Thursday, 31 December 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆  নববর্ষ ২০২১  ∆∆∆∆∆∆∆∆
               দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
            কবিতা বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা
                    "  সেতু সাঁকো"
                             ২০২১

 
                "এ সময়ের কবিতা' 
             ২০২১ নববর্ষে প্রকাশ
====={===={=====================
     Doinik sabder methopath
     Vol - 239. Dt - 01/01/2021
       ১৫ পৌষ,১৪২৭. শুক্রবার
=================================
১.
খড় সন্ধ্যায়
খুকু ভূঞ্যা


হেমন্তের খড় বাঁধা সন্ধ্যা
গোটা একটা মাঠ নিয়ে একা
হাতে খড়ের আঁটি দিগন্তের দিকে চলে যাচ্ছে চোখ
ঠাকুরের পায়ে পড়ে থাকা ফুল দুর্বার মতো কেন অচলা হয়না সাধ
ধুনুচির ধুনোর মতো দীপের আলোর মতো অথবা
বোতলের গঙ্গাজলের মতো
কেন বন্ধন নেই
বেড়ার পর বেড়া নেই শেকলের পর শেকল ভেতরে বাইরে

কেন আটকাও না আমায়
কেন আদেশ করো না ফিরে এসো
গন্ডি ভেঙে বাউল হবার কোনো মহত্ত্ব নেই
ঘর খোঁজো, সংসার গুছাতে গুছাতে চুল পাকুক
স্থির হয়ে দেখো বার্ধক্য 

কিছু বললে না তাই
গন্ডি ভেঙে ছুটতে ছুটতে ক্যাকটাস স্বপ্ন দুচোখে
আর নক্ষত্রের তৃষ্ণা শিরায় শিরায়

*************************************
২.
এসো নিরাময়
সোমা প্রধান


অসুখের পাশে বসে আছি
বিষন্ন ক্যানভাস
এক টুকরো রোদ পড়েছে আজ
জানলার সার্সি গলে
পথ্যের মতো।

হাঁটু মুড়ে বসে ছিলো বয়েস
রোদের গন্ধে এইমাত্র উঠে দাঁড়ালো 
বিপন্ন ফুসফুস... 

এসো নিরাময়,বছর শেষে
জানলা খুলে দিচ্ছে নতুন সকাল।

************************************
৩.
আগামীর আলো
সোনালী মিত্র 


বিবর্ণ রংচটা দিনের আলোয় শুধুই আর্তনাদের ভাষা। 
ফেলে আসা সময়ের ঘরে হারানো জীবনের কথা।
 
কাঁটার বিষে রক্ত ঝরেছে মৃত্যুর মিছিলে
হারিয়েছে স্নেহ বন্ধন হারিয়েছে স্বজন নিদারুণ শোকে। 
অশ্রুঝরা পথের মাঝে আজো 
পড়ে আছে স্মৃতির দিনলিপি।
 
চাইনা ফিরে তাকাতে চাইনা হিসেব মেলাতে
রাত্রি শেষে নতুন আলোয় 
এগিয়ে যাব আগামীর হাত ধরে।

****************************************
৪.
সীমারেখা 
অপর্ণা দেওঘরিয়া


একটা সীমারেখা টেনে দিলে ইচ্ছেরা মরে না,
গন্যমান্য মানুষ বড় সামীয়ানা টাঙ্গায়,
রঙ্গীন পতাকায় উদ্বোধনে ঝড় বয়ে যাই
মুমুর্ষু হৃদয় যেন বিঙ্গাপনের ছবি সাজায়।
 
তালাবন্ধ কথারা জ্বলে উঠে দলবেধেঁ
শ্রুশুষার আরোগ্য নিকেতন আস্তবল বাড়ায়।
শান্তপ্রিয় ছোড়দি একমনে রবীন্দ্রনাথ পড়ে
সংকীর্ণতার অহং ব্যর্থ জীবনে যুদ্ধ ছড়ায়।

ভালোবাসা মরিচীকার মত বাসা বাঁধে
পিসিমা কাকিমার টিভি সিরিয়াল জুড়ে,
দিনান্তের হিসাব স্বতঃপ্রনোদিত কৌশলে
নির্ভরশীলতার ক্ষমা ভরা হাত সরে যায় দুরে।

*******************************†****
৫.

স্বপ্ন হলেও সত্যি হোক 
কোয়েলী বসু


বর্ষশেষে পশ্চিম দিগন্তে
শুনি বিদায়ের সুর,
ঝুপ করে ডুব দিল রবি ,
বলে,আসছে নতুন সুর।

তুলসী তলায়,ঘরের কোণে 
জ্বলল সাঁঝের বাতি ।
কিচিমিচি কলরবে
বাসায় সহস্র জীবনসাথী ।

ব্যস্ত জীবন গান গায় ,
সাঁকোর এপারে দাঁড়িয়ে
মৃত্যু হাসে ক্ষণে ক্ষণে 
তখন ওপারে হাঁকিয়ে।

সময়ের বোঝা কাঁধে নিয়ে
মহাকাল চলে বয়ে,
চোখের জলে ভাসাই 2020,
 2021এসো ,চোখ মুছিয়ে ।

***********************************
৬.
একবিংশে একুশে
বীথিকা পড়ুয়া মহাপাত্র



সারা বছর জুড়ে মৃত্যুর ছায়াছবি দেখিয়ে গেল
দু'হাজার বিশ!
এঁকে গেলো অসহায় মারী আতঙ্কিত জীবনে
ভাঙাকুলোর চালচিত্র!
উপহার দিল কুড়িজন সীমান্তরক্ষীর গুলিবিদ্ধ
বাক্সবন্দী কফিন!
চারিদিক থেকে মৃত্যু মিছিল রেশনের লাইনের মতো
উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব,পশ্চিম!

রক্তে মিশিয়ে দেওয়া অবিশ্বাসের ছ্যাঁকার 
কালশিটে দাগ
প্রতিটি ভাঙামনের খসে পড়া পলেস্তরা জুড়ে!
পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া পূর্ব ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে গেছে বিষের বিশ!

মৃত্যুকে মৃত্যু দিয়ে চিনে নেওয়া!
সুস্থকে অসুস্থ মনে করে চরম অবমাননা!
উড়ো খইর মতো উড়ছে প্রেম-প্রীতির বন্ধন!
গতদিনের টুটে যাওয়া ব্যর্থ পরিসংখ্যান
কে আর দিতে বসে?
নষ্ট সাল চলে যাক্! দূর হয়ে যাক বিবমিষা!

একবিংশের একুশ,আর বিঘ্নতা- বিপর্যয় নয়! 
তোমার হাতে থাক উত্থানের নবপত্রিকা!
কন্ঠে থাক সম্ভাবনার সোপান,
একটা পাপমুক্ত নির্লোভ সত্যযুগের আগমনের প্রতিলিপি হাতে এসে দাঁড়াও একগুচ্ছ
প্রত্যাশার বাজেট নিয়ে!

এ বিধ্বস্ত ধরা শান্তির প্রলেপ মেখে
নবজন্ম দিক চির আকাঙ্খিত পৃথিবীর!
স্বাগতম একুশ!
***************************************
৭.
বিদায় বিষ সাল
নীতা সরকার।

        

আজ 2020কে জানাই বিদায়
আজ রাতে শেষ হবে তোমার রাজত্ব।

তুমি নিয়ে এসেছো অতিমহামারি
নিয়ে এসেছো আমফানের মত দুরন্ত একটা ঝড়। 

মানুষের গতিময়তার ব্যস্ত জীবন যাত্রায় 
তুমি লাগাম পড়িয়েছো। 

ট্রেন, বাস, প্লেন সব বন্ধ করেছো তুমি
বন্ধ করেছো মানুষের কর্ম জীবন। 

লকডাউন নামক একটি শব্দের জন্ম দিয়েছো। 
তুমি করেছো সকল মানুষকে গৃহবন্দি। 

বন্দি মানুষদের মুখে পড়িয়েছ মুখোশ
কত মানুষের জীবন নিয়েছো তুমি। 

তোমার অত্যাচারে খসে পড়ল
কত উজ্জ্বল তারারা। 

মানুষের মানুষের যে ভালোবাসার
সম্পর্ক করেছো তুমি বিচ্ছেদ। 

তোমার দাপটে সারা পৃথিবীতে
হাহাকার পড়ে গেছে। 

তাই এই অভিশপ্ত 2020কে বিদায় জানিয়ে
আমন্ত্রণ জানাই 2021শের নতুন সূর্যোদয়কে।

2021শে সকলের জীবন হয়ে উঠুক মধুময়
সকলকে জানাই হ্যাপি নিউ ইয়ার।


================================











Wednesday, 30 December 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
             অনুনাটক সংখ্যা (০৬)

                 "ফসলের গান"
=================================
      Doinik Sabder Methopath
       Vol -237. Dt -31.12.2020
        ১৫ পৌষ, ১৪২৭. বৃহস্পতিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷


=================================

১.
ফসলের গান
নন্দিনী সরকার 


পরমজিত - ধরম জী, কি ভাবলেন যাবেন ঐ আন্দোলনে? কৃষি নিয়ে যা সব আইন বেরোচ্ছে, তাতে তো আমরা ধনে প্রাণে মারা পরবো।

ধরম জী- আরে যাবো না মানে? ভারতবর্ষের সবুজ বিপ্লব যেমন আমরা করেছিলাম, তেমনি কৃষকদের ওপর অবিচারটাকেও আমাদেরই চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো দরকার।

পরমজিত- আরে আমার কাকা জী, ফুফাজী সব তো ওখানে যাবার জন্য অস্থির হয়ে পরেছে। ওদের বয়সটাও তো আমাকেই দেখ্তে হবে ধরম জী।

ধরম জি-- ভাই, আমাদের জান প্রাণ হলো ফসল, মাটি হলো মা। তা সেই জানে যদি টান পরে, তাহলে বয়সের কথা আর খেয়ালে থাকে না। আচ্ছা বলো তো আমরা এই জন্যই কি স্বাধীনতা এনেছি দেশে??

পরমজিৎ - চাচা ও সেই কথাই বলছিল। মাঠ জুড়ে ফসল হলে যেদিন ফসল তোলা হয় সেই দিন রাতে সবাই ভাংড়া নাচে আর গান গায়।

ধরম জি-- জানো ভাই, দিল্লিতে যেখানে সবাই ধর্নাতে বসেছে , সেখানে রাত ভোর ঐ গানই করা হচ্ছে।
"জান কবুল আর মান কবুল
আর দেবো না আর দেবো না
ধান, মোদের প্রাণ গো"।

--------------------/---------------------

২.
ফসলের গান 
গোবিন্দ মোদক 


(কুশীলব : শিবু ও রহিম। দু'জন আঞ্চলিক কৃষক-ভাই)

রহিম- ও কর্তামশাই ! আপনের ধানের খবর কি ?

শিবু- ভালো রহিম ভাই ! বলতে কি, এবার ফলন খুবই ভালো। গোলাভরা ধান -- তাই নবান্ন-পরবটাও হয়েছে খুব জমিয়ে ! 

রহিম- হ্যাঁ, কর্তামশাই, শুনছি ! আমাগো বদর বলছিল বটে !

শিবু- তা, তোমার চাষাবাদের খবর কি রহিম ভাই ?

রহিম- আপনাগো আশীর্বাদে খারাপ না কর্তামশাই! চার বিঘা ছোলা লাগাইছিলাম, আর বিঘা-পাঁচেক কলাই। বাদবাকি সরিষা। এহনও পর্যন্ত যা দেখতাছি তাতে বুঝছি ফলন ভালোই হইবো। আপনি তো শুনছি গম, মুসুর আর তিল রবিশষ্য লাগাইছেন।

শিবু- হ্যাঁগো মিঞা, ওই যা মুসুরি হয় তাতে আমার সম্বৎসর চলে যায় ; আর একে ওকে খেতে-ও দিই খানিকটা।

রহিম- সে আপনের দিল আছে গো কর্তা ! হক্কলে তাই কয় ! তা আপনের ছোট ভাইডা শুনছি সবজি চাষ কইরা খুব লাভবান হইছে !

শিবু- ঠিকই শুনেছো রহিম-ভাই। ওর তো এক লপ্তে অনেকখানি জমি -- আর অনেকগুলো শ্যালো। তাই যেমন হয়েছে ওর বেগুন, তেমন কপি, পালং, আর মুলো ! কড়াইশুঁটির দাম এবার খুব ভালো, ভাইটা অনেকগুলো টাকার মুখ দেখলো এবার।
 
রহিম- ঠিকই কইছেন কর্তা। সবজি-চাষীরা এদ্দিন পর দুইডা টাকার মুখ দ্যাখছে। আচ্ছা, আসি গো কর্তা, ভাল থেইকেন ! আদাব !

শিবু- হ্যাঁ, তুমিও ভালো থেকো রহিম ভাই, নমস্কার।

----------------------/-----------------

৩.
নাটক - সম্বল
রচয়িতা - বিমল মণ্ডল 


 চরিত্র চিত্রণ
---------------- ------
মণ্টু - দরিদ্র কৃষক 
মনি- কৃষকের বউ
হিরন্ময় দাস- গ্রাম সেবক(নেতা)
পবিত্র- আর এক দরিদ্র কৃষক
সুধাংশু - সুদখোর মহাজন

(মাঠে মাঠে ধান তোলা হচ্ছে। সেখানে দরিদ্র কৃষকদের মুখে সামান্য হাসি দেখে সুদখোর মহাজন এসে তাঁর পাওনা চাইছে এবং সমাজসেবী নেতাও এসেছে কৃষকদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে ।) 
মন্টু- আরে এবছর যে ধান হয়েছে। মোটামুটি এইবছর চলে যাবে মনে হয়।কি বলো বউ?

মনি- সে তো হবে। কিন্তু মহাজন বাবুকি তোমায় ছাড়বে? (মাথা নিচু করে আবার ধান কাটতে থাকে।) 
মন্টু - (ধান কাটতে কাটতে বলে) এবছর এতোদিন আমরা লকডাউনে ঘরে বসে আছি। তার উপর কাজ নেই। সেই কথাই বলবো । যে এবছর আমাদের ছাড় দিন। 

মনি - সে কথা কি ওরা শুনবে। দেখো হয়তো আজই ওরা এখানেই চলে আসবে। আসলে ওদের দেখলে ভয় হয় আমার। এই মনে হয় যেন কিছু একটা বিপদ হবে। 

মন্টু - সে কি আমার হয়না বউ? হয় কি করি বলো দুটো মেয়ে মাথার উপর । তার উপর কাজ নেই। কি যে করবো ভাবতে পারি না। 

মনি- এতো ভেবে শরীর খারাপ করো না। যা হবে ঠিক হবে। 
(সুধাংশু বাবু, হিরন্ময় বাবু পবিত্র কথা বলতে বলতে প্রবেশ করেছে) 

সুধাংশু বাবু- দেখো পবিত্র এবছর এসব বলো না। সবটাই আমাদের ভাগ দিতে হবে। 
পবিত্র - না দাদা। এবছর পারবো না। আমরা যে মরে যাবো দাদা। একে এই লকডাউনের বাজারে কাজ নেই। ঘরে ছেলে মেয়ে , পরিবার না খেতে পেয়ে মরে যাবে যে দাদা...
হিরন্ময় - কেন? কেন? মরে যাবে কেন? রেশনে বিনেপয়সাতে এতো সাহায্য করছে সরকার । তাতে মরে যাবে কেন?
সুধাংশু - হ্যাঁ ঠিক বলেছেন হিরন্ময় বাবু। আমি অতসব বুঝি না। আমি আমার সব হিসেব নিয়ে চলে যাবো । 

হিরন্ময় বাবু -(মন্টুকে দেখে) এই যে মন্টু বাবু। তোমার সব ধান তোলা হলো? সুধাংশু বাবু এসেছে সব হিসাব করে নিয়ে যাবে বলে। 
মন্টু- না...মানে... হিসেব মানে...
সুধাংশু -এটাও বোঝো না? আমার জমিতে চাষ করো আর এটা বোঝো না? 

মণ্টু - (কেঁদে কেঁদে) - এবছর তো অতিমারি গেল বাবু। এবছর একটু ছাড় দিন। 
পবিত্র- মন্টু দা ঠিক কথা বলছেন। আমরা গরীব তাই এবছরের কথা ভেবে ছেড়ে দিন আমাদের । 

হিরন্ময় বাবু - (শাসিয়ে) - চুপকর।মুখে মুখে কথা। কেন ছাড়বে শুনি? সুধাংশু বাবু আপনি একদম ছাড়বেন না। ওদের প্রচুর মুখ হয়েছে দেখছি।
সুধাংশু বাবু - আচ্ছা তোমরা আজ আমাকে এমন বলছো কেন? সরকারি অনুদান যেমন -আমফানে, রেশনে, ইত্যাদি পাচ্ছো তো। তাহলে আমার হিসাব টা দিয়ে দাও। 

(আমফান আর রেশনের কথা শুনে মন্টু চোখ বড়সড় করে বলে)
মণ্টু - আমফান? রেশন?...এসব কি আমরা পাই বাবু? দেখুন না আপনি আমফান ঝড়ে ঘরটা উড়ে গেছে। একটি পলিথিন পর্যন্ত দেয়নি বাবু। আর ঘর সারানো টাকা?
পবিত্র - হ্যাঁ দাদা। আমরা কিছুই পাইনি । যাদের ঘর ভাঙ্গেনি তারা ঐ টাকার অংশ পেয়েছে । আর রেশন? 
তাতেও আমরা বঞ্চিত । 

হিরন্ময় বাবু -(রেগেমেগে চিৎকার করে) তোরা কিন্তু মিথ্যা বলছিস। আমি আজই গিয়ে দেখবো তোরা এসব পেয়েছিস কিনা। 

সুধাংশু বাবু - আমি সব জানতে চাই না। রাজনীতিতে আমার আবার এলার্জি আছে কিনা... কি বলেন হিরন্ময় বাবু?( দুজন চোখে চোখে মৃদু হাসি)
হিরন্ময় বাবু - ঠিক বলেছেন আপনি। এদের এই মায়া কান্নায় কান দেবেন না। হিসেবে যা পান নিয়ে নিন। আর দেরি করা যাবে না। অনেক কাজ আছে। 

মন্টু,পবিত্র (সুধাংশু বাবুর পায়ের কাছে বসে কাঁদতে থাকে) - দেখুন। এবছর মাপ করে দিন। এই টুকু তো সম্বল আমাদের । সব দিয়ে দিলে কি থাকবে বলুন? না খেয়ে আমরা মরে যাবো যে। 

হিরন্ময় বাবু -অতকথায় কাজ নেই আর। সুধাংশু বাবু আপনার লোকদের ডাকুন। বস্তাতে সব ধান ঢুকিয়ে নিক। 
সুধাংশু বাবু ( তাঁর লোকদের ধান তুলে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন) কে আছিস! এদিকে এসে এই ধান গুলো তুলে নিয়ে যা। 
(মন্টু, পবিত্র, মনি কাঁদতে থাকে) 

মনি- আমার শেষ সম্বলটুকু নিয়ে যান...
(কান্নার শব্দ ভেসে আসে। আলো নিভে যায় ।)

----------------------/-------------------

৪.
ইচ্ছে পূরণ 
কোয়েলী বসু।


তৃপ্তি- শুভ একটু তাড়াতাড়ি এস।নীচে প্রবীর বাবুর সঙ্গে বেশ কয়েক জন এসেছেন বাড়ি বিক্রির বিষয়ে কথা বলতে।
শুভ- তৃপ্তি এত ডাকাডাকি করছ কেন? আমি বাড়ি বিক্রি করব না।
তৃপ্তি- সে কি কেন? আমরা বিদেশে চলে যাওয়ার পরেই বাড়ির কী হবে ভেবে দেখেছ?হঠাত এই সিদ্ধান্ত নিলে? কিছু হয়েছে?
শুভ - এই চিঠিটা পড়ে দেখ।
তৃপ্তি- " প্রিয় মিতা কেমন আছ তোমরা? আমি ভালো থাকার চেষ্টা করছি।দেশের মানুষ ভালো থাকলে আমরাও যে ভালো থাকি।আমার গাঁয়ের সোনার ধানের গন্ধ পাচ্ছি, এবার ফসল তোলার উত্সবে কী গান বাঁধলে? খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। ঐ সময়ে বাড়ি যাব,এবার ধার শোধ করে বাড়িটা বানাব আরো সুন্দর করে।খোকা,বাবা, মাকে নিয়ে খুব ভাল থেকো।চিন্তা করো না,আমি আসছি তাড়াতাড়ি ।"
শুভ- আমার সিপাহী বাবা এসেছিলেন ফসল ওঠার উত্সবের দিন,দেশের পতাকায় ঢাকা কফিনের বুকের ভিতর আগলে।ঐ গাঁয়ের মাটিতে,সোনার ধানের গন্ধে মিশে গেলেন শহীদ নবীন চন্দ্র মজুমদার।মা গেয়ে উঠলেন বাবার পছন্দের ফসলের গান।
তৃপ্তি - হ্যাঁ শুভ আমি শুনেছি ওটাই ছিল তোমার মায়ের লেখা শেষ গান।
শুভ- হ্যাঁ গো আমিও তাই জানতাম ।কিন্তু এই দেখ।
তৃপ্তি- এতো বিরাট মোটা খাতা আর একটা চিঠি।
শুভ - হ্যাঁ আমার মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণের চিঠি।
আজ যাঁরা এসেছেন প্রবীর বাবুর সাথে,তাদের সাথে কথা হয়েছে এই বাড়িটি আগামী প্রজন্মের জন্য একটি স্কুল হবে এবং প্রতি বছর এখানে গ্রামের ফসল উত্সব পালিত হবে।মায়ের এই গানের খাতা টাও তখন তাদের কাজে লাগবে।

----------------------/---------------------
৫.
       একেই বলে বিপন্নতা 
        তপনকুমার গোস্বামী 


( রোদ ঝলমলে সকাল। মাটির দাওয়ায় দেওয়ালে ঠেস দিয়ে নড়বড়ে শরীরে বসে আছে পবন)
(আবহ সঙ্গীতে বাঁশির সুর)

পবনঃ লকাই, বলি ও লকাই, 
           বাপ আমার। আমারে এট্টু 
           জমির পানে নে চলনা 
           বাপ। 
লকাইঃ হুঁ! নিজে নড়তে পারেনে, 
             তার আবার জমির পানে 
              যাবার সখ কত! বলি 
               জমির পানে গিয়ে কী
              হবেটা শুনি! 
পবনঃ অ বাপ, তুই খামোকা রাগ 
          রাগ করচিস কেনে!তোদের  
          মুখে শুনলু ইবারে জমিতে
          খুব ভালো ধান হইচে। তাই
          একবার চোকের দেকা 
          দেকতি সাধ হয়। 
লকাইঃ ( যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে)বেশ
             চল। তবে এই একদিনই। 
[লকাই পবনকে জমির ধারে আলের ওপর বসিয়ে দেয়। কোমর ভাঙ্গা নড়বড়ে পবন নিজের মনে বকতে থাকে ]
পবনঃ আহা-হা!পরানটো ভরি 
           গেলরে বাপ। মা নক্কী 
           ক্ষেত এক্কেরে আলো
            করে বইসে আচে। 
            শুনচিস লকাই সোনার
            ফসলে কেমুন ঝমঝম 
             করি গান বাজতেচে! 
[পবন তন্ময় হয়ে বসে থাকে। দূর থেকে বাঁশির সুরে পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে বাজে ]
পবনঃ হ্যাঁরে বাপ, ফসল তোলার 
           সুর বাজতেচে কুথায়!
লকাইঃ ফসল কাটবার লেগে 
             কামিনরা আসতিছে। 
              উয়ারাই গাইচে। 
[মহাজন বৈকুন্ঠ সঙ্গে লোক নিয়ে প্রবেশ করে ]
বৈকুন্ঠঃ আরে! এযে এক্কেরে 
             চাঁদের হাট! বাপ-বেটা 
              লগেলগে। তা পবন, 
               আছ কেমুন?
পবনঃ আজ্ঞে কত্তা এখুনও মরি
            লাই। 
বৈকুন্ঠঃ(খিকখিক করে হাসি) সে
             তো দেখতেই পাচ্ছি। তা
              ভাঙ্গা কোমরে লিয়ে
               জমিতে কেনে? 
লকাইঃ আজ্ঞে কত্তা, আইজ ধান
             কাটা হবেক। তা বাপ 
              কইল কী ভরা খেতিটো
               একবার নিজের চোকে 
             দেখবে। তাই.... 
বৈকুন্ঠঃ কী কইলি লকাই! ধান 
              কাটা! ই ধান কী তুদের
              যে কাইটবি! 
লকাইঃ এজ্ঞে কত্তা, আপনের 
             কুথাটো বুঝতে লারলাম।
বৈকুন্ঠঃ ( মেজাজ দেখিয়ে) তা 
              বুঝবি কেনে!বলি চুক্তি -
              চাষের দাদনের শর্তটা 
               কী ভুলে গেলি!ই ফসলে
                তোদের কুনো হক 
                লাইরে। কুনো হক লাই
                ( হাসি)
              [বাঁশিতে বিষাদের সুর]

  ----------------------/--------------------/-------------------
৬.
পৌষের কাছাকাছি
--------------------------------
দেবাশিস চক্রবর্ত্তী
----------------------------------------
বসির - আরে ওটা কে যায় ! শিবু না ? এ-এই শিবু ,ইদিকে শোন ।
শিবু - কি গো বসির চাচা , চললে কোথায় ?
বসির - খামারে যাবো বাপ । ফসল উঠছে যে । ঝাড়াই বাছাই করে খামার থেকে গোলায় তুলতে হবে রে বাপ ।
তা তুই কোথায় যাবি এখন ?
শিবু - ইস্টিশনে যাবো গো চাচা , আজ মোর বাপ ঘরকে ফিরছে যে । 
বসির - এ্যাঁ বলিস কি রে বাপ , এতদিন পরে তোর বাপ - হরে ফিরছে ঘরে !
শিবু - হ্যা গো চাচা , বাপের কারখানায় তো এখন লক্ আউট হয়ে গেছে । কবে খুলবে ঠিক নেই । তাই -
বসির - হ্যা - হ্যা ,চাষির ছেলে, চাষ না করে চললো শহরে,
বাবুর বাড়ির গুঁতো খেয়ে
ফিরলো সে ঘরে ।
শিবু - আহঃ চাচা, তোমার এই কথায় কথায় ছড়াকাটার গুনটা বড়ো মজার গো ।
বসির - কথাটা ঠিক কিনা বল ? বাপ চোদ্দ পুরুষ যে জমিতে চাষ করেছে , সেই জমিতে সোনার ফসল ফলিয়ে মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার যে আনন্দ ,সে কি আর মাপা যায় রে বাপ ।
শিবু - ঠিক বলেছো চাচা ।
বসির - শোন বাপ, আজ সন্ধ্যা বেলা তোর বাপকে নিয়ে আমার খামারে যাস । তোর বাপ হরে আমার ছোটো বেলার বন্ধু রে বাপ । কাদা মেখে মাঠেঘাটে কতো খেলে বেড়িয়েছি । ল্যাঠা, চুনো, কৈ ধরিচি ক্ষেতখামার আর ঝিল পগারে ।
শিবু - জানি চাচা, ঠিক আছে আসবোখন ।
বসির - এ বছর ফসল বড়ো ভালো হয়েছে রে বাপ, সন্ধ্যা বেলা তাই সকলে মিলে একটু আমোদ করব । খাওয়া দাওয়া হবে ,নাচ হবে আর হবে ফসলের গান ।
শিবু - ঠিক আছে চাচা ।
বসির - ওরে শিবু , আজ পৌষের কাছাকাছি, তোরা আছিস আমি আছি ।
আয় পরবে জড়িয়ে বুকে
ভরাই মোদের প্রাণ,
সবাই মিলে একসুরে গাই
আজ ফসলের গান ।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆



দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
     জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
                  জাতীয় শিক্ষক
                  ঈশ্বর চন্দ্র প্রামাণিক
=================================
          Doinik sabder methopath
          Vol - 236. Dt - 30.12.2020
            ১৪ পৌষ,১৪২৭. বুধবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
      অখন্ড মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার অন্তর্গত খেজুরি থানার জরারনগর গ্রামে এক দরিদ্র ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ( বাংলা ১৪ পৌষ,১৩১৯) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ধরণীধর প্রামানিক ও মাতা রাইমণি দেবীর একমাত্র সন্তান তিনি।
      গ্রামে পাঠশালা না থাকায় প্রতিবেশী পঞ্চানন প্রধানের বাড়িতে আদর্শ শিক্ষক রঘুনাথ বেরা শিক্ষকতায় প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু করেন পরে চতুর্থ শ্রেণীতে হেঁড়িয়া শিবপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন এ ভর্তি হন ১৯২৫ সালে। আদর্শ শিক্ষক যতীন্দ্রনাথ জানার সান্নিধ্য লাভ করে স্বদেশ সেবায় উদ্বুদ্ধ হন এবং ২৬ শে জানুয়ারি ১৯৩০সালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে দেশকে স্বাধীন করার সংকল্প গ্রহণ করেন. জড়িয়ে পড়েন লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে, বিক্রি করেন লবণ ও বুলেটিন রণভেরী, ১৯৩২ সালে তিনি প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। আর্থিক অনটনের কারণে কিছুদিন পড়ায় ছেদ পড়ে। পরে ঠাকুরনগরে গড়ে ওঠা শ্রীগৌরাঙ্গ জাতীয় বিদ্যালয় কিছু দিন পড়াতে থাকেন। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে ইংরেজরা স্কুল ভেঙে দেয় ফলে ঈশ্বরচন্দ্রের ঠিকানা হয় 24 পরগনার একটি রাইস মিলে হিসাবরক্ষকের দায়িত্বে। ১৯৩৩ সালে বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী নিকুঞ্জ বিহারী মাইতি এবং আদর্শ শিক্ষক পূর্ণেন্দু শেখর ভৌমিক ও তার অন্তরঙ্গ বন্ধু উপেন্দ্রনাথ প্রধানের পরামর্শে আবার লেখাপড়া শুরু করেন। পরে মা রাইমনি দেবীর অনুরোধে ভগবানপুর এর গান্ধীবাদী জননেতা ভীমা চরণ পাত্র ঈশ্বরচন্দ্রের জন্য দশগ্রাম এম .ই স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তিনি লেখাপড়া শুরু করার মনস্থ করায় ওখানে যোগদান না করে ১৯৩৫ সালে আই. এ পাশ করেন কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজ থেকে। ওই সময় তিনি কাঁথি রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী মঙ্গল আনন্দের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বামীজীর আদর্শে পথ চলার শপথ গ্রহণ করেন এবং স্বামী বিজ্ঞানানন্দ দীক্ষা গ্রহণ করেন পরবর্তীতে শিব জ্ঞানে জীব সেবা আদর্শ কে সামনে রেখে জীবনের পথ চলতে থাকেন। তিনি ভর্তি হন কলকাতার আশুতোষ কলেজে স্নাতক শেষ করে ইংরেজিতে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই জোগাড় করতে থাকেন একদিকে উচ্চশিক্ষার আগ্রহ অন্যদিকে সাংসারিক কর্তব্যবোধ শেষ পর্যন্ত উচ্চশিক্ষায় চাকুরীতে নিযুক্ত হওয়ার সংকল্প সরকারি ও বেসরকারি নানাক্ষেত্রে সুযোগ থাকলেও তিনি শিক্ষাবৃত্তি কে গ্রহণ করেন। ফতেপুর সৃণাথ ইনস্টিটিউশন হেঁড়িয়া শিবপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন দশগ্রাম সতীশচন্দ্র শিক্ষা সদন ঠাকুর নগর নন্দা মহিলা বিদ্যাপীঠ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ আসীন ছিলেন। ১৯৩৮ সালে তরুণ জননেতা সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ। ১২ এপ্রিল তারই আমন্ত্রণে প্রথমে তমলুক কাঁথি যাওয়ার পথে মুগবেড়িয়া এবং পরে জোড়ার নগর গ্রামে আগমন সম্বর্ধনা জ্ঞাপন এবং পরবর্তীতে তার স্মৃতিধন্য শিল্প ভারতে গড়ে তোলেন। ১৯৪০ সালে তার জীবনে এক স্মরণীয় অধ্যায়ে সূচিত হয়। ১৮ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে সবং থানার দশগ্রাম সতীশচন্দ্র শিক্ষা সদন যোগদান করেন। সুদীর্ঘ ৪১ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ৩৯ বছর তিনি অতিবাহিত করেন এই বিদ্যালয়. অবশেষে সেই দিন আসে ১৯৬৪ সালে তিনি সম্মানিত হন রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ  কতৃর্ক জাতীয় শিক্ষক সম্মাননা।
  আজীবন ঐক্য ও সংহতির প্রতীক এই মানুষটি বৃহত্তর কল্যাণ অর্থে পরস্পরের প্রতি সহনশীলতাকে জীবনের নিয়ম মেনে কাজেও কর্তব্যে এগিয়ে চলেছেন। গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত এই মানুষটি আবিষ্কার করেন এটম চরকা। বহুভাবে উদ্যোগ নিয়ে তিনি গান্ধীজিকে মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় এনেছেন ।এদের মধ্যে অন্যতম কৃষ্ণনগর গ্রাম ৩রা জানুয়ারির ১৯৪৬ সাল.
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয় ওই বছর তিনি ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.টি পাস করেন। ১৯৪৭ সালের ৩১ অক্টোবর খেজুরি থানার নগরে গঠন করেন জরারনগর সুভাষ শুভাগমন স্মৃতি সংরক্ষণ সমিতি। যেখানে শিক্ষা ও সংস্কৃতির সমন্বয়, বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে আত্মনির্ভরশীলতা উপযোগী শিল্পকর্ম ,প্রাক বুনিয়াদি বিভাগ, নিম্ন বুনিয়াদী বিভাগ, উচ্চ বুনিয়াদি বিদ্যালয়, সুভাষপল্লী  কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভবন, সুভাষ শিল্প শিক্ষালয়, সুভাষ স্মৃতি পাঠাগার, খাদি ও গ্রামোদ্যোগ ,নারী কল্যাণ শিশু কল্যাণ কেন্দ্র স্বাস্থ্যসেবাসত্র সুভাষ ব্যায়ামাগার সংগ্রহশালা প্রভৃতি।১৯৫৭ সালে এই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি রেজিস্ট্রিকৃত নাম হয় সুভাষ শিল্প ভারতী। ১৯৫১ সালে তিনি ঠাকুরনগর শ্রীগৌরাঙ্গ মেলায় প্রকাশ্য দিবালোকে জুয়া খেলা দেখতে পেয়ে প্রতিবাদে অনশন সত্যাগ্রহ শুরু করেন, তদানীন্তন মহকুমা শাসককে দিয়ে আইন প্রয়োগের দাঁড়ায় প্রতিবিধান হওয়াতে ২৮এপ্রিল ইশ্বরচন্দ্র ৬৪ ঘন্টার অনশন ভঙ্গ করেন।
অন্যান্য নানা নেশার মধ্যে ফটোগ্রাফিতে তার দক্ষতা আমাদের চোখে পড়ে। মাসিক ভারতবর্ষে বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো এবং ওরা কাজ করে এবং আনন্দবাজারে ধান্য ছেদন ছবি ছাপা হয়েছিল তারই তোলা খেয়াঘাট আলোকচিত্রের প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন তিনি এছাড়া বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ও ডাকটিকিট সংগ্রহ তার অন্যতম ছিল।
  ১৯৪৮ সালে মহাত্মার মহাপ্রয়াণে গ্রন্থ রচনা করেন।এছাড়া সাধ ও সদাচার ,শুদ্ধ বাংলা বানান ,বিদ্যার্থীর বিদ্যাসাগর , বিশ্ব গুরু মহাত্মা গান্ধী , পাছে ভুলে যাই, গান্ধীজি ও নেতাজি, সর্বাধিনায়ক ভীমাচরণ , শশী বাবুর সংসার প্রভৃতি রচনা করেন।
সাংগঠনিক প্রতিভার কারণে বহুবিধ সংস্থার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি ,সর্বোদয় মন্ডলের সহ-সভাপতি পশ্চিমবঙ্গ আচার্য কুলের সহ-সভাপতি, কেন্দ্রীয় আচার্য কুলের কার্যকরী সদস্য, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সদস্য, ভূদান যজ্ঞ আন্দোলনের নেতৃত্ব, সুভাষ মেলা ও প্রদর্শনী সাধারণ সম্পাদক প্রভৃতি।
 ১৯৭৮ সালে সুদীর্ঘ কর্ম জীবন থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
 নানাভাবে সম্মানিত হয়েছেন
যদুনাথ মুখোপাধ্যায় সমাজসেবা পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গ গান্ধী মেমোরিয়াল কমিটি প্রদত্ত গান্ধী পুরস্কার সাহিত্য সেবায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক পুরস্কার দূরদর্শন কলকাতা কর্তৃক প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী সম্বর্ধনা  ( ১১ আগস্ট, ১৯৯৭ ) প্রভৃতি।
  পরিবারের দুই পুত্র কমল কুমার প্রামাণিক ও কানন কুমার প্রামানিক ।
  জীবনে বহু মনীষীও ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছেন। 
 ২০০২ সালের ২২ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে ৯০ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।
   দৈনিক শব্দের মেঠোপথ পত্রিকার পক্ষ থেকে জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে আমরা আদর্শে অনুপ্রাণিত হলাম।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Monday, 28 December 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
      বিশেষ আলোচনা পর্ব

         বিভূতিভূষণের "রমা"
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
     Doinik Sabder Methopath
     Vol -236. Dt -29.12.2020
       ১২ পৌষ,১৪২৭. মঙ্গলবার
=================================

কিছু না হোক, অন্তত একটি সুবিধে আপনি হয়েছিল৷ সেই ১৯৩৯ সালের গোড়ার দিকেই রমা ম্যাট্রিক সেশন পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ করতে পেরেছিল এবং সফলও হয়েছিল৷ কিন্ত্ত ষোড়শীকান্তের বদলির নোটিশে মেয়ের উচ্চশিক্ষার সম্ভাবনাটি মুলতুবি হয়ে রইল৷ মাতৃহীনা কন্যাটি কলেজে পড়বে, এবং অতঃপর তার জন্য উপযুক্ত পাত্র সন্ধান করবেন, এমনটাই ভেবে রেখেছিলেন ষোড়শীকান্ত৷ কিন্ত্ত বনগাঁয় কাজ করতে গেলে, সে সন্ধান বিঘ্নিত হবে জানতেন, অথচ নিরুপায় তিনি৷ কী ভাগ্যিস বড়োটির বিবাহ হয়ে গিয়েছিল৷

রমার অবশ্য কোনও হেলদোল তাঁর চোখে পড়ল না৷ তা সত্ত্বেও সংবাদটি তাকে জানিয়ে বললেন, সরকার যদি বদলি করে, আমার তো না গিয়ে উপায় নেই৷ কিন্ত্ত তোর জন্যই যে চিন্তা মা৷
রমা একই সঙ্গে বুদ্ধিমতী ও আন্তরিক মেয়ে৷ দেখতে শুনতেও সুশ্রী৷ গায়ের রং শ্যামবর্ণা বটে, তা হলেও সুগঠিত, স্বাস্থ্যবতী এবং স্বভাবে নম্র, ভদ্র এবং খুবই অনুভূতিশীল মেয়ে৷ জানে, বনগাঁ যাওয়ার ব্যাপারে সে যদি সামান্য আপত্তিও করে, বাবা মানসিক ভাবে বিচলিত হবেন এবং শুধু তাই না, হয়তো কোনও ভাবে রমার কলকাতায় থাকার আয়োজনও করতে পারেন৷ কিন্ত্ত তার তো সত্যি সত্যিই কোনও আপত্তি নেই বনগাঁ যেতে৷ এবং বিভিন্ন স্থানে বসবাস করলে মনের প্রসারতা বৃদ্ধি পায়, দেখাশোনার চোখকান খোলা, এমনটাই ওর মনে হয়৷ নিজে কিছু সাহিত্যচর্চা এবং রচনাও করে রমা৷
তুমি কি জানো, আমাদের এই বনগাঁয়ে বিভূতিভূষণ থাকেন! রমা অবাক হয়ে বলল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়! পথের পাঁচালীর লেখক? হ্যাঁ ভাই তিনিই৷ এখন এ শহরেই থাকেন… তবে একটু বাইরের দিকে, নদীর কাছাকাছি৷ রমা দুরন্ত উত্‍সাহে বলল, কবে আমায় নিয়ে যাবে বলো৷ এক বারটি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আসব… আর যদি সুযোগ হয় একটা অটোগ্রাফও নিয়ে আসব৷ ওহ্ আমি ভাবতেই পারছি না৷
কয়েক দিন পরে এক বিকেলে প্রায় দুরুদুরু বক্ষে বেনুর সঙ্গে রমা চলল স্বনামধন্য সাহিত্যিকের বাড়িতে৷ বনগাঁ শহর থেকে একটু পুবের দিকে ছয়ঘেরির কাছাকাছি থাকেন বিভূতিভূষণ৷ আশা করা যায় বাড়িতেই থাকবেন, কেননা এখন তিনি আর অন্য কোনও কাজ করেন না, সাহিত্যচর্চাই তাঁর কাজ ও জীবিকা৷ একটা রিকশা নিয়েছে দুই বন্ধু৷ বিকেলে তাপ খানিকটা কমে এসেছে, ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে৷
বিশেষ করে সেই কারণেই আরও, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় স্থানান্তর, বসবাস এবং জীবনাপনে তার কিছুমাত্র আপত্তি নেই৷ ষোড়শীকান্তর মন্তব্য শুনে রমা বলল, আমার জন্য কীসের চিন্তা বাবা? কেন?
ষোড়শীকান্ত বললেন, গঞ্জ মফস্সল জায়গা… নামে বনগাঁ শহর কিন্ত্ত শহরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ কি আর ওখানে আছে! তাতে কী হয়েছে বাবা! আমি শহরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ, আধুনিকতা ছাড়া থাকতে পারি না?
পারবি না কেন মা! কিন্ত্ত আর একটু অন্তত কলকাতার কাছে হলে, বোধ হয় তোর আমার দু’জনেরই সুবিধে হত৷ আমি কিন্ত্ত তা মোটেও ভাবছি না বাবা৷ তবে তোমার অসুবিধে হলে আলাদা কথা৷ না-না আমার আর অসুবিধে কী! তোর জন্যই…৷
ষোড়শীকান্তকে শেষ করতে না দিয়েই রমা বলল, আমি কিন্ত্ত খুশিই বাবা৷ এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় গিয়ে থাকলে, মনের মধ্যে একঘেয়েমি আসে না৷ নতুন জায়গা, পরিবেশ দেখা যায়, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়৷ তা ছাড়া শহরের মধ্যে বৈচিত্র্য কম বাবা৷ গ্রাম-গঞ্জ-মফস্সলে প্রকৃতিকেও অনেক কাছের থেকে অনুভব করা যায়৷
ষোড়শীকান্তরা থাকেন একতলায়, বাড়িওলা ওপরে৷ বাইরের দিকে সিঁড়ি, সুতরাং ভাড়াটে-বাড়িওলার স্বাধীন বিচরণে কোনও ঠোকাঠুকি নেই৷ দু’টি ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর-বাথরুম- এটুকুর মধ্যে ষোড়শীকান্তরা তিনটি প্রাণী নিজেদের মধ্যে দিব্যি মানিয়ে নিলেন৷ একটু একটু করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হতে লাগল৷ রমার কয়েকটি বান্ধবী জুটে যেতে সময় লাগল না৷ রবীন্দ্র পাঠাগারেও সে যাতায়াত করে৷ বই আনে, পড়ে, প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা দেখে৷
মানুষ যেখানেই বসবাস করে, নিজের পছন্দের মানুষজন সেখান থেকে ঠিক খুঁজে নেয়৷ একটু একটু করে অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পায়৷ তার পর কয়েকজনের সঙ্গে হয় ঘনিষ্ঠতা৷ ভাবনা আর রুচির স্বতঃস্ফূর্ত মিল অনুভূত হলে ঘনিষ্ঠতা জন্মায়৷
বর্ণালি তথা বেনু নামের মোটামুটি সমবয়সিনী একটি মেয়ের সঙ্গে রমার বেশ ভাব হয়েছে৷ বেনু আবার প্রতিবেশিনীও বটে৷ পাঠাগারে আলাপ, তার পর বাড়িতে যাতায়াত৷ শীতের দিন যাই-যাই করেও যায়নি৷ ইতিমধ্যে মাস তিনেক অতিবাহিত হয়েছে রমারা বনগাঁয় এসেছে৷ প্রকৃতি এ দিকে বেশ খোলামেলা৷ বাতাস এখন দিক্ভ্রান্ত৷ গাছে গাছে নতুন পাতা আসছে৷
দুপুরবেলা গল্প করতে করতে বেনু এক দিন বলল, রমা, তুমি নিশ্চয়ই গল্পটল্প লেখো, তাই না?
রমা হেসে বলল, খুব ইচ্ছে করে… কিন্ত্ত ভাই পারি না৷ তোমার ও কথা মনে হল কেন?
তোমার কথাবার্তা, মাঝে মাঝে যে ভাবে বর্ণনা করো… সেই সব শুনেই মনে হয়৷ গল্প ছাড়া আর অন্য কিছুও কি লেখো? ওই যে বললাম… ইচ্ছে করে কিন্ত্ত পারি না৷ তবে চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই৷
তাই তো৷ সারা জীবন ধরে আমরা যা কিছু করি, সে তো কিছু চেষ্টারই সমষ্টি৷
কথাটা বেশ ভালো বলেছো তো৷ ভেবে দেখলে সত্যি তাইবেনু এর পর থেকে প্রায় নিয়মিত রমাকে উত্‍সাহিত করে লেখার জন্য৷ রমাও সময় সুযোগ মতো আবার চর্চা শুরু করে দেয়৷ স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় টুকটাক করে রমার একটা-দুটো রচনা প্রকাশিতও হচ্ছে৷ সে নিজেও টের পায়, তার সাহিত্য মনস্কতা একটা মাত্রা পাচ্ছে৷ এ রকম সময়ে বেনু এক দিন খুব ভালো একটা খবর দিল রমাকে৷
অটোগ্রাফ খাতাটি বুকে চেপে, বাড়ি থেকে একটু দূরেই রিকশা থেকে নেমে পড়ল দুই বন্ধু৷ তার পর হাঁটতে হাঁটতে বিভূতিভূষণের বাড়ি৷ একটেরে, একতলা বাড়ি৷ বেশ খানিকটা চ্যাঁচাড়ি বাঁশের বেড়া দেওয়া বাগান, সামনে বেড়ার ফটক৷ বাগানে কিছু ফুল ফুটে রয়েছে- চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, দোপাটি৷ বাড়ির এক পাশের পাঁচিল বেয়ে ছাদে লতিয়ে উঠেছে ফনফনে লাউডগা৷ ফটকের কাছে দু’জন পৌঁছতেই মালিগোছের একটি লোক এগিয়ে এল৷ বেনু জিজ্ঞেস করল, বিভূতিভূষণবাবু কি আছেন বাড়িতে? আমরা একটু দেখা করব৷
লোকটি গেট খুলে দিয়ে বলল, আসুন৷ বাড়িতেই আছেন… কিন্ত্ত দেখা করবেন কি না… আমি খবর দিচ্ছি৷
পায়ে পায়ে বাগানের মাঝখানে সরু পথ দিয়ে রমা আর বেনু পাকাবাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল৷ সামনে দু’ধাপ সিঁড়ি, তার পর লাল মেঝের বারান্দা, উপরে ছাদ সামনে খোলা৷ পিছনে অন্দরমহলে ঢোকার দরজা, একটু হাঁটু পর্যন্ত মলিন পর্দা ঝুলছে সামনে৷ সেইটি সরিয়ে বছর ত্রিশের এক আটপৌরে মহিলা বেরিয়ে এলেন৷ রমা এগিয়ে গিয়ে বলল, নমস্কার৷ আমার নাম রমা চট্টোপাধ্যায়, আর এই আমার বন্ধু বর্ণালি৷ আমরা কি এক বার ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?... মানে… বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়…৷
মহিলা বললেন, আসুন৷ আমি ওঁর ভাগনি, আমার নাম উমা৷ আপনারা বসুন, আমি খবর দিচ্ছি৷
বলতে বলতে বারান্দাতেই একটা মাদুর পেতে দিলেন উমা৷ আবার বললেন, মামার মনটা ভালো নেই আজ৷ রমা দ্রুত বলল, আচ্ছা তা হলে না হয় থাক… আমরা পরে আর এক দিন আসব৷
উমা বললেন, বসুন তো আগে, মামাকে জিজ্ঞেস করে আসি৷ বনগাঁতে থাকেন আপনারা? আজ্ঞে হ্যাঁ… পালপাড়ায়, রবীন্দ্র পাঠাগারের কাছে৷
উমা ভেতরে চলে গেলেন৷ মিনিট দশেক পরে আবার বেরিয়ে এলেন৷ হাতে দু’কাপ চা আর নিমকি বিস্কুট৷ রমা আর বেনুর সামনে নামিয়ে বললেন, মামা আসছেন, আপনারা চা খান৷ আমি একটু কাজে ব্যস্ত আছি… আসছি৷
কিছুক্ষণ পরেই লেখক এলেন৷ পরনে ধুতি, হাফহাতা গেঞ্জি৷ মধ্যবয়সী, প্রায় ষোড়শীকান্তর মতোই হবে মনে হল রমার৷ মুখে একটা উদাস চিন্তাচ্ছন্ন ভাব৷ মাঝারি গায়ের রং, মাঝারি উচ্চতা৷ মাদুরের উপরেই দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই রমা ও বেনু তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে৷ বিভূতিভূষণ বুকের সামনে নমস্কারের ভঙ্গিতে দু’হাত জড়ো করে বললেন, থাক থাক, বসুন৷
সৌজন্যমূলক কিছু কথাবার্তার সূচনা করলেন বিভূতিভূষণই৷ কোথায় থাকেন, কী করেন, বাড়িতে আর কে আছেন, কী রকম বই-টই পড়েন, সাহিত্যে উত্‍সাহ কেন, নিজেরা চর্চা করেন কিনা… ইত্যাদি কথাবার্তা হল৷ রমাই অধিকাংশ কথার উত্তর দিল৷ এবং মনে মনে অনুভব করল, একটি মুগ্ধ আনন্দের স্রোতে ও ভেসে যাচ্ছে, এই নিরাড়ম্বর অথচ প্রখর অনুভূতিশীল, হূদয়বান-প্রকৃতি প্রেমিক-আন্তরিক-বিবেকবান- ভাষার জাদুকরটির সান্নিধ্যে ও সাহচর্যে৷ দিনটি বিশেষ ভাবে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে রমার জীবনে৷
একটু পরেই অটোগ্রাফের খাতাটি বিভূতিভূষণের কাছে বাড়িয়ে ধরল রমা৷ বিজড়িত সংকোচ সত্ত্বেও বলে ফেলল, একটা কিছু কথা যদি লিখে দেন, আমি সারা জীবন কৃতার্থ বোধ করব৷
খুব হালকা একটা হাসির আভাস ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন বিভূতিভূষণ৷ কিন্ত্ত যেন পারছেন না৷ খাতাটা টেনে নিলেন অবশ্য৷ সহজ ভাবেই মুক্তাক্ষরে লিখে দিলেন, ‘গতিই জীবন, গতির দৈন্যই মৃত্যু’৷ তার পর নাম সই করে তারিখ দিলেন৷
গভীর আগ্রহে খাতার লেখাটি দেখতে দেখতে রমার মনে হল, এর চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি তার জীবনে ইতিপূর্বে ঘটেনি৷ ফিরে আসার আগে, সনির্বন্ধ অনুরোধের মতো রমা বলল, আপনি যদি এক দিন আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন… আমার বাবা এবং আমরা সকলেই ভীষণ খুশি হব৷ আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব৷
বিভূতিভূষণ বললেন, তার কোনও প্রয়োজন নেই৷ আমি নিশ্চয়ই এক দিন যাব, কিন্ত্ত কবে তা এখনই বলতে পারছি না৷ রমা বলল, সে ঠিক আছে, আমি খোঁজ নিয়ে যাব৷ আজ আপনার মনটা ভালো নেই… দিদি বলছিলেন৷ বিভূতিভূষণ বললেন, আজ আমার বোন জাহ্নবী পিয়ালী নদীতে স্নান করতে গিয়ে ঘাট থেকে আর ফেরেনি৷ বেনু ও রমা দু’জনেই তড়িদাহতের মতো বলল, সে কী!
বিভূতিভূষণ বললেন, খোঁজাখুঁজি চলছে… হয়তো জলেই ডুবে গিয়ে থাকবে৷ মনটা তাই বড়ো খারাপ৷ রমা বলল, ইশশ্… আর তার মধ্যে আমরা এতক্ষণ ধরে…৷ তাইতে আপনাদের কোনও দোষ হয়নি৷ বিভূতিভূষণ বললেন৷ কিন্ত্ত আমি আপনাদের ঠিকমতো অভ্যর্থনা করতে পারিনি আজ… পরে অবশ্যই আর এক দিন আসবেন৷

এ দিকে বিভূতিভূষণের সান্নিধ্যে আসার পর থেকে, সাহিত্য রচনার দুরন্ত প্রেরণা অনুভব করে রমা৷ আগেও লিখতো, কিন্ত্ত এ বার নিয়মিত বসার জন্যই তার লেখাপত্র প্রকাশিত হতে লাগল পত্র-পত্রিকায়৷ সুযোগ পেলেই সে প্রখ্যাত সাহিত্যিকটির কাছে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে৷ কেন যেন বিভূতিভূষণও কন্যাসমা এবং তাঁর সাক্ষাত্‍প্রার্থিনী, মুগ্ধ অষ্টাদশী মেয়েটিকে ফেরাতে পারেন না, বরং কিঞ্চিত্‍ প্রশ্রয়ই দেন৷ জীবন এবং অভিজ্ঞতার কথা বলেন৷ তাঁর চাকুরিজীবন, মাস্টারি করা, মেসে বসবাস করার অভিজ্ঞতা, লবটুলিয়ার অরণ্যে ম্যানেজারি করার সময়কার কথা, কত বিচিত্র বিশ্বাস-দারিদ্র-সুখদুঃখ নিয়ে চলা নানান মাপের মানুষের কথা বলেন৷ কেন যে বলেন, নিজেও যেন তার সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারেন না৷ অথচ নিভৃত মনে যেন একটি কৌতুক বোধেরই উদয় হয়৷
মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভালো লাগে৷
অন্তর্মুখী মনের মানুষ বিভূতিভূষণ৷ শান্ত, ভাবুক৷ এক সময় অফিস-কাছারি, শিক্ষকতা, মেসের বন্ধুদের সঙ্গে কলেজস্ট্রিট পাড়ায় আড্ডার সঙ্গেই সাহিত্য রচনা করেছেন, আবার গার্হস্থ্য জীবনযাপনও করেছেন৷ বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তাঁর জীবন ও জীবদ্দশা৷ দারিদ্র থেকে শুরু করে, মানুষের ব্যক্তি জীবনের বেদনা-বঞ্চনা, হতাশা-প্রত্যাশা, আনন্দ, সুখ যেমন গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছেন, তেমনই আন্তরিক ভাষায়, শব্দে সেই সব উপলব্ধিকে সাহিত্যের উপজীব্য করে তুলেছেন৷ এক দিকে বঙ্গসাহিত্য দেবতা তাঁকে যেমন অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ করেছেন, অপর দিকে তিনিও আপন সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে এক স্বচ্ছন্দ, প্রীতিময়, ভালোবাসার সরল মানবিক মাত্রা সংযোজন করেছেন৷ ইতিমধ্যেই তাঁর সৃষ্টি-সম্ভার কালজয়ী আখ্যা পেয়েছে৷ অথচ এ সব সত্ত্বেও, অর্ধাঙ্গিনী গৌরীদেবীর অকাল প্রয়াণের পর থেকে, নিঃসঙ্গতাই যেন তাঁর নিত্যসঙ্গী, অবিচ্ছেদ্য ভাবেই জড়িয়ে গেছে অস্তিত্বের সঙ্গে৷

