Tuesday, 26 January 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
বিশেষ আলোচনা পর্ব
রামায়ণের সীতা দেবীর চরিত্র
=================================
Doinik Sabder Methopath
Vol -264. Dt -27.01.2021
১৩ মাঘ, ১৪২৭. মঙ্গলবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

রাক্ষসরাজ রাবণের ভগিনি সুর্পনখা রামভার্যা মহালক্ষী সীতাকে রাবণভার্যা হওয়ার জন্য তাঁকে আনতে উদ্যত হলে রামানুজ লক্ষ্মন তার নাক-কান কেটে দিল। প্রতিহিংসায় ক্রোধিত হয়ে সুর্পনখা ভ্রাতা রাবণের কাছে নালিশ করল এবং সীতার অপূর্ব সৌন্দর্যের কথা ব্যক্ত করে তাকে সীতাবিবাহ করার মাধ্যমে এর প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করার জন্য তারকা রাক্ষসীর পুত্র মায়াবী মরীচের কাছে গেল। রাবণ মারীচকে বলল-
“সীতাকে প্রলোভিত করার জন্য তুমি মায়াবলে রজতবিন্দুসমূহে চিত্রিত স্বর্ণমৃগ (স্বর্ণবর্ণ হরিণ) হয়ে রামের আশ্রমে গিয়ে জনকদুহিতা সীতার সম্মুখে বিচরণ করো। তুমি স্বর্ণমৃগ হয়ে বিচরণ করতে থাকলে রামভার্যা, জনকনন্দিনী সীতা তোমাকে দেখে বিস্মতা হয়ে তৎক্ষণাৎ রামকে ‘এই মৃগ আনয়ন করো’ এ কথা বলবে; এরপর রাম তোমাকে ধরতে আশ্রম হতে বহির্গত হলে, তুমি বহু দূরে গিয়ে ‘হা সীতে, হা লক্ষ্মণ’-এরূপ বাক্য উচ্চারণপূর্বক আর্তনাদ করবে। সীতা তা শুনে সুমিত্রানন্দন লক্ষ্মণকে রামের নিকট পাঠাবে; লক্ষ্মণও সৌভ্রাত্রবশত রামের অনুগামী হবে। এভাবে রাম ও লক্ষণ আশ্রম ত্যাগ করলে আমি বিদেহরাজনন্দিনী সীতাকে অনায়াসে অপহরণ করব।” 

মহামুনি বাল্মীকি রচিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের দিব্য লীলাসমন্বিত গ্রন্থ ‘রামায়ণ’-এর অন্যতম একটি অধ্যায় রাবণ কর্তৃক দেবীসীতা অপহরণ। নির্বিশেষবাদী ও নাস্তিকদের ধারণা, “শ্রীরামচন্দ্র তাঁর পত্নী সীতাদেবীকে রাবণের হাত থেকে সুরক্ষা দিতে পারেননি। তাই তিনি ভগবান হতে পারেন না।” পরমেশ্বর ভগবান সম্বন্ধে যথাযথ ধারণার অপূর্ণতার কারণেই তাঁর সম্বন্ধে কেউ এমন মন্তব্য করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, রামচন্দ্র সীতাদেবীকে সুরক্ষা দিতে পারেননি-এর পরিবর্তে বলা উচিত-তিনি সুরক্ষা দেননি। কেন সুরক্ষা দেননি তা-ই এ প্রবন্ধে আলোচনা করা হলো। 
 
 ভগবান এজগতে বিভিন্ন লীলা করেন তাঁর ভক্তের আনন্দবিধান ও জীবশিক্ষার নিমিত্তে এবং কোন লীলা থেকে কী শিক্ষা তা কেবল তাঁর ভক্তরাই উপলব্ধি করতে পারেন; অপরপক্ষে, সাধারণ মানুষ তাঁকে বুঝতে না পেরে তাঁর নিন্দা করে। সীতা দেবীকে অবশেষে শ্রীরামচন্দ্রই উদ্ধার করেছিলেন। আর অসামর্থ্যের লীলাচ্ছলে এ কার্যে তিনি তাঁর পরম ভক্ত লক্ষণ, সুপ্রীব, বিভীষণ, হনুমান ও অন্যান্য বানরসেনাদি বিভিন্ন ভক্তদের তাঁর সেবায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ প্রদান করেছিলেন। তাছাড়া, হরিণরূপী মারীচের ইচ্ছে ছিল যে সে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের হাতে নিহত হবে এবং সেজন্য ভগবান একটি ঘটনার আবহ তৈরি করে তাকে সে সৌভাগ্য প্রদান করেছেন। রাবণ কর্তৃক সীতা অপরণের লীলা তা থেকে আমরা অনেক শিক্ষা লাভ করতে পারি। 




 প্রথমত, মারীচ যেমন যেমন সোনার হরিণরূপে এসেছিল, তেমনি মায়া বিভিন্নরূপে আমাদের সামনে উপস্থিত হতে পারে। বিশেষত এ কলিযুগে টিভিতে প্রদর্শিত বিভিন্ন জড়জাগতিক সিরিয়াল, সিনেমা. বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড, ইন্টারনেট, ফেসবুক,ভিডিওগেম, পর্ণগ্রাফি, বন্ধু-বান্ধবী, নেশাজাতীয় দ্রব্য, জুয়াখেলা ইত্যাদি হচ্ছে মায়ার প্রলোভন। এগুলো সোনার মায়াহরিণের মতো আকর্ষণীয়, কিন্তু পরিণামে বিপদ ডেকে আনে। সর্বোপরি পারমার্থিক জীবন বিনাশপ্রাপ্ত হয়। 

দ্বিতীয়ত, সীতাদেবী যেরূপ মাহরিণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তেমনি, জীব যদিও মায়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ভগবান সাধু, গুরু ও শাস্ত্র নির্দেশ, এমনকি নিজে এসে বাণীর দ্বারা তাকে নিষেধ করে। কিন্তু বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও জীব যখন সেসব নির্দেশ পরোয়া না করে মায়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়, তখন ভগবান বা ভগবদ্ভক্তি থেকে তিনি দূরে সরে যায়। আমাদের কখনো মায়ার প্রলোভনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া উচিত নয়। কেননা, তাহলে আমরা ভগবানকে হারাব।ঠিক যেভাবে সীতা দেবী ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে হারিয়েছিলেন। 

ভগবানের চেয়ে তাঁর ভক্ত বা শ্রীগুরুদেব অধিক করুণাময়। শ্রীরাম ভগবত্তত্ত্ব এবং লক্ষণ গুরুতত্ত্ব। সীতা দেবী মায়া হরিণের প্রতি আকৃষ্ট হলে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র সীতা থেকে (জীবের) তত্ত্বাবধান করেন। অর্থাৎ ভগবান অসন্তুষ্ট হলেও গুরুদেব কাউকে সুরক্ষা দিতে পারেন। হরিণরূপী মারীচ শ্রীরামের কন্ঠস্বর অনুকরণ করে ভ্রাতা লক্ষণ বলে আর্তনাদ করছিলেন, তখন সীতাদেবী ভাবছিলেন যে, প্রভু রাম কোনো বিপদে পড়েছেন। তাই তিনি লক্ষণকে সেখানে গিয়ে রামকে রক্ষা করতে বলেন। কিন্তু লক্ষণের সুদৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, রামের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, আমাদের কখনো ভগবানের প্রতি আস্থা হারানো উচিত নয়। 



 

লক্ষণ সীতাদেবীকে একা রেখে যেতে চাননি। কিন্তু সীতার কটুবাক্যবানে বিদ্ধ হয়ে তিনি সীতাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবুও তিনি পূর্ণরূপে তাকে ত্যাগ করেননি। তিনি তখন বনদেবতা ও দিকমন্ডলের হস্তে সমর্পণ করে রামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে গমন করলেন। দিকমন্ডলের স্থলে কোথাও কোথাও বলা হয়েছে যে, রক্ষাকবচ হিসেবে লক্ষণ কুটিরের চারপাশে একটি রেখা অংকন করে দিয়ে যান এবং সীতা দেবীকে বলেন যে,

