পুণ্যলতা চক্রবর্তী


বাঘ ও বক'-এর গল্প- 

একদা এক বাঘের গলায় ফুটেছিল অস্থি ।

যন্ত্রণায় কিছুতেই নাহি তার স্বস্তি।

তিন দিন তিন রাত নাহি তার নিদ্রা।

সেঁক দেয় তেল মাখে, লাগায় হরিদ্রা-

এই রকম চলতে চলতে সুন্দরকাকা যেই বললেন-

ভিতরে ঢুকায়ে দিল দীর্ঘ তার চঞ্ু।

(কেউ আর তার মিল দিতে পারে না। আমরা সবাই পাস' দিয়ে দিলাম, দাদার পালা আসতেই সে

চট করে বলল -)

'বক সে চালাক অতি চিকিৎসক-চুঞ্।

  বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী ও যন্ত্রকুশলী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কন্যা শিশুসাহিত্যিক পুণ্যলতা চক্রবর্তী। তাঁর স্বামী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অরুণনাথ চক্রবর্তী। স্বামীর পদবীতে রায়চৌধুরী থেকে পুণ্যলতাচক্রবর্তী।

জন্ম: ১০ সেপ্টেম্বর ১৮৯০ . একজন বাঙালি শিশুসাহিত্যিক। পু্ণ্যলতা চক্রবর্তীর আদি নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহের মসুয়ায়। তার পিতা বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী ও যন্ত্রকুশলী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তার মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। তার বড় ভাই (বড়দা) ছিলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে ননসেন্সের প্রবর্তক সুকুমার রায়। তার আরও ছোট দুই ভাই ছিলেন সুবিনয় রায় এবং সুবিমল রায় । এছাড়াও তার আরও দুই বোন ছিল সুখলতা রাও এবং শান্তিলতা। বিএ পড়ার সময় ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তার বিবাহ হয়েছিল। তার স্বামী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অরুণনাথ চক্রবর্তী। তার দুই কন্যা এবং দুজনেই কৃতি। জ্যেষ্ঠা কল্যাণী কারলেকার বিশিষ্ট সমাজদেবী, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা ও লেখিকা। কনিষ্ঠা নলিনী দাশ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অধ্যাপিকা, অধ্যক্ষা ও শিশু সাহিত্যিক। বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন তার মাতামহ।

রচনা কর্ম :

  • ছোটবেলার দিনগুলি
  • ছোট ছোট গল্প
  • সাদিব ম্যাজিক
  • গাছপালার কথা
  • রাজবাড়ি (উপন্যাস)

                      নতুন বাড়িটা জ্যেঠামশাই ও পিসিমার বাড়ির কাছেই ছিল, সুতরাং খেলার সাথীর অভাব হলাে না।জ্যেঠতুতাে, খুড়তুতাে, পিসতুতাে ভাইবােনদের দল জুটে গেল। ছাতের এক কোণে ঘােলা জলের ট্যাঙ্ক থেকে গঙ্গামাটি তুলে জমা করা ছিল, তাই দিয়ে গােলা-গুলি বানিয়ে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হলাে। সে যুদ্ধের নাম দেওয়া হয়েছিল পটগুলটিশ ওয়ার নরম কাদার গুলিতে খেলা বেশ ভালােই চলছিল। হঠাৎ কী কুবুদ্ধি হলাে গুলিগুলোকে বেশ লাল করে পুড়িয়ে নিলাম। দুপুরবেলায় যখন চাকরবাকররা বিশ্রাম করতে যেত, তখন চুপিচুপি রান্নাঘরে ঢুকে মরা উননের মধ্যে গুলি গুজে দিয়ে আসতাম, ওরা উনুন ঝাড়বার সময় সেগুলি বেছে ধুয়ে আমাদের দিয়ে দিত। কিন্তু তাতে দু-পক্ষই এমনভাবে আহত' হতে আরম্ভ করল যে, আমাদের রান্নাঘরে যাওয়াই বারণ হয়ে গেল।

আরেকদিন জ্যেঠামশাই-র বাড়িতে পটগুলটিশ খেলা হচ্ছে, হঠাৎ একজনের হাতের গােলা-টা ছিটকে সিড়ির ছাতের তলার দিকে (সিলিং-এ) লেগে একেবারে খুঁটের মতাে চ্যাপটা হয়ে সেঁটে রইল। ভারি মজা, সবাই মিলে ঘুঁটে দেওয়ার পাল্লা শুরু করলাম। দেখতে দেখতে ছাতটা কাদার ঘুঁটেতে ভরতি হয়ে গেল। এমন সময় জ্যেঠামশাই-এর পায়ের শব্দ শুনে যে যেখানে পারল লুকিয়ে পড়ল। জ্যেঠামশাইকে ও বাড়ির ছেলেরা ভীযণ ভয় করত। তাঁর চেহারা আর গলার আওয়াজ ছিল গন্ভীর। শুনতাম তিনি মস্ত বড়াে খেলােয়াড়, গায়ে খুব জোর, আর রাগও খুব। আমরা কিন্তু কোনােদিন তাঁর রাগ দেখিনি। যখনই ও বাড়ি যেতাম, দেখতাম তিনি একমনে লেখাপড়া করছেন। যদি কখনও আমাদের দিকে চোখ পড়ত, মৃদু হেসে দুয়েকটা কথা বলতেন। যা হােক, ওদের দেখাদেখি, আমরাও লুকোলাম। জ্যেঠামশাই আনমনে কী ভাবতে ভাবতে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন, হঠাৎ থ্যাপ করে কী একটা তাঁর পায়ের কাছে পড়ল। চমকে উঠে তিনি গুরুগন্ভীর গলায় হাঁক দিলেন, এই কে আছিস, আলাে আন। 'চাকর ছুটে গিয়ে সিড়ির আলােটা উসকিয়ে সামনে ধরতেই দেখা গল একতাল থলথলে কালােমতন কী জিনিস। ধমক দিয়ে বললেন, এটা আবার কী, কোথেকে এল?' চাকর কাঁচুমাচু হয়ে বলল, আজ্ঞে, ছেলেরা কী যেন খেলা করছিল'তখন কী ভেবে হঠাৎ উপর দিকে তাকিয়ে ছাতের ছিরি দেখেই জ্যেঠামশাই হাে হাে করে হেসে উঠলেন, আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

আরেকদিন চোর-পুলিশ খেলছি। দাদা হয়েছে পুলিশ, আমি চোর। আমার হাতে সাপমুখাে বালা ছিল, তার একটা মুখ টেনে ফাঁক করে অন্য বালাটা তার ভিতর দিয়ে গলিয়ে দিব্যি হাতকড়ি বানিয়ে দাদা আমাকে ধরে নিয়ে চলল। আমি যেই এক ঝটকায় হাত ছাড়াতে গিয়েছি, অমনি নতুন বালা ভেঙে দু-তিন টুকরাে হয়ে ছাতে ছড়িয়ে পড়ল। টুকরোগুলো কুড়িয়ে মার কাছে নিয়ে গেলাম। মা হেসে বললেন, তােমাকে দেখছি এবার লােহার বালা গড়িয়ে দিতে হবে।

                 ক্রিকেট হকি প্রভৃতি খেলাতেও 'হাতেখড়ি ওই ছাতেই আরম্ভ হয়েছিল। আমি একটু "দস্যি' ছিলাম কিনা, দাদাদের সঙ্গে যত সব হড়ােহড়ি খেলায় খুব মজবুত ছিলাম। তেমনি আবার দিদিদের সঙ্গে পুতুল খেলাও চমৎকার লাগত। মা সুন্দর করে দোতলা পুতুল-ঘর সাজিয়ে দিয়েছিলেন...কত ডল-পুতুল, কাচের পুতুল, মাটির পুতুল, পুতুলের খাট-বিছানা, চেয়ার-টেবিল, টি-সেট, ডিনার-সেট, পিতল ও মাটির কত হাঁড়িকুড়ি হাতাবেড়ি কত ঘরকন্না রান্নাবান্না। দিদিরা সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পুতির গয়না তার করত, পূতুলের বিয়েতে ছােটো ছাটো পাতায় করে ছােটো ছােটো লুচি-মিষ্টি ইত্যাদি খাওয়া হতোে। একবার পুতুলের বিয়েতে আমরা ফুলপাতা নিশান দিয়ে বিয়েবাড়ি সাজিয়ে সারি সারি ছােট্ট ছােট রঙিন মােমবাতি জেলে দিলাম, সবাইকে ডেকে দেখালাম, কী সুন্দর দেখাচ্ছে।

                    তারপর খাবার ডাক পড়তে সবাই নীচে চলে গেলাম। খাওয়া সেরে এসে দেখি, পুতুলঘরে সে এক অগ্নিকাণ্ড! ছােট মােমবাতি কয়েক মিনিট জ্ুলেই শেষ হয়ে গিয়েছে, নিশানটিশান পুড়ে এবারে কাঠের ছাত জ্বলতে আরম্ভ করেছে। তাড়াতাড়ি জল ঢেলে আগুন নিভানাে হলাে, অকল্পের জন্য পুতুলগুলো বেঁচে গেল। আমাদের এক মজার খেলা ছিল 'রাগ বানানাে'হয়তাে কারাে উপর রাগ হয়েছে অথচ তার শােধ দিতে পারছি না, তখন দাদা বলত, 'আয় রাগ বানাই। বলেই সেই লােকটির সম্বন্ধে যা তা অদ্ভুত গল্প বানিয়ে বলতে আরম্ভ করত আমরাও সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বলতাম। তার মধ্যে বিদ্বেষ কিংবা হিংশ্র ভাব কিছু থাকত না, সে ব্যক্তির কোনাে অনিষ্ট চিন্তা থাকত না, শুধু মজার মজার কথা। যত রকম বােকামি হতে পারে, যত রকমে মানুষ নাকাল ও অপ্রস্তুত হয়ে হাস্যাস্পদ হতে পারে সবকিছু সেই লােকটির সম্বন্ধে কল্পনা করে আমরা হেসে কুটিপাটি হতাম। দাদার 'হ-য-ব-র-ল বইয়ের

হিজি-বিজ-বিজ' যেমন 'মনে করাে' বলে যত রকম সব উদ্ভট কল্পনা করে নিজে নিজেই হেসে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম করে, আমাদেরও প্রায় সেই দশাই হতাে। কিন্তু মজা হতাে এই যে, হাসির স্রোতে রাগটাগ সব কোথায় ভেসে যেত-মনটা আবার বেশ হালকা খুশিতে ভরে উঠত।

আর একটা মজার খেলা ছিল, কবিতায় গল্প বলা। একটা কোনাে জানা গল্প নিয়ে একজন প্রথম লাইনটা বানিয়ে বলবে, আরেকজনা তার সঙ্গে মিল দিয়ে দ্বিতীয় লাইন বলবে, তার পরের জন তৃতীয় লাইন, এমনি করে গল্পটা শেষ করতে হবে। যদি কেউ না পারে সে হেরে গেল, তার পরের জন বলবে। দাদা কখনও হার মানত না। যত শক্তু হােক না কেন।

আমরা চেঁচামেচি করে উঠলাম, ওসব যা তা বললে হবে না। চু ঞ আবার কী কথা? সুন্দরকাকা

খুশি হয়ে দাদার পিঠ চাপড়ে বললেন, চুঞু মানে ওস্তাদ, এক্সপার্ট। ছােটোবেলা থেকেই দাদা কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিল। আট বৎসর বয়সে তার প্রথম কবিতা

'নদী আর নয় বৎসর বয়সে দ্বিতীয় 'টিক টিক টং মুকুল পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।  দাদার দেখাদেখি আমারও শখ হলাে কবিতা লেখার। একটা খাতায় বেশ ফুল লতাপাতা এঁকে লুকিয়ে দুয়েকটা কবিতা লিখলাম, তারপর একটা গল্প লিখতে আরম্ভ করলাম। একদিন দুপুরে বসে গল্প লিখছি, বাবার কাছে একজন ভদ্রলােক দেখা করতে এলেন। তাঁকে বসিয়ে বাবাকে ডেকে দিলাম, বাবা এসে তাঁর সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্পসল্প করলেন, তারপর দুজনে একসঙ্গে কোথায় বেরিয়ে গেলেন।

আমার খাতাটা টেবিলে ফেলে এসেছিলাম, ওঁরা চলে যেতেই তাড়াতাড়ি খাতাটা আনতে গিয়ে দেখি, আমার সেই অর্ধেক লেখা গল্পটার পাতায় তারপর হলাে কী বলে বাকি গল্পটা সেই ভদ্রলােক নিজেই লিখে শেষ করে রেখেছেন। তিনি ছিলেন তখনকার একজন নামকরা লেখক নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত! বড়াে হয়ে তাঁর লেখা অনেক সুন্দর গল্প প্রবাসী-তে পড়েছি। আমার খাতায় তাঁর লেখাটা নিশ্চয়ই খুব ভালাে হয়েছিল, কিন্তু তখন আমার মনে কী হয়েছিল জানাে? মনে হলাে, আমার গল্পটা মাটি হয়ে গেল! মনের দুঃখে খাতাটা ছিড়েই ফেললাম।

বাবা যখন বিদেশে কোথাও যেতেন, মজার মজার

ছবি আর পদ্যে আমাদের চিঠি লিখতেন। আমাদের পড়া হয়ে গেলে সেগুলি কত লােকের হাতে হাতে ঘুরত। সেসব যদি সংগ্রহ করা থাকত, তাহলে তাই দিয়ে মজার একটা বই হতে পারত।


 মৃত্যু:  ২১ নভেম্বর ১৯৭৪ ।


======[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[[======