১৮৯৪ সালে ২১ ডিসেম্বর আয়োজন হল প্রথম পৌষমেলা ও যাত্রার। কি কি হল তার বিবরণ দিই। সবাই ব্রহ্ম উপাসনার জন্য প্রস্তুত হল। রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে মঙ্গলগীত গাইতে গাইতে সবাই মন্দির প্রদক্ষিণ করল। পরে আচার্যরা বেদী গ্রহণ করল, ক্ষিতীন্দ্র সবাইকে স্বাগত জানান। এরপর হেমচন্দ্রের বক্তৃতা পাঠ, সঙ্গে প্রধান আচার্যের উপদেশ পাঠ, তারপর চিন্তামণির প্রার্থনা। তারপর গান ও সমাপ্তি। মন্দিরের সিঁড়িতে বহুসংখ্যক ভোজ্য সুসজ্জিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ সেখানে দাঁড়িয়ে ভোজ্য উৎসর্গ করলেন, সবস্ত্র ভোজ্য অনাথ দীন দু:খী আতুরদের দেওয়া হল। দুপুরবেলায় দোকান বসল, স্থানীয় লোক ভিড় করল। এ সময় রাজা হরিশচন্দ্রের উপাখ্যান গীত হল। সন্ধ্যা নামল। সান্ধ্য উপাসনা উদ্বোধন করলেন প্রিয়নাথ শাস্ত্রী ও তারপর অন্যান্যদের বক্তৃতা। এরপর আতসবাজি। তারপর চটচটা শব্দে বহ্নুৎসব। লোকদের মধ্যে মহাকোলাহল। এই প্রথম পৌষমেলায় ব্যয় — ১৭৩২ টা ১০ আনা। এর মধ্যে ৬০০ গানের কাগজ ছাপানোর হিসেবও আছে। ১৯০১-এ স্থাপন হল ব্রহ্মবিদ্যালয়। তারপর মেলা। ব্যাপক কেনাবেচা। বাউল সম্প্রদায় নানা স্থানে নাচগান করছে। ব্যাপক ভিড়। কতকগুলো বালক ক্ষৌমবস্ত্র পরিধান করে বসে আছে। প্রথমে সত্যেন্দ্র বিদ্যালয় সম্বন্ধে কিছু বললেন। পরে রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত করলেন। বেলা শেষ হল, কাচনির্মিত মন্দিরে আলো জ্বলে উঠল। আলোকছটায় ঘরের নানা বর্ণ উদ্ভাসিত। ১৯০৪ এর মেলার বর্ণনা — দুপুরে মেলা শুরু, স্থানীয় দ্রব্যাদির যথেষ্ট ক্রয় বিক্রয়। দীন হীন দরিদ্রেরা অন্নবস্ত্র পেয়ে উল্লসিত। রাতে বিপুল বহ্নুৎসব। এ মেলায় আপত্তিকর কিছু নেই। আদিপর্বের এ মেলার বৈশিষ্ট্য ৪টি — কলকাতা আগত ব্রাহ্মনেতাদের পরিচালনায় মন্দিরে সকাল সন্ধ্যায় ব্রহ্মোপাসনা। দীন দরিদ্রদের অন্নবস্ত্র দান। যাত্রাভিনয়, বাউল গান, কীর্তন, আতসবাজি। মেলা মাত্র ১ দিনের।
মহর্ষি প্রয়াণের পর রবীন্দ্রনাথ এই ত্রিদিবসের রূপকার। মন্দিরের সোপানে দাঁড়িয়ে অনাথ আতুরদের বস্ত্র ভোজ্য উৎসর্গ। উপাসনায় তাঁর ভাষণ। ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থমালায় রবীন্দ্র ভাষণগুলি সংকলিত। যেমন — (ক) শান্তিনিকেতনের সাম্বৎসরিক উৎসবের সফলতার মর্মস্থান যদি উদঘাটন করে দেখি, তবে দেখতে পাব, এর মধ্যে সেই বীজ অমর হয়ে আছে, যে বীজ থেকে এই আশ্রম-বনস্পতি জন্মলাভ করেছে, সে হচ্ছে সেই দীক্ষাগ্রহণের বীজ। (খ) মহর্ষির জীবনের একটি ৭ পৌষকে সেই প্রাণস্বরূপ অমৃতপুরুষ একদিন নি:শব্দে স্পর্শ করে গিয়েছেন, তার উপরে আর মৃত্যুর অধিকার রইল না। (গ) তাঁর সেই মহা দিনটির চারদিকে এই মন্দির, এই আশ্রম, এই বিদ্যালয় প্রতিদিন আকার ধারণ করে উঠছে, আমাদের জীবন, আমাদের হৃদয়, আমাদের চেতনা একে বেষ্টন করে দাঁড়িয়েছে। (ঘ) এখানে কর্মে দীক্ষা, শিক্ষায় দীক্ষা, শিক্ষকতার দীক্ষা সেই অমর জীবনের দীক্ষা। শুধু ভাষণ বা বক্তৃতা নয়, চিঠিপত্রেও আছে এই পৌষপার্বণ সম্পর্কে কবির শ্রদ্ধা ও অনুরাগ। যেমন — অজিত চক্রবর্তীকে লেখা ১৯২২-এ আমেরিকার ইলিনয় থেকে চিঠির একাংশ — ‘আজ ৭ ই পৌষ। ....