 তিনি যেন এ রেখা লঙ্ঘন বা অতিক্রম না করেন। অর্থাৎ শিষ্য গুরুদেবের কথার অবাধ্য হলে বা গুরুদেবকে ত্যাগ করলেও গুরুদেব কখনো তাঁর শিষ্যকে ত্যাগ করতে চান না। আর গুরুদেবের অনুপস্থিতিতে তাঁর নির্দেশই শিষ্যের জীবন পাথেয়স্বরূপ। লক্ষণরেখা হলো গুরুদেবের নির্দেশস্বরূপ। কৃষ্ণভাবনামৃতে গুরুদেব শিষ্যকে আমিষাহার, নেশা, দ্যূতক্রীড়া ও অবৈধ যৌনসঙ্গ বর্জন এবং জপমালায় নিয়মিত নির্দিষ্ট সংখ্যক হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার নির্দেশ দেন। শিষ্যের কখনো এ নির্দেশগুলো লঙ্ঘন করা উচিত নয়। 


রাম ও লক্ষণ উভয়ই যখন কুটির থেকে দূরে চলে গেলেন, তখন অসুর রাবণ সাধুর বেশ ধরে সীতার কুটিরে আসে। কিন্তু সীতা তাকে চিনতে না পেরে তার কথার ফাঁদে পড়ে লক্ষণরেখা অতিক্রম করেন এবং রাবণ কর্তৃক অপহৃত হন। এ থেকে প্রথম শিক্ষা হলো স্ত্রীলোকদের পক্ষে একাকী থাকা বিপজ্জনক। তাদের সর্বদা করো আশ্রয়ে থাকা উচিত-শৈশব ও কৈশরে পিতার অধীনে, যৌবনে পতির অধীনে বার্ধক্যে উপযুক্ত সন্তানের অধীনে। আর যদি কারো সন্তান না থাকে তবে কোনো আশ্রমে গুরুদেবের তত্ত্বাবধানে। দ্বিতীয়ত, শিষ্য যদি গুরুর নির্দেশ অমান্য করে, তবে নিশ্চিতরূপে সে বিপদের সম্মুখীন হবে এবং মায়ার আকর্ষণে আসুরী শক্তির প্রভাবে তার আধ্যাত্মিক জীবন বিনাশপ্রাপ্ত হবে।

তৃতীয়ত, রাক্ষস রাবণ যেমন সাধুর বেশে সীতাদেবীর সামনে এসেছে, তেমনি সামাজে অনেক ভন্ড, প্রতারক অসুর আছে যারা সাধুর বেশে সাধারণ লোকদের সঙ্গে প্রতারণা করে, বিশেষ করে এ কলিযুগে। তাদের মিথ্যে মধুর বাক্যে মোহিত না হয়ে আমাদের উচিত তাদের থেকে সাবধান থাকা এবং শাস্ত্রনির্দেশ অনুসারে সদগুরু ও ভগবানের আশ্রয়ে থাকা। অন্যথায় এসমস্ত অসুরেরা আমাদের ভক্তিসম্মদকে অপহরণ করবে। আবার, রাবণ যখন সীতাদেবীকে আকাশমার্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি আকুলভাবে প্রভু রাম ও লক্ষ্মণকে স্মরণ করছিলেন এবং একেকে করে তাঁর সমস্ত অলংকার ফেলে দিচ্ছিলেন, যেন সেগুলো দেখে সহজে বোঝা যায় যে, তিনি কোন পথে গিয়েছেন। এ থেকে শিক্ষা হলো, জীব যতই অধঃপতিত হোক, যদি ঐকান্তিকভাবে ভগবানের শরণগ্রহণ করেন, তবে ভগবান তাঁকে বুদ্ধি দান করেন, যেন সে জীব পুনায় তাঁর কাছে ফিরে যেতে পারে।



