মাটিতে লালিত ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে
মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে।"
তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৫ই আগস্ট ১৯২৬ সালে, কোলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের অন্তর্গত ৪৩নং মহিম হালদার স্ট্রিটে তাঁর মামার বাড়িতে | তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ছিলো ফরিদপুর জেলার উনশিয়া গ্রামে | সুকান্তের বাবার নাম ছিলো নিবারণ ভট্টাচার্য যিনি কিনা এক গ্রন্থাগারের মালিক ছিলেন এবং মায়ের নাম ছিলো সুনীতি দেবী, যিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধু |
তিনি তাঁর ছয় ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয় | তাঁর ভাইদের নাম যথাক্রমে- মনমোহন, সুশীল, প্রশান্ত, বিভাষ, অশোক এবং অমীয় | তিনি তাঁর বড় দাদা মনমোহন এবং বৌদি সর্জু দেবীর বড় আদরের ছিলেন | তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন রানীদি | সেইসময়ের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মনিন্দ্রলাল বসুর “সুকান্ত” গল্পটি পড়ে, তিনি তাঁর নাম রেখেছিলেন সুকান্ত |
তাঁর প্রিয় রানীদির জন্যই তিনি সাহিত্যকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন | কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর রানীদি তাঁর কোনো সাহিত্যকর্মই দেখে যেতে পারেননি, এর প্রধান কারণ তিনি খুব তাড়াতাড়ি মারা যান | তারপর দিদির মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই আবার তাঁর মা সুনীতি দেবীও পরলোক গমন করেন |
পরপর চোখের সামনে দুটো মৃত্যু, সুকান্তকে ভীষন শোকাহত এবং মর্মাহত করে তোলে, যারফলে তাঁর মানসিক অবস্থা পুরোপুরি বিদ্ধস্ত হয়ে যায় বেশ কিছুদিন | এই চরম শোকের মূহুর্তেই তিনি রচনা করে অনেক কবিতা | নিঃসঙ্গতার সময় সেইসব কবিতাই ছিলো তাঁর একমাত্র সঙ্গী
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কোলকাতার কমলা বিদ্যামন্দির থেকে | এখানেই তাঁর লেখা প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয় স্কুলেরই নিজেস্ব পত্রিকা “সঞ্চয়ে” | সেই স্কুলে তিনি বেশ কিছুবছর পড়াশোনা করেন, এবং তারপর তিনি ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে | এরপর ১৯৪৫ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি সেই পরীক্ষায় ফেল করেন |স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবি সুকান্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন | এই সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত হওয়ায জন্য, তাঁর পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটে । ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অনৈতিক ব্রিটিশ শাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর দল ভীষনভাবে সোচ্চার হন |
১৯৪৪ সালে তিনি এরপর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন | সেই বছরই “আকাল” নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তিনি সম্পাদনাও করেন এবং সেখানেই শোষিত মানুষের কর্ম জীবন, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম, সমাজের দুর্দশাজনিত বেদনা এবং শোষণ মুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে থাকেন |তাঁর সেই কবিতা সংকলন মানুষকে ভীষনভাবে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার জন্য | পরে সুকান্ত ভট্টাচার্য কোলকাতা রেডিও আয়জিত “গল্পদাদুর আসর” নামক এক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন | সেখানে তিনি প্রথমে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন | যখন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়, তখন সেই আসরেই তিনি নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধাও জানান |
মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি “রাখাল ছেলে” নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেছিলেন, যেটা পরে “হরতাল” নামক বইতে সংকলিত হয়েছিলো |
তাঁর সমস্ত রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো-
গ্রন্থতালিকা :
- ছাড়পত্র (১৩৫৪ ব.)
- (ছাড়পত্র,আগামী,রবীন্দ্রনাথের প্রতি,চারাগাছ,খবর ,ইউরোপের উদ্দেশ্যেপ্রস্তুতপ্রার্থী ,একটি মোরগের কাহিনী ,সিঁড়ি ,কলম ,দুরাশা , মৃত্যু ,আগ্নেয়গিরি ,ঠিকানা ,লেনিন , অনুভব ,কাশ্মীর ,সিগারেট ,দেশলাই কাঠি ,বিরতি ,চিল ,চট্টগ্রামঃ ১৯৪৩ ,মধ্যবিত্ত’৪২ ,সেপ্টেম্বর’৪৬ ,ঐতিহাসিক ,শত্রু এক ,মজুরদের ঝড়(ল্যাংস্টন হিউজ) ,ডাক ,বোধন ,রানার ,মৃত্যুজয়ী গান ,কনভয় ,ফসলের ডাকঃ১৩৫১ ,কৃষকের গান,এই নবান্নে ,আঠারো বছর বয়স ,হে মহাজীবন )
- ঘুম নেই (১৩৫৭ ব*)
- (শুরুতেই ,বিক্ষোভ ,পয়লা মে-র কবিতাঃ১৯৪৬ ,পরিখা ,সব্যসাচী ,উদ্বীক্ষণ , বিদ্রোহের গান, অনন্যেপায় ,অভিবাদন ,জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী ,কবিতার খসড়া ,আমরা এসেছি ,একুশে নভেম্বরঃ১৯৪৬ব,দিন বদলের পালা ,মুক্ত বীরদের প্রতি ,প্রিয়তমাসু ,ছুরি ,সূচনা ,অদ্বৈত ,মণিপুর ,দিকপ্রান্তে ,চিরদিনের ,নিভৃত(অনিশ্চিত পৃথিবীতে অরণ্যের ফুল) ,বৈশম্পায়ন ,নিভৃত(বিষন্ন রাত প্রসন্ন দিন আনো) ,কবে ,অলক্ষ্যে ,মহাত্মাজীর প্রতি ,পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশে ,পরিশিষ্ট ,মীমাংসা ,অবৈধ ,১৯৪১ সাল ,রোমঃ১৯৪৩ ,জনরব ,রৌদ্রের গান ,দেওয়ালী)
- পূর্বাভাস (১৩৫৭ ব*),
- (পূর্বাভাস ,হে পৃথিবী ,সহসা ,স্মারক ,নিবৃত্তির পূর্বে ,স্বপ্নপথ ,সুতরাং ,বুদ্বুদমাত্র ,আলো অন্ধকার ,প্রতিদ্বন্দ্বী ,আমার মৃত্যুর পর ,স্বতঃসিদ্ধ ,মুহূর্ত (ক) ,মুহূর্ত (খ) ,তরঙ্গ ভঙ্গ ,আসন্ন আঁধারে ,পরিবেশন ,অসহ্য দিন ,উদ্যোগ ,পরাভব ,বিভীষণের প্রতি ,ঘুম ভাঙার গান ,হদিশ ,দেয়ালিকা ,প্রথমবার্ষিকী ,তারুণ্য , মৃত পৃথিবী ,দূর্মর)
- অভিযান নাটিকা (১৩৬০ ব* )
- অভিযান(১৩৫০ সাল)
- সূর্যপ্রনাম(১৩৪৮ সাল)
- বইয়ের শেষে সচিত্র মঞ্চ নির্দেশনা।
- মিঠে-কড়া (১৯৫১ ইং)
- অতি কিশোরের ছড়া
- এক যে ছিল
- ভেজাল
- গোপন খবর
- জ্ঞানী
- মেয়েদের পদবী
- বিয়েবাড়ির মজা
- রেশনকার্ড
- খাদ্য-সমস্যার সমাধান
- পুরানো ধাঁধা
- ব্ল্যাক-মার্কেট
- পৃথিবীর দিকে তাকাও
- সিপাহী বিদ্রোহ
- আজব লড়াই
- হরতাল (১৩৬৯ ব* )
- লেজের কাহিনী(সোভিয়েট শিশুসাহিত্যিক ডি বিয়াঙ্কির ‘টেইলস’ গল্পের অনুবাদ)
- ষাঁড়-গাধা ছাগলের কথা
- দেবতাদের ভয়(ব্যাঙ্গার্থক নাটিকা)
- রাখাল ছেলে
- গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫ ইং)
- বেশ কয়েকটি গানের সংকলন।
- আকাল (১৯৪৪ ইং)
জীবনের তিনটি অংশেই সুকান্ত যেন অনিয়মকেই তাঁর জীবনের অঙ্গ করে তুলেছিলেন | একদিকে যেমন পার্টির কাজ, তেমনই অন্যদিকে সাহিত্যকর্ম, অভাব ও অনটন এইসব কিছুর ধকল তাঁর শীর্ণ শরীর আর মেনে নিতে পারেনি | অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করেন তাতে তাঁর শরীরে প্রথমে ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য যক্ষারোগ এসে হানা দেয় |
১৯৪৭ সালের ১৩ই মে তারিখে কোলকাতার ১১৯ নম্বর লাউডট ট্রিষ্ট্রের অন্তর্গত “রেড এড কিওর হোমে” তিনি অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন | মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ২১ বছর |
============//////১০০//////============
No comments:
Post a Comment