Sunday, 31 January 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
শক্তিপদ রাজগুরু 
কৃষ্ণ ধর
=============///////////////============
    Doinik Sabder Methopath
     Vol -269. Dt -01.02.2021
       ১৯ মাঘ, ১৪২৭. সোমবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷||||||||||||||||÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
শক্তিপদ রাজগুরু
শক্তিপদ রাজগুরুর জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯২২ সালে একজন বাঙালি কথাসাহিত্যিক হিসেবে। তিনি বাংলা জনপ্রিয় ধারার লেখক । পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার গোপমারি গ্রামে। পিতা মণীন্দ্র নাথ ছিলেন মুর্শিদাবাদের একটি গ্রামের পোস্টমাস্টার।  তার স্কুল জীবন কেটেছে মুর্শিদাবাদের পাঁচথুপি টি এন ইন্সটিটিউশন স্কুলে। পরে বহরমপুর কৃষ্ণনগর কলেজ ও কলকাতা রিপন কলেজ পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পরিণত বয়সে কলকাতায় আবাস গড়েন। কলকাতার সিঁথিতে তার বাড়ির সামনের রাস্তার নাম রাখা হয়েছে শক্তিপদ রাজগুরু সরণি।ছোটো থেকেই অসাধারণ স্মরণশক্তি ছিল তাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দীর্ঘ কবিতাগুলিও মুখস্থ আবৃত্তি করতেন তিনি। পড়াশুনোর পাশাপাশি তিনি বেড়াতে ভালোবাসতেন। ছোটোনাগপুরের জঙ্গল, দণ্ডকারণ্যের বনানী তাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করতো। অবসর পেলেই ভ্রমণে যেতেন এই জায়গাগুলিতেে।] উদ্বাস্তুদের নিয়ে লিখে তার জীবনে যশ আসে। কিন্তু তিনি উদ্বান্তু ছিলেন না। তিনি বলেছেন, “আমি উদ্বাস্তু নই, পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দা৷ বাঁকুড়ায় আমাদের সাত পুরুষের ভিটে ছিল৷ কিন্ত্ত আমার বাবা চাকরি করতেন ‘পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফস’-এ৷ মুর্শিদাবাদ জেলার পাঁচথুপি গ্রামের পোস্ট মাস্টার ছিলেন৷ আমার বারো বছর বয়স অবধি সেখানে কেটেছে৷ তখন আমি ভাবতাম যে ওই জায়গাটা আমার জায়গা৷ কিন্ত্ত বারো বছর পর বাবা যখন ট্রান্সফার হয়ে গেলেন তখন আমি আবিষ্কার করলাম যে এই মাটির আমি কেউ নই৷ সরকারের এক কলমের খোঁচায় আমার পায়ের তলা থেকে মাটিটা সরে গেল৷ বন্ধুবান্ধব, বারো বছরের ইতিহাস, স্মৃতি সব কিছু ছেড়ে আমি উদ্বাস্তু হয়ে পথে নামলাম৷”

             তাঁর লেখালেখির সূচনা ১৯৪০ দশকের গোড়ার দিকে। ১৯৪২-এ দেশ পত্রিকায় প্রথম গল্প “আবর্তন” লিখে তিনি সকলের নজর কাড়েন। ১৯৪৫-এ প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস দিনগুলি মোর। আদ্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হয়ে ছিন্নমূল পূর্ববঙ্গীয়দের সুখ-দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণা উপলব্ধি করার জন্য ঘুরেছেন 'তবু বিহঙ্গ' উপন্যাসের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য। গল্প-উপন্যাস ও বিবিধ রচনার সমগ্র সম্ভার প্রায় তিনশতাধিক । উল্টোরথ পত্রিকায় ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার একটি বড়গল্প, যার নাম “চেনামুখ" । এ গল্পের আখ্যান ছিল উদ্বাত্তদের অসহনীয় জীবন সংগ্রাম। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক এ গল্পের কাহিনী অবলম্বনে তৈরী করে একটি চলচ্চিত্র যার নাম “মেঘে ঢাকা তারা”। এ চলচ্চিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং শক্তিপদ রাজগুরুকে জনসাধারণ্যে পরিচিত করে তোলে। ঋত্বিক ঘটকের প্রশিক্ষণে এ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন শক্তিপদ নিজেই।

তার নয়া বসত” গল্পের কাহিনী অবলম্বনে থেকে শক্তি সামন্ত নির্মাণ তৈরি করেন “অমানুষ” ছবিটি যা ১৯৭৫ সালে মুক্তি লাভ করে এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৮১-তে শক্তি সামান্ত তার আরেকটি গল্প নিয়ে দ্বিতীয় একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যার নাম ছিল “অমানুষ”। বিখ্যাত হয়ে আছে উত্তম কুমারের অভিনয়ে। হিন্দিতে হয়েছে 'বরসাত কি এক রাত'। একই সঙ্গে ছবিটির বাংলা সংস্করণ বের হয় এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।[৩] অন্যায় অবিচার শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাস নিয়ে তৈরি আরেকটি চলচ্চিত্র।

ছোটদের জন্য তিনি অনেক উপন্যাস লিখেছেন। এ সবের কেন্দ্রীয় নায়ক “পটলা” বেশ খ্যাতি লাভ করেছিল।
রচনা কর্ম :

মেঘে ঢাকা তারা মনি বেগম অন্তরে অন্তরে জীবন কাহিনী অনুসন্ধান অমানুষ জনপদ অধিগ্রহণ স্বপ্নের শেষ নেই আজ-কাল-পরশূ মাশুল স্মৃতি টুকু থাক অচিন পাখি ভাঙাগড়ার পালা দিনের প্রথম আলো শেষ প্রহর গোঁসাইগঞ্জের পাঁচালী
নিঃসঙ্গ সৈনিক পরিক্রমা অনিকেত দূরের মানুষ
নবজন্ম গ্রামে গ্রামান্তরে দিন অবসান অধিকার
বাঘা বায়েন পটলা সমগ্র পথের বাউল প্রভৃতি।

       "মেঘে ঢাকা তারা" তাঁর জনপ্রিয়তম গ্রন্থ। দীর্ঘজীবি এই সাহিত্যিক তিন শতাধিক গ্রন্থের লেখক। তাঁর লেখালেখির সূচনা ১৯৪০ দশকের গোড়ার দিকে। ১৯৪২-এ দেশ পত্রিকায় প্রথম গল্প “আবর্তন” লিখে তিনি সকলের নজর কাড়েন। ১৯৪৫-এ প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস দিনগুলি মোর।বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। সারা জীবনে ১০০টির বেশি উপন্যাস লিখেছেন এই সাহিত্যিক। ১৯৪৫ সালে দেশভাগের প্রেক্ষাপটে উদ্বাস্তু জীবনের উপর ভিত্তি করে লেখা প্রথম উপন্যাস 'দিনগুলি মোর' প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাঠকমহলে জনপ্রিয়তা লাভ করেন শক্তিপদবাবু।
তাঁর একাধিক উপন্যাস ও গল্প অবলম্বন করে বেশ কিছু বাংলা এবং হিন্দি উল্লেখযোগ্য ছবি তৈরি হয়েছে। এমনকি মঞ্চ ও টেলিভিশনেও তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে তাঁর রচনা অবলম্বনে তৈরি নাটক ও টেলি সিরিয়াল। তিনি নিজেও চিত্রনাট্য লেখক হিসেবে বিশেষ সমাদৃত হয়েছেন। এর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য 'মেঘে ঢাকা তারা', 'মণি বেগম', 'অন্তরে অন্তরে', 'জীবন কাহিনি', 'অনুসন্ধান', 'অমানুষ', 'বাঘিনী' ও 'কুয়াশা যখন' উল্টোরথ পত্রিকায় ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি বড়গল্প, যার নাম “চেনামুখ । এ গল্পের আখ্যান ছিল উদ্বাত্তদের অসহনীয় জীবন সংগ্রাম। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক এ গল্পের কাহিনী অবলম্বনে তৈরী করে একটি চলচ্চিত্র যার নাম “মেঘে ঢাকা তারা”। এ চলচ্চিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং শক্তিপদ রাজগুরুকে জনসাধারণ্যে পরিচিত করে তোলে। ঋত্বিক ঘটকের প্রশিক্ষণে এ চলচ্চিতের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন শক্তিপদ নিজেই। তাঁর নয়া বসত” গল্পের কাহিনী অবলম্বনে থেকে শক্তি সামন্ত নির্মাণ তৈরি করেন “অমানুষ” ছবিটি যা ১৯৭৫ সালে মুক্তি লাভ করে এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৮১-তে শক্তি সামান্ত তাঁর আরেকটি গল্প নিয়ে দ্বিতীয় একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যার নাম ছিল “অমানুষ”। এ ছবিটির হিন্দি সংস্করণের নাম রাখা হয় “বারসাত কি এক রাত” এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। অন্যায় অবিচার শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাস নিয়ে তৈরী আরেকটি চলচ্চিত্র। ছোটদের জন্য তিনি অনেক উপন্যাস লিখেছেন। এ সবের কেন্দ্রীয় নায়ক “পটলা” বেশ খ্যাতি লাভ করেছিল।
  তিনি নিজের রচিত উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন। মৌলিক নাটক কখনো লেখেননি। তাঁর রচিত নাটক 
 মেঘে ঢাকা তারা , মনি বেগম,  জীবন কাহিনী , প্রজাপতি,  কুমারী মন , প্যালারাম নিরুদ্দেশ প্রভৃতি বিশেষ সাড়া ফেলেছিল।  বিশেষ করে কিশোর নাটক ও মনি বেগম ছাড়া সবগুলি শতমিতা নাট্যগোষ্ঠী দীনের রায়ের নির্দেশনা ও প্রযোজনায় মঞ্চ সফল নাটক হয়ে উঠেছিল।

মৃত্যু -১২ জুন ২০১৪ 
-----------------------------------
কৃষ্ণ ধর
    
"একরাশ লোকের ভিড়ে গন্ধ শুঁকে শুঁকে পথ চলছি
মানুষের বাড়ি ফেরার গন্ধ আমি বিকেল হলেই টের পাই
তখন নদীর জল করুন হয়
তখন স্টিমারের ভো বাজে 
...................................
আমি মানুষের জন্মের কান্না শুনতে শুনতে
এই রক্তগোধূলিতে নদী পার হ‌ই একা একা।"
      
         স্বাধীনতা-উত্তর বামপন্থী ধারায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল কবিদের মধ্যে অন্যতম কৃষ্ণ ধর। যার সর্বাধিক পরিচিতি কাব্য নাটক রচনায় তিনি পেশায় সাংবাদিক হলেও তার অন্তর্নিহিত কবি মন্টি বারেবারে কবিতার যাপন চিত্রে মৌলিকতার চিহ্ন এঁকে গেছে শিল্পিত সুষমা নিয়ে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "অঙ্গীকার "(১৯৪৮) প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাঠকমহলে পরিচিতি লাভ করেন।
১৯২৮ সালে ১ লা ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমার কমলপুর গ্রামে কৃষ্ণ ধরের জন্ম। বাবার নাম উপেন্দ্রচন্দ্র ধর ও মায়ের নাম চিন্ময়ী দেবী। বাজিতপুর এইচ ই হাই স্কুল থেকে ১৯৪৩ সালে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফেনী কলেজ থেকে ১৯৪৫ সালে আই এ পাশ করে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এম এ পড়েন। এম এ পড়তে পড়তেই ১৯৪৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অঙ্গীকার’ প্রকাশিত হয়। তখনকার বিখ্যাত ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় এই কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯৪৯ সালে কবি এম এ পাশ করেন।

তাঁর কর্মজীবনের শুরু কলকাতা দেশবন্ধু গার্লস কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে। অল্পদিন সেখানে পড়ানোর পরে তিনি ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি ‘যুগান্তর’-এর সম্পাদক হন। বিশিষ্ট সাংবাদিক কৃষ্ণ ধর বিভিন্ন সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ও ভারতীয় বিদ্যা ভবনের সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত তিনি ‘বসুমতী’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

বিভিন্ন সময়ে তিনি সাম্মানিক পদে থেকে বহুবিধ দায়িত্ব পালন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রথম কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাস মিডিয়া সেন্টারের সভাপতি। ছিলেন কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের রিনেমিং কমিটির সদস্য। এছাড়াও তিনি রবীন্দ্র সদনের উপাদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন।

কবি কৃষ্ণ ধর গত শতাব্দীর পাঁচের ও ছয়ের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন। ওই সময়কালের মধ্যে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল ‘প্রথম ধরেছে কলি’ (১৯৫৫), ‘এ জন্মের নায়ক’ (১৯৬২), ‘এক রাত্রির জন্য’ (১৯৬০), ‘আমার হাতে রক্ত’ (১৯৬৭), ‘কালের নিসর্গ দৃশ্য’ (১৯৬৮) ‘দুঃসময় কবিতার লেখকের কাছে’ (১৯৭০) প্রভৃতি। পরবর্তী কালে প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে আছে ‘কালের রাখাল তুমি ভিয়েতনাম’ (১৯৭২), ‘যে যেখানে আছো’ (১৯৭৬), ‘শব্দহীন শোভাযাত্রা’ (১৯৮১), ‘হে সময় হে সন্ধিক্ষণ’ (১৯৯১), ‘নির্বাচিত কবিতা’ (১৯৯৬), ‘প্রিয় বাক্ কথা রাখো’ (২০০১), ‘গাঙচিলের স্বপ্ন ও সাতরঙা রামধনু’ (২০০৫), ‘হাঁটব থামব না’ (২০০৮), ‘জোনাকপরি হোমাপাখি’ (২০০৮), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (সংকলনগ্রন্থ) (২০১৬), ‘কবিতা সংগ্রহ’ (২০১৯) প্রভৃতি।

কবিতার পাশাপাশি তিনি অনেক কাব্যনাটক রচনা করেছেন। তাঁর কাব্যনাটকগুলি হল ‘নির্বাচিত কাব্যনাটক’ (১৯৮৪), ‘বিরুদ্ধ বাতাস’ (১৯৮৯), ‘কাব্যনাটক সংগ্রহ’ (২০০৯) (‘ভোরের মানুষেরা’, ‘সিন্ধুপারের পাখি’, ‘আমি নচিকেতা’, ‘ডানা’, ‘অভিমন্যু’, ‘জেগে আছো বর্ণমালা’, ‘খড়কুটো’, ‘বিরুদ্ধ বাতাস’, ‘বিকেলের বারান্দা পেরিয়ে’, ‘পায়ের শব্দ শোনা যায়’, ‘প্রচ্ছদে লেগেছে ধুলো’, ‘কেয়া ফুলের গন্ধ’, ‘পদধ্বনি কার’, ‘যাই উৎসের দিকে’, ‘একটাই জীবন’, ‘নদীতেই প্রতীক’, ‘গোলাপের যুদ্ধ’, ‘ঘরে ফেরার দিন’, ‘যদিও সন্ধ্যা, ‘পাহাড় ডেকেছিল’, ‘হে সময় হে সন্ধিক্ষণ’, ‘নিহত গোধূলি’, ‘বধ্যভূমিতে বাসর’, ‘করুণ রঙীন পথ’, ‘অন্ধকারে জুঁই ফুলের গন্ধ’, ‘বনজ্যোৎস্না’, ‘সমবেত করতালি’, ‘বাতিঘর’, ‘পদধ্বনি পলাতক’)। অপ্রকাশিত কাব্যনাটক ‘ফুলওয়ালি’ ১৯৬৮/৬৯ সালে গন্ধর্ব নাট্যগোষ্ঠীর দ্বারা মঞ্চস্থ হয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

তাঁর লেখা দুটো অত্যন্ত সুখপাঠ্য ভ্রমণকাহিনী হল ‘মস্কো থেকে ফেরা’ (১৯৭৪), এবং ‘অন্য দেশ অন্য নগর’ (১৯৮১)। তাঁর স্মৃতিচারণামূলক বই ‘আট দশক সাত কাহন'(২০১৬)। গত বছর ‘ঝাঁকিদর্শন’ (২০১৯) শিরোনামে তাঁর আর একটা স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দুটোই বেশ সুখপাঠ্য।

সাহিত্য নিয়ে লেখা তাঁর বইয়ের মধ্যে আছে ‘আধুনিক কবিতার উৎস'(১৯৬৯) ও ‘সাহিত্যের সাজঘর'(২০১৫)।
তাঁর ইতিহাসমূলক লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ (১৯৭১), ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রামে বাংলা’ (১৯৯৭) ও ‘কলকাতা তিন শতক’ (প্রথম সংস্করণ ১৯৮৯, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯৪)।

তাঁর লেখা জীবনীগুলি হল ‘দেশনায়ক সুভাষ’ (প্রথম সংস্করণ ১৯৯৭, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৭), এবং ‘সংগ্রামী সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়’ (২০০৭)।

সাংবাদিকতা নিয়ে লিখেছেন ‘সাংবাদিকতার দর্শন : আদর্শ ও বিচ্যুতি’ (প্রথম সংস্করণ ২০০৩, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৫)।

এ ছাড়াও অন্যান্য ধরনের তাঁর দুটো উল্লেখযোগ্য বই আছে। সেগুলো হল ‘বই পড়ুয়ার দেখা মানুষ’ (২০১৪) ও ‘পুরানো আখরগুলি’ (২০১৩)।

স্বনামে লেখার পাশাপাশি তিনি মল্লিনাথ, বিদুর ও অন্যদর্শী ছদ্মনামেও লিখেছেন।

সারাজীবনে তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুধা বসু পুরস্কার, পোয়েট্রি ইন্ডিয়া পুরস্কার, শিশির কুমার পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির নজরুল পুরস্কার, মুজফফর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার, অমৃত পুরস্কার, ত্রিবৃত্ত পুরস্কার, গৌরী ঘোষাল স্মৃতি পুরস্কার, সারঙ্গ সাহিত্য পত্রিকার সারঙ্গ অর্ঘ্য নিবেদন ও গ্রেট বেঙ্গল পুরস্কার।

তাঁর কবিতার ভাষা বড়ো মোলায়েম। ব্যক্তি জীবনের মতো কবিতাতেও তিনি মৃুদুভাষী। অনুচ্চ কণ্ঠে মৃদু পদক্ষেপে তাঁর কবিতা আমাদের অজান্তেই আমাদের নিয়ে চলে যায় তাঁর কবিতার নিজস্ব ভুবনে। কঠোর বাস্তবের লড়াই সংগ্রামের কথা বলার সময়েও কৃষ্ণদা বরাবর অনুত্তেজিত থেকেছেন। তাই তাঁর কবিতা পড়ে পাঠকেরাও অনুত্তেজিত চিত্তে সমকালে তাঁদের কৃত্যাকৃত্য নির্ধারণের দিশা খুঁজে পান। ‘হে সময় হে সন্ধিক্ষণ’ কাব্যগ্রন্থের নীচের কবিতাটি পড়লেই এটা বুঝতে পারা যাবে।
তাঁর কবিতায় শুধু প্রেম নয়,  উপাদান হিসেবে স্থান পেয়েছে দেশবিভাগ জনিত যন্ত্রণা মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধ।  মনুষ্যত্ববোধের প্রত্যয়, চীনের সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদ, রাশিয়ায় স্ট্যালিনের সংস্কার প্রভৃতি। সমাজ সচেতন ও আঙ্গিক সচেতন তিনি যে ছিলেন তাঁর প্রমাণ কবিতায় আমরা প্রত্যক্ষ করি। অনুভব স্পন্দিত অভিনন্দিত উপলব্ধির স্বরূপ সন্ধানে মানুষের কথা বলেছেন, সারাজীবন ধরে ।তিনি মানুষের কবি মানুষের কান্নার প্রতি কান পেতে আছেন মানুষের জন্য একা একা পথ হেঁটেছেন মানুষের কাছে ,মানুষের সাথে ,মানুষ কে নিয়ে চলতে চেয়েছেন।

=================================




Saturday, 30 January 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

*****************************************
     জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
   আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী
###############################
Doinik Sabder Methopath
    Vol -268. Dt -31.01.2021
     ১৭ মাঘ ১৪২৭. রবিবার
©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©©
আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৪৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার চাংড়িপোতা গ্রামে (বর্তমানে সুভাষগ্রাম)  মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মজিলপুরে। তাঁর পিতা পণ্ডিত হরানন্দ বিদ্যাসাগর (১৮২৭-১৯১২) ছিলেন জয়নগর মজিলপুর পৌরসভার প্রথম পৌরপ্রধান। তাঁর মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ (১৮১৯-১৮৮৬) ছিলেন তৎকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাপ্তাহিক পত্রিকা 'সোমপ্রকাশ'এর সম্পাদক।

শিবনাথ কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৬৬) এবং কলেজ থেকে এফ.এ (১৮৬৮), বি.এ (১৮৭১) ও এম.এ (১৮৭২) পাস করেন। পরে ঐ কলেজ থেকেই তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধি লাভ করেন।

ছাত্রাবস্থায়ই (১৮৬৯) শিবনাথ কেশবচন্দ্র সেনের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। Indian Reforms Association-এ যোগ দিয়ে তিনি মদ্যপান নিবারণ ও নারীমুক্তি আন্দোলনে এবং শিল্প-সাহিত্য-কারিগরি বিদ্যার প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। মদ্যপানের বিরোধিতা কল্পে তিনি ১৮৭০ সালে প্রকাশ করেন মদ না গরল শীর্ষক একটি মাসিক পত্রিকা। পরে তিনি সোমপ্রকাশ (১৮৭৩-৭৪) ও ধর্মবিষয়ক সমদর্শী পত্রিকা (১৮৭৪) এবং আরও পরে 
১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি সিটি স্কুল ও স্টুডেন্টস সোসাইটি নামে একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র সমিতি গঠন করেন।
১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নারী শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে মেয়েদের নীতিবিদ্যালয় স্থাপন করেন।
১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর উদ্যোগে ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক পত্রিকা 'সখা' প্রকাশিত হয়।
১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের জন্য সাধনাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ।

১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ইন্ডিয়ান মেসেজ ও মুকুল (১৮৯৫) পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
এই সময়ে তিনি কিছুদিন 'তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকার সম্পাদনা করেন।

শিবনাথ কেশব সেনের ভারত আশ্রমের বয়স্কা মহিলা বিদ্যালয় (১৮৭২), ভবানীপুর সাউথ সুবারবন স্কুল (১৮৭৪) এবং হেয়ার স্কুলে (১৮৭৬) শিক্ষকতা করেন। এক পর্যায়ে তিনি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৭৮)। নারীমুক্তি আন্দোলনে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহের পক্ষে তিনি কেশবচন্দ্রের সহযোগী ছিলেন। তাদের বলিষ্ঠ প্রচেষ্টায় ১৮৭২ সালে মেয়েদের বিয়ের নূ্যনতম বয়সসীমা ১৪ বছর নির্ধারিত হয়।

১৮৭৭ সালে শিবনাথ ব্রাহ্ম যুবকদের ‘ঘননিবিষ্ট’ নামে একটি বৈপ্লবিক সমিতিতে সংগঠিত করে পৌত্তলিকতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে এবং নারী-পুরুষের সমানাধিকার ও সর্বজনীন শিক্ষার পক্ষে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন। শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি সিটি স্কুল ও স্টুডেন্টস সোসাইটি নামে একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র সমিতি (১৮৭৯) এবং নারী শিক্ষার প্রসারের লক্ষে্য মেয়েদের নীতিবিদ্যালয় (১৮৮৪) স্থাপন করেন। ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক পত্রিকা সখা (১৮৮৩) তার উদ্যোগেই প্রকাশিত হয়। ১৮৯২ সালে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সাধনাশ্রম।

শিবনাথ কাব্য , উপন্যাস , প্রবন্ধ, জীবনী ইত্যাদি ধারায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তার কয়েকটি অনুবাদ ও সম্পাদিত গ্রন্থও আছে। রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (১৯০৪), আত্মচরিত (১৯১৮), History of Brahma Samaj ইত্যাদি তার গবেষণামূলক আকরগ্রন্থ। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা হলো: নির্বাসিতের বিলাপ (১৮৬৮), পুষ্পমালা (১৮৭৫), মেজ বৌ (১৮৮০), হিমাদ্রি-কুসুম (১৮৮৭), পুষ্পাঞ্জলি (১৮৮৮), যুগান্তর (১৮৯৫), নয়নতারা (১৮৯৯), রামমোহন রায়, ধর্মজীবন (৩ খণ্ড, ১৯১৪-১৬), বিধবার ছেলে (১৯১৬) ইত্যাদি। 
প্রাবন্ধিক হিসেবেও শিবনাথ শাস্ত্রী রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। 
সমাজ সম্পর্কে প্রগতিশীল দৃষ্টিই তাঁর প্রবন্ধ-সাহিত্যের উপজীব্য বিষয়।
হিন্দু ধর্মের নানামাত্রিক কুসংস্কার থেকে তিনি সমাজকে মুক্ত করার মানসে একের পর
এক প্রবন্ধ লিখেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হচ্ছে – এই কি ব্রাহ্ম বিবাহ? (১৮৭৮), খৃষ্টধর্ম (১৮৮১), জাতিভেদ (১৮৮৪), বক্তৃতা স্তবক (১৮৮৮), মাঘোৎসব উপদেশ (১৯০২), মাঘোৎসব বক্তৃতা (১৯০৩), প্রবন্ধাঞ্জলি (১৯০৪), ধর্মজীবন (১৯১৬) ইত্যাদি।
ব্রাহ্মধর্মের তিন প্রধান তাত্ত্বিকের জীবনী লিখেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী। তাঁর জীবনী
গ্রন্থগুলো হচ্ছে রামমোহন রায়
(১৮৮৫), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
(১৯১০) এবং ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র
(১৯১০)। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী আত্মচরিত। তাঁর আত্মচরিত পাঠ করলে গোটা উনিশ শতক পাঠকের
চোখে ভেসে উঠবে। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর কালজয়ী গ্রন্থ -
রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, যা
ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবে উত্তরকালে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইংরেজি
ভাষাতেও শিবনাথ শাস্ত্রী কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য ইংরেজি
গ্রন্থ – History of the Brahma Samaj (১৮৮৮) এবং Men I have seen (১৮৯৯)।
রামতনু লাহিড়ী এবং উনিশ শতকী বাঙালির নবজাগরণকে সমান্তরাল দৃষ্টিতে
পর্যবেক্ষণ করে শিবনাথ শাস্ত্রী রচনা করেছেন রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ। রামতনু লাহিড়ীর ব্যক্তিজীবন
উপস্থাপন সূত্রে শিবনাথ শাস্ত্রী এই গ্রন্থে নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন উনিশ
শতকী উন্মথিত বাঙালির জাগরণ-ইতিহাস। কেবল উনিশ শতকী সমাজ নয়, সমকালীন
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কেও এখানে পাওয়া যাবে শিবনাথ শাস্ত্রীর বিশ্লেষণাত্মক মূল্যায়ন। গ্রন্থটি কেবল উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকিত মানুষ রামতনু লাহিড়ীর জীবনেতিহাস নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে ওই শতকের সামাজিক-সাংস্কৃতিকইতিহাস ও রেনেসাঁস-আন্দোলনের ঐতিহাসিক এক দলিল। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় শিবনাথ শাস্ত্রীর নিম্নোক্ত ভাষ্য :
…অগ্রে ভাবিয়াছিলাম বিশেষভাবে তাহার [রামতনু লাহিড়ী] অনুরক্ত ব্যক্তিগণের জন্য একখানি
ক্ষুদ্রাকার জীবনচরিত লিখিব।… অতএব, প্রথমে তদ্নুরাগী লোকদিগের জন্যই লিখিতে
আরম্ভ করিয়াছিলাম। কিন্তু তৎপরে মনে হইল, লাহিড়ী মহাশয়ের যৌবনের প্রথমোদ্যমে
রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার ও ডিরোজিও, নব্যবঙ্গের এই তিন দীক্ষাগুরু তাঁহাদিগকে যে
মন্ত্রে দীক্ষিত করেন, সেই মন্ত্রের প্রভাবেই বঙ্গসমাজের সবর্ববিধ উন্নতি ঘটিয়াছে;
এবং সেই প্রভাব এই সুদূর সময় পর্যন্ত লক্ষিত হইতেছে। আবার সেই উন্নতির স্রোতের
সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেন, অগ্রসর হইয়া অত্যগ্রসর দলের সঙ্গে মিশিয়াছেন, এরূপ দুই একটি
মাত্র মানুষ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে লাহিড়ী মহাশয় একজন। অতএব, তাঁহার জীবনচরিত লিখিতে
গেলে, বঙ্গদেশের আভ্যন্তরীণ ইতিবৃত্তকে বাদ দিয়া লেখা যায় না। তাই বঙ্গদেশের
আভ্যন্তরীণ সামাজিক ইতিবৃত্তের বিবরণ দিতে প্রবৃত্ত হইতে হইল।রামতনু লাহিড়ীর জীবন-ইতিহাস, উনিশ শতকের সামূহিক অবক্ষয় এবং রামমোহন-হেয়ার-ডিরোজিও প্রভাবিত ভাব-আন্দোলন – এই ত্রিমাত্রিক বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রন্থটি পাঠ করার সময় মনে হয় না যে একখানা জীবনীগ্রন্থ বা সমাজ-ইতিহাসের বই পাঠ করছি; বরং মনে হয়,পাঠ করছি অসামান্য এক উপন্যাস। 



১৯১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।
$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$$

Friday, 29 January 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

       জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য

নরেন্দ্রনাথ মিত্র

=================================

   Doinik sabder methopath

Vol -267.Dt -30.01.2021

  ১৭ মাঘ, ১৪২৭. শনিবার

÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷


কল্লোল পরবর্তী যুগে সমাজ বাস্তবতা ও মানবিক অন্তর্মুখী ঘাত-প্রতিঘাতে গরীব নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত মানুষের চেনা সম্পর্ক নিয়ে পরিচিত সংসারের রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে খুঁজে পেয়েছেন বাঙালি পাঠক।বিশেষ করে চল্লিশের দশকের জটিল জীবনযন্ত্রণার মুক্তিকামী মমত্ববোধ সম্পন্ন শুভ বিশ্বাসের শিল্পীমন  ছিলেন তিনি।

                            তিনি ১৬ মাঘ, ১৩২৩ বঙ্গাব্দ (৩০ জানুয়ারি, ১৯১৬)-এ জন্মগ্রহণ করেন  বাংলাদেশের ফরিদপুরের সদরদিতে। ভঙ্গা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই-এ ও বি-এ পাশ করেন বঙ্গবাসী কলেজ থেকে। লেখালেখির সূচনা বাল্য কালে। প্রথম মুদ্রিত কবিতা 'মূক', প্রথম মুদ্রিত গল্প 'মৃত্যু ও জীবন'। দুটোই 'দেশ' পত্রিকায়, ১৯৩৬ সালে। বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'জোনাকি' (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ)। "নিরিবিলি" নামে আরও একটি কাব্যগ্রন্হ প্রকাশিত হয় । এরপর মাঝেমাঝেই তার লেখা কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও গ্রন্হাকারে আসেনি । প্রথম গল্প-সংগ্রহ 'অসমতল' (১৩৫২ বঙ্গাব্দ)। প্রথম উপন্যাস 'হরিবংশ', গ্রন্থাকারের নাম 'দীপপুঞ্জ' (১৩৫৩ বঙ্গাব্দ)। গল্পগ্রন্থ একান্নটি আর উপন্যাসের সংখ্যা আটত্রিশটি। উপন্যাসের মধ্যে বিশেষত, 'দীপপুঞ্জ', 'চেনামহল', 'তিন দিন তিন রাত্রি' ও 'সূর্যসাক্ষী', দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশকাল থেকেই দারুণ ভাবে সমাদৃত। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মারা যান।

শান্ত-নিস্তরঙ্গ পল্লীজীবন, নগরমুখী মফস্বল শহরের ভাসমান মধ্যবিত্ত এবং মহানগরী কলকাতার সীমায়িত এলাকার অভিজ্ঞতা তার উপন্যাসগুলির মূল উপজীব্য। নিজের ‘দ্বীপপুঞ্জ’ উপন্যাসের আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, “আমার কোন রচনাতেই অপরিচিতদের পরিচিত করবার উৎসাহ নেই। পরিচিতরাই সুপরিচিত হয়ে উঠেছে।”

রচনা কর্ম :

তাঁর প্রথম লেখা কবিতা "সুখ" ১৯৩৬ সালে দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়। ঐ বছর তাঁর রচিত প্রথম ছোটগল্প 'জীবন ও মৃত্যু' দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

উপন্যাস : (৩৫ টি)

দ্বীপপুঞ্জ রূপমঞ্জরী অক্ষরে অক্ষরে চেনামহল দেহমন দূরভাষিণী সঙগিণী অনুরাগিণী সহৃদয়া গোধুলি শুল্কপক্ষ চোরাবালি তিন দিন তিন রাত্রি পরস্পরা জলপ্রপাত কণ্যাকুমারী সুখ দুঃখের ঢেউ প্রথম তোরণ তার এক পৃথিবী সেই পথটুকু নীড়ের কথা নতুন ভূবন জলমাটির গন্ধ শিখা অনাত্মীয়া নতুন তোরণ সূর্যমুখী সিঁদূরে মেঘ নির্বাসন প্রভৃতি।

    - বাঙালির মধ্যবিত্ত জীবনের কথাকার নরেন্দ্রনাথ, তাঁর উপন্যাসে এঁকেছেন - সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা জীবনের জটিলতা গ্রামীণ জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত অন্তর্দ্বন্দ্ব চেনা জানা মানুষের ভিড়ে মানবিক নানান অনুষঙ্গ।বিশেষ করে মানবজীবনের কুসুম ও কীট দুই ‌‌ই তিনি দেখেছেন, শান্ত মসৃণ পরিবেশে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। 

গল্প সংকলন

অসমতল হলদে বাড়ি চড়াই-উৎরাই বিদ্যুৎলতা সেতার উল্টোরথ পতাকা কাঠগোলাপ অসবর্ণ ধূপকাঠি রুপালি রেখা ও পাশের দরজা একুল ওকুল বসন্ত পঞ্চমী দেবজানি ময়ূরী বিন্দু বিন্দু একটি ফুলকে ঘিরে বিনি সুতোর মালা যাত্রাপথ  চিলেকোঠা উন্নয়ন বিবাহ বাসর চন্দ্রমল্লিকা সন্ধ্যারাগ সেই পথটুকু অনাগত পালঙ্ক প্রভৃতি।

  * তিনি তার নিজের রচনা সম্পর্কে বলেছেন -

" সমাজে শঠতা আছে ক্রুরতা আছে তা আমি জানি হিংসা-বিদ্বেষের অভাব নেই কিন্তু সমাজ জীবনের এই অন্ধকার দিকের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় কম কারন আমার লেখায় জীবনের সেই সকল দিক খুব বড় হয়ে দেখা দেয় নি যতদূর মনে হয় সান্ত মধুর ভাবি আমার রচনায় বেশি মানুষের উত্থান পতন ত্রুটি অবশ্যই আছে কিন্তু তা আমার গর্বের বস্তু নয় যেখানে আমার মহৎ শক্তিমান সেখানে যেন আমাদের যথার্থ পরিচয় আছে..... আমার মেজাজ রোমান্টিক সৌন্দর্যপ্রিয় তাই মহত্বই আমার আকর্ষণ করে বেশি।"

   - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলে নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত জীবনের সংস্কার মূল্যবোধ ও নানান অভিঘাতে ক্ষতবিক্ষত তাঁর গল্পগুলি জীবন্ত ও বাস্তব । ব্যক্তিত্বের সংকটে অসহায় আবার উৎসাহে একান্ত জীবনমুখী - আমরা লক্ষ্য করি।

কবিতা সংকলন

জোনাকি

              নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাহিত্যকর্মের মধ্যে যেগুলি চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে তার কয়েকটি - সত্যজিৎ রায়ের মহানগর, অগ্রগামীর 'হেডমাস্টার', 'বিলম্বিতলয়'; রাজেন তরফদারের 'পালঙ্ক'। 'রস' গল্পটির অমিতাভ বচ্চন অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের নাম 'সৌদাগর'।


সিন্ধুতে বিন্দু খোঁজার মতো মৌলিকতা নিয়ে যিনি উপলব্ধি করেছিলেন চেনাজানা মানুষের মুখের ভাষায় পরিচিত মহল,  মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনচর্চায় প্রতিদিনের জীবনধারা, ধারাবাহিক যাপন চিত্রে আঁকা নানান রঙের ছবি,  তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে।  তাই তিনি কল্লোল উত্তর তথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকার।

মৃত্যু _ ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ ।


∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Thursday, 28 January 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

  ∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆ 
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
১। 
আন্তন পাভলোভিচ চেখভ

২। 
রোমা রোলাঁ
 ÷÷=÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷////////////////////÷÷÷÷÷÷÷÷÷   
 Doinik Sabder Methopath
   Vol -266. Dt -29.01.2021
১৫ মাঘ, ১৪২৭. শুক্রবার
==========///////////////////////////==========
১। 
       আন্তন পাভলোভিচ চেখভ

""আমুর নদীতে স্টিমার চলছে সাখালিনের দিকে। পায়ে বেড়ি পরা এক কয়েদি ছিল সেখানে, যে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। তার সাথে তার ছয় বছর বয়সী ছোট মেয়েটি ছিল। আমি লক্ষ্য করলাম যে, যখনই কয়েদিটি নড়েচড়ে দাঁড়াচ্ছে এবং হাঁটছে, তার মেয়েটি দ্রুত ছুটে যাচ্ছে তার দিকে এবং হাত দিয়ে পায়ের বেড়ি ধরে রাখছে। রাতের বেলায় শিশুটি কয়েদি এবং সৈন্যদের গাদার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লো।"

২৯ জানুয়ারি ১৮৬০ সালে দক্ষিণ রাশিয়ার আজভ সাগর সংলগ্ন বন্দরনগরী তাগানরোগে জন্মগ্রহণ করেন। এটি ছিল সন্ত মহান অ্যান্থনির মৃত্যুবার্ষিকী। ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। চেখভের পিতা পাভেল জেগোরোভিচ চেখভ (১৮২৫-১৮৯৮) ছিলেন ভরনেজ প্রদেশের ওলহভাৎকা গ্রামের একজন প্রাক্তন ভূমিদাস কৃষক এবং তার মাতা ছিলেন ইউক্রেনীয়।পাভেল চেখভ তাগানরোগে একটি মুদি দোকান চালাতেন। তিনি ছিলেন গির্জার ধর্মসংগীতে নেতৃত্বদানকারী গায়কবৃন্দের পরিচালক এবং একজন ধর্মপ্রাণ গোঁড়াবাদী খ্রিস্টান। পিতা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও রূঢ়। তার সন্তানদের তিনি এমনকি শারীরিকভাবেও শাস্তি দিতেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন চেখভের রচিত কপটতাপূর্ণ চরিত্রগুলো তৈরী হয়েছে তার পিতার আদলে।চেকভের মা জেভগেনিয়া জাকোভলেভনা (১৮৩৫-১৯১৯), ছিলেন চমৎকার গল্পকথক। তিনি তার ছেলেমেয়েদের কাছে তার কাপড়-ব্যবসায়ী বাবার সাথে পুরো রাশিয়া ভ্রমণের গল্প বলতেন। চেখভ তার মায়ের কথা স্মরণ করেছেন এভাবে, “আমরা আমাদের মেধা বাবার কাছ থেকে পেয়েছি, কিন্তু হৃদয় পেয়েছি মা’র কাছ থেকে”।পরিণত বয়সে চেখভ তার ভাই আলেকসান্দরের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের প্রতি তার বিরুদ্ধ আচরণের সমালোচনা করতেন। 
তাগানরোগের বাণিজ্যে গ্রিক ব্যবসায়ীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাই চেখভের পিতা চেখভকে ও তার এক ভাই নিকলাইকে গ্রিক চার্চ ও গ্রিক স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলটি অসফলভাবে চলছিল এবং দুই বছর পরেই এটি পরিণত হয় তাগানরোগ শরীরচর্চা কেন্দ্রে, যা বর্তমানে চেখভ জিমনেসিয়াম। স্কুলে চেখভের কৃতিত্ব ছিল গড়পড়তা মানের। পনের বছর বয়স পর্যন্ত চেখভকে একই ক্লাসের পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছিল, কেননা তিনি একটি গ্রিক পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি।এই ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে গ্রিক গোঁড়াবাদী গির্জার সমবেত ধর্মীয় সঙ্গীতে অংশগ্রহণ এবং তার পিতার দোকানের কাজে চেখভের নিয়মিত কার্যক্রম। এছাড়াও কারণ হিসেবে যোগ করা যেতে পারে সমকালীন রাশিয়ার কতৃত্বপূর্ণ শিক্ষা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি,কেননা চেখভ প্রভূত্বকে তুচ্ছজ্ঞান করতেন, প্রবলভাবে অপছন্দ করতেন। ১৮৯২ সালে লেখা এক চিঠিতে চেখভ তার শৈশব বর্ণনা করতে গিয়ে “দুঃখক্লেশ” শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। 

১৮৭৬ সালে একটি নতুন বাড়ি তৈরিতে অনেক বেশি পুঁজি বিনিয়োগের পর চেখভের পিতাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কারাবাস এড়াতে তিনি মস্কোতে পালিয়ে যান। সেখানে তার বড় দুই ছেলে আলেকসান্দর ও নিকলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। পরিবারটি মস্কোতে দারিদ্র্যের মাঝে বাস করছিলো। চেখভের মা শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। বিষয়সম্পত্তি বিক্রি ও স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার জন্য চেখভকে তাগানরোগেই রেখে আসা হয়েছিল।

চেখভ তাগানরোগে আরও তিন বছর ছিলেন। তিনি তাগানরোগে সেলিভানভ নামের এক ব্যক্তির সাথে থাকতেন যিনি চেখভের দ্য চেরি অরচার্ড-এর চরিত্র লোপাখিনের মতোই তাদের বাড়ি কিনে নিয়ে পরিবারটিকে ঋণমুক্ত করেছিলেন।চেখভকে নিজের পড়াশোনার ব্যয় নিজেকেই বহন করতে হতো। এই খরচের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি বেশ কয়েকরকমের কাজ করতেন যার মধ্যে একটি ছিল গৃহশিক্ষকতা। এছাড়াও তিনি গোল্ডফিঞ্চ পাখি ধরে বিক্রি করতেন এবং খবরের কাগজে ছোট ছোট স্কেচ এঁকেও অর্থ উপার্জন করতেন।তিনি তার দৈনন্দিন খরচ থেকে সঞ্চিত প্রতিটি রুবল মস্কোতে পাঠিয়ে দিতেন, সেই সাথে পরিবারের সদস্যদের উদ্দীপিত করার জন্যে পাঠাতেন হাস্যরসাত্মক চিঠি।] এই সময়টাতে তিনি প্রচুর পরিমাণে পড়েছেন। পড়েছেন বিশ্লেষণাত্মকভাবে। যে লেখকদের লেখা তিনি এই সময়ে পড়েছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন থের্ভান্তেসতুর্গেনেভগনচারভ এবং শোপনহাওয়ার।একই সময়ে তিনি ফাদারলেস নামের একটি পুরো দৈর্ঘ্যের কমেডি নাটকও লিখেছেন, যেটাকে তার ভাই আলেকজান্ডার বাতিল করে দিয়েছেন "অমার্জনীয়, যদিও নির্দোষ কল্পকাহিনী" হিসেবে। চেখভ বেশ কিছু প্রণয়ঘটিত সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিল শিক্ষকের স্ত্রীর সাথে।

১৮৭৯ সালে চেখভ স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে মস্কোতে তার পরিবারের সাথে যোগ দেন। তিনি আই.এম. সেচেনভ ফার্স্ট মস্কো স্টেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

মস্কোতে চলে আসার অল্প কিছুদিন পরেই চেখভ মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এখানেই তার শিক্ষা গ্রহণ চলে ১৮৭৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৮৪ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত। ঐ গ্রীষ্মে চেখভ ফাইনাল পরীক্ষা দেন। এই সময়ের মধ্যে সাত সদস্যের চেখভ পরিবার কয়েকবার তাদের আবাস বদল করেছে। এবং স্থায়ী আবাসে সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার আগের কয়েক মাস তাদেরকে যে অপ্রশস্ত বাসস্থান ও দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে বসবাস করতে হয়েছে তা চেখভের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।

চেখভ তার প্রথম দিকের লেখা গল্প বা অন্যান্য রচনায় যে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে বিস্ময়কর সব সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। এই বিস্ময়কর সম্পর্কগুলোর সম্যক উপলব্ধি সম্ভব যদি তার শুরুর দিকে লেখা চিঠিগুলো পর্যবেক্ষণ করা যায়। 