 
পতিমধ্যে রামভক্ত জটায়ু (পাখি) সীতামাতাকে অসহায় অবস্থায় দেখে সহায়তা করার জন্য রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রাবণ তার একটি ডানা কেটে ফেলে। তথাপি সে মৃত্যু অবধি লড়াই করে চলে। অর্থাৎ ভগবানের সেবার জন্য ভক্তের উচিত তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করা এবং জন্মজন্মান্তর ধরৈ ভগবানের সেবা করার জন্য শত বিপদ সত্ত্বেও দৃঢ় সংকল্প থাকা। আবার এখানে জটায়ু সরাসরি ভগবানের সেবা না করে ভগবানের ভক্তের (সীতার) সেবা করেছেন। আর তাতে ভগবান তার প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছেন। সীতাদেবীকে খুঁজতে খুঁজতে রাম-লক্ষ্মণ জটায়ুর সম্মুখে উপনীন হন এবং রামচন্দ্র স্বহস্তে জটায়ুর শবদেহ সৎকার করেন। অর্থাৎ কেউ যখন সম্পুর্ণরূপে ভগবান ও তাঁর শুদ্ধভক্তের দাসত্ব স্বীকার করেন, তখন তিনি ভগবানের অত্যন্ত প্রিয় হন। তখন অগবান ভক্তের অধীন হয়ে যান, ভগবান নিজেই তখন তাঁর সেই প্রিয় ভক্তের সেবা করতে চান।

এরপর রামনাম লেখা পাথরে জলে ভাসমান সেতু নির্মাণ লীলা থেকে আমরা ভগবানের নামের মহিমা সম্বন্ধে জানতে পারি। রাবণ সীতাদেবীকে প্রতারণার দ্বারা জয় করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, রাবণ মায়াসীতাকেই হরণ করেছিল। কাম এবং লোভ চির অতৃপ্ততা, ঔদ্ধত্য ও ঈর্ষার জন্ম দেয়। রাবণ কখনোই সীতাকে লাভ করতে পারেনি। বরং, এর কারণেই রাবণের বিনাশ নিশ্চিত হয়েছিল। তাছাড়া ভক্ত বা পরস্ত্রীকে অবমাননা করার শাস্তি যে কত ভয়ংকর এ শিক্ষাও আমরা রামায়ণের এ লীলা থেকে লাভ করতে পারি। সীতা অপহরণের এ লীলায় রয়েছে এমন অনেক উন্নত শিক্ষা, যা ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ করার মাধ্যমে বদ্ধজীব খুব সহজেই ভগবানের ধামে ফিরে যেতে পারে। সেজন্যই ভগবান এমন বিচিত্র লীলা সম্পাদন করে থাকেন।
এছাড়াও সীতা অপহরণের পেছনে রয়েছে আরো গুপ্ত তথ্য, যেসব কারণে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র নিজ পত্মীকে রক্ষা না করতে পারার মতো অসমর্থ্যের ন্যায় লীলা করেছেন।

বীররস আস্বাদন ও চতুষ্কুমারের অভিশাপ পূর্ণকরণ
 
শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর- বিশেষত এ পাঁচটি মুখ্য রসের মাধ্যমে ভক্ত ভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হন। এছাড়া হাস্য, অদ্ভুত, বীর, করুণ, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীভৎস-এ সাতটি গৌণ রসের কথাও ভক্তিরসামৃত গ্রন্থে শ্রীল রূপগোস্বামীপাদ উল্লেখ করেছেন। সীতাহরণ লীলার একটি বিশেষ কারণ হলো-ভগবান নিজে বীর-রস আস্বাদন করতে ও তাঁর ভক্তকে সে রস আস্বাদন করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অসীম ভগাবানকে দর্শন, স্পর্শন বা তাঁর সাঙ্গে যুদ্ধ করার সামর্থ্য বা যোগ্যতা সাধারণ জীবের নেই।
তাই সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ভগবান প্রথমে বৈকুন্ঠের দ্বারপালরূপী তাঁর দুই মহান সেবক জয় ও বিজয়কে সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার-এ চতুষ্কুমারের দ্বারা অভিশপ্ত করিয়েছেন যে, তারা মর্ত্যলোকে অসুরকুলে জন্মগ্রহণ করবে এবং কেবল ভগবানের হাতে নিহত হলেই তাদের অসুরযোনি থেকে মুক্তি হবে। তাই জয়-বিজয় প্রথমে হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু রূপে এবং তারপর রাবণ ও কুম্ভকর্ণরূপে পৃথিবীতে রাক্ষসকুলে জন্মগহণ করেন। কিন্তু অকারণে কারো সঙ্গে যুদ্ধ করা বা কাউকে বধ করা অনুচিত। তাই ভগবান তাদের বধ করার জন্য সে ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি করতে রাবণ কর্তৃক সীতা অপহরণ লীলা সংঘটিত করেন।


মারীচের ইচ্ছা পুরণ 
 
তারকা বধের পর রাবণমিত্র মারীচ শ্রীরামের মহিমা বুঝতে পেরে মানসিকভাবে তাঁর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। রাবণ যখন সীতারামকে প্রতারণা করার জন্য মারীচকে প্রস্তাব দেয়, মারীচ প্রথমে রাজি হননি। বরং সে রাবণকে রামের সঙ্গে শত্রুতা করতে নিষেধ করে। তখন রাবণ ক্রোধিত হয়ে মারীচকে বলল- “রামের নিকট গেলে তোমার প্রাণ সংশয় হবে, আর আমার সঙ্গে বিবাদ করলে তোমার প্রাণ সংহার হবে। এবার বিচার করে দেখ কী করবে।”

মারীচ চিন্তা করল শস্ত্রধারী, ভেদজ্ঞানী (যে গোপন কথা জানে), সামর্থ্যযুক্ত প্রভু, মূর্খ, ধনী, চিকিৎসক, চাটুকার ব্যক্তি, কবি ও পাচক-এ নয় রকম ব্যক্তির সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করলে কল্যাণ হয় না। আজ্ঞাপালন করতে অস্বীকার করলে এ অভাগা রাবণকর্তৃক এখনই আমাকে নিহত হতে হবে। তার চেয়ে বরং শ্রীহরি রঘুনাথের হাতে মৃত্যু হওয়াই আমার পরম সৌভাগ্য।”



 
 সে ভাবতে লাগল- “আজ প্রিয়তমের দর্শন লাভ করে আমার নয়ন সার্থক করব। তখন সীতাদেবী ও অনুজ শ্রীলক্ষ্মণ সহিত কৃপানিকেতন শ্রীরামচন্দ্রের পাদপদ্মে নিজেকে আমি সমর্পণ করে দেব, যাঁর ক্রোধও মঙ্গলজনক, সেই আনন্দনিকেতন ভগবান শ্রীহরি নিজ হস্তে শরনিক্ষেপ করে আমাকে স্পর্শ দান (বধ) করবেন। যখন প্রভু ধনুর্বাণ হস্তে আমাকে ধরবার জন্য ছুটে আসবেন তখন তাঁকে পিছন ফিরে বারবার দর্শন করব। আমার মতন ভাগ্যবান আর কে আছে।” কেননা, ভগবানের হাতে নিহত হলে জীব মুক্তিলাভ করে। এমন ভেবে মারীচ রঘুনাথের প্রতি শরণাগতিই বেছে নিল, রাবণের সঙ্গে সম্মতি জানাল এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হলো। অর্থাৎ, মারীচের মনোভিলাষ পুর্তি ও তাকে রাক্ষস দেহ থেকে মুক্ত করা ছিল সীতা অপহরণ লীলার আরেকটি কারণ।


রাবণের ইচ্ছা পুরণ
 
ভগিনি সুর্পনখার মুখে রাম কর্তৃক খর, দূষণ ও ত্রিশিরা বধের কথা শুনে দশানন রাবণের সর্বাঙ্গে যেন অগ্নিজ্বালা শুরু হলো। নিজ শক্তিসামর্থ্য আর বীরগাথা কীর্তন করে রাবণ সূর্পনখাকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিল। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় তখন রাবণ ভয়ানক দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরে ফিরে গেল এবং রাতভর সে ঘুমাতে পারল না। রাবণ চিন্তা করল- “দেবতা, মানব, অসুর, নাগ এবং পক্ষীকুলের মধ্যে এমন কেউ নেই যে আমার অনুচরদের সমকক্ষ হতে পারে; আর খর-দূষণ তো আমারই মতো শক্তিধর ছিল।

তাদের তো একমাত্র ভগবানই বিনাশ করতে সক্ষম। দেবতাদের আনন্দদাতা ও ভূভারহারী শ্রীভগবানই যদি অবতারূপে এসে থাকেন, তবে আমি বলপ্রয়োগ করে ভবসাগর পার হব। এই তামস দেহে তো আর তাঁর ভজনা হবে না; তাই এরূপ সিদ্ধান্ত কায়মনোবাক্যে নেয়াই মঙ্গলজনক। আর যদি তারা নেহাতই নরসম রাজকুমারই হয়, তবে তাদের যুদ্ধে পরাজিত করে সেই নারীকে হরণ করতে বেগ পেতে হবে না।”(তুলসীদাসকৃত রামচরিতমানস) ভগবানের হাতে রাবণের নিহত হওয়ার এ মনোভাব স্পষ্টই প্রমাণ করে যে, রামণের এ অভিলাষ পূর্ণকরাও ছিল সীতাহরণ লীলার এক বিশেষ কারণ।


বেদবতীর প্রতিক্ষা রক্ষা-(রামায়ন কথা)
রাবণ পরস্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত লালায়িত ছিল। তার পাপ কর্মে বর্ধিত হয়ে সীতা অপহরণের মধ্য দিয়ে চরমে পৌছল। রাবণ ধরণীতলে ভ্রমণপূর্বক একদিন হিমালয় পর্বতের নিকটস্থ বনে ধ্যানরতা অপূর্বসুন্দরী কন্যার প্রতি অসদাচরণ করতে উদ্যত হয়।সে মহিয়সী ছিলেন অমিতপ্রভ বৃহস্পতিসূত ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজের কন্যা। কুশধ্বজ নিয়মিত বেদ পাঠ করতেন। তাঁর শ্রীমুখ থেকে উচ্চারিত শব্দব্রহ্মরূপ বেদমন্ত্রই মূর্তিমতি কন্যারূপে প্রকটিত হন।

 তাই সে কন্যার নাম রাখা হয় বেদবতী যিনি কেবল শ্রীবিষ্ণুকেই তাঁর পতিরূপে হৃদয়ে ধারণ করেন। রাবণ তার কেশ স্পর্শ করা মাত্রই বেদবতী অগ্নিশর্মা হয়ে নিজেই হস্ত দ্বারা সে কেশ ছিন্ন করেন এবং যোগবলে দেহত্যাগ করেন। দেহত্যগের পূর্বে প্রতিজ্ঞা করেন যে, পরবর্তী জন্মে তিনিই হবেন রাবণের মৃত্যুর কারণ। এ বেদবতীই পরবর্তীতে জনক রাজার কন্যা সীতা রূপে আবির্ভূত হন এবং রামরূপধারী শ্রীবিষ্ণুকে পতিরূপে প্রাপ্ত হন। তখন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বেদবতীর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে সীতা অপহরণ লীলা সংঘটিত করেন।




মায়াসীতা-(রামায়ন কথা)
 
সীতা অপহরণের ঘটনার আপাত বিচার হলো, “ভগবানের পত্মীকে সামান্য এক অসুর অপহরণ করেছে এবং ভগবান তাকে রক্ষা করতে পারেননি”। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, যে সীতাকে রাবণ অপহরণ করেছে তিনি ভগবান শ্রীরামের পত্মী সীতা নন, মায়াসীতা এবং যে রাবণ মায়া সীতাকে হরণ করেছে, সে অসুর নয়, ভগবানের মহান ভক্ত-বৈকুন্ঠের দ্বারপাল।সীতা অপহরণের পূর্বেই রামচন্দ্র মূল সীতাকে অগ্নিদেবের দায়িত্ব অনত্র রেখে দেন।



 
শ্রীরামের মহান ভক্ত তুলসী দাস রচিত রামায়নের (শ্রীরামচরিতমাস) অরণ্যকান্ডে এবং আরো কিছু শাস্ত্রে তার উল্লেখ রয়েছে। হরিণরূপে সীতাকে মোহিত করার প্রস্তাব নিয়ে রাবণ যখন মারীচের নিকট উপস্থিত হলেন, সেসময় লক্ষণ কন্দ ও ফলমূল আহরণে বনে গমন করেছেন। তখন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লক্ষ্মীস্বরূপিণী সীতাদেবীকে বললেন- শুনহ প্রিয়া ব্রত রুচির সুসীলা। মৈঁ কিছু করবি ললিত নরলীলা।। 
তুমহ পাবক মহুঁ করহু নিবাসা। জৈৗ লগি করৌ। নিশাচর নাসা।। 
“হে পতিব্রতা সুশীলা প্রিয়তমা, শোন, আমি এখন কিছু ললিত নরলীলা সম্পাদন করব। কিছু রাক্ষস বধ করব। তাই রাক্ষস বিনাশ না হওয়া পর্যন্ত তুমি অগ্নিতে নিবাস করো।” 

সীতাদেবী যেরূপ মায়াহরিণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তেমনি, জীব যদিও মায়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ভগবান সাধু, গুরু ও শাস্ত্র নির্দেশ, এমনকি নিজে এসে বাণীর দ্বারা তাকে নিষেধ করে। কিন্তু বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও জীব যখন সেসব নির্দেশ পরোয়া না করে মায়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়, তখন ভগবান বা ভগবদ্ভক্তি থেকে সে দূরে সরে যায়। 
 




জবহি রাম সব কহা বখানী। প্রভু পদ ধরি হিয় অনল সমানী।।
নিজ প্রতিবিম্ব রাখি তহুঁ সীতা। তৈসই সীল রূপ সুবিনীতা।।
অর্থাৎ, “শ্রীরামচন্দ্র সব কথা বুঝিয়ে বলতেই সীতাদেবী শ্রীপ্রভুর পাদপদ্ম হৃদয়ে ধারণ করে অগ্নিতে মিলিত হলেন। সীতাদেবী তাঁর যে প্রতিবিম্ব বা ছায়ামূর্তি সেখানে রেখে গেলেন, তা তাঁরই মতো সুশীল স্বভাবসম্পন্না, রূপবতী ও নম্র স্বভাবযুক্তা ছিল।” লঙ্কা বিজয় তথা রাবণ বধের পর রামচন্দ্র সীতাদেবীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে আদেশ করেন। পরমপবিত্র সীতাদেবী প্রভুর আদেশ কায়মনোবাক্যে শিরোধার্য করে নিলেন। লক্ষণের নির্মিত অগ্নিকুন্ডের সামনে দাঁড়িয়ে সীতাদেবী নির্ভয়ে বলতে লাগলেন-“যদি কায়মনোবাক্যে আমার অন্তরে শ্রী রঘুবীর ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের প্রতি আনুগত্য না থাকে, তাহলে হে অগ্নিদেব, আপনি তো সকলের গতি সম্বন্ধে সম্যকভাবে পরিচিত; আমার রক্ষায় আপনি চন্দনসম শীতল হয়ে যান।”
শ্রীখন্ড সম পাবক প্রবেস কিয়োসুমিরি প্রভু মৈথিলী। 
জয় কোসলেস মহেশ বন্দিত চরণ রতি অতি নির্মলী।।
প্রতিবিম্ব অরু লৌকিক কলঙ্ক প্রচন্ড পাবকমহুঁ জরে। 
প্রভু চরিত কাহুঁ ন লখে নভ সুর সিদ্ধ মুনি দেখহিঁ খরে।।
“যাঁর শ্রীচরণ দেবাদিদেব শংকর দ্বারাও সেবিত, সেই প্রভু শ্রীরামচন্দ্রকে স্মরণ করে ও তাঁর ওপর বিশুদ্ধ প্রীতি ধারণ করে আর তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে দেবীজানকী চন্দনসমশীতল অগ্নিতে প্রবেশ করলেন। প্রতিবিম্ব তথা (সীতাদেবীর ছায়ামূর্তি) মায়াসীতা ও তাঁর লৌকিক কলঙ্ক প্রচন্ড অগ্নিতে ভস্মীভূত হলো। প্রভুর এ লীলা সকলের বোধগম্য হলো না। দেবতা, সিদ্ধ ও মুনিগণ আকাশে অবস্থান করে ঘটনাসকল প্রতক্ষ্য করে গলেন।”