পারিবারিক কর্তব্য পালনে অবশ্য তার পরেও রেহাই নেই বিভূতিভূষণের৷ সাহিত্যকর্ম, চর্চা এবং ধারাবাহিক রচনার উদ্যোগকে তিনি নিজেই ইদানীং সাহিত্য ব্যবসার রসে অভিহিত করেন, এবং যথারীতি ছেদ পড়েনি সেই অভ্যাসেও৷ কিন্ত্ত সব কিছু নিয়ে এই আপাত-নিস্তরঙ্গ জীবন যাপনেই যেন একটি অদৃশ্য চোরাস্রোতের অস্তিত্ব অনুভব করেন৷ নিশ্চিত হতে পারেন না, আবার অনিশ্চিত ভেবে উপেক্ষাও বা করতে পারছেন কই! জীবনের এমন একটি সময়ে এ কী অন্যতর এক দোলাচলেরই সূচনা!
বনগাঁ শহরের আর এক প্রান্তে ষোড়শীকান্ত যেন আলোআঁধারি এক বিভ্রান্ত অনুভবের শিকার হয়েছেন৷ ঘরে বিবাহযোগ্যা অষ্টাদশী মেয়ে পাত্রস্থ না হওয়া পর্যন্ত, বাবার একটি অনিবার্য দুশ্চিন্তা থাকাই স্বাভাবিক৷ সে দুশ্চিন্তা লাঘবের জন্য তিনি মানসিক ভাবে প্রস্ত্তত৷ কিন্ত্ত তাঁর বিভ্রান্তি রমাকে নিয়েই৷ লক্ষ করেছেন, বিবাহের কথায় রমা যে খুব অসম্মতি প্রদর্শন করেছে, তা নয়৷ কিন্ত্ত পাত্র নির্বাচনের কথায় মেয়ে কোনও উত্‍সাহ দেখায় না৷ শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী মেয়ে সে৷ তার দিক থেকে একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া খুবই জরুরি ষোড়শীকান্তর পক্ষে৷ নতুবা শুধুমাত্র তাঁর নিজের পছন্দ এবং সিদ্ধান্ত রমার উপর চাপিয়ে দিতে হয়৷ উদারমনা ষোড়শীকান্ত তা করতে চান না৷ তিনি নিজেও শিক্ষিত মানুষ৷ পদস্থ সরকারি অফিসার৷ মেয়ের পূর্ণ সম্মতি ব্যাতিত কোনও পাত্রের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া তাঁরও রুচি এবং নীতিবিরুদ্ধ৷
বিভ্রান্তি আর ভাবনার দোলাচলের মধ্যেই কখনও চকিতে একটি প্রান্তিক সম্ভাবনার প্রশ্ন ষোড়শীকান্তর মনে উঁকি দেয়৷ রমা সাহিত্যঅন্তপ্রাণ৷ নিজে পত্রপত্রিকায় লেখে৷ আবার এ শহরেই দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয়, কৃতী সাহিত্যিকটিও বসবাস করেন৷ রমা যাতায়াত করে তাঁর কাছে৷ ষোড়শীকান্তও গেছেন তাঁর বাসাবাড়িতে৷
একটি পারিবারিক পরিচয়ের যোগসূত্রও কি রচিত হয়নি! লেখকটি বিপত্নীক, এবং বয়সেও ষোড়শীকান্তর ধারেকাছেই হবেন৷ তথাপি…! ষোড়শীকান্ত বনগাঁয় বদলি হয়ে এসেছেন প্রায় বছর ঘুরতে চলল৷ সরকার কবে আবার স্থানান্তরে পাঠাবে ঠিক নেই৷ ঠাঁইনাড়া হওয়ার আগে রমার বিবাহ দিয়ে দিতে পারলে তিনি নিশ্চিন্ত বোধ করবেন৷
সুতরাং মনের দোলাচল পাশে সরিয়ে রেখে, নিজেই এক দিন দেখা করতে গেলেন বিভূতিভূষণের সঙ্গে৷ মনে মনে বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিশীল লেখক মা সরস্বতীর বরপুত্র৷ তিনি সজ্জন, আন্তরিক৷
বিভূতিভূষণ বিনম্র হাসিমাখা মুখে বললেন, আমার বিশ্বাস, আপনার সম্ভাব্য প্রশ্নটি সঠিক ভাবনা থেকেই উত্‍সারিত৷ রমা মনে মনে তার স্বামী নির্বাচন করে ফেলেছে বলেই আমার মনে হয়৷
পরম নিশ্চিন্ত ও দ্বিধাহীন মন নিয়ে ষোড়শীকান্ত বাড়ি ফিরলেন৷ কিছু দিন পরেই রমা ও বিভূতিভূষণের শুভবিবাহ সম্পন্ন হল৷ দিনটি ছিল ৪ ডিসেম্বর, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ৷ রমার বয়স আঠারো, বিভূতিভূষণের ছেচল্লিশ৷ কিন্ত্ত আঠাশ বছরের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রীতিময়তা ও মানসিকতার নিরিখে, বিবাহের পক্ষে কোনও তরফ থেকেই তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি৷
কালের দেবতা সে দিন অলক্ষ্য থেকে এই অসমবয়সী বিবাহের পরিণতি বিষয়ে কী লিখে রেখেছিলেন, জানা গেল না৷ কিন্ত্ত বঙ্গ সাহিত্য জগতে এই ঘটনা উত্তরকালের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল৷ এবং তা যতখানি প্রতিভাবান লেখকটির সৃষ্টিমালার জন্য, ততখানি তাঁর তরুণী দ্বিতীয়া স্ত্রী রমাদেবীর ভূমিকার জন্যও বটে৷ বয়সে কন্যাসমা হলেও, স্বামীর শ্রমের সঠিক মূল্যায়নের জন্য রমাদেবী উঠে পড়ে লাগলেন৷ বিবাহের ঘটনাটি বাস্তবায়িত হওয়ার পরে তিনি সত্যিই অবাক হয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত খুশি আর আনন্দে ভরপুর হলেন তার চেয়েও বেশি৷
বিভূতিভূষণ এক দিন বললেন, আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে এ আমার কল্পনায় ছিল না৷
রমা বললেন, কোন ঘটনার কথা বলছ?
আবার কী! পৌঢ় বয়সে এই বিবাহ৷ কত বিচিত্র আকস্মিকতা যে মানুষের জীবনে থাকে!
রমা বললেন, তাইতে কী! তোমার কি অনুশোচনা হচ্ছে আবার বিয়ে করে?
বিভূতিভূষণ অবাক হয়ে বললেন, ও কী কথা বলছ! অনুশোচনা… সে বরং তোমার হলেও হতে পারে… আমার মতন এমন লোককেই শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে হল!
করতে তো হয়নি, আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে বিয়ে করেছি৷ তা ছাড়া… ঠাকুর কার সঙ্গে কার জোড় বেঁধে রাখেন… কেই বা বলতে পারে! তা অবশ্য ঠিক৷ কিন্ত্ত তোমার ঘাড়ে যে অনেক ঝামেলা পড়ে গেল৷
আমি তা মনে করি না৷ রমা বললেন৷ তুমি যেগুলো ঝামেলা বলে ভাবছো, আমি ভাবি সেগুলোই আমার দায়িত্ব৷ আচ্ছা বেশ, তা-ও না হয় হল৷ কিন্ত্ত আমি মরে যাওয়ার পরে একা এই সব দায়িত্ব নিয়ে…৷
বিভূতিভূষণকে শেষ করতে না দিয়েই, তাঁর মুখের ওপর হাত রাখলেন রমা৷ বললেন, ছি… ও রকম কথা মুখে এনো না৷ বিভূতিভূষণ শ্বাস ফেলে বললেন, জানি, তোমার কষ্ট হয়৷ কিন্ত্ত বাস্তবকে তো অস্বীকারও করা যাবে না৷ রমা একটু পরে অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, আমায় আশীর্বাদ কর, যেন সব দায়িত্ব পালন করতে পারি৷
প্রেম-প্রীতি আর ভালোবাসার বাঁধনে এক নিবিড় দাম্পত্য জীবন রচনা করলেন বিভূতিভূষণ ও রমা৷ রমা বোঝেন, ওপর ওপর সাদামাটা, উদাসীন গোছের মনে হলেও, তাঁর স্বামীটি এলেবেলে, যে-সে মানুষ নন৷ যে মানুষ পথের পাঁচালী-অপরাজিত-অপুর সংসার-আরণ্যক রচনা করতে পারেন, তিনি অন্য আর কিছু না লিখলেও বিশ্বসাহিত্যে অমর হয়ে থাকতেন৷ কিশোর সাহিত্যে চাঁদের পাহাড়-ও কালজয়ী সৃষ্টি৷ তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন মানুষটি যেমন সংবেদনশীল, শিল্পী মনের অধিকারী, উদার আবার তেমনই রসিক৷ রবীন্দ্রোত্তর যুগে বঙ্গ সাহিত্যাকাশে ইতিমধ্যে তিনি একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন৷

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Sunday, 27 December 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য

রমাপদ চৌধুরী

=================================

   Doinik Sabder Methopath

Vol -235 . Dt -28.12.2020

১১ পৌষ,১৪২৭। সোমবার

+++++++++++++++++++++++++++-+++++++


রমাপদ চৌধুরী ২৮ ডিসেম্বর, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমমেদিনীপুর জেলার খড়গপুরে জন্ম গ্রহণ করেন।পিতা মহেশচন্দ্র চৌধুরী ও মাতা দুর্গাসুন্দরী। তিনি খড়গপুরে তার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে, কলকাতায় উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। সহধর্মিনী  সুষমা চৌধুরী।

কর্মজীবন ও সাহিত্যকীর্তি :

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি লেখা লেখি শুরু করলেও, বন্ধুদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে মাত্র ২৫ বছর বয়সে প্রথম ছোটগল্প রচনা করেন। তার জীবনের প্রথম গল্প 'উদয়াস্ত' প্রকাশিত হয়েছিল যুগান্তর পত্রিকায়। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এম.এ পাস করে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেন। কর্মজীবনে কালক্রমে তিনি ওই পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন এবং পত্রিকার রবিবারের ক্রোড়পত্র 'রবিবাসরীয়' বিভাগের সম্পাদক হন। পাশাপাশি চলতে থাকে তার নিজস্ব সাহিত্য চর্চা। ১৯৫৪ সালে প্রথম উপন্যাস 'প্রথম প্রহর' প্রকাশ পায়।[৪] ষাটের দশকে দেশ পত্রিকায় তার উপন্যাস 'বনপলাশীর পদাবলী' পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়, যার ফলে তিনি পাঠক সমাজে পরিচিত মুখ হয়ে পড়েন।

তিনি ১৯৬৩ সালে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭১ সালে 'এখনই' উপন্যাসের জন্য রমাপদ চৌধুরীকে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। 'বাড়ি বদলে যায়' উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮৮ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি পঞ্চাশটির উপরে উপন্যাস রচনা করেন। এছাড়া দেশ পত্রিকার গল্প সংকলনও দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনা করেন। ২০১১ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মারক আন্তর্জাতিক পুরস্কার চালু করলে প্রথম বছর 'বনপলাশী পদাবলী' উপন্যাসের জন্য রমাপদ চৌধুরীকে ওই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।


রমাপদ চৌধুরীর জীবনের উপর একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছে সাহিত্য অকাদেমি। ছবিটির পরিচালক রাজা মিত্র।


রচনাবলী

তাঁর অনন্য সাহিত্যকীর্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু সাহিত্য প্রতিভা :-


প্রথম প্রহর (১৯৫৪)

দ্বীপের নাম টিয়ারং

বনপলাশীর পদাবলী (১৯৬০)

যে যেখানে দাঁড়িয়ে 

এখনই (১৯৬৯)

খারিজ

বাড়ি বদলে যায় (১৯৮৮)

অভিমন্যু (১৯৮২)

বীজ

দরবারী

লালবাড়ি

হারানো খাতা

লালবাঈ

পিকনিক

বাহিরি

ছাদ

শেষের সীমানা

আকাশপ্রদীপ

রমাপদ চৌধুরীর সাহিত্যকীর্তি অবলম্বনে চলচ্চিত্র সম্পাদনা

তার বহু উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়নও হয়েছে যেগুলি চলচ্চিত্র হিসেবেও দারুণ সাফল্য পায়। যেমন:


দ্বীপের নাম টিয়ারং (১৯৬৩) , পরিচালনায় গুরুদাস বাগচী 

এখনই (১৯৭০), পরিচালনায় তপন সিংহ

পিকনিক (১৯৭২), পরিচালনায় ইন্দ্র সেন

বনপলাশীর পদাবলী (১৯৭২), পরিচালনায় উত্তমকুমার

যে যেখানে দাঁড়িয়ে (১৯৭৪), পরিচালনায় অগ্রমী

খারিজ (১৯৮২),পরিচালনায় মৃণাল সেন

এক দিন আচানাক (১৯৮৯), পরিচালনায় মৃণাল সেন (বীজ কাহিনি অবলম্বনে)

এক ডক্টর কি মওত (১৯৯২), পরিচালনায় তপন সিংহ ('অভিমন্যু' উপন্যাস অবলম্বনে )

সুন্দরী (১৯৯৯), পরিচালনায় গুল বাহার সিংহ ('আহ্লাদী' কাহিনি অবলম্বনে)

পুরস্কার ও স্মারক :

 ্সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার] ১৯৮৮। রবীন্দ্র পুরস্কার ১৯৭১। আনন্দ পুরস্কার ১৯৬৩ র রবীন্দ্রনাথঠাকুর স্মারক আন্তর্জাতিক পুরস্কার ২০১১

মৃত্যু : ২৯ জুলাই ২০১৮ (বয়স ৯৫)।

কলকাতা

মূল্যায়ন

রমাপদ চৌধুরী বাংলা কথাসাহিত্যের সেই বিরল লেখকদের একজন, যিনি লেখার শুরুটাকে যেমন চিনতেন তেমনি জানতেন থামাটাও। তাঁর একটি উপন্যাসের নাম ‘অভিমুন্য’, যে ব্যুহে প্রবেশের কৌশল জানে, কিন্তু জানে না কী ভাবে বেরিয়ে আসতে হয়। সেই অজানা দুর্গম পথের পর্যটক প্রায় সব বাঙালি লেখক, কেউই আর সহজে ফেরেন না; রমাপদ কিন্তু উল্টো পথেই হেঁটেছেন।একটি গল্প ‘ভারতবর্ষ’ লেখক রমাপদকে চিনিয়ে দিয়েছিল একেবারে শুরুর দিনে। সেই অনেক বছর আগে; খড়্গপুর রেল কলোনিতে বেড়ে ওঠা  রমাপদর কাছেই আমাদের জানা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা, এই কলকাতা শহর, সেই রেল কলোনি, মার্কিন সোলজার, নিষ্প্রদীপ রাত্রির কথা। অনুদান,  সাহায্য যে কী ভাবে একটি জনজাতি একটি দেশের মেরুদণ্ডকে বাঁকিয়ে দেয়, ভিখারি করে দেয়, সেই গল্পই ‘ভারতবর্ষ’। সেই গল্পই বহুকাল ধরে বড় বেদনার মতো বাজে যে গল্প সময় থেকে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েও প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে। রমাপদ চৌধুরীর ‘ভারতবর্ষ’ তেমনই একটি গল্প। সে গল্পের নানা মাত্রা। দেশটা সেই যে আন্ডা হল্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল হাত বাড়িয়ে, সে হাত আজও তো নামেনি। উচ্ছিষ্টের লোভে মানুষ তো হাত বাড়িয়েই আছে। ‘ভারতবর্ষ’ শুধু এই ভারতবর্ষের গল্প নয়, গোটা তৃতীয় বিশ্বের।রমাপদ চৌধুরীর গল্প, উপন্যাস, মানুষের ভিতরের হাড়-কঙ্কাল বের করে ফেলে। সত্য উন্মোচনে রমাপদ লেখক মানুষটি অতি নির্মম। ‘ভারতবর্ষ’ গল্পে যে মাহাতো বুড়ো ভিক্ষা প্রত্যাখ্যান করতে করতে মাথা উঁচু রেখেছিল, সেই বুড়োই শেষ পযর্ন্ত, বকশিস বকশিস বলে চিৎকার করে ওঠে। যে মাহাতো বুড়োকে নিয়ে ভারতবর্ষ তার মাথা উঁচু করে রেখেছিল, সেই মাহাতো বুড়োই গোটা দেশটাকে একদিন ভিখিরি বানিয়ে দেয়।

‘পোস্ট মর্টেম’ গল্পে গলায় দড়ি দিয়ে মরা ধনঞ্জয়বাবুর বাড়ির সামনে যাঁরা সক্কাল বেলায় এসে দাঁড়ায় এবং নানা মন্তব্য করে, তারা যে আসলে নিরাপত্তার বৃত্তে থাকা মধ্যবৃত্ত মানুষ, একটু একটু করে তারা খোলস ছেড়ে বের হয়। তাদের ওই মৃত্যুর কারণ খোঁজা আসলে এক ধরনের তৃপ্তি যে তারা বেঁচে আছে আর একটি লোক আত্মহত্যা করেছে। আসলে এই আখ্যান মৃত ব্যক্তির পোস্টমর্টেম নয়, ময়নাতদন্ত চলতে থাকে জীবিত মানুষেরও।

প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র লিখলেন পূর্বাশা, চতুরঙ্গ, দেশ ও আনন্দবাজার পত্রিকায়। প্রথম গল্প ‘ট্র্যাজেডি’। প্রথম প্রকাশিত বই গল্পগ্রন্থ ‘ দরবারী’। বছর ঘুরতে সে বইয়ের সংস্করণ। প্রথম উপন্যাস ‘প্রথম প্রহর’। উপন্যাস লিখেছেন ৫০টি। বেশির ভাগই আয়তনে ছোট। নিজেও ছিলেন স্বল্পবাক, উপন্যাসেও সে রীতি মেনেছেন। কাহিনিগদ্য নিয়ে ছিল স্বতন্ত্র ভাবনা, লেখার কৌশল নিয়ে ছিল খুঁতখুঁতানি। নিজেই বলেছেন, ‘প্রথম জীবনে তো ভাষা, আঙ্গিক ইত্যাদি নিয়ে কত কারিকুরি করেছি, পরে একেবারে সহজ-সরল। সহজ হওয়া যে কত কঠিন, জানি’।ছিঁড়েছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। এমনকি আস্ত উপন্যাসও ফেলে দিয়েছেন ঝুড়িতে। একটি দীর্ঘ আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও তা লেখেননি। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় অন্তত ৩০ বছর আগের লেখা আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথা ‘হারানো খাতা’। সেই লেখা উদ্ধার হয় বাতিল কাগজপত্রের গাদাগুচ্ছ থেকে। ছাপার যোগ্য মনে হয়নি, তাই ফেলে রেখেছিলেন। খড়্গপুরে কাটানো তাঁর শৈশব-কৈশোর আর কলকাতা জীবনের প্রথম দিকের টুকরো টুকরো ছবি পাওয়া যায় সেখানে। এমনকি খড়্গপুর রেলস্টেশনে রবীন্দ্রনাথকে দেখার স্মৃতিও।তবে ঔপন্যাসিক রমাপদ চৌধুরী ঠিক এমনটা নন। অন্তত খারিজ-এর পর থেকে, ‘প্রথম জীবনে বৈচিত্র্যের প্রতি মোহ ছিল, একই বিষয় নিয়ে দু’বার লিখিনি। কিন্তু খারিজ-এর পর থেকে তিরিশ বছর ধরে একই বিষয়ের মধ্যে বৈচিত্র্য খুঁজে পেয়েছি। মধ্যবিত্ত জীবনের আত্মসমালোচনা, তা পাঠকের কাছে অস্বস্তিকর লেগেছে, কখনও মনে হয়েছে নির্মম। কিন্তু যা বলার তা না বলে পারিনি। কাহিনির বাইরেও তো এসব উপন্যাসে আমার কিছু বলার কথাও থাকে’।

তাঁর উপন্যাস রচনার দ্বিতীয় পর্বের ক্ষেত্রে এ কথা মেনে নেওয়া যায়। কেননা, প্রথম পর্বে ‘কাহিনির বাইরে ভিতরের তল’ বিষয়টা তেমন ছিল না। ‘প্রথম প্রহর’, ‘লালবাঈ’, ‘বনপলাশির পদাবলি’ কিংবা ‘দ্বীপের নাম টিয়ারং’ তাঁর বিস্তার দ্বিতীয় পর্ব থেকে আলাদা। ইতিহাসের পটভূমিতে লেখা ‘লালাবাঈ’তে কাহিনির বাইরে সেই অন্তর্জগতের খোঁজ দেওয়া যায় না। আবার গ্রামজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর একদমই ছিল না। তাই ‘বনপলাশি’ কিংবা ‘দ্বীপের নাম টিয়ারং’ লেখা হয় অর্ধেক-দেখাকে নিজস্ব কল্পনার মিশেল দিয়ে।খারিজ-এর পরে তিনি আঙ্গিকে অনেকখানি আলাদা। ‘বীজ’, ‘বাহিরি’, ‘ছাদ’, ‘পাওয়া’, ‘অহঙ্কার’, ‘জৈব’, ‘স্বার্থ’ লিখেছেন খুব অল্প দিনের ব্যবধানে। যদিও তিনি মনে করতেন, ‘আসলে সব উপন্যাসই হয়তো আমরা সারা জীবন ধরে লিখি’। এই সময় তার উপন্যাসের আয়তন ছোট হয়ে আসে। পটভূমিও হয়ে পড়ে ছোট আর স্থির।

কলকাতা শহরের পাড়াগুলিও খুব আলাদা করা যায় না। ওদিকে চরিত্রেরা একেবারে নিকটজন। প্রতিদিনের দেখা মানুষ। তারা মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতিমুহূর্তের সংকটে অবিচ্ছিন্ন জড়িয়ে। সেখানে শঠতা, অজ্ঞতা, ক্রূরতা, গ্লানি, বিদ্বেষ ও ক্ষয়ের ভেতরেও যে মহত্ত্ব ও বন্ধুতা লেপে আছে, তা লেখক চিহ্নিত করেন খুব সহজেই। এতটাই সহজ যেন কাহিনিটাই পড়ছি অথচ মানবিক সংকট ভীষণভাবে ধরা পড়ছে।সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাওয়া তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাড়ি বদলে যায়’তেও চলে যাওয়ার পরে ধ্রুব আর অবিনাশ দু’জনেরই অনুশোচনা হলো। এ ভাবে সুনন্দকে আঘাত দেওয়া ঠিক নয়। অথচ আঘাত তো দিল। কিন্তু কেন? ঈর্ষা? সুনন্দর একটা বাড়ি আছে বলে কি ওদের মনে কোনো ঈর্ষা আছে?সুনন্দর সঙ্গে এত দিনের বন্ধুত্ব, পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করে, একজনের বিপদে আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছে কত দিন, অথচ তাকেই ওরা ভাবল বিপরীত দিকের মানুষ। কী আশ্চর্য, একজন অজ্ঞাতকুলশীল, কেমন ধরনের লোক কে জানে, ধ্রুব তাকে কোনেও দিন দেখেওনি, চেনে না, জানে না, সেই লোকটাই ওদের সমবেদনা পেল। মনে হলো আপনজন, আত্মীয়! শুধু সেও একজন ভাড়াটে বলেই?কাহিনির ভেতরে থাকা এই দ্বিতীয় স্তরের কথা নিজেই বলেছেন তিনি। এখানে একটি স্তরে থাকে শুধুই কাহিনি। আর দ্বিতীয় স্তরে থাকে সেই ব্যঞ্জনা, যা জীবনের গভীরতম স্তরকে চেনায়। প্রচলিত মূল্যবোধের আপাত অন্ধকার দিকটা খুঁচিয়ে দেখানোতে রমাপদ যে দারুন সফল, সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। কাহিনি-গদ্যকার হিসেবে প্রকাশ্য একই সঙ্গে অপ্রকাশ্য জীবন চিনিয়ে দিতে পারাই রমাপদ চৌধুরীর প্রধান কৃতিত্ব। বাংলা কথাসাহিত্যে সরাসরি লক্ষ্যে পৌঁছানো গদ্য তিনি ব্যবহার করছেন অনায়াস কৌশলে এটাও রমাপদর আরেক বড় সাফল্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বেড়ে ওঠা চল্লিশের লেখকেরা শেষ পর্যন্ত যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ধ্বস্ত স্বদেশকেই খুঁজে ফিরেছেন সারাটা জীবন, সেখানে সাহিত্যিক হিসেবেই রমাপদ চৌধুরী নামটি উচ্চারণ করতেই হয়।তিনিই একসময়ে নতুন উপন্যাস লেখার আগে কিনতেন নতুন একটি ঝর্না কলম। সেই লেখকই একদিন জানিয়ে দিলেন, বলা ভাল ঘোষণা করেই নিজের লেখা থামিয়ে দিলেন। তিনি কোনও সভায় যেতেন না। টেলিভিশনে তাঁর মুখ কেউ দেখেছেন বলেও শুনিনি কখনও। বিদেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ পেয়েছেন বহুবার, কিন্তু সযত্নে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তরুণ লেখকদের পছন্দ করতেন খুব। তাঁদের সঙ্গেই মেলামেশা করতেন বেশি।

উপন্যাসের চাইতে ছোটগল্পের ওপর তাঁর দরদ ছিল বেশি। তাই তো তিনি ‘আনন্দ’ থেকে প্রকাশিত নিজের ‘গল্প-সমগ্র’র ভূমিকায় লিখেছিলেন, “ রণক্ষেত্রের দামামা বেজে উঠলো। লক্ষ লক্ষ সিপাহী, সান্ত্রী, অশ্বারোহী সৈনিক ছুটে এলো উন্মত্ত আক্রোশে। বিপরীত দিক থেকেও ঝাঁপিয়ে পড়লো লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যুদ্ধ, এক জাতির সঙ্গে আর এক জাতির। ঔপন্যাসিক তখন কোনো মিনারের চূড়ায় উঠে নোটবুকে টুকে নেবেন সমস্ত দৃশ্যটা। রাজার অঙ্গে লাল মখমলের পরিচ্ছদ, মাথার মুকুটে মণিমুক্তাহীরের জ্যোতি, সেনাপতির দুঃসাহসিক অভিযান, সৈন্যদের চিৎকার, এসবের একটা কথাও বাদ দেবেন না ঔপন্যাসিক। লিখে নেবেন কতগুলো হাতি, কত ঘোড়া … । খুঁটিনাটি প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি বর্ণনা ইনিয়ে বিনিয়ে লিখে নেবেন তিনি। যুদ্ধ জয়ের পর সৈন্যদল দেশে ফিরবে যখন, তখনও পিছনে পিছনে ফিরবেন ঔপন্যাসিক। শঙ্খধ্বনি আর সমারোহের আনন্দ ছিটিয়ে আহ্বান জানাবে গ্রামীণা আর নগরকন্যার দল। তাও লিখবেন ঔপন্যাসিক, বর্ণনা দেবেন তাদের, যারা উলুধ্বনির আড়ালে কলরব করে উঠলো।


===============≠===============≠






Saturday, 26 December 2020

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆বিশেষ আলোচনা পর্ব


       "‌ছন্নছাড়া মহাপ্রাণের সংসার জীবন"
=================================
 Doinik Sabder Methopath
Vol -234. Dt -27.12.2020
 ১১ পৌষ,১৪২৭. রবিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷


      হিরণ্ময়ী দেবী শরৎচন্দ্রের জীবনে এসেছিলেন এক ঝোড়ো–এলোমেলো সময়ে। সাহিত্যচর্চা থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত, আত্মীয়স্বজন–পরিবৃত্ত চেনা পরিমণ্ডলের বাইরে তখন তিনি রয়েছেন দূর–প্রবাসে রেঙ্গুনে। সে–সময়, আকস্মিকই হিরণ্ময়ী দেবীর আগমন। এসেছিলেন নিঃশব্দ চরণে, পিতার হাত ধরে। পিতা তঁাকে শরৎচন্দ্রের হাতে সমর্পণ করে কন্যাদায় থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। হিরণ্ময়ী দেবীর পিতা কৃষ্ণদাস চক্রবর্তীর (‌মতান্তরে অধিকারী)‌ সঙ্গে শরৎচন্দ্রের পূর্বপরিচয় ছিল। সেই পরিচয়ের সূত্রেই গড়ে উঠেছিল নির্ভরতা। তাই হিরণ্ময়ী দেবীকে সঙ্গে নিয়ে এভাবে হাজির হয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের বাসগৃহে। শরৎচন্দ্রের জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায় তথ্যের প্রয়োজনেই বারবার হিরণ্ময়ী দেবীর কাছে সামতাবেড়ের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন, হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে শুধু নয়, শরৎচন্দ্রের আত্মীয়পরিজনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। সেই শোনা কথার ভিতিতে গোপালচন্দ্র লিখেছেন কী করে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে হিরণ্ময়ী দেবীর যোগাযোগ ঘটেছিল। তঁার লেখায় আছে, ‘‌একদিন সকালে কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করে বলেন— আমার মেয়েটির এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। একে সঙ্গে নিয়ে একা বিদেশ বিভুঁইয়ে কোথায় থাকি। আপনি যদি অনুগ্রহ–পূর্বক আমার এই কন্যাটিকে গ্রহণ করেন তো গরিব ব্রাহ্মণের বড় উপকার হয়।’‌
এ প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিতে পারেননি শরৎচন্দ্র। আকস্মিক এমন এক প্রস্তাব শুনে, সামনে দঁাড়ানো চোদ্দো বছরের হিরণ্ময়ীকে দেখে বিষম সঙ্কটেই পড়েছিলেন। বছর দুয়েক আগে প্রয়াত শান্তির স্মৃতি তখনও মনের মণিকোঠায় সযত্নে লালিত, সেই স্মৃতিতে তিনি আচ্ছন্ন। বেদনায় বিষণ্ণতায় লেখাটেখা ছেড়েছুড়ে কোনও রকমে চলেছে তঁার দিনযাপন। এর মাঝে যদি এমন প্রস্তাব আসে, এক ভাগ্যবিড়ম্বিত পিতা, চোখেমুখে আর্তি নিয়ে সম্মুখে দঁাড়ান, তাহলে দ্বিধায় দ্বন্দ্বে জেরবার হওয়াই তো স্বাভাবিক। শরৎচন্দ্রের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছিল।
আজকের মায়ানমার, সেকালের রেঙ্গুনে এসে প্রথমদিকে শরৎচন্দ্র বেশ আনন্দেই ছিলেন শান্তি–সান্নিধ্যে। ‘‌ব্রহ্মদেশে শরৎচন্দ্র’‌ নামে একটি বই লিখেছিলেন শরৎচন্দ্রের রেঙ্গুনের বন্ধু গিরীন্দ্রনাথ সরকার। সে–বইতে আছে, ‘‌শরৎচন্দ্র স্বজাতীয় কোনও ব্রাহ্মণ কন্যাকে সমাজের অবিচার হইতে রক্ষা করিবার জন্য স্ব–ইচ্ছায় বিবাহ করিয়া সুখী হইয়াছিলেন।.‌.‌.‌ স্বপ্নবিলাসী শরৎচন্দ্রের প্রাণে ছিল অপূর্ব প্রেমের ভাণ্ডার, তিনি তঁাহার সমস্ত খুলিয়া দান করিয়াছিলেন স্ত্রী শান্তি দেবীকে.‌.‌.‌।’‌ গিরীন্দ্রনাথ বন্ধুজন, এসব দেখে কৌতুক করেই শরৎচন্দ্রকে বলতেন, ‘‌মহাস্ত্রৈণ’‌। শান্তির সঙ্গে শরৎচন্দ্রের হঠাৎই বিবাহ, এমন এক ঘটনার প্রেক্ষাপটে সে–বিবাহ, যা গল্পকথা বলেই ভ্রম হতে পারে। রেঙ্গুনে শরৎচন্দ্র যে বাড়িতে থাকতেন, সে–বাড়ির একতলায় কলকবজার এক মিস্ত্রি থাকত। স্ত্রী মরেছে, কারখানায় কাজ করে মেয়েকে নিয়ে কোনও রকমে দিন কাটানো সেই মিস্ত্রি রোজ রাতে নেশাড়ু বন্ধুদের নিয়ে মদ–গঁাজার আসর বসাত বাড়িতে। মেয়েটি বড়ই বিপন্ন হয়েছিল সংসারে। লাঞ্ছনা–গঞ্জনার সে–জীবন মুখ বুজেই সহ্য করছিল। হঠাৎই জানতে পারে, এক বৃদ্ধ–মাতালের হাতে বাবা সঁপে দিতে চাইছে তাকে। সে–পরিকল্পনা তলে তলে অনেক দূর এগিয়েওছে।
অশ্রুজলে অসহায় মেয়েটি দোতলার যুবকের কাছে সেদিন আশ্রয় খুঁজেছিল। শরৎচন্দ্র অশ্রুসিক্ত কিশোরী–কন্যাকে শুধু আশ্রয় দেননি, দিয়েছিলেন স্ত্রীর স্বীকৃতি। শরৎচন্দ্র ও শান্তির আনন্দ–সংসার স্থায়ী হয়নি। ভেঙেচুরে সব তছনছ হয়ে গিয়েছিল। শান্তির কোল–আলো করে যে পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছিল, এক বছরের বেশি বঁাচেনি সে। বঁাচেনি শান্তিও। প্লেগে দু’‌দিনে দুটি প্রাণ শরৎচন্দ্রকে বিধ্বস্ত করে ঝরে পড়ে।
হিরণ্ময়ী দেবী যখন পিতৃদেবের হাত ধরে দরজায় দঁাড়ালেন, তখনও শরৎচন্দ্র শান্তিময়, নানা রঙের দিনগুলিরই স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন। তঁার গান গাওয়া, ছবি অঁাকা— সব বন্ধ হয়েছিল আগেই। সাহিত্যেও আর মনোনিবেশ করতে পারতেন না। প্রাণোচ্ছল চেনা শরৎচন্দ্র একেবারেই অচেনা হয়ে উঠেছিলেন।
প্রথমে রাজি না হলেও অচিরেই রাজি হতে হয়। হিরণ্ময়ী দেবীকে মন্ত্রোচ্চারণ করে বিবাহ না করলেও অন্তর থেকেই তঁাকে গ্রহণ করেছিলেন শরৎচন্দ্র। হিরণ্ময়ী দেবীকে নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবিষ্কার করেছিলেন।
শরৎচন্দ্রের জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায় শ্যামচঁাদপুর গ্রামে গিয়ে পরবর্তিকালে হিরণ্ময়ী দেবীর পিতা কৃষ্ণদাসের বংশপরিচয় ও সন্তানসন্ততিদের নামধাম উদ্ধার করেছিলেন। জানা যায়, কৃষ্ণদাসের চার কন্যা, কনিষ্ঠার নাম মোক্ষদা। মোক্ষদাই হিরণ্ময়ী। এ নাম কি শরৎচন্দ্রের দেওয়া, যদি তা–ই হয়, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে!‌ সুখ্যাত হিন্দি–লেখক বিষ্ণু প্রভাকর ‘‌আওয়ারা মসীহা’‌ নামে শরৎচন্দ্রের একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। নানা ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই জীবনীগ্রন্থটি। বাংলা ভাষায় অনূদিত সংস্করণটির নাম ‘‌ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ’‌। এ বই থেকে জানা যায়, সে–সময় শরৎচন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেবায় পরিচর্যায় হিরণ্ময়ীই সুস্থ করে তুলেছিলেন তঁাকে। বিষ্ণু প্রভাকরের লেখা জীবনচরিতে আছে, ‘‌মায়ের মৃত্যুর পর শান্তি তঁার জীবনে একমাত্র নারী যে তঁাকে সত্যিকারের স্নেহ–ভালোবাসা দিয়েছিল। বহুদিন পর দুটো মমতামাখানো কথা, তঁার মনে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল ।

এদিকে কন্যাটিকে শরৎচন্দ্রের কাছে রেখে তঁার পিতা কৃষ্ণদাস ততদিনে রেঙ্গুন থেকে ফিরে গিয়েছেন। হিরণ্ময়ী শরৎচন্দ্রের কাছেই রয়ে গিয়েছিলেন। দিনে দিনে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে মোক্ষদা শরৎচন্দ্রের কাছে নতুন করে ধরা দিয়েছেন। শরৎচন্দ্র বুঝেছেন, খঁাটি সোনা, ‘‌মোক্ষদা’‌ আসলে হিরণ্ময়ী। ‘‌ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ’‌ বইতে বিষ্ণু প্রভাকর লিখেছেন, ‘‌যতক্ষণ না গান–বাজনা, আলোর ঝলমলানি ও বিধি–বিধানের সঙ্গে বিয়ে হয়, সমাজ তা মানতে চায় না। না মানুক, সর্বহারাদের শরৎ তা মেনেছিল।.‌.‌.‌ আইনত স্ত্রী না হয়েও স্ত্রীর সব দায়িত্ব হিরণ্ময়ী সেদিন গ্রহণ করেছিল। মনের এই মিলনই যথার্থ বিবাহ। .‌.‌.‌ হিরণ্ময়ী যদি মন্ত্রশুদ্ধ স্ত্রী না–ও হয়, তাতে কী হয়েছে?‌ সমাজ যদি তাকে স্ত্রীর ন্যায্য মর্যাদা না দিয়ে থাকে, তাতে তার কি ক্ষতি হয়েছিল?‌ শরতের প্রতি তার মনে ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার শেষ ছিল না। শরৎও যে হিরণ্ময়ীকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত।’‌
এই ভালবাসায় কোনও খাদ ছিল না, সজীব ছিল জীবনভর। তঁাদের আদৌ আনুষ্ঠানিক বিবাহ হয়েছিল কি না, তা নিয়ে একদা মতভেদ–মতান্তর কম হয়নি। শরৎচন্দ্রের স্নেহধন্য উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণী দেবীর সুরে সুর মিলিয়ে হিরণ্ময়ী দেবীকে শরৎচন্দ্রের ‘‌জীবন–সঙ্গিনী’‌ বলতে চাননি। ‘‌শরৎচন্দ্র প্রসঙ্গ’‌ নামের বইটিতে নিজের মতো করে যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে ওই অভিমতের বিরোধিতা করেছেন তিনি। আদৌ হিরণ্ময়ী দেবীকে শরৎচন্দ্র বিবাহ করেছিলেন কি না, তা নিয়ে ঘোরতর অস্পষ্টতা রয়েছে। গোপালচন্দ্র রায়ও তঁার ‘‌শরৎচন্দ্র’‌ নামের বইটির ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘‌সত্যই শরৎচন্দ্রের বিবাহটা একটা ধোঁয়াটে ব্যাপার। কেউ কেউ বলেন তিনি বিয়ে করেছিলেন;‌ আবার অনেকে বলেন, তিনি বিয়ে করেননি, কেবল জীবনসঙ্গিনী জুটিয়েছিলেন।’‌ গোপালচন্দ্র নিজে অবশ্য বিবাহ হয়েছিল বলেই মনে করেছেন।
মতভেদ–মতান্তরের কূটকচালি যতই চলুক, রাধারাণী দেবীও লক্ষ্য করেছিলেন, ‘‌শরৎচন্দ্র তঁাকে স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদায় সংসারে প্রতিষ্ঠিত রেখেছিলেন।’‌ হিরণ্ময়ী দেবীর দুঃস্থ পিতার প্রতি শরৎচন্দ্র কতখানি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তা বোঝা যায় একটি ঘটনায়। শরৎচন্দ্রের বই ছাপতেন কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ‘‌গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স’‌। প্রকাশকের কাছ থেকে রয়্যালটি বাবদ যে টাকা প্রাপ্য হত, সে–টাকা থেকে মাসে মাসে পঁাচ টাকা মানি অর্ডার যেত মেদিনীপুরে, হিরণ্ময়ী দেবীর পিতার ঠিকানায়। শরৎচন্দ্রের নির্দেশে প্রকাশক এই টাকা পাঠাতেন।
হিরণ্ময়ী দেবী ছিলেন রন্ধনপটিয়সী, ভাল রান্না করতেন। শরৎচন্দ্রকে এটা–সেটা রেঁধে খাওয়াতেন। লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক লেখিকা শরৎচন্দ্রকে মাঝে মাঝেই চিঠি লিখতেন। শরৎচন্দ্রও সে–সব চিঠির উত্তর দিতেন। ‘‌পরম কল্যাণীয়াসু’‌ সম্বোধনে লেখা শরৎচন্দ্রের চিঠিতে সম্পর্কের মাধুর্যতা গোপন থাকেনি। হাওড়ার কাছে শিবপুর থেকে লেখা এক চিঠিতে হিরণ্ময়ী দেবী খাওয়ার ব্যাপারে কতখানি পীড়াপীড়ি করতেন, সে–সব জানিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। হিরণ্ময়ী দেবী শরৎচন্দ্রকে চোখে চোখে রাখতেন, তঁাকে নিয়ে কতখানি চিন্তা–দুশ্চিন্তা ছিল, তা বোঝা যায় এই তৎপরতায়। যত্নের বাড়াবাড়ি, অভিমান করে ‘‌বিবাগী’‌ হয়ে যাওয়ার কথা বলা— সবই হিরণ্ময়ীর প্রেমের ভিন্নতর প্রকাশ। শরৎচন্দ্র উল্লিখিত চিঠিতে লীলারাণীকে লিখেছিলেন, ‘‌বাড়ীর লোকে বোঝে না, তারা ভাবে আমি কেবল না খেয়ে খেয়েই রোগা। সুতরাং খেলেই বেশ ওদেরই মত হাতী হয়ে উঠব।.‌.‌.‌ আজ বিশ বছর আমরা কেবল খাওয়া নিয়েই লাঠালাঠি করে আসছি। ঐ খেলে না, খেলে না— রোগা হয়ে গেল— ঘরসংসার রান্নাবান্না কিসের জন্য— যেখানে দুচোখ যায় বিবাগী হয়ে যাব.‌.‌.‌।’‌
হিরণ্ময়ী দেবী রান্নাবান্নায় যেমন মনোযোগী ছিলেন, তেমনই মনোযোগী ছিলেন পূজার্চনায়। ধর্মেকর্মে নিবেদিতপ্রাণ। ব্রত–উদযাপন, ব্রাহ্মণভোজন— এসব বাড়িতে লেগেই থাকত। শরৎচন্দ্র এসবে কখনও বাধা দেননি। সব সময়ই সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে পাশে থেকেছেন। হিরণ্ময়ী দেবীর ব্রত উদযাপনকল্পে একবার প্রচণ্ড গরমে গোটা চৈত্রমাসই শরৎচন্দ্রকে কাটাতে হয়েছিল কাশীতে। একলাইনও লিখতে পারেননি, তবু বিরক্ত না হয়ে হিরণ্ময়ী দেবীর মনস্কামনাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। প্রকাশক হরিদাস চট্টোপাধ্যায়কে দুশো টাকা পাঠানোর আর্জি জানিয়ে কাশী থেকে লিখেছিলেন, ‘‌এখানে ভারি গরম পড়িয়াছে, আর এক মুহূর্ত মন টেকে না এমন হইয়াছে। .‌.‌.‌ একটা ব্রত উদযাপন আছে এঁর। শ দুই টাকা পাঠিয়ে দেবেন। একছত্র লেখা বার হয় না, একি বিশ্রী দেশ। গত ৪/‌৫ দিন নিয়ে বসি, আর ঘণ্টা দুই চুপ করে থেকে উঠে পড়ি।’‌
একদিন নিশ্চিন্ত হয়ে কোথাও নেশা করে পড়ে থাকার উপায় ছিল না। চটকা ভাঙলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে— একটা মানুষ উপোস করে ঘরের মেঝেয় লম্বা হয়ে পড়ে আছে।.‌.‌.‌ সদর দরজায় কড়া নাড়লেই দরজা খুলে যাবে— সামনে থাকবে বোকা–বোকা ভীতু চোখে একটা উপোসী শুকনো মুখ।.‌.‌.‌ রাগারাগি বকাঝকা অনেক করেচি।.‌.‌.‌ কোনও ফল হয়নি। কৈফিয়তও চায় না— রাগও করে না— শুধু ভাবনাভয়ে ভরা ভীতু চোখে তাকিয়ে থাকে।’‌
অতি নিকট থেকে জানতেন, অপরিমেয় স্নেহ পেয়েছিলেন, তিনি তঁার বিবাহব্যবস্থা করেছিলেন— সেই রাধারাণী দেবীকে শরৎচন্দ্র এসব বলেছিলেন। যঁার সম্পর্কে এ কথা বলেছিলেন, তিনি হিরণ্ময়ী দেবী। ‘‌শরৎচন্দ্র:‌ মানুষ ও শিল্প’‌ বইতে বিশেষ করে মানুষ শরৎচন্দ্রকে চেনাতে চেয়েছিলেন রাধারাণী। মরমি মানুষটির জীবনে ঘাত–প্রতিঘাত কম ছিল না, ছিল টানাপোড়েন, বিবিধ সঙ্কট— সেদিকেই আলো ফেলেছেন স্নেহধন্যা রাধারাণী।
রাধারাণী দেবীকে বালিগঞ্জের বাড়িতে বসে শরৎচন্দ্র সেদিন নিজের বিপন্নতার কথা শুনিয়েছিলেন। জীবনসঙ্গিনী হিরণ্ময়ী দেবীর ভক্তিপরায়ণতার এই বাড়াবাড়ি নিয়ে শরৎচন্দ্র প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছেন। কখনও বা হাসি–মশকরাও। সেদিকে হিরণ্ময়ী দেবী ফিরেও তাকাতেন না। নিত্যদিনের কর্মসূচি থেকে কেউ তঁাকে কখনও টলাতে পারেননি। স্বামী নরেন্দ্র দেবকে সঙ্গে নিয়ে রাধারাণী দেবী এক রোববার সকালের দিকে শরৎচন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে এক নিদারুণ দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন। খবরের কাগজ হাতে নিয়ে শরৎচন্দ্র তখন আড্ডায় মশগুল। হঠাৎই ছন্দপতন। সবারই চোখ চলে যায় দরজার দিকে। রাধারাণী লিখেছেন, ‘‌দরজার সামনে বউদি এসে দঁাড়ালেন। চওড়া লালপাড় তসরের শাড়ি, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, সাদা শঁাখা, আর একগোছা ঝকঝকে সোনার চুড়ি।’‌ হিরণ্ময়ী দেবীর হাতে ছিল পাথরের বাটি। কখনও কঁাসার বাটিও থাকত। শূন্য বাটি নয়, জল–ভরা বাটি হাতে নিয়ে লজ্জা–লজ্জা মুখে কেন হিরণ্ময়ী দেবীর আগমন— শরৎচন্দ্র খোলসা করেছিলেন খানিক রসিয়ে। রাধারাণী দেবী, শরৎচন্দ্রের কাছে যিনি স্নেহের ‘‌রাধু’‌, তঁাকে নিয়ে কৌতুক করতেও ছাড়েননি। কৌতুক মেশানো গলায় হিরণ্ময়ী দেবীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘‌পা–দোক নেবে বুঝি তুমি?‌ এরা রয়েছে বলে লজ্জা হচ্চে?‌ লজ্জার কী আছে?‌ তুমি কত ভক্তিমতী আদর্শ হিন্দুনারী— একটু দেখেশুনে শিখে নিক না রাধু। এরা তো সব একেলে বিবি–মেয়ে।’‌

 

‘‌রাধু’‌কে জড়িয়ে শরৎচন্দ্র যা বলেছিলেন, তা নিশ্চয়ই তঁার মনের কথা নয়। শরৎচন্দ্রের পা–ধোয়া জল খেতেন প্রতিদিন, হিরণ্ময়ী দেবীর এই ভক্তির বাড়াবাড়িতে স্তম্ভিত হতেই হয়। যঁার লেখার অনেকখানি জুড়েই নারীমনের যন্ত্রণা, দুঃখের বারোমাস্যা, সেই শরৎচন্দ্র এসব বরদাস্ত করতেন কী করে, কে জানে। তঁার ভাবনার জগতের সঙ্গে মেলানো যায় না, ঘোরতর বৈপরীত্য রয়ে যায়। ভাবতেও কেমন যেন লাগে, হিরণ্ময়ী দেবী এভাবে প্রতিদিন জলের বাটি শরৎচন্দ্রের পায়ের কাছে ধরতেন। শরৎচন্দ্র বাটির জলে বুড়ো আঙুল ছুঁইয়ে দিতেন। রাধারাণী দেবী লক্ষ্য করেছিলেন, ‘‌বউদি শরৎদাকে প্রণাম করে বাটি হাতে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।’‌
যতই মধ্যযুগীয় মনে হোক না কেন, এও বোধহয় গভীর প্রেমের এক ভিন্নতর প্রকাশ। যদিও শরৎচন্দ্র তঁাকে প্রথা মেনে বিয়ে করেননি। শরৎচন্দ্রকে যঁারা নিকট থেকে জানতেন, তঁারা কেউ কেউ এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। মধ্যযুগীয় ‘‌পাদোদক’‌–পান, সেই সঙ্গে আধুনিকতার পরিচয়বহ ‘‌লিভটুগেদার’‌— সবই শরৎচন্দ্রের জীবনে মানানসই হয়ে উঠেছিল। বাড়তি সমস্যা তৈরি করেনি
শরৎচন্দ্রের মৃত্যু হিরণ্ময়ী দেবীকে শোকস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ করে তোলে। ছবির পর ছবি, মনের কোণে কত না ছবি ভেসে ওঠে। সব ছবি সমান নয়, কোনওটি ধূসর–ফিকে, আবার কোনওটি ঝলমলে উজ্জ্বল। মনে পড়ে রেঙ্গুনবাসের স্মৃতি। তঁার আঁধার–কালো মুখে আলো ফুটিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। তঁাদের সেই আনন্দ–সংসারে ‘‌ভেলু’‌ নামে একটি কুকুরও ছিল। রেঙ্গুন থেকে ফেরার সময় শরৎচন্দ্র ভেলুকেও সঙ্গে এনেছিলেন। রেঙ্গুনের চাকরি ছেড়ে স্থায়ীভাবে কলকাতায় ফেরার পর সংসার পেতেছিলেন হাওড়ার বাজে শিবপুরে, পরে দেউলটি স্টেশনের অদূরে রূপনারায়ণ–সংলগ্ন সামতাবেড়ে গ্রামে। শরৎচন্দ্র প্রয়াত হওয়ার পর স্মৃতি দিয়ে ঘেরা মূলত সামতাবেড়েতেই থাকতেন হিরণ্ময়ী দেবী। স্মৃতি অঁাকড়ে আরও বছর তেইশ বেঁচেছিলেন তিনি। শরৎচন্দ্র মারা গিয়েছিলেন ১৯৩৮–এর ১৭ জানুয়ারি। স্বামীর প্রয়াণদিবসে হিরণ্ময়ী দেবী নিরম্বু উপবাস করে থাকতেন সারাদিন। ব্যবস্থা করতেন বালকভোজনের।
শরৎচন্দ্রের জীবন ভরিয়ে দিয়েছিলেন হিরণ্ময়ী দেবী। শরৎচন্দ্রের এলোমেলো জীবনে শৃঙ্খলা এনেছিলেন তিনি। শরৎ–জীবনে হিরণ্ময়ী দেবীর ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। শরৎ–জীবনীকার যথার্থই লিখেছেন, ‘‌শরৎচন্দ্র তঁার প্রথম যৌবনে অল্পদিন স্থায়ী সাহিত্য–সাধনার পর দীর্ঘদিন যখন সাহিত্যক্ষেত্র থেকে দূরে ছিলেন এবং আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূর প্রবাসে যখন ছন্দহীন জীবনযাপন করেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে তঁার জীবনে হিরণ্ময়ী দেবী এসে যদি না দেখা দিতেন, তা হলে সেদিনের সেই শরৎচন্দ্র আজকের শরৎচন্দ্র হতে পারতেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’‌
নার্সিংহোমে শয্যাশায়ী শরৎচন্দ্র শুনতে পেয়েছিলেন মৃত্যুর পদধ্বনি। বুঝতে পেরেছিলেন তঁার মৃত্যু আসন্ন। রাধারাণী দেবীর লেখায় আছে, এক সময় ‘‌ভারতবর্ষ’‌ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন ও প্রকাশক হরিদাস চট্টোপাধ্যায় শরৎচন্দ্র–হিরণ্ময়ীর ম্যারেজ–রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করতে তৎপর হয়েছিলেন। জলধর সেনকে সামনে রেখে জড়ো হয়েছিলেন আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ হিতার্থী। শরৎচন্দ্র অবশ্য কিছুতেই রাজি হননি। বলেছিলেন, ‘‌বড়বউকে কেউ যদি কোন ঘা দিতে আসে— সেটা বুমেরাং হয়ে তাকেই উল্টে আঘাতে ফেলবে। তোমাদের কোনো ভয় নেই। রেজিস্ট্রি ফেজিস্ট্রি করতে চাই না। সারা জীবনে যা করলুম না— মরবার আগে সে ভণ্ডামি করতে পারবো না।’‌ অবশ্য আদৌ এমন ঘটেছিল কি না, তা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তঁার লেখা থেকে জানা যায়, উইল করার ঢের আগে জীবনবিমার নমিনিতে হিরণ্ময়ী দেবীর নাম ‘‌স্ত্রী’‌ হিসেবেই যুক্ত করেছিলেন শরৎচন্দ্র। ‘‌শরৎচন্দ্র–প্রসঙ্গ’‌ বইতে তিনি জানিয়েছেন, ‘‌তঁার মৃত্যুর পর হিরণ্ময়ী দেবী শরৎচন্দ্রের একটি জীবন–বীমাপত্র— Life Insurance Policy আমাকে দেখান। তাতে প্রকাশ পায়, মৃত্যুর বহু পূর্বে শরৎচন্দ্র হিরণ্ময়ী দেবীকে ‘‌স্ত্রী’‌ বর্ণনা করে তঁার nominee‌ মনোনয়ন করেন এবং বীমা অফিসে যথাবিধি জানিয়েও রাখেন। এই মনোনয়নের বলে হিরণ্ময়ী দেবী তঁার প্রাপ্য টাকাও পান।’‌ উমাপ্রসাদের মতো আরও কেউ কেউ হিরণ্ময়ীকে শরৎচন্দ্রের বিয়ে করা ‘‌স্ত্রী’‌ ভাবতেই চেয়েছেন, ‘‌জীবনসঙ্গিনী’‌ নয়। রাধারাণী দেবীর লেখা নিয়ে এক সময় জোর তর্ক–বিতর্কও হয়েছিল। শরৎচন্দ্র অবশ্য মৃত্যুশয্যায় হিরণ্ময়ীকে ‘‌মাই ওয়াইফ’‌ বলেছিলেন।
অপারেশন ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই— এই চরম সত্যটি জানার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন শরৎচন্দ্র। যাবতীয় সম্পত্তি দ্রুত উইল করে রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সেইমতো ব্যবস্থাও হয়। উইলে লেখা হয়েছিল, ‘‌I give devise and bequeath all my estate and effects to my wife Sm. Hironmoyee Debi of No. 24, Aswini Dutt Road to be held and enjoyed by her for the term of her natural life subject nevertheless to the right of my brother to live in the premises No. 24 Aswini Dutt Road with his family as he is at present doing and after my death and my wife's death my brother Prokash's son or sons who shall survive her shall be the absolute owner.‌’‌
হিরণ্ময়ী দেবী ছিলেন ঘোরতর সংসারী। দক্ষ হাতে ঘরগৃহস্থালি সামলাতেন। ছিলেন অন্তঃপুরচারিণী। সে–ভাবে কোথাও বেরুতেন না। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে সভাসমিতিতে কখনই যাননি। ক্যামেরার সামনেও দঁাড়াননি। নিজেকে মেলে ধরে নয়, গুটিয়ে রেখেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। নিজের সন্তান ছিল না, শরৎচন্দ্রের ভাইপো–ভাইঝি অমলকুমার ও মুকুলমালাকে সন্তানস্নেহে আগলে রেখেছিলেন।
শরৎচন্দ্রের সঙ্গে হিরণ্ময়ীর আদৌ বিবাহ হয়েছিল কি না, তা নিয়ে তর্ক–বিতর্কের কোনও মানে হয় না। আটপৌরে হিরণ্ময়ীকে নিয়ে শরৎচন্দ্র ভাল ছিলেন, এটাই বোধহয় বড় কথা। শরৎ–জীবনীকার গোপালচন্দ্র জানিয়েছেন, ‘‌হিরণ্ময়ী দেবী খুব স্বামী–সোহাগিনী ছিলেন।’‌ ১৯১২ থেকে ১৯৩৮ ছাব্বিশ বছরের সম্পর্ক, সেবায় শুশ্রূষায় শরৎ–জীবন ভরিয়ে তুলেছিলেন তিনি। হাল–ভাঙা দিশা হারানো নাবিকের মতো অবস্থা তখন, শরৎচন্দ্রের সেই বিশৃঙ্খল–বোহেমিয়ান জীবনে দু’‌দণ্ড নয়, স্থায়ী শান্তি–প্রশান্তি দিয়েছিলেন হিরণ্ময়ী দেবী।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