আমার মধ্যে একটা বেদনা বোধ হতে লাগল। ...তোমাদের সমস্ত উৎসব আমার হৃদয়কে বোধহয় আকর্ষণ করেছিল’। অন্যত্র বলেন — ‘তোমাদের ওখানে রাত্রের উৎসব এতক্ষণ শেষ হয়ে গেছে। লোকের কোলাহল শেষ হয়ে এসেছে ... আমি তোমাদের মুখরিত মাঠের কলরব সুনতে পাচ্ছি’। আলোচকদের মতে হিন্দুমেলা স্বদেশী সমাজ এর মেলার আদর্শ পৌষমেলার আদর্শকে প্রাণিত করেছিল।
আশ্রমের প্রথম যুগের ছাত্র সুধীরঞ্জন দাস লিখছেন — ‘সাতই পৌষের দিন তিনেক আগে থাকতেই লোক সমাগম শুরু হল। কতদূর গ্রাম থেকে গোরুর গাড়িতে পসরা বোঝাই করে কত দোকানী পসারী আসতে লাগল। কত রকমের হাঁড়ী কলসী - কোনোটা বা লাল, কোনোটা বা কালো। কতো দরজা-জানালাই না জড়ো হল। দুটো তিনটে নাগরদোলা এবং একাধিক চড়কি ঘোড়দৌড়ের মঞ্চ। এক এক পয়সায় কত পাক খাওয়া যেত সেকালে। গালার কত রকমারি জিনিস — আম আতা কলা শশা টিয়েপাখি হরিণ হাতি ও বাঁদর। তাছাড়া নানা আকারের কাগজচাপা এবং আরো কতরকম খেলনা ছিল তা বলে শেষ করা যায় না। বাঁশের ছোট বড় ছড়ি, মুখোশ, তালপাতার টুপি ও হাতপাখা তো থাকতই। হরেকরকম খাবারের দোকান, মিঠাই, মণ্ডা ও পাঁপড়ভাজা। বড়ো বড়ো বাক্সের মধ্যে কত রকমের ছবি দেখাত সামনের কাঁচবসানো বড়ো দুটো ফুটো দিয়ে। আর ছবির চেয়ে রসালো হত সেই বাক্সওয়ালার সুর করে বলা বর্ণনাগুলি। কত বিক্রি হত সাঁওতালি মেয়দের রূপার গহনা — কানের ঝুমকো, গলার হার, খোঁপার ফুল এবং হাতের বাউটি। কত আসত তাঁতের বোনা কাপড়, বেড-কভার, গামছা। কত না থাকত মনোহারী দোকান — সামনে ঝুলত একটা করে প্রকাণ্ড আয়না, দোকানের চেহারা যাতে খোলে, আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থাও ছিল। কবির লড়াই বা যাত্রাগান শুনে শেষ রাত্রে সবাই সেই আসরেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। সন্ধ্যার সময় মন্দিরে উপাসনা করলেন গুরুদেব। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর ছোট ছোট দল বেঁধে এক একজন মাস্টার মশায়ের তত্ত্বাবধানে ছেলেরা বাজি দেখতে গেল। তখনকার দিনে বাজি পোড়ানো হত রতনকুঠির উত্তর পুব দিকে। অনেক রাতে প্রাক্ কুটিরে ফিরে এসে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়া গেল। (আমাদের শান্তিনিকেতন)
প্রমথনাথ বিশী-ও পুরোনো কালের ছাত্র। তাঁর লেখাতেও ৭ই পৌষের উৎসবের চমকপদ বিবরণ আছে। তিনি লেখেন — দুদিন খুব ধুমধাম হত। সবচেয়ে যা মনোহরণ করত তা হচ্ছে একটা কাগজের জাহাজ ও একটা কাগজের কেল্লার লড়াই। গোলার আঘাতে দুটোই শেষপর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যেত। উৎসবের দিন অন্ধকার থাকতে উঠতে হত। মন্দিরের উত্তরের মাঠ এক রাত্রেই দোকানে তাঁবুতে গাড়িতে নাগরদোলায় শামিয়ানায় ভরে যেত। সাঁওতাল বাঙালী মাড়োয়ারী কেউ বেচতে, কেউ কিনতে কেউ তামাসা দেখতে এসেছে। সন্দেশ, লোহার বাসন, কাটা কাপড়, তেলেভাজা, খেলনা, শিউড়ির মোরব্বার দোকান আসত। মাঝখানে পাল খাটিয়ে যাত্রাগান। একদিকে নাগরদোলা আরোহী নিয়ে পাক খাচ্ছে। আশ্রম অতিথিস্বজনে পূর্ণ। ছোটরা বড়দের নেতৃত্বে মেলায় যাবার হুকুম পেত। কিন্তু চিহ্নিত স্থান ছাড়া কোথাও যাবার উপায় ছিল না, পিছনে অভিশাপের মতো কাপ্তেনের দল। কিছু যে জিনিস কিনব তার উপায় নেই। দুপুরবেলা আহারান্তে যাত্রাগান আরম্ভ। ছাত্ররা সারিবদ্ধ ভাবে আসরে গিয়ে বসত। হয়ত নীলকণ্ঠ অধিকারীর কৃষ্ণবিষয়ক পালা। গান শুনতে শুনতে শীতের রোদ নিস্তেজ হয়ে আসত, মেলার কন্ঠমুখর, আর তাল রেখে বাজছে ডুগডুগি, বাউলের একতারা, সাঁওতাল নাচের মাদল। সন্ধের আগে আহার। খাওয়া বেশ রাজকীয় ধরনের। খাবার পরে আবার মন্দির। মন্দিরে পাঁচটা ঝাড়ে মোমবাতির আলো, মেঝেতে বাতিদানে অসংখ্য মোমবাতি। সন্ধের সময় মেলার ভিড় এত বেড়ে উঠত যে, তা সংযত করতে পারত একমাত্র রায়পুরের রবি সিং। সে বেত হাতে সপাসপ জনতাকে আঘাত করে চলত। শেষে বাজিতে আগুন। তুবড়িগুলো মুহূর্তে অগ্নিময়। ৮ পৌষ আশ্রমের প্রাক্তন ছাত্রদের উৎসব। আমবাগানে সভা। প্রাক্তন ছাত্ররা সারবন্দীভাবে সভায় প্রবেশ করত, সবার আগে প্রাক্তনতম রথীন্দ্র ও সন্তোষ মজুমদার। ৯ তারিখে স্মরণ উৎসব — আশ্রমের ছাত্র, অধ্যাপক, কর্মী স্মরণে। সেদিন হবিষ্যান্ন গ্রহণের ব্যবস্থা। এরপরই ১০ কিম্বা ১১ পৌষ বার্ষিক ক্লাস প্রমোশনের পালা। (রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন) মুজতবা আলি জানান — অনেক পরে আশ্রমের মাস্টারদের গৃহিনী কন্যারা মেলা দেখার অনুমতি পান। তাদের আনা হয়েছিল গরুর গাড়িতে করে এবং তারা মেলার প্রত্যন্ত প্রদেশ থেকে, গাড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেলা দেখতেন। (গুরুদেব শান্তিনিকেতন)
‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকায় আছে ১৯১৮ সালের মেলার বর্ণনা। সে বছর কীর্তনের আখড়া বসেছিল, আরেকদিকে দু দল বাউল একতারা বাজিয়ে নৃত্য করতে করতে সকলকে মুগ্ধ করে বেড়াত। মন্দিরের গায়ক শ্যাম ভট্টাচার্য ও আশ্রম বালকরা গাছের তলে বসে বাউলের সুরে গান গাইছিল। কৃষিবিদ সন্তোষ মুজমদার একটি গো-প্রদর্শনী খুলেছিলেন। ইলামবাজারের গালার কারিগররা গালার দ্রব্য তৈরির প্রণালী সাধারণকে দেখাচ্ছিল। আশ্রম ছাত্রদের সমবায় ভাণ্ডারের দোকান দেওয়া হয়। আর একদল ছাত্র ‘সমবায়’ খাদ্য ভাণ্ডার খুলে বিশুদ্ধ খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করছিল। অল্পবয়স্ক ছাত্ররা নিজেরা টাকা তুলে দোকান তৈরি, কেনা বেচা, হিসাব রাখার দায়িত্ব নেয়। শ্রীনিকেতনে মেলার সময় একটি বড় সভা হয় যাতে সভাপতি হন গুরুসদয় দত্ত। সেখানে জলকষ্ট নিবারণ, পুকুরের পাঁক তোলা, ম্যালেরিয়া পরিত্রাণ, সমবায় প্রণালীতে কৃষি ও শিল্পের উন্নতিসাধন বিষয়ে আলোচনা হয়। স্থানীয় মুন্সেফ এবং অধ্যাপকরাও বক্তৃতা দেন। দুপুরে হয় সাঁওতালদের তীর চালনার প্রতিদ্বন্দ্বিতা — পুরস্কারও ঘোষণা হয়। দ্বিজেন্দ্র মৈত্রের উদ্যোগে শিক্ষা, স্বাস্থ্য দুরবস্থা বিষয়ে ১০৭টি ছবি দেখানো হয়। ১৯২২ সালের পৌষমেলায় কীর্তন, বাউল, কুস্তি ব্যায়াম, সাঁওতাল নাচ, বায়স্কোপ, আতসবাজি, যাত্রাগান, তীর ছোড়া, ঘোড় দৌড়, ম্যাজিক লন্ঠন, বৈকুন্ঠের খাতা, ম্যাকবেথ হয় অঙ্ক এবং তারকারাক্ষস ৩য় অঙ্কের অভিনয়, খ্রিস্টোৎসবের উপাসনা হয়। এবার মেলায় শেষ আকর্ষণ ছিল কৃষি শিল্প স্বাস্থ্য প্রদর্শনী। মেলা চলে ২ দিন ধরে। সবশুদ্ধ ২টি ঘরে প্রদর্শনী হয়। কৃষি প্রদর্শনীর আয়োজন করে সুরুল কৃষিবিভাগ ও সরকারী কৃষিবিভাগ। খাগড়ার বাসন, মুর্শিদাবাদের রেশমী কাপড়, তাঁতের কাপড়, খদ্দর ইত্যাদি প্রদর্শনীতে এসেছিল। স্থানীয় পল্লীশিল্পের স্টলটি বিশেষ উল্লেখ্য। চাষি মেয়েদের হাতের বোনা মাদুর, পাখা, শিকে, কাঁথা, মাটির ঘর সাজাবার বিবিধ জিনিস শিল্প অনুরাগীদের চিত্ত আকর্ষণ করে। ছিল খড়ের - দেশীয় আসবাব সজ্জিত ও আল্পনা দেওয়া। তাছাড়া বয়ন ও চর্মশিল্পের প্রদর্শনী। মেলা প্রাঙ্গনে নৈশ প্রহরার দায়িত্ব নেন অনেকেই। আস্তে আস্তে মেলার পরিবর্তন ঘটে, দোকানের সংখ্যা বাড়ে। ১৯২৫ এ ছিল ৬০টি দোকান — বেশির ভাগই খাবার ও মনোহারি দোকান। বিনোদনে এসে গেল ম্যাজিক। বায়স্কোপ ইত্যাদি।
২য় মহাযুদ্ধ, ৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন, দুর্ভিক্ষ, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা ইত্যাদির প্রতিক্রিয়া পড়ে পৌষমেলার ওপর। ৪১ সালের মেলা প্রাণহীন, দোকান পসরা তেমন বসেনি। ‘সাহিত্যিকা’ চা জলখাবার দোকানের লভ্যাংশ পাঠিয়েছিল মেদিনীপুরের বন্যার্তদের ত্রাণভাণ্ডারে। ৪৩ সালে ৪৬ সালে দুর্ভিক্ষ বা দাঙ্গার কারণে মেলা বন্ধ ছিল। ৪৪ সালে ৮ তারিখে বার্ষিক সভার সঙ্গে বিশ্বভারতীর সমাবর্তন চালু হয়। আস্তে আস্তে মেলা প্রসারিত হল ৩দিন ও ৩ রাত্রে। ৫১ সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়রূপে স্বীকৃতি পাবার পর বিশ্বভারতীর জীবনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে, পৌষমেলায় ভিড় বাড়ে। ১৯৫০ থেকে ৭ পৌষের উপাসনা ব্রহ্ম-মন্দিরের পরিবর্তে ছাতিমতলায় স্থানান্তরিত হয়। ৬১ সালে মেলা চলে যায় মন্দির সংলগ্ন মাঠ থেকে পূর্বপল্লীর মাঠে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর ৮ পৌষের সমাবর্তনে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী তথা বিশ্বভারতীর আচার্য। ৬৭ তে ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে আম্রকুঞ্জে বোমা বিস্ফোরণ হলে পৌষ উৎসবে সমাবর্তন বন্ধ করা হয়। রবীন্দ্র তিরোধানের পর অনুষ্ঠানসূচীতে নূতনত্ব হল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ স্মারক বক্তৃতা। ৮ পৌষ বিকেলে বেদ উপনিষদ প্রসঙ্গে বক্তৃতা। ভিড় ক্রমবর্ধমান হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের হলঘর, ক্লাসরুমে খড় তেরপল শতরঞ্চি বিছিয়ে বহিরাগতদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এককালে তাঁবু খাটানো হত। এছাড়া অনেক অস্থায়ী হোটেল গড়ে ওঠে।
উৎসবের সূচনা হয় বৈতালিক গানে। গাওয়া হয় — ‘আজি যত তারা তব আকাশে/ সবে মোর প্রাণভরি প্রকাশে’ কিংবা ‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে/ একেলা রয়েছে নীরব শয়ন পরে/ প্রিয়তম হে, জাগো জাগো, জাগো’ এইসব গানে আশ্রমিক ও অতিথিরা পরিক্রমা করেন শালবীথি, আম্রকুঞ্জ, বকুলবীথি, ছাতিমতলা। বৈতালিকের পর ব্রহ্ম উপাসনা। মহর্ষির দীক্ষার তাৎপর্য এবং শান্তিনিকেতনের জীবনে ৭ পৌষের ভূমিকা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রের কথা উপাচার্য পড়ে শোনান। তারই মাঝে উচ্চারিত বেদমন্ত্র। রবীন্দ্র দ্বিজেন্দ্র সত্যেন্দ্র জ্যোতিরিন্দ্র রচিত ব্রহ্মসংগীত ও পূজা পর্যায়ের গান। সঙ্গীতভবনের ছাত্রছাত্রী অধ্যাপিকা অধ্যাপকরা গানের দায়িত্বে। উপাসনা শেষে ‘কর তার নাম গান’ গাইতে গাইতে দর্শক ও শ্রোতারা ছাতিমতলা পার হয়ে উত্তরায়নে যায়। শান্তিনিকেতন বাড়ি থেকে ভেসে আসে নহবতের সুর। ৮ তারিখে দুপুরে দর্শন ভবনে হয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ স্মারক বক্তৃতা। আশ্রমিক সঙ্ঘের অধিবেশনের সূচনায় কোনো বিদগ্ধ ব্যক্তি বলেন বিশ্বভারতীর আদর্শ, প্রাক্তনদের দায়িত্ব, সাম্প্রতিক বিশ্বসমস্যা বিষয়ে। কোনো প্রবীণ আশ্রমিককে অর্ঘ্য দান করা হয়। শান্তিনিকেতন মন্দিরে খৃষ্টদেবের জন্মোৎসব উপলক্ষে উপাসনা অনুষ্ঠানে এ উৎসবের শেষ।
এটা ঘটনা যে অতীতে দরিদ্রজনের মধ্যে উৎসবের দ্বার উন্মোচিত থাকলেও বর্তমানে গ্রামের সাধারণ মানুষের কুন্ঠা ও সংকোচ আছে। মেলা শেষে ভাঙা মেলায় ঘর গেরস্থালির জিনিস কিনতে অবশ্য তাদের যাতায়াত চোখে পড়ে। আর লোকসংস্কৃতির এতো বৈচিত্র্য আর কোনো মেলায় চোখে পড়ে না। বিশ্বভারতীর প্রদর্শনী মণ্ডপে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের বিভিন্ন বিভাগের কাজকর্মের পরিচয় মেলে। বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের দোকান পৌষমেলার চরিত্রকে গ্রামীণ থেকে নাগরিক বেসরকারী থেকে সরকারী মনস্ক করে