Monday, 8 March 2021

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয়ঃ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। 

নারী দিবসে ছুটি ঘোষণা-
আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা,জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ, ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান,কিরগিজিস্তান, লাওস, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া,মন্টেনিগ্রো, রাশিয়া,তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উগান্ডা,ইউক্রেন, উজবেকিস্তান,
ভিয়েতনাম এবং জাম্বিয়া।
এছাড়া, চীন,মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার,নেপালে শুধুমাত্র নারীরাই সরকারী ছুটির দিনভোগ করেন।
=================================

বাংলার নারী :

স্বর্ণকুমারী দেবী

আনুমানিক ১৮৫৫ খ্রীস্টাব্দে কলিকাতা জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরপরিবারে স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্ম হয়। তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা; রবীন্দ্রনাথের ভগিনী। ১৮৬৭ সনের ১৭ই নবেম্ববর ১৩ বৎসর বয়সে জানকীনাথ ঘোষালের সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। স্বর্ণকুমারীর সুদীর্ঘ জীবন বাণী-সাধনায় সমুজ্জ্বল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বঙ্গভারতীর সেবা করিয়া গিয়াছেন। সাহিত্যে তাঁহার দান সুবিপুল। বঙ্গমহিলাদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম সার্থক উপন্যাস, গাথা ও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁহার রচিত গ্রন্থাবলী:

১ দীপ-নির্ব্বাণ (উপন্যাস): ১২৮৩ সাল (১৫-১২-১৮৭৬)। পৃ ৩২১।
২ বসন্ত উৎসব (গীতিনাট্য): ১৮০১ শক (৪-১১-১৮৭৯)। পৃ ৪০।
৩ ছিন্নমুকুল (উপন্যাস): (৪-১১-১৮৭৯)। পৃ ২৩৮।
৪ মালতী (উপন্যাস): ১২৮৬ সাল (২৫-৩-১৮৮০)। পৃ ৪৪।
৫ গাথা: ১২৮৭ সাল (২০-১২-১৮৮o)। পৃ ৯৫।
৬ পৃথিবী (বৈজ্ঞানিক পুস্তক): আশ্বিন ১২৮৯ ২ে৭-৯-১৮৮২)। পৃ ১৮৪।

৭ সখিসমিতি: ১২৯৩ সাল (১২-৮-১৮৮৬)। পৃ ২৪।
৮ মিবাররাজ (ঐতিহাসিক উপন্যাস): জ্যৈষ্ঠ ১৮০৯ শক (১৭-৬-১৮৮৭)। পৃ ৮০।
৯ হুগলীর ইমামবাড়ী (ঐতিহাসিক উপন্যাস): পৌষ ১২৯৪ (৮-১-১৮৮৮)। পৃ ২৫৬।
১০ বিদ্রোহ (ঐতিহাসিক উপন্যাস): ১৫ শ্রাবণ ১২৯৭ (৯-৮-১৮৯০)। পৃ ২৮২।
১১ বিবাহ-উৎসব (গীতি-নাট্য): (১৩-৫-১৮৯২)। পৃ ২৩।
১২ নবকাহিনী (ছোট গল্প): (১৭-৮-১৮৯২)। পৃ ১২৮।
১৩ স্নেহলতা বা পালিতা (উপন্যাস)
১ম খণ্ড। ১২৯৯ সাল (১৩-১০-১৮৯২)। পৃ ২৩৮
২য় খণ্ড। ফাল্গুন ১২৯৯ (১৫-৩-১৮৯৩)। পৃ ১৮২।
১৪ ফুলের মালা (উপন্যাস): (১২-৩-১৮৯৫)। পৃ ১৫৯।
১৫ কবিতা ও গান: কার্তিক ১৩০২ (১-১২-১৮৯৫)। পৃ ২৪০।
১৬ কাহাকে? (উপন্যাস): জুলাই ১৮৯৮। পৃ ১২১।
১৭ কৌতুকনাট্য ও বিবিধ কথা: ইং ১৯০১, জ্যৈষ্ঠ। পৃ ৮১।
১৮ দেবকৌতুক (কাব্যনাট্য): ১৩১২ সাল (২৬-২-১৯০৬)। পৃ ৯৬।
১৯ কনে-বদল (প্রহসন): বৈশাখ ১৩১৩, ইং ১৯০৬। পৃ ৫৮।
২০ পাকচক্র (প্রহসন): (২৮-২-১৯১১)। পৃ ৭০+১৮।
২১ রাজকন্যা (নাট্যোপন্যাস): (১৭-৪-১৯১৩)। পৃ ৮২।
২২ নিবেদিতা (নাটক): ৩ এপ্রিল ১৯১৭। পৃ ৬০।
২৩ যুগান্ত কাব্যনাট্য: (২০-১-১৯১৮)। পৃ ৩৬।
২৪ বিচিত্রা (উপন্যাস): ১ বৈশাখ ১৩২৭ (৭-৫-১৯২০)। পৃ ১৫৭।
২৫ স্বপ্নবাণী (উপন্যাস): জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮ (২৪-১০-১৯২১)। পৃ ১৭২।
২৬ মিলন রাত্রি (উপন্যাস): জ্যৈষ্ঠ ১৩৩২, ইং ১৯২৫। পৃ ২৮৫।
২৭ দিব্য-কমল (নাটক): (১৪-৪-১৯৩০)। পৃ ১৬৩।
স্বর্ণকুমারী অনেকগলি পাঠ্য পস্তকেরও রচয়িত্রী। তিনি অতীব যোগ্যতার সহিত দীর্ঘকাল ‘ভারতী’ সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন। ১৯৩২ সনের ৩রা জলাই তাঁহার মত্যু হইয়াছে।

 প্রসন্নময়ী দেবী। 
ইনি সার্‌ আশুতোষ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠা ভগিনী ও প্রিয়ম্বদা দেবীর মাতা; জন্ম ১৮৫৭ সনে। ইঁহার পিতা পাবনা জেলার হরিপুর গ্রাম-নিবাসী দুর্গাদাস চৌধুরী। দশ বৎসর বয়সে পাবনা গুণাইগাছা গ্রাম-নিবাসী কৃষ্ণকুমার বাগচীর সহিত প্রসন্নময়ীর বিবাহ হয়। বিবাহের দুই বৎসর পরেই তাঁহার স্বামী উন্মাদরোগগ্রস্ত হন; সেই অবধি তিনি পিত্রালয়েই কাটাইয়াছেন।

 প্রসন্নময়ী শৈশব হইতেই সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। তাঁহার ‘বনলতা’ও ‘নীহারিকা’ কাব্য দুইখানি তাঁহাকে সাহিত্যসমাজে সুপ্রতিষ্ঠ করিয়াছিল। তাঁহার রচিত গ্রন্থাবলীর কালানুক্রমিক তালিকা:

১ আধ আধ ভাষিণী (কাব্য): ১২৭৬ সাল (১৪-২-১৮৭০)। পৃ ১২।
২ পূর্ব্বস্মৃতি। কৃষ্ণনগর ২১ বৈশাখ ১২৮২ (ইং ১৮৭৫)।[৫]
৩ যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারতবর্ষে শুভাগমন (কবিতা) (২৭-১২-১৮৭৫)। পৃ ২৬।
৪ বনলতা (কাব্য): ১২৮৭ সাল (২০-৫-১৮৮০)। পৃ ১১৯।
৫ নীহারিকা (কাব্য)
১ম ভাগ, ১২৯০ সাল (২৩-৮-১৮৮৪)। পৃ; ১৪৯।
২য় ভাগ, অগ্রহায়ণ ১৮১৮ শক (১১-১২-১৮৯৬)। পৃ ১৬২।
৬ আয্যাবর্ত্ত (ভ্রমণ): পৌষ ১২৯৫ (১২-১-১৮৮৯)। পৃ ১৭৭।
৭ অশোকা (উপন্যাস): ১২৯৬ সাল (১০-৪-১৮৯০)। পৃ ৬২।
৮ তারাচরিত (জীবনী): ১৩২৪ সাল (৩-৯-১৯১৭)। পৃ ১১৬।
৯ পূর্ব্বকথা (জীবনী): ১৩২৪ সাল (১৯-১০-১৯১৭)। পৃ ১৮৭।
১৯৩৯ সনের ২৫এ নবেম্বর প্রসন্নময়ী পরলোকগমন করিয়াছেন।

 জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। 
১৮৫২ খ্রীস্টাব্দে যশোহর জেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামে জ্ঞানদানন্দিনীর জন্ম হয়। তাঁহার পিতার নাম অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায়। ১৮৫৯ সনে, আট বৎসর বয়সে, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত জ্ঞানদানন্দিনীর বিবাহ হয়। স্বামীর উৎসাহ ও নিজের যত্ন-চেষ্টায় জ্ঞানদানন্দিনী নিজেকে সুশিক্ষিতা করিয়া তুলিয়াছিলেন। বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁহার আন্তরিক অনুরাগ ছিল। পুরাতন ‘ভারতী’র পৃষ্ঠায় মুদ্রিত তাঁহার এই কয়টি রচনার সন্ধান পাওয়া গিয়াছে:

শ্রাবণ, ১২৮৮: ইংরাজ-নিন্দা ও দেশানুরাগ
আশ্বিন, ১২৮৮: স্ত্রী-শিক্ষা
অগ্রহায়ণ, ১২৮৮: কিণ্টারগার্টেন।
মাঘ-চৈত্র ১২৯০; ভাউ সাহেবের বখর
বৈশাখ-আষাঢ়-শ্রাবণ-    
আশ্বিন ১২৯১ (মরাঠী হইতে অনূদিত)
 জ্ঞানদানন্দিনীর নিকট হইতে আমরা দুইখানি সুলিখিত শিশুপাঠ্য পুস্তক লাভ করিয়াছি; সেগুলি:

১ টাক্‌ ডুমা ডুম্‌ ডুম্‌ (নাটিকা): (৬-৬-১৯১০)। পৃ ১৭।
২ সাত ভাই চম্পা (নাটিকা): (২৬-১২-১৯১১)। পৃ ৫২।
১৩৪৮ সালের ১৫ই আশ্বিন, ৯০ বৎসর বয়সে, জ্ঞানদানন্দিনী পরলোকগমন করিয়াছেন।

 শরৎকুমারী চৌধুরাণী। 
শরৎকুমারীর জন্ম ১৮৬১ সনের ১৫ই জুলাই। তাঁহার পিতার নাম শশিভূষণ বসু (কলিকাতা চোরবাগানের বসু-বংশজাত); তিনি ১৮৬৩ সনে চাকুরী উপলক্ষে সুদূর লাহোরে গমন করিয়াছিলেন। শরৎকুমারীর শৈশব লাহোরেই কাটে। ১৮৭১ সনের ১২ই মার্চ আন্দুলের বিখ্যাত চৌধুরী-বংশের অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। অক্ষয়চন্দ্র সুকবি ছিলেন; স্বামীর ন্যায় শরৎকুমারীও মাতৃভাষার পরম অনুরাগিণী ছিলেন। পুরাতন সাময়িক-পত্রের পৃষ্ঠা অন্বেষণ করিলে তাঁহার বহু রস-রচনার সন্ধান মিলিবে। তাঁহার প্রথম রচনা ‘কলিকাতার স্ত্রীসমাজ’ ১২৮৮ সালের ভাদ্র ও কার্তিক-সংখ্যা ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হয়। এক মাত্র ‘শুভবিবাহ’ (মার্চ ১৯০৬) ছাড়া শরৎকুমারীর আর কোনো রচনা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই। এই সামাজিক চিত্রখানি বঙ্গসাহিত্যে লেখিকাকে একটি বিশিষ্ট আসন দান করিয়াছে। ইহার সমালোচনা-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন:

 “এমন সজীব সত্য চিত্র বাংলা কোনো গল্প বইয়ে আমরা দেখি নাই।”

 তাঁহার সমগ্র রচনাবলী সম্প্রতি গ্রন্থাবলী-আকারে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত হইয়াছে।

 শরৎকুমারীর শেষজীবন বৈধব্য অবস্থায় কাটে; স্বামীর মৃত্যুর (৫-৯-১৮১৮) ২২ বৎসর পরে—১৯২০ সনের ১১ই এপ্রিল তিনি পরলোকগমন করিয়াছেন।

 মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায় (মোক্ষদা দেবী)।
 ইনি ডবলিউ. সি. বোনার্জীর সহোদরা। বউবাজারের প্রতিষ্ঠাতা ধনকুবের বিশ্বনাথ মতিলালের দৌহিত্র শশিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সহিত ইঁহার বিবাহ হয়। মোক্ষদায়িনী উচ্চশিক্ষিতা মহিলা ছিলেন। তাঁহার রচিত ‘বন-প্রসূন’ কাব্য সমালোচনাকালে সঞ্জীবচন্দ্র-সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ (জ্যৈষ্ঠ ১২৮৯) যে মন্তব্য করেন, তাহা উদ্ধারযোগ্য:

 “মুখোপাধ্যায় মহাশয়ার কবিতাগুলি পড়িয়া আমরা মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে তিনি ক্ষমতাশালিনী বটে। .. আমরা এই গ্রন্থকর্ত্রীর অন্যান্য গুণের প্রশংসা ছাড়িয়া দিয়া তাঁহার কাব্যগত সাহসের প্রশংসা করিব। সকলেই জানেন, বাঙ্গালায় সাহিত্যসংগ্রামক্ষেত্রে বাবু হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অদ্বিতীয় মহারথী। তাঁহার প্রতি শরসন্ধানে সাহস করে বাঙ্গালার পুরুষ লেখকদিগের মধ্যে এমন শূর বীর কেহ নাই। তাঁহার প্রণীত “বাঙ্গালীর মেয়ে” নামক কবিতার জ্বালায় অনেক বাঙ্গালীর মেয়ে আজিও কাতর। আজি সেই আঘাতের প্রতিশোধের জন্য এই কাব্যবীরাঙ্গনা বদ্ধপরিকর—ধৃতাস্ত্র। হেমচন্দ্রের ঐ কবিতার উত্তরে মোক্ষদায়িনী “বাঙ্গালির বাবু” শিরোনামে একটি কবিতা লিখিয়াছেন। কবিতাটি বড় রঙদার—লেখিকার লিপিশক্তিপরিচায়িকা—আদ্যোপান্ত পাঠের যোগ্য।”

 রচনার নিদর্শন-স্বরূপ আমরা মোক্ষদায়িনী-লিখিত ‘বাঙ্গালির বাবু’ কবিতাটির কয়েক পংক্তি উদ্ধৃত করিতেছি:

“হায় হায় অই যায় বাঙ্গালীর বাবু।
দশ্‌টা হ’তে চারটাবধি দাস্য বৃত্তি করা
সারাদিন বইতে হয় দাসত্ব পশরা।

আমরা মোক্ষদায়িনীর রচিত এই তিনখানি গ্রন্থের সন্ধান পাইয়াছি:

১ বন-প্রসূন (কাব্য)। ইং ১৮৮২।
২ সফল স্বপ্ন (ইতিবৃত্তমূলক উপন্যাস)। ইং ১৮৮৪ (১২ ডিসেম্বর)। পৃ ১৬৯।
৩ কল্যাণ-প্রদীপ (জীবনী)। অগ্রহায়ণ ১৩৩৫ (ইং ১৯২৮)। পৃ ৪২৯।

 গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী। 
ইহার জন্ম ১৮৫৮ সনের ১৮ই আগস্ট। পিতার নাম হারাণচন্দ্র মিত্র। দশ বৎসর বয়সে গিরীন্দ্রমোহিনীর বিবাহ হয়। তাঁহার স্বামী নরেশচন্দ্র দত্ত, বউবাজার-নিবাসী অক্রূর দত্তের প্রপৌত্র দুর্গাচরণের কনিষ্ঠ পুত্র। ১৮৮৪ সনে গিরীন্দ্রমোহিনীর বৈধব্য ঘটে। তিনি দ্বাদশ বর্ষ হইতেই কবিতারচনায় হস্তক্ষেপ করেন। তাঁহার রচিত ‘অশ্রুকণা’ বাংলা-সাহিত্যে তাঁহাকে প্রতিষ্ঠা দান করিয়াছিল। গিরীন্দ্রমোহিনীর গ্রন্থগলির তালিকা।

১ জনৈক হিন্দুমহিলার পত্রাবলী: (১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৭২)। পৃ ১৭।
২ কবিতাহার (কাব্য): ২৯ মাঘ ১২৭৯ (ইং ১৮৭৩)। পৃ ৩৯।
৩ ভারত-কুসম (কাব্য): ১ কার্তিক ১২৯৯ (ইং ১৮৮২)। পৃ ৮৮।
৪ অশ্রুকণা (কাব্য): ১২৯৪ সাল (ইং ১৮৮৭)।
৫ আভাষ (কাব্য): ১২৯৭ সাল (৫-৪-১৮৯০)। পৃ ১৪১।
৬ সন্ন্যাসিনী বা মীরাবাই (ঐতিহাসিক নাট্যকাব্য): ১ কার্তিক ১২৯৯ (ইং ১৮৯২)। পৃ ১০৩।
৭ শিখা (কাব্য): ১৩০৩ সাল (২৮-৪-১৮৯৬)। পৃ ১৫৮।
৮ অর্ঘ্য (কাব্য): ১৩০৯ সাল (১০-৯-১৯০২)। পৃ ৮২।
৯ স্বদেশিনী (কাব্য): ১৩১২ সাল (২৫-২-১৯০৬)। পৃ ২৭।

১০ সিন্ধুগাথা (কাব্য): ১৩১৪ সাল (৬-৫-১৯০৭)। পৃ ৮২।
১৯২৪ সনের ১৬ই আগস্ট গিরীন্দ্রমোহিনীর মত্যু হইয়াছে।

মানকুমারী বসু। 
১৮৬৩ সনের ২৫এ জানুয়ারি যশোহর জেলায় শ্রীধরপুর গ্রামে মাতুলালয়ে মানকুমারীর জন্ম হয়। ইনি মাইকেল মধুসূদনের জ্ঞাতিভ্রাতুষ্পুত্রী। ইঁহার পিতার নাম আনন্দমোহন দত্ত চৌধুরী। ১৮৭৩ সনে, দশ বৎসর বয়সে, বিদ্যানন্দকাটী গ্রামের বিবুধশংকর বসুর সহিত মানকুমারীর বিবাহ হয়। উনিশ বৎসর পর্ণ হইতে-না-হইতেই ইঁহার বৈধব্য ঘটে। বিধবা হইবার পর সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক কার্যে মানকুমারীর মন বসিত না, ইনি শেষে সাহিত্য-সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ইঁহার রচিত গ্রন্থগুলির তালিকা দিতেছি:

১ প্রিয়প্রসঙ্গ বা হারাণো প্রণয় (গদ্য-পদ্য): ইং ১৮৮৪ (২৪ ডিসেম্বর)। পৃ ১৩০।
২ বনবাসিনী (উপন্যাস): ভাদ্র ১২৯৫ (৫-৯-১৮৮৮)। পৃ ২৩।
৩ বাঙ্গালী রমণীদিগের গৃহধর্ম্ম (সন্দর্ভ): (১৫-৭-১৮৯০)। পৃ ১২।
৪ দুইটি প্রবন্ধ: ১২৯৮ সাল (২২-১২-১৮৯১)। পৃ ৩২।
৫ কাব্যকুসুমাঞ্জলি (কাব্য): ইং ১৮৯৩ (২ অক্টোবর)। পৃ ২৭১।
৬ শুভ সাধনা (গদ্য-পদ্য সংকলন): ১৩০১ সাল।
৭ কনকাঞ্জলি (কাব্য): ১৩০৩ সাল (২৯-১০-১৮৯৬)। পৃ ২৬০।
৮ বীরকুমার-বধ কাব্য: ১৩১০ সাল (১০-৫-১৯০৪)। পৃ ২৩৫।
৯ বিভূতি (কাব্য): চৈত্র ১৩৩০ (১২-৪-১৯২৪)। পৃ ৩১১+১।
১০ সোনার সাথী (কাব্য): (২-৫-১৯২৭)। পৃ ৫০।
১১ পুরাতন ছবি (আখ্যায়িকা): (২৫-৭-১৯৩৬)। পৃ ১৩১।
 ছোট গল্প রচনায় মানকুমারী সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ‘কুন্তলীন-পুরস্কারে’র প্রথম (১৩০৩), তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে (১৩০৫-৬) তাঁহার গল্প স্থান পাইয়াছিল। ১৯৪৩ সনের ২৬এ ডিসেম্বর, ৮১ বৎসর বয়সে, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।

 কামিনী রায়। 
১৮৬৪ সনের ১২ই অক্টোবর বাখরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত বাসণ্ডা গ্রামে এক বৈদ্য পরিবারে কামিনী দেবীর জন্ম হয়। তাঁহার পিতা লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক চণ্ডীচরণ সেন। ১৮৮৬ সনে কামিনী বেথুন ফিমেল স্কুল হইতে কৃতিত্বের সহিত বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৪ সনে স্ট্যাটুটরি সিবিলিয়ান কেদারনাথ রায়ের সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। ১৯০৯ সনে তাঁহার বৈধব্য ঘটে।

 কামিনী আট বৎসর বয়স হইতেই কবিতা লিখিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার ‘আলো ও ছায়া’ কাব্যখানি সাহিত্যসমাজে তাঁহাকে স্থায়ী আসন দান করিয়াছিল। কামিনী রায়ের রচিত গ্রন্থগুলির একটি কালানুক্রমিক তালিকা দিতেছি:

১ আলো ও ছায়া (কাব্য): ইং ১৮৮৯ (১ নবেবর)। পৃ ১৬৮।
২ নির্মাল্য (কাব্য): (১ এপ্রিল ১৮৯১)। পৃ ৮০।
৩ পৌরাণিকী (কাব্য): ১৮১৯ শক (ইং ১৮৯৭)। পৃ ৬০।
৪ গুঞ্জন (শিশুরাজ্যের কবিতা): ১৩১১ সাল (১৫-৫-১৯০৫)। পৃ ৬৬।
৫ ধর্ম্মপুত্র (গল্প): ১৩১৪ সাল (১৫-৭-১৯০৭)। পৃ ৪২।
৬ অশোক-স্মৃতি (জীবনী): (২ জুন ১৯১৩)। পৃ ৩২।
৭ শ্রাদ্ধিকী (জীবনী): ইং ১৯১৩ (৪ জুন)। পৃ ১০৩।
৮ মাল্য ও নির্ম্মাল্য (কাব্য): ইং ১৯১৩ (২৫ সেপ্টেম্বর)। পৃ ১৬০।
৯ অশোক-সঙ্গীত (সনেটগুচ্ছ: ইং ১৯১৪ (২৩ ডিসেম্বর)। পৃ ৫৮।
১০ অম্বা (নাট্যকাব্য): ইং ১৯১৫ (৮ এপ্রিল)। পৃ ১০৪।
১১ সিতিমা (গদ্য নাটিকা): ইং ১৯১৬ (১৭ এপ্রিল)। পৃ ৬২।
১২ বালিকা শিক্ষার আদর্শ—অতীত ও বর্ত্তমান (নিবন্ধ): (১ সেপ্টেম্বর ১৯১৮)। পৃ ৩৫।
১৩ ঠাকুরমার চিঠি (কবিতা): (১৭ মে ১৯২৪)। পৃ ২৩।
১৪ দীপ ও ধূপ (কাব্য): ইং ১৯২৯। পৃ ১৭৬।
১৫ জীবনপথে (সনেটগুচ্ছ): ইং ১৯৩০। পৃ ৭০।
১৯৩৩ সনের ২৭এ সেপ্টেম্বর কামিনী রায়ের মৃত্যু হইয়াছে।

 কুসুমকুমারী দেবী। 
ইনি বরিশালের অন্তর্গত লাখুটিয়ার জমিদার রাখালচন্দ্র রায় চৌধুরীর পত্নী, কবি দেবকুমার রায় চৌধুরীর জননী। কুসুমকুমারী স্বামীর নিকট উৎসাহ লাভ করিয়া স্বীয় অবসরকাল মাতৃভাষার সেবায় নিয়োজিত করিয়াছিলেন। তাঁহার রচিত পুস্তকগুলির কালানুক্রমিক তালিকা দিতেছি; তিনি কোনো পুস্তকেই নিজ নাম প্রকাশ করেন নাই:

১ স্নেহলতা (সামাজিক উপন্যাস): ১১ মাঘ ১২৯৬ (২৭-২-১৮৯০)। পৃ ১৯২।[৬] “কোন মহিলা কর্তৃক প্রণীত।”
২ প্রেমলতা (সামাজিক উপন্যাস): ১১ আশ্বিন ১২৯৯ (ইং ১৮৯২)। পৃ ২৬৮।
৩ প্রসূনাঞ্জলি (সন্দর্ভাবলী): ১৩০৭ সাল। (৩০-৯-১৯০০)। পৃ ২৭+১৬।
৪ শান্তিলতা (উপন্যাস): (২৭-৯-১৯০২)। পৃ ২৫৭।
৫ লুৎফ-উন্নিসা (ঐতিহাসিক উপন্যাস): ১৩১২ সাল (৩-৯-১৯০৫)। পৃ ২০০।
 কুসুমকুমারীর পুস্তকগুলি[৭] সুধীসমাজে বিশেষভাবে আদৃত হইয়াছিল। ‘স্নেহলতা’-পাঠে বিদ্যাসাগর মহাশয় এইরপ অভিমত প্রকাশ করেন:

 “সমাজচরিত্র জানিবার পক্ষে ইহা একখানা সুন্দর গ্রন্থ। স্বাধীন রাজ্য হইলে ইহার পঞ্চবিংশতি সংস্করণ হইত বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ‘প্রেমলতা’ পাঠ করিয়া লিখিয়াছিলেন:

 “আমার বিবেচনায় গ্রন্থখানি যত দূর উৎকৃষ্ট হইতে পারে, তাহার ত্রুটি হয় নাই। প্রত্যেক পরিবারে এক একখানা প্রেমলতা থাকা বাঞ্ছনীয়।

১৩২২ সালের ভাদ্র মাসে কুসমকুমারী দেবীর মত্যু হইয়াছে।

 বিনয়কুমারী বসু (ধর)। 
১৮৭২ সনের নবেম্বর মাসে বিনয়কুমারীর জন্ম। তাঁহার পিতা কাশীচন্দ্র বসু; মাতা ললিতমণি বসু, ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষের জ্যেষ্ঠ সহোদরা। ১৩০০ সালের অগ্রহায়ণ মাসে ডাক্তার ভারতচন্দ্র ধরের সহিত বিনয়কুমারীর বিবাহ হয়; এই বৎসরের অগ্রহায়ণ সংখ্যা ‘সাহিত্যে’ ইঁহার নামের শেষে ‘বসু’ আছে, কিন্তু পৌষ-সংখ্যায় ‘ধর’ দেখিতেছি। তিনি বেথুন কলেজের এক জন প্রাক্তন ছাত্রী; বারো-তেরো বৎসর বয়স হইতেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১২৯৫ সালের মাঘ-সংখ্যা ‘ভারতী ও বালকে’ তাঁহার একটি প্রাথমিক রচনা— “জাগো (বালিকার রচনা)” স্থান পাইয়াছিল। বিনয়কুমারীর কবিতা ‘সাহিত্য’, ‘ভারতী’, ‘দাসী’, ‘প্রদীপ’ প্রভৃতি মাসিকপত্রে সাদরে স্থান লাভ করিত। আমরা তাঁহার দুইখানি কাব্যের উল্লেখ পাইয়াছি; উহা:

১ নব মকুল (কাব্য): (৫ সেপ্টেম্বর ১৮৮৭)। পৃ ৯০।
২ নির্ঝর (কাব্য): (১১ সেপ্টেম্বর ১৮৯১)। পৃ ১০২।
 প্রমীলা বসু (নাগ)। ১৮৭১ সনে প্রমীলার জন্ম। তাঁহার পিতা বিজয়চন্দ্র বসু; মাতা লালমণি বসু, মনোমোহন ঘোষের কনিষ্ঠা সহোদরা। ইঁহার পিত্রালয় বিক্রমপুর। ১২৯৭ সালে বিলাত-ফেরত ডাক্তার গঙ্গাকান্ত নাগের সহিত প্রমীলার পরিণয় হয়।[৯] অতি অল্প বয়সেই ইঁহার কাব্য প্রতিভা স্ফূরিত হয়। ১২৯৩ সাল হইতে ইঁহার রচিত কবিতা ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’, ‘ভারতী’, ‘নব্যভারত’, ‘সাহিত্য’ (১২৯৮-১৩০০, ১৩০৪-৫), ‘প্রতিমা’ প্রভৃতি সে যুগের শ্রেষ্ঠ পত্রিকায় স্থান লাভ করিয়াছিল। প্রমীলার এই দুইখানি কাব্যগ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে:

১ প্রমীলা (কাব্য): জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭ (ইং ১৮৯০)। পৃ ১২৫।
২ তটিনী (কাব্য): ইং ১৮৯২। পৃ ১৪৮।
১৩০৩ সালে প্রমীলা অকালে পরলোকগমন করেন।[১০]

 কৃষ্ণভাবিনী দাস। 
আনুমানিক ১৮৬৪ সনে বহরমপুরের অন্তর্গত কাজলা গ্রামে এক জমিদার-গহে কৃষ্ণভাবিনীর জন্ম হয়। দশ বৎসর বয়সে বউবাজার-নিবাসী শ্রীনাথ দাসের পুত্র—‘সেঞ্চুরী কলেজ’-প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিস্টার দেবেন্দ্রনাথ দাসের সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। ইনি স্বামীর সহিত বিলাত যাত্রা করিয়াছিলেন। বিলাত হইতে ফিরিবার পর, তাঁহার লিখিত ‘ইংরাজদের পর্ব্ব’ ও ‘বিলাতের গল্প’ ১৮৯২ সনের ‘সখা’য় প্রকাশিত হইয়াছিল। এই বিদূষী মহিলার বহু সুলিখিত সন্দর্ভ ‘ভারতী’ (১২৯৬..), ‘সাহিত্য’ (১২৯৮..), ‘প্রদীপ’ (১৩০৪..), ‘প্রবাসী’ ‘ভারতবর্ষ’ প্রভৃতির পুরাতন পৃষ্ঠায় বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। কৃষ্ণভাবিনী নারীকল্যাণ-কার্যে জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন; তিনি ভারতস্ত্রী-মহামণ্ডলের প্রাণস্বরূপ ছিলেন বিলাত-ফেরত হইয়াও তিনি বৈধব্যাবস্থায় হিন্দুবিধবার ন্যায় জীবন যাপন করিয়া গিয়াছেন। ১৯১৯ সনের ২৭এ ফেব্রুয়ারি তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।।

 অম্বুজাসুন্দরী দাসগুপ্তা। 
১৮৭০ সনে পাবনা জেলার ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামে অম্বুজাসুন্দরীর জন্ম হয়। তাঁহার পিতা গোবিন্দনাথ সেন রাজসাহীর একজন উকীল ছিলেন। কবি রজনীকান্ত সেন এই গোবিন্দনাথেরই ভ্রাতুষ্পুত্র। অম্বুজাসুন্দরীর বিবাহ হয় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কৈলাসগোবিন্দ দাসের সহিত। কিশোর বয়স হইতেই তাঁহার অন্তরে কবিত্বশক্তির উন্মেষ হয়; বিদ্যোৎসাহী স্বামীর সংস্পর্শে আসিয়া তাঁহার কবিপ্রতিভা বিকশিত হয় ও তিনি বিদ্যাচর্চা করিবার সংযোগ লাভ করেন। ‘বামাবোধিনী পত্রিকা,’ ‘সাহিত্য’, ‘নব্যভারত’ প্রভৃতি মাসিকপত্রে ও ‘কুন্তলীন-পুরষ্কারে’ অম্বুজাসুন্দরীর গদ্য-পদ্য বহু রচনা প্রকাশিত হইয়াছে। তাঁহার রচিত গ্রন্থগুলি এই:

১ কবিতালহরী: (১০-৯-১৮৯২)। পৃ ২১।
২ অশ্রুমালা (কাব্য): (১২-১০-১৮৯৪)। পৃ ২৪।
৩ প্রীতি ও পূজা (কাব্য): ১৩০৪ সাল (২-৯-১৮৯৭)। পৃ ১৪১।
৪ খোকা (শোক-কবিতা): সংবৎ ১৯৫৯ (২৫-৪-১৯০৩)। পৃ ২১২।
৫ প্রভাতী (উপন্যাস): ইং ১৯০৫ (১০ জুলাই)। পৃ ৪৬।
৬ দুটি কথা (গল্প): ১৩১২ সাল (৬-২-১৯০৬)। পৃ ৬৯।
৭ ভাব ও ভক্তি (কাব্য): ১৩১৩ সাল (২৫-১-১৯০৭)। পৃ ১৬৮।
৮ গল্প: ১৩১৩ সাল (১৭-৪-১৯০৭)। পৃ ১৭৭।
৯ প্রেম ও পণ্য (কাব্য): ১৩১৭ সাল (২০-৫-১৯১০)। পৃ ১৮৩।
 ইহা ছাড়া তিনি ভাগবতের সারাংশ লইয়া ‘শ্রীশ্রীকৃষ্ণলীলামৃত ’(ইং ১৯৩২) ও পরে ‘শ্রীশ্রীকৃষ্ণকেলিরসালাপ’ (১৩৪১), ‘শ্রীশ্রীরামকীর্ত্তি সুধা’, ‘শ্রীশ্রীকৃষ্ণের সহস্র নাম’ প্রভৃতি কবিতাগ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। ১৯৪৬ সনের ১লা জানয়োরি তারিখে অম্বুজাসুন্দরীর মৃত্যু হইয়াছে।

 মৃণালিনী সেন। 
১৮৭৯, ৩রা আগস্ট মৃণালিনী জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতা ডাক্তার লাড্‌লিমোহন ঘোষ। ইনি ১৩ বৎসর বয়সে পাইকপাড়ার ভূম্যধিকারী ইন্দ্রচন্দ্র সিংহের সহিত পরিণীতা হন। বিবাহের দুই বৎসর পরে ইঁহার বৈধব্য ঘটে। স্বামি-বিয়োগ-বিধুর অবস্থায় মৃণালিনী কাব্য চর্চায় প্রবৃত্ত হন। তাঁহার নিকট হইতে আমরা এই চারিখানি কাব্যগ্রন্থ লাভ করিয়াছি:

১ প্রতিধ্বনি (কাব্য): ১৩০১ সাল (১০-৮-১৮৯৪)। পৃ ১৮৪।
২ নির্ঝরিণী (কাব্য): ১৩০২ সাল (৭-৫-১৮৯৫)। পৃ ১৬৩।
৩ কল্লোলিনী (গীতিকাব্য): ১৩০৩ সাল (ইং ১৮৯৬)। পৃ ২৩৭।
৪ মনোবীণা (কাব্য): মাঘ ১৩০৬ (২৪-৪-১৯০০)। পৃ ২৫৯।
 ১৯০৫ সনে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের দ্বিতীয় পুত্র নির্মলচন্দ্র সেনের সহিত মৃণালিনীর বিবাহ হয়। ইনি স্বামীর সহিত বহু দিন বিলাতে কাটাইয়াছেন। নারীপ্রগতিমূলক বহু কার্যে ইঁহার নাম যুক্ত দেখা যায়।

 সরোজকুমারী দেবী। 
ইনি সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের ভগিনী। ইঁহার জন্ম ৪ নবেম্বর ১৮৭৫ তারিখে। দশ বৎসর বয়সে (ইং ১৮৮৬) কলুটোলার সেন-বংশীয় যোগেন্দ্রনাথ সেনের সহিত ইঁহার বিবাহ হয়; যোগেন্দ্রনাথ সম্বলপরের গভর্নমেন্ট উকীল ছিলেন। সরোজকুমারী বিবাহের পর নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন। ১২৯৫ সাল হইতে তিনি ‘ভারতী’তে ও ১২৯৭ সাল হইতে ‘সাহিত্যে’ লিখিতে শুরু করেন। তাঁহার রচিত এই কয়খানি গ্রন্থের সন্ধান মিলিয়াছে:

১ হাসি ও অশ্রু (কাব্য): মাঘ ১৩০১ (ইং ১৮৯৫)। পৃ ২৯৫।
২ অশোকা (কাব্য): ১৩০৮ সাল (৬-৭-১৯০১)। পৃ ২৭৪।
৩ কাহিনী বা ক্ষুদ্র গল্প: ১৩১২ সাল (৩০-১১-১৯০৫)। পৃ ৩১৬।
৪ শতদল (কাব্য): (২ ৬-৯-১৯১০)। পৃ ১০২।

৫ অদৃষ্ট-লিপি (গল্প): (২২-৩-১৯১৫)। পৃ ১৭৭।
৬ ফুলদানি (গল্প): (৮-১০-১৯১৫)। পৃ ১৫৫।
১৯২৬ সনে সরোজকুমারীর মৃত্যু হইয়াছে।[১২]

 নগেন্দ্রবালা মুস্তোফী (সরস্বতী)। 
১৮৭৮ সনে নগেন্দ্রবালার জন্ম হয়। ইঁহার পিতার নাম নৃত্যগোপাল সরকার। দশ বৎসর বয়সে তিনি হুগলি জেলার সুখড়িয়া গ্রাম-নিবাসী খগেন্দ্রনাথ মুস্তোফীর সহিত বিবাহিত হন। খগেন্দ্রনাথ সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। বিবাহের পর হইতে নগেন্দ্রবালা কবিতা-রচনায় হস্তক্ষেপ করেন। তাঁহার রচিত এইসকল গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে:

১ মর্ম্মগাথা (কাব্য): ১৩০৩ সাল (২৫-৯-১৮৯৬)। পৃ ১৭০।
২ প্রেম-গাথা (কাব্য): অগ্রহায়ণ ১৩৩৫ (১০-১২-১৮৯৮)। পৃ ১৫৫।
৩ নারীধর্ম্ম (সন্দর্ভ): (৪-১২-১৯০০)। পৃ ১০৮।
৪ অমিয়গাথা (কাব্য): ১৩০৮ সাল (২৫-৩-১৯০২)। পৃ ২১০।
৫ ব্রজগাথা (কাব্য): (২০-১২-১৯০২)। পৃ ২৫০।
৬ ধবলেশ্বর (কাব্য): (১৭-৩-১৯০৩)। পৃ ২২।
৭ গার্হস্থ্যধর্ম্ম (সন্দর্ভ): (১২-১২-১৯০৪)। পৃ ১২৮।
৮ বসন্ত গাথা (কাব্য): (২৩-১-১৯০৫)। পৃ ৩১।
৯ কণা (কাব্য): ১৩১২ সাল (১৬-৬-১৯০৫)। পৃ ৬০।
১০ কুসুম গাথা (কাব্য): ১৩১২ সাল (১২-১২-১৯০৫)। পৃ ৯০।
১১ সতী (সামাজিক উপন্যাস): ১৩১৩ সাল (২-৮-১৯০৬)। পৃ ৭৮।
১৩১৩ সালের বৈশাখ মাসে অকালে নগেন্দ্রবালার মত্যু হইয়াছে।[১৩]

 হিরন্ময়ী দেবী। 
ইনি স্বর্ণকুমারী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা। শিশুপাঠ্য মাসিকপত্র ‘সখা’য় (ডিসেম্বর ১৮৮৩) প্রকাশিত ‘ভাইবোনের দোলনা’ কবিতাটিই বোধ হয় ইঁহার প্রথম মুদ্রিত রচনা। ১২৯১ সালের বৈশাখ সংখ্যা ‘ভারতী’ ও ১২৯২ সালের ‘বালকে’ও ইঁহার কয়েকটি প্রাথমিক রচনা মুদ্রিত হইয়াছে। বিশেষ করিয়া ‘ভারতী’র পৃষ্ঠায় হিরন্ময়ীর বহু গদ্য-পদ্য রচনার সন্ধান মিলিবে। পুস্তকাকারে তিনি কোনো কিছই রাখিয়া
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ।
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ।
যান নাই। ইনিও অন্যতর সম্পাদিকারূপে তিন বৎসর ‘ভারতী’ পরিচালনা করিয়া গিয়াছেন। ১৯২৫ সনের ১৩ই জুলাই তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।

 সরলা দেবী। 
ইনি স্বর্ণকুমারী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা; জন্ম ১৮৭২ সনের ৯ই সেপ্টেম্বর। ১৮৯০ সনে ইনি বেথুন কলেজ হইতে কৃতিত্বের সহিত বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯০৫ সনে পঞ্জাবের আর্য সমাজ-নেতা পণ্ডিত রামভজ দত্ত চৌধুরীর সহিত ইঁহার বিবাহ হয়। ১৯২৩ সনের ৬ই আগস্ট রামভজের মত্যু হয়।

 জীবনের দীর্ঘ কাল দেশসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করিলেও সরলা দেবী মাতৃভাষার প্রতি উদাসীন ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে শৈশবাবধি সাহিত্যের প্রতি তাঁহার প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। ১২৯২ সালের জ্যৈষ্ঠ-সংখ্যা ‘বালকে’ তাঁহার লিখিত প্রথম রচনা—‘দুর্ভিক্ষ (বালিকার রচনা)’ প্রকাশিত হয়। ১৮৮৫ সনের নবেম্বর-সংখ্যা ‘সখা’য় তাঁহার পুরস্কারপ্রাপ্ত রচনা ‘পিতামাতার প্রতি কিরূপ ব্যবহার করা কর্ত্তব্য’ স্থানলাভ করে; রচনার শেষে লেখিকার বয়স ‘১২ বংসর ১১ মাস’ দেওয়া আছে। ১২৯৪ সাল হইতে আরম্ভ করিয়া সরলা দেবী ‘ভারতী’তে বহু গদ্য-পদ্য রচনা ও স্বরলিপি প্রকাশ করিয়াছেন; ১৩০০ সালের আশ্বিন-সংখ্যা ‘ভারতী ও বালকে’ তাঁহার কৃত ‘বন্দে মাতরং’ গানের স্বরলিপি স্থান পাইয়াছে। তিনি অনেক কাল ‘ভারতী’ও সম্পাদন করিয়াছেন। একদা তাঁহার রচনা সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশংসাও অর্জন করিয়াছিল। সরলা দেবী তাঁহার স্মৃতিকথায় বলিয়াছেন:

 “‘ভারতী’তে আমার আঠার উনিশ বৎসরের লেখা ‘রতিবিলাপ’ [‘ভারতী ও বালক’, বৈশাখ ১২৯১] ও ‘মালবিকা-অগ্নিমিত্র’ [‘ভারতী ও বালক’, পৌষ, ফাল্গুন, চৈত্র ১২৯৮] পড়ে তাঁর লেখা চিঠি। সে চিঠি সাহিত্য দায়রায় দণ্ডায়মান একজন নবীনের উপর তাঁর রায়—বা তাকে দুই বাহু বাড়িয়ে আদর করে নেওয়া। যদিও রবিমামার চিঠিতে তাঁরও appreciation ব্যক্ত হয়েছিল, কিন্তু তাঁর চেয়েও সেদিন সাহিত্যসম্রাট ও সাহিত্যের ন্যায়াধীশ বঙ্কিমের রায়ে নিজেকে বেশি চরিতার্থ মনে করলুম।..শ্রীশ মজুমদার প্রভৃতি বন্ধুদের কাছে বঙ্কিম আমার লেখাগুলি সম্বন্ধে না কি নিজের সবিস্ময় অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন—তা তাঁদের লিখিত বঙ্কিমের জীবন-প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু বঙ্কিমের লিপি আর অন্যের লিপিতে অনেক তফাৎ। বঙ্কিমের লিপিখানি ছিল পুরো বঙ্কিমী ঠাটের সাহিত্যের একখানি হীরের কুচি। বিদূষক সম্বন্ধে আমার মন্তব্যের সঙ্গে তাঁর মতের মিল হয় নি। তার উল্লেখ করে “গরীব বিদষকের” পক্ষ নিয়ে তাঁর সরস লেখনী দুই এক ছত্রে কি হাস্যের ছটাই তুলেছিল। তাই বলছি তাঁর চিঠিখানি ছিল একটি সাহিত্যিক ক্ষুদ্র রসকুম্ভ।”

 সরলা দেবীর বাংলা পুস্তক-পুস্তিকার সংখ্যা খবই কম। তিনি নিজেই জীবনস্মৃতিতে বলিয়াছেন:

 “আজ পর্যন্ত আমার সব লেখাই প্রায় ‘ভারতী’র পৃষ্ঠাতেই নিবদ্ধ এবং গানগুলি আমার খাতায় বা গায়কদের মখে মুখে। আমার লেখা-কুমারীরা মাসিকে সাপ্তাহিকে দৈনিকে ছাপাসুন্দরী হয়েছে কিন্তু গ্রন্থের ঘরণী হয় নি— মাত্র গুরুদাস চাটুয্যে কোম্পানীর আট আনার এডিশনে ছাপান ‘নববর্ষের স্বপ্ন’ নামে কতকগুলি ছোট গল্প, বড় বড় সভাসমিতিতে ভাষিত ইংরেজি ও বাঙ্গলা বক্তৃতা, ‘বঙ্গের বীর’ সিরিজের দুখানি পুস্তিকা ও ইদানীংকার দুয়েকটি আধ্যাত্মিক বিষয়ের বই ছাড়া। লাহোর থেকে দুএকবার আগেকার লেখাগুলি বই আকারে ছাপাবার চেষ্টা করে ব্যর্থশ্রম হয়েছি। ‘কবিমন্দির’ প্রভৃতি দুতিন ফর্মা ছেপে, প্রেসওয়ালাদের পকেটে টাকা ভরে’ রুদ্ধশ্বাস হয়ে গেছে।”

 আমরা সরলা দেবীর লিখিত এই কয়খানি পুস্তক-পুস্তিকার সন্ধান পাইয়াছি:

১ শতগান (স্বরলিপি সহ): বৈশাখ ১৩০৭ (ইং ১৯০০)। পৃ ২১৬।
২ বাঙ্গালীর পিতৃধন: (২৬-৫-১৯০৩)। পৃ ৯।
৩ ভারতস্ত্রী-মহামণ্ডল: (৭-৩-১৯১১)। পৃ ২৪।
৪ নব-বর্ষের স্বপ্ন (গল্প): শ্রাবণ ১৩২৫ (১৫-৭-১৯১৮)। পৃ ১৫২।
৫ কালীপূজার বলিদান ও বর্ত্তমানে তাহার উপযোগিতা (২-২-১৯২৬)। পৃ ২১।
৬ শ্রীগুরু বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্ম্মানুষ্ঠিত শিবরাত্রিপূজা (ইং ১৯৪১)।
৭ বেদবাণী (আচার্য্য বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্ম্মার উপদেশাবলী সরলা দেবী কর্ত্তৃক লিখিত): ১ম খণ্ড (জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৪)-১১শ খণ্ড (পৌষ ১৩৫৭) ইং ১৯৪৭-৫০।
 ১৮ আগস্ট ১৯৪৫ তারিখে, ৭৩ বৎসর বয়সে, সরলা দেবীর মত্যু হইয়াছে। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে তিনি সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় (১১-১১-১৯৪৪—৯-৬-১৯৪৫) ‘জীবনের ঝরা পাতা’ নামে জীবনস্মৃতি বিবৃত করিয়াছিলেন। এই প্রসঙ্গে তাঁহার লিখিত ‘আমার বাল্যজীবনী’ (‘ভারতী, বৈশাখ ১৩১২) ও ‘রবীন্দ্রনাথ’ (‘ভারতবর্ষ, কার্তিক ১৩৪৬) প্রবন্ধ দুইটি পঠিতব্য।

প্রিয়ম্বদা দেবী। 
ইনি প্রসন্নময়ী দেবীর একমাত্র সন্তান। ১৮৭১ সনে পাবনা জেলার গুণাইগাছা গ্রামে তাঁহার জন্ম হয়। ১৮৯২ সনে প্রিয়ম্বদা বেথুন কলেজ হইতে কৃতিত্বের সহিত বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই বৎসরই মধ্যপ্রদেশের ব্যবহারাজীব তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। কিন্তু পাঁচ বৎসর যাইতে-না-যাইতেই তাঁহার বৈধব্য (১৬-৯-১৮৯৫) ঘটে।

 শৈশবাবধি বাংলা-সাহিত্যে প্রিয়ম্বদার অনরাগ ছিল। ১২৯২ সালের আশ্বিন-সংখ্যা ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ফুল’ নামে একটি ক্ষুদ্র সন্দর্ভই তাঁহার প্রথম মুদ্রিত রচনা। পর-বৎসর ‘ভারতী ও বালকে’ (কার্তিক ১২৯৩) তাঁহার একটি ‘গান’ “বালিকার রচনা” হিসাবে মুদ্রিত হয়। ১৩০৫ সাল হইতে ‘ভারতী’তে তাঁহার গদ্য-পদ্য বহু রচনা প্রকাশিত হইয়াছে। সুকবি হিসাবে প্রিয়ম্বদা খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার রচিত গ্রন্থাবলী:

১ রেণু (কাব্য): (১-৯-১৯০০)। পৃ ৬৯।
২ তারা (শোক-কবিতা): (১৮-১১-১৯০৭)। পৃ ৩৪।
৩ পত্রলেখা (কাব্য): (১০-১-১৯১১)। পৃ ১৫৮।
৪ ঝিলে জঙ্গলে শিকার (অনূদিত): (১৫-৯-১৯২৪)। পৃ ৯৮।
৫ অংশু (কাব্য): শ্রাবণ ১৩৩৪ (ইং ১৯২৭)। পৃ ১২৫।
৬ চম্পা ও পাটল (কাব্য): (ইং ১৯৩৯)। পৃ ৩৮।
 ইহা ছাড়া তিনি তিনখানি শিশ্যপাঠ্য গ্রন্থ-—‘অনাথ’ (১৮-২-১৯১৫), ‘কথা ও উপকথা’ ও ‘পঞ্চুলাল’ (ইং ১৯২৩) রচনা করিয়াছিলেন। ১৩৪১ সালের ফাল্গুন মাসে প্রিয়ম্বদার মৃত্যু হইয়াছে।[১৪]

 সরলাবালা দাসী। 
বাংলায় যে-কয়খানি সুপরিচিত শোক-কাব্য আছে, তাহার মধ্যে সরলাবালা দাসীর ‘প্রবাহ’ অন্যতম। তিনি কিশোরীলাল সরকারের কন্যা, ডাক্তার সরসীলাল সরকারের ভগিনী। ১২৮২ সালের ২৫এ অগ্রহায়ণ তাঁহার জন্ম, এবং ১২৯৪ সালে রায়-বাহাদুর মহিমচন্দ্র সরকারের পুত্র শরচ্চন্দ্রের সহিত বিবাহ হয়। ১৩০৫ সালের কার্তিক মাসে তাঁহার বৈধব্য ঘটে।

 তরুণ বয়স হইতেই সরলাবালার কাব্যানুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। ১২৯৭ সালের অগ্রহায়ণ-সংখ্যা ‘ভারতী ও বালকে’ প্রকাশিত ‘লজ্জাবতী’ নামে কবিতাটিই বোধ হয়। তাঁহার প্রথম মুদ্রিত রচনা। ‘সাহিত্য’, ‘প্রদীপ’ প্রভৃতি বহু সাময়িক-পত্রিকাতে তাঁহার কবিতা প্রকাশিত হইয়াছে। ছোট গল্প রচনাতেও তাঁহার কৃতিত্ব কম নহে; তাঁহার প্রথম গল্প ‘ঘরের লক্ষ্মী’ তৃতীয় বর্ষের ‘সাহিত্যে’ (কার্তিক ১২৯৯) মুদ্রিত হয়। ‘উৎসাহ’, ‘জাহ্নবী’, ‘উদ্বোধন' প্রভৃতির পৃষ্ঠা অনুসন্ধান করিলে সরলাবালার বহু, গদ্য-পদ্য রচনার সন্ধান মিলিবে। তিনি যে কয়খানি গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহার তালিকা:

১ প্রবাহ (শোককাব্য): ১৩১১ সাল (৮-১০-১৯০৪)। পৃ ২৫৩।
২ চিত্রপট (গল্প): (১৫-১-১৯১৭)। পৃ ২০৪।
৩ নিবেদিতা (জীবনী): জ্যৈষ্ঠ ১৩১৯ (১০-৬-১৯১২)। পৃ ৫৩।
৪ কুমুদনাথ (জীবনী): ১৩৪৪ সাল (১-৩-১৯৩৮)। পৃ ১৫৩।
 লজ্জাবতী বসু। ইনি স্বনামধন্য রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। ইহার বহু কবিতা ‘সাহিত্য’ (১৩০০..), ‘প্রদীপ’, ‘নব্যভারত’, ‘প্রবাসী’ প্রভৃতির পৃষ্ঠায় স্থানলাভ করিয়া বঙ্গীয় পাঠক-সমাজকে আনন্দ দান করিয়াছে। ইনি আজীবন কৌমার্য-ব্রত অবলম্বন করিয়া ১৯৪২ সনের ২১এ আগষ্ট, বাহাত্তর বৎসর বয়সে, পরলোকগমন করিয়াছেন। ইঁহার প্রতিভা সম্বন্ধে ১৩৫০ সালের জ্যৈষ্ঠ-সংখ্যা ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত বারীন্দ্রকুমার ঘোষের আলোচনা দ্রষ্টব্য।

 লাবণ্যপ্রভা বসু (সরকার)। 
ইনি সার্‌ জগদীশচন্দ্র বসুর ভগিনী; ১৯০৭ সনে হেমচন্দ্র সরকার, ডি. ডি.র সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। লাবণ্যপ্রভা বিদূষী মহিলা ছিলেন। দৈনিক ধর্ম সাধনের সাহায্যার্থ লিপির আকারে সংকলিত তাঁহার ‘দৈনিক’ গ্রন্থখানি (প্রথমার্ধ ১৮৯৯, উত্তরাধ ১৯০১) বহু ক্ষুধিত আত্মার তৃপ্তিসাধন করিয়াছে। এতদ্ব্যতীত তিনি ‘নীতি-কথা’, ‘গৃহের কথা’, ‘পরিণয়’, ‘কবি ও কাব্যের কথা’ ‘পৌরাণিক কাহিনী’ (১ম
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ।
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ।
খণ্ড, মহাভারত; ২য় খণ্ড রামায়ণ), ‘শ্রদ্ধায় স্মরণ’ (১৩১৯) প্রভৃতি আরও কয়েকখানি পুস্তকের রচয়িত্রী। তিনি সুপরিচিত শিশুপাঠ্য পত্রিকা ‘মুকুলের’ শেষ তিন বৎসর সম্পাদন করিয়াছিলেন। ১৯১৯ সনে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।

 প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। 
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্রী, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা। ইঁহার রচিত ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার (ইং ১৯০০ ..) সাহিত্যক্ষেত্রে নিতান্ত অপরিচিত নহে।

 সারদা সুন্দরী দেবী
ইনি ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের জননী; জন্ম ১৮১৯ সনে। ১৮৯২ ও ১৯০০ সনে ইঁহার বিবৃত আত্মকথা যোগেন্দ্রলাল খাস্তগীর ১৯১৪ সনের জানুয়ারি মাসে ‘কেশবজননী দেবী সারদাসুন্দরীর আত্মকথা’ নামে প্রকাশ করিয়াছেন।

 পঙ্কজিনী বসু। 
১৮৮৪ সনে ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার শ্রীনগর গ্রামে পঙ্কজিনীর জন্ম হয়। তাঁহার পিতার নাম নিবারণচন্দ্র গুহ মুস্তফী। তেরো বৎসর বয়সে বজ্রযোগিনী গ্রামে কুমন্দবন্ধু বসুর জ্যেষ্ঠ পত্র আশুবোধ বসুর সহিত পঙ্কজিনীর বিবাহ হয়। সতের বৎসর পূর্ণ হইতে-না-হইতেই ২ সেপ্টেম্বর ১৯০০ তারিখে তাঁহার মৃত্যু হয়। তাঁহার সকল কবিতাই বিবাহের পরে রচিত। ১৯০১ সনে ‘হেলেনা’ কাব্যের লেখক আনন্দচন্দ্র মিত্র স্বীয় ভূমিকা সহ ‘স্মৃতি-কণা’ নামে পঙ্কজিনীর কবিতাগুলি প্রকাশ করেন। পনর বৎসর পরে ১৯১৬ সনে ইহার পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ বাহির হয়; এই সংস্করণে খ্যাতনামা পণ্ডিত হরিনাথ দে কর্তৃক ‘সূর্যমুখী’ কবিতাটির ইংরেজী অনুবাদও স্থান পাইয়াছে।

 অন্নদাসুন্দরী ঘোষ। 
১৮৭৩ সনের ৩১এ ডিসেম্বর বাখরগঞ্জ জেলার অন্তঃপাতী রামচন্দ্রপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত গৃহ-পরিবারে অন্নদাসুন্দরীর জন্ম হয়। তাঁহার পিতার নাম মোহনচন্দ্র গুহ। বারো বৎসর বয়সে নিকটবর্তী গাভা গ্রামের ক্ষেত্রনাথ ঘোষের সহিত তাঁহার বিবাহ হয় (২৭ মে ১৮৮৬)। ইঁহাদের জ্যেষ্ঠ পত্র-রংপরে কারমাইকেল কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ শ্রীদেবপ্রসাদ ঘোষ। অন্নদাসুন্দরী উনিশ-কুড়ি বৎসর বয়স হইতেই কবিতা লিখিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার বহু কবিতা ‘দাসী’, ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’, ‘অন্তঃপুর’, ‘নব্যভারত’ প্রভৃতিতে সাদরে স্থান লাভ করিয়াছিল। বরিশালের ‘ব্রহ্মবাদী’ নামক মাসিকপত্রেও তাঁহার প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হইয়াছে। অন্নদাসুন্দরীর লিখিত কবিতাগুলি পুত্র দেবপ্রসাদ ১৩৪৭ সালের বৈশাখ মাসে ‘কবিতাবলী’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশ করিয়াছেন। কয়েক মাস পূর্বে—১৩৫৭, ৪ঠা শ্রাবণ—অন্নদাসুন্দরী পরলোকগমন করিয়াছেন।

 এই ক্রমোন্নতির জের আজও পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বঙ্গসাহিত্যে মহিলার দানের আয়তন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে। প্রবন্ধ, ভ্রমণ-কাহিনী কাব্য, ও কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁহাদের কেহ কেহ স্থায়ী আসন লাভ করিয়াছেন। যিনি বর্তমান কাল পর্যন্ত এই ইতিহাসের জের টানিবেন, সাহিত্যে বঙ্গমহিলার দীর্ঘতর তালিকা তাঁহাকে প্রস্তুত করিতে হইবে; কারণ, স্বভাবতই জীবনের নানা ক্ষেত্রের মত সাহিত্যক্ষেত্রেও নারীদের অভিযান ব্যাপকভাবে আরম্ভ হইয়াছে। গ্রন্থকর্ত্রী এবং সাময়িক-পত্রের লেখিকা হিসাবে এই শতাব্দীর গোড়া হইতে—

অনিন্দিতা দেবী, অনুরূপা দেবী, আশাপূর্ণা দেবী, আশালতা দেবী, আশালতা সিংহ, ইন্দিরা দেবী (চৌধরাণী), ইন্দিরা দেবী (বন্দ্যোপাধ্যায়), উমা দেবী (গুপ্ত), উমা রায়, উর্মিলা দেবী, কুমন্দিনী মিত্র (বসু), গিরিবালা দেবী, জ্যোতির্ময়ী দেবী, জ্যোতির্মালা দেবী, তুষার দেবী, দুর্গাবতী ঘোষ, নিরুপমা দেবী, নিরুপমা দেবী (সেন), নিস্তারিণী দেবী, পারুল দেবী, পূর্ণশশী দেবী, প্রতিভা বসু, প্রতিমা দেবী (ঠাকুর), প্রফুল্লময়ী দেবী (ঠাকুর), প্রভাবতী দেবী, ফুলকুমারী গুপ্ত, বাণী গুপ্তা, বাণী রায়, বিনোদিনী দাসী, বিমলা দাশগুপ্তা, বীণা দাস (ভৌমিক), মিসেস আর. এস. হোসেন, মৈত্রেয়ী দেবী, রত্নমালা দেবী, রমা চৌধরী, রাজকুমারী অনঙ্গমোহিনী, রাণী চন্দ, রাধারাণী দেবী (অপরাজিতা দেবী), লীলা দেবী (চৌধুরী), শরৎকুমারী দেবী, শান্তা দেবী, শান্তিসুধা ঘোষ, শৈলবালা ঘোষজায়া, সরযুবালা দাসগুপ্তা, সীতা দেবী, সুখলতা রাও, সরমাসুন্দরী ঘোষ, সুরুচিবালা সেনগুপ্তা, স্নেহলতা সেন, হাসিরাশি দেবী, হেমন্তবালা দেবী, হেমলতা দেবী, হেমলতা সরকার.।
     (সংক্ষিপ্ত)
                             বঙ্গসাহিত্যে নারী 
                         ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
        দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
       Doinik sabder methopath
         Vol -306. Dt -08.03.2021
           ২৩ ফাল্গুন,১৪২৭. সোমবার।
=================================




No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...