"স্টেলা ক্রামরিশের মতে, ভারতের প্রথম আধুনিক চিত্রশিল্পী। পশ্চিমি দুনিয়ায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। তবু, ক’জন মনে রেখেছে তাঁকে? "
(জয়িতা বাগচি)
(অবনীন্দ্রনাথ )
দুই দাদাকে দক্ষিণের বারান্দায় বসে ছবিতে মগ্ন থাকতে দেখে বড় হওয়া বালিকাটি যে কখন নিজের হাতে তুলি তুলে নিয়েছিলেন তার খবর কেউ রাখেনি। কিন্তু একদিন তাঁর আঁকা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন গগনেন্দ্রনাথ।
তখনকার দিনে অবশ্য আঁকা ছড়িয়ে পড়ছিল ঘরে ঘরে। বিশেষ করে, ঠাকুর পরিবারের মেয়েরা রীতিমতো আঁকার চর্চা করতেন। কিন্তু সেগুলো ছিল অনুকরণ। সুনয়নী সর্বপ্রথম সেখান থেকে বেরলেন। যা দেখলেন, তার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন নিজস্ব দৃষ্টি। তাই তাঁর আঁকা প্রতিটা ছবিই হয়ে উঠল তাঁর মতো সহজ, স্নিগ্ধ, মায়াময়। সেখানে কোনো আতিশয্য নেই। আর এই ব্যাপারটাই নজর কাড়ল অবনীন্দ্রনাথেরও। ‘অর্ধনারীশ্বর’ আঁকার পর গগনেন্দ্রনাথ, দাদাকে গিয়ে বলেন সুনয়নীকে একটা সার্টিফিকেট লিখে দেওয়ার জন্য। উত্তরে অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন -" সুনয়নীকে তিনি কি সার্টিফিকেট দেবেন, সুনয়নী তাঁর আঁকার মধ্যে দিয়ে সে সার্টিফিকেট নিজেই আদায় করে নেবেন। সেকথা সত্য হয়েছিল।"
নিয়মিত ছবি আঁকার শুরু তাঁর ত্রিশ বছর বয়সে। সেকালের প্রথা অনুযায়ী বারো বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয় রাজা রামমোহন রায়ের দৌহিত্র রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ৫ নম্বর বাড়ীতেই থাকতেন রজনীমোহন-সুনয়নী। শুরু দেরিতে হলেও সুনয়নীর একনিষ্ঠতা ছিল আশ্চর্যের।
১৮৭৫ সালের ১৮ই জুন সুনয়নী দেবী ভারতের সম্ভ্রান্ত ঠাকুর পরিবারের গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সৌদামিনী দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র। সে দিক থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পিতৃব্য ছিলেন। বারো বছর বয়সে রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। চিত্রশিল্প বা শিল্পের যে কোন আঙ্গিকেই তাঁর কোন প্রথাগত শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও তিনি একজন নারী হিসেবে যে শিল্প ক্ষেত্রে তাঁর কাজ সুসম্পাদিত করেন সে তথ্য পার্থ মিত্রের বই 'দ্য ট্রায়াম্ফ অফ মর্ডানিজম্ : ইন্ডিয়া'জ্ আর্টিস্ট অ্যান্ড দ্য অ্যাভান্ট্ গ্রেড' (১৯২২-১৯৪৭) থেকে জানতে পারি।
'বেঙ্গল আর্ট স্কুল' এর একজন প্রকৃত প্রাচীন চিত্রশিল্পী হওয়ার অনুপ্রেরণায় তিনি লোক পট আঁকেন যা ঠাকুর বাড়ির মহিলাদের মধ্যে খুবই প্রচলিত ও গৃহস্থালিসংক্রান্ত বিষয় ছিল।
সকাল আটটা বাজলেই শুরু করতেন ছবি আঁকা। চলত দুপুর পর্যন্ত। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার তিনটে থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত আঁকতেন। এই নিষ্ঠার সঙ্গে ছিল নিজস্ব এক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দুয়ের মিলনে সুনয়নীর ছবি স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। সেকালের অভিজাত পরিবারের অনেক মেয়েই ছবি এঁকেছেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও ছবি
আঁকতেন অনেকে। কিন্তু স্বভাবত স্বতন্ত্র ছিলেন সুনয়নী। অবনীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘শিল্প হচ্ছে শখ। যার সেই শখ ভিতর থেকে এল সেই পারে শিল্প সৃষ্টি করতে'। সেই অর্থে সুনয়নী ছিলেন যথার্থ শিল্পী। অবনীন্দ্রনাথের মতো জাপানি ওয়াশ পদ্ধতিতে ছবি আঁকতেন সুনয়নী দেবী। স্বতোৎসারিত প্রাকৃতিক অনাবিল আনন্দময় ছিল তাঁর ছবির জগৎ।
সুনয়নী দেবীর ছবি নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য আলোচনা করেন শিল্প ইতিহাসবিদ স্টেলা ক্র্যামরিশ। তাঁর মতে, সুনয়নী ভারতের প্রথম আধুনিক মহিলা চিত্রশিল্পী। তাঁর আঁকা ছবির বিষয়বস্তু একান্ত দেশজ। যে ‘ভারত শিল্প’-কে খুঁজেছেন অবনীন্দ্রনাথ সেই শিল্পরূপ তার সমস্ত নিজস্বতা নিয়ে সুনয়নীর আঁকায় ফুটে উঠেছে।
তিনি প্রথম যিনি পটচিত্রের আঙ্গিকে ছবি এঁকেছেন। অর্ধনিমীলিত টানা দীঘল চোখ পটের ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য, সুনয়নীর ছবিতেও তা আছে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, কথকতা, রূপকথার স্বপ্নময় জগত তাঁর ছবিতে ধরা পড়েছে। শিব, কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, হরপার্বতী, রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি, অর্ধনারীশ্বর, সতীর দেহত্যাগ ইত্যাদির সঙ্গে আত্মপ্রতিকৃতিও এঁকেছেন সুনয়নী। তাঁর ছবির সারল্য, কোমল পেলবতা, স্নিগ্ধ রঙের খেলা সেকালের অনেক সমালোচকদের মুগ্ধ করেছিল।
১৯০৮ ও ১৯১১ সালে এদেশে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়। স্টেলা ক্র্যামরিশের উদ্যোগে ১৯২৫ সালে জার্মান আর্ট ম্যাগাজিন Der Cicerone-এ ছাপা হয়েছিল সুনয়নী দেবীর আঁকা ছবি। ১৯২৭ সালে লন্ডনের উইমেন্স ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ক্লাব আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে তাঁর আঁকা প্রদর্শিত হয়েছিল। তাঁর ছবিতে আধুনিকতা আর চিরকালীন ভারতসত্তা এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে যে তাঁকে এক আধুনিক সমালোচক ‘ন্যাশনালিস্ট আর্টিস্ট’ বলে অভিহিত করেছেন।
সুনয়নী শিল্পচর্চা করেছেন প্রাণের আনন্দে। কোনো নতুন ধারার সৃষ্টিতে তাঁর আগ্রহ ছিল না। ছবি নিয়ে কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষাও তিনি করেননি। কিন্তু তাঁর ছবিতেই প্রথম ভারতীয় লোককথা, পুরাণের নিজস্ব ঐতিহ্য এক ভারতীয় নারীর দৃষ্টিতে প্রকাশিত হল। সেখানেই তাঁর অভিনবত্ব। ছবি আঁকার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন সুনয়নী।
এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে তাঁর বেশীরভাগ ছবির বিষয়বস্তুই স্বপ্নে পাওয়া। সেই স্বপ্নময় জগত থেকে তিনি সরে গেলেন তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর। তাঁর প্রথম ছবি থেকে শেষ ছবির মধ্যে কোনও উত্তরণ নেই। তবু অল্পদিনের শিল্পচর্চায় ভারতীয় ছবির ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র ধারা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখে প্রয়াত হন সুনয়নী দেবী।
উনবিংশ শতকের রক্ষণশীল সমাজের নানা নিষেধ সত্ত্বেও বদল ঘটছিল সমাজের বুকে। আর এই পুরো ছবিতে প্রবলভাবে উঠে আসছিল একটি বিশেষ পরিবার। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ— উঠে আসতে থাকে একের পর এক ব্যক্তিত্ব।
দু’শো বছর আগের অজ্ঞাতপরিচয় বাঙালির আঁকা ছবি, জায়গা পাচ্ছে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে
তবে এ তো গেল একটি দিকের কথা। অন্যদিকে ছিলেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো করে বদল আনার কাজটি করে গেছেন। কেউ লেখায়, কেউ নারী অধিকারের লড়াইতে, কেউ গানে-আঁকায় শুনিয়েছেন বাঁধ ভাঙার গান। ঠিক এই পরিস্থিতিতে উঠে আসেন সুনয়নী দেবী। রবীন্দ্রনাথের আদরের ‘গুনো দাদা’, অর্থাৎ গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ছোট মেয়ে রং-তুলির মধ্যেই খুঁজে নিয়েছিলেন নিজের জগত। কোনো আড়ম্বর না, কোনো আতিশয্য না; প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই নিজের মতো করে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। বলা ভালো, তিনিই ছিলেন বাঙালি মহিলা চিত্রশিল্পীদের পথিকৃৎ।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment