকশাগুলির কথা বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত, এ গুলিতে আঁকা সমকালের দুর্গাপূজার ছবির কথাও আমরা কম বেশি জানি। দুর্গাপূজার সামাজিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও প্রভাব, এই পূজার সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা এ সব নকশায় অত্যন্ত জীবন্তভাবে চিত্রিত হয়েছে, বারোয়ারি পূজার উদ্যোক্তা, পুরোহিত, এমন কি, গাঁটকাটা চোর পর্যন্ত হুতোমের মনোযোগ থেকে বঞ্চিত হয়নি! বহুস্তরীয় সমাজব্যবস্থার এমন মিনিয়েচার-রূপায়ন বাংলা সাহিত্যে খুব কমই দেখা যায়।

পূজাবিষয়ক সাহিত্যে সমাজচিত্র প্রসঙ্গে এই নকশাগুলির পরেই উল্লেখযোগ্য ঈশ্বর গুপ্তের কিছু কবিতা যাতে পূজোর নানা টুকরো ছবি পাওয়া যায়। রসরাজ অমৃতলাল বসুও অনেক পূজাবিষয়ক কবিতা লিখেছেনঃ- ‘বৈজ্ঞানিক দুর্গোৎসব’, ‘বিলাতে দুর্গাপূজা’, ‘কেরানীর আগমনীগীতি‘ , ‘বিজয়া দশমী’, ‘পূজার আবদার’ ইত্যাদি। ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘দুর্গোৎসব উদ্ভট কাব্য’ (১২৯০), আর ‘শারদীয় সাহিত্য’ (১৩০৩) পুস্তিকা দু’টিও জনপ্রিয় হয়। এ ছাড়াও নানা অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রাম্য কবিও পূজার সময় কবিতা ও ছড়ার সংকলন বের করতেন।

‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকাটি ১৮৭৩ সালে ‘ছুটির সুলভ’ নামে শারদ সংখ্যা প্রকাশ করে [১২৮০ বঙ্গাব্দ]। দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা ‘উনবিংশ শতাব্দীর দুর্গোৎসব’ শিরোনামে কিছু কবিতা ও কাহিনী আর ‘উন্মাদিনী আগমনী’ নামে একটি রম্যরচনা প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রিকায় কার্টুন ছাড়াও প্রতিবার দুর্গাপূজার সময় পূজাকেন্দ্রিক রঙ্গব্যঙ্গ,গান, নকশা ইত্যাদিও প্রকাশিত হত। মনোমোহন বসু সম্পাদিত ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকায় ‘কোঁড়ল’-কৃত পাঁচালিও এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য। মাসিকপত্র ‘মালঞ্চে’র আশ্বিন,১৩২১ সংখ্যায় বেরিয়েছিল সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের নকশা ‘পূজার ফলাফল’। ব্যঙ্গচিত্রভিত্তিক সুপরিচিত পত্রিকা ‘বসন্তক’ এর পূজাবিষয়ক রচনা ও ছবিগুলিতেও পাওয়া যেত সামাজিক সমস্যার নানা উপাদান। সম্ভবত এই পত্রিকাতে ১৮৭৩-৭৪ সাল নাগাদ প্রকাশিত ‘স্পেশাল রিপোর্টারের হিমালয় হইতে প্রেরিত চিত্র’ নামক বিশাল ব্যঙ্গচিত্রটিই বাঙলা পত্রিকায় দুর্গা বিষয়ক প্রথম কার্টুন। এ জাতীয় নকশা বা হরপার্বতী সংবাদই বোধ হয় পূজা-সাহিত্যের একমাত্র ধারা, যা ক্ষীণভাবে হলেও এখনকার বাংলা সাহিত্যে কিছু পরিমাণে টিঁকে আছে।

‘পূজার গল্প’ লেখারও চল ছিল এক সময়। ১৩৭০ সনে অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী বের করেন ‘পূজার গল্প’।এই সংকলনে ছিল চারটি গল্পঃ- ‘সদানন্দের সন্ধিপূজা’, ‘মনে মনে মায়ের পূজা’, ‘মুখুজ্জেমশাই’ আর ‘তারাসুন্দরী’। বলা বাহুল্য, এই তালিকা সম্পূর্ণ নয়, আমরা কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করেছি। ক্ষেত্রনাথ ঘোষ নামে এক ছাত্র ‘সুখের শরৎ/ দুর্গোৎসব’ নাম দিয়ে একটি চটি বই প্রকাশ করেন, যাতে হরপার্বতীর কথোপকথন নাটকের ধাঁচে লেখা হয়, এর একটি দ্বিতীয় পর্বও বের হয়েছিল, যার নাম ‘হিমাচলে মা’র আগমন’।

বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে পূজা সাহিত্যের এই বিশেষ ধারাটিতে ভাঁটা পড়ে যায়। ষাটের দশকেও অবশ্য প্রবুদ্ধ রচিত ‘হরপার্বতী সংবাদ’, কমলাকান্ত শর্মা ছদ্মনামে প্রমথনাথ বিশীর কবিতা ইত্যাদি চোখে পড়ত। আরো পরে ক্ষীয়মান এই ধারাটিতে গৌড়ানন্দ কবি [গৌরকিশোর ঘোষ], সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ মাঝে মাঝে কলম ধরেছেন। চিরকালের সেই শিব-পার্বতীর ঘরকন্না ও কথাবার্তা নিয়েই তাঁরা নাটক-নকশা রচনা করেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমকালীন চেহারা আর মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক ভাবনার সেই চিরন্তন ছবিই এসব আধুনিক পূজা-সাহিত্যে ফুটে উঠেছে। 

মধ্যবিত্ত বাঙালির পূজোর সময়কার নানা অনুভূতির অন্যতম অবশ্যই ছুটির আনন্দ। অখিলচন্দ্র লহিড়ির ‘পূজার পাগল’ সংকলনটির ‘মা’ শীর্ষক কবিতাটিতে দেখা যাচ্ছে, প্রবাসী ছেলের পূজোর ছুটিতে বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করছেন বিরহকাতরা মাঃ- “ শরতের বিধু আধ-হাসি ছড়ায় গগনে/ জাগাইছে মনে পুত্রে মোর প্রবাস-ভবনে/ কবে আসিবে সেদিন, মিলিবে যেদিন, / কোলের মাণিক কোলে পুনরায়।/ দেখিনি আজ ক’টি মাস হায়। ...“ শুধু ছাত্রেরাই নয়, চাকুরেরাও দিন গোনেন পূজোর ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য। ‘বসন্তক’ পত্রিকার এক নকশায় কেরানীদের অধীরতার সে ছবির কিছুটাঃ- “ক্রমে পূজা নিকট, জলের মত সময় কেটে যাচ্ছে ,চতুর্থী এসে পড়লো। চাকরে বিদেশী কেরানীরা আজ ছূটি পাবেন, কিন্তু ছুটি আর হয় না, বাতি জ্বেলেও কাজ হচ্ছে, করেন কি/ বিকারী রোগীরা শয্যাকন্টকীতে যেরূপ ছটফট করে সেইরূপ ছটফট কচ্চেন! কি সর্বনাশ, আজ হলো চতুর্থী, এখন শাটী, মিশি, মাথাঘষা,চুলবাঁধা, জরি খরিদ, হয়নি; করেন কি, চারা নাই।….” বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, বাঙালির পূজা-সংশ্লিষ্ট সব ভাবনার সঙ্গেই চিরকাল অনিবার্যভাবে জড়িয়ে থাকে এর আর্থিক অনুষঙ্গটি। তাই কেরানীবাবুরা “আপিস থেকে বেরিয়ে আগুন খাকির মত গে বাজারে পড়লেন। ঠাকরুনের তস্মিসাটি হ’ক না হ’ক, গিন্নির ঢাকাই গুলবাহার, চিনের সিঁদুর, বেলেওয়ারী চুড়ি, ম্যাকেসার অয়েল, কিনতেই ব্যতিব্যস্ত হলে, ক্রমে রাত দুই প্রহর পর্যন্ত লাঠিমের মত ঘুরে ঘুরে বাজার কোরে বাসায় গে বুচকী বাচকা বাঁধতে লাগলেন। আজ আর চক্ষে ঘুম নাই।……”[বসন্তক, ১ম খণ্ড, ১২৮০-৮১]

দুর্গোৎসবের আগে বাঙালির এই কেনাকাটার হুজুগের পেছনে সব সময়ই যে কোন একটা নিরুপায় দায় থাকে তা কিন্তু নয়, পূজো উপলক্ষে প্রিয়জনকে সাজাবার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষাও সমান সত্যি। ‘বসন্তক-এর দুর্গোৎসব’ শীর্ষক এক কবিতায় এক গরিব ব্রাহ্মণের অক্ষম অভিলাষের ছবির কিছুটাঃ- “প্রাণের প্রিয়ারে আর নানা আভরণে/ সাজাতে বড়ই সাধ হয় মোর মনে। / বারণসী সাঁচ্চা শাড়ী পরাইয়ে আর/ দেখি রূপ অপরূপ আঁখি ভরি তার।।/ এইরূপ মনোহর বেশভুষা করি/ বরণ করিবে দুর্গা আমার সুন্দরী।“ হতভাগ্যের এই রকম আরও কত সাধ ছিল, বাড়িতে দুর্গোৎসবের আয়োজন করে রাজারাজড়ার মতো গড়ের বাদ্যি আনার ও গ্যাসের ঝাড় লন্ঠন জ্বালাবার , কিন্তু – “পিতলের বালা যার ঘটেনা কপালে/ তার কি এমন সাজ ঘটে কোন কালে!/ কেন রে এমন অসম্ভব সাধ তার।/ গরিব ব্রাহ্মণ ভিক্ষা উপজীব্য যার।“[বসন্তক, ২য় খণ্ড, ১২৮১-৮২]

পূজোর কেনাকাটার হুজুগে মধ্যবিত্ত বাঙালির অর্থকৃচ্ছতাকে কেন্দ্র করেই তার যত সমস্যা। বঙ্গবাসীর অসীম ক্ষুধা, তার দারিদ্র্যের জ্বালা ইত্যাদি মনে রেখে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দুর্গোৎসব’ নামে এক কবিতায় লেখেন, “এনেছ মা বিঘ্নহরে কিসের কারণে?/ বিঘ্নময় এ বাঙ্গালা আছে কি তা মনে?/ এনেছ মা শক্তিধরে, দেখি কত শক্তি ধরে/ মেরেছ মা বারে বারে দুষ্টাসুরগণে,/ মেরেছ মা তারকাসুর/ আজ বঙ্গ ক্ষুধাতুর/ মার দেখি ক্ষুধাসুর সমাজের রণে?...।“ এর পরে বঙ্কিম যা লিখেছিলেন, তা থেকে বোঝা যায়, তিনি বাঙালির সমস্যার সারকথাটি ঠিকই বুঝেছিলেনঃ- “ হাহাকার বঙ্গদেশে টাকার জ্বালায়।/ তুমি এলে শুভঙ্করি! বাড়ে আরও দায়।/ কেন এসো, কেন যাও/ কেন চালকলা খাও/ তোমার প্রসাদে যদি টাকা না কুলায়।/ তুমি ধর্ম, তুমি অর্থ , তার বুঝি এই অর্থ,/ তুমি মা টাকারূপিনী ধরম টাকায়।/ টাকা কাম টাকা মোক্ষ,/ রক্ষ মাতঃ রক্ষ রক্ষ/ টাকা দাও লক্ষ লক্ষ নৈলে প্রাণ যায়। ......” [ গদ্য পদ্য বা কবিতা পুস্তক, ১৮৭৮]

চাকুরিজীবী বাঙালির দৈনন্দিন যন্ত্রণার ছবি পাওয়া যায় ‘পূজার পাগল’-এর ‘চাকরে’ নামের এক কবিতায়। এতে পূজোয় সংসারের নানা রকমের খরচের এক বিশাল ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে। রজক, পাচক, পরামাণিক, গোয়ালিনী, পিওন, খানসামা – সবার দাবি তো আছেই, তার পরেঃ- “ছেলেপিলেদের পোষাক, ধূতি, জামা,/ উলকাঁটা, বডি, জ্যাকেট, বিনামা”, যা কিনা “পরে হবে বলে রেখে দিলে পরে,/ বাজার উঠে যাবে চড়ে।“ এ ছাড়া – “দিদিমা পিসিমা জেঠাইমা, মাসীমা;/ কার যে কত চাই নাইক তার সীমা,/ বার তের খানা নামাবলী, আর/ ডজন দুই তিন মালাই।“ কিন্তু এসবেরও ওপরে – “গত সপ্তাহে গিন্নির এক পত্রে/ লেখা ছিল প্রায় পঞ্চাশটি ছত্রে/ সাজ সরঞ্জাম এটা ওটা সেটার মস্ত একখান লিস্টি…।“ সবশেষে গৃহস্থের হাহাকারটুকুও লক্ষ করার মতোঃ- “হায়রে প্রবাস, হায়রে গোলামী,/আনন্দময়ি মা! আর নিরানন্দে/ রেখনা প্রাণ যে যায়।“ 

শুধু নিজের স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের জন্য পূজোয় কেনাকাটা করলেই বাঙালি গৃহস্থের সমস্যা শেষ হয়না, কারণ তার অন্যান্য সামাজিকতা –লৌকিকতাগুলোও পূজো-কেন্দ্রিক। সারা বছরের জমানো সমস্যাগুলোও যে পূজোর মরশুমের বোঝার ওপরেই চেপে বসে, তা বোঝা যায় ‘পূজার পাগল’ সংকলনটিতে ‘কর্তা ও গিন্নি’ কবিতাটিতে নানারকম সাংসারিক দাবির দীর্ঘ তালিকা থেকে। এখানে দেখা যায় কর্তা গিন্নিকে বলছেন, “ ওগো যতই করনা ভর্ৎসনা,/ এবার বুঝি হয়না মায়ের অর্চনা!/ আদায়পত্র শূন্যি আমার,/ পুণ্যি থাকুক মাথায়,/ কন্যাটি হলেন চতুর্দশ পার/ কুল মান রাখা দায়।...“ ইত্যাদি। গৃহস্থের নানা আর্থিক দায়িত্বের এই তালিকায় আছে ছেলের কলেজের ও পরীক্ষার ‘ফিস্‌’, কাশীবাসী শাশুড়ির মাসোহারা, গৃহিনীর গহনার ও বাড়ির দুর্গাপ্রতিমার ডাকের সাজ,, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লৌকিকতা ইত্যাদি। এ-প্রসঙ্গে গিন্নির মন্তব্যঃ- “হয়েছই যখন সংসারী/ তখন দিলে ত চলে না ফাঁকি।“

পূজোর সময় মধ্যবিত্তের বাড়তি খরচ সামলাতে বোনাসের ব্যবস্থা যে হাল আমলের জিনিস, এমনটা মনে করার কারণ নেই। এর আগে উল্লিখিত উনিশ শতকের ‘বসন্তক’ পত্রিকার সেই ‘দুর্গোৎসব’ নকশাটিতেও আমরা কেরানীবাবুদের পরিচিত বোনাসকে পাই অন্য চেহারায়ঃ- “...অনেক কষ্টের পর রাত ৭।।০ র সময় আপিসের বড় সাহেব মাহিনা বাঁটতে লাগলেন ও সঙ্গে প্রণাম দিতে লাগলেন।আহা এখন আর কেরানী ভায়াদেরে মুখে হাসি ধরেনা, সম্বৎসরের ইস্টুপিড, ড্যাম, রাস্কেল, এন্ড মি এন্ড সি, ঘুষো লাথি সব ভুলে গেলেন; দুহাত তুলে হুজুরের জয় বলে বগল বাজায়ে আপিস থেকে বেরিয়ে আগুনখাকির মত গে বাজারে পড়লেন।“ এর পাশাপাশি রাখা যায় অপেক্ষাকৃত হাল আমলের একটি নকশায় দেবী দুর্গার স্বীকারোক্তিঃ- “নন্দীভৃঙ্গী বোনাসের লাগি লাগি করে সদা উস্খুস।“[‘হরপার্বতী সংবাদ’ / প্রবুদ্ধ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭-১০-১৯৬৩]

পুজোর মরশুমে এমনিতেই মধ্যবিত্তের ওপর আর্থিক ধাক্কাটা একটু বেশিই হয়, তার ওপর বিশেষ কোনও সমকালীন ঘটনার ফলে যদি অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তা হলে তো কথাই নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ও বাংলাব্যাপী খাদ্যাভাব ও অনটনের আঁচ পাওয়া যায় শশীভূষণ দাসের ‘এস মা জননী (আগমনী)’ নামক এক কবিতা-সংকলনেঃ - “এস মা জননী দুর্গতিনাশিনী নেহার দুর্গতি আজ/ ধ্বংসের বাজনা বাজিছে ভারতে মাথায় পড়িছে বাজ।/ খাদ্যশস্যের অভাব হয়েছে, পরনে বসন নাই,/ রোগের ওষুধ মেলেনা কাহারো পথ্য খুঁজে না পাই,/…সংবাদ আসিল এবার পূজায় লুচির ফলার নাই,/ পুঁই চচ্চড়ি, মানকচু পোড়া ভাতে খেতে হবে ভাই!” এই কবিতা মনে পড়িয়ে দেয় পঞ্চাশ সালের দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় মোহিতলাল মজুমদারও লিখেছিলেন -- “মাতৃশক্তিপূজা নয়,মাতৃশ্রাদ্ধ দিন / বাৎসরিক – দায়গ্রস্ত পুত্র দীনহীন / করিয়াছে কোনোমতে তার উদ্‌যাপন / আজি তার বর্ষকৃত্য প্রেতের তর্পণ!’’ আবার‘বিজয়চন্ডী’ কবিতায় যতীন্দ্রমোহন বাগচি লিখেছিলেন, অন্নবস্ত্রহীন দেশে ভীরু ও শঙ্কিত প্রাণের পূজা দেবী গ্রহণ করেন না -- “দুর্বল দেহ, দুর্বল প্রাণ – আনন্দহীন ভীরুর দলে -/ মৃন্ময়ী মাতা চিন্ময়ী হন কোন্‌ কল্পনাশক্তিবলে?/ বিরাট বিশ্বমাতারে বরিয়া কেমনে সে মূঢ় বাঁধিবে কাছে, / বক্ষের নীচে শূন্য জঠর হাঁ করিয়া যার পড়িয়া আছে।” স্বদেশ-সমকালের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ উৎসবের সময় ভুলে থাকা স্বাভাবিকভাবেই এই কবিদের কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এই দারিদ্র্যের কারণেই আগমনীর সানাই শুনে কাজী নজরুলের মনে হয়েছে -- “ও যেন কাঁদিছে শুধু, নাই, কিছু নাই!”

“তুমি এলে শুভঙ্করি! বাড়ে যত দায়’- এই কথা বলে দুর্গার বাৎসরিক আরাধনাকে কেন্দ্র করে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে ঘনিয়ে আসা যেসব দায় বা দায়িত্বের কথা বঙ্কিম বোঝাতে চেয়েছিলেন, তার মধ্যে পরিবার-পরিজনের জন্য নতুন জামাকাপড় ইত্যাদি কেনার দায়ের পড়েই আসে বারোয়ারি পূজোগুলোর চাঁদার উৎপাতের সম্মুখীন হবার দায়। এই চাঁদার দাবি নিয়ে যারা প্রতি বছর গৃহস্থের দ্বারে হাজির হয়, তাদের বক্তব্য দেখা যাচ্ছে গত শতকের ষাটের দশকে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘কমলাকান্তের আসর’ কলমে “পূজার চাঁদার হিসাব’ নামে একটি কবিতায়ঃ- “ এবার টাকার টানাটানি/ মাছ তেলে সব ফুরোয়,/ বাঁধা দামের মধুর মিথ্যা,/ তবুও কান জুড়োয়!....” এই রচনাটিতে একটি সার্বজনীন দুর্গাপূজার আর্থিক দায়দায়িত্বের যে-ফিরিস্তি রয়েছে সেটি দেখা যেতে পারেঃ- “......দাদা,/ এবার পূজোয় নমো নমো/ সবই আধামাধা।/ পুরুত ধরুন আড়াই টাকা/ চালকলা দশ আনা,/ হাফ রেশনে খাবেন মাতা,/ বুঝুন মজাখানা!/ আলোকসজ্জা আড়াই হাজার ,/ মন্ডপে পাঁচ হাজার,/ বাদ্যভান্ডে হাজার খানেক,/ বেজায় মাগ্‌গী বাজার।/ নৃত্যগীতের অনুষ্ঠানে/বাজেট এবার কম,/হাজার দশেক, তার বেশি নয়,/ ফুরিয়ে গেল দম।....” তাই চাঁদাপ্রার্থীর আবেদনঃ- “কাজেই পূজো নমো নমো,/ দেখতে পাচ্ছেন শাদা/ গতবারের চেয়ে বেশি/ দেবেন এবার চাঁদা।“ সবশেষে তার দার্শনিক উপলব্ধিঃ-- “দাদা;/ চাঁদার হিসাব কেউ দিয়েছে? যে দেয় নেহাত গাধা।/ মায়ের টাকা ছেলেয় খাবে, আর খাবে ভক্তগণ/ প্রাচ্য দেশের এই তো রীতি নিয়ম চিরন্তন।“ 

প্রবুদ্ধ রচিত ‘হর-পার্বতী সংবাদে’রও শুরুতেই দেখা যায় ‘১৮৮৫ শকে’র [অর্থাৎ ১৩৭০ বঙ্গাব্দ] বঙ্গভূমির এই বর্ণনাঃ- “সমাগত শারদীয়া; আকাশে-বাতাসে/ বাজারে-অফিসে, আর গৃহস্থের ঘরে/ লবণ আনিতে পান্তা ফুরোবার ধূম।/ চাল মহামূল্য।– তবু চাল মারিবার/ বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই; দোকানেতে ভীড়।/ সাজের বহর, আর পকেটে ও পেটে/ লক্ষ্মীপূজা পর হতে ডন মারিবারে/ ছুছুন্দরীকুল তৈরী। যুগের হুজুগে/ মত্ত সবে, কেবা আজ কার কথা শোনে!...“ এতে দেখা যায় শিব পার্বতীকে বলছেন, “ কিন্তু দেবি! বঙ্গবাসী দুর্দশায় ভোগে।/ ঘরে চাল-চুলো নাই, দেখেও এসেছ/ এই তো সেদিন। কিবা আশীর্বাদ দেবে/ পূজা শেষে সন্তানেরে, বিরস বদন?/ ....কোন্‌ সে উপায়ে/ অগণিত ভক্তের দুঃখ হবে দূর?” এর উত্তরে দেবী দুর্গা বলেন, “দুর্গা মোর নাম, দুর্গতিমোচন চেষ্টা অবশ্য-কর্তব্য মোর। চাল দিতে নাহি পারি,/ আশ্বাস তো আছে। ....তাই নাথ,চল যাই/ আশার ললিত বাণী শুনাইয়া আসি,/ অতঃপর ভবিষ্যৎ জানা সবাকার,/ খন্ডাইতে পারে কেবা ললাট লিখন।“ [আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭-১০-১৯৬৩] 

তুমি এলে শুভঙ্করি! বাড়ে যত দায়’- এই কথা বলে দুর্গার বাৎসরিক আরাধনাকে কেন্দ্র করে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে ঘনিয়ে আসা যেসব দায় বা দায়িত্বের কথা বঙ্কিম বোঝাতে চেয়েছিলেন, তার মধ্যে পরিবার-পরিজনের জন্য নতুন জামাকাপড় ইত্যাদি কেনার দায়ের পড়েই আসে বারোয়ারি পূজোগুলোর চাঁদার উৎপাতের সম্মুখীন হবার দায়। এই চাঁদার দাবি নিয়ে যারা প্রতি বছর গৃহস্থের দ্বারে হাজির হয়, তাদের বক্তব্য দেখা যাচ্ছে গত শতকের ষাটের দশকে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘কমলাকান্তের আসর’ কলমে “পূজার চাঁদার হিসাব’ নামে একটি কবিতায়ঃ- “ এবার টাকার টানাটানি/ মাছ তেলে সব ফুরোয়,/ বাঁধা দামের মধুর মিথ্যা,/ তবুও কান জুড়োয়!....” এই রচনাটিতে একটি সার্বজনীন দুর্গাপূজার আর্থিক দায়দায়িত্বের যে-ফিরিস্তি রয়েছে সেটি দেখা যেতে পারেঃ- “......দাদা,/ এবার পূজোয় নমো নমো/ সবই আধামাধা।/ পুরুত ধরুন আড়াই টাকা/ চালকলা দশ আনা,/ হাফ রেশনে খাবেন মাতা,/ বুঝুন মজাখানা!/ আলোকসজ্জা আড়াই হাজার ,/ মন্ডপে পাঁচ হাজার,/ বাদ্যভান্ডে হাজার খানেক,/ বেজায় মাগ্‌গী বাজার।/ নৃত্যগীতের অনুষ্ঠানে/বাজেট এবার কম,/হাজার দশেক, তার বেশি নয়,/ ফুরিয়ে গেল দম।....” তাই চাঁদাপ্রার্থীর আবেদনঃ- “কাজেই পূজো নমো নমো,/ দেখতে পাচ্ছেন শাদা/ গতবারের চেয়ে বেশি/ দেবেন এবার চাঁদা।“ সবশেষে তার দার্শনিক উপলব্ধিঃ-- “দাদা;/ চাঁদার হিসাব কেউ দিয়েছে? যে দেয় নেহাত গাধা।/ মায়ের টাকা ছেলেয় খাবে, আর খাবে ভক্তগণ/ প্রাচ্য দেশের এই তো রীতি নিয়ম চিরন্তন।“ 

প্রবুদ্ধ রচিত ‘হর-পার্বতী সংবাদে’রও শুরুতেই দেখা যায় ‘১৮৮৫ শকে’র [অর্থাৎ ১৩৭০ বঙ্গাব্দ] বঙ্গভূমির এই বর্ণনাঃ- “সমাগত শারদীয়া; আকাশে-বাতাসে/ বাজারে-অফিসে, আর গৃহস্থের ঘরে/ লবণ আনিতে পান্তা ফুরোবার ধূম।/ চাল মহামূল্য।– তবু চাল মারিবার/ বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই; দোকানেতে ভীড়।/ সাজের বহর, আর পকেটে ও পেটে/ লক্ষ্মীপূজা পর হতে ডন মারিবারে/ ছুছুন্দরীকুল তৈরী। যুগের হুজুগে/ মত্ত সবে, কেবা আজ কার কথা শোনে!...“ এতে দেখা যায় শিব পার্বতীকে বলছেন, “ কিন্তু দেবি! বঙ্গবাসী দুর্দশায় ভোগে।/ ঘরে চাল-চুলো নাই, দেখেও এসেছ/ এই তো সেদিন। কিবা আশীর্বাদ দেবে/ পূজা শেষে সন্তানেরে, বিরস বদন?/ ....কোন্‌ সে উপায়ে/ অগণিত ভক্তের দুঃখ হবে দূর?” এর উত্তরে দেবী দুর্গা বলেন, “দুর্গা মোর নাম, দুর্গতিমোচন চেষ্টা অবশ্য-কর্তব্য মোর। চাল দিতে নাহি পারি,/ আশ্বাস তো আছে। ....তাই নাথ,চল যাই/ আশার ললিত বাণী শুনাইয়া আসি,/ অতঃপর ভবিষ্যৎ জানা সবাকার,/ খন্ডাইতে পারে কেবা ললাট লিখন।“ [আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭-১০-১৯৬৩] 

এই পত্রিকাতেই পরের বছর একই লেখকের ‘হর-পার্বতী সংবাদ ১৩৭১’ রম্যরচনাটিতে দেখা যাচ্ছে দুর্গোৎসবে দেবী দুর্গার সন্তানদের বঙ্গদেশে যেতে ঘোর অনীহা! এই সূত্রে গণেশ মা দুর্গাকে যা বলেন, তাতে ফুটে উঠেছে সমকালের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও কালোবাজারীর সমস্যার ছবিঃ- “...মন্ডপেতে দর্শকের মন্তব্য কি পাওনা শুনিতে?/ কেউ বলে,’পেট মোটা ঐ ব্যাটা গণেশের তরে/ আমরা অভুক্ত আছি।‘ আমি নাকি ‘বেলাকের’ চাঁই/ মাছ ও সরিষা নিয়ে ম্যাজিক দেখাই।....“ এরই সমসাময়িক কালে আনন্দবাজার পত্রিকায় কলকাতার এক বস্ত্রবিপণির কবিতায় লেখা এক সচিত্র বিজ্ঞাপনে পূজো উপলক্ষে গৃহিনীর কেনাকাটার ঠেলায় পতিদেবতার চিন্তা ভাবনার কিছু নমুনাঃ- “কোন্‌ দোকানের ছোট জামা কিনে,/ গিন্নি বলেন, এটাই লেটেস্ট ফ্যাশন্‌/ কর্তা ভাবেন চোখ কপালে তুলে,/ এই টাকাতে দু’দিন হ’ত র‍্যাশন্‌!/ যেমনি মা তার তেমনি ছেলে মেয়ে,/ হাল ফ্যাশনের কিন্‌ছে পোষাক কত।/ সে সব দেখে হাত পা সেঁধোয় পেটে, / গৃহস্বামীর নাড়ী ছাড়ার মত।।“ [‘শারদীয় ফ্যাশন্‌ রঙ্গ’] 

সমাজে সমস্যা থাকলে তার সমাধানের বা মোকাবিলা করার দায়ও থেকে যায় ও দুর্গোৎসবের মতো বিরাট সামাজিক উৎসবকে কেন্দ্র করে তা যেন আরও প্রকট মূর্তি নিয়ে দেখা দেয়। বাঙালির সব যুগের পূজা-কেন্দ্রিক সাহিত্যে তাই সমকালের পরিস্থিতির ও সমাজ-সমস্যার নির্ভুল প্রতিফলন দেখা যায়। ‘বসন্তক-এর দুর্গোৎসব’ নামে যে কবিতাটির [১৮৮৮-৮৯] কথা আমরা উল্লেখ করেছি, তাতে গরিব ব্রাহ্মণটি যেসব অভিলাষ ব্যক্ত করেছে, তার সবই নিছক অক্ষমের ইচ্ছাপূরণ নয়, তার মধ্যে সে-সময়ের নানা সামাজিক অভ্যাস, প্রথা ও প্রবণতার প্রতি শ্লেষও আছে। এর কয়েকটিঃ- বিলিতি সাজে দেবীপ্রতিমার অলঙ্করণ, বন্ধুদের নিয়ে মজলিশ, বাই-নাচ, খেমটা নাচ, ‘মদের সদাব্রত’, হোটেল থেকে বাড়িতে খানা এনে খাওয়া, বৈঠকখানায় ‘বেশ্যা আনা’, বাড়ির দুর্গাপূজায় ‘লালমুখো সাহেব বিবি’দের আমন্ত্রণ করে আনা,ইংরেজের পদলেহন, বাঙালির নিন্দা ও খেতাবের জন্য মোসাহেবি ইত্যাদি ইত্যাদি। এরই পাশে রেখে দেখা যায় ১৯৮৪ সালের সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘হর-পার্বতী সংবাদ ১৩৯১’ নকশাটি থেকে শিবের এই সংলাপঃ- “ভুলে যেওনা গিন্নি, দেশের নাম পশ্চিমবাংলা।...এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ/ তবু রঙ্গে ভরা। সব হবে। সব এক মঞ্চে পাশাপাশি হবে। পাতাল রেল, চক্র রেল, বাহাত্তর ইঞ্চি পাইপ, দাবি-মিছিল, ধর্ম-মিছিল, বিয়ের মিছিল, ফুটবল, বাস্কেটবল, হকি, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, যাত্রা উৎসব, বাঙলাবন্ধ, বোম ছোরাছুরি, ভোট, ব্যালে নাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, বন্যা, খরা, বনমহোৎসব, বননিধন, সব পাশাপাশি চলবে। ...তুমি কিস্যু ভেব না। [আনন্দবাজার পূজা ক্রোড়পত্রিকা, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪] 

আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘গৌড়ানন্দ কবি’ রচিত একটি কৌতুক নকশায় গত শতকের ষাট-সত্তর দশকের কিছু পরিচিত শব্দ ও নাগরিক সমস্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন – উগ্রপন্থী, হিপি, ও সর্বদলীয় সমন্বয় সমিতি ইত্যাদি। এটিতে দেখা যাচ্ছে, পুত্রকন্যাসহ দুর্গা পশ্চিমবঙ্গে আসার পরে হাওড়া ব্রিজে ট্রাফিক জ্যামে আটকে যান। ফলে মন্ডপে পৌঁছতে দেরি হওয়ায় সর্বদলীয় কোঅর্ডিনেশন কমিটির সদস্যেরা বাড়ি ফিরে যান। মণ্ডপে পুলিশ এসে উগ্রপন্থী সন্দেহে কার্তিককে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের পক্ষে ‘অকাট্য প্রমাণ’ হল - “ধৃত ব্যক্তি কবুল করিয়াছে যে, তাহার বয়স একুশ এবং তীর ধনুকও তাহার, তাহাও সে স্বীকার করিয়াছে। অতএব উহাকে বিভিন্ন স্থানে জোতদার হত্যার আসামী হিসাবে অনায়াসে চালান দেওয়া যাইবে।“ [‘হিং টিং ছট’] 

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের পূর্বোক্ত ‘হরপার্বতী সংবাদ ১৩৯১’ রচনাটিতে দুর্গাপূজা ও বঙ্গজীবন নিয়ে শিবের নানারকম ভুয়োদর্শন পাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে বাঙালির দৈনন্দিন অভাব আর অনটনের প্রসঙ্গঃ- “ ...সার্বজনীন অনেকটা টিউমারের মতো, আবের মতো। বেড়েই চলে। ... বাঙালীর জীবনে আর কী আছে বল। চাকরি নেই, বাকরি নেই, জল নেই, আলো নেই, খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই, সুখ নেই, নিরাপত্তা নেই, শিল্প নেই, সংস্কৃতি নেই। থাকার মধ্যে এই পুজোটুকু আছে। “ আবার পূজোর সময় গতবছর মশার কামড় খেতে হয়েছে, দুর্গার এই অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁকে শিবের উপদেশঃ- “ এবার প্যান্ডেলে সিংহের পিঠে উঠে পোজ দেবার আগে বড়বাজার থেকে বেশ বড় সাইজের একটা নাইলনের মশারি কিনে নিও। ম্যালেরিয়া, ফ্লু আর ডেঙ্গু একসঙ্গে ধরলে ধন্বন্তরীর বাবার ক্ষমতা নেই সারায়।“ এই বিবরণ যেন মনে করিয়ে দেয় এর একশো বছে আগে লেখা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিঘ্নময় এ বাঙ্গালা’ শব্দবন্ধটি।

পশ্চিম বাঙলা বা বাঙালি যতই আর্থিক অস্বাস্থ্যে ভুগুক, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যে সাময়িক ভাবে হলেও বাঙালির অর্থনীতিতে, বাণিজ্যে চাঙ্গাভাব আসে, সেই সত্যটিও শিবই জানান দুর্গাকেঃ- “......তুমি তো ক্যাপিটাল গো, মূলধন। তোমাকে পেছনে রেখে পুজো, পুজোকমিটি। বাইশের পল্লী, তেইশের পল্লী। বিল বই, চাঁদা। প্রিপূজা সেল, পূজা সেল, একজিবিশান, ফাংশান। পটুয়াপাড়ায় তুমি হাফ-ফিনিশ হয়ে এসেছ। দোমেটের কাজ শেষ হয়ে এসেছে। তোমার ছাঁচে ঢালা মুন্ডু সার সার তাকে তোলা আছে। ঠ্যাঙে বায়নার টিকিট ঝুলছে। গেরস্থেরা মার্কেটিং-এ নেমে পড়েছে। শ্যামবাজার থেকে গড়িয়া গুঁতোগুঁতি শুরু হয়ে গেছে।“ [আনন্দবাজার পূজা ক্রোড়পত্রিকা, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪] আজ থেকে তিন দশক আগের এই বর্ণনাটি পড়লে মনে হয় আমরা যেন হুতোমের নকশায় বা ‘বসন্তক’ পত্রিকার কোনও রম্য রচনায় বঙ্গজীবনে দুর্গোৎসবের ছবি দেখছি। বোঝা যায় যে, গত তিনশো বছরে রাজনীতি, অর্থনীতি আর সমাজনীতি অনেক বদলে গেলেও নিজেদের জীবনে সবরকম দায়দুর্গতিকে মেনে নিয়েই বাঙালির ‘শুভঙ্করী’ দুর্গাকে আবাহন করে নেবার সেই কৌতুকস্নিগ্ধ মেজাজটি আজও হারিয়ে যায়নি।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆


No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...