বেয়নেট হোক যত ধারালো—
কাস্তেটা ধার দিয়ো, বন্ধু!
শেল আর বম হোক ভারালো
কাস্তেটা শান দিয়ো, বন্ধু।
নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি
তুমি বুঝি খুব ভালোবাসতে ?
চাঁদের শতক আজ নহে তো
এ-যুগের চাঁদ হ’লো কাস্তে!ইস্পাতে কামানেতে দুনিয়া
কাল যারা করেছিল পূর্ণ,
কামানে-কামানে ঠোকাঠুকিতে
আজ তারা চূর্ণবিচূর্ণ :চূর্ণ এ-লৌহের পৃথিবী
তোমাদের রক্ত-সমুদ্রে
গ’লে পরিণত হয় মাটিতে,
মাটির—মাটির যুগ ঊর্ধ্বে!
দিগন্তে মৃত্তিকা ঘনায়ে
আসে ওই! চেয়ে দ্যাখো বন্ধু!
কাস্তেটা রেখেছো কি শানায়ে
এ-মাটির কাস্তেটা, বন্ধু!
(কাস্তে )
দীনেশ দাস।বিগত শতকের তিরিশের দশকে রবীন্দ্র কাব্যধারার পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অথবা রবীন্দ্রনাথের কাব্য-ভাবনার বিস্তৃত ছত্রছায়ার প্রভাব থেকে মুক্তির সন্ধানে কল্লোলগোষ্ঠির কবিরা এক নব্য-ভাবধারার আন্দোলন শুরু করেন। সেই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে এবং কিছুটা সমর সেন প্রমুখ কবিরা। তাঁরা চিরাচরিত প্রেম এবং প্রকৃতি থেকে সরে এসে কবিতাকে সমসাময়িক সমাজ ও ইতিহাস সচেতনতার সঙ্গে যুক্ত করলেন। তার সার্থক ফসল হল বামপন্থী মতবাদের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ কাব্যগ্রন্থ (প্রকাশ ১৯৪১)। যেখানে মেহনতী মানুষের যাপনচিত্র ছিল মুখ্য বিষয়।
পরবর্তী চল্লিশের দশক সংযুক্ত বাংলার (অন্তত ১৯৪৭ পর্যন্ত) জন্য এক দুঃস্বপ্নের দশক ছিল। ভীষ্ম পিতামহের মতো বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিকে দীর্ঘ প্রতিপালনের পর কবিগুরু প্রয়াত হলেন। দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধে শত্রুপক্ষ একেবারে সদরদরজায় এসে হানা দিয়েছিল। মানুষের কদর্য লালসা আর স্বার্থপর লোভের পরিণতিতে মানুষেরই তৈরি দুর্ভিক্ষে (পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে কুখ্যাত : ১৯৪৩) কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু। এবং সর্বোপরি ১৯৪৬-এ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ও স্বাধীনতা পূর্ব দেশ বিভাজনের ফলে উদ্বাস্তু আগমন সম্পর্কিত পরিস্থিতির চাপে মৃত্যু হয়েছিল মানুষের শুভবুদ্ধি ও সুকুমার বোধের। প্রকৃতপক্ষে মানবসভ্যতাই এসে দাঁড়িয়েছিল এক চরম সংকটের মুখে।
কবি দিনেশ দাস এই (৬/৯/১৯১৩-১৩/৩/১৯৮৫) আবর্ত-সংকুল সময়খণ্ডের এক উল্লেখযোগ্য কবি – তাঁর কাব্যচেতনাকে প্রভাবিত করেছিল এই সমস্তকিছুই। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত যাপনের চালচিত্র।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় মাত্র পনেরো বছর বয়সে (১৯২৮) মহাত্মা গান্ধীর লবণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে সাময়িকভাবে লেখাপড়ায় ছেদ ঘটে। একবছর বাদে আবার শিক্ষার জগতে ফিরে এসে ১৯৩০ সালে ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩২তে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বিপ্লবাত্মক স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। ১৯৩৩-এ বি এ ক্লাসে ভর্তি হলেও সেই বিপ্লবী আন্দোলন এবং সাহিত্যচর্চার জন্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেন না। ১৯৩৩-এ দেশ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৫-এ খয়েরবাড়ি চা-বাগানে চাকরির সূত্রে কার্শিয়াং চলে আসেন। সেখানে গান্ধীবাদী মতাদর্শের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পেরে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৩৬-এ বামপন্থী মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে কার্ল মার্কস, ফ্রেড্রিখ এঙ্গেল, রালফ ফক্সের রচনা পাঠ করে এক নতুন ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন। এই চিন্তামানসই তাঁর কবিতাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে আমৃত্যু।
১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো ‘কাস্তে’ কবিতা। এই কবিতাটি আধুনিক বাংলা কবিতার এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় এবং তিনি প্রায় রাতারাতি মেহনতী মানুষের জীবন-যন্ত্রণা প্রকাশের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। ‘কাস্তে’ কবিতায় শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদটাকে তিনি শ্রমজীবী কৃষকের ফসল-কাটার ক্ষুরধার অস্ত্র কাস্তের সঙ্গে তুলনা করেন। যে চাঁদ এতকাল কাব্যজগতে প্রেম ও সৌন্দর্যের লাবণ্যময় প্রতীক ছিল তাকে তিনি খেটে-খাওয়া মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার করে তুললেন। এমন একটি বৈপ্লবিক চিন্তার তিনিই পথিকৃৎ ।
পরবর্তী সময়ে বামপন্থী মতধারার আরেক কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৫/৮/১৯২৬-১৩/৫/১৯৪৭) পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির প্রতীক হিসেবে কল্পনা করে অমরত্ব পেয়েছেন।
দিনেশ দাসের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল: কবিতা; ভুখা মিছিল; কাচের মানুষ; রাম গেছে বনে; কাস্তে প্রভৃতি।
দিনেশ দাসের ‘কাস্তে’ কবিতাটি একসময়ে যুবাবয়সের তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ঘুরত পথে-ঘাটে, কফি হাউসের চত্বরে। কলকাতার ক্লাইভ স্ট্রিট তাঁর কবিতার কল্যাণে সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে গেছে। আর দীনেশ দাস পরিচিতি লাভ করেন ‘কাস্তে-কবি’ হিসেবে!
লেখক সমবায় (১৯৫৯) এবং ভারবী (১৯৭২) প্রকাশিত দুটি শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলনের প্রত্যেকটির ভূমিকায় কবি দিনেশ দাস কবির ব্যক্তি বা সামাজিক জীবনের সঙ্গে তাঁর কাব্যজীবনের গভীর সম্পর্কের উল্লেখ করে বলেছেন— ‘প্রতিটি কবিকর্মকে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেখাই যুক্তিসংগত। তবে কবির জীবন যেমন তাঁর কাব্যে প্রকাশিত তেমনই তাঁর কাব্যও অনেক সময় তার জীবনের মধ্যে রূপায়িত।’ একই প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর ‘কাচের মানুষ’ কাব্যগ্রন্থে ‘কাব্যচিন্তা; কবিতাগুচ্ছের ‘জীবন ও সাহিত্য’ শিরোনামে লেখা লাইনে—
জানতাম, জীবনের প্রতিবিম্ব/ উপন্যাস কবিতা সম্ভার।/ সাহিত্যের প্রতিবিম্ব এ জীবন কিনা/ মনে মনে ভাবি ‘বারবার’। কবির শততম জন্মবর্ষে তাঁকে বুঝতে তাই প্রথমে তাঁর কাব্যময় জীবনের রূপরেখা পেশ করা জরুরী।
আদি গঙ্গার তীরে আলিপুরে চেতলা অঞ্চলে (৬৫ এফ জয়নুদ্দি মিস্ত্রি লেন, কলি-২৭) তাঁর মাতুলালয়ে ১৯১৩সালে ১৬ই সেপ্টেম্বর কবির জন্ম। পিতা হৃষিকেশ দাস, মাতা কাত্যায়নী দেবী। কবির দুটি ভাই শৈলেন ও মনোজ এবং এক বোন জয়শ্রী দাস।( হাওড়া জেলার কথা) বারো বছর বয়সে ৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় কবি ছড়া মেলাতে শুরু করেন। কিন্তু নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় জনৈক বর্মনদার নেতৃত্বে গোপন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। অন্যদিকে গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে, তথাপি ১৯৩০সালে সসম্মানে ম্যাট্রিক ও ১৯৩২সালে আই-এ পাস করেন, ১৯৩৩-৩৪ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হন। এই সময়ে ১৯৩৪সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘শ্রাবণে’ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এদিকে পুরনো বিপ্লবী সমিতির কাজ ও কাব্যসাহিত্য চর্চার চাপে বি এ পরীক্ষা দেওয়া হলো না। বাবা সরকারী চাকরি নিতে বলায় দ্বিমত হয়ে কবি ১৯৩৫সালে কলকাতা ছেড়ে কার্শিয়াং-এর খয়াবাড়ি চা বাগানে চাকরি নিয়ে চলে যান। সেখানে চা বাগানের নিপীড়িত কুলিদের বঞ্চনা ও দারিদ্র্য মোচনে গান্ধীবাদী অহিংস পথের কার্যকারিতা সম্পর্কে সংশয়াপন্ন হয়ে উঠেন। পরের বছর ১৯৩৬কবি কলকাতায় ফিরে আসেন।
কলকাতায় ফিরে অন্যান্য কবিদের মতো তিনি গদ্যরীতিতে কাব্যরচনায় যুক্ত হয়ে লিখলেন ‘প্রথমবৃষ্টির ফোঁটা’, ‘মৌমাছি’, ‘নখ’, ‘হাই’, ‘চায়ের কাপে’- সহ নানা কবিতা, তখনও কবির কোন সংকলন প্রকাশিত না হওয়া সত্বেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ সংকলন গ্রন্থে ‘মৌমাছি’ অন্তর্ভুক্ত করেন।( হাওড়া জেলার কথা) একই সময়ে তখনকার কলকাতার সর্বত্র সাম্যবাদ ও কমিউনিজমের আলোচনার পরিবেশে কবিও মার্কস, এঙ্গেলসের পাশাপাশি র্যালফ্ ফকস্ প্রমুখ সাম্যবাদী ব্যক্তিদের দর্শন ও সাহিত্যের সংস্পর্শে আসেন। স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। এরই ফলে কাব্যজগতে তিনিও রোমান্টিসিজমের নদী পেরিয়ে ধীরে ধীরে বাস্তবতার ডাঙায় উঠে এলেন। এই সময় ফ্যাসিবাদের গুরু মুসোলিনি ইথিওপিয়ায় বোমা ফেলে হাজার মানুষকে মেরে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন শুরু করেন। আর হিটলারের উত্থানের শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধের আগাম পদধ্বনি। এই পরিপ্রেক্ষিতে কেবলমাত্র শ্রমিক কৃষক সকল মেহনতী জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ একে পরাস্ত করতে পারে এই বিশ্বাসে স্থিত হয়ে লিখলেন ১৯৩৭সালে ‘কাস্তে’, (কবিতা ১৯৪২)। আহ্বান করলেন সকল শ্রমজীবীদের হাতিয়ারের প্রতীক হিসাবে কাস্তে শান দিতে। এই কবিতা মুহূর্তে ইতিহাস রচনা করল, যেন সমাজমানসের অন্তঃস্থলের একান্ত চাহিদা পূরণ হলো। প্রভাবিত হলেন পাঠকসহ কবি সাহিত্যিকবৃন্দ। ( হাওড়া জেলার কথা) অগ্রজ বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ‘কাস্তে’র লাইনকে শিরোনাম করে কাব্য রচনা করলেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘অলকা’ পত্রিকায় ওই নামে গল্প লিখলেন। ছোট বড় আরও অনেকে কবিতা রচনা করলেন।
কিন্তু ব্রিটিশ সরকারকে ধোঁকা দিতে পরিকল্পিতভাবে হাতুড়ি বর্জিত করা সত্ত্বেও রাজরোষের ভয়ে এক বছর ‘কাস্তে’ ছাপার মুখ দেখেনি। ১৯৩৮এ অবশেষে কবিবন্ধু অরুণ মিত্রের সৌজন্যে তা আনন্দবাজার শারদীয়ায় প্রকাশিত হয়। কবিও নতুন করে কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৩৮ এ বি এ পাস করেন। কিন্তু ব্রিটিশরাজের পুলিস তাঁর বাসস্থানে তল্লাশি করে এবং তাকে লর্ড সিন্হা রোডে আটকে রাখে।
১৯৩৯সালে ঢাকা নিবাসী উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারী যামিনী বিশ্বাসের তৃতীয়া কন্যা শ্রীমতি মণিকা বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ঐ সময়েই তিনি ক্যালকাটা ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে (পরে নাম হয় এল আই সি) কাজে যোগ দেন। ১৯৪০-৪১সালে বাংলায় বোমাতঙ্ক, ১৯৪২-এ মন্বন্তর, একটু ফ্যানের জন্য মৃত্যুমিছিল কবির হৃদয় বিদীর্ণ করলো। তিনি লিখলেন ‘গ্লানি’, ‘ডাস্টবিন’, ‘ভুখ মিছিল’, ‘বামপন্থী’। অন্যদিকে ‘মজুতদারী’, পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে লিখলেন ‘ক্লাইভ স্ট্রিট’। ‘ভুখ মিছিলের’ (১৯৪৪) থেকে ‘পঞ্চাশের মন্নন্তর’ কবিতাটি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আকাল’ কাব্যসংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়।
চাকরি জীবনের সাত বছর পর ১৯৪৬সালে কর্মস্থলে ইউনিয়ন গড়তে গিয়ে তিনি বাধা পেয়ে কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন। এই সময় প্রথমে দৈনিক কৃষক ও মাতৃভূমি কাগজে কিছুদিন কাজ করেন।( হাওড়া জেলার কথা) চলচিত্রে গীতিকার ও সহ পরিচালকের কাজেও যুক্ত হন। কিন্তু কোন কাজই তাঁর মনঃপুত হয়নি। অর্থাভাব, দারিদ্র্য তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিন্তু সৎ, দৃঢ়চিত্ত আত্মসম্মানবোধে অবিচল বলে কখনও কারুর অযাচিত অনুগ্রহ লাভের জন্য মাথা নোয়াননি।
ইতোমধ্যে খণ্ডিত স্বাধীনতা, ভ্রাতৃদাঙ্গা, সর্বশেষে গান্ধীজীর গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে। তিনি কলকাতা ছেড়ে হাওড়া জেলার গ্রামে দেউলপুর বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের কাজ নিয়ে ১৯৪৮সালে চলে যান। সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন, কিন্তু বিদ্যালয় ও গ্রামের মানুষ তাঁকে অপরিসীম শ্রদ্ধায় আজও স্মরণে রেখেছেন। এই সময় নতুন ভাবনা বোধের কবিতা লেখেন, উল্লেখযোগ্য হলো ‘দেউলপুর’, ‘ঘুঘু ডাকে’, ‘শেষ ক্ষমা’, ‘স্বর্ণভস্ম’ (দীনেশ দাসের কবিতা ১৯৫১)। এক বছর পর কলকাতায় ফিরে এসে স্থায়ীভাবে চেতলা বয়েজ স্কুলে বাংলার শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন।( হাওড়া জেলার কথা) তাঁর লেখায় নতুন অনুভাবনার সঙ্গে প্রতীক ও ব্যঞ্জনার চরিত্রে গভীরতা ও মগ্নতার লক্ষণ ধরা পড়ে। এই সময়ের (অহল্যা ১৯৫৪) তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘অহল্যা’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রণমি’। সাথে সাথে গরিব নিম্নবিত্ত মানুষের বেদনা ও আন্দোলনের সমব্যথী হয়ে লিখলেন ‘শিক্ষক আন্দোলন ১৯৫৩’, ‘শিক্ষক ধর্মঘট ১৯৫৪’। ইতিমধ্যে মাতুলালয় ছেড়ে অন্যত্র কিছুকাল বাস করেন। পরে গোপালনগরে ৪/১ আফতাব মস্ক লেন ঠিকানায় পিতৃগৃহে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কবির দুই পুত্র শান্তনু ও ভারবী এবং এক কন্যা জোনাকি।
১৯৫৯সালে প্রকাশিত প্রথম শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন ‘উল্টোরথ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়। ১৯৬১ ও ১৯৭৪সালে দিল্লিতে জাতীয় কবি সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি কবি রূপে আমন্ত্রিত হন। ১৯৬১-তে আর্থারাইটিস রোগে অসুস্থ অবস্থায় তাঁর ‘কাচের মানুষ’ প্রকাশিত হয়। তাছাড়া ১৯৭২-এ ‘অসংগতি’ এবং একই বছরে শ্রেষ্ঠ কবিতা দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ইতিমধ্যে ১৯৭৫-এ নতুন করে ‘কাস্তে’ নামে একটি আলাদা সংকলন প্রকাশ করে নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার শপথ নেন।( হাওড়া জেলার কথা) ১৯৮০সালে কবিকে নজরুল আকাদেমি প্রথম নজরুল পুরস্কারে ভূষিত করেছিল। আর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘রাম গেছে বনবাসে’ ১৯৮২সালেই রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত হয়।
১৯৮৪তে কবির ‘কাব্যসমগ্র’ প্রকাশের পর তাঁর স্বাস্থের ক্রমাবনতি ঘটে, সে অবস্থায় লিখলেন ‘হার্ট অ্যাটাক’, ‘জার্নাল’, ‘হাসপাতাল’ এবং ‘এবার ঘুম’। ১৯৮৫সালে ১৩ই মার্চ কবি গোপালনগরের বাসভবনে চিরঘুমে বিদায় নিলেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কাস্তে’ কবিতায় ‘হাতুড়ি’ রাখা হয়নি ব্রিটিশকে ধোঁকা দিতে, কবি একথা বার বার বলেছেন, ফ্যাসিবাদকে তখনও অনেক বৃদ্ধিজীবী না বুঝে প্রশংসা করেছেন, কেউ কেউ মুসোলিনি, পরে হিটলারকে ভগবানের অবতার বলছেন, কবির ভাষায় ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মনে সংশয়, — It is difficult to choose between, communism and fascism. সেই ভীত ত্রস্ত সংশায়িত যুগে স্থিরবিশ্বাসের কবিতা ‘কাস্তে’। ( হাওড়া জেলার কথা)বলতে চেয়েছিলুম ফ্যাসিস্তদের বেয়োনেট যত তীক্ষ্ম হ’ক না কেন, কাস্তে হাতুড়ি অর্থাৎ জনগণের শক্তির সঙ্গে তারা কিছুতেই পারবে না।’ (কাস্তে ১৯৭৫ সংস্করণের ভূমিকা থেকে।)
কালযুগের ফসল, ধ্রুপদী উপাদানের অভাব বা মার্কসবাদের ধারণায় শিল্প সাহিত্যের প্রসঙ্গে তল উপরিতলের সরলীকৃত বিতর্ক যাঁরা হাজির করেন, তাঁরাও কেউ অস্বীকার করেননি এই কবিতার অসাধারণ শব্দ চয়ন, ছন্দ, স্তবক, বিন্যাস এবং অপূর্ব ব্যাঞ্জনাসমৃদ্ধ গীতিমুখর গঠনশৈলী, কালের আহ্বানে লিখিত হলেও এই কবিতা কালজয়ী তার কাব্য সুষমায়। এ যেন মাও জে দঙ তাঁর ইয়েনান বক্তৃতামালায় ঠিক যেমনটি আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন— রাজনৈতিক উপাদান নিয়ে গড়া শিল্পরূপের সর্বোত্তম সম্ভব বিকাশ। (the unity of revolutionary political content and the highest possible perfection of artistic form).
কবির কাব্য জীবনের দ্বিতীয় পর্বে দেখি চল্লিশের দশকের শুরুতে মন্বন্তর, কলকাতায় একটু ফ্যানের জন্য গ্রাম থেকে ছিন্নমূল ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকারে সমব্যথী হয়ে প্রকাশিত হলো ‘ভুখ মিছিলে’র সেইসব হৃদয় বিদারক কবিতার স্তবকগুলি— ‘এই দারুণ ক্রন্দনেই/যুদ্ধ নেই? যুদ্ধ নেই?/তবু আকাশ স্তব্ধ নীল/নিম্নে ভিড় ভ্রষ্ট নীড় মৌন মুখ ভুখা মিছিল।’ বা ‘বেঁচে আছি আমি/ এর চেয়ে নেই লজ্জা, নেই বড় গ্লানি।’ (গ্লানি) আর ‘ডাস্টবিন’ কবিতায় লিখলেন, ‘এই যে খুনে সভ্যতা/অনেক জনের অন্ন মেরে কয়েক জনের ভব্যতা।’
কবির দেউলপুর ও পরবর্তী পর্যায়ে নানা অভিজ্ঞতার ভিন্নধর্মী কবিতা স্বাভাবিকভাবেই এসেছে, একথা আগেই বলা হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটির কিছু স্মরণযোগ্য লাইন উল্লেখ করি— ‘যে প্রাণ দেউলপুরে সে প্রাণই আমার’ (দেউলপুর)। আর সবচাইতে স্মরণীয় বোধহয় এযাবৎ রবীন্দ্রস্মরণে লেখা ‘প্রণমি’ (২৫শে বৈশাখ) এর সর্বোৎকৃষ্ট চারটি লাইন— ‘আকাশে বরুণে দূরে স্ফটিক ফেনায়/ ছড়ানো তোমার প্রিয় নাম/ তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা/ কোনখানে রাখব প্রণাম।’
ষাটের দশকে সমাজের অবক্ষয়, সত্তরের দশকে সন্ত্রাস জরুরী অবস্থা তাঁকে পীড়া দেয়। এইসব অবস্থানে জীবনের নানা বোধের সঞ্চারের মধ্যেও কবি সর্বহারা, গরিব নিম্নবিত্তের বেদনা ও লড়াই ও পরিচয়কে ভোলেননি।( হাওড়া জেলার কথা) মানুষের মহাকাশ যাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে লিখলেন, ‘এতে কি দূর হবে পৃথিবীর দুঃখ/ মানুষের ভাত রুটির কান্না।’ ‘লেলিন শতবর্ষে কোন চাষি’ কবিতায় নিজেকে হাওড়া জেলার কোনে কাষ্ঠস্যাংড়া গ্রামের চাষিপাড়ার চূড়ামণি দলুই পরিচয় দিয়ে লিখেছেন— ‘কেটে যাবে এই অমাবস্যার ঘোর/ দেখা যাবে ঠিক/ কাকের মুখেতে বটফল যেন/ টকটকে রাঙা ভোর।’ আর ‘গান, স্লোগান, মেশিনগান’ কবিতায় সদর্প ঘোষণা ‘আমি কবি চিরদিনই সর্বহারা।’
প্রথমেই বলেছিলাম দিনেশ দাসের জীবন যেমন তাঁর কাব্যে, তেমনি তাঁর কাব্য, তাঁর জীবনে প্রতিপদে প্রতিফলিত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য বস্তির নিতান্ত বাস্তব জীবনে ভর করে ‘কবি লেখেন’ কবিতায় টিনের চালের নিচে একফালি তক্তপোষের উপর লুঙ্গি আর ফুটো গেঞ্জি পরে বিদ্যুৎবিহীন ঘরে মোমবাতির সামনে কবি অপেক্ষায় রত কখন ‘হঠাৎ জ্বলে ওঠে কবির মন একটি শুচিশুভ্র শিখায়।’
জীবন পরিক্রমায় সব মানুষের মতো কবিও নানা বাঁক ও মোড়ের সম্মুখীন হয়েছেন। এমনকি যৌবনের স্বপ্ন সাম্যবাদ শোষণমুক্ত দুনিয়ার ছবি যত দূরে সরে যাচ্ছে মনে হচ্ছে কবি বিক্ষুব্ধ হয়েছেন, কিন্তু উলটোপথে হাঁটেননি, বা সমাজমানসকে বর্জন করে একান্ত ব্যক্তিমানসের মগ্নতায় তথাকথিত পবিত্র কবিতায় অথবা কোন অজ্ঞেয়বাদী নিয়তিসর্বস্ব দর্শনে আত্মসমর্পন করেননি। বরং তিনি মনে করেন ‘কবির কাজ শুধু সময়কে প্রভাবিত করা/তার যুগচেতনাকে আলোয় উদ্ভাসিত করা।’ (কবির কাজ)।( হাওড়া জেলার কথা) জীবনের শেষ লগ্নে ১৯৮৪সালে ‘কাব্যসমগ্র’ প্রকাশকালে ভূমিকায় শেষ পরিচ্ছেদে এই মহাদুর্যোগের দিনে কবিদের অন্যান্য শিল্পীদের মতো কর্তব্য স্থির করে দিয়েছেন, কবির বিশ্বাস শব্দ কবির হাতে নবজন্মান্তর লাভ করে সমাজ মানসের মগ্ন চৈতন্যে অনুপ্রবেশ করে অন্তর্লোককে পরিবর্তিত করতে সক্ষম। আর তা পারাটাই হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্প ও সংস্কৃতি।
এই সমাজবোধে অনিষ্ট, সর্বাংশে সার্থক কালজয়ী কবি দীনেশ দাস ও তাঁর কাব্যকে নতুন করে চর্চা করা আজকের দিনে তাই আমাদের চেতনার দিগন্তকে প্রসারিত করার স্বার্থেই একান্ত জরুরী।
ভারতবর্ষ
চোখভরা জল আর বুকভরা অভিমান নিয়ে
কোলের ছেলের মতো তোমার কোলেই
ঘুরে ফিরে আসি বারবার
হে ভারত, জননী আমার।
তোমার উত্সুক ডালে
কখন ফুটেছি কচিপাতার আড়ালে,
আমার কস্তুরী-রেণু উড়ে গেছে কত পথে
দিগন্তে আকাশে ছায়াপথে,
তবুও আমার ছায়া পড়েছে তোমার বুকে কত শত ছেলে
তুমি বাঁকা ঝিরঝিরে নদী ছলছলে
বাজাও স্নেহের ঝুমঝমি,
জননী জন্মভূমি তুমি!তোমার আকাশে আমি প্রথম ভোরের
পেয়েছি আলোর সাড়া,
দপদপে হীরে-শুকতারা
অস্ফুট কাকলি,
জলে ফোটে হীরকের কলি
মধ্যাহ্নে হীরের রোদ—
হে ভারত, হীরক-ভারত!
কোন্ এক ঢেউছোঁয়া দিনে
বঙ্গোপসাগর থেকে পথ চিনে চিনে
কখন এসেছি আমি ঝিনুকের মতো,
তোমার ঘাসের হ্রদে ঝিলের সবুজে
খেলা করি একা অবিরত!
আমি তো রেখেছি মুখ
তোমার গঙ্গোত্রী-স্তনে অধীর উন্মুখ,
মিটাল আগ্নেয় ক্ষুধা তোমার অক্ষয় বটফলে
দিনান্তে সুডৌল জানু মালাবার করোমণ্ডলে
দিয়েছ আমাকে কোল ;
কত জলতরঙ্গের রাত্রি উতরোল
ভরে দিলে ঘুমের কাজলে ;
মিশে গেছি শিকড়ের তন্ময়তা নিয়ে
তোমার মাটির নাড়ি হাওয়া আর জলে
গ্রীষ্ম বর্ষা হেমন্ত শরৎ —
হে ভারত, হীরক-ভারত!
আজ গৌরীশঙ্করের শিখরে শিখরে
জমে কালো মেঘ
বৈশাখী পাখির ডানা ছড়ায় উদ্বেগ ;
তবু এই আকাশ সমুদ্র থেকে কাল
লাফ দেবে একমুখো হীরের সকাল
চকচকে মাছের মতন—
হে ভারত, হীরক-ভারত পুরাতন!
প্রণমি
(পঁচিশে বৈশাখ)
দেখেছি তোমার নাম সবার পথমে
শ্রাবণের ধানের শিসে দুধটুকু জমে,
তোমারিতো নামে
বৈশাখে আখের ক্ষেতে যত মধু নামে ।
তবুও হাজার হাতেহাওয়া দেয় ডাক
কোথায় মাটির স্বপ্নে শীলিভূত পঁচিশে বৈশাখ ।
কোথায় আকাশে বাজে সোনার সরোদ
পঁচিশে বৈশাখী ভোর গ’লে হয় গিনিসোনা-রোদ ।
তুমি তো বনষ্পতি তোমার পায়েতে থরে থরে
অজস্র শব্দের রঙ কৃষ্ণচূড়ার মত ঝরে
তুমি এক অবাক মৌচাক
কথাগুলি চার পাশে ঘোরে যেন গুনগুন সুর একঝাঁক।
তোমার হন্দের নদী জমা হ’ত যদি
পৃথিবীতে হ’ত মহাসমুদ্র-বলয়,
ঝুরঝুরে গানের মাটি জ’মে জ’মে হ’ত
আর এক নতুন হিমালয় ।
আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায়
ছড়ানো তোমার প্রিয় নাম,
তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা
কোনখানে রাখবো প্রণাম !
শ্রাবণে
ধ্যানমগ্ন তপস্বীর তপোভঙ্গ হ’ল আজ বহুদিন প’র
বর্ষণের মত্ততায় রুদ্রসুরে আত্মভোলা জেগেছে শঙ্কর
দুরন্ত উল্লাসে যেন । পিঙ্গল জটার জালে নভের নীলিমা
মসীম্লান হ’য়ে আসে – লুপ্তপ্রায় হ’ল দিক দিগন্তের সীমা,
বিত্যুতের অগ্নিসর্প ক্ষণে ক্ষণে ফনা হানে জটাভার হ’তে
ধরিত্রীর অন্তরাত্মা মুহুর্মুহহু ত্রাসে কাপে- এ বিশ্বজগতে
শুনি যেন ভয়ার্তের আর্তসুর । নৃত্য করে মত্ত নটরাজ
বজ্রের বহ্ণিতে তার প্রলয়ের তৃতীয় নয়ন জ্বলে আজ
শঙ্কিত উমার চক্ষে অবিরল ঝরঝর ঝরে অশ্রুধারা
তিলার্ধ ভ্রুক্ষেপ নাই, তান্ডবের নটরাজ নাচে আত্মহারা ।
অহল্যা
দীপময় ভারতের মত
বিশাল বিচিত্র এই আমার হৃদয়,
সেখানেয়ামার মনোমত
স্বচ্ছ তারার রাত, ফেনার উপরে সূর্যোদয়।
সোনালো বৃষ্টির মত দিনগুলি ঝরে
হৃদয়ের তীর নেই কোনো
হাওয়া হতে হাওয়ার উপরে
শূণ্য জলের মত ভেসে চলি কখনো কখনো।
এই ফেনা, এই ঢেউ, গ্লেসিয়ার বেয়ে
কোথায় কখন আসে জীবনের অদৃশ্য লবণ:
জীবন, মানুষ, মন
তাইতো অনেক বড় দ্বীপময় সমুদ্রের চেয়ে।
জীবন বিশাল স্মরণীয়,
প্রাণের গোপন কূপে অনন্ত পানীয় :
তবু চাপা পাষাণের অতলে পাষাণ
অহল্যার মত কাঁদে শিলীভূত প্রাণ ।
দিন-রাত্রি বর্ষ-যুগ নক্ষত্র-শতাব্দী ধ’রে
অহল্যার কান্না শুনি জীবন্ত পাথরে
স্ফটিক-শিশিরে উজ্বল:
কোথায় হলুদ শিস, আশা,শান্তি, জল।
ডাস্টবিন
মানুষ এবং কুত্তাতে
আজ সকলে অন্ন চাটি একসাথে
আজকে মহা দুর্দিনে
আমরা বৃথা খাদ্য খুঁজি ডাস্টবিনে।
এই যে খুনে সভ্যতা
অনেক অনেক অন্ন মেরে কয়েকজনের ভবতা,
এগোয় নাকো পেছোয় নাকো অচল গতি ত্রিশঙ্কুর–
হোটেলখানার পাশেই এরা বানিয়ে চলে আঁস্তাকুঁড়
পুঁজির প্রভু ! মহাপ্রভু ! তোমার কৃপা অনন্ত –
জলের ফোঁটা ঘিয়ে কড়ায় ফুটন্ত,
পিঁপড়ে পেল মানুষ-গলা শর্করা,
মার কৃপা বুঝবে কি আর মুর্খরা?
আজ যে পথে আবর্জনার স্বৈরিতা
মহাপ্রভু ! সবই তোমার তৈরি তা।
দেখছি বসে দূরবীনে
তোমায় শেষে আসতে হবে তোমার গড়া ডাস্টবিনে।
কান্না
পালকের মত বুক
ধুকপুক ধুকপুক
অসহায় কাতরায় হাতড়ায় ।
পিষে যায় মিশে যায়
ছোট ছোট কচি মুখ
ছোট হোট চূনি আর পান্না;
প্রাণ বলে আর না ! আর না !
তট ভাঙে পট ভাঙে দুপদাপ,
হাওয়াখানা তবু চুপচাপ ।
একে একে তারা ফোটে রাত্রে
ভ’রে ওঠে আকাশের পাত্র,
তারার মতই কত
চকচকে লাখো ক্ষত
আঁকা হ’ল এ মাটির গাত্রে,
জানল না কেউ কণামাত্র ।
রাতের শিশির কাঁদে টুপটাপ
হাওয়াখানা চুপচাপ
হাওয়াখানা চুপচাপ।
নজরুল ইসলাম
পঁচিশে বৈশাখে রবি
বাজাল আলোর শঙ্খ,
এঁকেছিল আকাশেতে উজ্বল সোনালি রেখা
বহ্ণির বলয়।
এগারোই জ্যৈষ্ঠে সেই আগুন-হলুদ রঙ
হঠাত তাম্রাভ হ’ল
প্রচন্ড উত্তাপ তার–সাক্ষাৎ প্রলয়
অনির্বাণ শিখা লেলিহান
এর যদি নাম কিছু থাকে–
এরই নাম নজরুল ইসলাম।।
খোকা ফিরে আয়
মা বলেন, খোকা ফিরে আয়!
হঠাৎ সজোরে মাথা ঠুকে যায়,
সকল সময় আমি বাধা পাই নিয়ে কচিকাঁচা,
ফিরে আয় বাছা।
জানিস আমার বড় ভয় করে সর্বদাই
পৃথিবী এখন দেখি গরুর শিঙের মত
তেড়ে আসে সকল সময়:
দরজা জানালা খাট ঘরের দেওয়াল,
মাতালের মত টলে, ধাক্কা দিয়ে
ফেলে দেয় সকাল-বিকাল:
ফিরে আয় বাছা,
আবার জীবন পাক এবাড়ির খাঁচা
আবার উঠুক কলকলি–
পাখীর কাকলি।
ছেলে বলে, মা আমি ফিরব না
তোমার শহরতলীর রাজ্যপাটে,
এখন আমি যে ছুটি রেসের ঘোড়ার মত কলকাতার মাঠে,
সূর্যের সারথী হানে অজস্র চাবুক অবিরাম,
আমার মসৃণ ত্বকে অবিরত ঝরে রক্ত, ঘাম:
তাই বল, আমার পায়ের চাপে হবে ছত্রাকার
তোমার তাসের সংসার:
মা আমার, আমি আর ফিরতেই পারিনা,
তোমার দুধের বাটি আর আমি চুমুক দেব না মুখ ভ’রে,
সে দুধ উপুড় করে ঢেলে দিও
তুলসীমঞ্চের কালো শিরার ওপরে:
পেয়েছি অনেক আমি, খেয়েছি অনেক–ঢের,
এখন মাছের পেটি দিও ছোটদের।।
===========∆∆∆∆∆∆∆∆============
No comments:
Post a Comment