এই অর্ধ-পরিহাসমূলক, অর্ধ-অপ্রসন্নতাবোধক ভাব বিদ্যমান ছিল চেখভের শিক্ষাজীবনে লেখা চিঠিগুলোয় এবং এর পরবর্তী সময়ের চিঠিতেও। শুধুমাত্র ঘিঞ্জি পরিবেশ ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপনই তার লেখালেখির কাজকে বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং অনেক সম্পাদকের উপযুক্ত সম্মানী না দেয়ার মতো অসাধু মনোবৃত্তি, লেখার দৈর্ঘ্যের উপর সীমা আরোপও এক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে।১৮৮১ সালে একটি সন্ত্রাসবাদী দল জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে গুপ্তহত্যা করলে সরকারের সেন্সর পর্ষদ অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নেয় যা চেখভের লেখার কাজ আরও কঠিন করে দেয়। ১৮৮২ সালে চেখভের প্রথম ছোটগল্প সংকলন আ প্র্যাঙ্ক স্থগিত হয় এবং ধরে নেয়া হয় যে এটি হারিয়ে গিয়েছে।

মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে চেখভকে পুরো পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।.পরিবারকে সাহায্য করার জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যোগাড় করার জন্য চেখভ সমসাময়িক রুশ জীবন নিয়ে ছোট ছোট হাস্যরসাত্মক নাটক বা রচনা লিখতেন এবং অলঙ্করণমূলক নকশা আঁকতেন। এই নকশাদার চিত্র এবং হাস্যরসাত্মক লেখার অনেকগুলোই তিনি লিখেছিলেন ছদ্মনামে। আন্তোশা চেখন্তে (Антоша Чехонте) এবং রাগহীন মানব (Человек без селезенки) হচ্ছে তেমন দুইটি নাম। তার এই চিত্রাঙ্কণ ও বিদ্রুপাত্মক ধাঁচের লেখার জনপ্রিয়তা তাকে ক্রমে ক্রমে খ্যাতি এনে দেয় রাশিয়ার সাধারণ নাগরিক জীবনের ব্যাঙ্গাত্মক ইতিবৃত্তকার হিসেবে। ১৯৮২ সালের মধ্যেই খ্যাতনামা প্রকাশক নিকোলাই লেইকিনের পত্রিকা অসকোলস্কিতে তিনি লিখতে শুরু করেন।এই সময়টাতে চেখভের লেখা গল্প ও অন্যান্য রচনার অন্তর্নিহিত ভাব বা সুর ছিল তার পরিণত সময়ের গল্প উপন্যাসের চেয়ে বেশি রূঢ়।

১৯৮৪ সালে চেখভ চিকিৎসক হিসেবে পূর্ণ যোগ্যতাপ্রাপ্ত হন। চিকিৎসা পেশাকে তিনি তার প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিলেও এ থেকে তিনি সামান্যই উপার্জন করেছেন। দরিদ্রদের চিকিৎসায় তিনি তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেননি।১৮৮৪ ও ১৮৮৫ সালে চেখভ লক্ষ্য করেন তার কাশির সাথে রক্ত পড়ছে এবং ১৮৮৬ সালে এ অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তার পরিবার ও বন্ধুদের কাছে স্বীকার করেননি যে তার ক্ষয়রোগ হয়েছে।লেইকিনের কাছে স্বীকার করেছেন, “আমি পরীক্ষানীরিক্ষা করানোর জন্য বন্ধুদের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে ভয় পাচ্ছি।” তিনি সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলিতে লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকলেন এবং এ থেকে তার পরিবারের জন্য উত্তরোত্তর অপেক্ষাকৃত ভাল আবাসের সংস্থান করার মতো পর্যাপ্ত অর্থও উপার্জন করে যাচ্ছিলেন। ১৮৮৬ সালের শুরুর দিকে চেখভ মিলিয়নিয়ার শিল্পপতি আলেক্সি সাভরিনের মালিকানাধীন ও সাভরিনের সম্পাদিত সেন্ট পিটার্সবার্গের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা নোভায়া ভ্রেমায়াতে লেখার আমন্ত্রণ পান। লেখার প্রতি লাইনের জন্য লেইকিন যে সম্মানী দিতেন, এই সম্পাদক দিতেন তার দ্বিগুণ এবং লেইকিন পত্রিকার যতটুকু জায়গা জুড়ে চেখভের লেখা ছাপানোর অনুমোদন করতেন, আলেক্সি সাভরিনের অনুমোদন ছিল তার তিনগুণ বেশি স্থানের। সাভরিন চেখভের বন্ধু ছিলেন আজীবন, সম্ভবতঃ সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন তিনি।

এর অনেক আগে থেকেই চেখভ সাধারণ মানুষের কাছে যেমন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন, জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তেমনি বিখ্যাত সাহিত্যিকদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন তার লেখার সাহিত্যগুণের জন্য। চৌষট্টি বছর বয়স্ক নামকরা প্রবীণ রুশ লেখক দিমিত্রি গ্রিগোভিচ চেখভের ছোটগল্প দ্য হান্টসম্যান পড়ে চেখভকে লিখেছিলেন, "তোমার সত্যিকারের প্রতিভা আছে - এমন এক প্রতিভা, যা তোমাকে নতুন প্রজন্মের লেখকদের সামনের সারিতে জায়গা করে দিতে পারবে।" তিনি চেখভকে লেখালেখির পরিমাণ কমিয়ে লেখার সাহিত্যমানের প্রতি মনোযোগ দেয়ার উপদেশ দেন।

দিমিত্রি গ্রিগোভিচের চিঠির প্রতুত্তরে চেখভ লিখেছিলেন যে এ চিঠি তাকে আঘাত করেছে যেন বজ্রপাতের মতো এবং স্বীকার করেছেন, "আমি আমার গল্পগুলো লিখেছি এমন ভাবে, যেমন করে প্রতিবেদকরা কোথাও আগুন লাগলে তার বিবরণ লিখেন - যান্ত্রিক, অর্ধ-সচেতন এবং পাঠক ও আমার নিজের কোনো কিছুর প্রতি কোনো গুরুত্ব না দিয়ে।"এই স্বীকারোক্তি হয়তো চেখভের জন্য ক্ষতিকর ছিল, কারণ তার পূর্ববর্তী পাণ্ডুলিপিগুলো এটাই প্রকাশ করে যে তিনি বেশিরভাগ সময়েই লিখেছেন অত্যন্ত যত্নের সাথে, লেখার পরিমার্জনা করেছেন বারবার। তথাপি গ্রিগোভিচের উপদেশ ছাব্বিশ বছর বয়সের তরুণ চেখভকে আরো গভীর, শৈল্পিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৮৮৭ সালে গ্রিগোভিচের গোপন প্রভাবের সামান্য প্রয়োগে চেখভের ছোটগল্প সংকলন অ্যাট ডাস্ক বহু আকাঙ্ক্ষিত পুশকিন পুরস্কার জিতে নেয় "সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্যকর্মের জন্য, যা উচ্চ শৈল্পিক মূল্যগুণে স্বতন্ত্র।

চেখভের পরিবার ও বন্ধুরা, ১৮৯০। (উপরের সারিতে, বাম থেকে ডানে) ইভান, আলেকসান্দর, তাদের পিতা; (দ্বিতীয় সারি) একজন অজ্ঞাতনামা বন্ধু, লিকা মিজিনভা, মাশা, মাতা, সেরিওঝা কিসেলেভ; (নিচের সারি) মিশা, আন্তন।

অতিরিক্ত পরিশ্রমের দরুন ক্লান্ত ও অসুস্থ চেখভ বর্তমান ইউক্রেনের বিস্তীর্ন স্তেপ অঞ্চলে সফরে বের হন ১৮৮৭ সালের বসন্তে। তিনি তাগানরোগে তাদের পুরোনো বাড়ি এবং দক্ষিণ রাশিয়ার কিছু শহর ও বর্তমান ইউক্রেন ভ্রমণ করেন। ভ্রমণকালে স্তেপ অঞ্চলের সুন্দর দৃশ্যাবলী তার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।ফিরে আসার পর তিনি উপন্যাসিকা-ব্যাপ্তির একটি ছোট গল্প ‘দ্য স্তেপ’ লিখতে শুরু করেন যা ছাপা হয় প্রভাবশালী সাহিত্য সাময়িকী ‘সাভের্ন ভেস্টনিক’ (দ্য নর্দার্ণ হেরাল্ড)-এ।গল্পের চরিত্রগুলোর চিন্তাপ্রক্রিয়ার সাথে একই সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে যাওয়া এই উপাখ্যানে চেখভ একটি অল্পবয়সী বালকের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তুলেছেন স্তেপ অঞ্চলের এপার হতে ওপারে যাওয়া এক প্রমোদভ্রমণকে। এই অল্পবয়সী বালকটিকে তার বাড়ি থেকে দূরে বসবাস করার জন্য পাঠানো হয়েছিল এবং তার সঙ্গী ছিল এক পুরোহিত ও এক বণিক। দ্য স্তেপ, যাকে বলা হতো “চেখভের কাব্যশাস্ত্রের অভিধান”, সাহিত্যজগতে চেখভের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির প্রতিনিধিত্ব করেছে। এই গল্পটিই চেখভের পূর্ণাঙ্গ, পরিণত মানের লেখাগুলোর বৈশিষ্টমূলক গুণের বেশিরভাগের পরিচয় তুলে ধরে এবং চেখভের জন্য এনে দেয় দৈনিক পত্রিকার পরিবর্তে সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশনার সুযোগ।

১৮৮৭ সালের শরতে কোর্শ নামের এক থিয়েটার ব্যবস্থাপক চেখভকে একটি নাটক লিখতে বলেন যার প্রেক্ষিতে চেখভ এক পক্ষকালের মধ্যে ইভানভ রচনা করেন। নাটকটি সেই নভেম্বরেই মঞ্চস্থ হয় এবং এর মঞ্চস্থকরণের অভিজ্ঞতা ছিল চেখভের জন্য অত্যন্ত বিরক্তিকর। তিনি তার ভাই আলেকজান্ডারকে এই বিশৃংখল ঘটনাবলীর কৌতুকপ্রদ বর্ণনা দিয়ে একটি চিঠি লিখেন। তবে বিস্ময়করভাবে এই নাটকটি অনেক জনপ্রিয় হয় এবং প্রশংসিত হয় একটি অভিনব ও মৌলিক কাজ হিসাবে। মিখাইল চেখভ ইভানভকে বিবেচনা করেছেন তার সহোদরের সাহিত্য পেশার ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের এক গুরূত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে। এই নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে লেখা চেখভের গল্প, উপন্যাসগুলো থেকে একটি পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায়, যা পরে “চেখভ’স গান” হিসাবে পরিচিত হয়। ইলিয়া গারল্যান্ডের একটি কথোপকথন থেকে উল্লেখ্যঃ “যদি নাটকের কোনো অঙ্কে একটি বন্দুককে দেয়ালে ঝুলতে দেখতে পাও, তাহলে নাটকের শেষ অঙ্কে অবশ্যই এটি গুলিবর্ষণ করবে।”

১৮৮৯ সালে ক্ষয়রোগে চেখভের সহোদর নিকোলাই এর মৃত্যুর ঘটনা প্রভাবিত করে তার এ ড্রিয়েরি স্টোরি গল্পটিকে। ঐ বছরের সেপ্টেম্বরে সমাপ্ত গল্পটি চিত্রিত করেছে একজন ব্যক্তিকে যিনি জীবনের শেষ সীমায় উপনীত হয়ে উপলব্ধি করেছেন যে তার জীবন ছিল একেবারে উদ্দেশ্যবিহীন। নিকোলাই এর মৃত্যুর পর চেখভের অস্থিরতা এবং বিষাদগ্রস্ততার বিবরণ দিয়েছেন মিখাইল চেখভ। এই সময়টাতে মিখাইল চেখভ আইনশিক্ষার অংশ হিসেবে কারাগার নিয়ে গবেষণা করছিলেন, এবং ঐ একই সময়ে আন্তন চেখভ তার নিজের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সন্ধান করছিলেন। এই অবস্থায় অল্পকালের মধ্যেই তিনি কারাগার সংস্কার সম্বন্ধীয় বিষয়গুলি নিয়ে পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।

একটি ক্ল্যাসিক চেখভ-সাজঃ স্প্রিংসহ বিশেষ ধরনের চশমা, হ্যাট এবং বো-টাই

১৮৯০ সালে, ট্রেনে ও ঘোড়ার গাড়িতে এবং নদীপথে স্টিমারে করে এক কষ্টকর ভ্রমণে বের হন চেখভ। তিনি দূরপ্রাচ্যের রাশিয়া-অংশে (বৈকাল হ্রদ ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি) ও জাপানের উত্তরে সাখালিন দ্বীপের কাতোর্গা বা বন্দীশিবির দর্শন করেন। এখানে তিনি একটি আদমশুমারির জন্য কয়েদিদের ও বসতি স্থাপনকারীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তিন মাস কাটান। সাখালিনে আড়াই মাস যাবত ভ্রমণকালে লেখা চিঠিগুলোকেই তার লেখা সেরা চিঠি হিসেবে গণ্য করা হয়।

তোমস্কের অধিবাসীরা চেখভের একটি বিদ্রূপাত্মক প্রতিমূর্তি নির্মাণ ও স্থাপন করে এর শোধ নিয়েছিলেন।

সাখালিনে কয়েদিদের বেত, চাবুক দিয়ে নির্দয়ভাবে প্রহার করা হতো, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ আত্মসাৎ এবং নারীদেরকে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হতো যা চেখভ সেখানে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই ব্যাপারগুলো চেখভকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছিল এবং তাকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। তিনি লিখেছিলেন, "এমন সব সময় ছিল যখন আমার মনে হতো যে আমি আমার সামনে ব্যক্তির চরম মাত্রার মর্যাদাহানি দেখছি।"বিশেষ করে বন্দীশিবিরে বাবা-মা’র সাথে বাস করা শিশুদের দুর্দশা তাকে বিচলিত করেছিল। 

পরবর্তীকালে চেখভ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বদান্যতা ও চাঁদার মাধ্যমে অর্থদানই এ অবস্থার সমাধান নয়, বরং কয়েদিদের প্রতি মানবিক আচরণ ও তাদের সুচিকিৎসার জন্য অর্থ সংস্থান করার দায়িত্ব সরকারেরই। তাঁর এই অনুসন্ধানের ফলাফল ১৯৮৩ এবং ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল অস্ট্রোভ সাখালিন (সাখালিন দ্বীপ) নামে, যা কিনা সাহিত্য নয় - সমাজবিজ্ঞানের কাজ -মূল্যবান ও তথ্যবহুল।চেখভের অপেক্ষাকৃত বড় দৈর্ঘ্যের ছোট গল্প দ্য মার্ডারার এর শেষ অণুচ্ছেদে রয়েছে সাখালিন, যেখানে ফেলে আসা নিজের বাড়ির জন্যে আকুল আকাঙ্ক্ষারত খুনি লোকটি রাতের বেলায় কয়লা বোঝাই করে।১৮৯২ সালে মস্কোর চল্লিশ মাইল দক্ষিণে মেলিখোভোতে একটি ছোট জমিদারি কিনে পরিবারসহ চেখভ সেখানেই বসবাস করেন ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত। “জমিদার হওয়ার ব্যাপারটি চমৎকার”, শ্‌চেগ্লোভকে ঠাট্টার ছলে বলেছিলেন তিনি। কৌতুক করলেও ভূম্যধিকারী হিসেবে তার দায়িত্ব তিনি আন্তরিকতার সাথেই গ্রহণ করেছিলেন এবং স্থানীয় কৃষকদের মাঝে অল্পকালের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন নির্ভরযোগ্য ও প্রয়োজনীয়। ১৮৯২ সালের কলেরা প্রাদুর্ভাব এবং দুর্ভিক্ষ উপদ্রুতদের জন্য ত্রাণের বন্দোবস্ত করা সহ চেখভ মেলিখোভোতে তিনটি বিদ্যালয়, একটি দমকল স্টেশন ও একটি বেসরকারি চিকিৎসালয় নির্মাণ করেছিলেন। ক্ষয়রোগের নিয়মিত পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে তিনি মাইলের পর মাইল ঘুরে কৃষকদের চিকিৎসা করেছেন।

মেলিখোভোতে চেখভ পরিবারের এক সদস্য, মিখাইল চেখভ, তার ভাইয়ের চিকিৎসাসেবা দানের ব্যাপ্তি বা পরিমাণের বিবরণ দিয়েছেন এভাবেঃ

চেখভ মেলিখোভোতে যাবার প্রথম দিন থেকেই বিশ মাইল দূরের স্থান থেকেও অসুস্থ মানুষেরা দলে দলে আসতে শুরু করেছিল। কেউ এসেছিল পায়ে হেঁটে, কেউবা দুই চাকার ঘোড়ার গাড়িতে করে, এবং তাঁকে প্রায়ই রোগী দেখার জন্য দূরে যেতে হতো। কখনো কখনো খুব সকাল থেকেই কৃষক নারীরা ও তাদের শিশুরা চেখভের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতো।

ঔষধের জন্য চেখভের যা খরচ হতো পরিমাণের দিক থেকে তা খুব বেশি না হলেও অসুস্থদের দেখতে যাওয়ার জন্য কয়েক ঘণ্টা যাবত যাত্রায় তাকে যথেষ্ট খরচ স্বীকার করতে হতো। আর এটা তার লেখার সময়কেও কমিয়ে দিয়েছিল। যাইহোক, এই চিকিৎসক-বৃত্তির কারণেই চেখভ রুশ সমাজের সব স্তরের মানুষের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে যেতে পেরেছিলেন যা পরিণামে তার লেখালেখিকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি স্বচক্ষে কৃষকদের যে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা স্মরণ করেছেন তার কৃষকেরা ছোট গল্পে। অভিজাত শ্রেণীর সংস্পর্শেও এসেছেন চেখভ, যার বিবরণ পাওয়া যায় তার নোটবইয়েঃ "অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা? সেই একই কদর্য ব্যক্তিরা এবং শারীরিক অশুচিতা, সেই একই দন্তহীন বৃদ্ধ বয়স এবং নিদারুণ বিরক্তিকর মৃত্যু, যেমনটা হয় বাজারে-মেয়েদের।"

মেলিখোভোর ফলবাগানে নির্মিত তার বাড়িতে চেখভ দ্য সীগাল নাটকটি লিখতে শুরু করেন। সেটা ছিল ১৮৯৪ সাল। মেলিখোভোর এস্টেটে চলে আসার দুই বছরের মধ্যে তিনি বাড়িটিকে আবার ঝকঝকে ও পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে তুলেছেন, কৃষিকাজ ও উদ্যানবিদ্যা নিয়ে পড়েছেন, পুকুর ও ফলবাগানের তত্ত্বাবধান করেছেন, এবং অনেক গাছ লাগিয়েছেন, যা কিনা মিখাইলের মতে, তিনি “দেখাশোনা করেছেন … এমনভাবে যেন ওগুলো তাঁর সন্তান। তাঁর থ্রী সিস্টার্স গল্পটির কর্নেল ভার্শিনিন এর মতোই যখনই তিনি তাঁর রোপণ করা গাছগুলোর দিকে তাকিয়েছেন, তিনশ বা চারশ বছর পরে এই গাছগুলিই কেমন হবে এ নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন।”

১৮৯৬ সালের ১৭ই অক্টোবর পিটার্সবার্গের আলেক্সান্দ্রিনস্কি থিয়েটারে দ্য সীগাল নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী হয়। দর্শকদের অবজ্ঞাসূচক ধ্বনির মাঝে পরিবেশিত নাটকটির প্রথম রাতটি ছিল চরম ব্যর্থ। এরই প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ চেখভ আনুষ্ঠানিকভাবে থিয়েটার পরিত্যাগ করেন।কিন্তু এই নাটকটিই থিয়েটার পরিচালক ভ্লাদিমির নেমিরোভিচ-ড্যানচেঙ্কোর মনে এতোটাই রেখাপাত করেছিল যে তিনি তার সহকর্মী কনস্ট্যান্টিন স্ট্যানিস্লাভস্কিকে মস্কো আর্ট থিয়েটারে নাটকটি পরিচালনা করতে রাজি করান। এটা ১৮৯৮ সালের কথা। মনস্তাত্ত্বিক বাস্তববাদ ও দলের সামগ্রিক অভিনয়ের শৈল্পিক ঐক্যের প্রতি স্ট্যানিস্লাভস্কির মনোযোগ লেখার মূল পাঠে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ণতার উপস্থিতির বিষয়ে প্ররোচনা দিয়েছে এবং চেখভকে ফিরিয়ে দিয়েছে নাটক লেখার আগ্রহ। এরপরে মস্কো আর্ট থিয়েটার চেখভকে আরও নাটক লেখার দায়িত্ব দেয় এবং এর পরের বছরে মঞ্চস্থ হয় আঙ্কল ভানিয়া। এই নাটকটি তিনি লিখে শেষ করেছিলেন ১৮৯৬ সালে।

১৮৯৭ সালের মার্চে মস্কোতে থাকাকালীন সময়ে চেখভ ফুসফুসে রক্তক্ষরণ-জনিত সমস্যায় ভুগতে থাকেন। তারপরেও অনেক চেষ্টার পর তাকে হাসপাতালে যেতে রাজি করানো সম্ভব হয়। তার ফুসফুসের উপরের অংশে ক্ষয়রোগ ধরা পড়ে। ফলশ্রুতিতে ডাক্তার তাকে জীবনযাপনের ধারা বদলাতে বলেন।

১৮৯৮ সালে পিতার মৃত্যুর পরে চেখভ ইয়াল্টাতে শহরের প্রান্তদেশে একখণ্ড জমি কিনে তাতে একটি বাগানবাড়ি তৈরী করেন। এর পরের বছরেই মা ও বোনের সাথে তিনি এই বাড়িতে চলে আসেন। যদিও চেখভ ইয়াল্টাতে ফুলগাছসহ নানাবিধ গাছ লাগিয়েছেন, কুকুর পুষেছেন, পোষ মানিয়েছেন সারস পাখি এবং অতিথি হিসেবে পেয়েছেন লিও টলস্টয় ও ম্যাক্সিম গোর্কির মতো সাহিত্যিকদের, তারপরেও ইয়াল্টার অতি উষ্ণ আবহাওয়া নিয়ে তার অভিযোগ ছিল এবং ইয়াল্টা ছেড়ে মস্কো ও অন্যান্য স্থানে ভ্রমণ করে তিনি স্বস্তি পেয়েছেন। এমনকি তাগানরোগে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা সংস্থাপনের সাথে সাথে তিনি সেখানে ফিরে যাবেন, এমন প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন। ইয়াল্টা থাকাকালীন তিনি আর্ট থিয়েটারের জন্য আরও দুটি নাটক রচনা করেন। তবে এ দুটি নাটক রচনা করতে তাকে বেশ কষ্ট করতে হয় যেখানে তিনি আগের দিনগুলিতে লেখালেখির ব্যাপারে, "যেভাবে আমি এখন একটি প্যানকেক খাই, তেমনি স্থির ও শান্তিপূর্ণভাবে লিখতাম", এমন মত প্রকাশ করেছেন। থ্রি সিস্টার্স ও দ্য চেরি অর্চার্ড, এ দুইটির প্রতিটি লিখতে তিনি এক বছর করে সময় নিয়েছিলেন।

বিয়েতে তার ভীতিকে স্বীকার করে নিয়েই চেখভ ১৯০১ সালের ২৫শে মে তারিখে ওলগা নিপারকে বিয়ে করেন। নেমিরোভিচ-ডানচেঙ্কোর অনুগ্রহভাজন ও কোনো এক সময়ে তার প্রণয়ী এই ওলগা নিপারের সাথে চেখভের প্রথম দেখা হয় দ্য সীগাল নাটকের মহড়ায়।এর আগে পর্যন্ত চেখভকে বলা হতো, "রাশিয়ার সবচেয়ে পলায়নপর সাহিত্যিক অকৃতদার।

এই চিঠির কথাগুলো চেখভ ও ওলগার বিবাহিত জীবনে ভবিষ্যদ্বাণীর মতো ফলে গিয়েছিল। তিনি বেশিরভাগ সময়ে ইয়াল্টাতেই থাকতেন। ওলগা থাকতেন মস্কোতে, সেখানে তিনি তার অভিনয় পেশা চালিয়ে গিয়েছেন। ১৯০২ সালে সন্তানসম্ভবা ওলগার গর্ভপাত ঘটে। অধ্যাপক ডোনাল্ড রেফিল্ড, যিনি রুশ লেখকদের নিয়ে লেখা বইয়ের সম্পাদক এবং রুশ সাহিত্য-সম্বন্ধীয় বইয়ের লেখক, এই দম্পতির লেখা চিঠির ওপর ভিত্তি করে সাক্ষ্যপ্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করেন যে ওলগা যখন সন্তানসম্ভবা হন তখন চেখভ ও ওলগা একই স্থানে বসবাস করছিলেন না। যদিও রুশ পণ্ডিতেরা ডোনাল্ডের এই দাবি তর্কাতীতভাবে ভুল প্রমাণ করেছেন।তবে একে অপরের থেকে দূরে থাকার সময়ে তাদের মধ্যে যে চিঠি বিনিময় ঘটে, তার মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে থিয়েটারের ইতিহাসের কিছু তথ্য ও ঘটনা যা মণিরত্নের মতোই দামি। এর মধ্যে রয়েছে স্তানিস্লাভস্কির পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের পারস্পরিক অভিযোগ ও চেখভের নাটকগুলিতে ওলগাকে অভিনয়ের পরামর্শদান।

ইয়াল্টাতে চেখভ তার একটি বিখ্যাত গল্প দ্য লেডি উইদ দ্য ডগ রচনা করেন।একজন বিবাহিত পুরুষ ও এক বিবাহিত নারীর মধ্যেকার আপাতদৃষ্টিতে অপরিকল্পিত ও অনিয়মিত যোগাযোগ নিয়েই এই গল্প। গল্পের নারী ও পুরুষটি তাদের সম্পর্ক স্থায়ী হবে এমন আশা করছে না, আবার সেই সাথে এটাও আবিস্কার করছে যে এই পারস্পরিক আকর্ষণ তাদের নিজ নিজ পারিবারিক জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।১৯০৪ সালের মে মাসের মধ্যেই চেখভ প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্ষয়রোগ চরম অবস্থায় পৌঁছে যায়। সেই অবস্থার কথা মিখাইল চেখভ এভাবে স্মরণ করেছেন, "যারা তাঁকে দেখতো তাদের প্রত্যেকেই গোপনে ভাবতো যে শেষ সময়ের আর বেশি দেরী নেই, কিন্তু শেষ সময়টা যতই নিকটবর্তী হচ্ছিলো তিনি যেন এটি ততটাই কম হৃদয়ঙ্গম করছিলেন।"জুনের তিন তারিখে তিনি ওলগার সাথে জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্টের ব্যাডেনওয়েইলার শহরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। এই শহরটিতে থাকার সময় তিনি তার বোন মাশাকে শহরের খাবার ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বাহ্যত আনন্দপূর্ণ কিছু চিঠি লিখেন। চিঠির মাধ্যমে তিনি তার মা ও বোনকে এই নিশ্চয়তা দেন যে শারীরিকভাবে তিনি আগের চেয়ে ভালো বোধ করছেন। তার শেষ চিঠিতে তিনি এমনকি জার্মান মেয়েদের পোশাক পরার ধরন নিয়েও অভিযোগ করেছেন।

চেখভের মৃত্যুর ঘটনাটি পরিণত হয় সাহিত্যের ইতিহাসে এক অসামান্য দৃশ্যপটের পরম্পরায়। যা তার মৃত্যুর পর থেকে বহুবার বর্ণিত হয়েছে। প্রতিবার নতুন করে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় বিশদ বর্ণনাসহ চেখভের শেষ সময়ের ঘটনাবলী লেখা হয়েছে। কখনো কখনো এতে যুক্ত হয়েছেকাল্পনিক খুঁটিনাটি, ফলে কিছুটা হলেও বদলে গেছে প্রকৃত তথ্য। এ বিষয়ে আমেরিকান লেখক ও কবি রেমন্ড কারভারের এর‍্যাণ্ড ছোটগল্পটি উল্লেখযোগ্য। ১৯০৮ সালে ওলগা তার স্বামীর শেষ মুহূর্তগুলো নিয়ে লিখেছেনঃ

খুব অদ্ভুতভাবে আন্তন শায়িত অবস্থা থেকে একেবারে সোজা হয়ে উঠে বসলেন এবং জার্মান ভাষায় (অথচ তিনি জার্মান ভাষা বলতে গেলে জানতেনই না) স্পষ্ট ও জোরগলায় বলে উঠলেন, “আমি মারা যাচ্ছি।” ডাক্তার তাঁকে শান্ত করলেন। একটি সিরিঞ্জের সাহায্যে তাঁকে কর্পূরের ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করলেন এবং আদেশ দিলেন শ্যাম্পেন আনার জন্য। চেখভ একটি পুরো গ্লাস ভর্তি শ্যাম্পেন নিয়ে তা পরীক্ষা করলেন কিছুক্ষণ, মৃদু হেসে আমাকে বললেন, “বহুদিন হলো আমি শ্যাম্পেন পান করিনা।” শ্যাম্পেন শেষ করে তিনি নীরবে শুয়ে পড়লেন এবং আমি শুধুমাত্র বিছানায় ঝুঁকে পড়ে তাঁর নাম ধরে ডাকার সময়টুকু পেলাম। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে। একটি শিশুর মতো শান্ত হয়ে তিনি ঘুমাচ্ছেন...

চেখভের মরদেহ মস্কোতে বহন করে আনা হয়। নোভোদেভিচে সমাধিক্ষেত্রে তার পিতার পাশেই চেখভকে সমাহিত করা হয়।

1) ১৮৮৩ সালের আগস্টে একটি সাময়িকীর সম্পাদককে কিছু গল্পের সাথে পাঠানো এই চিঠির উল্লেখ করা যেতে পারেঃ

"আমাদের সর্বোচ্চ কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে যতটা শোচনীয় পরিস্থিতির কথা আমরা ভাবতে পারি, ঠিক ততটাই শোচনীয় পরিস্থিতিতে আমি লেখালেখি করে থাকি । আমাকে নিষ্করুণ বিরক্ত করছে আমার সামনে পড়ে থাকা সাহিত্যের সাথে সম্পর্কহীন কিছু কাজ, লাগোয়া ঘরটিতে এক শিশু বেড়াতে আসা আমার এক আত্মীয়কে দেখে তীব্র চিৎকার করছে, অন্য একটি ঘরে আমার বাবা লেসকভের দ্য সীলড এঞ্জেল থেকে আমার মা’কে উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনাচ্ছেন [...] আমার বিছানা দখল করে নিয়েছে বেড়াতে আসা আত্মীয়রা, তাদের কেউ কেউ আমার সাথে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে আসছেন [...] এক তুলনাহীন পরিস্থিতি।"

 ১৮৮৩ সালে লেখা আন্তন চেখভের একটি চিঠি থেকে .

2) পিতার নির্মম আচরণের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন:

"ভুলে যেয়োনা মিথ্যা আর নিষ্ঠুরতা তোমার মায়ের যৌবনকাল ধ্বংস করে দিয়েছে। ওই একই মিথ্যা আর নিষ্ঠুরতা আমাদের শৈশবও নষ্ট করে দিয়েছে, এতটাই যে সে অতীতের কথা স্মরণ করাটাও নিদারুণ বিরক্তির ও ভীতিপ্রদ। ভুলে যেয়োনা সেই বিতৃষ্ণা আর আতঙ্কের কথা, যা আমরা আমাদের বাবার প্রতি অনুভব করতাম যখন তিনি খাবার সময় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন এবং স্যুপে বেশি লবণের জন্য মা’কে কটু কথা বলতেন।"

3) তিনি তাঁর শৈশবকে স্মরণ করেছেন এভাবে:

"যখন আমার ভাইয়েরা ও আমি গির্জার মাঝে দাঁড়াতাম এবং ত্রয়ী গাইতাম, “আমার প্রার্থনা হোক মহিমান্বিত” বা “দেবদূতের কণ্ঠস্বর”, সবাই আমাদের দিকে আবেগভরে তাকিয়ে থাকতো আর আমাদের পিতামাতাকে ঈর্ষা করতো। কিন্তু ঐ মুহূর্তে আমরা নিজেরা যেন কিছুটা দণ্ডিত অপরাধীর মতো অনুভব করতাম।"

4)তোমস্ক শহরটি সম্পর্কে তিনি তার বোনকে যে মন্তব্যটি করেছিলেন তা ছিল এমনঃ[


"তোমস্ক একটি ক্লান্তিকর নিষ্প্রভ শহর। নেশাগ্রস্ত যে ব্যক্তিদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে এবং যে ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ আমার সাথে সাক্ষাৎ করে আমাকে সম্মান জানিয়েছেন তাদের থেকে এই শহরের অধিবাসীদের মূল্যায়ন করে বলতে পারি, এর বাসিন্দারাও বিরক্তিকর।"

5) তিনি একবার সাভরিনকে লিখেছিলেনঃ


তুমি যদি চাও তো আমি অবশ্যই বিয়ে করবো। তবে এই শর্তেঃ সবকিছু তেমনই থাকবে যেমনটা আছে এখন পর্যন্ত, মানে তাকে অবশ্যই মস্কোতে থাকতে হবে যখন আমি গ্রামে থাকবো, এবং আমি তাকে দেখতে আসবো... আমাকে এমন একজন স্ত্রী দাও যে হবে চাঁদের মতো, আমার আকাশে উঠবে না প্রতিদিন।

6) তিনি একবার সাভরিনকে লিখেছিলেনঃ


"তুমি যদি চাও তো আমি অবশ্যই বিয়ে করবো। তবে এই শর্তেঃ সবকিছু তেমনই থাকবে যেমনটা আছে এখন পর্যন্ত, মানে তাকে অবশ্যই মস্কোতে থাকতে হবে যখন আমি গ্রামে থাকবো, এবং আমি তাকে দেখতে আসবো... আমাকে এমন একজন স্ত্রী দাও যে হবে চাঁদের মতো, আমার আকাশে উঠবে না প্রতিদিন।"

১৮৮০ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে তিনি সর্বমোট ৬০০টি সাহিত্যকর্ম রচনা ও প্রকাশ করেন। শুরুতে নাট্যকার হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পান থ্রি সিস্টার্স, দ্য সিগাল এবং দ্য চেরি অরচার্ড এই তিনটি নাটকের মাধ্যমে। দ্য সিগাল নাটকটি ১৮৯৬ সালে মঞ্চস্থ হলে সেটি একেবারেই দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। প্রবল বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এর মঞ্চায়ন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষিতে চেখভ থিয়েটার বর্জন করেন। পরে ১৮৯৮ সালে এই নাটকটিই কনস্তান্তিন স্তানিস্লাভ্‌স্কির আগ্রহে মস্কো আর্ট থিয়েটারে মঞ্চস্থ হলে তা ব্যাপক প্রশংসিত হয়। মস্কো আর্ট থিয়েটার চেখভের আঙ্কল ভানিয়া নাটকটি প্রযোজনাসহ তার শেষ দুটি নাটক, থ্রি সিস্টার্স এবং দ্য চেরি অরচার্ড এর প্রথম প্রদর্শনীও করে। চেখভের চারটি নাটক দর্শক ও সকল অভিনয়শিল্পীদের সমন্বিত অভিনয়,এই দুইয়েরই অনেক সময় ও মনোযোগ দাবী করে। কারণ এই নাটকগুলিতে কোনো সনাতন বাহ্যিক নাট্যক্রিয়া নেই, এর পরিবর্তে মামুলি অকিঞ্চিৎকর সব বিষয়ে করা সংলাপে রয়েছে আবেগ, অনুভূতির অন্তঃস্রোতের প্রবাহ।

উল্লেখযোগ্য পুরস্কার : পুশকিন পুরস্কার

দাম্পত্যসঙ্গী : ওলগা নিপার (বি. ১৯০১)

আত্মীয়:

আলেক্সান্দ্‌র চেখভ (ভাই)

মাইকেল চেখভ (ভ্রাতুষ্পুত্র)

লেভ নিপার (ভ্রাতুষ্পুত্র)

ওলগা চেখভা (ভ্রাতুষ্পুত্রী)

" চেখভের গল্পগুলো এখনও তেমনই বিস্ময়কর (এবং অপরিহার্য), যেমনটা ছিল প্রথম প্রকাশের সময়ে। শুধুমাত্র তাঁর বিপুল সংখ্যক গল্পের সম্ভারই নয় - খুব কম লেখকই, যদি আদৌ তেমন কেউ থেকে থাকেন, তাঁর চেয়ে বেশি লিখেছেন - তিনি যে বিস্ময়জনক হারে সেরা গ্রন্থ ও গল্প রচনা করেছেন তা যেমন আমাদের আধ্যাত্মিক মুক্তির অনুভূতি দেয়, তেমনি আনন্দিত ও আলোড়িতও করে। তাঁর লেখা রচনা আমাদের আবেগ অনুভূতিকে যেভাবে তুলে ধরে তা শুধুমাত্র সত্যিকারের শিল্পকর্মের পক্ষেই সম্ভব।"


================================

২। 

রোমা রোলাঁ

জন্ম - ২৯ জানুয়ারি, ১৮৬৬ সালে।

শিল্পকলা ও সংগীত গবেষক রোলাঁ ১৯০৩ সালে সর্বন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ 

Vie de Beethoven (বেটোভেন-চরিত) প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে। 

এরপর ১৯০৬ সালে মিকেলাঞ্জেলোর জীবনী ও ১৯১১ সালে তলস্তয়ের জীবনী রচনা করেছিলেন তিনি। জাঁ-ক্রিস্তফ তার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য রচনা।

তিনি মহাত্মা গান্ধী, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ও রচনা করেছিলেন।

 ১৯১০ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে দশ খণ্ডে প্রকাশিত এই গ্রন্থটির জন্যই তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধের বিরোধিতা করেন। রোলাঁ ছিলেন একজন ভারতপ্রেমিক ও ভারততত্ত্ববিদ্।


১৯১৫ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন

তিনি ছিলেন ফরাসি নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিল্প ঐতিহাসিক ও অধ্যাত্মবিদ । যার মৃত্যু হয় ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৪৪ সালে।


¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥



Wednesday, 27 January 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

        সংগ্রহযোগ্য বইয়ের আলোচনা

              পর্ব -৫

=================================

       Doinik Sabder Methopath

       Vol -265. Dt -28.01.2021

        ১৪ মাঘ, ১৪২৭. বৃহস্পতিবার

÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

১।

গত কয়েক শতাব্দিতে পৃথিবীর বুক আলোকিত করে যে কয়জন মহান ব্যক্তি জন্ম নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন এ পি জে আবদুল কালাম। ‘উইংস অব ফায়ার’ ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও পৃথিবীর একজন বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী এ পি জে আবুল কালাম-এর আত্মজীবনী।

একটি অল্প শিক্ষিত পরিবার থেকে উঠে এসে প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা, পরবর্তী সময়ে অসামান্য অবদানের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার “ভারতরত্ন” অর্জন করার পথের পুরোটাই উঠে এসেছে এই বইতে। বলেছেন তাঁর তৈরি অগ্নি, পৃথ্বী, আবাশ, ত্রিশুল ও নাগ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর নেপথ্য-কাহিনী।

প্রচণ্ড পরিশ্রম করে যখন উচ্চশিক্ষা শেষ করে বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, তখন যতজন লোক নিয়েছিলো বিমানবাহিনী, ঠিক তার পরের পজিশনেই ছিলেন এ পি জে আবুল কালাম। ব্যর্থতাকে খুব কাছ থেকে বারবার দেখা এই মানুষটির দর্শন, জীবন-চেতনা ও হার না মানা মনোভাবের খোঁজ পেতে চাইলে এই বইটি অবশ্যই পড়তে হবে আপনাদের। কেননা, তিনিই বলেছিলেন,

স্বপ্ন তা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখস্বপ্ন তাই যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না

২।


দু’হাজার বছরের পুরোনো সত্যকে চিরতরে নির্মূল করার জন্যে একই দিনে চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। সত্যটি জানাজানি হয়ে গেলে হাজার বছরের ইতিহাস লিখতে হবে নতুন করে। সত্যটি লালন করে আসছে একটি গুপ্ত সংঘ-সেই গুপ্ত সংঘের সদস্য ছিলেন আইজ্যাক নিউটন, ভিক্টর হুগো, বত্তিচেল্লি আর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো ব্যক্তি।


ওদিকে উগ্র ক্যাথলিক সংগঠন ওপাস দাই সেই সত্যকে চিরতরে নির্মূল করার আগেই গুপ্তসংঘের গ্র্যান্ডমাস্টার তার ঘনিষ্ঠ একজনের কাছে হস্তান্তর করে দেয় আর ঘটনাচক্রে এরকম একটি মারাত্মক মিশনে জড়িয়ে পড়ে হার্ভাডের সিম্বোলজিস্ট এক প্রফেসর।


শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা, তথ্যবহুল লেখনি আর একের পর এক ঘটে যাওয়া রোমাঞ্চকর ঘটনার এক পরিপূর্ণ প্যাকেজ এই বইটি বিশ্বজুড়েই বেস্টসেলার। থ্রিলার ঘরানার বই ভাল লাগলে ড্যান ব্রাউনের এই বইটি নিশ্চয়ই আপনাদের প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত।

৩।


আমরা সচরাচর যা ভাবি বা করি তা সাময়িক ভাবে সুফল বয়ে আনলেও, সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনাকে ব্যহত করতে পারে। যদি টিমওয়ার্ক ঠিকমতো না হয়, অনেক ভালো পরিকল্পনাও ব্যর্থ হতে পারে। এই বইটিতে বলা হয়েছে টিমওয়ার্ক কী এবং কীভাবে টিমওয়ার্ক এর মাধ্যমে ব্যবসাকে এগিয়ে নেওয়া যায়।

প্যাট্রিক লিঞ্চিওনির লেখা এই বইটি কেবল ব্যবসাক্ষেত্রেই নয়, কাজে লাগে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও। একটি টিমকে নেতৃত্ব দিয়ে কোন একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে কাজ করতে হয়, এমন যেকোন মানুষের জন্যেই এটি একটি অবশ্যপাঠ্য বই।


লীডারশিপের উপর  দক্ষতা বাড়াতে কিংবা নেতৃত্বের খুঁটিনাটিগুলো শিখে নিতে, নিশ্চিন্তেই বেছে নিতে পারেন এই বইটি! বইটির অনুবাদক ফারজানা মোবিনের লেখার হাতও খুব চমৎকার। ছন্দে ছন্দে লেখাটিকে করে তুলেছেন সুখপাঠ্য এবং একেঘেয়েমি মুক্ত।

৪.


স্বাধীনতা মহাকাব্যের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অনেকেই গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে পাঠক বঙ্গবন্ধুর জীবনী এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের এমন অনেক অজানা তথ্য খুঁজে পাওয়া যাবে-যা আগে কোথাও পাওয়া যায়নি।

গ্রন্থটি মূলত শেখ হাসিনা লিখিত স্মৃতিকথামূলক আত্মজৈবনিক রচনা। যাতে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের অনেক অজানা তথ্য। বইটি চারটি মূল অধ্যায়ে বিভক্ত হলেও এর ভেতর প্রতি অধ্যায়ে তিনটি করে অনুচ্ছেদ আছে। প্রথম দুই অধ্যায়ে পারিবারিক স্মৃতি থাকলেও তৃতীয় অধ্যায়ে লেখিকা ড.আবদুল মতিন চৌধুরী, বেগম জাহানারা ইমাম এবং নূর হোসেনকে নিয়ে স্মরণ-শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে এই বইটির চেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র  আর নেই।


৫।


লিও টলস্টয়ের 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' (১২৯৬ পৃষ্ঠা)

টলস্টয়ের মহাকাব্যটি রাশিয়ার নেপোলিয়ন যুগকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে।


যুদ্ধক্ষেত্র এবং হোম ফ্রন্টের মধ্যে তিনটি কুখ্যাত চরিত্রকে ঘিরে গল্প এগিয়ে যায়।


চরিত্র তিনটি হল: পেরে বেজুখভ, একজন কাউন্টের অবৈধ পুত্র যিনি নিজের উত্তরাধিকারের জন্য লড়াই করছেন; প্রিন্স আন্দ্রেই বলকনস্কি, যিনি নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তাঁর পরিবারকে ছেড়ে চলে এসেছেন; এবং নাতাশা রোস্তভ, একজন অভিজাত ব্যক্তির সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়ে।


টলস্টয় একইসাথে সেনাবাহিনী এবং অভিজাতদের উপর যুদ্ধের প্রভাব কেমন হয়, সেটা ফুটিয়ে তুলেছেন। 

¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥¥


Tuesday, 26 January 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
বিশেষ আলোচনা পর্ব
রামায়ণের সীতা দেবীর চরিত্র
=================================
Doinik Sabder Methopath
Vol -264. Dt -27.01.2021
১৩ মাঘ, ১৪২৭. মঙ্গলবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

রাক্ষসরাজ রাবণের ভগিনি সুর্পনখা রামভার্যা মহালক্ষী সীতাকে রাবণভার্যা হওয়ার জন্য তাঁকে আনতে উদ্যত হলে রামানুজ লক্ষ্মন তার নাক-কান কেটে দিল। প্রতিহিংসায় ক্রোধিত হয়ে সুর্পনখা ভ্রাতা রাবণের কাছে নালিশ করল এবং সীতার অপূর্ব সৌন্দর্যের কথা ব্যক্ত করে তাকে সীতাবিবাহ করার মাধ্যমে এর প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করার জন্য তারকা রাক্ষসীর পুত্র মায়াবী মরীচের কাছে গেল। রাবণ মারীচকে বলল-
“সীতাকে প্রলোভিত করার জন্য তুমি মায়াবলে রজতবিন্দুসমূহে চিত্রিত স্বর্ণমৃগ (স্বর্ণবর্ণ হরিণ) হয়ে রামের আশ্রমে গিয়ে জনকদুহিতা সীতার সম্মুখে বিচরণ করো। তুমি স্বর্ণমৃগ হয়ে বিচরণ করতে থাকলে রামভার্যা, জনকনন্দিনী সীতা তোমাকে দেখে বিস্মতা হয়ে তৎক্ষণাৎ রামকে ‘এই মৃগ আনয়ন করো’ এ কথা বলবে; এরপর রাম তোমাকে ধরতে আশ্রম হতে বহির্গত হলে, তুমি বহু দূরে গিয়ে ‘হা সীতে, হা লক্ষ্মণ’-এরূপ বাক্য উচ্চারণপূর্বক আর্তনাদ করবে। সীতা তা শুনে সুমিত্রানন্দন লক্ষ্মণকে রামের নিকট পাঠাবে; লক্ষ্মণও সৌভ্রাত্রবশত রামের অনুগামী হবে। এভাবে রাম ও লক্ষণ আশ্রম ত্যাগ করলে আমি বিদেহরাজনন্দিনী সীতাকে অনায়াসে অপহরণ করব।” 

মহামুনি বাল্মীকি রচিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের দিব্য লীলাসমন্বিত গ্রন্থ ‘রামায়ণ’-এর অন্যতম একটি অধ্যায় রাবণ কর্তৃক দেবীসীতা অপহরণ। নির্বিশেষবাদী ও নাস্তিকদের ধারণা, “শ্রীরামচন্দ্র তাঁর পত্নী সীতাদেবীকে রাবণের হাত থেকে সুরক্ষা দিতে পারেননি। তাই তিনি ভগবান হতে পারেন না।” পরমেশ্বর ভগবান সম্বন্ধে যথাযথ ধারণার অপূর্ণতার কারণেই তাঁর সম্বন্ধে কেউ এমন মন্তব্য করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, রামচন্দ্র সীতাদেবীকে সুরক্ষা দিতে পারেননি-এর পরিবর্তে বলা উচিত-তিনি সুরক্ষা দেননি। কেন সুরক্ষা দেননি তা-ই এ প্রবন্ধে আলোচনা করা হলো। 
 
 ভগবান এজগতে বিভিন্ন লীলা করেন তাঁর ভক্তের আনন্দবিধান ও জীবশিক্ষার নিমিত্তে এবং কোন লীলা থেকে কী শিক্ষা তা কেবল তাঁর ভক্তরাই উপলব্ধি করতে পারেন; অপরপক্ষে, সাধারণ মানুষ তাঁকে বুঝতে না পেরে তাঁর নিন্দা করে। সীতা দেবীকে অবশেষে শ্রীরামচন্দ্রই উদ্ধার করেছিলেন। আর অসামর্থ্যের লীলাচ্ছলে এ কার্যে তিনি তাঁর পরম ভক্ত লক্ষণ, সুপ্রীব, বিভীষণ, হনুমান ও অন্যান্য বানরসেনাদি বিভিন্ন ভক্তদের তাঁর সেবায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ প্রদান করেছিলেন। তাছাড়া, হরিণরূপী মারীচের ইচ্ছে ছিল যে সে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের হাতে নিহত হবে এবং সেজন্য ভগবান একটি ঘটনার আবহ তৈরি করে তাকে সে সৌভাগ্য প্রদান করেছেন। রাবণ কর্তৃক সীতা অপরণের লীলা তা থেকে আমরা অনেক শিক্ষা লাভ করতে পারি। 




 প্রথমত, মারীচ যেমন যেমন সোনার হরিণরূপে এসেছিল, তেমনি মায়া বিভিন্নরূপে আমাদের সামনে উপস্থিত হতে পারে। বিশেষত এ কলিযুগে টিভিতে প্রদর্শিত বিভিন্ন জড়জাগতিক সিরিয়াল, সিনেমা. বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড, ইন্টারনেট, ফেসবুক,ভিডিওগেম, পর্ণগ্রাফি, বন্ধু-বান্ধবী, নেশাজাতীয় দ্রব্য, জুয়াখেলা ইত্যাদি হচ্ছে মায়ার প্রলোভন। এগুলো সোনার মায়াহরিণের মতো আকর্ষণীয়, কিন্তু পরিণামে বিপদ ডেকে আনে। সর্বোপরি পারমার্থিক জীবন বিনাশপ্রাপ্ত হয়। 

দ্বিতীয়ত, সীতাদেবী যেরূপ মাহরিণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তেমনি, জীব যদিও মায়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ভগবান সাধু, গুরু ও শাস্ত্র নির্দেশ, এমনকি নিজে এসে বাণীর দ্বারা তাকে নিষেধ করে। কিন্তু বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও জীব যখন সেসব নির্দেশ পরোয়া না করে মায়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়, তখন ভগবান বা ভগবদ্ভক্তি থেকে তিনি দূরে সরে যায়। আমাদের কখনো মায়ার প্রলোভনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া উচিত নয়। কেননা, তাহলে আমরা ভগবানকে হারাব।ঠিক যেভাবে সীতা দেবী ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে হারিয়েছিলেন। 

ভগবানের চেয়ে তাঁর ভক্ত বা শ্রীগুরুদেব অধিক করুণাময়। শ্রীরাম ভগবত্তত্ত্ব এবং লক্ষণ গুরুতত্ত্ব। সীতা দেবী মায়া হরিণের প্রতি আকৃষ্ট হলে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র সীতা থেকে (জীবের) তত্ত্বাবধান করেন। অর্থাৎ ভগবান অসন্তুষ্ট হলেও গুরুদেব কাউকে সুরক্ষা দিতে পারেন। হরিণরূপী মারীচ শ্রীরামের কন্ঠস্বর অনুকরণ করে ভ্রাতা লক্ষণ বলে আর্তনাদ করছিলেন, তখন সীতাদেবী ভাবছিলেন যে, প্রভু রাম কোনো বিপদে পড়েছেন। তাই তিনি লক্ষণকে সেখানে গিয়ে রামকে রক্ষা করতে বলেন। কিন্তু লক্ষণের সুদৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, রামের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, আমাদের কখনো ভগবানের প্রতি আস্থা হারানো উচিত নয়। 



 

লক্ষণ সীতাদেবীকে একা রেখে যেতে চাননি। কিন্তু সীতার কটুবাক্যবানে বিদ্ধ হয়ে তিনি সীতাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবুও তিনি পূর্ণরূপে তাকে ত্যাগ করেননি। তিনি তখন বনদেবতা ও দিকমন্ডলের হস্তে সমর্পণ করে রামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে গমন করলেন। দিকমন্ডলের স্থলে কোথাও কোথাও বলা হয়েছে যে, রক্ষাকবচ হিসেবে লক্ষণ কুটিরের চারপাশে একটি রেখা অংকন করে দিয়ে যান এবং সীতা দেবীকে বলেন যে,

 তিনি যেন এ রেখা লঙ্ঘন বা অতিক্রম না করেন। অর্থাৎ শিষ্য গুরুদেবের কথার অবাধ্য হলে বা গুরুদেবকে ত্যাগ করলেও গুরুদেব কখনো তাঁর শিষ্যকে ত্যাগ করতে চান না। আর গুরুদেবের অনুপস্থিতিতে তাঁর নির্দেশই শিষ্যের জীবন পাথেয়স্বরূপ। লক্ষণরেখা হলো গুরুদেবের নির্দেশস্বরূপ। কৃষ্ণভাবনামৃতে গুরুদেব শিষ্যকে আমিষাহার, নেশা, দ্যূতক্রীড়া ও অবৈধ যৌনসঙ্গ বর্জন এবং জপমালায় নিয়মিত নির্দিষ্ট সংখ্যক হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার নির্দেশ দেন। শিষ্যের কখনো এ নির্দেশগুলো লঙ্ঘন করা উচিত নয়। 


রাম ও লক্ষণ উভয়ই যখন কুটির থেকে দূরে চলে গেলেন, তখন অসুর রাবণ সাধুর বেশ ধরে সীতার কুটিরে আসে। কিন্তু সীতা তাকে চিনতে না পেরে তার কথার ফাঁদে পড়ে লক্ষণরেখা অতিক্রম করেন এবং রাবণ কর্তৃক অপহৃত হন। এ থেকে প্রথম শিক্ষা হলো স্ত্রীলোকদের পক্ষে একাকী থাকা বিপজ্জনক। তাদের সর্বদা করো আশ্রয়ে থাকা উচিত-শৈশব ও কৈশরে পিতার অধীনে, যৌবনে পতির অধীনে বার্ধক্যে উপযুক্ত সন্তানের অধীনে। আর যদি কারো সন্তান না থাকে তবে কোনো আশ্রমে গুরুদেবের তত্ত্বাবধানে। দ্বিতীয়ত, শিষ্য যদি গুরুর নির্দেশ অমান্য করে, তবে নিশ্চিতরূপে সে বিপদের সম্মুখীন হবে এবং মায়ার আকর্ষণে আসুরী শক্তির প্রভাবে তার আধ্যাত্মিক জীবন বিনাশপ্রাপ্ত হবে।

তৃতীয়ত, রাক্ষস রাবণ যেমন সাধুর বেশে সীতাদেবীর সামনে এসেছে, তেমনি সামাজে অনেক ভন্ড, প্রতারক অসুর আছে যারা সাধুর বেশে সাধারণ লোকদের সঙ্গে প্রতারণা করে, বিশেষ করে এ কলিযুগে। তাদের মিথ্যে মধুর বাক্যে মোহিত না হয়ে আমাদের উচিত তাদের থেকে সাবধান থাকা এবং শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারে সদগুরু ও ভগবানের আশ্রয়ে থাকা। অন্যথায় এসমস্ত অসুরেরা আমাদের ভক্তিসম্মদকে অপহরণ করবে। আবার, রাবণ যখন সীতাদেবীকে আকাশমার্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি আকুলভাবে প্রভু রাম ও লক্ষ্মণকে স্মরণ করছিলেন এবং একেকে করে তাঁর সমস্ত অলংকার ফেলে দিচ্ছিলেন, যেন সেগুলো দেখে সহজে বোঝা যায় যে, তিনি কোন পথে গিয়েছেন। এ থেকে শিক্ষা হলো, জীব যতই অধঃপতিত হোক, যদি ঐকান্তিকভাবে ভগবানের শরণগ্রহণ করেন, তবে ভগবান তাঁকে বুদ্ধি দান করেন, যেন সে জীব পুনায় তাঁর কাছে ফিরে যেতে পারে।



 
পতিমধ্যে রামভক্ত জটায়ু (পাখি) সীতামাতাকে অসহায় অবস্থায় দেখে সহায়তা করার জন্য রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রাবণ তার একটি ডানা কেটে ফেলে। তথাপি সে মৃত্যু অবধি লড়াই করে চলে। অর্থাৎ ভগবানের সেবার জন্য ভক্তের উচিত তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করা এবং জন্মজন্মান্তর ধরৈ ভগবানের সেবা করার জন্য শত বিপদ সত্ত্বেও দৃঢ় সংকল্প থাকা। আবার এখানে জটায়ু সরাসরি ভগবানের সেবা না করে ভগবানের ভক্তের (সীতার) সেবা করেছেন। আর তাতে ভগবান তার প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছেন। সীতাদেবীকে খুঁজতে খুঁজতে রাম-লক্ষ্মণ জটায়ুর সম্মুখে উপনীন হন এবং রামচন্দ্র স্বহস্তে জটায়ুর শবদেহ সৎকার করেন। অর্থাৎ কেউ যখন সম্পুর্ণরূপে ভগবান ও তাঁর শুদ্ধভক্তের দাসত্ব স্বীকার করেন, তখন তিনি ভগবানের অত্যন্ত প্রিয় হন। তখন অগবান ভক্তের অধীন হয়ে যান, ভগবান নিজেই তখন তাঁর সেই প্রিয় ভক্তের সেবা করতে চান।

এরপর রামনাম লেখা পাথরে জলে ভাসমান সেতু নির্মাণ লীলা থেকে আমরা ভগবানের নামের মহিমা সম্বন্ধে জানতে পারি। রাবণ সীতাদেবীকে প্রতারণার দ্বারা জয় করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, রাবণ মায়াসীতাকেই হরণ করেছিল। কাম এবং লোভ চির অতৃপ্ততা, ঔদ্ধত্য ও ঈর্ষার জন্ম দেয়। রাবণ কখনোই সীতাকে লাভ করতে পারেনি। বরং, এর কারণেই রাবণের বিনাশ নিশ্চিত হয়েছিল। তাছাড়া ভক্ত বা পরস্ত্রীকে অবমাননা করার শাস্তি যে কত ভয়ংকর এ শিক্ষাও আমরা রামায়ণের এ লীলা থেকে লাভ করতে পারি। সীতা অপহরণের এ লীলায় রয়েছে এমন অনেক উন্নত শিক্ষা, যা ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ করার মাধ্যমে বদ্ধজীব খুব সহজেই ভগবানের ধামে ফিরে যেতে পারে। সেজন্যই ভগবান এমন বিচিত্র লীলা সম্পাদন করে থাকেন।
এছাড়াও সীতা অপহরণের পেছনে রয়েছে আরো গুপ্ত তথ্য, যেসব কারণে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র নিজ পত্মীকে রক্ষা না করতে পারার মতো অসমর্থ্যের ন্যায় লীলা করেছেন।

বীররস আস্বাদন ও চতুষ্কুমারের অভিশাপ পূর্ণকরণ
 
শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর- বিশেষত এ পাঁচটি মুখ্য রসের মাধ্যমে ভক্ত ভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হন। এছাড়া হাস্য, অদ্ভুত, বীর, করুণ, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীভৎস-এ সাতটি গৌণ রসের কথাও ভক্তিরসামৃত গ্রন্থে শ্রীল রূপগোস্বামীপাদ উল্লেখ করেছেন। সীতাহরণ লীলার একটি বিশেষ কারণ হলো-ভগবান নিজে বীর-রস আস্বাদন করতে ও তাঁর ভক্তকে সে রস আস্বাদন করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অসীম ভগাবানকে দর্শন, স্পর্শন বা তাঁর সাঙ্গে যুদ্ধ করার সামর্থ্য বা যোগ্যতা সাধারণ জীবের নেই।
তাই সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ভগবান প্রথমে বৈকুন্ঠের দ্বারপালরূপী তাঁর দুই মহান সেবক জয় ও বিজয়কে সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার-এ চতুষ্কুমারের দ্বারা অভিশপ্ত করিয়েছেন যে, তারা মর্ত্যলোকে অসুরকুলে জন্মগ্রহণ করবে এবং কেবল ভগবানের হাতে নিহত হলেই তাদের অসুরযোনি থেকে মুক্তি হবে। তাই জয়-বিজয় প্রথমে হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু রূপে এবং তারপর রাবণ ও কুম্ভকর্ণরূপে পৃথিবীতে রাক্ষসকুলে জন্মগহণ করেন। কিন্তু অকারণে কারো সঙ্গে যুদ্ধ করা বা কাউকে বধ করা অনুচিত। তাই ভগবান তাদের বধ করার জন্য সে ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি করতে রাবণ কর্তৃক সীতা অপহরণ লীলা সংঘটিত করেন।


মারীচের ইচ্ছা পুরণ 
 
তারকা বধের পর রাবণমিত্র মারীচ শ্রীরামের মহিমা বুঝতে পেরে মানসিকভাবে তাঁর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। রাবণ যখন সীতারামকে প্রতারণা করার জন্য মারীচকে প্রস্তাব দেয়, মারীচ প্রথমে রাজি হননি। বরং সে রাবণকে রামের সঙ্গে শত্রুতা করতে নিষেধ করে। তখন রাবণ ক্রোধিত হয়ে মারীচকে বলল- “রামের নিকট গেলে তোমার প্রাণ সংশয় হবে, আর আমার সঙ্গে বিবাদ করলে তোমার প্রাণ সংহার হবে। এবার বিচার করে দেখ কী করবে।”

মারীচ চিন্তা করল শস্ত্রধারী, ভেদজ্ঞানী (যে গোপন কথা জানে), সামর্থ্যযুক্ত প্রভু, মূর্খ, ধনী, চিকিৎসক, চাটুকার ব্যক্তি, কবি ও পাচক-এ নয় রকম ব্যক্তির সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করলে কল্যাণ হয় না। আজ্ঞাপালন করতে অস্বীকার করলে এ অভাগা রাবণকর্তৃক এখনই আমাকে নিহত হতে হবে। তার চেয়ে বরং শ্রীহরি রঘুনাথের হাতে মৃত্যু হওয়াই আমার পরম সৌভাগ্য।”



 
 সে ভাবতে লাগল- “আজ প্রিয়তমের দর্শন লাভ করে আমার নয়ন সার্থক করব। তখন সীতাদেবী ও অনুজ শ্রীলক্ষ্মণ সহিত কৃপানিকেতন শ্রীরামচন্দ্রের পাদপদ্মে নিজেকে আমি সমর্পণ করে দেব, যাঁর ক্রোধও মঙ্গলজনক, সেই আনন্দনিকেতন ভগবান শ্রীহরি নিজ হস্তে শরনিক্ষেপ করে আমাকে স্পর্শ দান (বধ) করবেন। যখন প্রভু ধনুর্বাণ হস্তে আমাকে ধরবার জন্য ছুটে আসবেন তখন তাঁকে পিছন ফিরে বারবার দর্শন করব। আমার মতন ভাগ্যবান আর কে আছে।” কেননা, ভগবানের হাতে নিহত হলে জীব মুক্তিলাভ করে। এমন ভেবে মারীচ রঘুনাথের প্রতি শরণাগতিই বেছে নিল, রাবণের সঙ্গে সম্মতি জানাল এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হলো। অর্থাৎ, মারীচের মনোভিলাষ পুর্তি ও তাকে রাক্ষস দেহ থেকে মুক্ত করা ছিল সীতা অপহরণ লীলার আরেকটি কারণ।


রাবণের ইচ্ছা পুরণ
 
ভগিনি সুর্পনখার মুখে রাম কর্তৃক খর, দূষণ ও ত্রিশিরা বধের কথা শুনে দশানন রাবণের সর্বাঙ্গে যেন অগ্নিজ্বালা শুরু হলো। নিজ শক্তিসামর্থ্য আর বীরগাথা কীর্তন করে রাবণ সূর্পনখাকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিল। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় তখন রাবণ ভয়ানক দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরে ফিরে গেল এবং রাতভর সে ঘুমাতে পারল না। রাবণ চিন্তা করল- “দেবতা, মানব, অসুর, নাগ এবং পক্ষীকুলের মধ্যে এমন কেউ নেই যে আমার অনুচরদের সমকক্ষ হতে পারে; আর খর-দূষণ তো আমারই মতো শক্তিধর ছিল।

তাদের তো একমাত্র ভগবানই বিনাশ করতে সক্ষম। দেবতাদের আনন্দদাতা ও ভূভারহারী শ্রীভগবানই যদি অবতারূপে এসে থাকেন, তবে আমি বলপ্রয়োগ করে ভবসাগর পার হব। এই তামস দেহে তো আর তাঁর ভজনা হবে না; তাই এরূপ সিদ্ধান্ত কায়মনোবাক্যে নেয়াই মঙ্গলজনক। আর যদি তারা নেহাতই নরসম রাজকুমারই হয়, তবে তাদের যুদ্ধে পরাজিত করে সেই নারীকে হরণ করতে বেগ পেতে হবে না।”(তুলসীদাসকৃত রামচরিতমানস) ভগবানের হাতে রাবণের নিহত হওয়ার এ মনোভাব স্পষ্টই প্রমাণ করে যে, রামণের এ অভিলাষ পূর্ণকরাও ছিল সীতাহরণ লীলার এক বিশেষ কারণ।


বেদবতীর প্রতিক্ষা রক্ষা-(রামায়ন কথা)
রাবণ পরস্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত লালায়িত ছিল। তার পাপ কর্মে বর্ধিত হয়ে সীতা অপহরণের মধ্য দিয়ে চরমে পৌছল। রাবণ ধরণীতলে ভ্রমণপূর্বক একদিন হিমালয় পর্বতের নিকটস্থ বনে ধ্যানরতা অপূর্বসুন্দরী কন্যার প্রতি অসদাচরণ করতে উদ্যত হয়।সে মহিয়সী ছিলেন অমিতপ্রভ বৃহস্পতিসূত ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজের কন্যা। কুশধ্বজ নিয়মিত বেদ পাঠ করতেন। তাঁর শ্রীমুখ থেকে উচ্চারিত শব্দব্রহ্মরূপ বেদমন্ত্রই মূর্তিমতি কন্যারূপে প্রকটিত হন।

 তাই সে কন্যার নাম রাখা হয় বেদবতী যিনি কেবল শ্রীবিষ্ণুকেই তাঁর পতিরূপে হৃদয়ে ধারণ করেন। রাবণ তার কেশ স্পর্শ করা মাত্রই বেদবতী অগ্নিশর্মা হয়ে নিজেই হস্ত দ্বারা সে কেশ ছিন্ন করেন এবং যোগবলে দেহত্যাগ করেন। দেহত্যগের পূর্বে প্রতিজ্ঞা করেন যে, পরবর্তী জন্মে তিনিই হবেন রাবণের মৃত্যুর কারণ। এ বেদবতীই পরবর্তীতে জনক রাজার কন্যা সীতা রূপে আবির্ভূত হন এবং রামরূপধারী শ্রীবিষ্ণুকে পতিরূপে প্রাপ্ত হন। তখন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বেদবতীর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে সীতা অপহরণ লীলা সংঘটিত করেন।




মায়াসীতা-(রামায়ন কথা)
 
সীতা অপহরণের ঘটনার আপাত বিচার হলো, “ভগবানের পত্মীকে সামান্য এক অসুর অপহরণ করেছে এবং ভগবান তাকে রক্ষা করতে পারেননি”। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, যে সীতাকে রাবণ অপহরণ করেছে তিনি ভগবান শ্রীরামের পত্মী সীতা নন, মায়াসীতা এবং যে রাবণ মায়া সীতাকে হরণ করেছে, সে অসুর নয়, ভগবানের মহান ভক্ত-বৈকুন্ঠের দ্বারপাল।সীতা অপহরণের পূর্বেই রামচন্দ্র মূল সীতাকে অগ্নিদেবের দায়িত্ব অনত্র রেখে দেন।



 
শ্রীরামের মহান ভক্ত তুলসী দাস রচিত রামায়নের (শ্রীরামচরিতমাস) অরণ্যকান্ডে এবং আরো কিছু শাস্ত্রে তার উল্লেখ রয়েছে। হরিণরূপে সীতাকে মোহিত করার প্রস্তাব নিয়ে রাবণ যখন মারীচের নিকট উপস্থিত হলেন, সেসময় লক্ষণ কন্দ ও ফলমূল আহরণে বনে গমন করেছেন। তখন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লক্ষ্মীস্বরূপিণী সীতাদেবীকে বললেন- শুনহ প্রিয়া ব্রত রুচির সুসীলা। মৈঁ কিছু করবি ললিত নরলীলা।। 
তুমহ পাবক মহুঁ করহু নিবাসা। জৈৗ লগি করৌ। নিশাচর নাসা।। 
“হে পতিব্রতা সুশীলা প্রিয়তমা, শোন, আমি এখন কিছু ললিত নরলীলা সম্পাদন করব। কিছু রাক্ষস বধ করব। তাই রাক্ষস বিনাশ না হওয়া পর্যন্ত তুমি অগ্নিতে নিবাস করো।” 

সীতাদেবী যেরূপ মায়াহরিণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তেমনি, জীব যদিও মায়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ভগবান সাধু, গুরু ও শাস্ত্র নির্দেশ, এমনকি নিজে এসে বাণীর দ্বারা তাকে নিষেধ করে। কিন্তু বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও জীব যখন সেসব নির্দেশ পরোয়া না করে মায়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়, তখন ভগবান বা ভগবদ্ভক্তি থেকে সে দূরে সরে যায়। 
 




জবহি রাম সব কহা বখানী। প্রভু পদ ধরি হিয় অনল সমানী।।
নিজ প্রতিবিম্ব রাখি তহুঁ সীতা। তৈসই সীল রূপ সুবিনীতা।।
অর্থাৎ, “শ্রীরামচন্দ্র সব কথা বুঝিয়ে বলতেই সীতাদেবী শ্রীপ্রভুর পাদপদ্ম হৃদয়ে ধারণ করে অগ্নিতে মিলিত হলেন। সীতাদেবী তাঁর যে প্রতিবিম্ব বা ছায়ামূর্তি সেখানে রেখে গেলেন, তা তাঁরই মতো সুশীল স্বভাবসম্পন্না, রূপবতী ও নম্র স্বভাবযুক্তা ছিল।” লঙ্কা বিজয় তথা রাবণ বধের পর রামচন্দ্র সীতাদেবীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে আদেশ করেন। পরমপবিত্র সীতাদেবী প্রভুর আদেশ কায়মনোবাক্যে শিরোধার্য করে নিলেন। লক্ষণের নির্মিত অগ্নিকুন্ডের সামনে দাঁড়িয়ে সীতাদেবী নির্ভয়ে বলতে লাগলেন-“যদি কায়মনোবাক্যে আমার অন্তরে শ্রী রঘুবীর ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের প্রতি আনুগত্য না থাকে, তাহলে হে অগ্নিদেব, আপনি তো সকলের গতি সম্বন্ধে সম্যকভাবে পরিচিত; আমার রক্ষায় আপনি চন্দনসম শীতল হয়ে যান।”
শ্রীখন্ড সম পাবক প্রবেস কিয়োসুমিরি প্রভু মৈথিলী। 
জয় কোসলেস মহেশ বন্দিত চরণ রতি অতি নির্মলী।।
প্রতিবিম্ব অরু লৌকিক কলঙ্ক প্রচন্ড পাবকমহুঁ জরে। 
প্রভু চরিত কাহুঁ ন লখে নভ সুর সিদ্ধ মুনি দেখহিঁ খরে।।
“যাঁর শ্রীচরণ দেবাদিদেব শংকর দ্বারাও সেবিত, সেই প্রভু শ্রীরামচন্দ্রকে স্মরণ করে ও তাঁর ওপর বিশুদ্ধ প্রীতি ধারণ করে আর তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে দেবীজানকী চন্দনসমশীতল অগ্নিতে প্রবেশ করলেন। প্রতিবিম্ব তথা (সীতাদেবীর ছায়ামূর্তি) মায়াসীতা ও তাঁর লৌকিক কলঙ্ক প্রচন্ড অগ্নিতে ভস্মীভূত হলো। প্রভুর এ লীলা সকলের বোধগম্য হলো না। দেবতা, সিদ্ধ ও মুনিগণ আকাশে অবস্থান করে ঘটনাসকল প্রতক্ষ্য করে গলেন।”




সীতাদেবীর অগ্নি পরিক্ষার রহস্য

  ধরি রূপ পাবক পানি গহি শ্রী সত্য শ্রুতি জগ বিদিত জো। 
জিমি ছীরসাগর ইন্দিরা রামহি সমর্পি আনি সো।।
“তখনি অগ্নিদেব স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে বেদসম্মত জগদ্বিখ্যাত প্রকৃত লক্ষ্মীদেবী তথা সীতাদেবীকে প্রভু শ্রীরামচন্দ্র অর্পণ করলেন। এ ঘটনা তেমনভাবেই ঘটল যেভাবে ক্ষীরসাগর দেবী মহালক্ষ্মীকে শ্রীবিষ্ণুর হাতে সমর্পণ করেছিলেন।” সেই সীতাদেবী শ্রীরামের বামভাগে বিরাজিতা হলেন। সেই যুগলমূর্তির অনুপম সৌন্দর্য মনে হলো যেন সদ্যপ্রস্ফুটিত নীলকমলের পাশে সুবর্ণ কমলকণিকা শোভামান রয়েছে।”

সীতাদেবীর এ অগ্নিপরিক্ষা নিয়ে অনেকে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তাদের ধারণা এটা সীতাদেবীর তথা সমগ্র স্ত্রীজাতির অবমাননা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এতে সীতাদেবী যে সর্বদা সম্পূর্ণরূপে নির্মল হৃদয়, পরম পবিত্র এবং পরম সতী, সে মহিমাই কীর্তিত হয়েছে। সুতরাং সমগ্র স্ত্রী জাতির অবমাননার প্রশ্নই ওঠে না। মূলত, অগ্নিপরীক্ষার পেছনে শ্রীরামের উদ্দেশ্যে ছিল সীতার পবিত্রতা বিষয়ে জগদ্বাসী যেন কখনো কোনো সন্দেহ পোষণ করতে না পারে তা প্রতিষ্ঠিত করা এবং সকলের অলক্ষে মায়াসীতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রকৃত সীতাকে অগ্নিদেবের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেয়া।



 
এভাবে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বেদবতী নাম্নী তাঁর ভক্তের বাক্য সত্যে পরিণত করতে, ভৃগুমুনি ও চতুস্কুমারের অভিশাপ পূর্ণ করতে, বীর-রস আস্বাদন করতে, কুম্ভকর্ণ ও রাবণকে অসুরজীবন থেকে মুক্তি দিতে এবং সর্বপুরি রামায়ণের রোমাঞ্চকর লীলার মধ্য দিয়ে ভক্তের আনন্দ বিধান ও জগজ্জীবকে শিক্ষা দেয়ার নিমিত্তে সীতা অপহরণ লীলা সংঘটিত করেন। কিন্তু ভগবানের এ লীলারহস্য বুঝতে না পেরে কেউ কেউ ভগবানের অক্ষমতা মনে করে। 
এই আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে, রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ ভগবানের অসমর্থতা প্রমাণ করে না বরং তাতে ভগবান শ্রীরামের মহিমা আরো বর্ধিত হয়েছে, এজন্যই যে, ভগবান কত তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা এমন জটিলতাপূর্ণ অদ্ভুত লীলা সম্পাদন করেছেন। 
 " রঘুপতি রাঘব রাজা রাম
পতিতপাবন সীতারাম"।