তোলে। যশোরের চিরুনী, কাঠের বাসন, বেতের ছড়ি, নানা আঞ্চলিক মিষ্টি ও তেলেভাজা, কাঠের দরজা জানলা, ড্রেসিং টেবিল, বাঁশের ডালা, ধামাকুলো, গরম শাল, খাজা, মুখরোচক খাবার, কেক, পেষ্ট্রি, কফি, ফুচকা, ভেলপুরি, টেপ টিভি, ইলেকট্রনিক্স — কতো বৈচিত্র্য। নানা দল মতের প্রচারপত্রের স্টল চোখে না পড়ে পারে না। পৌষমেলা তার আদর্শ থেকে সরে এসেছে কালের অবশ্যম্ভাবী নিয়মে। কিন্তু কালোর দোকান বা সেঁজুতির কফিস্টলে প্রাচীন মানুষদের জমায়েত পুরোনো দিনকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
মেলার খরচ বেড়েছে, ব্যবস্থাপনার খরচ বেড়েছে, বিশৃঙ্খলা ও বিন্যাসের প্রতুলতা ছড়িয়ে গেছে বোলপুর পর্যন্ত। একদিকে হুল্লোড়ের ব্যাপ্তি ও অন্যদিকে লুব্ধ দোকানীদের ব্যবসা মেলার ধর্মীয় পবিত্রতা, শান্তশ্রীকে নষ্ট করে মুখব্যাদান করে থাকে।
তথাপি শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে বঙ্গভূমি থেকে বিশ্বভূমিতে। মানুষ আসছে নানা ভারতীয় অঞ্চল থেকে, বিদেশীদের আগমন চোখে না পড়ে পারে না। কেন্দ্রভূমিতে আছেন রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র পরিমণ্ডল, বিশ্বভারতীর অভিনব শিক্ষাদর্শ — এ কথা আজ মুষ্টিমেয় মানুষের চেতনায় বিরাজ করে। আশা করা যায় এই চেতনার অবলুপ্তি ঘটবে না।
পঞ্চাশ বছর আগে তরুণ বয়সে প্রথম এসেছিলাম পৌষমেলায়। দুরন্ত শীতের রাতে শিয়ালদহ থেকে ব্যান্ডেল, সেখান থেকে অন্য কোনো ট্রেনে ব্যাপারীদের সঙ্গে ভিড়ে ভিড়াক্কার কামরায় পৌঁছেছিলাম বোলপুরে। উপাসনার সেই পরিচ্ছন্ন মাহাত্ম্য আজও চোখে ভাসে। কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষফাগুনের পালা গানটা মনের মধ্যে এমন একটা ঢেউ তুলেছিল যে তার রেশ থেকে গিয়েছিল বহুদিন। মনে পড়ে আশ্রমের বারান্দায় ছবি বন্দোপাধ্যায়ের কীর্তন শোনা, পূর্ণদাস ও তার কাকা নবনী দাসের নাচ সহযোগে ধুনির সামনে বাউল গান, এবং দর্শকদের প্রণামী দান। পৌষউৎসবের দ্বিতীয় দিন সমাবর্তনে প্রধানমন্ত্রী জওহরলালের অসামান্য ভাষণ মুগ্ধ করেছিল। সীমিত বিত্ত নিয়ে মেলায় ঘুরেছিলাম। মনে পড়ে সাঁওতালদের কাছ থেকে বাবার জন্য কিনেছিলাম নামমাত্র মূল্যে কারুকার্যকরা একটি ছড়ি এবং মহিষের শিংএর পিঠ চুলকাবার হাতল।
পরে যখন চাকরি করতে যাই তখন আস্তে আস্তে রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিমন্দির থেকে হারিয়ে যান, তবে ডোকরা কারুকাজ, পুরোনো বইয়ের দোকানে দুর্লভ বই, স্পেনীয় সংগ্রাহক হোজে পাজের সঙ্গে এ দোকানে সে দোকানে ঘোরা, অপমৃত প্রিয় মুসলমান ছাত্রের সঙ্গে মলিন দোকানে টুকটাক খাওয়া, টেরাকোটার কারুকাজ কেনা, বাউল গানের আসর, চেলা অচেনা মানুষের মৈত্রী আর কুয়াশাঘেরা বিষন্নতা আজও টিঁকে আছে।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment