(২০ জুলাই ১৯০২ - ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭)
বাঙালি কবি ও শিশুসাহিত্যিক।
তিনি ১৯০২ সালের ২০ জুলাই ভারতের বিহারের গিরিডি নামক স্থানে পিতার কর্মস্থলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের মালখানগর। পিতার নাম পশুপতি বসু। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক গিরিশচন্দ্র বসু ছিলেন তাঁর পিতামহ এবং বিপ্লবী ও সাহিত্যিক মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা ছিলেন তার মাতামহ। ছোটবেলা সাঁওতাল পরগণার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে তাঁর মনে কবিতা রচনার অনুপ্রেরণা জাগায়। তাঁর প্রথম কবিতা 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রধানত সরস শিশু সাহিত্য রচনাকেই সাহিত্যের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। কবিতা রচনা ছাড়াও কিশোর বয়স থেকে চিত্রাঙ্কনেও দক্ষ ছিলেন।
পিতার কর্মস্থল পাটনার গিরিডি স্কুল থেকে ১৯২০ সালে সুনির্মল বসু ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার সেন্ট পলস কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু ১৯২১ সালে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কলেজ ত্যাগ করেন। এরপর অবনীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত আর্ট কলেজে ভর্তি হন।
ছড়া, কবিতা, গল্প, কাহিনি, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি,রূপকথা, কৌতুকনাট্য প্রভৃতি শিশু ও কিশোরদের উপযোগী বিভিন্ন বিষয়ক রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আর তার জনপ্রিয়তার মূলে ছিল ছন্দের চমৎকারিত্ব ও মিলপ্রয়োগের কুশলতা।
রচনা কর্ম:
হাওয়ার দোলা (১৯২৭)
ছানাবড়া
বেড়ে মজা
হৈ চৈ
হুলুস্থূল
কথাশেখা
পাততাড়ি, ছন্দের টুংটাং (১৯৩০)
আনন্দ নাড়ু
শহুরে মামা
কিপটে ঠাকুরদা (১৯৩৩)
টুনটুনির গান
গুজবের জন্ম
বীর শিকারী
লালন ফকিরের ভিটে
পাতাবাহার
ইন্তিবিন্তির আসর (১৯৫০)
পাহাড়ে জঙ্গলে
আত্মজীবনী "জীবনখাতার কয়েক পাতা"। এটি লিখেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৬ সালে তিনি ভুবনেশ্বরী পদক লাভ করেন।
তিনি ১৯৫৭ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
কবিতা/১
সবার আমি ছাত্র
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান-
হই যেন ভাই মৌন-মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে-
দিল-খোলা হই তাই রে।
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,
মধুর কথা বলতে।
ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর-
অন্তর হোক রত্ন-আকর;
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
আপন বেগে চলতে।
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষান দিল দীক্ষা।
ঝরনা তাহার সহজ গানে,
গান জাগাল আমার প্রাণে;
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা।
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,
পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায়
শিখছি সে সব কৌতূহলে,
নেই দ্বিধা লেশমাত্র।
কবিতা/২
আমরা কিশোর-
কিশোর মোরা ঊষার আলো, আমরা হাওয়া দুরন্ত
মনটি চির বাঁধন হারা পাখির মত উরন্ত।
আমরা আসি এই জগতে ছড়িয়ে দিতে আনন্দ,
সজীবতায় ভরিয়ে দিতে এই ধরণীর আনন তো।
আমরা সরল কিশোর শিশু ফুলের মত পবিত্র,
অন্তরেতে গোপন মোদের শিল্প, গীতি, কবিত্ব।
জাগাই যদি, লাগাই তাদের এই দুনিয়ার হিতার্থ,
ভবিষ্যতের নবীন ধরা হবেই তবে কৃতার্থ।
যে বীজ আছে মনের মাঝে চায় যে তারা আহার্য,
ফসল লয়ে ফলবে সে বীজ একটু পেলে সাহায্য।
একান্ত যার ইচ্ছা আছে, দাম আছে তার কথার তো,
এই জগতে অবশ্য সে মানুষ হবে যথার্থ।
শোনরে কিশোর ভাইরা আমার, সত্য পথের শরণ নে,
হারিয়ে তোরা যাস নে যেন অমানুষের অরণ্যে।
কবিতা/৩
এমন কী আর খাই
তোমরা …যাই বল না ভাই,
এমন কী আর খাই!
আস্ত পাঁঠা হলেই পরে_
ছোট্ট আমার পেটটা ভরে
যদি…তার সঙ্গে ফুলকো-লুচি
গণ্ডা বিশেক পাই;-
এমন কী আর খাই!
চপ কাটলেট পড়লে পাতে,
আপত্তি আর নাইকো তাতে,
আর…কোপ্তা-কাবাবা-কালিয়াতে
অমত আমার নাই;
এমন কী আর খাই!
হয় না হজম এখন দাদা
খাওয়া দাওয়ায়া অনেক বাধা,
এখন…তাইতো অনেক বুঝে-সুঝে
খাবার খেতে চাই;
এমন কী আর খাই!
সের পাঁচ-ছোয় রাবড়ি-দধি
তোমরা আমায় খাওয়াও যদি,
কষ্ট করে ‘এই বয়সেও
খেতেও পারি তাই’
এমন কি আর খাই!
সন্দেশ আর পান্তুয়াতে,
রুচি বিশেষ নাইকো তাতে,
আপাতত দুসের হলেই,
ঠাণ্ডা হয়ে যাই;
এমন কী আর খাই!
মা কেঁদে কয় “এমন করে
না খেয়ে তুই যাবি মরে-
শুকিয়ে শরীর আমসি হল-”
কি আর করি ছাই;
এমন কি আর খাই!
কবিতা/৪
সব-পেয়েছির দেশে
গল্প না ভাই, কল্পনা নয়,
স্বপন-বুড়ো এসে
আমায় নিয়ে উধাও হোলো
সব-পেয়েছির দেশে।
স্বপন-বুড়োর লম্বা দাড়ি,
পোষাকটি তার রং-বাহারী,
আমায় নিয়ে দিচেছ পাড়ি
হাল্কা-হাওয়ায় ভেসে;
সব-পেয়েছির দেশে রে ভাই,
সব-পেয়েছির দেশে।
স্বপন-বুড়ো, রসিক-চূড়ো
নিদ্-মহলের রাজা,
থুর্থুরে তার শরীর বটে,
মনটি আজও তাজা;
সব-পেয়েছির দেশে চলো
সকল ছেলে মেয়ে,
উঠব মেতে সবাই সেথায়
সকল জিনিস পেয়ে,
সেথায় হাসির ঝর্ণা হাসে,
আমোদ খুশির বন্যা আসে,
মাতিয়ে তোলে শিশুর দলে
অসীম ভালোবেসে,
সব-পেয়েছির দেশে রে ভাই
সব-পেয়েছির দেশে।
বাংলাদেশের কিশোর-শিশু
তোমরা যারা আছো,
নাচার মতো নাচো তারা
বাঁচার মতো বাঁচো।
আধ-মরা আর ঘুণে ধরারা
বুড়োর কথা শুনবে যারা,-
সত্যিকারের মানুষ তারা
হবেই অবশেষেসব-
সব-পেয়েছির দেশে রে ভাই
সব-পেয়েছির দেশে।
কবিতা/৫
হবুচন্দ্রের আইন
হবুচন্দ্র রাজা বলেন গবুচন্দ্রে ডেকে–
“আইন জারী করে দিও রাজ্যেতে আজ থেকে,
মোর রাজ্যের ভিতর–
হোক্ না ধনী, হোক্ না গরীব, ভদ্র কিংবা ইতর,
কাঁদতে কেহ পারবে নাক, যতই মরুক শোকে–
হাসবে আমার যতেক প্রজা, হাসবে যত লোকে।
সান্ত্রী-সেপাই, প্যায়দা, পাইক ঘুরবে ছদ্মবেশে,
কাঁদলে কেহ, আনবে বেঁধে, শাস্তি হবে শেষে।”
বলে গবু- “হুজুর–
ভয় যদি কেউ পায় কখনো দৈত্য, দানা জুজুর,
কিম্বা যদি পিছলে পড়ে মুণ্ডু ফাটায় কেহ,
গাড়ীর তলে কারুর যদি থেঁতলিয়ে যায় দেহ;
কিম্বা যদি কোনো প্রজার কান দুটি যায় কাটা,
কিম্বা যদি পড়ে কারুর পিঠের ওপর ঝাঁটা;
সত্যিকারের বিপন্ন হয় যদি,
তবুও কি সবাই তারা হাসবে নিরবধি ?”
রাজা বলেন- “গবু-
আমার আইন সকল প্রজার মানতে হবে তবু।
কেউ যদি হয় খুন বা জখম, হাড্ডিতে ঘুণ ধরে,
পাঁজরা যদি ঝাঁঝরা হয়ে মজ্জা ঝরে পড়ে,
ঠ্যাংটি ভাঙে, হাতটি কাটে, ভুঁড়িটি যায় ফেঁসে,
অন্ধকারে স্কন্ধ কাটা ঘাড়টি ধরে ঠেসে,
কিম্বা যদি ধড়ের থেকে মুণ্ডুটি যায় উড়ে,
কাঁদতে কেহ পারবে নাক বিশ্রী বিকট সুরে।
হবুচন্দ্রের দেশে–
মরতে যদি হয় কখনো, মরতে হবে হেসে।”
পিটিয়ে দিলো ঢ্যাঁড়া গবু, রাজার আদেশ পেয়ে–
“কাঁদতে কেহ পারবে না আর, পুরুষ কিম্বা মেয়ে;
যতই শোকের কারণ ঘটুক হাসতে হবে তবু,
আদেশ দিলেন রাজাধিরাজ হবু;
রাজার আদেশ কেউ যদি যায় ভুলে,
চড়তে হবে শূলে।”
==========!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!============
No comments:
Post a Comment