যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর
( ১৬ মে ১৮৩১ - ১০ জানুয়ারি ১৯০৮)
সঙ্গীতমনা যতীন্দ্রমোহনের যত্নে ক্ষেত্ৰমোহন গোস্বামী দ্বারা ঐকতানবাদন প্ৰণালী এদেশে প্রথম সৃষ্ট হয় (১৮৫৮)। মেয়ো হাসপাতাল, দাতব্য সভা প্রভৃতিতে এবং বিধবাদের দুঃখ দূর করবার জন্য তিনি বহু অর্থ দান করেন। তাঁর উৎসাহে ‘Settled Estates Act’ এদেশে প্রচলিত হয়। তাঁর অনুপ্রেরণায় কবি মধুসূদন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ রচনা করলে তিনি তা নিজব্যয়ে মুদ্রিত করেন। তাঁর একটি গ্রন্থসংগ্রহ ছিল। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ও সভাপতি এবং বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা, বড়লাটের শাসন-পরিষদ, শিক্ষা কমিশন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদুঘর প্রভৃতির সদস্য ছিলেন। তিনি ইংরেজী, সংস্কৃত ও বাংলায় বহু প্ৰবন্ধ ও সঙ্গীত রচনা করেছেন। অল্পবয়সে লিখিত কাব্য ও গল্প-সঙ্কলন ‘ফ্লাইটস অফ ফ্যান্সি’, ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটক এবং স্তব ও সঙ্গীতের সঙ্কলন ‘গীতিমালা’ তাঁর সাহিত্যকীর্তির পরিচায়ক। রয়াল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির তিনিই প্রথম ভারতীয় সদস্য (১৮৯৮)।
তিনি ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে রাজা বাহাদুর অভিধায় ভূষিত হন। পরে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারীতে মহারাজা অভিধায় উন্নীত হন। বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা ও মেধার সাথে ব্রিটিশ রাজের বিভিন্ন সাফল্যে অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি অর্ডার অব দ্যা স্টার অব ইন্ডিয়া সম্মানে ভূষিত হন।১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে নাইট উপাধি পান। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে মহারাজা বাহাদুর অভিধায় ভূষিত হন এবং পরের বছর হতে এই উপাধি তাঁদের পরিবারের বংশগত হয় ।
কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার বিখ্যাত জমিদার বংশে ঠাকুর পরিবারে ১৬ মে ১৮৩১ সালে
জন্মগ্রহণ করেন। । পিতা ছিলেন হরকুমার ঠাকুর এবং পিতামহ ছিলেন গোপীমোহন ঠাকুর। তিনি তৎকালীন হিন্দু কলেজে (বর্তমানের প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়া শেষ করে স্বগৃহে ইংরেজ শিক্ষকের কাছে ইংরাজী ও পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত শেখেন।তিনি ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসন ও অন্যান্যদের কাছে গৃহে শিক্ষা লাভ করেন। তার পিতা হরকুমার ঠাকুর ছিলেন হিন্দুধর্মশাস্ত্রজ্ঞ , ইংরাজী ও সংস্কৃতের পণ্ডিত। তিনি রাধাকান্ত দেবকে (১৭৮৩ -১৮৬৭) সংস্কৃত অভিধান "শব্দকল্পদ্রুম" রচনায় ও সমালোচনামূলক সংকলনে সহায়তা করেন।
শৈশবকাল থেকেই যতীন্দ্রমোহনের ইংরাজী ও বাংলা উভয় ভাষাতেই সাহিত্য রচনায় প্রবল আগ্রহ ছিল, বহু নাটক ও প্রহসন রচনা করেন। তার রচিত এমনই এক "বিদ্যাসুন্দর নাটক" তাঁদের বাড়িতে অভিনীত হয় এবং সকলের সপ্রশংস সমালোচিত হয়।
তাঁর পিতৃব্য প্রসন্নকুমার ঠাকুরের পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলে তিনি পিতৃব্যের বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হন।
১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরের দুর্ভিক্ষ-পীড়িত কৃষকদের সাহায্যার্থে প্রশাসনকে সাহায্য করেন ও বহু অর্থ দান করেন। তিনি বহু বছর ধরে বৃটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সাম্মানিক সম্পাদক ছিলেন । ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এর সভাপতি নির্বাচিত হন, ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দেও পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সভ্য মনোনীত হন এবং তারপর ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দেও পুনরায় ওই পদে আসীন হন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি "রাজা বাহাদুর" অভিধায় ভূষিত হন এবং সেই বৎসরের এপ্রিল মাস হতে তিনি দেওয়ানি বিধি অনুসারে ছাড় পান। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাণী ভিক্টোরিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী হওয়ায় তিনি "মহারাজা" উপাধি লাভ করেন। ওই বৎসরের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি গভর্নর জেনারেলের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সভ্য হন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে সিভিল প্রসিডিওর বিল পাস করানোয় সহায়তার কারণে তিনি ওই পদে পুনর্নিয়োগ পান।পরবর্তী বৎসরে বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা ও মেধার সাথে ব্রিটিশ রাজের বিভিন্ন সাফল্যে অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি অর্ডার অব দ্যা স্টার অব ইন্ডিয়া সম্মানে ভূষিত হন।১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে নাইট উপাধি পান। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে “মহারাজা বাহাদুর” অভিধায় ভূষিত হন এবং পরের বছর হতে এই উপাধি তাঁদের পরিবারের বংশগত হয় ।
যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বিশেষ অবদান ছিল মেয়ো হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। তাই এই হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের নামকরণ তার নামে করা হয়। এছাড়া তার পিতা ও পিতৃব্য প্রসন্নকুমার ঠাকুরেরনামে সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কয়েকটি বৃত্তির সূচনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত সাহিত্যে বার্ষিক পরীক্ষায় সেরা ছাত্রের জন্য সোনার আর্মলেটের ব্যবস্থা করেন। তিনি প্রতি বৎসর টেগোর ল' লেকচারস্-এ যোগ দেওয়া বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সেরা পড়ুয়া এবং ভৌত বিজ্ঞানের সেরা পড়ুয়ার জন্য স্বর্ণ পদক প্রদানের জন্য অর্থের বরাদ্দ করেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ অ্যালবার্ট ভিক্টর সফরের সময় তিনি অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ১৮৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে কলা অনুষদের সভাপতি হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার পিতৃব্য প্রসন্নকুমার ঠাকুরের মর্মর মূর্তি স্থাপন করেন। এ ছাড়াও তিনি ও তার ভাই সৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুরের সাথে যৌথভাবে পিতার একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করান। তিনি বিধবাদের দুঃখ দূর করবার জন্য বহু অর্থ দান করেন। তিনি রাজমাতা শিবসুন্দরী দেবীর স্মৃতিতে "মহারাজমাতা শিব সুন্দরী দেবীর হিন্দু বিধবাদের তহবিল" নামে এক লক্ষ টাকার এক তহবিলও গঠন করেছিলেন।
তাঁর অন্যতম কীর্তি হল 'টেগোর ক্যাসল' নির্মাণ। ২৬, প্রসন্নকুমার ঠাকুর স্ট্রিটে প্রথমে যে বাড়িটি ছিল সেটি কালীকুমার ঠাকুর তৈরি করেন। সহজ সরল কাঠামোয় তৈরি চারতলা বাড়িটি কালীকুমার তার ছোট ভাই প্রসন্নকুমারকে দিয়ে দেন। উত্তরাধিকার সূত্রে বাড়িটি যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বাড়ির স্বত্ব পান। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে যতীন্দ্রমোহন পুরানো বাড়িটি ভেঙ্গে নতুন পরিকাঠামোয় তৈরি করেন এক দুর্গের চেহারায়। বাড়িটির পরিকাঠামোয় পরিকল্পনা করানো হয়েছিল ইংল্যান্ডের ম্যাকিন্টোশ বার্ন অ্যান্ড কোম্পানির দ্বারা। ইংল্যান্ডের উইন্ডসোর ক্যাসেলের অনুকরণে এখানেও ১০০ ফুট উঁচু টাওয়ার তৈরি করা হয়েছিল।বাড়িটির জন্য ইংল্যান্ড থেকে একটি ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা এবং বিগ বেনের আদলে ঘড়ি আনানো হয়েছিল। নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য ক্যাসেলের তিন তলায় একটি প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাড়িটি এস বি হাউস অ্যান্ড ল্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেডের হরিদাস মুন্দ্রা নিয়ে নেয় এবং পরিবর্তনের পর আর সেই অবস্থায় নেই।
যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের আগেকার বাসস্থান অবশ্য এই বাড়িটির বিপরীতে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত প্রাসাদ নামেই পরিচিত। এই বাড়িতে পারিবারিক সদস্য যেমন,গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গিরিশ ঘোষ, শিশির ঘোষ, রাজেন্দ্রলাল মিশ্র, মহেন্দ্রলাল সরকার, রমেশ দত্ত, নবীন সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অমৃতলাল বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা প্রায়শই আসতেন।
যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও তার ভ্রাতা সৌরেন্দ্রমোহন ঠাকুর দুজনেই নাট্যামোদী ছিলেন। তারা পাথুরিয়াঘাটায় বঙ্গ নাট্যালয়ের সূচনা করেন। অনুষ্ঠিত নাটক সমূহ সেসময়ের হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের "হিন্দু প্যাট্রিয়ট" ও দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের "সোমপ্রকাশ" পত্রিকায় সমালোচিত হত। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে প্রথম "কালিদাস" ও সংস্কৃত নাটক "মালবিকাস্তোত্রম" বঙ্গনাট্যালয়ে মঞ্চস্থ হয়েছিল। পরের বৎসর পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নের নাটক বাংলায় অনুবাদ করে মঞ্চস্থ করা হয়।
সংগীত ও চিত্রাঙ্কন :
সঙ্গীতমনা যতীন্দ্রমোহনের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী ভারতীয় সঙ্গীতে প্রথম অর্কেস্ট্রাকে পরিচিতি দিয়ে ঐকতানবাদন প্রণালী সৃষ্টি করেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ৩রা জুলাই যতীন্দ্রমোহনের বেলগাছিয়ার বাড়িতে "রত্নাবলী" নাটক অভিনীত হয়। সেখানে তিনি ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী ও যদুনাথ পালকে ইউরোপীয় থিয়েটারে আদলে অর্কেস্ট্রার ব্যবহার করতে বলেন। এর সাথে এক যুগান্তকারী সাফল্য আসে যখন ভারতীয় সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটানো হলো। ভারতের প্রথম সুরবাহার কনসার্ট প্রদর্শিত হল তার দরবারে।] তখন থেকেই বেশ কয়েকজন বাঙালি সংগীতজ্ঞ ইউরোপীয় সংগীত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, প্রায়শই তাদের কর্মীদের স্বরলিপিতে স্থানান্তরিত করে।
এছাড়া ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ও সভাপতি ছাড়াও বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক্ষে সভা,বড়লাটের শাসন-পরিষদ, শিক্ষা কমিশন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর প্রভৃতির সদস্য ছিলেন। তিনি ইংরাজী, সংস্কৃত ও বাংলায় বহু প্রবন্ধ ও সঙ্গীত রচনা করেছেন। নাটক 'বিদ্যাসুন্দর', 'চক্ষুদান', 'বুঝলে কিনা'; স্তব ও সঙ্গীতের সংকলন 'গীতিমালা'; এবং কাব্য ও গল্প সংকলন 'ফ্লাইটস্ অব ফ্যান্সি' তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি। রয়্যাল ফটোগ্রাফার সোসাইটির তিনিই প্রথম ভারতীয় সদস্য ছিলেন.
কলকাতা মহানগরীর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের উত্তর প্রসারিত রাজপথটির নাম যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সম্মানে রাখা হয়েছে।
মৃত্যু - ১০ জানুয়ারি ১৯০৮ সালে।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment