Sunday, 31 October 2021
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কবি জন কীটস । ৩১.১০.২১. Vol -542. The blogger in literature e-magazine
Saturday, 30 October 2021
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। ৩০.১০.২১. Vol -541. The blogger in literature e-magazine
Thursday, 28 October 2021
Happy Birthday to Henry Green . 29.10.21. Vol - 540. The blogger in literature e-magazine
Henry Green
English author best remembered for the novels Party Going, Living and Loving. He published a total of nine novels between 1926 and 1952.
Bibliography
- Blindness (1926)
- Living (1929)
- Party Going (1939)
- Pack My Bag: A Self-Portrait (1940)
- Caught (1943)
- Loving (1945)
- Back (1946)
- Concluding (1948)
- Nothing (1950)
- Doting (1952)
Collections
- Surviving: The Uncollected Writings of Henry Green (1992)
- Loving; Living; Party Going (2005)
- Nothing; Doting; Blindness (2008)
- Caught; Back; Concluding (2016)
Wednesday, 27 October 2021
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। । যোগীন্দ্রনাথ সরকার। ২৮.১০.২১. Vol -539. The blogger in literature e-magazine
"এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো !
আকাশ সেথা সবুজবরণ গাছের পাতা নীল;
ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা জলের মাঝে চিল !
সেই দেশেতে বেড়াল পালায়, নেংটি-ইঁদুর দেখে;
ছেলেরা খায় ‘ক্যাস্টর-অয়েল’ -রসগোল্লা রেখে !
মণ্ডা-মিঠাই তেতো সেথা, ওষুধ লাগে ভালো;
অন্ধকারটা সাদা দেখায়, সাদা জিনিস কালো !
ছেলেরা সব খেলা ফেলে বই নে বসে পড়ে;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া লোকের পিঠে চড়ে !
ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই, উড়তে থাকে ছেলে;
বড়শি দিয়ে মানুষ গাঁথে, মাছেরা ছিপ্ ফেলে !
জিলিপি সে তেড়ে এসে, কামড় দিতে চায়;
কচুরি আর রসগোল্লা ছেলে ধরে খায় !
পায়ে ছাতি দিয়ে লোকে হাতে হেঁটে চলে !
ডাঙ্গায় ভাসে নৌকা-জাহাজ, গাড়ি ছোটে জলে !"
(মজার দেশ)
বা
‘অ-য়ে অজগর আসছে তেড়ে
আমটি আমি খাবো পেড়ে
ইঁদুরছানা ভয়ে মরে
ঈগল পাখি পাছে ধরে’।
ঈশ্বরচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ যেমন শুধু ‘বর্ণপরিচয়’ বা ‘সহজ পাঠে’র জন্যেই পরিচিত নন তেমনই ‘হাসিখুশি’র স্রষ্টা যোগীন্দ্রনাথ সরকারও কিন্তু ‘হাসিখুশি’র জন্যেই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নন। শিশুসাহিত্যের গম্ভীর আকাশে তিনি সত্যি যেন চাঁদের হাসি ঢেলে দিতে পেরেছিলেন প্রথম। আর তাই তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি আজও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার।দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নেতড়াতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ২৮ অক্টোবর ১৮৬৬ (১২ কার্তিক ১২৭৩ বঙ্গাব্দ) । তাঁর আদি নিবাস যশোহর। তাঁর পিতার নাম নন্দলাল সরকার । নন্দলাল সরকার যশোরের একটি দরিদ্র কায়স্থ পরিবারের মানুষ ছিলেন। তিনি পরবর্তী কালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে থাকতে আরম্ভ করেন। বিখ্যাত চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ নীলরতন সরকার যোগীন্দ্রনাথ সরকারের দাদা। যোগীন্দ্রনাথ সরকার ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। দেওঘর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি নিজের প্রথাগত পড়াশোনা শেষ করতে পারেন নি।
সিটি কলেজিয়েট স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতে আরম্ভ করেন মাত্র পনের টাকা বেতনে। এ সময় থেকেই তিনি শিশু সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হন এবং শিশুসাহিত্য রচনা আরম্ভ করেন। আজগুবী ছড়া রচনায় তিনি খুব দক্ষ ছিলেন। তার সঙ্কলিত বই হাসি ও খেলা ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় । তিনি সখা, সখী, মুকুল, বালকবন্ধু, বালক, সন্দেশ প্রভৃতি ছোটদের পত্রিকায় লিখতেন। তিনি মুকুল পত্রিকাটি সম্পাদনাও করেছিলেন ।
তিনি ছবির সাহায্য অক্ষর চেনাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার কবিতাগুলির সাথে সুন্দর ছবি থাকত যা ছোটদের মনে এক কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করত। ছোটদের জন্য লেখা বিদেশী উদ্ভট ছন্দ ও ছড়ার অনুসরনে তিনি হাসি রাশি নামে একটি সচিত্র বই প্রকাশ করেন। এর সাথে সাথেই ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তার সংগৃহিত খুকুমনির ছড়া প্রকাশিত হয়। তার রচিত হাসিখুসি (১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত) বইটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল। তার রচিত ও সঙ্কলিত ৩০টি ছোটদের গল্প ও ছড়ার বইয়ের মধ্যে ছড়া ও ছবি, রাঙাছবি, হাসির গল্প, পশুপক্ষী, বনে জঙ্গলে, গল্পসঞ্চয়, শিশু চয়নিকা হিজিবিজি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার সম্বন্ধে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “বাংলার মাটিতে এমন একজন মানুষ অন্ততঃ জন্মেছেন, যিনি একান্তভাবে ছোটদের লেখক, সেই সব ছোটদের, যারা কেঁদে কেঁদে পড়তে শিখে, পরে হেসে হেসে বই পড়ে।”
ছোটদের উপযোগী ২১টি পৌরানিক বই এইসময় তিনি রচনা করেছিলেন। সেগুলি হল, ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৯০৯), ‘শকুন্তলা’, ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘সীতা’ (১৯১০), ‘ধ্রুব’ (১৯১৫), ‘ছোটদের রামায়ণ’ (১৯১৮), ‘ছোটদের মহাভারত’ (১৯১৯), ‘দৈত্য ও দানব’ (১৯২০) প্রভৃতি। এছাড়াও জ্ঞানমুকুল, সাহিত্য, চারুপাঠ, শিক্ষাসঞ্চয় প্রভৃতি ১৩-১৪টি স্কুলপাঠ্য বই তিনি রচনা করেছিলেন। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বন্দেমাতরম্ বলে একটি জাতীয় সঙ্গীত সংগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সিটি বুক সোসাইটি নামে প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করেন। এই প্রকাশনা সংস্থা থেকেই উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর প্রথম বই ছেলেদের রামায়ণ প্রকাশিত হয়েছিল। নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর শিশুদের বই ‘টুকটুকে রামায়ণ’ এবং কুলদারঞ্জন রায়ের লেখা ‘ইলিয়াড’ এই পাবলিকেশন থেকেই প্রকাশিত হয়।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রবল কর্মব্যস্ততার ফলে উচ্চরক্তচাপজনিত কারণে মস্তিষ্কের শিরা ছিঁড়ে জ্ঞান হারান তিনি। বহু চিকিৎসার পর প্রাণরক্ষা পেলেও শরীরের ডান ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়। কিন্তু অসুস্থতার মধ্যেও তিনি তাঁর রচনা ও প্রকাশনার কাজ চালিয়ে যান। এই পরিস্থিতির মধ্যেই ১৯৩৬ সালে তাঁর শেষ সংকলন 'গল্প সঞ্চয়' প্রকাশিত হয়। তার রচিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৭৮টি।
যোগীন্দ্রনাথের কালজয়ী বই ‘হাসিখুশি’। যদিও মনে রাখা প্রয়োজন যে এটাই ওনার প্রথম বই নয়। ১৮৯১ সালে তাঁর সংকলিত ‘হাসি ও খেলা’ বাংলায় প্রকাশিত প্রথম সচিত্র শিশুপাঠ্য বই। ‘হাসি ও খেলা’ বইটার নিবেদন অংশটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে এখনও। যোগীন্দ্রনাথ সেখানে লিখেছেন, “আমাদের দেশে বালক বালিকাদের উপযোগী স্কুলপাঠ্য পুস্তকের নিতান্ত অভাব না থাকিলেও গৃহপাঠ্য ও পুরস্কার-প্রসাদযোগ্য সচিত্র পুস্তক একখানিও দেখা যায় না। এই অভাব কিঞ্চিৎ পরিমাণে দূর করিবার জন্যে হাসি ও খেলা প্রকাশিত হইল।”
‘হাসি ও খেলা’ প্রকাশের আগে যে এরকম বইয়ের সত্যি অভাব ছিল তা বোঝা যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্যে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাধনা’ পত্রের ১৩০১-এর ফাল্গুন সংখ্যায়। “...ছোট ছেলেদের জন্যে যে সকল বই আছে তাহা স্কুলে পড়িবার বই; তাহাতে স্নেহের বা সৌন্দর্যের লেশমাত্র নাই, তাহাতে যে পরিমাণ উৎপীড়ন হয় সে পরিমাণ উপকার হয় না।”
১৮৯২-এ যোগীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়েছিল বৈকুন্ঠ রায়ের আঠারো বছরের মেয়ে গিরিবালা দেবীর সাথে। এই বিবাহে আচার্য্যের কর্তব্য পালন করেছিলেন স্বনামধন্য পন্ডিত শ্রী শিবনাথ শাস্ত্রী। ক্রমে তিনি ছয়টি সন্তানের পিতা হন।
শিক্ষক যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন ছাত্রসমাজে বিপুল জনপ্রিয়। শিক্ষকতার সাথে সাথে ছাত্রদের জন্য সঙ্গীতাভিনয়ের ব্যবস্থা করা, ‘মুকুল’ পত্রিকার কার্য্যাধ্যক্ষ পদে আসীন থাকার দায়িত্ব নির্বাহ করা ইত্যাদি নানারকম কাজে ব্যস্ত থাকতেন তিনি। ‘মুকুল’-এর ছবির জন্য তাঁকে সে সময়ের একমাত্র উড ব্লক প্রস্তুতকারক প্রিয়গোপাল দাসের কাছে প্রায়ই যেতে হত। এসব কারণে নিয়মিত সময়ে প্রতিদিন তিনি স্কুলে পৌঁছোতে পারতেন না, আর যার ফলে তাঁর একমাত্র রোজগার পনেরো টাকার বড়ো অংশটাই কাটা যেত। আর তাই তিনি নিজে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নেমেছিলেন বই প্রকাশনার জগতে। ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজস্ব প্রকাশনালয় ‘সিটি বুক সোসাইটি’। সেই একই সালে প্রকাশিত হয় শিশুগদ্য পাঠের সচিত্র বই ‘রাঙাছবি’। ছোটোদের বইয়ের প্রকাশক হিসেবে তিনি অতুলনীয় ছিলেন। সেই যোগীন্দ্রনাথ তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর সহায়তায় ‘সখা’ পত্রিকার সমস্ত ব্লকগুলো কিনে নিয়েছিলেন যা তাঁকে পুস্তক প্রকাশনা ব্যবসায়ে বিশেষ প্রেরণা দিয়েছিল। পরের বছর ১৮৯৭-এ ওই প্রকাশনা সংস্থা থেকেই প্রকাশিত হল যুগান্তকারী ওই প্রাইমার ‘হাসিখুশি’। ‘হাসিখুশি’ প্রকাশিত হল দুটি ভাগে। প্রথম ভাগ ১৮৯৭ সালে ও দ্বিতীয় ভাগ ১৯০৪ সালে।বলা বাহুল্য, প্রথম ভাগটির জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশি। পরবর্তীকালে ‘হাসিখুশি’র জনপ্রিয়তা অনেকটাই পেছনে ফেলে দিয়েছিল বিয়াল্লিশ বছর আগে প্রকাশিত বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’কে। ‘হাসিখুশি’র শুরু হয়েছে ছড়া দিয়ে। তাই ছোটোদের কোমল মনে রেখাপাত করতে অসুবিধা হয়নি। তাছাড়া প্রত্যেকটা ছড়ার শুরুতেই সেই বর্ণটি দেওয়া আছে। সহজবোধ্য ছবির মাধ্যমে বর্ণটিকে সহজে চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলা বর্ণমালার কিছু কিছু বর্ণের শব্দের প্রথমে না আসার অসুবিধার জন্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে বর্ণটিকে ছবির মধ্যে আলগাভাবে বসানো হয়েছে। যেমন ণ, ড়, ঢ়, ৎ, য় ইত্যাদি। তাতে অবশ্য পড়ার বা বোঝার কোনও অসুবিধা হয় না। কয়েকটা বর্ণ আবার নিজের ছবির প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে যেমন, লৃ-কারের ছবির বালকটার শরীরটাকে অক্ষরটার মতন করেই আঁকা হয়েছে, কিংবা বলা যায় ‘ৎ’ হল বেড়ালের লেজ! এছাড়া ‘হাসিখুশি’ বর্ণমালায় ছড়ায় ব্যবহৃত শব্দগুলো শিশুদের কাছে অনেক বেশি শ্রুতিমধুর ও কাছের। মনে হয় সবসময় ওই শব্দগুলো পালটে দিলে যেন কোনও মানানসইতাই থাকবে না, হয়ে যাবে এলোমেলো। তৎকালীন অন্যান্য শিশুশিক্ষার বইয়ে ব্যবহৃত কিছু শব্দ যেমন ঊষা, একতারা, ঐরাবত, থানা ইত্যাদি শব্দ অক্ষরজ্ঞানহীন সাধারণ ঘরের শিশুদের কাছে সহজবোধ্য নয় বলেই ‘হাসিখুশি’তে সেগুলোর জায়গায় অনেক বেশি প্রচলিত ও চলতি শব্দ ব্যবহার করেছেন যোগীন্দ্রনাথ। থানার সাহায্যে ‘থ’ চেনানোর চাইতে ‘থালা ভরা আছে মিঠাই’ অনেক মনোগ্রাহী।১৯৩৭-এ জীবনের শেষবেলায় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকায় সমৃদ্ধ ‘গল্প সঞ্চয়ন’ সংকলনটি প্রকাশিত হয়। এছাড়াও প্রকাশিত হয় আরও দুটি শিশুপাঠ্য সংকলন – ‘ছোটদের উপকথা’ এবং ‘আগমনী’। জীবন পশ্চিমের পটে চলে আসার সময় যোগীন্দ্রনাথের জীবনে ঘটে যায় আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা। তাঁকে জীবদ্দশায় দেখে যেতে হল নিজের মেয়ের মৃত্যু। এর একমাসের মধ্যেই দুরারোগ্য নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে একাত্তর বছর বয়সে ১৯৩৭-এর ২৬শে জুন ইহলোক ত্যাগ করেন শিশুসাহিত্যের এই প্রাণপুরুষ। যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন স্নেহবৎসল কোমল মানুষ, যিনি সারাজীবন শিশুসাহিত্যকে পরিপুষ্ট করে তুলতে নিয়োজিত ছিলেন। অনেক শিশুসাহিত্যিক পাওয়া যাবে, কিন্তু যোগীন্দ্রনাথ সরকারের অবদান বাংলা শিশুসাহিত্য কোনওদিন ভুলবে না। আজ থেকে ১০০ বছর পরও হয়তো দেখা যাবে একটি চার বছরের শিশু দুলে দুলে ইন্টারনেট খুলে পাঠ করছে –
কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি
খেঁকশেয়ালি পালায় ছুটি
গরু বাছুর দাঁড়িয়ে আছে
ঘুঘু পাখি ডাকছে গাছে।
১৯৩৭ সালের ২৭শে জুন (মতান্তরে ২৬শে জুন) ৭১ বছর বয়সে মৃত্যু হয় যোগীন্দ্রনাথ সরকারের।
ছড়া ১
হারাধনের দশটি ছেলে
হারাধনের দশটি ছেলে
ঘোরে পাড়াময়,
একটি কোথা হারিয়ে গেল
রইল বাকি নয়।
হারাধনের নয়টি ছেলে
কাটতে গেল কাঠ,
একটি কেটে দু’খান হল
রইল বাকি আট।
হারাধনের আটটি ছেলে
বসলো খেতে ভাত,
একটির পেট ফেটে গেল
রইল বাকি সাত।
হারাধনের সাতটি ছেলে
গেল জলাশয়,
একটি সেথা ডুবে ম’ল
রইল বাকি ছয়।
হারাধনের ছয়টি ছেলে
চ’ড়তে গেল গাছ,
একটি ম’ল পিছলে পড়ে
রইল বাকি পাঁচ।
হারাধনের পাঁচটি ছেলে
গেল বনের ধার,
একটি গেল বাঘের পেটে
রইল বাকি চার।
হারাধনের চারটি ছেলে
নাচে ধিন ধিন,
একটি ম’ল আছাড় খেয়ে
রইল বাকি তিন।
হারাধনের তিনটি ছেলে
ধরতে গেল রুই,
একটি খেলো বোয়াল মাছে
রইল বাকি দুই।
হারাধনের দুইটি ছেলে
মারতে গেল ভেক,
একটি ম’ল সাপের বিষে
রইল বাকি এক।
হারাধনের একটি ছেলে
কাঁদে ভেউ ভেউ,
মনের দুঃখে বনে গেল
রইল না আর কেউ।
ছড়া ২
তোতাপাখি
আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মউ,
কথা কও না কেন বউ ?
কথা কব কী ছলে,
কথা কইতে গা জ্বলে !
ছড়া ৩
কাকাতুয়া
কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুমণি,
সোনার ঘড়ি কি বলিছে, বল দেখি শুনি ?
বলিছে সোনার ঘড়ি, “টিক্ টিক্ টিক্,
যা কিছু করিতে আছে, করে ফেল ঠিক।
সময় চলিয়া যায়-
নদীর স্রোতের প্রায়,
যে জন না বুঝে, তারে ধিক্ শত ধিক।”
বলিছে সোনার ঘড়ি, “টিক্ টিক্ টিক্।”
কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুধন,
অন্য কোন কথা ঘড়ি বলে কি কখন ?
মাঝে মাঝে বল ঘড়ি, “টঙ্-টঙ্-টঙ্,
মানুষ হইয়ে যেন হয়ো না ক সঙ।
ফিটফিটে বাবু হলে,
ভেবেছ কি লবে কোলে ?
পলাশে কে ভালবাসে দেখে রাঙা রঙ্।”
মাঝে মাঝে বলে ঘড়ি, “টঙ্-টঙ্-টঙ্।”
ছড়া ৪
প্রার্থনা সঙ্গীত
ছোটো শিশু মোরা তোমার করুণা হৃদয়ে মাগিয়া লব
জগতের কাজে জগতের মাঝে আপনা ভুলিয়া রব।
ছোটো তারা হাসে আকাশের গায়ে ছোটো ফুল ফুটে গাছে;
ছোটো বটে তবু তোমার জগতে আমাদেরো কাজ আছে।
দাও তবে প্রভু হেন শুভমতি প্রাণে দাও নব আশা;
জগত মাঝারে যেন সবাকারে দিতে পারি ভালবাসা।
সুখে দুখে শোকে অপরের লাগি যেন এ জীবন ধরি;
অশ্রু মুছায়ে বেদনা ঘুচায়ে জীবন সফল করি।।
ছড়া ৫
কাজের ছেলে
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল,চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল;
ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়,”
” ছিঁড়ে দেবে চুল।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
বাহবা বাহবা – ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ!
দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।
দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
ডিম-ভরা বেল, দু’টা পাকা তেল, সরিষার কৈ।
ওই তো ওখানে ঘুরি ধরে টানে, ঘোষদের ননী;
আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি!
দাদখানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দুটা পাকা দৈ,
সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ!
এসেছি দোকানে-কিনি এই খানে, যত কিছু পাই;
মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই!
দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,
চিনি-পাতা চাল, দুটা পাকা ডাল, ডিম ভরা দৈ।
==========∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆==========
Tuesday, 26 October 2021
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। লেখক চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় ২৭.১০.২১. Vol -538. The blogger in literature e-magazine.
- উদ্ভ্রান্তপ্রেম (১৮৭৫)
- মশলা-বাধা কাগজ
- সারস্বতকুজ্ঞ (১৮৮৫)
- স্ত্রী-চরিত্র (১৮৯০)
- কুঞ্জলতার মনের কথা
- রামবসুর বিরহ
- মৃন্ময়ী
- রসসাগর
চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে অক্টোবর প্রয়াত হন।
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কবি মোহিতলাল মজুমদার। ২৬.১০.২১. Vol -537. The blogger in literature e-magazine
"আমার মনের গহন বনে
পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী
নারী-অপ্সরী সঙ্গোপনে!
ফুলেরি ছায়ায় বসে তার দুই চরণ মেলি
বিজন-নিভৃতে মাথা হতে দেয় ঘোমটা ফেলি,
শুধু একবার হেসে চায় কভু
নয়ন কোণে,
আমারি মনের গহন বনে।"
বিংশ শতাব্দীর এক জন বিখ্যাত বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক এবং সাহিত্য সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। কাব্যচর্চা দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও পরে সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, নিপুণ বিশ্লেষণ ও ভাবগম্ভীর ভাষার মহিমায় মোহিতলালের সমালোচনাধর্মী গ্রন্থগুলো ধ্রুপদী সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। শিল্প-সাহিত্যের নানা সমস্যা আলোচনায় তাঁর ছিল নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, মতবাদ। ফলে কবি ও প্রবন্ধকাররূপে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জুলাই তিনি প্রয়াত হন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, মোহিতলাল মজুমদার ১৮৮৮ সালের ২৬ অক্টোবর নদীয়ার কাচঁড়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
মোহিতলাল মজুমদার (জন্ম : ২৬ অক্টোবর, ১৮৮৮ – মৃত্যু : ২৬ জুলাই, ১৯৫২) প্রথম জীবনে কবিতা লিখলেও পরবর্তী জীবনে সাহিত্যসমালোচক হিসেবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মোহিতলাল মজুমদারের পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত বলাগড় গ্রাম। তাঁর বাবার নাম নন্দলাল মজুমদার। নন্দলাল ছিলেন কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের জ্ঞাতি ভাই। মোহিতলালের কৈশোর এবং বিদ্যালয়জীবন বলাগড় গ্রামেই অতিবাহিত হয়।ছোটবেলায় তিনি কিছু দিন চব্বিশ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার কাছে হালিশহরে মায়ের মামাবাড়িতে অবস্থান করে সেখানকার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। মোহিতলাল চার-পাঁচ বছর বয়সে কাশীরাম দাসের মহাভারতের সঙ্গে পরিচিত হন। নয় বছর বয়সে তাঁর রোমান্স পাঠে আগ্রহ জন্মায়। বারো – তেরো বছর বয়সেই পলাশীর যুদ্ধ এবং মেঘনাদ বধ কাব্য পড়ে শেষ করেন। তিনি বলাগড় বিদ্যালয় থেকে ১৯০৪ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৯০৮ সালে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে বি.এ পাস করেন। কিন্তু অসুবিধায় পড়ে এম.এ পড়া ছেড়ে দেন। ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার তালতলা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯১৪ সালে সরকারি জরিপ বিভাগে কানুনগো পদে চাকরি গ্রহণ করেন। তিন বছর তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পুনরায় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা কর্মে নিয়োজিত থাকেন। ১৯৪৪ সালে অধ্যাপনার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন মোহিতলাল।তারপর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। পরে বঙ্গবাসী কলেজে গিরিশ সংস্কৃতি ভবনে অধ্যাপনায় যোগ দেন।
মোহিতলাল মজুমদারের সাহিত্যচর্চার শুরু ‘মানসী’ পত্রিকার মাধ্যমে। পরে ভারতী ও শনিবারের চিঠিসহ অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়ও তিনি নিয়মিত লিখতেন। বীরভূমি পত্রিকায় কবিতা প্রবন্ধ অনুবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম দিকের কবিতায় স্বপ্নবিহবল তরুণ মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বেদনা মনোরম ছন্দে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির পশ্চাতে নিজস্ব কাব্যাদর্শ, সৌন্দর্যবোধ ও আধ্যাত্মিক মতবাদ ক্রিয়াশীল ছিল। অবশ্য এই আধ্যাত্মিক মতবাদটি খুব স্পষ্ট নয় বৈষ্ণবতত্ত্বের সঙ্গে বেদান্তের একটা সমন্বয়ের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। ভাবসাধনার দিক থেকে মোহিতলাল ভোগসর্বস্ব দেহবাদী কবি।
দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে তাঁর কাব্যচর্চায় দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব দেখা যায়। এ ছাড়াও, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যাযের় কবিতার ছন্দোমাধুর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। মোহিতলাল কিছু কাল ভারতী গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক ছিলেন। তিনি শনিচক্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্র পরবর্তী কাব্যে কবি মোহিতলালের স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য সমালোচক হিসাবেও তাঁর সবিশেষ খ্যাতি ছিল। ভাষারীতির বিশুদ্ধতা নিয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ ও নিষ্ঠা ছিল। শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলি দেখানোর ক্ষেত্রে তাঁর একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তাঁর মননধর্মিতা এবং কবিসুলভ ভাবাত্মক বিচারবোধ সমালোচনা সাহিত্যকে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলিতে ‘কৃত্তিবাস ওঝা’, ‘সব্যসাচী’, ‘শ্রী সত্যসুন্দর দাস’ ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন।
বাংলা কাব্যে বিদেশী শব্দ, বিশেষ করে আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগে মোহিতলালের বিশেষ কৃতিত্ব ছিল। তিনি ইংরেজি সাহিত্যেও সুপন্ডিত ছিলেন। বাংলা ছন্দ ও অলঙ্কার বিষয়ে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। মোহিতলাল রবীন্দ্রকাব্যের একজন রসজ্ঞ ও মর্মজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তবে পরবর্তীতে শনিবারের চিঠির দলে যোগ দিয়ে তিনি রবীন্দ্রবিরোধী হয়ে ওঠেন। কাব্য বিচারে তিনি পঞ্চাশ-উত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখেননি। তিনি বঙ্গ সাহিত্য-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ আসনে মাইকেল ও বঙ্কিমচন্দ্রকে বসানোর চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই এই বিতর্কিত সাহিত্যপ্রতিভার কাব্য আপন বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বঙ্গসাহিত্য প্রসঙ্গে মোহিতলাল সৃজনধর্মী ও সৃষ্টিশীল আলোচনা করে গেছেন.
ভারতী’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র অনুসারী যে কবি সমাজ রাবীন্দ্রিক রোমান্টিক মোহ মদির পরিবেশে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন, মোহিতলাল সেই বলয়ে প্রবেশ না করে নতুন কালের বাস্তবতার জয়ধ্বজা ওড়ালেন- যা ত্রিশের দশকে প্রকাশিত ‘কল্লোল’ পত্রিকার কাব্যাদর্শকে অনেকক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। কল্লোলপন্থীদের দেহকেন্দ্রিক প্রেম ভাবনার অনুপ্রেরণা মহিতলালই। ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত মোহিতলালকে তাই ‘আধুনিকোত্তম’ বলেছেন। ‘কবিতা’ পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘আমাদের তরুণ বয়সে যখন রবিদ্রোহিতার প্রয়োজনীয় ধাপটি আমরা পার হচ্ছিলাম তখন যে দু’জন কবিকে আমরা তখনকার মতো গত্যন্তর খুঁজে পেয়েছিলাম, তাঁদের একজন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আর একজন ‘বিস্মরণী’-র মোহিতলাল। কিন্তু বাংলা কাব্যে দেহবাদের প্রবক্তা হয়েও মোহিতলাল কিন্তু যাযাবরী উদ্দামতাকে প্রশ্রয় দেননি। তাই ‘কল্লোল’-এর কবিদের কাছে ‘দ্রোণাচার্য’ হয়েও তার সঙ্গে মোহিতলালের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কল্লোল গোষ্ঠীর তীব্র নিরাশা আর আদিমতার আসক্তিতে তিনি ছিলেন নিঃস্পৃহ। কল্লোলীয়দের সঙ্গে মোহিতলালের এই ছিল প্রাথমিক পার্থক্য। মোহিতলালের বিদগ্ধ কবি-মানসে শেষ পর্যন্ত ‘কাম’ দেহকে আশ্রয় করে সার্থক হয়ে উঠেছে। কিন্তু কল্লোলীয়দের কামের জন্যই দেহে, অথচ সেই সম্ভোগের মধ্যে নেই কোন আধ্যাত্মিক তৃপ্তি। এমিল জোলার Naturalism, লরেন্সের সেক্স ও ঈডিপাস তত্ত্ব, লেডি চ্যাটার্লির সন্সকার-মুক্তি, ক্লুট হামসুনের ‘ক্ষুধা’ ইত্যাদি সব কিছুই তাঁর কাছে ভোগ্য ও আস্বাদ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু মোহিতলাল দেহের সৌন্দর্য-ধ্যানেই শেষ পর্যন্ত তন্ময় হয়ে ভালোবাসার মহিমা উপলব্ধি করেছেন, “আমার দেবতা সুন্দর সে যে, পূজা নয়-ভালোবাসি।” মানুষের মাঝে দেবতার, দেহের মাঝে আত্মার স্বীকৃতিদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কবিতার ভাববৃত্ত পূর্ণ হয়েছে। কবিতার ভাবানুসঙ্গ ও রূপনির্মিতিতে মোহিতলাল ক্ল্যাসিকপন্থী। তাঁর কবিতায় বলিষ্ঠ ভাবচেতনা ভাস্করের কারুকার্যে সুগঠিত। হয়ত অনেক সময় ভাবাবেগের প্রাবল্য আছে, কিন্তু তা দৃঢ়তায় পূর্ণ, কবিতার আঙ্গিকের সঙ্গে সামঞ্জস্যময়। খেয়ালী কল্পনা ও লঘু ভাবনার অবসর সেখানে নেই। মননের দীপ্ত বিলাসে, আত্মকেন্দ্রিক আভিজাত্য এবং ব্যক্তি চেতনার সজাগ অভিমান কবি মহিতলাল আজও রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে যেন এক নিঃসঙ্গ দৃষ্টান্ত।
মৌলিক গ্রন্থ, সমালোচনা ও সম্পাদিত গ্রন্থ মিলিয়ে মোহিতলাল মজুমদারের প্রকাশিত গ্রন্থ অনেক। কবি মোহিতলালের জীবনকাল ১৮৮৮ থেকে ১৯৫২। প্রথম প্রকাশিত কাব্য ‘দেবেন্দ্রমঙ্গল’ ১৬টি সনেট নিয়ে প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রি.। তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ছন্দচতুর্দশী’ ৫৪টি সনেট নিয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রি.। এই কালসীমার মধ্যে রচিত তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল-ক) কাব্যগ্রন্থ- ১) দেবেন্দ্র-মঙ্গল (১৯২২) ২) স্বপন-পসারী (১৯২২) ৩) বিস্মরণী (১৯২৭) ৪) স্মরগরল (১৯৩৬) ৫) হেমন্ত-গোধূলি (১৯৪১) ৬) ছন্দ চতুর্দশী (১৯৪১) (সনেট সঙ্কলন) ৭) কাব্য মঞ্জুষা তন্মধ্যে – ‘দেবেন্দ্র-মঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থটি ছিল আত্মীয় ও কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রশস্তিমূলক ১৬টি সনেটের সঙ্কলন। খ) প্রবন্ধগ্রন্থ- ১) আধুনিক বাংলা সাহিত্য (১৯৩৬) ২) সাহিত্যকথা (১৯৩৮) ৩) বিবিধ কথা (১৯৪১) ৪) বিচিত্র কথা (১৯৪১) ৫) সাহিত্য বিতান (১৯৪২) ৬) বাঙলা কবিতার ছন্দ (১৯৪৫) ৭) বাঙলার নবযুগ (১৯৪৫) ৮) জয়তু নেতাজী (১৯৪৬) ৯) কবি শ্রীমধুসূদন (১৯৪৭) ১০) সাহিত্য বিচার (১৯৪৭) ১১) বঙ্কিমবরণ (১৯৪৯) ১২) রবি-প্রদক্ষিণ (১৯৪৯) ১৩) শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্র (১৯৫০) ১৪) জীবন জিজ্ঞাসা (১৯৫১) ১৪) বাঙলা ও বাঙালী (১৯৫১) ১৫) কবি রবীন্দ্র ও রবীন্দ্র কাব্য (প্রথম খণ্ড ১৯৫২, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৫৩) ১৬) বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস (১৯৫৫)। বঙ্গদর্শন পত্রিকা তৃতীয় পর্যায়ে মোহিতলালের সম্পাদনায়ই প্রকাশিত হয়।
তাঁর কাব্যে প্রেমপরিবেশে তাই ফুল, মালা, স্রগ্ধ-চন্দন ইত্যাদি অনিবার্যভাবে স্থান নিয়েছে। ‘তিমির তীর্থে’ পথিক কবি ‘দেহ’-কে ক্ল্যাসিক কবির মতোই মন্দির বলেছেন এবং প্রেমকেও ক্ল্যাসিকাল পূজার মনোবৃত্তিতেই দেহোপাসনা বলেছেন বারংবার। বলা বাহুল্য এইখানেই শিল্পী হিসেবে সমকালীন কবিদের তুলনায় মোহিতলালের এতখানি স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা। তাঁর কাব্যে ক্লাসিক্যাল ভঙ্গি এবং রোমান্টিক ভাবের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর মানস-লক্ষ্মী কবিতার প্রথম কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপ -
“আমার মনের গহন বনে
পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী
নারী-অপ্সরী সঙ্গোপনে!
ফুলেরি ছায়ায় বসে তার দুই চরণ মেলি
বিজন-নিভৃতে মাথা হতে দেয় ঘোমটা ফেলি,
শুধু একবার হেসে চায় কভু
নয়ন কোণে,
আমারি মনের গহন বনে। ”
মোহিতলাল নারীর মোহিনীরূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন-
“সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি মিথ্যা সনাতনী
সত্যেরে চাহিনা তবু সুন্দরের করি আরাধনা”
সমালোচকগণ বলছেন, মোহিতলালের মানসলক্ষ্মী কোন বিদেহী রোমান্টিক সৌন্দর্যে প্রবর্তনা না হয়ে ‘স্পর্শরসিক’ কবির স্পর্শ বন্ধনেই ধরা পরবে-কবির এরকম আকাঙ্ক্ষাতেই রবীন্দ্রনাথের মানসসুন্দরী ও মোহিতলালের মানসলক্ষ্মী দুই স্বতন্ত্র সৌন্দর্যলোকবাসিনী হয়ে উঠেছে। এখানেই ভোগবাদী মোহিতলালের ইন্দ্রীয়ময় দেহসৌন্দর্যবাদের বৈশিষ্ট্য। দুরন্ত দেহবাসনার উত্তাল তরঙ্গেই প্রেয়সী নারীর সৌন্দর্যসম্মোহন উপভোগ করেছেন মোহিতলালঃ-
‘সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি মিথ্যা সনাতনী
তবুও তার আকর্ষণ কবির কাছে দুর্বার; কেননা,
কটাক্ষ ঈক্ষণ তার হৃদয়ের বিশল্যকরণী;
স্বপনের মনিহারে হেরি তার সীমন্ত রচনা
নিপুণা নটিনী নাচে, অঙ্গে অঙ্গে অপূর্ব লাবণি
স্বর্ণপাত্রে সুধারস, না সে বিষ? কে করে শোচনা
পান করি সুনির্ভয়ে, মুচকিয়া হাসে যবে ললিতলোচনা।’
নব্যতান্ত্রিক মোহিতলালের জীবনের আদর্শ তাই নীলকণ্ঠ, রবীন্দ্রনাথের মতো নটরাজ নয় এবং ‘স্বপনপসারী’র ‘পাপ’কবিতায় তিনি লিখেছেনঃ-
‘ত্যাগ নহে, ভগ,-ভোগ তারি লাগি, যেই জন বলীয়ান।
নিঃশেষে ভরি’ লইবারে পারে এত বড় যার প্রাণ!
যে জন নিঃস্ব, পঞ্জরতলে নাই যার প্রাণধন
জীবনের এই উৎসবে তার হয়নি নিমন্ত্রণ!’
‘স্মরগরল’ কাব্যের নাম কবিতায় প্রথমেই লিখেছেনঃ
‘আমি মদনের রচিনু দেউল-দেহের দেউল ‘পরে
পঞ্চশরের প্রিয় পাঁচ-ফুল সাজাইনু থরে থরে।
দুয়ারে প্রাণের পূর্ণকুম্ভ-
পল্লবে তার অধীর চুম্ব,
রূপের আবীরে স্বস্তিক তায় আঁকিনু যতন ভরে।’
এইজন্যই কবি মোহিতলালের কাছে নারীসৌন্দর্য তার ‘জায়া’ রূপের মধ্য দিয়েই উপভগ্য।
‘তাই আমি রমণীয় জায়ারূপ করি উপাসনা।’
রবীন্দ্রনাথের ‘রাতে ও প্রভাতে’ কবিতায় দুই ভিন্নরূপে রমণীর জায়ারূপ এবং কল্যাণসুন্দর গৃহিণীরূপকে আলাদা করে দেখেছেন। কিন্তু মোহিতলাল দেখেছেন-
‘বধূ ও জননী পিপাসা মিটায় দ্বিধাহারা
রাধা ও ম্যাডোনা একাকারা।’
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে বলা হতো চলমান বিশ্বকোষ। অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতি এই সবগুলো বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত দেয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর। সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠসমূহের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অনেকেই একবাক্যে তাঁর মেধা এবং ধী-শক্তির অন্যন্যতা স্বীকার করেছেন। এই নিভৃতচারী, অনাড়ম্বর জ্ঞানসাধক মানুষটি সারাজীবন কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। তিনি ব্যক্তি মানুষটি কেমন মুষ্টিমেয় অনুরাগীর বাইরে অনেকেরই ধারণা নেই। এই অনুরাগীদের একজন আহমদ ছফা। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ছাত্র। দীর্ঘ মেলামেশার ফলে প্রফেসর রাজ্জাককে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার দুলর্ভ সুযোগ হয়েছে তাঁর। আর সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই ছফা লিখেছেন 'যদ্যপি আমার গুরু'। অধ্যাপক রাজ্জাককে নিয়ে খোলামেলা, তীক্ষ্ম, গভীর এবং সরস গ্রন্থ। আহমদ ছফা'র সাথে আলাপচারিতায় নানা বিষয় নিয়ে বলেছেন প্রফেসর রাজ্জাক। আহমদ ছফা প্রাণবন্ত ভাষায় সেগুলো উল্লেখ করেছেন 'যদ্যপি আমার গুরু'তে। আমার প্রিয় বই এটি। তাদের আলাপচারিতার মোহিতলালের প্রসঙ্গটি পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই। আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘কবি জসীমুদ্দীনের প্রসঙ্গ ধরে কবি মোহিতলালের কথা উঠলো। মোহিতলাল মজুমদার পূর্ববাংলার উচ্চারণরীতি বরদাশত করতে পারতেন না। কবি জসীমুদ্দীনের একটা কবিতার বইয়ের নাম ছিল ধান খেত। মোহিতবাবু ব্যঙ্গ করে বলতেন জসীমুদ্দীন ধান খেতো। মোহিতলালের জিভের মধ্যে বিষ আছিল। তাঁর ঠাট্টা রসিকতা এমনভাবে ছড়াইয়া পড়ল জসীমুদ্দীন বেচারার জান যাওনের দশা। একদিন আমি মোহিতবাবুরে চ্যালেঞ্জ কইরা বইলাম। কইলাম, আপনে জসীমুদ্দীনরে এত ঠাট্টা করেন ক্যান্। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যদি জসীমুদ্দীনের উপর এক অধ্যায় লেখা অয়, আপনেরে নিয়া লেখব মাত্র চাইর লাইন।’
===={{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆¶¶¶}}}}}}}}}}}======Monday, 25 October 2021
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়।। ২৫.১০.২০২১. Vol -536. The blogger in literature e-magazine
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
জন্ম ২৫ অক্টোবর ১৯৩৩ । বিশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালী সাহিত্যিক। পশ্চিমবঙ্গের হাংরি আন্দোলনের সাথে ছিলেন শুরু থেকে, যদিও পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর বিনয় মজুমদারের মত তিনিও সরে আসেন সেই আন্দোলন থেকে।
লিখেছেন একুশটি উপন্যাস, ষাটের অধিক গল্প, অসংখ্য নিবন্ধ। যুক্ত ছিলেন দৈনিক আজকালের সাথে, দৈনিকটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে। বাংলা সাহিত্যের 'আভাঁ-গার্দ' লেখকদের মাঝে অন্যতম তিনি।
রচনা কর্ম :
উপন্যাস | প্রকাশকাল |
---|---|
একক প্রদর্শনী | ১৯৭১ |
এখন আমার কোনো অসুখ নেই | ১৯৭৭ |
আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি | ১৯৮৫ |
জঙ্গলের দিনরাত্রি | ১৯৮৮ |
হিরোসিমা মাই লাভ | ১৯৮৯ |
অস্তিত্ব , অতিথি তুমি | ১৯৯০ |
কুকুর সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমি জানি | ১৯৯১ |
কলেরার দিনগুলিতে প্রেম | ১৯৯২ |
রিক্তের যাত্রায় জাগো | ১৯৯৩ |
রুবি কখন আসবে | ১৯৯৩ |
এখন জীবন অনেক সতেজ স্বাস্থ্যে ভরা | ১৯৯৪ |
এসো , নীপবনে | ১৯৯৫ |
কলকাতার দিনরাত্রি | ১৯৯৬ |
কলকাতা , তুমি কার | ১৯৯৭ |
কোলাজ | ১৯৯৮ |
ভারতবর্ষ | ১৯৯৯ |
আমি ও বনবিহারী | ২০০০ |
যখন সবাই ছিল গর্ভবতী | ২০০১ |
ডাবল বেডে একা | ২০০১ |
স্বর্গের নির্জন উপকূলে | ২০০৩ |
নিষিদ্ধ স্বপ্নের ডায়েরী | ২০০৩ |
ধ্বংস্বের মধ্য দিয়ে যাত্রা | ২০০৪ |
ছোটগল্প সংকলন
ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী
সমবেত প্রতিদ্বন্দ্ধী ও অন্যান্য
হ্যাঁ প্রিয়তমা
এক যে ছিল দেয়াল
সোনালী ডানার ঈগল
পুরস্কার
- ১৯৯৫ - বঙ্কিম পুরস্কার
- ২০০২ - সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (আমি ও বনবিহারী বইখানির জন্য)
শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। কালীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় । বাংলা চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের খ্যাতনামা অভিনেতা।পরিচিতিকলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন তিনি। পিতা মনীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী। প্রথমে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সিনেমা জগতে তিনি কালী ব্যানার্জী নামে সমধিক পরিচিত। dt -২০.১১.২০২৪. Vol -১০৫৬. Wednesday। The blogger post in literary e magazine.
কালীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ( ২০ নভেম্বর, ১৯২০ — ৫ জুলাই, ১৯৯৩ ) বাংলা চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের খ্যাতনামা অভিনেতা। কলকাতার কালীঘাট অঞ্...
-
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মজয়ন্তীতে দৈনিক শব্দের মেঠোপথ পত্রিকার উদ্যোগে পরিবারের সঙ্গে ৮ম মাসিক সাহিত্য বিকেলের আড্ডা ও বর্ণ...
-
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৮ সালে বাংলাদেশের সিলেটে। তুলনামূলক সাহিত্য, ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব, ললিতকলার ইতিহাস নিয়ে তিনি পড়াশোন...
-
‘ কী গাব আমি কী শোনাব" গানটির সুর এখনো কানে ভেসে আসে , শিল্পী বেঁচে নেই কিন্তু তার সৃষ্টি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অলিতে গলিতে এখনো সুরেলা ...