Wednesday, 30 June 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। রতনতনু ঘাঁটি। ৩০.০৬.২০২১. Vol -419. The blogger in literature e-magazine

 দুই প্রজন্ম ধরে বাংলার ছোটোরা অজস্র সুন্দর সুন্দর ছড়া আবৃত্তি করার জন্য তিনি লিখেছেন। ছড়ার পাশাপাশি ওঁর লেখা সরল ও মায়াময় গল্পগুলোও মন জুড়ে আছে অনেকেরই। জয়ঢাক এর পাতায় বেশ কিছুদিন ধরেই বের হয়ে চলেছে লেখা গল্প আর ছড়া।            




   

জন্ম ৩০ জুন ১৯৫৩। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের রাজারামপুর গ্রামে, ছােটো। ক্ষয়ে-আসা বিকেলের মতাে এক। ক্ষয়িষ্ণু কৃষক পরিবারে।। তার কৈশােরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। মায়ের রাঙা সিঁথির মতাে হলদি নদী আর উর্বশীর মতাে এক গ্রাম প্রকৃতি। বাংলা সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর । পড়াশােনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে সাংবাদিক হিসেবে। কর্মজীবন শুরু। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে। আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত।। এখন আনন্দমেলা পত্রিকার সহসম্পাদক।
 কর্মজীবনের শেষে এখনও সৃজনশীল সাহিত্যের অঙ্গনে সমানভাবে সক্রিয় রয়েছেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পঞ্চাশ। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে দশটি কিশোর গ্রন্থ।বাংলাদেশ থেকে কিশোর গল্পের ইংরেজি অনুবাদের বইও বেরিয়েছে একটি। 

রচনা কর্ম :
১) জরিপ নামা
২) ধান ফুল
প্রভৃতিি


ছড়া 
১) পালকি চলে
২) ফুল কড়ানি নদী
প্রভৃতি





২০১৪ সালে পেয়েছেন শিশুসাহিত্যের জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পুরস্কার, ওই বছরই দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি ও পারুল প্রকাশনীর যৌথ উদ্যোগে শিশুসাহিত্য পুরস্কার।


কবিতা -
১.

সিয়াচেনের মেঘ

সিয়াচেনের মেঘ, তুমি দিনরাত বন্ধুর বেশে 
পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম গ্লেসিয়ারের গায়ে 
সৈন্যদের মৌন পোশাক টাঙিয়ে রাখো।
অত উঁচু থেকে নেমে এসে তোমার কি কোনোদিন 
মাটির পৃথিবীর অশীতি রমণীকে ‘মা’ বলে ডেকে উঠতে ইচ্ছে করে না?
থলকলমির বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বান্ধবীর 
আগুনরঙা ঠোঁটের কথা ভুলে যাও তুমি সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে?
তুমি রোজ বিকেলবেলা ঘরেফেরা মেঘের ছেলেমেয়েদের
কেন পড়তে দাও উদাসীন জীবনের পাঠ?

আকাশপারের দৌবারিক,
তুমি এক আকাশ উঁচুতে দাঁড়িয়ে সীমান্ত পাহারা দাও।
তোমার জন্মনক্ষত্র কবে মুখ লুকিয়েছে এই কুচুটেপনায়,
বুঝতে পারো না? 
 
তোমার অনেকটা নীচে যে মানুষগুলো দেশের জন্যে লড়াই করছে
পররাষ্ট্রনীতির জিরাফ এসে রোজ বিকেলবেলা 
তাদের সামনে মুখ তুলে দাঁড়ায়। 
তার গ্রীবাদেশের নীচে কনে-দেখা আলোর মুখশ্রী নিয়ে 
যে মানুষগুলোর বাড়ি যাওয়ার ছুটি বারেবারেই বাতিল হয়ে যায়,
তাদের মুখ লুকনো বিষণ্ণতায় তুমি আড়াল রচনা করো!
তুমি জেনে রাখো, মাইনাস পঁয়শট্টি ডিগ্রি ঠান্ডায় 
তাদের চোখের জল কখনো বরফ হতে শেখেনি।

তাদের খাকি রঙের বুকপকেট থেকে লুকিয়ে 
সন্তানের হ্যাপি বার্থ ডে’র ছবি কেড়ে নাও কেন?
বান্ধবীর সঙ্গে একটা সূর্যাস্ত বুকের মধ্যে লুকিয়ে
যে লোকটা শত্রুপক্ষের মিসাইলকে বুক পেতে ফিরিয়ে দেয়,
পূর্ব কারাকোরাম রেঞ্জের অবিনাশী মেঘ, 
তাকে তুমি উদয়াস্ত বৈরাগ্যের ছবি আঁকা শেখাবে?

কুড়ি হাজার ফুট উপরে পৃথিবীর উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্রের মাথায়
একবার তুমি ভালোবাসার মেঘ ছড়িয়ে দিতে পারো না?
অনেক দূরে একটা গঞ্জের বাঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অধোবদন সংসারকে,
পায়সান্ন-রাঁধা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা 
ঘোমটা খসে পড়া মেদুর মায়ের কাছে
ছেলের ঘরে ফেরার খবর পৌঁছে দিতে পারো না তুমি? 

এই তো সেদিন হিমানীসম্পাতে মেশিনগান আঁকড়ে মারা গেল যারা
ওরা যে দেশেরই হোক, মনে রেখো, ওরাও মানুষ!
সত্তর ফুট বরফের নীচ থেকে তাদের শরীর তুলে এনে
বিধবার পোশাক পরা তাদের স্ত্রীর পিঠে হাত রেখে আর বলতে যেও না,
“চলে যাওয়া মানুষের জন্যে অমন করে মাতম করতে নেই!”

মানুষের বাধানো যুদ্ধে ভেঙে পড়ছে গ্লেসিয়ারের হীমশীতল পাঁজর।
এদিক থেকে পল্টুর ভাই গেছে, ওদিক থেকে এসেছে ইয়াসিনের ভাতিজা,

 
আজ সকালে সূর্য মুখ তোলার আগে পল্টুর ভাইয়ের ছেলে হয়েছে
অকৃতদার ইয়াসিন চোখ বোজার সময় ভাতিজাকে খুঁজেছিল। 
সিয়াচেনের মেঘ, তুমি আর কবে যুদ্ধবিরতির সংবাদ শোনাবে? 
মানুষের লড়াই তুমি আজ যদি থামাতে না পারো,
তবে কোথায় দাঁড়াবে গর্ভধারিণী স্নো লেপার্ড?
কলকাতা মেট্রোরেলের কম্পার্টমেন্টে লজ্জাহীন যুবকযুবতীকে দেখে 
চোখ নামিয়ে নিয়ে যেমন করে ক্ষমা করে দিচ্ছ প্রতিদিন
তেমন ক্ষমাভিক্ষার দরকার নেই শরমী ব্রাউন বিয়ারদের,
তাদের তুমি এক অঞ্জলি নির্জনতা দাও।

ক্ষয়িষ্ণু মানবিকতার মতো ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে 
তাপে দগ্ধ কালশিটে পড়া সিয়াচেন গ্লেসিয়ার,
ওর গায়ের মিসাইল আর গ্রেনেডের ক্ষতচিহ্ন মুছে যাক, 
ওকে শান্তিতে শুয়ে থাকতে দাও বরফের নিশ্চিন্ত বিছানায়।

পৃথিবী জুড়ে মানুষ এবার ভুলে যাক সার্বভৌমত্বের মায়াজাল
এবার শপথ নিতে জেগে উঠুক নতুন এক মানব সভ্যতা।
ব্লাউজের ভিতর থেকে ছোট ছেলের ছবিটা বের করে 
প্রসাদ উজিয়ে ঠাকুরের সামনে রেখে 
ভাতের মাড় শুকিয়ে যাওয়া হাতে 
মা ফের ভাত রাঁধতে তিনপাখা উনুন জ্বালুক।
জন্মান্ধ বাবার কোল আলো করে শুয়ে থাকুক 
যুদ্ধে যাওয়া তার একমাত্র ছেলে।
যুদ্ধে যাওয়া দাদার জন্যে এবার থেকে ভাইফোঁটায় 
বোনকে আর দেওয়ালে ফোঁটা দিতে হবে না!
এবার যুদ্ধফেরা সৈনিকের নিরহঙ্কারী স্ত্রীকে উপহার দাও 
একটা গোটা রাতের একটানা অগ্নিকাণ্ড!

তা না হলে নতুন পৃথিবী তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
ভিন গ্রহের প্রাণীরাও তোমার দিকে আঙুল তুলে বলবে,
“সিয়াচেনের মেঘ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী তুমি একটা মিথ্যুক! 
তুমি এক হিংস্র রূপকথার ভুল পররাষ্ট্রনীতি।”


২.
নতুন পাঠ্যক্রম

বাঘের মেয়েকে আমি হিংসা পড়ানোর দায়িত্ব পেয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন এই পাঠ্যক্রমে 
তাকে ভরতি করতে চায় তার বাবা-মা।

হাতে-পায়ে তার এত বাঘনখ
দাঁতে তার টুঁটি কামড়ে ধরার আহ্লাদ
চোখে জঙ্গলের ব্যাকরণ।
আমি তাকে নতুন কী হাংসা পড়াব?

তবু তাকে হিসা-কবিতা, হিংসা-অঙ্ক,
হিংসা-কুইজ ও হিংসা-ব্যাকরণ পড়াই।
দেখি, এ সম্পর্কে তার জ্ঞান বড় কম!
বাঘের মেয়ে, এখনও ঠিকমতো হিংসা বানান লিখতে শেখেনি।

আমি তার বাবা-মাকে ডেকে বলি,
‘আপনার মেয়ে এই হুঙ্কার শিখছে তো
এই ভুলে যাচ্ছে থাবার কৌশল,
এই দাঁতের তীক্ষ্ণতা রপ্ত করছে তো
এই ভুলে যাচ্ছে হুঙ্কার।
ওকে এক বছর হিংসাপুরের হস্টেলে রেখে আসুন।’

আজ এক বছর পরে দেখি,
দূর মাঠ ভেঙে বাঘ আসছে মেয়েকে নিয়ে
মানুষের কাছে হিংসা পড়াতে।   






সাহিত্য সাধনার মধ্যে রোমান্টিকতা এসেছে বারে বারে বিশ শতকের 70 দশকের কবি ও ছড়াকার বেশ কিছু রচনা সমাজ সচেতনতার কে লক্ষ রেখে করেছেন তাই মানুষ স্বদেশ তাঁর রচনায় বারে বারে দায়বদ্ধ থেকেছে আনন্দমেলা পত্রিকা সম্পাদনায় কিশোর বিভাগ পর্বে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন তারাগুলি আপনি উচ্চারিত হয় মধুময় আহ্লাদ এনে দেয় ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে গুনগুন মন গেয়ে ওঠে শিশুদের অন্তর বেদনা বিশেষ করে তার চিত্র নাটকীয়তা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী চিত্রকল্পের অভিনবত্ব খুবই প্রশংসনীয়। 

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Tuesday, 29 June 2021

শুভ জন্মদিন। বুদ্ধদেব গুহ। ২৯.০৬.২০২১. VOL- 418. The blogger in literature e-magazine

":দিনে রাতে চাঁদে অন্ধকারে আমার এই সুন্দর দেশ ভারতবর্ষের সুন্দরতর গরিব বঞ্চিত মানুষদের অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি। তাদের সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা হতাশা ব্যর্থতাকে মনের আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়েছি আর অসহায় নিষ্ফল ক্রোধে ক্ষোভে চোখ ভিজে উঠেছে । তাদের উদ্ধার করতে পারিনি উন্নত করতে পারিনি কিন্তু আবিষ্কার যে করেছি সমব্যথী যে হয়েছি এটুকুই আমার মস্ত লাভ ।"





তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সুপরিচিত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশুনা করেন।

তিনি পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল চাটার্ড অ্যাকাউন্টার হয়ে। তিনি ছিলেন একজন নামী চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। দিল্লির কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গের আয়কর বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত করেছিল। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অডিশন বোর্ডের সদস্য হয়েছিলেন তিনি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। একদা বামফ্রন্ট আমলে তাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগের বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ড পশ্চিমবঙ্গ বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ড এবং নন্দন উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য করা হয়েছিল। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে পরিচালন সমিতির সদস্যও নিযুক্ত হয়েছিলেন। বুদ্ধদেব গুহ খুব সুন্দর ছবিও আঁকেন। নিজের লেখা একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি নিজেই এঁকেছেন। গায়ক হিসেবেও তিনি বহুজনের প্রিয়।



'জঙ্গলমহল' তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। তারপর বহু উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লেখক হিসেবে খুবই অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তার বিতর্কিত উপন্যাস 'মাধুকরী' দীর্ঘদিন ধরে বেস্টসেলার। ছোটদের জন্য তার প্রথম বই- 'ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে'। ঋজুদা তাঁর সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় অভিযাত্রিক গোয়েন্দা চরিত্র। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৭ সালে। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ঋতু গুহ তার স্ত্রী। সুকণ্ঠ বুদ্ধদেব গুহ নিজেও একদা রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। পুরাতনী টপ্পা গানে তিনি অতি পারঙ্গম। টিভি এবং চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে তার একাধিক গল্প উপন্যাস।

উপন্যাস

  • কোজাগর
  • আয়নার সামনে
  • অভিল্বাহিক
  • অববাহিকা
  • অবরোহী
  • অদ্ভুত লোক
  • আলোকঝারি
  • অনবেষ
  • বাবলি
  • বাজে চন্দনপুরের কড়চা
  • বাংরিপোসির দু রাত্রির
  • বাসনাকুসুম
  • বাতি ঘর
  • চবুতরা 
  • চান ঘরে গান
  • চারকন্যা
  • চারুমতি
  • ছৌ
  • কুমুদিনী
  • পাখসাট
  • পরিযায়ী
  • বাসানাকুসুম
  • একটু উষ্ণতার জন্য
  • গুঞ্জা ফুলের মালা
  • হলুদ বসন্ত
  • জগমগি
  • যাওয়া-আসা
  • ঝাঁকিদর্শন
  • পলাশতলির পড়শি
  • জঙ্গল মহল
  • বনোবাসার
  • লবঙ্গীর জঙ্গলে
  • খেলা ঘর
  • কোয়েলের কাছে
  • মান্ডুর রুপমতী
  • মহরা
  • নগ্ন নির্জন
  • ওয়াইকিকি
  • কাঁকড়িকিরা
  • পামরি
  • জলছবি
  • পারিধি
  • রাগমালা
  • কুর্চিবনে গান
  • রিয়া
  • সুখের কাছে
  • এক ঘরের দুই রাত


বুদ্ধদেব গুহ 'হলুদ বসন্ত' উপন্যাসের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৭ সালে।

ছোটগল্প:

টাটা, প্রবেশ, মুন্নির বন্ধুদের জন্য ,প্রন্টি, সাগর রাজা, শারদপ্রাতে, দ্বীপান্তর,বীজতালিকা, 

টিটিচিকোরি, শেষ বিকেলের পেসেঞ্জার,  শিকার, মুখাবয়ব, চরিত খেকো এন্ড কোঙ, গোসাঘর প্রাইভেট লিমিটেড, বোদাদা প্রভৃতি।



সমাজ সময় সচেতন শিল্পী বুদ্ধদেব গুহ তার কথাসাহিত্যে প্রতিবাদী চেতনার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তিনি জানতেন মানুষের জীবনে নিত্য কত ঘটনা ঘটতে থাকে এবং তাও আবার কালের করাল গ্রাসে তলিয়ে যায়, থেকে যায় অনুভূতির আনন্দ-বেদনা যা চিরন্তন। তিনি এই আনন্দ-বেদনার শিল্পী যিনি সময়ে সমাজের সাক্ষী হয়ে শাশ্বত অনুভূতিকে পাঠকের দরবারে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন। এখানেই বাংলা সাহিত্যে কৃতিত্বের অধিকারী সার্থক শিল্পী তিনি।

ইংল্যান্ড, ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ, কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ড ও পূর্বআফ্রিকা তার দেখা। পূর্বভারতের বন-জঙ্গল, পশুপাখি ও বনের মানুষের সঙ্গেও তার সুদীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরংগ পরিচয়। সাহিত্য-রচনায় মস্তিষ্কের তুলনায় হৃদয়ের ভূমিকা বড়- এই মতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন আজীবন। 

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Monday, 28 June 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। গোকুল চন্দ্র নাগ। ২৮.০৬.২০২১. VOl -417 The blogger in literature e-magazine.


গোকুলচন্দ্র নাগ


জন্ম কলকাতায় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে জুন। পিতা মতিলাল নাগ মাতা কমলা দেবী। আদি পৈত্রিক নিবাস ছিল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. কালিদাস নাগ তাঁর অগ্রজ। শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন হয়ে মানুষ হন মাতুলালয়ে গোঁড়া ব্রাহ্ম পরিবারের আবহাওয়ায়। অতি অল্প বয়সে চিত্রাঙ্কন ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। কৃতি ফটোগ্রাফার ছিলেন তিনি।


, গোকুল তখন স্কুলের ছাত্র। নাগদের পৈতৃক নিবাস ছিল অক্রুর দত্ত লেনে। মতিলালের ছিল তিন পুত্র ও দুই কন্যা - বিভাবতী (মিত্র), কালিদাস, গোকুলচন্দ্র, প্রভাবতী (মিত্র) ও রামচন্দ্র।  পিতৃমাতৃহীন গোকুলচন্দ্র মামা বিজয় বসুর কাছে মানুষ হতে থাকেন।গোকুলচন্দ্রের পড়াশোনা বেশীদূর এগোয় নি। ছোটবেলা থেকেই তার স্বাস্থ্য ভাল ছিল না। সাউথ সুবার্বন স্কুলে পড়েছেন, কিন্তু পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ায় প্রধান শিক্ষকের বকুনি খেয়ে পড়া ছেড়ে দেন। ঘাটশিলায় কিছুদিন পড়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু হয় নি। ছবি আঁকার দিকে গোকুলচন্দ্রের ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই, তারই রেশ ধরে তিনি সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তখন ছবি আঁকার পেশাকে খুব ভাল চোখে দেখা হত না, মামা বিজয় বসুও খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না। আর্ট স্কুলেই গোকুলচন্দ্রের সঙ্গে শিল্পী অতুল বসু, যামিনী রায় ও ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। পার্সি ব্রাউন ও যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে তিনি ছবি আঁকা শিখেছিলেন। আর্ট স্কুলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ছবি এঁকে কিছু কিছু রোজগার করতে থাকেন, তবে তা সামান্যই।


১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রত্নতত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে ভারতীয প্রত্নতত্ব বিভাগের ওয়েস্টার্ন সার্কেলে কাজে যোগ দেন গোকুলচন্দ্র, কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য কাজ ছেড়ে দিতে হয়। গোকুলচন্দ্রের মামা বিজয় বসুর ভাই সুরেন বসুর নিউ মার্কেটে একটি ফুলের দোকান ছিল; সেখানে সকালে বসতেন সুরেন বাবু আর বিকালে ভার নিতেন গোকুলচন্দ্র। কেনা বেচার সময় যখন ফুল টানাটানি হত গোকুলচন্দ্র তখন বুকে ব্যাথা অনুভব করতেন। অচিন্ত্যকুমার লিখেছেন -"যে দোকান নিয়ে বসেছে সে ব্যবসা করতে বসে নি এমন কথা কে বিশ্বাস করতে পারত? কিন্তু সেদিন একান্তে তার কাছে এসে অনুভব করলাম, চার পাশের এই রাশিকৃত ফুলের মাঝখানে তার হৃদয়ও একটি ফুল। আর সে ফুলটি সে অকাতরে বিনামূল্যে যে কারুর হাতে দিয়ে দিতে প্রস্তুত।" এ থেকেই গোকুলচন্দ্রের মনের কিছুটা পরিচয় মেলে। ফুলের দোকানে কাজের মাঝেই চলতে থাকে ছবি আঁকার কাজ। তেল রঙের পোর্ট্রেট ছিল তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। সুদূর বম্বে ও পুণা থেকে অর্ডার পেতেন গোকুলচন্দ্র।


সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকলেও গোকুলচন্দ্র তখনও তাতে মন দিতে পারেন নি। ফুলের দোকানে ফুল কিনতে আসা দীনেশরঞ্জনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। গোকুলচন্দ্র, দীনেশরঞ্জন দাশ, মণীন্দ্রলাল বসু ও সুনীতি দেবীকে নিয়ে তৈরী হয় 'ফোর আর্টস ক্লাব'। গোকুলচন্দ্রের মামাবাড়ি ছিল আলিপুর চিরিখানায়; তারাই প্রাঙ্গণে বসেছিল ক্লাবের প্রথম সমাবেশ। প্রত্যেকের একটি করে মোট চারটি গল্প নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছিল 'ঝড়ের দোলা'। এর মধ্যে গোকুলচন্দ্রের লিখিত গল্পের নাম ছিল 'মাধুরী'। চিত্র, সাহিত্য, সঙ্গীত ও অভিনয়-এই চারটি ক্ষেত্রেই গোকুলচন্দ্রের প্রবেশ ঘটেছে। তিনি বেহালা খুব খারাপ বাজাতেন না। দীনেশরঞ্জন দাশ বন্ধু গোকুলচন্দ্র সম্বন্ধে লিখেছেন -"কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর না হইলেও তাহার গানে এমন একট গম্ভীর সুর ধ্বণিয়া উঠিত যে, তাহাতে শ্রোতার মনকে একান্ত আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিত। গোকুল যখন বেহালা বাজাইত তখন ও অত্যন্ত মনযোগের সহিত বাজাইত। বাজাইতে বাজাইতে গায়কের মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাইয়া থাকিত।"


গোকুলচন্দ্র কিছুদিন অভিনয়ের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। Photo Play Syndicate of India নামে একটি সিনেমা কোম্পানী গড়ে উঠেছিল; উদ্যোগক্তারা ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, প্রফুল্ল ঘোষ, কানাইলাল দাশ প্রমুখ ব্যক্তিরা। এই প্রতিষ্ঠানের একমাত্র নির্বাক চিত্র 'সোল অফ এ স্লেভ' বা 'বাঁদীর প্রাণ' খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের তক্ষশীলার প্রণয় কাহিনীকে উপজীব্য করে তৈরী হয়েছিল। নায়ক 'ধর্মপালে'র ভূমিকায় ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী আর সহচর 'বাহুসেন' হয়েছিলেন গোকুলচন্দ্র। চলচ্চিত্রে তিনি সম্ভবতঃ আর অভিনয় করেন নি, তবে মাঝে মাঝে নাট্যাভিনয়ে অংশ গ্রহণ করেছেন।

চিত্র, সঙ্গীত বা অভিনয়ের জন্য নয় গোকুলচন্দ্র স্মরণীয় থাকবেন তার প্রকাশিত 'কল্লোল' পত্রিকার জন্য। চিরাচরিত গণ্ডী ও অনুশাসন উপেক্ষা করে বাংলা সাহিত্যে 'আধুনিকতা'র প্রবেশ ঘটে 'কল্লোলে'র হাত ধরেই। এ জন্য পত্রিকাটিকে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয় নি। ১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিত হয় পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা। তার নাম সহ-সম্পাদক হিসাবে থাকলেও সজনীকান্তের মতে গোকুলচন্দ্রই ছিলেন 'আসল কর্ণধার'। লেখা যোগাড় করা, প্রুফ দেখা, প্রচ্ছদ পরিকল্পনা, চিঠিপত্র লেখা ইত্যাদি কাজে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত গোকুলচন্দ্রকে। তার স্বাস্থ্য কোনদিনই ভাল ছিল না। ১৯২৫-এর শুরু থেকেই অবিরাম জ্বরে ভুগতে থাকেন। যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। রোগমুক্তির আশায় তাকে দার্জিলিং-এ নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকে যাত্রা করেন।


গোকুলচন্দ্র বেঁচেছিলেন মাত্র ৩১ বছর। তার মধ্যে কঠিন জীবন সংগ্রামে, জীবিকা অর্জনের চেষ্টায় তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। সাহিত্যানুরাগী হলেও খুব বেশী লেখা তিনি লিখে যেতে পারেন নি। 'প্রবাসী' পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে; যেমন - 'শিশির' (আষাঢ়, ১৩২৬) ; 'বাতায়ন' (মাঘ, ১৩২৬) ; 'দুই সন্ধ্যা' (চৈত্র, ১৩২৬)। 'ভারতবর্ষ', 'ভারতী', 'নব্যভারত' পত্রিকাতেও তিনি লিখেছেন। তার রচিত গ্রন্থ -


(১) 'ঝড়ের দোলা' (১৯২২)। 'ফোর আর্টস ক্লাবে'র চারজনের চারটি গল্প নিযে বইটি রচিত হয়। গোকুলচন্দ্র লিখেছিলেন 'মাধুরী' গল্পটি।

(২) 'রাজকন্যা' (১৯২২)। টেনিসনের লেখা 'দি প্রিন্সেস' অবলম্বনে ছোটদের জন্য রচিত বই।

(৩) 'রূপরেখা' (১৯২২)। 'মালিনী', 'শিশির', 'বাতায়ন', 'জলছবি', 'মা', 'আলো', 'ছায়া', 'দুই সন্ধ্যা', 'পুজারিণী', 'অনন্ত' ও 'আশা' - এই দশটি রচনা গ্রন্থবদ্ধ হয়ে 'রূপরেখা' প্রকাশিত হয়। এই লেখাগুলি 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ', 'নব্যভারত' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

(৪) 'সোনার ফুল' (১৯২২)। এটি 'বঙ্গবাণী' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, শেষের কযেক অধ্যায় বাদ দিযে। কারণ হিসাবে লেখক নিজেই বলেছেন -"কারণ তাতে যা লেখা আছে তা মাসিক পত্রে ছাপবার উপযুক্ত নয়, এবং অনেকে বলেছেন যে ও ভাবে লেখা অন্যায়, ওতে "নীতির কোন আভাস নেই", এবং "কুরুচির" প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ওতে সমাজের বিশেষ ক্ষতি হতে পারে।" ... ইত্যাদি। এ থেকেই কিছুটা আঁচ করা যায় 'কল্লোল' তখন কেন এত কলরোল তুলেছিল।

(৫) 'পরীস্থান' (১৯২৪)। মেটারলিঙ্কের 'ব্লু বার্ড' নামক নাটকের কিছু নির্বাচিত অংশ নিয়ে ছোটদের জন্য রচিত হয়েছে এই গন্থটি।

(৬) 'পথিক' (১৯২৫)। এই উপন্যাসটি 'কল্লোল' পত্রিকায় ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা (১৩০০ বঙ্গাব্দ, বৈশাখ) ২য় বর্ষ ৭ম সংখ্যা পর্যন্ত (১৩৩১-এর জ্যৈষ্ঠ ও আশ্বিন বাদে) ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে।

(৭) 'মায়ামুকুল' (১৯২৭)। তিন খণ্ডে মোট ১৯টি গল্প নিয়ে এই গ্রন্থটি রচিত। লেখকের মৃত্যুর সময় এটি প্রকাশের কাজ চলছিল। সম্পূর্ণ গ্রন্থটি গোকুলচন্দ্র দেখে যেতে পারেন নি।


অকালে বিদায় নেওয়া গোকুলচন্দ্রের সম্বন্ধে তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু 'কল্লোল'-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ লিখেছেন -"তাঁর চেহারায় অগ্রজ কালিদাসের মত জৌলুস ছিল না। তাঁর ছিল বেহালা-বাজিয়ের মত লম্বা চুল, চোখে সেকেলে চশমা, শরীর বেশ দুর্বল, স্বাস্থ্য বরাবর খারাপ। সব সময় মুখে থাকত সিগারেট, কথা বলতেন কম। দূর থেকে দেখলে কেমন যেন দাম্ভিক মনে হত। কিম্বা নিরাসক্ত উদাসীন। সেই উদাসীনতা কতকটা নিস্তেজ শরীর ও স্বপ্নাভিলাষের দান। কিন্তু কাছে গেলে পাওয়া যেত একটা উত্তপ্ত সান্নিধ্য, কণ্ঠস্বরে অন্তরঙ্গতা।"


যে স্বপ্ন গোকুলচন্দ্র দেখেছিলেন, তা হয় ত পূরণ হয় নি; তবে যতদিন 'কল্লোল' পত্রিকা সাহিত্যের জগতে সজীব থাকবে ততদিন গোকুলচন্দ্রের মৃত্যু নেই।


∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Sunday, 27 June 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত। ২৭.০৬.২০২১ Vol -416. The blogger in literature e-magazine


সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত

তিনি অধুনা বাংলাদেশের ঢাকার বানারিতে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে জুন জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হেমচন্দ্র সেনগুপ্ত ও মাতা মৃণালিনী সেনগুপ্ত। স্কুলের পড়াশোনা ফরিদপুরে পালং স্কুলে। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন তৃতীয় স্থান অধিকার করে। এরপর কলকাতা চলে আসেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে বি.এ পাশ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পি.এইচ.ডি.ডিগ্রি লাভ করেন।


অবশ্য ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দেই দিল্লির হিন্দু কলেজ অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর প্রেসিডেন্সি সহ একে একে অনেক কলেজে অধ্যাপনা করেন। কলেজ গুলি হল- চট্টগ্রাম কলেজ (১৯৩৩-৩৫), রাজশাহী কলেজ (১৯৪২ -৪৬) ও জব্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬০ -৬২) অধ্যাপনা করেছেন। তবে সব থেকে বেশি সময় ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে (১৯২৯-৩৩, ১৯৩৫-৪২ এবং ১৯৪৬-৬০)। পরে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রধান অধ্যাপক হন(১৯৬২-৬৮)।


বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে তিনি শেষের দিকে ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সমালোচনা করেছেন। এমনকি সমালোচনার জগতে তাঁর এক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করা হত। বিশেষকরে শেক্সপিয়ারের সাহিত্য-সমালোচনার বিভিন্ন দিক তিনি উন্মোচন করেছেন। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের সাহিত্যের উপর তাঁর পাঁচটি উচ্চ প্রশংসিত গ্রন্থ গুলি হল-

  • 'অ্যাসপেক্টস অফ শেক্সপিরিয়ান কমেডি' (১৯৫০)
  • 'দ্য ওরিলিগিগ অব টাইম: দ্য প্রবলেম অব ডিউরেশন ইন শেক্সপিয়ারস্ প্লেজ' (১৯৬১)
  • 'শেক্সপিয়ারস্ হিস্টোরিকাল প্লেজ' (১৯৬৪)
  • 'অ্যাসপেক্টস অফ শেক্সপিরিয়ান ট্র্যাজেডি' (১৯৭২)
  • 'শেক্সপিয়ার ম্যানুয়াল' (১৯৭৭)।

সারা পৃথিবীর শেক্সপিয়ার-বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তাঁর অন্যতম লেখা "অ্যাসপেক্টস অফ শেক্সপিরিয়ারস্ ট্র্যাজেডি" পুস্তকটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য। জর্জ বার্নার্ড শ'র সাহিত্যকর্মের উপর তাঁর রচিত গ্রন্থ হল " দা আর্ট অফ বার্নাড শ' " (১৯৩৬) মনীষী মহলে সমানভাবে প্রশংসিত।

বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র সম্বন্ধেও তাঁর বাংলা গ্রন্থগুলি বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেছে।

  • 'শরৎচন্দ্র: ম্যান অ্যান্ড আর্টিস্ট' (১৯৭৫), বাংলায় "শরৎচন্দ্র (১৯৫১)
  • 'দি গ্রেট সেন্টিনাল: এ স্টাডি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর' (১৯৪৮) ' বাংলায় 'রবীন্দ্রনাথ'(১৯৩৫)
  • 'বঙ্কিমচন্দ্র চ্যাটার্জি' (১৯৯৬), বাংলায় 'বঙ্কিমচন্দ্র'(১৯৩৮)

সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্তর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -

  • 'কিটস: ফ্রম থিয়োরি টু পোয়েট্রি'
  • 'বিবেকানন্দ অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম'
  • 'টুওয়ার্ডস এ থিয়োরি অফ ইমাজিনেশন' (১৯৫৯)
  • 'অ্যান ইনট্রোডাকশন টু অ্যারিস্টটলস্ পোয়েটিক্স'
  • 'ইন্ডিয়া রেস্টেড ফ্রিডম' (১৯৮২)

শুধু ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য বা পাশ্চাত্য দর্শন নয়, ভারতীয় দর্শন, মার্কসবাদ,প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের নন্দনতত্ত্ব সব বিষয়েই তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। অবসর জীবনেও তিনি বহু অমূল্য রচনা ও গ্রন্থ লিখেছেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে আচার্য আনন্দবর্ধনের "ধ্বন্যালোক" গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ ও ভূমিকা রচনা তাঁর মনীষার আর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতামূলক রচনা "তে হি নো দিবসা" প্রকাশিত হয়। এছাড়া কলকাতার খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত প্রায় চার সহস্রাধিক জীবনী-সংবলিত আকর গ্রন্থ "সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান" (প্রথম প্রকাশ মে,১৯৭৬) সম্পাদনা তাঁর অনন্যসাধারণ কীর্তি।


সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্তর পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যাসাগর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দেই ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিশিষ্ট সদস্য ও ইংল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শেক্সপিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের একজিকিউটিভ কমিটির সদস্য ছিলেন।


সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর কলকাতায় প্রয়াত হন।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Saturday, 26 June 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ২৬.০৬.২০২১. VOL -415. The blogger in literature e-magazine

"তিনি উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এর মধ্য বাংলা ও বাঙালি চেতনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। সমাজ ধর্ম মনন সমস্ত কিছুকে নিজের কক্ষপথে ট্রেনে এনেছিলেন তার জন্য তিনি প্রবন্ধ কে বেছে নিয়েছিলেন নানা প্রবন্ধের সাহায্যে তিনি বাঙালিকে প্রবুদ্ধ করতে চেয়ে ছিলেন তাই তাকে বাংলাদেশের তদানীন্তন বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রধান নিয়ামক শক্তি বলে অভিহিত করা হয়। "

(ভ. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)



তাঁর জন্ম হয় বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে। তারিখ ২৬ জুন, ১৮৩৮ অর্থাৎ ১৩ আষাঢ় ১২৪৫। চট্টোপাধ্যায়দের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রামজীবন চট্টোপাধ্যায় কাঁঠালপাড়ার রঘুদেব ঘোষালের কন্যাকে বিবাহ করেন৷ রামজীবনের পুত্র তথা বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের সম্পত্তি পেয়ে কাঁঠালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন।রামহরির পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র,মাতা দুর্গাসুন্দরী দেবী,বঙ্কিমের পূর্বে তার আরও দুই পুত্রের জন্ম হয় – শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের জন্মকালে তিনি সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন।


জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। শিশু বয়সেই তার অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমের কণিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” যদিও গ্রামের পাঠশালায় বঙ্কিম কোনওদিনই যান নি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তার গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে মনে হয় তিনি রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে বিশেষ উপকৃত হন নি.  তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।” 

১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে আনীত হলে, সেখানেই তার প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তার স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিড সাহেব বঙ্কিমকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হলে যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন।[৭][১১] ১৮৪৭ সালে টিড ঢাকায় বদলি হয়ে গেলে সিনক্লেয়ার তার স্থলাভিষিক্ত হন; তার কাছেও বঙ্কিম প্রায় দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন। এইসময় কাঁঠালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। এছাড়াও পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে এই সময় তিনি মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাকে শিক্ষা দেন - “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তার পরবর্তী জীবনে রচিত নানা রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল।

কিছুকাল পরে ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে (অধুনা হুগলী মহসিন কলেজ) ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তার বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজ ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মতো বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু।

তার বাবার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্‌টার পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তবে সরকারি কর্মকর্তা নয় বরং লেখক এবং বাঙলা তথা ভারতের নবজাগরণের অন‍্যতম মুখ হিসেবেই তিনি অধিক প্রখ্যাত।


বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বিয়ে হয় ১৮৪৯ সালে। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১১ বছর। নারায়নপুর গ্রামের এক পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকার সাথে তার বিয়ে হয়। কিন্তু চাকুরি জীবনের শুরুতে যশোর অবস্থান কালে ১৮৫৯ সালে এ পত্নীর মৃত্যু হয়। অতঃপর ১৮৬০ সালের জুন মাসে হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়।


তার কর্মজীবনের সংক্ষেপিত তালিকা:

  1. যশোর - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের তারিখ: ১৮৫৮, ৭ আগস্ট
  2. নেগুয়া (মেদিনীপুর) - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের সাল: ১৮৬০, ৯ ফেব্রুয়ারি
  3. খুলনা - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের সাল: ১৮৬০, ৯ নভেম্বর
  4. বারুইপুর (২৪ পরগনা) - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - যোগদানের সাল: ১৮৬৪, ৫ মার্চ
  5. মুর্শিদাবাদ - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - উচ্চতর কার্যভার গ্রহণের তারিখ: ১৮৬৯, ১৫ ডিসেম্বর।
  6. মুর্শিদাবাদ - কালেক্টর - পদোন্নতির তারিখ: ১৮৭১, ১০ জুন।
  7. কলিকাতা - বেঙ্গল গভর্নমেন্টের অ্যাসিটেন্ট সেক্রেটারি - যোগদানের তারিখ: ১৮৮১, ৪ সেপ্টেম্বর।
  8. আলিপুর - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮২, ২৬ জানুয়ারি।
  9. জাজপুর (কটক) - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮৩, ৮ আগস্ট।
  10. হাওড়া - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮৩, ১৪ ফেব্রুয়ারি।
  11. ঝিনাইদহ - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর - ১৮৮৫, ১ জুলাই।[১৩]
  12. অবসরগ্রহণের তারিখ: ১৮৯১, ১৪ সেপ্টেম্বর।

শেষ জীবনে তার স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তার বহুমূত্র রোগ বেশ বেড়ে যায়। এই রোগেই অবশেষে তার মৃত্যু হয়, এপ্রিল ৮, ১৮৯৪ (বাংলা ২৬ চৈত্র ১৩০০ সাল)।


বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দুর্গেশনন্দিনী ছিলো প্রথম সার্থক বাংলা উপন্যাস যেটা বাংলা সাহিত্যের দ্বার উন্মোচন করেছিলো। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মোট ১৫টি উপন্যাস লিখেছিলেন এবং এর মধ্যে একটি ইংরেজি ভাষার উপন্যাস ছিলো। বঙ্কিমই বাংলা ভাষাকে প্রথম সত্যিকারের মর্যাদা দিয়েছিলেন।[১] তার রচনা 'বঙ্কিমী শৈলী' বা 'বঙ্কিমী রীতি' নামে পরিচিত।

গ্রন্থ তালিকা

উপন্যাস

(ইন্দিরা,যুগলাঙ্গুরীয় ও রাধারানী ত্রয়ী সংগ্রহ)

(দেবী চৌধুরানী, আনন্দমঠ, সীতারাম ত্রয়ী উপন্যাস)

  • Rajmohan's Wife (ইংরেজি ভাষার উপন্যাস)
সম্পাদনা : নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শন। ১৮৮২.

"বঙ্গদর্শন এর সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব। বঙ্কিম প্রতিভা প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ভাবধারাকে সাঙ্গীকৃত  করেছিল বলেই বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর খ্যাতি যুগপৎ স্রস্টা ও সম্পাদক রূপে। "




প্রবন্ধ গ্রন্থ

বিবিধ

  • ললিতা (পুরাকালিক গল্প)
  • ধর্ম্মতত্ত্ব
  • সহজ রচনা শিক্ষা
  • শ্রীমদ্ভগবদগীতা
  • কবিতাপুস্তক

(কিছু কবিতা, এবং ললিতা ও মানস)

Friday, 25 June 2021

বিশেষ প্রতিবেদন। "ওগো বর্ষারানী ..... বাংলা কাব্য- কবিতায় রয়েছে জানি."। ২৫.০৬.২০২১. Vol -414. The blogger in literature e-magazine

"নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে
তিল ঠাঁই আর নাহি রে
ওগো আজ তোরা
 যাসনে ঘরের বাহিরে। "
বা
"লেবু পাতার করমচা
 যা বৃষ্টি ধরে যা ।"

এক অপরূপ মায়াকানন । চারদিকে তার অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানি। এ দেশে রয়েছে ছয়টি ঋতু। যা ভিন্ন রূপের ঢালি নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। যার অপার সৌন্দর্য আমাদেরকে মুগ্ধ করে। তবে ছয়টি ঋতুর কথা বই পুস্তকে লিখা থাকলেও তিনটি ঋাতু আমাদের বেশি আকৃষ্ট করে। তা হলো - গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। এই তিনটি ঋতুতে প্রকৃতি সাজে নতুন সাজে। তবে রূপসী বাংলার কবি জীননানন্দ দাসের কবিতায় প্রধান্য পেয়েছে ’হেমন্ত’ ঋতুর কথা। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সাথে মানব জীবনেও নতুনত্বের ছোঁয়া লাগে। আর তা উঠে এসেছে এদেশের প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের কবিতা ও গানে। গানে এসেছে হালকা চালে, কিন্তু কবিতায় এসেছে বিভিন্ন রঙে-ঢঙে, বিভিন্ন ব্যাঞ্জনায়, বিভিন্ন রূপে।
বাংলা কাব্যভূবনে যে দুটি ঋতুর আনাগোনা আর শোরগোল বেশি পাওয়া যায় তা হল, বসন্ত ও বর্ষা। বলা হয়ে থাকে ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত। বসন্তে গাছের ডালে কোকিল ডাকে, ফুল ফোটে, প্রকৃতি সাজে নতুন নানা প্রসাধনে। তার যেন একটাই ইচ্ছা নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা, প্রাণীকুলের মনে প্রেম জাগানো। বসন্তের কার্যপ্রণালী বিশেষত একমুখীন। অপরদিকে বর্ষার আবেদন চতুর্মুখীন। বর্ষার অপরূপ দৃশ্য যেমন আমাদের মনে কুহক জাগায় এর ঠিক উল্টোদিকে বিষাদও এনে দেয়। বর্ষা যেমন নতুন শিহরণে জাগরিত করে, আবার ডুবাতেও পারে তার উদারতায়। বর্ষার এই চতুর্মুখীনতার কারণেই বোধহয় অন্যান্য ঋতুর ছেয়ে এর গ্রহণযোগ্যতা আর গুরুত্ব বেশি। যার মায়াবী রূপ আমাদেরকে মোহিত করে, আন্দোলিত  করে শিহরিত করে। যার দর্শণে আমাদের হৃদয়-মন পুলকিত হয়। বিশেষকরে বর্ষার উথালি-পাথালি ঢেউ আমাদের হৃদয়-মনকে সিক্ত করে। কখনো আমরা হারিয়ে যাই স্বপ্নলোকে, আবার কখনো বা প্রিয়ার দর্শন লাভের জন্য আমরা উদগ্রিব হয়ে উঠি। আবার কখনো বা প্রিয়তমার বিচ্ছেদ ব্যাথায় বর্ষার বৃষ্টির মতো চোখের পানি ঝরতে থাকে আমাদের কপোল বেয়ে। তখন যেন মনের অজান্তেই আমাদের অবুঝ মন গেয়ে ওঠে-
                     এমন দিনে তারে বলা যায়
                     এমন ঘনঘোর বরিষায়-
                     এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
                     তপনহীন ঘন তমসায় ॥ -(রবীন্দ্রনাথ, বর্ষার দিনে)
বর্ষা নিয়ে কালিদাস রচনা করেছেন বিখ্যাত মহাকাব্য ’মেঘদূত’। মেঘকে সেখানে বন্ধু বলা হয়েছিল। অথচ একজন ফরাসি কবি যাকে আধুনিক কবিতার জনক বলে কেউ কেউ অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন-
                       বিরক্ত বর্ষার মাস অবিরল সমস্ত শহর
                       অফুরন্ত পাত্র থেকে ঢালে তার ঠান্ডা অন্ধকার।
                                                 -(অনুবাদ, বুদ্ধদেব বসু)
জানি না কালিদাসের সমাধীতে নৈবদ্য আকারে বর্ষা সারাক্ষণ ঝরে কি না। তবে বর্ষার আজীবনের ঋণ তাঁর কাছে। আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং যদি না রামগিরি পর্বতের উপর দিয়ে উড়ে যেত, আর সে মেঘ দেখে যক্ষের মনে না জাগতো প্রিয়া বিরহের যাতনা, তবে কি মেঘ কিংবা এই বর্ষা হতো কাব্য দেবীর যোগ্য রসদ। আসলেই হতো না। কালিদাসের শুরুটা আর শেষ হল না, লিখে ফেললেন পুরো দুস্তর ’মেঘদূত’ নামক একটি মহাকাব্য।
বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন: ’বর্ষা ও বিরহ এই বিষয় দুটি ভারতীয় কাব্যে আজ পর্যন্ত প্রধান হয়ে আছে; তার একটি মুখ্য কারণ, সন্দেহ নেই, ’মেঘদূত’র আবহমান প্রতিপত্তি। উভয়ের উৎসমূল বাল্মীকি হতে পারেন, কিন্তু অন্য নানা প্রসঙ্গ থেকে কালিদাস এই দু’টিকে বিযুক্ত করে নিয়েছিলেন বলেই তারা উত্তর সাধকের পক্ষে বিশেষভাবে ব্যবহার্য হলো।’
পুরনো ভারতীয় সাহিত্যে কবিরা বর্ষাকালকে বিরহের কাল হিসেবেই বিবেচনা করতেন। কারণ, ভারতে বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে পথঘাট ও মাঠপ্রান্তর বর্ষার জলে ডুবে যেতো। চলাচলের জন্য সেরকম কোনো যানবাহন তখন ছিল না। প্রবাসী স্বমীরা বর্ষা নামার নামার আগেই বাড়ি ফিরতেন, বণিকেরাও তাই করতেন। কিন্তু কেউ যদি বর্ষার আগে বাড়ি ফিরতে না পারতো তাহলে তাকে পুরো সাত-আট মাসই কাটাতে হতো নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে। বর্ষাকে নিয়ে লিখা হয়েছে প্রচুর প্রেম ও বিরহের কবিতা। এ জন্যই বর্ষাকে বিরহের কাল বলা হয়।
বৈষ্ণব কবিদেরকেও বিরহের সঙ্গে বর্ষার একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে দেখা যায়। বর্ষাকে তিনি দিলেন স্থিতিস্থাপকতা। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায় বর্ষা এসেছে একাধিকবার। বিদ্যাপতির বিরহের কবিতায় বর্ষা ও বিরহ একাকার হয়ে গেছে, যা নতুনত্ব পায় মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতায়। সেখানে বর্ষা এসেছে রাধিকার প্রেমকে উসকে দেবার জন্য। বিশেষ করে অভিসার আর বিরহ পর্বে এ বর্ষা যেন প্রেমানলে ঘৃতের ছিটা। বৃষ্টির বর্ষনের সঙ্গে সঙ্গে রাধার কন্ঠে বেজে উঠেছে-
                       এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
                       কেমনে আইলো বাটে।
                      আঙ্গিনার মাঝে বঁধূয়া ভিজিছে
                      দেখিয়া পরান ফাটে। (চন্ডীদাস)
অন্যখানে রাধা বলেছে-
                     এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
                     এ ভরা বাদর মাহ বাদর
                     শূন্য মন্দির মোর। -(বিদ্যাপতি)
এখানে বৃষ্টির জল যেন রাধার চোখের পানি হয়ে ঝরে পড়ছে। যা পৃথিবীর সকল প্রেমিকাকেই ব্যাকুল করে তোলে।
অথবা-
                   তিমির দিগভরি ঘোর যামিণী
                       অথির বিজুরিক পাতিয়া
                    মত্ত দাদুরী, ডাকিছে ডাহুকী
                       ফাটি যাওত ছাতিয়া।
                    বিদ্যাপতি কহে কৈসে গোঙাইবি
                       হরি বিনে দিন রাতিয়া।  -(বিদ্যাপতি)
উপরের কবিতায় রাধার মনের প্রেম, কামনা-বাসনা আরো উসকে দিয়েছে বর্ষা। এখানেই বর্ষার স্বর্থকতা। বাংলা সাহিত্যে একমাত্র বর্ষারই বিচিত্র ও স্বার্থক ব্যবহার হয়েছে বাংলা কবিতায়। বর্ষা কখনো নিটোল প্রেমের অনুঘটক, কখনোবা কামনা-বাসনা জাগানিয়। আবার কখনো প্রকৃতির রূপ বর্ণনায়, কখনো শৈশব বা কৈশোরের সোনালি স্মৃতির দর্পণ। আবার বর্ষা কখনো বা স্বয়ং নারী। কোথাও বা প্রেমকে অঙ্কুরিত করে এই বর্ষাই। ফুলে ফলে সুশোভিত, কুহুকহু পাখির ডাক আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অকুল পাথারে।
রবীন্দ্রনাথকে বলা হয় বর্ষার কবি আর জীবনানন্দকে হেমন্তের। তঁরা দু’জন এই দুই ঋতুকে তাদের মনের মাধুরী মেশানো কাব্যভাষা দিয়ে ঋদ্ধ করেছেন। বর্ষার আবেদন যে এত বেশি সুধাময় হয় তা রবীন্দ্রনাথই প্রথম আমাদের সামনে খোলাসা করেছেন। কালিদাসের মেঘদূত আর রবীন্দ্রনাথের বর্ষাপ্রীতি আমাদের কবি সাহিত্যিকদেরকে বড়ই ভাবুক ও প্রেমিক করে তুলেছে। রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান এর প্রকৃতি অংশে বর্ষা ও শরৎ ঋতুর উপর যথাক্রমে ১২০+২২= ১৪২টি গান-কবিতা দেখতে পাওয়া যায়। এরপর বসন্ত-৮৯টি, হেমন্ত-৪টি, শীত-১০টি ও গ্রীষ্মের উপর-১৬টি গান দেখতে পাওয়া যায়।
ড. আফসার আহমদ বলেছেন-’বাংলাদেশের আকাশকে আমার কাছে বর্ষার বাবার বাড়ি মনে হয়। এই মনে হওয়াটাও রবীন্দ্রনাথের গানের প্রভাব।’ তিনি যখন যখন গেয়ে উঠেন-
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে, হৃদয় নাচে রে।
              শত বরনের ভাব-উচ্ছ্বাস
              কলাপের মতো করেছ বিকাশ
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে ॥
তখন সত্যিই আমাদের মন ও নেচে উঠে। ’বর্ষার দিনে’ কবিতার শেষে তিনি বলেছেন-
                       ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,
                       বিজুলি থেকে বিজুলি চমকায়।
                       সে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
                       সে কথা আজি যেন বলা যায়
                       এমন ঘনঘোর বরিষায়॥
রবীন্দ্রনাথের ’মেঘদূত’ কবিতায় এসেছে বিদ্যুৎ চমকের কথাও-
                     আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর,
                     দুরন্ত পবন অতি-আক্রমণে তার
                     অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার।
                     বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘবার
                     খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া ॥
অথবা-
                    দেখিছ না, ওগো সাহসিকা,
                    ঝিকিমিকি বিদ্যুতের শিখা ?
                    মনে ভেবে দেখো তবে এ ঝড়ে কি বাঁধা রবে
                    করবীর শেফালিমালিকা ?। (ঝড়ের দিনে )
’কৃষ্ণকলি’ কবিতায় কালো মেঘ আর কালো মেয়ের রূপ একাকার হয়ে গেছে-
                   কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
                   কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
                   মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
                   কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
                   ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,
                   মুক্তবেণী পিঠের ’পরে লোটে।
                   কালো? তা সে যতই কালো হোক,
                   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ ॥
                   ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
                   ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
                   শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
                   কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
                   আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
                   শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
                   কালো? তা সে যতই কালো হোক,
                   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ ॥
আর নবীনদেরকে তিনি নব প্রেরণার জেগে উঠার আহ্বান জানিয়েছেন ’বর্ষশেষ’ কবিতায়-
          হে কুমার, হাস্যমুখে তোমার ধনুকে দাও টান
                     ঝনন রনন-
         বক্ষের পঞ্জর ভেদি অন্তরকে হউক কম্পিত
                    সুতীব্র স্বনন।
    হে কিশোর, তুলে লও তোমার উদার জয়ভেরি,
                   করহ আহ্বান-
    আমরা দাঁড়াব উঠি, আমরা ছুটিয়া বাহিরিব,
                  অর্পিব পরান ॥
বর্ষায় ব্যাঙ ডাকে, ডাহুক ডাকে, বিরহীর হৃদয় ফেটে যায়। শ্যাম বিনে যে আর দিন কাটে না। শ্যামকে নিয়ে বিরহার্তি বর্ষাকালে যেন শ্যামেরই শ্যামল শরীরের আভা। রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে অবাহন করেন এভাবে-
             এসো শ্যামল সুন্দর,
       আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা
         বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে ॥
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর কবিতায় বর্ষাকে এনেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসেবে। বর্ষার প্রকৃতি আর মানব প্রকৃতি এখানে একাকার। যার সাথে একাতœতা ঘোষণা করেছেন দেবতাগণও। ’বর্ষকাল’ কবিতায় তা ফুটে উঠেছে এভাবে-
              গভীর গর্জ্জন সদা করে জলধর,
              উথলিল নদ-নদী ধরণী উপর।
              রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,
              দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অনতœরে। -(বিবিধ কাব্য)
কবি আল মাহ্মুদ বর্ষাকে দেখেছেন একটু আলাদা করে। তাঁর বর্ষা ঋতুবর্তী নারী। যা প্রকৃতিকে করে যৌবনবর্তী। ফলবর্তী হতে লোভ জাগায়। যেমন-
              শুধু দিগন্তবি¯তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়,
              শেওয়াপিছল আমাদের গরীয়ান গ্রহটির যায়।
                 -(আরব্য রজনীর রাজহাঁস; আষাঢ়ের রাত্রে)
তবে সৈয়দ শামসুল হকের ভালোবাসার রাতে নামক গ্রন্থে বর্ষাকে আমরা প্রায় দেখি সম্পূর্ণ আলাদাভাবে। সেখানে বর্ষা, নারী, বীজ, কাম, কর্ষণ সব মিলেমিশে একাকার। এ যেন সৃজনের এক মহা প্রস্তুতি। কবি ওমর আলী তাঁর কবিতায় বর্ষার উল্টোপিঠে দেখেছেন। বর্ষা আমাদের শুধু পুলকিতই করে না, শঙ্কিতও করে। বর্ষার পরিণতি সুখের ইতিহাস রচনা করে না। বন্যার কালো থাবা ডুবায়, ভাসায় ভিটে ছাড়া করে ভাটির দেশের মানুষকে। ওমর অলী বর্ষার সে রূপটিই তুলে ধরেছেন তাঁর বন্যা নামক কবিতায়। যেমন-
                   ঘরের চালার পরে বসে আছে
                   মাজেদা সাজেদা কিন্তু আর কতক্ষণ
                   পানি তো ক্রমেই বাড়ছে চারদিকে সাঁতার।
                           -(গ্রামে ফিরে যাই; বন্যা)
বাংলা কবিতায় বর্ষার বন্দনা হয়েছে যুগে যুগে; সেই মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত। বর্ষা আর বৃষ্টি এখন কবিতার একটি অংশ। এমন কোনো কবি নেই বর্ষাকে কেন্দ্র করে দু’একটি পঙক্তি রচনা করেন নি। আসলে বর্ষার রূপটাই এমন যে, যা যে কোনো মানুষকেই সহজে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। সে শুধু এখন আর বর্ষামঙ্গলের স্তুতি আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সে এখন সর্বব্যাপী। সকল কবি- সাহিত্যিকদের মনে সে আসন পেতে আছে।
মহাদেব সাহা বর্ষাকে দেখেছেন অন্যভাবে। তিনি লিখেছেন-
              বর্ষা, তোমাকে না হয় আরো একটু টেনে বলি বরষা,
              পদাবলীর ঢংয়ে,
              বর্ষা শুনে নাকি কারো মন খারাপ হয়ে যায়,
              বিরহ জাগে;
              আমার কিন্তু বৃষ্টি খুব ভালো লাগে, বৃষ্টি
             আমার শৈশবের মতো
             মেয়েরা ভিজতে চায় বৃষ্টিতে,
             ভিজুক না,
             মেয়েরা জলে না নামলে পদ্মফুল ফুটবে কেন?
             এখানে এখন বুক-সমান  জল, এখানে এখন
             সাঁতার, বর্ষা,
             ক্ষতি কী, বর্ষাকে যদি আদর করে বরষা বলি।
             শহরে না হোক গ্রামে তো কোনো মেয়ের
             নাম হতে পারে বরষা,
             সেই ঝমঝম রেলগাড়ি, সেই বৃষ্টি
             আমার ঘুমের উপর দিয়ে মেঘ ভেসে যায়
             আমি কাঁচা ঘুমের মধ্যে থেকে ডাকতে থাকি,
             বরষা, ও বরষা।
পল্লী কবি জসীমউদ্দীন বর্ষাকে দেখেছেন বাংলার সুখ-সমৃদ্ধি আর আশার আলো হিসেবে। তিনি ’পল্লীবর্ষা’ কবিতায় লিখেছেন-
            বউদের আজ কোনো কাজ নাই
                বেড়ায় বাঁধিয়া রসি
           সমুদ্র কলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
           কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
          তারে ভাষা দেয় দীঘল সুতোয় মায়াবী নকশা টানি।
           বৈদেশী কোন বন্ধুর লাগি মন তাঁর কেঁদে ফেরে
           মিঠে সুরে গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেড়ে।
           আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে
           বেণু বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে?
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-’আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে।’ কবি শামসুর রাহমান বলেছেন চমৎকার কথা- ’বর্ষাকে আমি ভালবাসি আমার প্রিয়জনের মত করে।’- এই প্রিয়জন হয়ে সবার মন রাঙিয়ে দিতে, গলায় সুর তুলতে বর্ষা আবার ফিরে এসেছে আমাদের জীবনে। বর্ষাকালে আকাশে মেঘ জমাট বাধার সাথে সাথে আমাদের মনও ভারাক্রান্ত হয়ে যায়; সে শুধু প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। হারিয়ে যায় দূর অজানায়, কল্পলোকের রাজ্যে।
পরিশেষে একথা বলা যায়, ঐশ্বর্যের ঋতু, অকৃপণ ঋতু, সমৃদ্ধির ঋতু বর্ষা। সে,সকল প্রকার জরাজীর্ণ, পাপ-তাপ আর পুরাতনকে ধুয়ে মুছে পবিত্র করে তোলে। সে যতটা না কাঁদে, তার ছেয়ে বেশি হাসে। প্রকৃতিতে লাগে যৌবনের হাওয়া। পুকুর পাড়ে ফুটে সোনালি কদম। বলক-বালিকারা তোলে শাপলা-শালুক। প্রভাতের শিউলি ফুলে ঢেকে যায় সবুজ দুর্বাঘাস। বর্ষার সাথে বাঙালীর জীবনও একই সূত্রে গাঁথা। চারদিকে সবুজের মনোলোভা রূপ আমাদেরকে মোহিত না করে পারে না। তখন আমাদের কেবল গুনগুনিয়ে গাইতে ইচ্ছে করে -
"শাওন রাতে যদি
 আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরাণসখা বন্ধু হে আমার ॥"
 বর্ষার আবেদন যুগে যুগে অমলিন থাকবে আমাদের সাহিত্যের সাথে মনে-মননে ও হৃদয়ের মণিকোঠায়।।
  "শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে ......"
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