সীতাদেবীর অগ্নি পরিক্ষার রহস্য

  ধরি রূপ পাবক পানি গহি শ্রী সত্য শ্রুতি জগ বিদিত জো। 
জিমি ছীরসাগর ইন্দিরা রামহি সমর্পি আনি সো।।
“তখনি অগ্নিদেব স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে বেদসম্মত জগদ্বিখ্যাত প্রকৃত লক্ষ্মীদেবী তথা সীতাদেবীকে প্রভু শ্রীরামচন্দ্র অর্পণ করলেন। এ ঘটনা তেমনভাবেই ঘটল যেভাবে ক্ষীরসাগর দেবী মহালক্ষ্মীকে শ্রীবিষ্ণুর হাতে সমর্পণ করেছিলেন।” সেই সীতাদেবী শ্রীরামের বামভাগে বিরাজিতা হলেন। সেই যুগলমূর্তির অনুপম সৌন্দর্য মনে হলো যেন সদ্যপ্রস্ফুটিত নীলকমলের পাশে সুবর্ণ কমলকণিকা শোভামান রয়েছে।”

সীতাদেবীর এ অগ্নিপরিক্ষা নিয়ে অনেকে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তাদের ধারণা এটা সীতাদেবীর তথা সমগ্র স্ত্রীজাতির অবমাননা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এতে সীতাদেবী যে সর্বদা সম্পূর্ণরূপে নির্মল হৃদয়, পরম পবিত্র এবং পরম সতী, সে মহিমাই কীর্তিত হয়েছে। সুতরাং সমগ্র স্ত্রী জাতির অবমাননার প্রশ্নই ওঠে না। মূলত, অগ্নিপরীক্ষার পেছনে শ্রীরামের উদ্দেশ্যে ছিল সীতার পবিত্রতা বিষয়ে জগদ্বাসী যেন কখনো কোনো সন্দেহ পোষণ করতে না পারে তা প্রতিষ্ঠিত করা এবং সকলের অলক্ষে মায়াসীতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রকৃত সীতাকে অগ্নিদেবের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেয়া।



 
এভাবে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বেদবতী নাম্নী তাঁর ভক্তের বাক্য সত্যে পরিণত করতে, ভৃগুমুনি ও চতুস্কুমারের অভিশাপ পূর্ণ করতে, বীর-রস আস্বাদন করতে, কুম্ভকর্ণ ও রাবণকে অসুরজীবন থেকে মুক্তি দিতে এবং সর্বপুরি রামায়ণের রোমাঞ্চকর লীলার মধ্য দিয়ে ভক্তের আনন্দ বিধান ও জগজ্জীবকে শিক্ষা দেয়ার নিমিত্তে সীতা অপহরণ লীলা সংঘটিত করেন। কিন্তু ভগবানের এ লীলারহস্য বুঝতে না পেরে কেউ কেউ ভগবানের অক্ষমতা মনে করে। 
এই আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে, রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ ভগবানের অসমর্থতা প্রমাণ করে না বরং তাতে ভগবান শ্রীরামের মহিমা আরো বর্ধিত হয়েছে, এজন্যই যে, ভগবান কত তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা এমন জটিলতাপূর্ণ অদ্ভুত লীলা সম্পাদন করেছেন। 
 " রঘুপতি রাঘব রাজা রাম
পতিতপাবন সীতারাম"।

No comments: