Sunday, 31 October 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কবি জন কীটস । ৩১.১০.২১. Vol -542. The blogger in literature e-magazine


Beauty is truth, truth beauty,-that is all
Ye know on earth, and all ye need to know.”

‘চিরসুন্দরের কবি’। জন কীটস, রোমান্টিক যুগের সুবিখ্যাত কবিদের একজন। সৌন্দর্য, তারুণ্য আর একই সাথে দণ্ডিতের প্রতীক জন কীটস। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে শুরু হওয়া ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক ধারায় যে ক’জন কবি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে অনন্য একজন জন কীটস। ইংরেজি সাহিত্যের এক নতুন যুগের সূচনালগ্নে তার জন্ম। মাত্র ২৫ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেও তার অনন্যসাধারণ কল্পনাশক্তি, মনন ও সৌন্দর্যের প্রতি তীব্র আকর্ষণ দিয়ে এই সংক্ষিপ্ত জীবনকালকেই তিনি চিরস্মরণীয় করে গেছেন। আসুন, এই ক্ষণজন্মা কবির ঘটনাবহুল জীবন সম্পর্কে কিছু জানি।
কীটসের জন্ম লন্ডনে, ১৭৯৫ সালের ৩১ অক্টোবর। পিতা টমাস কীটস ছিলেন ভাড়াটে ঘোড়ার আস্তাবলের কর্মচারী, পরে সেই আস্তাবলের মালিকের কন্যা ফ্রান্সিস জেনিংসকে বিয়ে করে সেই ব্যবসার মালিক হয়ে যান। কীটস’রা ছিলেন চার ভাই, এক বোন। তার এক ভাই ছোট বেলাতেই মারা যায়। কীটসের বাবার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিলো না। তিনি এনফিল্ডের একটি নামকরা স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করান। সেখানে প্রধান শিক্ষকের ছেলে চার্লস ক্লার্কের সাথে কীটসের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। ক্লার্ক ছিলেন একজন পন্ডিত ব্যক্তি ও সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি কীটসকে কল্পনা ও কাব্যের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ছোটবেলায় কীটসের অবশ্য পড়াশুনায় মন ছিলো না। তিনি ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির আর মারকুটে স্বভাবের। তবে স্কুলে এসে ক্লার্কের সান্নিধ্যে তিনি এলিজাবেথিয়ান কবি স্পেন্সার ও শেক্সপিয়ারের কাব্য ও নাটকের সাথে পরিচয় লাভ করেন। চ্যাপম্যান অনুদিত হোমারের ইলিয়াড-এর সঙ্গেও তার পরিচয় ঘটে। এডমন্ড স্পেন্সার-এর ‘দ্যা ফেইরী কুইন’ পড়ে প্রথম তার মনে কাব্যসৃষ্টির অনুপ্রেরণা জাগে।

১৮০৪ সালের এপ্রিলে, কীটস আর তার ছোটভাই জর্জকে স্কুলে রেখে ফেরার পথে তাদের বাবা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মাথার খুলিতে আঘাত পান। এই আঘাতই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কীটসের বয়স তখন মাত্র ৮ বছর। এর দু’মাস পর তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু এ বিয়ে সুখের না হওয়ায় তিনি ফিরে আসেন ও চার সন্তানকে নিয়ে মায়ের বাড়িতে চলে যান। ১৮১০ সালের মার্চে কীটসের মা যক্ষ্ণা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন কীটসের বয়স ১৪। রোগশয্যায় কীটসের সেবা ছিলো তুলনাহীন। এভাবেই ক্রমে নিঃসঙ্গ হতে থাকে কীটসের বেড়ে ওঠার দিনগুলো। দিদিমা কীটসকে স্কুল ছাড়িয়ে হ্যামন্ড নামক একজন চিকিৎসকের অধীনে শিক্ষানবিশ নিযুক্ত করেন। কিছুদিন পরেই কীটস ডাক্তার হ্যামন্ডের সাথে ঝগড়া করে শিক্ষানবিশী ছেড়ে দিয়ে লন্ডন ফিরে আসেন। এখানে সেন্ট টমাস হাসপাতালে বেশ কিছুদিন ধরে হাতে-কলমে ডাক্তারি শিখেন। কিন্তু এসব কীটসের জন্যে ছিলো না। তার ভাবুক মন কাব্যের মায়াময় জগতে ছুটেই চলতে থাকে অবিরত। ১৮১৪ সাল থেকে তার কাব্য রচনার শুরু।
১৮১৭ সালে ডাক্তারি ছেড়ে পুরোপুরি কাব্যের জগতে নিমগ্ন হন কবি। এ সময় কবি জন হ্যামিল্টন রেনল্ড, চিত্রশিল্পী সেভার্ণ, সমালোচক হ্যাজলিট, কোলরীজ, ল্যাম্ব, শেলীসহ প্রমুখ গুণী ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন কীটস। খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নিয়ে একটা সুন্দর বন্ধুচক্র গড়ে ওঠে তার। লন্ডনের দিনগুলি তার ভালো কাটছিলো না। ভাই জর্জ আর টমকে নিয়ে কীটস হ্যাম্পস্টেডে চলে আসেন। তার এই নতুন আবাস থেকে কবি লে হান্ট, কোলরীজ ও তার বন্ধুদের অন্যান্যদের বাড়ি কাছাকাছিই ছিলো। এ সময় কীটসের ছোট ভাই টম যক্ষ্ণায় পড়েন। কীটস আর জর্জ দুই ভাই মিলে দিনরাত সেবা করতে থাকেন ছোট ভাইয়ের। এই সংস্পর্শকালীন সময়েই কীটসের ভেতর সংক্রমিত হয় রাজরোগ যক্ষ্ণার বীজ। সেই দিনগুলোতে যক্ষা ছিলো দুরারোগ্য। পরবর্তী শতাব্দীতে এসে যক্ষ্ণার প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়। ১৮১৮ সালের ১ ডিসেম্বর টম কীটস মারা যান।
ভাইয়ের মৃত্যুর পর কীটস তার পুরোনো আবাস ছেড়ে একই এলাকায় বন্ধু চার্লস ব্রাউনের নতুন তৈরি বাড়ি ‘ওয়েন্টওয়ার্থ প্লেস”-এ চলে আসেন। এখানেই কীটস রচনা করেন তার ৫/৬টি বিখ্যাত ‘ওড’ (Ode)। ‘Ode to a Nightingale’, ‘Ode on a Grecian Urn’, ‘Ode on Melancholy’ প্রভৃতি তার সুবিখ্যাত Ode। কীটসের প্রতিভার সম্যক স্ফুরণ ঘটেছে তার Ode-গুলোর মধ্যে। কীটস যদি শুধু Ode-গুলোই রচনা করতেন, তবু ও ইংরেজি সাহিত্যের মর্যাদাসম্পন্ন একজন কবি বলে পরিগণিত হতেন। তার সমস্ত হৃদয়-মন ছিলো সৌন্দর্যের নন্দলোকে আবদ্ধ। তার সকল সৃষ্টিকর্মে তিনি সৌন্দর্য ও মাধুর্যের পূজারী ছিলেন। তবে তার বিশেষত্ব শুধু সৌন্দর্যের বর্ণনায় ছিলো না, ছিলো প্রকৃত সৌন্দর্য খুঁজে বের করার সক্ষমতার মধ্যে। আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ বস্তুগুলোর মধ্যে তিনি পেয়েছেন সৌন্দর্য, বিষণ্নতাকে বলেছেন সৌন্দর্যের পরিপূরক। তার কাছে প্রকৃতির মাঝে লুক্কায়িত এই নিগূঢ় সৌন্দর্যের অস্তিত্ব ছিলো মহান সত্য। আর তাই তিনি বলেছেন, “Beauty is truth, truth beauty”। সৌন্দর্যের মধ্যে একটা সুগভীর শান্তির ভাবও আছে। এই শান্তভাবের মধ্যেও রয়েছে বিষণ্ণতা। এই বিষণ্ণতা এসেছে কবিমনে স্বল্পায়ু জীবনের নশ্বরতার চিন্তা থেকে, মানব নিয়তির নিস্ফলতা বোধ থেকে। তবুও পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে যে সৌন্দর্যের যে রূপ-মাধুরী তিনি সম্ভোগ করেছেন, তাকেই চিরন্তন করে রেখে গেছেন তার Ode-গুলোর মধ্যে দিয়ে।
কীটস অনেকগুলো সনেটও লিখেছেন। সনেটগুলোর মাঝে কবি মনের ছোট ছোট ভাবগুলো মুক্তোর মতো ঝলমল করে উঠেছে। এখানেও রয়েছে সেই আদিম সুকুমার কল্পনার বিস্ময়করতা, নির্জন প্রকৃতির আসঙ্গ লিপ্সার আর্তি, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি আর গ্রীক সৌন্দর্যপ্রিয়তার ছোঁয়া।

১৮১৯ সালে ফ্যানি ব্রাউনির সাথে কীটসের পরিচয় হয়। ফ্যানি তার বিধবা মায়ের সাথে ওয়েন্টওয়ার্থ প্লেসের অপর অংশে এসে ওঠে। ফ্যানির নামের সাথে কীটসের বোন ও মায়ের ডাকনামের মিল ছিলো। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকে। কীটস ফ্যানিকে বই ধার দিতেন। প্রায়ই তারা একসাথে পড়তেনও। শান্তশিষ্ট মেয়েটির মাঝে নিজের নিঃসঙ্গ অংশটির পরিপূর্ণতা খুঁজে পান কবি। অনিবার্যভাবে ফ্যানির প্রেমে পড়ে যান কীটস। নিজের লেখা অসম্পূর্ণ সনেট ‘ব্রাইট স্টার’ তিন ফ্যানিকে দেন। আমৃত্যু কীটস ফ্যানির বাগদত্তা ছিলেন। তাদের বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। ১৮২০ সালেই কীটসের মধ্যে যক্ষ্ণার সমূহ লক্ষণ সাংঘাতিকভাবে ফুটে উঠতে থাকে। যক্ষ্ণায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে ফ্যানির সাথে তার শারীরিক স্পর্শের সুযোগও বন্ধ হয়ে যায় তার। তারা কাঁচের জানলার দু’পার থেকে একে অপরের সাথে কথা বলতেন, পত্র আদান-প্রদান করতেন।
ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে কীটসের অবস্থা খারাপ হতে থাকলে ডাক্তারের পরামর্শে তিনি ইটালীতে বন্ধু জোসেফ সেভার্ণের কাছে চলে যান। সেখানে রোমে একটি বাসা নেন তিনি। কিন্তু হাওয়া বদল করেও তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। ঘন ঘন রক্তবমি হতে থাকে। একদিন রক্তবমি করার পরে তিনি বলেন, “এই রক্ত আমি চিনি, এ উঠে এসেছে সোজা আমার ধমনী থেকে। এই রঙ আমাকে ধোঁকা দিতে পারে না।” বেঁচে থাকাটা তার জন্য একসময় দুঃসহ হয়ে ওঠে। একটা সময় বারবার তিনি বলতে থাকেন, “আমার এই মৃত অস্তিত্ব আর কতদিন চলবে?”
১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক জীবনকাল সমান নিঃসঙ্গতার দিনপঞ্জী, অপূর্ণ প্রেমকে পূর্ণ করার আমৃত্যু বাসনা আর এক মাত্রাহীন শারীরিক কষ্ট নিয়ে চিরসুন্দরের এই কবি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রোমের প্রোটেস্ট্যান্ট সিমেট্রিতে কবিকে দাফন করা হয়। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তার সমাধি ফলকে কোনো নাম বা তারিখ লিখা হয়নি। শুধু লিখা হয়েছে, “এখানে এমন একজন শায়িত, যার নাম লিখা হয়েছিলো জলের ধারায়।” নিজের ক্ষণস্থায়ী জীবনকে এভাবেই বর্ণনা করে গেছেন কীটস।
কীটস ছিলেন রোমান্টিক যুগের সর্বকনিষ্ঠ কবি। তার সমসাময়িকরা সকলে শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক বেশি উচ্চে ছিলেন। কীটস স্কুলের গন্ডীটাও ঠিকমতো পার হতে পারেন নি। কিন্তু যা পড়তেন, যার সংস্পর্শে আসতেন, তাকে আত্মসাৎ করে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা ছিলো তার। আর তাই স্পেন্সার, চ্যাপম্যান, মিল্টন, শেক্সপিয়ার, লে-হান্ট কারও প্রভাব থেকেই তিনি মুক্ত নন। মাত্র ৬ বছরের কাব্যজীবনে যে ফসল তিনি ঘরে তুলেছেন তা মোটেও নগন্য নয়। সমসাময়িক সকলের থেকে গৃহীত বৈচিত্র্যময় সব উপাদান নিয়ে গঠিত এক অপূর্ব রূপমূর্তি ছিলো তার সৃষ্টির।
১৮২০-এর ফেব্রুয়ারিতে ফ্যানিকে কীটস লিখেছিলেন, “আমি এমন কোনো মহান কর্ম পেছনে ফেলে যাচ্ছিনা যা আমার বন্ধুদের গর্বিত করবে, আমি শুধু প্রতিটি জিনিসের ভেতরের সৌন্দর্য্যের উৎসকে ভালোবেসেছি। সময় পেলে নিজেকে স্মরণীয় করে যেতাম।” সত্য, সৌন্দর্য আর প্রেমের পিয়াসী এই কবি তার পরেও স্মরণীয় হয়ে আছেন তার অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম দিয়ে, মানুষের মাঝে সৌন্দর্যতত্ত্বের বীজ বুনে দিয়ে। এক বসন্ত যায়, আরেক বসন্ত আসে। বাসন্তী হাওয়ায় ভেসে বসন্তের দূতের মতো চিরকাল কাব্যপ্রেমীদের হৃদয় ছুঁয়ে যান জন কীটস। চিরবসন্তের দুনিয়ায় চিরসুখী থাকুন চিরসুন্দরের কবি।
========{{{{{{{{{[[[[[$$$$$$$}}}}}})}}}}}}}==

Saturday, 30 October 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। ৩০.১০.২১. Vol -541. The blogger in literature e-magazine

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত 

১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতা শহরের হাতিবাগানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মায়ের নাম ইন্দুমতি বসুমল্লিক। সুধীন দত্তের বাল্যকাল কেটেছে কাশীতে। ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত কাশীর থিয়সফিক্যাল হাই স্কুলে অধ্যয়ন করেন। পরে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯২২ সালে স্নাতক হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য ও আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত যথারীতি পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও কোনো বিষয়েই পরীক্ষা দেন নি।

১৯২৪ সালে ছবি বসুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, কিন্তু এক বছরের ভিতরেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ১৯৪৩ সালের ২৯ মে প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রাজেশ্বরী বসুর সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬০ সালের ২৫ জুন কবি নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোকগমন করেন।
সুধীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ ছয়টি :

তন্বী (১৯৩০)
অর্কেষ্ট্রা (১৯৩৫)
ক্রন্দসী (১৯৩৭)
উত্তর ফাল্গুনী (১৯৪০)
সংবর্ত (১৯৫৩)
দশমী (১৯৫৬)
এছাড়াও তার দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ আছে :

স্বগত (১৯৩৮)
কুলায় ও কালপুরুষ (১৯৫৭)
অনুবাদগ্রন্থ : প্রতিধ্বনি (১৯৫৪)


বিশ শতকে বুদ্ধির দীপ্তি কিংবা প্রতিভার বিশেষ আবেশে বাংলা সাহিত্যকে যাঁরা অগ্রসরতার পথে পরিচালিত করতে সহায়তা করেছেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (৩০ অক্টোবর ১৯০১-- ২৫ জুন ১৯৬০) তাঁদের মধ্যে অবশ্য-বিবেচ্য ব্যক্তিত্ব।বাংলা কবিতায় “ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক” হিসেবে খ্যাত সুধীন্দ্রনাথ।, “ক্লাসিকাল” অর্থে “ধ্রুপদী” শব্দটি তাঁরই উদ্ভাবনা। নানান বিদ্যায় বিদ্বান এবং বহুভাষাবিদ এ কবি মনস্বী তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন।

এবং তথ্য ও তত্ত্বে আসক্ত মানুষ হিসেবে তিনি সমকালে ও উত্তরকালে প্রশংসিত হয়েছেন।
 
গার্হস্থ্য ধর্মপালনে, সামাজিক আচারে কিংবা পঠন ও আলাপনে তাঁর আগ্রহ ও সংশ্লিষ্টতা ছিল একরকম ঈর্ষণীয়।

ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠার মোহ সুধীনকে কখনো আঁকড়ে ধরেনি; পিতার উত্তরসূরি এই দেশহিতৈষী সমাজ সেবায়ও একসময় আগ্রহ হারিয়েছেন সমাজ ও সমকালের অধোগতির ফলে। আর শেষত স্থিত হয়েছেন সর্বজনের প্রতি প্রসারিত কিন্তু একান্ত ব্যক্তিগত সাহিত্যচর্চার উদার জমিনে।

তাঁর সমকালের কবি ও বন্ধু বুদ্ধদেব বসু সুধীনকে বলেছেন-- “স্বভাবকবি নন, স্বাভাবিক কবি”।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কৈশোরে কিংবা যৌবনের প্রথমপাদে ছোটগল্প এবং উপন্যাসের খসড়া তৈরি করলেও শেষপর্যন্ত কবিই হলেন। ভ্রমণ-বৃত্তান্ত, পুস্তক-সমালোচনা, অনুবাদ, প্রবন্ধ এবং বিবিধ গদ্যও লিখেছেন তিনি তাঁর প্রতিদিনকার কার্যলিপিতে। “পরিচয়” (১৯৩১--১৯৩৬) নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন।

তন্বী (প্রথম প্রকাশ: ১৯৩০) তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০-- এই দশ বছর সুধীনের অধিকাংশ রচনার জন্মকাল। পরে জীবনের ক্রান্তিকাল আর অভিজ্ঞতাও তাঁর লেখালেখির সরল উপাদান হয়েছে। আবেগ আর পরিশ্রমের দারুণ ফসল তাঁর কবিতা। সুধীনের সাহিত্যসাধনার মূল ভিত্তি ছিল আত্মোপলব্ধি। তাই কবিতার স্বপ্নবাড়িতে তিনি প্রবেশ করেছিলেন প্রবল প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় মাল-সামানা ও রশদ সাথে নিয়ে। নিজেকে ক্রমাগত অতিক্রমের এক অনিমেষ প্রেরণাকে চেতনায় ধারণ করে তিনি সামাজিক দুঃশাসন এবং সামাজিকের অবোধ্যতা-নির্বোধতাকে সরলপাঠে ও সাহসের সমাচারে তুলে ধরেছেন।

নিজের কবিতাযাত্রা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন-- “আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি”। অনুভবজ্ঞানের এই আত্মপ্রচার আমাদেরকে বিস্মিত ও শ্রদ্ধানত করে।

সুধীন্দ্রনাথের লেখা ১৯০টি কবিতার পরিসরকে বিবেচনায় রেখে এবং আমার কবিতা-বিশ্লেষণের অযোগ্যতাকে স্বীকার করে, বর্তমান পাঠ ও পর্যালোচনাটি দুটি কবিতাÑ “উটপাখি” এবং “দুঃসময়” কে ঘিরে আবর্তিত হবে এবং শেষত তা আপাত সমাপ্তির পথে, সুধীনের চিন্তা ও নির্দেশনাকে মনে রেখে, সতর্ক পা বাড়াবে।

“উটপাখি” (১৯৩৭ সালে প্রকাশিত ক্রন্দসী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত) কবিতাটি আত্মবিবরণ, আত্মপ্রতিফলন আর সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতে মানব জীবনে বাস্তবতা-কল্পনায় অবগাহনের ভাবনামিশ্রিত এবং বিচিত্র চিন্তা-জাগানিয়া বিবরণের বর্ণে মাখা। অভিভাবকীয় সুরে কবি এখানে নির্মাণ করেছেন কবিতার কথামালা; প্রাজ্ঞ এক সমাজ-বিশ্লেষক যেন বলছেন তাঁর দেখে-আসা সকল অনুভব, অভিজ্ঞতা আর পরামর্শের ব্যাপারাদি।

কবিতাটির আরম্ভ হচ্ছে এভাবে:

আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি?
কেন মুখ গুঁজে আছ তবে মিছে ছলে?
কোথায় লুকাবে? ধূ ধূ করে মরুভূমি;
ক্ষ’য়ে ক্ষ’য়ে ছায়া ম’রে গেছে পদতলে।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই;
নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ।

ফেলে-আসা সময়ের ও চিন্তার গতি-প্রকৃতির স্মৃতি-রোমন্থনে কবি মাঝে মাঝে নিবিড় হয়ে ওঠেন। মধ্যে মধ্যে হয়তো কোনো প্রিয়মুখের অনুপস্থিতিও তাঁকে বিষণ্ন করে তোলে। তাঁর অনুভব: “নিষাদের মন মায়ামৃগে মজে নেই;/ তুমি বিনা তার সমূহ সর্বনাশ। / কোথায় পালাবে? ছুটবে বা আর কত?/ উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা। / প্রাক্পুরাণিক বাল্যবন্ধু যত/ বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা। /”

নিঃসঙ্গতা, অপারগতা আর সময়ের অপার শূন্যতায় মানুষের নির্মম পরিণতির কথা ভাবতে গিয়ে তিনি যেন অন্তসারশূন্য সমাজের ছবি দেখেছেন নিজের চোখে ও অনুভবে।

মরুভূমিতে পানি ঢেলে সবজি চাষের চেষ্টা বৃথা, যেমন ক্ষুধার বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলার বোকামি সত্য। ইচ্ছা নামক ঘুড়িকে উড়তে দেওয়ার মধ্যে আছে স্বাধীনতা; সে স্বাধীনতা চিন্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার। বিপদ মোকাবিলা করার জন্য যে জাগতিক জ্ঞান দরকার তা বোধকরি সকলে আয়ত্ব করতে পারে না-- বিশেষত প্রতিভার প্রশস্ত বারান্দায় যারা ঠায় দাঁড়িয়ে মেধাবৃত্তির অমোঘ বাতাসে চুল ওড়াতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, তারা তো ওই নিরেট সত্যের পাটাতন থেকে নিশ্চিত দূরত্বে আপন অবস্থান নির্মাণ করেন হয়তো বা নিজেরই অজান্তে; কোনো অলৌকিক আবেশের অপরিহার্য প্রবল টানে। কবি কি সংসার-বিবাগি মরুচারি সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন? কে জানে সে কথা! তবে তিনি জাগতিক কৃত্রিম জীবন-ব্যবস্থার চেয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং স্বাভাবিক ও প্রতিযোগিতাহীন জীবনকেই হয়তো আরাধ্য জেনেছেন। নতুনের পথে; এবং তা অবশ্যই কৃত্রিমতাবিহীন-- তাঁর মানসিক পরিভ্রমণ এই কবিতায় একটা নিটোল ছবি হয়ে ধরা পড়ে পাঠকের সোজা চোখে।

ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া।
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনও বিপদ্প্রাজ্ঞ নও।
নব সংসার পাতি গে আবার চলো
যে-কোনও নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে।
মিলবে সেখানে অন্তত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে॥

আমরা যদি নিবিড়চোখে তাকাই দেখবো--- সমকালের যাপিত জীবন ও পৃথিবীর চালচিত্রের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে লিপ্ত হয়ে আছে সুধীন্দ্রনাথের কবিতার শরীর--  রক্ত ও মাংসসমেত সমূহ প্রবণতা ও প্রস্রবন। মানবিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক সম্প্রীতির ব্যাপারে তাঁর ভাবনার অতলতাকে আমরা স্পর্শ করি তাঁরই নির্মিত কবিতা-কথনের ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করার সময়। আর সামাজিক এবং ব্যক্তিগত দায় ও দায়িত্বের বিষয়েও যে তিনি প্রবল সচেতন, তাও আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রসঙ্গত “উটপাখি” কবিতার শেষাংশের পাঠ নেওয়া যেতে পারে:

আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দু-জনে সমান অংশীদার;
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি।
ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক’রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি:
তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে, বন্ধু, আমি লোকায়তে বাঁধি ॥

ঈশ্বরে বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস থাক-বা-না-থাক আমরা কিন্তু বিপদে পড়লে কিংবা প্রবল হতাশা ও ক্লান্তির মধ্যে অবগাহনের কালে একজন বা একাধিক বিধাতার কাছে অবনত মস্তকে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় মগ্ন হই। বিধাতাকে অস্বীকার হয়তো করেননি কবি সুধীন; তবে তাঁর নানান কবিতায় বিধাতার উপস্থিতি বিষয়ে সংশয়ের কথা আমরা জানি। আবার আরাধ্য মানুষের জন্য আকুতি প্রকাশের সময় এই কবিকে বিধাতার কাছে দ্বারস্থ হতে দেখি। কবি ও দার্শনিক সুধীন জানতেন--- পৃথিবীতে ভগবান যদি না থাকেন, প্রেম ও ক্ষমা যদি মিথ্যা হয়, তাহলেও মানুষ তার অমর বাসনার উচ্চারণ করেই ভুবনকে তাৎপর্য দান করতে পারে; আর এভাবেই অনুভবের পীড়িত-অবস্থা থেকে মুক্তির পথে প্রবেশ করে সচেতন ও প্রজ্ঞাবান মানুষ।

কবিতাটির পাঠ-বিবরণের মধ্যপর্যায়ে জীবন-মৃত্যুর আস্বাদ, বর্তমান-ভবিষ্যতের ফারাক আর ইচ্ছা ও সাধ্যের ব্যাপারাদি কবির কাছে, পাঠকের কাছেও নিশ্চয়, খুব মূল্যবান বস্তু হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি বর্তমানের সত্য ও অসহায়তাকে মেনে নিয়ে কেবল ভবিষ্যতের অনাগত অন্ধকার বা আলোর দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতেও যেন প্রস্তুত!

অসুন জেনে নিই তাঁর সেই প্রস্তুতির সারকথা: “তবুও ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে,/ কায়-মনে তোমারেই চাই। / জানি স্বর্গ মিথ্যা কথা, তথাপি অলীক বিধাতারে/ রাত্রি-দিন মিনতি জানাই। / উন্মথি হৃদয়সিন্ধু সৃজনের প্রথম প্রভাতে/ অভুঞ্জিত সুধাভা- অর্পিলাম মোহিনীর হাতে;/ মৃত্যুর মাধুরী কিন্তু বাকি আছে, এসো আজ তাতে/ আমাদের অমরা সাজাই। / অসাধ্যসিদ্ধির যুগ ফিরিবে না, জানি, এ-সংসারে;/ তবু রুদ্র ভবিষ্যতে চাই ॥”

ভগবানের অভাব সুধীন কবিতা দিয়ে মেটাতে চাননি; জনগণ কিংবা ইতিহাসের খেরোপাতা অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েও নয়-- তাঁর তৃষ্ণা ছিল সনাতনতার ভেতর থেকে অমৃতকে উদ্ধার করার বাসনায়। মিথ্যা দেবতাকে তিনি চিন্তা ও চেতনায় ধারণ করেননি; তবে কল্পনায় স্বর্গের অনুভবও নিতে চেয়েছেন। মর্তভূমির পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেবের দিকে সুধীনের প্রবল আকুতি মাঝে মধ্যে আমাদেরকে তাঁর ঈশ্বরভাবনা বিষয়ে ভাবিয়ে তোলে। নিয়তিকে কি নির্মাণ অথবা পুনর্নিমাণ কিংবা বিনির্মাণ করা যায়? অনেকে তো বলেন শুনি-- নিজের হাতে নাকি ভাগ্যের চাকা ঘুরানো সম্ভব। কী জানি, কী সত্য এই পৃথিবীতে! তবু ভাগ্য মেনে কেউ করেন কাজ; আবার ভাগ্যকে নিজের কব্ন্ত্তা

মরুভূমিতে পানি ঢেলে সবজি চাষের চেষ্টা বৃথা, যেমন ক্ষুধার বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলার বোকামি সত্য। ইচ্ছা নামক ঘুড়িকে উড়তে দেওয়ার মধ্যে আছে স্বাধীনতা; সে স্বাধীনতা চিন্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার। বিপদ মোকাবিলা করার জন্য যে জাগতিক জ্ঞান দরকার তা বোধকরি সকলে আয়ত্ব করতে পারে না-- বিশেষত প্রতিভার প্রশস্ত বারান্দায় যারা ঠায় দাঁড়িয়ে মেধাবৃত্তির অমোঘ বাতাসে চুল ওড়াতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, তারা তো ওই নিরেট সত্যের পাটাতন থেকে নিশ্চিত দূরত্বে আপন অবস্থান নির্মাণ করেন হয়তো বা নিজেরই অজান্তে; কোনো অলৌকিক আবেশের অপরিহার্য প্রবল টানে। কবি কি সংসার-বিবাগি মরুচারি সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন? কে জানে সে কথা! তবে তিনি জাগতিক কৃত্রিম জীবন-ব্যবস্থার চেয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং স্বাভাবিক ও প্রতিযোগিতাহীন জীবনকেই হয়তো আরাধ্য জেনেছেন। নতুনের পথে; এবং তা অবশ্যই কৃত্রিমতাবিহীন-- তাঁর মানসিক পরিভ্রমণ এই কবিতায় একটা নিটোল ছবি হয়ে ধরা পড়ে পাঠকের সোজা চোখে।

ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া।
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনও বিপদ্প্রাজ্ঞ নও।
নব সংসার পাতি গে আবার চলো
যে-কোনও নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে।
মিলবে সেখানে অন্তত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে॥



আমরা যদি নিবিড়চোখে তাকাই দেখবো--- সমকালের যাপিত জীবন ও পৃথিবীর চালচিত্রের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে লিপ্ত হয়ে আছে সুধীন্দ্রনাথের কবিতার শরীর-- রক্ত ও মাংসসমেত সমূহ প্রবণতা ও প্রস্রবন। মানবিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক সম্প্রীতির ব্যাপারে তাঁর ভাবনার অতলতাকে আমরা স্পর্শ করি তাঁরই নির্মিত কবিতা-কথনের ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করার সময়। আর সামাজিক এবং ব্যক্তিগত দায় ও দায়িত্বের বিষয়েও যে তিনি প্রবল সচেতন, তাও আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রসঙ্গত “উটপাখি” কবিতার শেষাংশের পাঠ নেওয়া যেতে পারে:

আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দু-জনে সমান অংশীদার;
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি।
ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক’রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি:
তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে, বন্ধু, আমি লোকায়তে বাঁধি ॥



ঈশ্বরে বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস থাক-বা-না-থাক আমরা কিন্তু বিপদে পড়লে কিংবা প্রবল হতাশা ও ক্লান্তির মধ্যে অবগাহনের কালে একজন বা একাধিক বিধাতার কাছে অবনত মস্তকে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় মগ্ন হই। বিধাতাকে অস্বীকার হয়তো করেননি কবি সুধীন; তবে তাঁর নানান কবিতায় বিধাতার উপস্থিতি বিষয়ে সংশয়ের কথা আমরা জানি। আবার আরাধ্য মানুষের জন্য আকুতি প্রকাশের সময় এই কবিকে বিধাতার কাছে দ্বারস্থ হতে দেখি। কবি ও দার্শনিক সুধীন জানতেন--- পৃথিবীতে ভগবান যদি না থাকেন, প্রেম ও ক্ষমা যদি মিথ্যা হয়, তাহলেও মানুষ তার অমর বাসনার উচ্চারণ করেই ভুবনকে তাৎপর্য দান করতে পারে; আর এভাবেই অনুভবের পীড়িত-অবস্থা থেকে মুক্তির পথে প্রবেশ করে সচেতন ও প্রজ্ঞাবান মানুষ।

কবিতাটির পাঠ-বিবরণের মধ্যপর্যায়ে জীবন-মৃত্যুর আস্বাদ, বর্তমান-ভবিষ্যতের ফারাক আর ইচ্ছা ও সাধ্যের ব্যাপারাদি কবির কাছে, পাঠকের কাছেও নিশ্চয়, খুব মূল্যবান বস্তু হয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি বর্তমানের সত্য ও অসহায়তাকে মেনে নিয়ে কেবল ভবিষ্যতের অনাগত অন্ধকার বা আলোর দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতেও যেন প্রস্তুত!

অসুন জেনে নিই তাঁর সেই প্রস্তুতির সারকথা: “তবুও ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে,/ কায়-মনে তোমারেই চাই। / জানি স্বর্গ মিথ্যা কথা, তথাপি অলীক বিধাতারে/ রাত্রি-দিন মিনতি জানাই। / উন্মথি হৃদয়সিন্ধু সৃজনের প্রথম প্রভাতে/ অভুঞ্জিত সুধাভা- অর্পিলাম মোহিনীর হাতে;/ মৃত্যুর মাধুরী কিন্তু বাকি আছে, এসো আজ তাতে/ আমাদের অমরা সাজাই। / অসাধ্যসিদ্ধির যুগ ফিরিবে না, জানি, এ-সংসারে;/ তবু রুদ্র ভবিষ্যতে চাই ॥”

ভগবানের অভাব সুধীন কবিতা দিয়ে মেটাতে চাননি; জনগণ কিংবা ইতিহাসের খেরোপাতা অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েও নয়-- তাঁর তৃষ্ণা ছিল সনাতনতার ভেতর থেকে অমৃতকে উদ্ধার করার বাসনায়। মিথ্যা দেবতাকে তিনি চিন্তা ও চেতনায় ধারণ করেননি; তবে কল্পনায় স্বর্গের অনুভবও নিতে চেয়েছেন। মর্তভূমির পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেবের দিকে সুধীনের প্রবল আকুতি মাঝে মধ্যে আমাদেরকে তাঁর ঈশ্বরভাবনা বিষয়ে ভাবিয়ে তোলে। নিয়তিকে কি নির্মাণ অথবা পুনর্নিমাণ কিংবা বিনির্মাণ করা যায়? অনেকে তো বলেন শুনি-- নিজের হাতে নাকি ভাগ্যের চাকা ঘুরানো সম্ভব। কী জানি, কী সত্য এই পৃথিবীতে! তবু ভাগ্য মেনে কেউ করেন কাজ; আবার ভাগ্যকে নিজের কব্জায় নেবার জন্য কতজনকে যে কত কসরত করতে হয় তারও কোনো ইয়ত্তা পাওয়া যায় না।

সুধীন্দ্রনাথ কি ভাগ্যের নবায়ন বা নতুন রূপায়নের পক্ষে? এই প্রশ্নের চূড়ান্ত ফয়সালা মেলা ভার। তবে কি তাঁর কবিতায় আশাবাদের সুতো ধরে পানির স্বচ্ছ ধারার মতো নিচে নেমে এসেছে কপালের লিখনের জন্য দোয়াতে সাজিয়ে রাখা লাল বা সোনালি রঙের কালি! নাকি এসব সবই স্বপ্ন ও কল্পনার মিথ্যামিথ্যা খেলার জাল মাত্র! কী পাঠ পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়? অনুসন্ধান করে দেখা যাক :

আঁধার ঘনায় চোখে, তুমি ছাড়া কেউ নেই পাশে,

অন্তরীক্ষে জমে বিভীষিকা।
লুব্ধ ভবিতব্য তারে রুদ্ধ করো দৃপ্ত পরিহাসে,
হাতে হাত রাখো, সাহসিকা।
তোমার মাভৈ শুনে হয়তো বা লজ্জিত নিয়তি
ফিরাবে, অভ্যাস ভুলে, ঐকান্তিক সময়ের গতি,
মৃত্যুর বিক্ষিপ্ত জাল দিবে বুঝি মোরে অব্যাহতি,
শাপমুক্ত হবে অহমিকা;
নবজাত ভগবান বিরচিবে কৃতজ্ঞ উল্লাসে
আমাদের নব নীহারিকা ॥

কবিতার মায়াবিনী মমতার পরশ ও সাহচর্য থেকে সুধীন যেন কিছুতেই মুক্তি পাননি। অবশ্য তার চেয়ে বড়ো কথা সে অবস্থা থেকে তিনি মুক্তি চাননি। কারণ তিনি প্রতিনিয়ত কবিতার পাশাপাশি নতুন করে রচনা করেছেন, আবিষ্কার করেছেন নিজেকে। এই পথ ছিল তাঁর আত্ম-অনুসন্ধানের পথ। কবি সুধীনের কাজ বহুমুখি হলেও সাধনা ও ধ্যান ছিল বিশুদ্ধ বাণীমাধুরী। বানান-ব্যাকরণ ও উচ্চারণের ভিন্নতায় তিনি অত্যন্ত সতর্ক শিল্পী। অস্পষ্ট ও অনিচ্ছুক ভাবনা-বেদনাকে ছন্দ ও ভাষার নিগড়ে বাঁধতে এবং চিরাচরিত সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে শিল্পের উদার জমিনের গীতল আহ্বানে সাড়া দেবার প্রত্যক্ষ প্রত্যয়ের বিচারে বাংলা কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শূন্যস্থানপূরণ করা, বোধকরি, খুব সহজ নয়। সৃজনকর্ম এবং ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পর্বে ও বাঁকে এই মানুষটি “কবি” শব্দের সকল সামর্থ্য ও শক্তিকে সফলভাবে ধারণ করতে পেরেছিলেন।

তাঁর কবিতায় দুরূহতা (বিশেষত নতুন ও অপ্রচলিত শব্দের প্রয়োগে) পাঠকের চোখে পড়ে; তবে সে কঠিনতা অল্পআয়াসে অতিক্রম করাও অসম্ভব নয়। আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি বাংলা কবিতাকে সুধীন দান করেছেন শ্রবণসুভগ সংহতি ও আভিজাত্য। সমাজের সত্য পাঠ অনুসন্ধান ও পরিবেশন, কল্পনা ও প্রেমানুভূতির উপস্থাপনাসমেত তিনি পাঠকের কাছে যথাসম্ভব হাজির থেকেছেন অভিজাত শিল্পী ও সামাজিকের দায় কাঁধে নিয়ে!
==============πππππππππππππππππ

Thursday, 28 October 2021

Happy Birthday to Henry Green . 29.10.21. Vol - 540. The blogger in literature e-magazine


Henry Green 

English author best remembered for the novels Party Going, Living and Loving. He published a total of nine novels between 1926 and 1952.


গ্রীন 1926 সালে ডিগ্রী না নিয়েই অক্সফোর্ড ছেড়ে চলে যান , তার পরিবারের কারখানার  মেঝেতে সাধারণ শ্রমিকদের সাথে কাজ করতে শুরু করেন,  বিয়ার-বোতলজাত মেশিন তৈরি  এবং পরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন। এই সময়ে তিনি লিভিং লেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস, যেটিতে  1927 এবং 1928 সালে সময় স্রোতের পরিচয়। 1929 সালে
Hon. Adelaide Biddulph তিনি বিয়ে করেন। অ্যাডিলেড বিডুলফ, 'ডিগ' নামেও পরিচিত। তারা দুজনেই প্রথম ব্যারন লেকনফিল্ডের নাতি-নাতনি। 
তাদের পুত্র সেবাস্টিয়ান 1934 সালে জন্মগ্রহণ করেন। 1940 সালে, গ্রীন প্যাক মাই ব্যাগ প্রকাশ করেন, যাকে তিনি প্রায়-সঠিক আত্মজীবনী হিসেবে গণ্য করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রিন অক্সিলিয়ারি ফায়ার সার্ভিসে ফায়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং এই যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতাগুলি তার ক্যাট উপন্যাসে প্রতিধ্বনিত হয়েছে; এগুলি তার পরবর্তী উপন্যাস, ব্যাক-এও একটি শক্তিশালী প্রভাব ছিল।সবুজের শেষ প্রকাশিত উপন্যাস ছিল ডটিং (1952); 
এটি ছিল তার লেখালেখির কর্মজীবনের সমাপ্তি। 
তার পরবর্তী বছরগুলিতে, 1973 সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধ্যয়নের দিকে ক্রমবর্ধমানভাবে মনোনিবেশ করেন এবং মদ্যপ এবং একান্ত হয়ে পড়েন।
             রাজনৈতিকভাবে, সবুজ তার সারা জীবন একজন ঐতিহ্যবাহী টরি ছিলেন।সবুজের
উপন্যাসগুলি ইংরেজি আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তার সেরা সম্মানিত উপন্যাস হল লিভিং (1929), পার্টি গোয়িং (1939), এবং লাভিং (1945) (এখন প্রায়ই একসাথে প্রকাশিত)।

              বার্মিংহামের কারখানার শ্রমিকদের আন্তঃযুদ্ধের বছরগুলিতে জীবনযাপনের নথিপত্র। মূল প্লটটি লিলি গেটস এবং কারখানার একজন কর্মী বার্ট জোন্সের সাথে তার মেলামেশা নিয়ে। 
তারা বিদেশ ভ্রমণ করে ব্রিটিশ শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্ব থেকে পালানোর সুযোগ খোঁজে। 
লিলির কাজ করার ইচ্ছা তাদের পালানোর চেষ্টার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ক্রেইগান যে তার বাবার সবচেয়ে ভালো বন্ধু এবং যার সাথে সে বাস করে তাকে 'গ্রান্ডাড' বলে ডাকে এই উদ্যোগে সে ক্রমাগত বাধাগ্রস্ত হয়। আরেকটি প্লটলাইন কারখানার মালিকের ছেলে 'ডিক' ডুপ্রেটকে নিয়ে। 
তার বাবা মারা যায়, ব্যবসা তার ছেলের হাতে ছেড়ে দেয়। কারখানার ফোরম্যান ডুপ্রেট এবং মিস্টার ব্রিজের মধ্যে অনেক বিরোধ রয়েছে। 
মিস্টার ব্রিজস তার চাকরির জন্য ভয় পান কারণ ডুপ্রেট কারখানা এবং এর শ্রমিকদের সংস্কার করতে চায়। বার্মিংহাম উচ্চারণ প্রতিফলিত করার জন্য নির্দিষ্ট নিবন্ধের ইচ্ছাকৃত অভাবের জন্য উপন্যাসের ভাষা উল্লেখযোগ্য। উপরন্তু, খুব কম নিবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে: "এই কারখানায় আবার লেদ কাজ করার শব্দ শুরু হয়েছে। শত শত বাইরের রাস্তা ধরে চলে গেছে, পুরুষ এবং গির।কেউ কেউ ডুপ্রেট ফ্যাক্টরিতে পরিণত হয়৷ গ্রিন পরে এই কৌশলটি ব্যবহার করার জন্য তার কারণগুলি ব্যাখ্যা করেছিলেন: "আমি এই বইটিকে যতটা সম্ভব টানটান এবং অতিরিক্ত বানাতে চেয়েছিলাম, আমি যে সর্বহারা জীবন পরিচালনা করছিলাম তার জন্য উপযুক্ত। তাই আমি নিবন্ধগুলি ছেড়ে দিয়েছি।"

           পার্টি গোয়িং একদল ধনী লোকের গল্প বলে যা একটি বাড়ির পার্টিতে ট্রেনে ভ্রমণ করে। 
তবে কুয়াশার কারণে ট্রেন আসতে অনেক দেরি হয় এবং দলটি পাশের বড় রেলওয়ে হোটেলে রুম নেয়। গল্পের সব অ্যাকশন হোটেলেই হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি আইরিশ দেশের বাড়ির সিঁড়ির উপরে এবং নীচের জীবনকে প্রেমের বর্ণনা দেয়। তাদের নিয়োগকর্তাদের অনুপস্থিতিতে টেন্যান্ট, চাকররা ইউরোপে যুদ্ধের গুজবের মধ্যে তাদের নিজস্ব যুদ্ধ এবং সংঘাত তৈরি করে। 1958 সালে দ্য প্যারিস রিভিউ-এ প্রকাশিত একটি সাক্ষাত্কারে টেরি সাউদার্ন সবুজকে প্রেমের জন্য তার অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। গ্রিন উত্তর দিয়েছিল, "আমি যুদ্ধের সময় ফায়ার সার্ভিসের একজন চাকরের কাছ থেকে প্রেমের ধারণা পেয়েছিলাম। সে আমার সাথে র‌্যাঙ্কে কাজ করত, এবং সে আমাকে বলেছিল যে সে একবার বৃদ্ধ বাটলারকে জিজ্ঞেস করেছিল যে তার উপরে থাকা বৃদ্ধ ছেলেটি সবচেয়ে বেশি কী? পৃথিবীতে ভালো লেগেছে। উত্তর ছিল: 'গ্রীষ্মের সকালে বিছানায় শুয়ে, জানালা খোলা রেখে, চার্চের ঘণ্টা শুনছি, কান্টি আঙুল দিয়ে বাটারড টোস্ট খাচ্ছি।' আমি এক ঝলকায় বইটি দেখেছি।"ব্যাক (1946) চার্লি সামারসের গল্প বলে, একজন যুবক ইংরেজ যিনি জার্মানি থেকে ফিরে আসেন, যেখানে তিনি ফ্রান্সে যুদ্ধে আহত হওয়ার পর তিন বছর ধরে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক ছিলেন। তার আঘাতের কারণে চার্লির পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। তিনি যখন বন্দী ছিলেন, রোজ, যে মহিলাকে তিনি
ভালোবাসতেন, মারা যান; তদুপরি, রোজ অন্য একজনের সাথে বিয়ে করেছিলেন, তাই চার্লি এমনকি কেলেঙ্কারির ভয়ে তার শোক প্রকাশ করতে পারে না। চার্লি রোজের বাবা মিঃ গ্রান্টকে ডাকেন, যিনি তাকে একজন তরুণ বিধবার সাথে পরিচিত হতে উৎসাহিত করেন। যখন তিনি তা করেন, তখন তিনি মহিলার মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখে অবাক হন, যার নাম ন্যান্সি হুইটমোর এবং রোজ। তিনি আবিষ্কার করেন যে ন্যান্সি মিঃ গ্রান্টের অবৈধ কন্যা, যিনি চার্লিকে তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য তাকে সান্ত্বনা দিতে পারেন ভেবে পাঠিয়েছিলেন, একজন RAF পাইলট অ্যাকশনে নিহত হন। উপন্যাসের বাকি অংশটি চার্লি এবং ন্যান্সির মধ্যে জটিল এবং ঝামেলাপূর্ণ সম্পর্কের বর্ণনা দেয়, কারণ এটি একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ব্রিটেনের পটভূমির বিরুদ্ধে উন্মোচিত হয়।
লেখাটি কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে সবুজের নিজস্ব মতামত ছিল: "গদ্যটি উচ্চস্বরে পড়া নয়, রাতে একা একা পড়া উচিত, এবং এটি কবিতার মতো দ্রুত নয়, বরং ইঙ্গিতের একটি জমায়েত জাল [...] গদ্য একটি সরাসরি হওয়া উচিত 
অপরিচিতদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা যা উভয়েরই জানা থাকতে পারে তার প্রতি কোন আবেদন নেই। এটি ধীরে ধীরে অপ্রকাশিত ভয়কে আপীল করা উচিত, এটি শেষ পর্যন্ত পাথর থেকে অশ্রু বের করা উচিত।"
         প্যারিস রিভিউ-এ গ্রিন-এর সাথে তার সাক্ষাৎকারের ভূমিকায় টেরি সাউদার্ন লিখেছেন: "একজন লেখকের জন্য একটি প্রাচীন বাণিজ্য প্রশংসা, যার কৌশল অত্যন্ত উন্নত, তাকে 'লেখকের লেখক' বলা হয়েছে; হেনরি গ্রিনকে একজন লেখক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। 
'লেখকের লেখকের লেখক'। তাঁর কোনো বইই 10,000 কপির বেশি বিক্রি হয়নি, যদিও তিনি 1940-এর দশকে ব্যাপকভাবে পঠিত হন, যখন লভিং সংক্ষেপে মার্কিন বেস্ট-সেলার তালিকায় উপস্থিত হয়। তিনি তার জীবদ্দশায় ডব্লিউ এইচ. অডেন, ক্রিস্টোফার ইশারউড, ইউডোরা ওয়েল্টি, অ্যান্টনি বার্গেস, এভলিন ওয়া (যিনি তাকে ভালভাবে চিনতেন) এবং রেবেকা ওয়েস্ট দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিলেন। শেষ নামটি তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, "তিনি সত্যিকারের একজন মৌলিক লেখক ছিলেন, তাঁর গদ্যটি ছিল তাজা মিশ্রিত, তিনি তার রক্তহীন স্কাল্পেলকে মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ের গভীরে নিয়ে গিয়েছিলেন, এর কিছুই আগে বলা হয়নি। তিনি প্রায় ভুলে গেছেন।" ভি.এস. প্রিচেট সবুজকে "তার প্রজন্মের সবচেয়ে প্রতিভাধর গদ্য লেখক" বলে অভিহিত করেছেন। লাইফ দ্বারা প্রকাশিত গ্রীন-এর একটি 1952 প্রোফাইলে, ডব্লিউ এইচ অডেনকে উদ্ধৃত করা হয়েছিল যে হেনরি গ্রিন ছিলেন "জীবিত সেরা ইংরেজ ঔপন্যাসিক"।
তার মৃত্যুর পর গ্রীনের কাজগুলো ছাপার বাইরে চলে যায় এবং খুব কম পঠিত হয়। 

              যাইহোক, 1990 এর দশকের শুরু থেকে তার খ্যাতি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। 1993 সালে সারভাইভিং, তার নাতি ম্যাথিউ ইয়র্ক দ্বারা সম্পাদিত পূর্বে অপ্রকাশিত কাজের একটি সংগ্রহ, ভাইকিং প্রেস দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল। 
অন্যান্য কাজ পুনরায় জারি করা হয়েছে। 
অনেক সমসাময়িক লেখক তাকে একটি প্রভাব হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে জন আপডাইক, লিখেছেন, "তার উপন্যাসগুলি আমার উপর জীবিত বা মৃত যেকোন লেখকের চেয়ে বেশি শৈলীগত প্রভাব ফেলেছে" একটি সংস্করণের ভূমিকায় (পেঙ্গুইন বিংশ শতাব্দী গ্রীনের তিনটি উপন্যাসের ক্লাসিক ইউএসএ, 1993) (লিভিং, লাভিং এবং পার্টি গোয়িং)। ঔপন্যাসিক সেবাস্তিয়ান ফকস, যিনি এই তিনটি উপন্যাসের একটি সংস্করণের (ভিন্টেজ ক্লাসিক ইউকে, 2005) ভূমিকাও লিখেছেন, তিনি সবুজকে "অনন্য" বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন: "কোনও কথাসাহিত্য আমাকে জীবনযাপন এবং প্রেমের সেরা মুহূর্তগুলির মতো রোমাঞ্চিত করেনি"। 

ডেভিড লজ সবুজকে "একজন অসাধারণ প্রতিভাধর এবং সত্যিকারের মৌলিক লেখক" বলে অভিহিত করেছেন। তার প্রবন্ধে দ্য জেনেসিস অফ সিক্রেসি ফ্রাঙ্ক কারমোড গ্রিন-এর উপন্যাস পার্টি গোয়িং আলোচনা করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন যে এর বাস্তবসম্মত পৃষ্ঠের পিছনে বইটি পৌরাণিক ইঙ্গিতগুলির একটি জটিল নেটওয়ার্ক লুকিয়ে রেখেছে।এটি কেরমোডকে আধুনিকতাবাদী আন্দোলনে সবুজকে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং পরামর্শ দেয় যে ঔপন্যাসিক টি.এস. দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত ছিলেন। একটি "পৌরাণিক পদ্ধতি" সম্পর্কে এলিয়টের ধারণা। সবুজের কাজ অন্যথায় শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে তুলনামূলকভাবে সামান্য সমালোচনামূলক মনোযোগ পেয়েছে; গ্রীনের কাজের সাথে জড়িত কয়েকজন শিক্ষাবিদদের মধ্যে তিনজন হলেন হেনরি গ্রিন: ক্লাস, স্টাইল এবং দ্য এভরিডে (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, 2016) জেরেমি ট্রেগ্লাউন, রোমান্সিং: দ্য লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্ক অফ হেনরি গ্রিন (ফ্যাবার এবং ফেবার) এর লেখক নিক শেপলি , 2000), এবং বেচি কার্ভার, গ্রানুলার মডার্নিজমের লেখক (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, 2015)। নিউ ইয়র্ক রিভিউ বুকস গ্রিনের আটটি উপন্যাস পুনর্মুদ্রণ করেছে।এটি কেরমোডকে আধুনিকতাবাদী আন্দোলনে সবুজকে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং পরামর্শ দেয় যে ঔপন্যাসিক টি.এস. দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত ছিলেন। একটি "পৌরাণিক পদ্ধতি" সম্পর্কে এলিয়টের ধারণা। সবুজের কাজ অন্যথায় শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে তুলনামূলকভাবে সামান্য সমালোচনামূলক মনোযোগ পেয়েছে; 
গ্রীনের কাজের সাথে জড়িত কয়েকজন শিক্ষাবিদদের মধ্যে তিনজন হলেন হেনরি গ্রিন: ক্লাস, স্টাইল এবং দ্য এভরিডে (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, 2016) জেরেমি ট্রেগ্লাউন, রোমান্সিং: দ্য লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্ক অফ হেনরি গ্রিন (ফ্যাবার এবং ফেবার) এর লেখক নিক শেপলি , 2000), এবং বেচি কার্ভার, গ্রানুলার মডার্নিজমের লেখক (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, 2015)। নিউ ইয়র্ক রিভিউ বুকস গ্রিনের আটটি উপন্যাস পুনর্মুদ্রণ করেছে।
নিউ ইয়র্ক রিভিউ অফ বুকস-এর সম্পাদক এডউইন ফ্র্যাঙ্ক বলেন, গ্রিন ছিল "20 শতকের মহান অপ্রত্যাশিত মূলগুলির মধ্যে একটি, যার প্রতিটি উপন্যাস (যার প্রতিটি বাক্য, এমনকি আপনি বলতে পারেন) নতুন এবং অপ্রত্যাশিত স্থানগুলির জন্য যাত্রা করে"। ফ্রাঙ্ক বলেন তার প্রিয় বইটি ছিল ব্যাক।

Bibliography

Collections

  • Surviving: The Uncollected Writings of Henry Green (1992)
  • LovingLivingParty Going (2005)
  • NothingDotingBlindness (2008)
  • CaughtBackConcluding (2016)

সবুজের জন্ম গ্লুচেস্টারশায়ারের টেক্সবারির কাছে,29 October 1905 সালে।  সফল ব্যবসায়িক শিক্ষিত পরিবারে। 
তার বাবা ভিনসেন্ট ওডহাউস ইয়র্ক, জন রেজিনাল্ড ইয়র্ক এবং সোফিয়া মাতিলদা দে টিউয়েল ডি সেরোসকারকেনের ছেলে, বার্মিংহামের একজন ধনী জমির মালিক এবং শিল্পপতি ছিলেন। 
তার মা, Hon. Maud Evelyn Wyndham, ছিলেন দ্বিতীয় ব্যারন লেকনফিল্ডের কন্যা।
গ্রিন গ্লুচেস্টারশায়ারে বেড়ে ওঠেন এবং সেভেনোয়াক্সের নিউ বিকন স্কুলে এবং তারপরে ইটন কলেজে পড়াশোনা করেন, যেখানে তিনি সহশিক্ষার্থী অ্যান্থনি পাওয়েল এর বন্ধু হয়ে ওঠেন এবং তার প্রথম উপন্যাসের অধিকাংশই লিখেছেন, অন্ধত্ব। তিনি অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজে অধ্যয়ন করেন এবং সেখানে হার্টফোর্ড কলেজের এভলিন ওয়াহর সাথে বন্ধুত্ব ও সাহিত্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।অক্সফোর্ড ইয়র্ক এবং ওয়াহ রেলওয়ে ক্লাবের সদস্য ছিলেন

মৃত্যু -  13 December 1973।

Railway Club at Oxford, conceived by John Sutro, dominated by Harold Acton. Left to right, back: Henry Yorke, Roy Harrod, Henry Weymouth, David Plunket Greene, Harry Stavordale, Brian Howard. Middle row: Michael Rosse, John Sutro, Hugh Lygon, Harold Acton, Bryan Guinness, Patrick Balfour, Mark Ogilvie-Grant, Johnny Drury-Lowe; front: porters.
==========}}}}}}}}∆∆∆∆∆∆{{{{{{{{{{{====

Wednesday, 27 October 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। । যোগীন্দ্রনাথ সরকার। ২৮.১০.২১. Vol -539. The blogger in literature e-magazine

"এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো !
আকাশ সেথা সবুজবরণ গাছের পাতা নীল;
ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা জলের মাঝে চিল !
সেই দেশেতে বেড়াল পালায়, নেংটি-ইঁদুর দেখে;
ছেলেরা খায় ‘ক্যাস্টর-অয়েল’ -রসগোল্লা রেখে !
মণ্ডা-মিঠাই তেতো সেথা, ওষুধ লাগে ভালো;
অন্ধকারটা সাদা দেখায়, সাদা জিনিস কালো !
ছেলেরা সব খেলা ফেলে বই নে বসে পড়ে;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া লোকের পিঠে চড়ে !
ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই, উড়তে থাকে ছেলে;
বড়শি দিয়ে মানুষ গাঁথে, মাছেরা ছিপ্ ফেলে !

জিলিপি সে তেড়ে এসে, কামড় দিতে চায়;
কচুরি আর রসগোল্লা ছেলে ধরে খায় !
পায়ে ছাতি দিয়ে লোকে হাতে হেঁটে চলে !
ডাঙ্গায় ভাসে নৌকা-জাহাজ, গাড়ি ছোটে জলে !"

                                              (মজার দেশ)

বা 

অ-য়ে অজগর আসছে তেড়ে

আমটি আমি খাবো পেড়ে

ইঁদুরছানা ভয়ে মরে

ঈগল পাখি পাছে ধরে’। 


                 ঈশ্বরচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ যেমন শুধু ‘বর্ণপরিচয়’ বা ‘সহজ পাঠে’র জন্যেই পরিচিত নন তেমনই ‘হাসিখুশি’র স্রষ্টা যোগীন্দ্রনাথ সরকারও কিন্তু ‘হাসিখুশি’র জন্যেই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নন। শিশুসাহিত্যের গম্ভীর আকাশে তিনি সত্যি যেন চাঁদের হাসি ঢেলে দিতে পেরেছিলেন প্রথম। আর তাই তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি আজও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

                         তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার।দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নেতড়াতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ২৮ অক্টোবর ১৮৬৬ (১২ কার্তিক ১২৭৩ বঙ্গাব্দ) । তাঁর আদি নিবাস যশোহর। তাঁর পিতার নাম নন্দলাল সরকার । নন্দলাল সরকার যশোরের একটি দরিদ্র কায়স্থ পরিবারের মানুষ ছিলেন। তিনি পরবর্তী কালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে থাকতে আরম্ভ করেন। বিখ্যাত চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ নীলরতন সরকার যোগীন্দ্রনাথ সরকারের দাদা। যোগীন্দ্রনাথ সরকার ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। দেওঘর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি নিজের প্রথাগত পড়াশোনা শেষ করতে পারেন নি।



সিটি কলেজিয়েট স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতে আরম্ভ করেন মাত্র পনের টাকা বেতনে। এ সময় থেকেই তিনি শিশু সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হন এবং শিশুসাহিত্য রচনা আরম্ভ করেন। আজগুবী ছড়া রচনায় তিনি খুব দক্ষ ছিলেন। তার সঙ্কলিত বই হাসি ও খেলা ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় । তিনি সখা, সখী, মুকুল, বালকবন্ধু, বালক, সন্দেশ প্রভৃতি ছোটদের পত্রিকায় লিখতেন। তিনি মুকুল পত্রিকাটি সম্পাদনাও করেছিলেন ।


তিনি ছবির সাহায্য অক্ষর চেনাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার কবিতাগুলির সাথে সুন্দর ছবি থাকত যা ছোটদের মনে এক কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করত। ছোটদের জন্য লেখা বিদেশী উদ্ভট ছন্দ ও ছড়ার অনুসরনে তিনি হাসি রাশি নামে একটি সচিত্র বই প্রকাশ করেন। এর সাথে সাথেই ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তার সংগৃহিত খুকুমনির ছড়া প্রকাশিত হয়। তার রচিত হাসিখুসি (১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত) বইটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল। তার রচিত ও সঙ্কলিত ৩০টি ছোটদের গল্প ও ছড়ার বইয়ের মধ্যে ছড়া ও ছবি, রাঙাছবি, হাসির গল্প, পশুপক্ষী, বনে জঙ্গলে, গল্পসঞ্চয়, শিশু চয়নিকা হিজিবিজি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার সম্বন্ধে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “বাংলার মাটিতে এমন একজন মানুষ অন্ততঃ জন্মেছেন, যিনি একান্তভাবে ছোটদের লেখক, সেই সব ছোটদের, যারা কেঁদে কেঁদে পড়তে শিখে, পরে হেসে হেসে বই পড়ে।”


ছোটদের উপযোগী ২১টি পৌরানিক বই এইসময় তিনি রচনা করেছিলেন। সেগুলি হল, ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৯০৯), ‘শকুন্তলা’, ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘সীতা’ (১৯১০), ‘ধ্রুব’ (১৯১৫), ‘ছোটদের রামায়ণ’ (১৯১৮), ‘ছোটদের মহাভারত’ (১৯১৯), ‘দৈত্য ও দানব’ (১৯২০) প্রভৃতি। এছাড়াও জ্ঞানমুকুল, সাহিত্য, চারুপাঠ, শিক্ষাসঞ্চয় প্রভৃতি ১৩-১৪টি স্কুলপাঠ্য বই তিনি রচনা করেছিলেন। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বন্দেমাতরম্ বলে একটি জাতীয় সঙ্গীত সংগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।


১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সিটি বুক সোসাইটি নামে প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করেন। এই প্রকাশনা সংস্থা থেকেই উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর প্রথম বই ছেলেদের রামায়ণ প্রকাশিত হয়েছিল।  নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর শিশুদের বই ‘টুকটুকে রামায়ণ’ এবং কুলদারঞ্জন রায়ের লেখা ‘ইলিয়াড’ এই পাবলিকেশন থেকেই প্রকাশিত হয়।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রবল কর্মব্যস্ততার ফলে উচ্চরক্তচাপজনিত কারণে মস্তিষ্কের শিরা ছিঁড়ে জ্ঞান হারান তিনি। বহু চিকিৎসার পর প্রাণরক্ষা পেলেও শরীরের ডান ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়। কিন্তু অসুস্থতার মধ্যেও তিনি তাঁর রচনা ও প্রকাশনার কাজ চালিয়ে যান। এই পরিস্থিতির মধ্যেই ১৯৩৬ সালে তাঁর শেষ সংকলন 'গল্প সঞ্চয়' প্রকাশিত হয়। তার রচিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৭৮টি।

যোগীন্দ্রনাথের কালজয়ী বই ‘হাসিখুশি’। যদিও মনে রাখা প্রয়োজন যে এটাই ওনার প্রথম বই নয়। ১৮৯১ সালে তাঁর সংকলিত ‘হাসি ও খেলা’ বাংলায় প্রকাশিত প্রথম সচিত্র শিশুপাঠ্য বই। ‘হাসি ও খেলা’ বইটার নিবেদন অংশটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে এখনও। যোগীন্দ্রনাথ সেখানে লিখেছেন, “আমাদের দেশে বালক বালিকাদের উপযোগী স্কুলপাঠ্য পুস্তকের নিতান্ত অভাব না থাকিলেও গৃহপাঠ্য ও পুরস্কার-প্রসাদযোগ্য সচিত্র পুস্তক একখানিও দেখা যায় না। এই অভাব কিঞ্চিৎ পরিমাণে দূর করিবার জন্যে হাসি ও খেলা প্রকাশিত হইল।”


‘হাসি ও খেলা’ প্রকাশের আগে যে এরকম বইয়ের সত্যি অভাব ছিল তা বোঝা যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্যে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাধনা’ পত্রের ১৩০১-এর ফাল্গুন সংখ্যায়। “...ছোট ছেলেদের জন্যে যে সকল বই আছে তাহা স্কুলে পড়িবার বই; তাহাতে স্নেহের বা সৌন্দর্যের লেশমাত্র নাই, তাহাতে যে পরিমাণ উৎপীড়ন হয় সে পরিমাণ উপকার হয় না।”

১৮৯২-এ যোগীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়েছিল বৈকুন্ঠ রায়ের আঠারো বছরের মেয়ে গিরিবালা দেবীর সাথে। এই বিবাহে আচার্য্যের কর্তব্য পালন করেছিলেন স্বনামধন্য পন্ডিত শ্রী শিবনাথ শাস্ত্রী। ক্রমে তিনি ছয়টি সন্তানের পিতা হন।


শিক্ষক যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন ছাত্রসমাজে বিপুল জনপ্রিয়। শিক্ষকতার সাথে সাথে ছাত্রদের জন্য সঙ্গীতাভিনয়ের ব্যবস্থা করা, ‘মুকুল’ পত্রিকার কার্য্যাধ্যক্ষ পদে আসীন থাকার দায়িত্ব নির্বাহ করা ইত্যাদি নানারকম কাজে ব্যস্ত থাকতেন তিনি। ‘মুকুল’-এর ছবির জন্য তাঁকে সে সময়ের একমাত্র উড ব্লক প্রস্তুতকারক প্রিয়গোপাল দাসের কাছে প্রায়ই যেতে হত। এসব কারণে নিয়মিত সময়ে প্রতিদিন তিনি স্কুলে পৌঁছোতে পারতেন না, আর যার ফলে তাঁর একমাত্র রোজগার পনেরো টাকার বড়ো অংশটাই কাটা যেত। আর তাই তিনি নিজে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নেমেছিলেন বই প্রকাশনার জগতে। ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজস্ব প্রকাশনালয় ‘সিটি বুক সোসাইটি’। সেই একই সালে প্রকাশিত হয় শিশুগদ্য পাঠের সচিত্র বই ‘রাঙাছবি’। ছোটোদের বইয়ের প্রকাশক হিসেবে তিনি অতুলনীয় ছিলেন। সেই যোগীন্দ্রনাথ তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর সহায়তায় ‘সখা’ পত্রিকার সমস্ত ব্লকগুলো কিনে নিয়েছিলেন যা তাঁকে পুস্তক প্রকাশনা ব্যবসায়ে বিশেষ প্রেরণা দিয়েছিল। পরের বছর ১৮৯৭-এ ওই প্রকাশনা সংস্থা থেকেই প্রকাশিত হল যুগান্তকারী ওই প্রাইমার ‘হাসিখুশি’। ‘হাসিখুশি’ প্রকাশিত হল দুটি ভাগে। প্রথম ভাগ ১৮৯৭ সালে ও দ্বিতীয় ভাগ ১৯০৪ সালে।বলা বাহুল্য, প্রথম ভাগটির জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশি। পরবর্তীকালে ‘হাসিখুশি’র জনপ্রিয়তা অনেকটাই পেছনে ফেলে দিয়েছিল বিয়াল্লিশ বছর আগে প্রকাশিত বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’কে। ‘হাসিখুশি’র শুরু হয়েছে ছড়া দিয়ে। তাই ছোটোদের কোমল মনে রেখাপাত করতে অসুবিধা হয়নি। তাছাড়া প্রত্যেকটা ছড়ার শুরুতেই সেই বর্ণটি দেওয়া আছে। সহজবোধ্য ছবির মাধ্যমে বর্ণটিকে সহজে চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলা বর্ণমালার কিছু কিছু বর্ণের শব্দের প্রথমে না আসার অসুবিধার জন্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে বর্ণটিকে ছবির মধ্যে আলগাভাবে বসানো হয়েছে। যেমন ণ, ড়, ঢ়, ৎ, য় ইত্যাদি। তাতে অবশ্য পড়ার বা বোঝার কোনও অসুবিধা হয় না। কয়েকটা বর্ণ আবার নিজের ছবির প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে যেমন, লৃ-কারের ছবির বালকটার শরীরটাকে অক্ষরটার মতন করেই আঁকা হয়েছে, কিংবা বলা যায় ‘ৎ’ হল বেড়ালের লেজ! এছাড়া ‘হাসিখুশি’ বর্ণমালায় ছড়ায় ব্যবহৃত শব্দগুলো শিশুদের কাছে অনেক বেশি শ্রুতিমধুর ও কাছের। মনে হয় সবসময় ওই শব্দগুলো পালটে দিলে যেন কোনও মানানসইতাই থাকবে না, হয়ে যাবে এলোমেলো। তৎকালীন অন্যান্য শিশুশিক্ষার বইয়ে ব্যবহৃত কিছু শব্দ যেমন ঊষা, একতারা, ঐরাবত, থানা ইত্যাদি শব্দ অক্ষরজ্ঞানহীন সাধারণ ঘরের শিশুদের কাছে সহজবোধ্য নয় বলেই ‘হাসিখুশি’তে সেগুলোর জায়গায় অনেক বেশি প্রচলিত ও চলতি শব্দ ব্যবহার করেছেন যোগীন্দ্রনাথ। থানার সাহায্যে ‘থ’ চেনানোর চাইতে ‘থালা ভরা আছে মিঠাই’ অনেক মনোগ্রাহী।১৯৩৭-এ জীবনের শেষবেলায় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকায় সমৃদ্ধ ‘গল্প সঞ্চয়ন’ সংকলনটি প্রকাশিত হয়। এছাড়াও প্রকাশিত হয় আরও দুটি শিশুপাঠ্য সংকলন – ‘ছোটদের উপকথা’ এবং ‘আগমনী’। জীবন পশ্চিমের পটে চলে আসার সময় যোগীন্দ্রনাথের জীবনে ঘটে যায় আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা। তাঁকে জীবদ্দশায় দেখে যেতে হল নিজের মেয়ের মৃত্যু। এর একমাসের মধ্যেই দুরারোগ্য নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে একাত্তর বছর বয়সে ১৯৩৭-এর ২৬শে জুন ইহলোক ত্যাগ করেন শিশুসাহিত্যের এই প্রাণপুরুষ। যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন স্নেহবৎসল কোমল মানুষ, যিনি সারাজীবন শিশুসাহিত্যকে পরিপুষ্ট করে তুলতে নিয়োজিত ছিলেন। অনেক শিশুসাহিত্যিক পাওয়া যাবে, কিন্তু যোগীন্দ্রনাথ সরকারের অবদান বাংলা শিশুসাহিত্য কোনওদিন ভুলবে না। আজ থেকে ১০০ বছর পরও হয়তো দেখা যাবে একটি চার বছরের শিশু দুলে দুলে ইন্টারনেট খুলে পাঠ করছে –

কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি

খেঁকশেয়ালি পালায় ছুটি

গরু বাছুর দাঁড়িয়ে আছে

ঘুঘু পাখি ডাকছে গাছে। 

১৯৩৭ সালের ২৭শে জুন (মতান্তরে ২৬শে জুন) ৭১ বছর বয়সে মৃত্যু হয় যোগীন্দ্রনাথ সরকারের।


ছড়া ১

হারাধনের দশটি ছেলে

হারাধনের দশটি ছেলে

ঘোরে পাড়াময়,

একটি কোথা হারিয়ে গেল

রইল বাকি নয়।

হারাধনের নয়টি ছেলে

কাটতে গেল কাঠ,

একটি কেটে দু’খান হল

রইল বাকি আট।

হারাধনের আটটি ছেলে

বসলো খেতে ভাত,

একটির পেট ফেটে গেল

রইল বাকি সাত।

হারাধনের সাতটি ছেলে

গেল জলাশয়,

একটি সেথা ডুবে ম’ল

রইল বাকি ছয়।

হারাধনের ছয়টি ছেলে

চ’ড়তে গেল গাছ,

একটি ম’ল পিছলে পড়ে

রইল বাকি পাঁচ।

হারাধনের পাঁচটি ছেলে

গেল বনের ধার,

একটি গেল বাঘের পেটে

রইল বাকি চার।

হারাধনের চারটি ছেলে

নাচে ধিন ধিন,

একটি ম’ল আছাড় খেয়ে

রইল বাকি তিন।

হারাধনের তিনটি ছেলে

ধরতে গেল রুই,

একটি খেলো বোয়াল মাছে

রইল বাকি দুই।

হারাধনের দুইটি ছেলে

মারতে গেল ভেক,

একটি ম’ল সাপের বিষে

রইল বাকি এক।

হারাধনের একটি ছেলে

কাঁদে ভেউ ভেউ,

মনের দুঃখে বনে গেল

রইল না আর কেউ।



ছড়া ২

তোতাপাখি

আতা গাছে তোতা পাখি

ডালিম গাছে মউ,

কথা কও না কেন বউ ?

কথা কব কী ছলে,

কথা কইতে গা জ্বলে !


ছড়া ৩

কাকাতুয়া

কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুমণি,

সোনার ঘড়ি কি বলিছে, বল দেখি শুনি ?


বলিছে সোনার ঘড়ি, “টিক্ টিক্ টিক্,

যা কিছু করিতে আছে, করে ফেল ঠিক।

সময় চলিয়া যায়-

নদীর স্রোতের প্রায়,

যে জন না বুঝে, তারে ধিক্ শত ধিক।”

বলিছে সোনার ঘড়ি, “টিক্ টিক্ টিক্।”


কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, আমার যাদুধন,

অন্য কোন কথা ঘড়ি বলে কি কখন ?


মাঝে মাঝে বল ঘড়ি, “টঙ্-টঙ্-টঙ্,

মানুষ হইয়ে যেন হয়ো না ক সঙ।

ফিটফিটে বাবু হলে,

ভেবেছ কি লবে কোলে ?

পলাশে কে ভালবাসে দেখে রাঙা রঙ্।”

মাঝে মাঝে বলে ঘড়ি, “টঙ্-টঙ্-টঙ্।”


ছড়া ৪

প্রার্থনা সঙ্গীত

ছোটো শিশু মোরা তোমার করুণা হৃদয়ে মাগিয়া লব

জগতের কাজে জগতের মাঝে আপনা ভুলিয়া রব।

ছোটো তারা হাসে আকাশের গায়ে ছোটো ফুল ফুটে গাছে;

ছোটো বটে তবু তোমার জগতে আমাদেরো কাজ আছে।

দাও তবে প্রভু হেন শুভমতি প্রাণে দাও নব আশা;

জগত মাঝারে যেন সবাকারে দিতে পারি ভালবাসা।

সুখে দুখে শোকে অপরের লাগি যেন এ জীবন ধরি;

অশ্রু মুছায়ে বেদনা ঘুচায়ে জীবন সফল করি।।


ছড়া ৫

কাজের ছেলে

দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল,চিনি-পাতা দৈ,

দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।

পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল;

ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়,”

” ছিঁড়ে দেবে চুল।

দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,

দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।

বাহবা বাহবা – ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ!

দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।

দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,

ডিম-ভরা বেল, দু’টা পাকা তেল, সরিষার কৈ।

ওই তো ওখানে ঘুরি ধরে টানে, ঘোষদের ননী;

আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি!

দাদখানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দুটা পাকা দৈ,

সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ!

এসেছি দোকানে-কিনি এই খানে, যত কিছু পাই;

মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই!

দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,

চিনি-পাতা চাল, দুটা পাকা ডাল, ডিম ভরা দৈ।


==========∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆==========

Tuesday, 26 October 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। লেখক চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় ২৭.১০.২১. Vol -538. The blogger in literature e-magazine.


চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায়। পিতার নাম বিশ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায়।তিনি বহরমপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। প্রথমে বহরমপুর কলেজিয়েট স্কুলে এবং পরে পুঁটিয়া ইংরাজী স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে বি.এল পাশ করে ওকালতি শুরু করেন। ওকালতি ব্যবসায় তেমন সফল হতে পারেননি। অবশেষে ১৩১১ বঙ্গাব্দে (১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে) কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী তাঁকে আমৃত্যু পঞ্চাশ টাকা মাসিক বৃত্তি দিয়ে উপাসনা পত্রিকার সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত করেন। তবে চন্দ্রশেখর বঙ্গদর্শন পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় নবপর্যায়ের বঙ্গদর্শন পত্রিকার সাহিত্য সমালোচকও ছিলেন। তার সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যকাব্যগ্রন্থ উদ্ভ্রান্তপ্রেম প্রথমা পত্নীর অকালমৃত্যুর পর রচিত। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত শোকোচ্ছাসপূর্ণ এই গদ্যকাব্যগ্রন্থটি একসময় বাঙালি পাঠক সমাজে বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয়েছিল। বঙ্গদর্শন, বান্ধব, জ্ঞানাঙ্কুর প্রভৃতি পত্রিকায় তার প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হত। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেই সমস্ত প্রবন্ধের সংকলন "সারস্বতকুজ্ঞ" প্রকাশ করেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি হল -

রচনা কর্ম
  • উদ্ভ্রান্তপ্রেম (১৮৭৫)
  • মশলা-বাধা কাগজ
  • সারস্বতকুজ্ঞ (১৮৮৫)
  • স্ত্রী-চরিত্র (১৮৯০)
  • কুঞ্জলতার মনের কথা
  • রামবসুর বিরহ
  • মৃন্ময়ী
  • রসসাগর



আলোচনা : উদ্ভ্রান্ত প্রেম

চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখন আর সহজলভ্য নয়। তাঁর পিতা-মাতা, নিবাস বা পেশা সম্পর্কে তথ্যাদি অপর্যাপ্ত। কিন্তু এটুকু জানা যায় যে, তিনি বঙ্গদর্শন-এর নিয়মিত লেখক ছিলেন।

বঙ্গদর্শন অন্তত তিন জনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়, দুটি পর্বে। দুই পর্বে বলা হলো মাঝখানে বিরতির কারণে। প্রথম পর্বের সম্পাদক ছিলেন ক্রমান্বয়ে সঞ্জীবচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর বঙ্গদর্শন নবপর্যায়ের সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় বঙ্গদর্শনের দুটি পর্বেই নিয়মিত লেখক ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনাকালে বঙ্কিমযুগের অনেক লেখক বেঁচে থাকলেও চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় ও শ্রীশচন্দ্র মজুমদার ছাড়া আর কাউকে এ পর্যায়ের লেখক হিসেবে পাওয়া যায় না; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দুজনকে গ্রহণ করেছিলেন অথবা অন্যরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাদের সম্পাদক হিসাবে গ্রহণ করেননি।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ নিয়ে চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করেন ‘সারস্বতকুঞ্জ’ নামে। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে। ‘সারস্বতকুঞ্জ’-এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, সংকলেন প্রবন্ধগুলি বঙ্গদর্শন, বান্ধব, জ্ঞানাঙ্কুর ও মাসিক সমালোচক-এ আগে প্রকাশিত হয়েছিলো।

উদ্ভ্রান্ত প্রেম প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালে। জানা যায়, লেখকের স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তিনি ‘উদ্ভ্রান্ত প্রেম’ রচনা করেন। ষষ্ঠ (১৮৯৮), দশম (১৯১২) এবং অষ্টবিংশ (অজানা) সংস্করণে ‘উদ্ভ্রান্ত প্রেম’-কে ‘গদ্যকাব্য’ বলা হয়েছে।

প্রথম সংস্করণের প্রকাশক সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু ষষ্ঠ সংস্করণের কপিতে দেখা যায়, প্রকাশক হিসাবে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের নাম; প্রকাশিত হয়েছিলো কলকাতা থেকে ১৮৯৮ সালে। ‘উদ্ভ্রান্ত প্রেম’-এর আটাশতম সংস্করণ পর্যন্ত কপি পাওয়া গেছে। সেটির প্রকাশক লেখা আছে ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স’, ঠিকানা দেয়া আছে ‘কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট, কলিকাতা’। এর পরে আর কোন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিলো কিনা জানা যায়নি।






চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে অক্টোবর প্রয়াত হন।


জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কবি মোহিতলাল মজুমদার। ২৬.১০.২১. Vol -537. The blogger in literature e-magazine

"আমার মনের গহন বনে


পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী


নারী-অপ্সরী সঙ্গোপনে!

ফুলেরি ছায়ায় বসে তার দুই চরণ মেলি

বিজন-নিভৃতে মাথা হতে দেয় ঘোমটা ফেলি,


শুধু একবার হেসে চায় কভু

নয়ন কোণে,

আমারি মনের গহন বনে।"



বিংশ শতাব্দীর এক জন বিখ্যাত বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক এবং সাহিত্য সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। কাব্যচর্চা দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও পরে সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, নিপুণ বিশ্লেষণ ও ভাবগম্ভীর ভাষার মহিমায় মোহিতলালের সমালোচনাধর্মী গ্রন্থগুলো ধ্রুপদী সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। শিল্প-সাহিত্যের নানা সমস্যা আলোচনায় তাঁর ছিল নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, মতবাদ। ফলে কবি ও প্রবন্ধকাররূপে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জুলাই তিনি প্রয়াত হন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, মোহিতলাল মজুমদার ১৮৮৮ সালের ২৬ অক্টোবর নদীয়ার কাচঁড়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
 
মোহিতলাল মজুমদার (জন্ম : ২৬ অক্টোবর, ১৮৮৮ – মৃত্যু : ২৬ জুলাই, ১৯৫২) প্রথম জীবনে কবিতা লিখলেও পরবর্তী জীবনে সাহিত্যসমালোচক হিসেবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মোহিতলাল মজুমদারের পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত বলাগড় গ্রাম। তাঁর বাবার নাম নন্দলাল মজুমদার। নন্দলাল ছিলেন কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের জ্ঞাতি ভাই। মোহিতলালের কৈশোর এবং বিদ্যালয়জীবন বলাগড় গ্রামেই অতিবাহিত হয়।ছোটবেলায় তিনি কিছু দিন চব্বিশ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার কাছে হালিশহরে মায়ের মামাবাড়িতে অবস্থান করে সেখানকার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। মোহিতলাল চার-পাঁচ বছর বয়সে কাশীরাম দাসের মহাভারতের সঙ্গে পরিচিত হন। নয় বছর বয়সে তাঁর রোমান্স পাঠে আগ্রহ জন্মায়। বারো – তেরো বছর বয়সেই পলাশীর যুদ্ধ এবং মেঘনাদ বধ কাব্য পড়ে শেষ করেন। তিনি বলাগড় বিদ্যালয় থেকে ১৯০৪ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৯০৮ সালে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে বি.এ পাস করেন। কিন্তু অসুবিধায় পড়ে এম.এ পড়া ছেড়ে দেন। ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার তালতলা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯১৪ সালে সরকারি জরিপ বিভাগে কানুনগো পদে চাকরি গ্রহণ করেন। তিন বছর তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পুনরায় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা কর্মে নিয়োজিত থাকেন। ১৯৪৪ সালে অধ্যাপনার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন মোহিতলাল।তারপর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। পরে বঙ্গবাসী কলেজে গিরিশ সংস্কৃতি ভবনে অধ্যাপনায় যোগ দেন।

মোহিতলাল মজুমদারের সাহিত্যচর্চার শুরু ‘মানসী’ পত্রিকার মাধ্যমে। পরে ভারতী ও শনিবারের চিঠিসহ অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়ও তিনি নিয়মিত লিখতেন। বীরভূমি পত্রিকায় কবিতা প্রবন্ধ অনুবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম দিকের কবিতায় স্বপ্নবিহবল তরুণ মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বেদনা মনোরম ছন্দে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির পশ্চাতে নিজস্ব কাব্যাদর্শ, সৌন্দর্যবোধ ও আধ্যাত্মিক মতবাদ ক্রিয়াশীল ছিল। অবশ্য এই আধ্যাত্মিক মতবাদটি খুব স্পষ্ট নয় বৈষ্ণবতত্ত্বের সঙ্গে বেদান্তের একটা সমন্বয়ের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। ভাবসাধনার দিক থেকে মোহিতলাল ভোগসর্বস্ব দেহবাদী কবি।

দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে তাঁর কাব্যচর্চায় দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব দেখা যায়। এ ছাড়াও, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যাযের় কবিতার ছন্দোমাধুর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। মোহিতলাল কিছু কাল ভারতী গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক ছিলেন। তিনি শনিচক্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্র পরবর্তী কাব্যে কবি মোহিতলালের স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য সমালোচক হিসাবেও তাঁর সবিশেষ খ্যাতি ছিল। ভাষারীতির বিশুদ্ধতা নিয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ ও নিষ্ঠা ছিল। শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলি দেখানোর ক্ষেত্রে তাঁর একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তাঁর মননধর্মিতা এবং কবিসুলভ ভাবাত্মক বিচারবোধ সমালোচনা সাহিত্যকে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলিতে ‘কৃত্তিবাস ওঝা’, ‘সব্যসাচী’, ‘শ্রী সত্যসুন্দর দাস’ ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। 

বাংলা কাব্যে বিদেশী শব্দ, বিশেষ করে আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগে মোহিতলালের বিশেষ কৃতিত্ব ছিল। তিনি ইংরেজি সাহিত্যেও সুপন্ডিত ছিলেন। বাংলা ছন্দ ও অলঙ্কার বিষয়ে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। মোহিতলাল রবীন্দ্রকাব্যের একজন রসজ্ঞ ও মর্মজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তবে পরবর্তীতে শনিবারের চিঠির দলে যোগ দিয়ে তিনি রবীন্দ্রবিরোধী হয়ে ওঠেন। কাব্য বিচারে তিনি পঞ্চাশ-উত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখেননি। তিনি বঙ্গ সাহিত্য-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ আসনে মাইকেল ও বঙ্কিমচন্দ্রকে বসানোর চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই এই বিতর্কিত সাহিত্যপ্রতিভার কাব্য আপন বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বঙ্গসাহিত্য প্রসঙ্গে মোহিতলাল সৃজনধর্মী ও সৃষ্টিশীল আলোচনা করে গেছেন.

ভারতী’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র অনুসারী যে কবি সমাজ রাবীন্দ্রিক রোমান্টিক মোহ মদির পরিবেশে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন, মোহিতলাল সেই বলয়ে প্রবেশ না করে নতুন কালের বাস্তবতার জয়ধ্বজা ওড়ালেন- যা ত্রিশের দশকে প্রকাশিত ‘কল্লোল’ পত্রিকার কাব্যাদর্শকে অনেকক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। কল্লোলপন্থীদের দেহকেন্দ্রিক প্রেম ভাবনার অনুপ্রেরণা মহিতলালই। ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত মোহিতলালকে তাই ‘আধুনিকোত্তম’ বলেছেন। ‘কবিতা’ পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘আমাদের তরুণ বয়সে যখন রবিদ্রোহিতার প্রয়োজনীয় ধাপটি আমরা পার হচ্ছিলাম তখন যে দু’জন কবিকে আমরা তখনকার মতো গত্যন্তর খুঁজে পেয়েছিলাম, তাঁদের একজন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আর একজন ‘বিস্মরণী’-র মোহিতলাল। কিন্তু বাংলা কাব্যে দেহবাদের প্রবক্তা হয়েও মোহিতলাল কিন্তু যাযাবরী উদ্দামতাকে প্রশ্রয় দেননি। তাই ‘কল্লোল’-এর কবিদের কাছে ‘দ্রোণাচার্য’ হয়েও তার সঙ্গে মোহিতলালের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কল্লোল গোষ্ঠীর তীব্র নিরাশা আর আদিমতার আসক্তিতে তিনি ছিলেন নিঃস্পৃহ। কল্লোলীয়দের সঙ্গে মোহিতলালের এই ছিল প্রাথমিক পার্থক্য। মোহিতলালের বিদগ্ধ কবি-মানসে শেষ পর্যন্ত ‘কাম’ দেহকে আশ্রয় করে সার্থক হয়ে উঠেছে। কিন্তু কল্লোলীয়দের কামের জন্যই দেহে, অথচ সেই সম্ভোগের মধ্যে নেই কোন আধ্যাত্মিক তৃপ্তি। এমিল জোলার Naturalism, লরেন্সের সেক্স ও ঈডিপাস তত্ত্ব, লেডি চ্যাটার্লির সন্সকার-মুক্তি, ক্লুট হামসুনের ‘ক্ষুধা’ ইত্যাদি সব কিছুই তাঁর কাছে ভোগ্য ও আস্বাদ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু মোহিতলাল দেহের সৌন্দর্য-ধ্যানেই শেষ পর্যন্ত তন্ময় হয়ে ভালোবাসার মহিমা উপলব্ধি করেছেন, “আমার দেবতা সুন্দর সে যে, পূজা নয়-ভালোবাসি।” মানুষের মাঝে দেবতার, দেহের মাঝে আত্মার স্বীকৃতিদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কবিতার ভাববৃত্ত পূর্ণ হয়েছে। কবিতার ভাবানুসঙ্গ ও রূপনির্মিতিতে মোহিতলাল ক্ল্যাসিকপন্থী। তাঁর কবিতায় বলিষ্ঠ ভাবচেতনা ভাস্করের কারুকার্যে সুগঠিত। হয়ত অনেক সময় ভাবাবেগের প্রাবল্য আছে, কিন্তু তা দৃঢ়তায় পূর্ণ, কবিতার আঙ্গিকের সঙ্গে সামঞ্জস্যময়। খেয়ালী কল্পনা ও লঘু ভাবনার অবসর সেখানে নেই। মননের দীপ্ত বিলাসে, আত্মকেন্দ্রিক আভিজাত্য এবং ব্যক্তি চেতনার সজাগ অভিমান কবি মহিতলাল আজও রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে যেন এক নিঃসঙ্গ দৃষ্টান্ত।

মৌলিক গ্রন্থ, সমালোচনা ও সম্পাদিত গ্রন্থ মিলিয়ে মোহিতলাল মজুমদারের প্রকাশিত গ্রন্থ অনেক। কবি মোহিতলালের জীবনকাল ১৮৮৮ থেকে ১৯৫২। প্রথম প্রকাশিত কাব্য ‘দেবেন্দ্রমঙ্গল’ ১৬টি সনেট নিয়ে প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রি.। তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ছন্দচতুর্দশী’ ৫৪টি সনেট নিয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রি.। এই কালসীমার মধ্যে রচিত তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল-ক) কাব্যগ্রন্থ- ১) দেবেন্দ্র-মঙ্গল (১৯২২) ২) স্বপন-পসারী (১৯২২) ৩) বিস্মরণী (১৯২৭) ৪) স্মরগরল (১৯৩৬) ৫) হেমন্ত-গোধূলি (১৯৪১) ৬) ছন্দ চতুর্দশী (১৯৪১) (সনেট সঙ্কলন) ৭) কাব্য মঞ্জুষা তন্মধ্যে – ‘দেবেন্দ্র-মঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থটি ছিল আত্মীয় ও কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রশস্তিমূলক ১৬টি সনেটের সঙ্কলন। খ) প্রবন্ধগ্রন্থ- ১) আধুনিক বাংলা সাহিত্য (১৯৩৬) ২) সাহিত্যকথা (১৯৩৮) ৩) বিবিধ কথা (১৯৪১) ৪) বিচিত্র কথা (১৯৪১) ৫) সাহিত্য বিতান (১৯৪২) ৬) বাঙলা কবিতার ছন্দ (১৯৪৫) ৭) বাঙলার নবযুগ (১৯৪৫) ৮) জয়তু নেতাজী (১৯৪৬) ৯) কবি শ্রীমধুসূদন (১৯৪৭) ১০) সাহিত্য বিচার (১৯৪৭) ১১) বঙ্কিমবরণ (১৯৪৯) ১২) রবি-প্রদক্ষিণ (১৯৪৯) ১৩) শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্র (১৯৫০) ১৪) জীবন জিজ্ঞাসা (১৯৫১) ১৪) বাঙলা ও বাঙালী (১৯৫১) ১৫) কবি রবীন্দ্র ও রবীন্দ্র কাব্য (প্রথম খণ্ড ১৯৫২, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৫৩) ১৬) বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস (১৯৫৫)। বঙ্গদর্শন পত্রিকা তৃতীয় পর্যায়ে মোহিতলালের সম্পাদনায়ই প্রকাশিত হয়।

তাঁর কাব্যে প্রেমপরিবেশে তাই ফুল, মালা, স্রগ্ধ-চন্দন ইত্যাদি অনিবার্যভাবে স্থান নিয়েছে। ‘তিমির তীর্থে’ পথিক কবি ‘দেহ’-কে ক্ল্যাসিক কবির মতোই মন্দির বলেছেন এবং প্রেমকেও ক্ল্যাসিকাল পূজার মনোবৃত্তিতেই দেহোপাসনা বলেছেন বারংবার। বলা বাহুল্য এইখানেই শিল্পী হিসেবে সমকালীন কবিদের তুলনায় মোহিতলালের এতখানি স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা। তাঁর কাব্যে ক্লাসিক্যাল ভঙ্গি এবং রোমান্টিক ভাবের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর মানস-লক্ষ্মী কবিতার প্রথম কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপ -

“আমার মনের গহন বনে

পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী

নারী-অপ্সরী সঙ্গোপনে!

ফুলেরি ছায়ায় বসে তার দুই চরণ মেলি

বিজন-নিভৃতে মাথা হতে দেয় ঘোমটা ফেলি,

শুধু একবার হেসে চায় কভু 

নয়ন কোণে,

আমারি মনের গহন বনে। ”

মোহিতলাল নারীর মোহিনীরূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন-

“সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি মিথ্যা সনাতনী

সত্যেরে চাহিনা তবু সুন্দরের করি আরাধনা”

সমালোচকগণ বলছেন, মোহিতলালের মানসলক্ষ্মী কোন বিদেহী রোমান্টিক সৌন্দর্যে প্রবর্তনা না হয়ে ‘স্পর্শরসিক’ কবির স্পর্শ বন্ধনেই ধরা পরবে-কবির এরকম আকাঙ্ক্ষাতেই রবীন্দ্রনাথের মানসসুন্দরী ও মোহিতলালের মানসলক্ষ্মী দুই স্বতন্ত্র সৌন্দর্যলোকবাসিনী হয়ে উঠেছে। এখানেই ভোগবাদী মোহিতলালের ইন্দ্রীয়ময় দেহসৌন্দর্যবাদের বৈশিষ্ট্য। দুরন্ত দেহবাসনার উত্তাল তরঙ্গেই প্রেয়সী নারীর সৌন্দর্যসম্মোহন উপভোগ করেছেন মোহিতলালঃ-

‘সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি মিথ্যা সনাতনী

তবুও তার আকর্ষণ কবির কাছে দুর্বার; কেননা,

কটাক্ষ ঈক্ষণ তার হৃদয়ের বিশল্যকরণী;

স্বপনের মনিহারে হেরি তার সীমন্ত রচনা

নিপুণা নটিনী নাচে, অঙ্গে অঙ্গে অপূর্ব লাবণি

স্বর্ণপাত্রে সুধারস, না সে বিষ? কে করে শোচনা

পান করি সুনির্ভয়ে, মুচকিয়া হাসে যবে ললিতলোচনা।’

নব্যতান্ত্রিক মোহিতলালের জীবনের আদর্শ তাই নীলকণ্ঠ, রবীন্দ্রনাথের মতো নটরাজ নয় এবং ‘স্বপনপসারী’র ‘পাপ’কবিতায় তিনি লিখেছেনঃ-

‘ত্যাগ নহে, ভগ,-ভোগ তারি লাগি, যেই জন বলীয়ান।

নিঃশেষে ভরি’ লইবারে পারে এত বড় যার প্রাণ!

যে জন নিঃস্ব, পঞ্জরতলে নাই যার প্রাণধন

জীবনের এই উৎসবে তার হয়নি নিমন্ত্রণ!’

‘স্মরগরল’ কাব্যের নাম কবিতায় প্রথমেই লিখেছেনঃ

‘আমি মদনের রচিনু দেউল-দেহের দেউল ‘পরে

পঞ্চশরের প্রিয় পাঁচ-ফুল সাজাইনু থরে থরে।

দুয়ারে প্রাণের পূর্ণকুম্ভ-

পল্লবে তার অধীর চুম্ব,

রূপের আবীরে স্বস্তিক তায় আঁকিনু যতন ভরে।’

এইজন্যই কবি মোহিতলালের কাছে নারীসৌন্দর্য তার ‘জায়া’ রূপের মধ্য দিয়েই উপভগ্য।

‘তাই আমি রমণীয় জায়ারূপ করি উপাসনা।’

রবীন্দ্রনাথের ‘রাতে ও প্রভাতে’ কবিতায় দুই ভিন্নরূপে রমণীর জায়ারূপ এবং কল্যাণসুন্দর গৃহিণীরূপকে আলাদা করে দেখেছেন। কিন্তু মোহিতলাল দেখেছেন-

‘বধূ ও জননী পিপাসা মিটায় দ্বিধাহারা

রাধা ও ম্যাডোনা একাকারা।’

জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে বলা হতো চলমান বিশ্বকোষ। অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতি এই সবগুলো বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত দেয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর। সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠসমূহের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অনেকেই একবাক্যে তাঁর মেধা এবং ধী-শক্তির অন্যন্যতা স্বীকার করেছেন। এই নিভৃতচারী, অনাড়ম্বর জ্ঞানসাধক মানুষটি সারাজীবন কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। তিনি ব্যক্তি মানুষটি কেমন মুষ্টিমেয় অনুরাগীর বাইরে অনেকেরই ধারণা নেই। এই অনুরাগীদের একজন আহমদ ছফা। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ছাত্র। দীর্ঘ মেলামেশার ফলে প্রফেসর রাজ্জাককে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার দুলর্ভ সুযোগ হয়েছে তাঁর। আর সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই ছফা লিখেছেন 'যদ্যপি আমার গুরু'। অধ্যাপক রাজ্জাককে নিয়ে খোলামেলা, তীক্ষ্ম, গভীর এবং সরস গ্রন্থ। আহমদ ছফা'র সাথে আলাপচারিতায় নানা বিষয় নিয়ে বলেছেন প্রফেসর রাজ্জাক। আহমদ ছফা প্রাণবন্ত ভাষায় সেগুলো উল্লেখ করেছেন 'যদ্যপি আমার গুরু'তে। আমার প্রিয় বই এটি। তাদের আলাপচারিতার মোহিতলালের প্রসঙ্গটি পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই। আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘কবি জসীমুদ্দীনের প্রসঙ্গ ধরে কবি মোহিতলালের কথা উঠলো। মোহিতলাল মজুমদার পূর্ববাংলার উচ্চারণরীতি বরদাশত করতে পারতেন না। কবি জসীমুদ্দীনের একটা কবিতার বইয়ের নাম ছিল ধান খেত। মোহিতবাবু ব্যঙ্গ করে বলতেন জসীমুদ্দীন ধান খেতো। মোহিতলালের জিভের মধ্যে বিষ আছিল। তাঁর ঠাট্টা রসিকতা এমনভাবে ছড়াইয়া পড়ল জসীমুদ্দীন বেচারার জান যাওনের দশা। একদিন আমি মোহিতবাবুরে চ্যালেঞ্জ কইরা বইলাম। কইলাম, আপনে জসীমুদ্দীনরে এত ঠাট্টা করেন ক্যান্। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যদি জসীমুদ্দীনের উপর এক অধ্যায় লেখা অয়, আপনেরে নিয়া লেখব মাত্র চাইর লাইন।’

===={{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆¶¶¶}}}}}}}}}}}======



Monday, 25 October 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়।‌। ২৫.১০.২০২১. Vol -536. The blogger in literature e-magazine


সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় 

 জন্ম ২৫ অক্টোবর ১৯৩৩ । বিশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালী সাহিত্যিক। পশ্চিমবঙ্গের হাংরি আন্দোলনের সাথে ছিলেন শুরু থেকে, যদিও পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর বিনয় মজুমদারের মত তিনিও সরে আসেন সেই আন্দোলন থেকে।

লিখেছেন একুশটি উপন্যাস, ষাটের অধিক গল্প, অসংখ্য নিবন্ধ। যুক্ত ছিলেন দৈনিক আজকালের সাথে, দৈনিকটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে। বাংলা সাহিত্যের 'আভাঁ-গার্দ' লেখকদের মাঝে অন্যতম তিনি। 


রচনা কর্ম

উপন্যাসপ্রকাশকাল
একক প্রদর্শনী১৯৭১
এখন আমার কোনো অসুখ নেই১৯৭৭
আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি১৯৮৫
জঙ্গলের দিনরাত্রি১৯৮৮
হিরোসিমা মাই লাভ১৯৮৯
অস্তিত্ব , অতিথি তুমি১৯৯০
কুকুর সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমি জানি১৯৯১
কলেরার দিনগুলিতে প্রেম১৯৯২
রিক্তের যাত্রায় জাগো১৯৯৩
রুবি কখন আসবে১৯৯৩
এখন জীবন অনেক সতেজ স্বাস্থ্যে ভরা১৯৯৪
এসো , নীপবনে১৯৯৫
কলকাতার দিনরাত্রি১৯৯৬
কলকাতা , তুমি কার১৯৯৭
কোলাজ১৯৯৮
ভারতবর্ষ১৯৯৯
আমি ও বনবিহারী২০০০
যখন সবাই ছিল গর্ভবতী২০০১
ডাবল বেডে একা২০০১
স্বর্গের নির্জন উপকূলে২০০৩
নিষিদ্ধ স্বপ্নের ডায়েরী২০০৩
ধ্বংস্বের মধ্য দিয়ে যাত্রা২০০৪

ছোটগল্প সংকলন
ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী
সমবেত প্রতিদ্বন্দ্ধী ও অন্যান্য
হ্যাঁ প্রিয়তমা
এক যে ছিল দেয়াল
সোনালী ডানার ঈগল 

 পুরস্কার


মৃত্যু   -১২ ডিসেম্বর ২০০৫.



সাক্ষাৎকার

বাংলা সাহিত্যে একটি বিতর্কিত নাম সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র পাঠক গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন সন্দীপন। লিখন শৈলীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভিন্ন মেরুতে অবস্থান সত্ত্বেও আজও সমান আলোচিত তিনি। সন্দীপনকে নিয়ে লিটল ম্যগাজিন ছাড়া অন্যত্র সেভাবে আলোচনা হয়নি বললেই চলে। নব্বইয়ের দশকে সন্দীপন ভাবনায় আলোড়িত হন তাঁর এক নিবিড় পাঠক প্রবীর চক্রবর্তী। সন্দীপন সান্নিধ্যে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় সদ্য প্রয়াত ও তৎকালীন তরুণ প্রাবন্ধিক অদ্রীশ বিশ্বাসের। উভয়ের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত হয় একটি অনন্য গ্রন্থ – ‘ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমরা জানি।’ ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভূমিকা’ প্রকাশন থেকে। এই বইটির জন্য দীর্ঘ আলাপচারিতায় বসেছিলেন প্রবীর চক্রবর্তী, অদ্রীশ বিশ্বাস এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখনের দায়িত্ব পড়েছিল তৎকালীন সাংবাদিক,লেখক এবং বর্তমানে গল্পের সময় পরিবারের অন্যতম সদস্য দেবাশিস মজুমদারের উপর।‘সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমরা জানি’ বইটি এখন বইবাজারে দুর্লভ। প্রকাশের বছর কুড়ি পর সেই জুলাই মাসেই ‘গল্পের সময়’এর পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটির সামান্য বাছাই করা অংশ তুলে আনলেন দেবাশিস মজুমদার। ]

 ‘সূর্যমুখী ফুল আর বিকালের আলো’। ওই গল্পটা পড়েই তো ফণীভূষণ আচার্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা আপনার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন।

ওটা ফণীভূষণ লিখেছে বটে, তবে প্রথম আলাপ ওটা পড়ে হয়নি। তবে পরবর্তীকালে শুনেছি সুনীল ঐ গল্পটা পড়ে মন্তব্য করেছিল, ‘লোকটা বোধহয় জেলে’। কফি হাউসে কোনো এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম। তখনও সুনীলের সঙ্গে আলাপ হয়নি। আমরা কফি হাউসে আলাদা টেবিলে বসতাম। সুনীলরা আলাদা টেবিলে বসতো। ‘কৃত্তিবাসে’র গোড়ার দিক তখন।

তখন কারা কারা আপনাদের টেবিলে বসতেন?

মিহির সেন, মিহির আচার্য, বীরেন্দ্র নিয়োগী, পূর্ণেন্দু পত্রী, একটু পরে অসীম সোমও আসে।

‘কৃত্তিবাসে’র সঙ্গে আলাপটা কীভাবে ঘটেছে?

আমি তখন ধুতি-শার্ট পরতাম। একথা আগেও অনেক জায়গায় বলেছি – আমি তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে ২৪ বি নূর মহম্মদ লেনে আলাদা থাকতাম। আমার সঙ্গে থাকতো প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়।ওখানে বসেই আমি ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ গল্পটা লিখতে শুরু করি।ওখানেই একটা কবিতাও লিখি, যার প্রথম লাইনটা মধুসূদন থেকে ধার করতে হয়েছিল – ‘দাঁড়াও পথিকবর’। ‘এপিটাফ’ নাম।সেটা আমি কোনো ক্রমে লিখি। সেটা পড়ে প্রণব বলল, ‘আরে এতো খাঁটি পয়ার ! চলুন আপনার সঙ্গে সুনীলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি’ – বলে দেশবন্ধু পার্কে নিয়ে গেল। ওখানেই সুনীলের সঙ্গে প্রথম আলাপ। তারপর টেবিল বদল হল। পুরনো বন্ধুত্ব কিছু রইলো। ওখানে খুব ইমপর্টেন্ট ছিল যুগান্তর চক্রবর্তী। আমরা দুজনেই ইংরাজি পড়তাম। আমি একবছর পরীক্ষা দিতে পারিনি বলে সে সিনিয়র হয়ে যায়।

হঠাৎ ইংরেজি?

দেবীপদ ভট্টাচার্য বললেন, ‘তুমি তো দেখছি বরাবর বাংলায় কম ইংরেজিতে বেশি নম্বর পাও’। ইংরেজিতেই অ্যাপ্লাই করলাম। এবং চান্সও পেয়ে গেলাম। যাইহোক, যা বলছিলাম। দেশবন্ধু পার্কে ঢুকে দেখলাম ওরা সবে কবিতা লিখছে। মাঝে-মধ্যে মদ-টদ খেতে যায়। শক্তির সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তারপর ওরই সঙ্গে প্রথম দিকে ওইসব মদ বিক্রির ঠেকগুলোতে যাতায়াত শুরু করলাম। ওদের মধ্যে আমিই সেই ভাগ্যবান যে প্রথমেই একটা চাকরি পেয়ে গিয়েছিল।আর চাকরি পাওয়ার প্রথম দিকে, মানে, মাইনে পাওয়ার প্রথম কয়েকদিন ওদের সঙ্গে থাকতাম। সবাই মিলে খুব পানাদি হত। তারপর চারআনা-আটআনা ওদের কাছ থেকে ধার নিয়ে চালাতাম। আমরা কিন্তু সোনাগাছিতে যেতাম। এই কথাগুলো কিন্তু আমি বলছি না। কারণ, এই যে আমি খরচ করে ফেলতাম, বা ধার নিয়ে কাজ চালাতাম, এগুলো তো আমি কখনও ভাবিনি, লক্ষ্যও করিনি। পরে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পুরনো দিনের কথা নিয়ে আড্ডা দেওয়ার সময় বিভিন্ন লোক রেফার করেছে।

‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ পর্যায়ের প্রথম যে গল্পটা লিখেছিলেন তা কি ‘বিজনের রক্তমাংস’ নয়?

না, ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ আমি আগে থেকেই লিখেছিলাম।এসম্পর্কে সুনীলের কথা বলতে হয়।গল্পটা তখন অনেকটা লেখা হয়ে গিয়েছিল। সুনীল কিছুটা পড়েও ছিল। তা, সুনীল নাকি সমীর রায়চৌধুরীকে একটা চিঠি লিখেছিল চাইবাসায়, ‘ সন্দীপন একটা অসাধারণ গল্প লিখছে। শেষ হলে একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটবে। তো যাই হোক, এ বিষয়টা আমার কাছে একেবারে আশ্চর্যের নয়। কারণ, ও তো ভীষণ বন্ধু-বৎসল। অবশ্য শুধু ও নয়, সে সময় আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সম্পর্কটা খুবই ঘনিষ্ট ছিল। যে কারণে সকলেই প্রায় প্রেম করতো লুকিয়ে। জানাজানি হলে মারধোর খাওয়ার একটা ভয় ছিল। বন্ধুত্বের বাইরে আর কিছুর যেন কোনো ভূমিকাই থাকতে পারে না আমাদের জীবনে – এরকম একটা ধারণা ছিল। আমাদের তাই এই নিয়মে লুকিয়ে প্রেম করতে হতো। খালি শক্তির ব্যাপারটা একটু আলাদা। ও তো প্রায় বুড়ো বয়সে প্রেম করেছে (চাইবাসায়)। আর তার আগে শক্তি তো কোনোদিনই ও সবের ধার ধারেনি। যে কটা প্রেম করতে গেছে সব কটাই গোলমেলে। এবং অনেকটাই এক তরফা। শক্তি অপর পক্ষের সম্মতির অপেক্ষাই করেনি। ও একটা আলাদা ঘরানার মানুষ। ওর মধ্যে যেটা ছিল সেটা ওবিসি স্তরের ব্যাপার। এ জিনিস এসিটিস্ট বা ভদ্দর লোকেরা বুঝতে পারবে না।

আপনার প্রথম পর্বের গল্পগুলোতে যে ব্যক্তির হতাশা ও সংকট চিহ্নিত হয়েছে, তা ওই বামপন্থী বন্ধুবান্ধবরা এবং পত্রপত্রিকাগুলো সমালোচনা করেনি?

হ্যাঁ, ‘বিজনের রক্তমাংস’ তো ‘পরিচয়’ পত্রিকা ফেরত পাঠিয়েছিল। এগুলোই আমায় পার্টি থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আসলে তখন আমি ভেবে দেখলাম – এভাবে হবে না। কারণ, এর আগে আমি যত কমিটেড লেখা লিখেছি সেগুলো কিন্তু যথারীতি গুরুত্ব দিয়েই ছাপা হয়েছিল। দীপেন নিজের হাতে ‘বিজনের রক্তমাংস’ ফেরত দিয়ে যায়। যদিও পরে এ ঘটনাটা নিয়ে দেবেশ রায় আমাকে বলেছিল, ‘তুমি কি করে ভাবলে দীপেন ওই লেখা ফেরত দিল?’ পরে আমি ভেবে দেখেছি, দেবেশই ঠিক বলেছিল। কারণ তখন তো সম্পাদক ছিলেন সত্য গুপ্ত, যিনি পরবর্তীকালে এমএল পার্টিতে যোগ দেন। দীপেন সত্যবাবুর বাতিল করে দেওয়া লেখাটা কেবলমাত্র আমার হাতে তুলে দিতে এসেছিল। পরবর্তীকালে ‘বিজনের রক্তমাংস’ যখন ছাপা হয় তখন দীপেন ভূয়সী প্রশংসা করেছিল। ওই সময়েই তো ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ ছাপা হল। আউট-স্ট্যান্ডিং স্টোরি! ওইরকম গল্প হয়তো আর লেখা হবে না। হয়ওনি।

‘কৃত্তিবাস’-এর সূত্রেই শক্তির সঙ্গে আলাপ এবং শক্তির সূত্র ধরেই ‘হাংরি জেনারেশনে’র সঙ্গে যোগাযোগ। হাংরির প্রতি এই আকর্ষণের কারণটা কী ছিল?

প্রথম কথা, আমি হাংরি জেনারেশনের লেখক নই। যদিও বুলেটিনে হয়তো একবার ২/৪ লাইন লিখেছি কিনা মনে নেই। তাতে হাংরি বলে কিছু ছিল না। যেমন, হাংরি জেনারেশন বলে যদি কোনো আন্দোলন হয়ে থাকে তাতে যোগদান করার কোনো ব্যাপার ছিল না। তবে মলয়রা যাদের ‘হাংরি’ লেখক বলে মনে করেছিল তাদের মধ্যে অবশ্যই আমি একজন। জীবনানন্দ দাশও একজন। সমীর আর শক্তির প্রতি আমার বন্ধুত্ব ছিল। সেই সূত্রেই যেটুকু। কিন্তু সব খবর রাখতামও না। একবার একটা আড্ডায় আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তাহলে কিছু মুখোশ কিনে বিভিন্ন লোককে পাঠানো যাক। ওপর থেকে নিচে সমস্ত স্তরের লোককেই। সে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ই হোক আর সাগরময় ঘোষই হোক। ঠিক হল মুখোশে লেখা থাকবে – ‘মুখোশ খুলে ফেলুন।‘ দ্যাট ওয়াজ মাই আইডিয়া। আর আমার আইডিয়া বলে সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে গিয়ে মুখোশগুলো কিনতে হল। এই রকম সব ঘটনা আর কি। তারপর ওরা যখন অ্যারেস্ট হল তখন আমি বিয়ে করেছি, ৬৪ সালের কথা। সত্যিকথা বলতে কি রীণারা খুবই অভিজাত পরিবারের মেয়ে। এই যেমন ধরো ওর দাদা পাঁচটা আংটি পরে। যারা উত্তর কলকাতায় থাকে। চামড়া রক্তাভ। তা যাইহোক, বিয়ে করে দমদমে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে উঠেছি, এমন সময় একদিন লালবাজার থেকে ডেকে পাঠালেন। আমার কিন্তু সাহস বলতে যা বোঝায়, তা হল ভীরুর সাহস। আমাদের দলে সাহসী বললে বলতে হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। এবং বারবার যে ওর দিকে আকর্ষিত হই তা ওই সাহসের কাছে। আর বাকি সব ভীতুর দল। তখন তো সুনীল এখানে নেই – আইওয়াতে। এদিকে এখানে এরা সব আন্দোলন করেই খালাস। লিখতে যে হবে সে ধান্দা তো নেই। লেখক বলতে যা তা ওই আমি, শক্তি আর উৎপল। আর একজনের কথা বলতে হয়, তাকে হাংরি জেনারেশনই বল আর যাই বল, সে হচ্ছে বাসুদেব দাশগুপ্ত।

সত্যিই, আজও ‘রন্ধনশালা’র গল্পগুলো পড়লে অভিভূত হই।

ওই রকম বই ওই সময় ওই একটাই। তা, বাসুদেব তো লিখলো না। আসলে লেখাটাই হচ্ছে প্রকৃত বিপ্লব করা আর সেটাই করে যেতে হয়। যাই হোক, হাংরি জেনারেশনের একটা সংখ্যা বেরিয়ে গেল পাটনা থেকে যাতে খুবই অশ্লীল লেখাটেখা ছিল। সেই পত্রিকার প্রিন্টার অ্যাণ্ড পাবলিশার হিসাবে ছিল আমার নাম।

 আপনি জানতেন না?

উইদাউট মাই নলেজ – টোটালি। সেইজন্য লালবাজারে গিয়ে আমি বলেছিলাম যে, এই সংখ্যাটা আমি ছাপিনি বা প্রকাশ করিনি। কিন্তু সাক্ষী দেওয়ার সময় মলয়কে সম্পূর্ণভাবে ডিফেণ্ড করি। বলি, সাহিত্যের ক্ষেত্রে এইরকম এক্সপেরিমেন্ট হয়েই থাকে। আজ যা অশ্লীল, পরে তাই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হয়ে দাঁড়ায়। পরে কোনো একটা লেখায় বোধ হয় এই বিষয়টা স্বীকার করেছে সমীর রায়চৌধুরী। তবে সমীর শক্তির বিষয়ে যেটা বলেছে সে ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। যদি সত্যি সত্যি ঘটনাটা ঘটে থাকে তবে তা দুঃখজনক। শক্তি যদি বলে থাকে বিষয়টা সত্যিই অশ্লীল তা হলে যা দাঁড়াচ্ছে সেটা খুব খারাপ।

গিনসবার্গ প্রসংগে জানতে চাই।

হ্যাঁ, গিনসবার্গ। গিনসবার্গের সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্টতা ছিল। বরেনরা টাটাতে গিনসবার্গকে যখন নিয়ে গেল, সুনীল থেকে শুরু করে প্রত্যেককে আমার বেশ পরিস্কার মনে আছে – হাওড়া স্টেশনে প্রত্যেককে আমায় বিদায় দিতে এল। একা আমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরকম ঘটনা জীবনে বহুবার হয়েছে। যখন আনন্দবাজারে ঢুকে গেল শক্তি আর সুনীল, আমি একা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। টাটার ঘটনায় আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। তবুও গিনসবার্গের সঙ্গে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয় বেনারসে। যেখানে আমি, গিনসবার্গ আর পিটার অরলভস্কি ছিলাম। আর কেউ ছিল না। ওরা ওই সময় এক মাসের জন্য বেনারস, এলাহাবাদ এলাকায় ছিল। তখন রোজ দেখা হত। মণিকর্নিকার ঘটে যেতাম। একদিনের কথা তো খুব মনে আছে। জানো তো, ওরা একটু ইয়ে ছিল – মানে, হোমো সেক্সুয়াল ছিল আর কী। গিনসবার্গ তো পিটারের পরিচয়ই দিত মাই ওয়াইফ বলে। একদিন আমি গিয়ে পড়ি। তখন বোধহয় ওরা ব্যস্ত ছিল। তা গিনসবার্গ বেরিয়ে এসে সেই দরাজ অসাধারণ হাসি হেসে বলেছিল – তুমি আর আসবার সময় পেলে না। তবে ওদের সঙ্গে খুব ভাল একটা ডিনার খেয়েছিলাম মনে পড়ে। ওরা তো সেই সময় খুব গরিবের মতন দশাশ্বমেধ বোর্ডিং-এ মাত্র ত্রিশ টাকা ভাড়ায় থাকত। এটা ৬২ সালের ঘটনা। পিটার একটা বাঁধাকপি কিনে আনলো। এককেজি কড়াই শুঁটি, যার দাম ছিল তখন চারআনা। সবাই মিলে তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে ফেলা হল। এর সঙ্গে অবশ্যই টমাটো আর আলুও ছিল। মাখন দিয়ে একটা ডেকচিতে বসিয়ে দিল অ্যালেন। জল বোধহয় দেওয়াই হয় নি বা, নামমাত্র। গিনসবার্গ বলেছিল ওর থেকে যে জল বেরবে তাতেই হবে। তবে মাখন বেশ অনেকটাই দেওয়া হয়েছিল। লেবু আর নুন। আহা, অপূর্ব খেতে হয়েছিল। সঙ্গে ছিল দিশি মদ। বড় অদ্ভূত ভাবে সে সব সময় কেটেছে। আসলে আমি তো বেনারসে গিয়েছিলাম মায়ের সঙ্গে, তো গিনসবার্গকে নিয়ে গেলাম আমাদের ওখানে। মা অনেক কিছু খাওয়ালেন। গিনসবার্গ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এইরকম ঠাকুমার মতন মা পেলে কোত্থেকে?’ সকলেই জানেন গিনসবার্গের মা নাওমি তুলনায় যথেষ্ট ইয়াং ছিলেন। তাঁর পিরিয়ডের উল্লেখ গিনসবার্গের কবিতায় আছে। তুলনায় মা’র শেষ তিরিশের সন্তান আমি। এইরকম অনেক টুকরো স্মৃতি ধরা আছে। যেমন, একবার মণিকর্ণিকার ঘাট থেকে গাঁজা খেয়ে ফিরছি হঠাৎ গিনসবার্গ ফুটপাতে বসে থাকা একটা লোককে দেখিয়ে বলে উঠল, ‘ওই লোকটা নিশ্চই মরে গেছে। ওর হাঁটুটা কিরকম খোলা রয়েছে দেখো। তুমি একটু হাঁটুটা ছুঁইয়ে এসো তো’। আমি সত্যি সত্যি ছুঁলাম। ঐটুকু ছোঁয়াতেই কাঁথা কম্বল সুদ্ধ লোকটা হুড়মুড় করে পড়ে গেল। খুবই অবাক হয়েছিলাম গিনসবার্গের সেই আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে। যাইহোক এরপর তো হিন্দু ইউনির্ভাসিটিতে ওর ওই লেখা পড়বার সময় আবার গোলমাল শুরু হল। অধ্যাপকরা ওর মায়ের পিরিয়ডের জায়গায় আপত্তি করলেন, গিনসবার্গ হঠাৎ বলে উঠল ‘দেন ফাক ইওরসেলফ’। এতে তার ওপরে সব রেগে আগুন। গিনসবার্গের কলার ধরে ঘা কতক দেয় আর কি। কিন্তু সাহেব-মারার দিন বোধহয় অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেকের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটা মিটমাট হয়। কোনমতে আমরা সে জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে আসি।

মিনিবুকের প্ল্যানের পেছনে কারণ কী ছিল?

হ্যাঁ, পুরোটাই আমার একেবারে নিজস্ব ভাবনা বলতে পারো। ডবল ক্রাউন ওয়ান-সিক্সটিন সাইজে ভাঁজ করে মুড়লে যা হয় সেভাবে ছাপা।
আমি ভাবলাম এর মধ্যে একটা গল্প যদি বের করা যায়। তবে এরজন্য আমাকে একটা প্রেস খুঁজতে হয়েছিল, যে প্রেসে এই ১৬টা পাতা একসঙ্গে ‘বর্জাইস’ টাইপে ছাপা যাবে। কারণ, একসঙ্গে না ছাপলে পড়তায় আসে না।

 সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মিনি কবিতার বই ‘লাল রজনীগন্ধা’ নকশালরা পুড়িয়েছিল কেন?

কেন পুড়িয়েছিল তা আমি জানি না। তবে ওখানে সমস্ত কবিতাই হচ্ছে লাল কবিতা। তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যা আনন্দবাজারি ইমেজ তাতে ‘লাল কবিতা’ কেউ বিশ্বাস করবে না, সেইজন্যই ‘লাল রজনীগন্ধা’ নাম দিয়েছিলাম। ওদের হয়তো সেটা পছন্দ হয়নি।

 এটা কি খুব যোগাযোগের মধ্যে থেকেই ঘটেছিল?

না না, ওদের কি কখনও চেনা যায়? কারা করেছিল জানি না। তবে কলেজ স্ট্রিটেই পাতিরামের স্টল থেকে কিছু কপি নিয়ে পুড়িয়েছিল।

কত ছাপা হয়েছিল ‘লাল রজনীগন্ধা’?

৫০০০। পরে ভেবে দেখলাম এভাবে তো ছবিও ছাপা যায়। তখন প্রকাশ কর্মকারের ছবি সহ শক্তির কবিতা ছেপেছিলাম। সেটা বোধহয় এগারো হাজার ছাপা হয়েছিল। বইমেলাতে প্রথম বেরয় পদ্ম ঘোষের কবিতার মিনিবুক। শ্যামবাজারের বিশ্বনাথ বস্ত্রালয়েরর শাড়ির প্যাকেটে চারমিনার আর ওই মিনিবুকগুলো সাজিয়ে, গলায় চুল বাঁধার ফিতে দিয়ে ঝুলিয়ে বিক্রি করা হয়েছিল। লেখা শ্লোগানঃ চার্মিনার অথবা মিনিবুক। দাম ৩০ পয়সা তখন দুটোরই। এতে নিত্যপ্রিয় ঘোষ খুব আপত্তি করেছিনেল। তখনকার নিত্যপ্রিয় ঘোষ আর কি।

আপত্তিটা কী?

‘দাদার বই এভাবে আপনারা বিক্রি করছেন’। তবে আমার নিজের ধারণা শঙ্খ ঘোষের এ পর্যন্ত যত বই বেরিয়েছে তার মধ্যে সব থেকে দ্রুত বিক্রি হয়েছে মিনিবুক। দ্বিতীয় সংস্করণ বইমেলার মধ্যে বেরয় এবং তাও শেষ হয়ে যায়। কোনও স্টলে দিতে হয়নি।

শঙ্খবাবুর কোনো আপত্তি ছিল কি এই মিনিবুক ছাপার ব্যাপারে?

না, না। শঙ্খদা কোনো আপত্তি করেন নি। শঙ্খদার আপত্তি ছিল অন্য জায়গায়। সেটা হচ্ছে শঙ্খদার সেই টাই-পরা ছবি আমি প্রথম ছাপি প্রচ্ছদে।

সত্যি, এই ব্যাপারটা খুবই মজার। ছবিটা পেলেন কোথায়?

উনি তখন আইওয়া থেকে ঘুরে এসেছেন। ওখানেই বোধহয় টাই-পরা কোনো ছবি তুলেছিলেন। আর সেটাই আমি পেয়ে গিয়েছিলাম।
      সাক্ষাৎকার - প্রবীর চক্রবর্তী ও অদ্রীশ বিশ্বাস 





আলোচনা -

. | মৃত‍্যুর নিপুণ শিল্প |
                                    সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

লেখকেরা যদি সাধারণভাবে জীবনানুগত হন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তবে মৃত্যু-অনুগত । 'বিজনের রক্তমাংস' থেকে 'কলেরার দিনগুলিতে প্রেম' যেন এক সম্প্রসারিত এপিটাফ; যখনই আমরা ভাষাপ্রদেশে ভ্রমণ করেছি তাঁর সান্নিধ্যে, তখনই আমাদের চক্ষু স্পর্শ করেছে সেই বাঙ্ময় সমাধিলিপি । মৃত্যু যা অমরতার সমায়তন, যা সমুদ্র-সমান, তা এই লেখকের প্রধান পরীক্ষা আজীবন । যারা তাঁর সহজীবী, যারা জড়ের সন্ততি, মৃত্যুভয় থেকে যারা পরিত্রাণ চেয়েছে মিথুনে, এই লেখকের তাদের পক্ষে আধুনিক নচিকেতা-প্রতিম; সন্দীপনের রচনায় শ্রেষ্ঠ মুহূর্তসমূহ আসলে যমালয়ে রাত্রিযাপন । ছোট এই ভূমিকাটুকু আমাকে করে নিতে হল কেননা যে সমস্ত লেখককে আমরা সাম্প্রতিককালে ভুল বুঝেছি প্রায় সফলভাবে, সন্দীপন তাঁদের অন্যতম । ভাষা-লাবণ্যের দাহ্যসুখে তিনি মজে যেতে চান না মোটেই, বরং, প্যাস্টোরাল গদ্যের নির্মনন স্থূলতাকে প্রত্যাখ্যান করে পৌঁছে যেতে চান উৎস এবং আত্মায় । আমাদের আলোচ্য 'হিরোশিমা মাই লাভ' এই অভিযানের অংশ কিন্তু অন্তর্গত গাম্ভীর্যে ধ্রুপদী । সন্দীপনের রচনাবলীর চেয়ে পৃথক ও স্পষ্ট একটি ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আছে । আর প্রচ্ছন্ন নয়, মৃত্যু এসে নিঃশ্বাস ফেলেছে এই উপন‍্যাসের শিয়রে। প্যারিস সমীপে র‍্যাবোঁ যেমন, নিউইয়র্ক সমীপে লোরকা যেমন, জীবনানন্দের পক্ষে কলকাতা যেমন এক সাতটি তারার তিমির, সন্দীপনের পক্ষে ক্যালিফোর্নিয়া তেমনই আদিঅন্তহীন এক নরক পরিক্রমা । মোটর দুর্ঘটনাজনিত যে আত্মীয় বিয়োগ এই কাহিনীর নায়ক হিরণ চ‍্যাটার্জিকে প্রাতিস্বিক হলোকস্টের দিকে টেনে নেয়, সেই অভিজ্ঞতাটুকুই সন্দীপনকে পরিচালিত করে সভ‍্যতার শোণিতগন্ধী উৎসব উদ্বোধনে। আর সম্ভবত নামকরণে অ্যাল‍্যাঁ রেনের অতিখ‍্যাত চলচ্ছবিটির উল্লেখ সেইজন‍্যেই । একান্ত ব্যক্তিগত অনুষঙ্গে জারিত বলেই হয়তো এই গ্রন্থের রচয়িতা পরিহাসমদির নন, পরিহার করেছেন তাঁর পক্ষে যা করতলধৃত আমলকী—মেধার সেই বঙ্কিম চিত্রলেখ ও সপ্রতিভতা । এই রচনার শরীরে প্রথম স্তরের বাস্তবতা, অন্তরালবর্তী প্রপাতধ্বনির সম্ভ্রম, অনুপুঙ্খের প্রতি বিপুল আনুগত‍্য আমাদের বিস্মিত করে । তথ্যচিত্রপ্রণেতা গ্রিয়ার্সন যাকে বলেন 'creative treatment of actuality' -তা ছড়িয়ে আছে এ লেখার পরতে পরতে । এমনকি সন্দীপন যখন স্বপ্নে প্রবেশ করেন তখনও সে স্বপ্নের কোনও ওষ্ঠ নেই, উচ্চারণ নেই । এই সূত্রে আমরা যদি সন্দীপনকে ধারাভাষ্যকার হিসেবে চিহ্নিতও করি, তথাপি তিনি আমাদের সাহিত্যের পক্ষে অগ্রণীপুরুষ । কেননা, তাঁর বর্ণনা কোয়ান্টাম প্রকৃতির; সেখানে সময়ের কোনও দেওয়াল নেই । যেন এক আধুনিক সঞ্জয় উন্মোচন করলেন নশ্বরতার সৌন্দর্য ও আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম অতীত ও ভবিষ্যতের প্রতিমুখী বিক্রিয়ায়; জানলাম বর্তমান হচ্ছে তাদেরই ব‍্যক্ত অস্তিত্ব । একদিকে সাদা গ্রানাইটের প্রাকৃতিক সমাধিফলক — আল কাপিনো, অন্যদিকে নিয়তির মতো অব‍্যর্থ এক সুরযন্ত্র: অপার এই অক্ষরেখাদ্বয়ের মধ্যে সংক্ষিপ্ত এই উপন্যাস যে কী কারুকার্যময়! ঘটনাস্থল আমেরিকা—এমন এক ভূখণ্ড যেখানে সম্পদের দারিদ্র্য, সে আলোর অপেরাতে পেট্রোডলারের বিষাদপ্রতিমা ও ঝকঝকে দুপুরেও রোরুদ‍্যমানিনী । পাত্রপাত্রীরা জীবিতের ছদ্মবেশে মাংসমণ্ডিত কঙ্কাল । হিরণের ভাতৃবধূ প্রিয়দর্শিনী ককতোর 'অরফি'র সেই নায়িকা নাকি, যে স্বর্ণমৃগের পশ্চাদ্ধাবনরত স্বামীর পথের নিশানা বদলে হাতছানি দিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে যায় সর্বনাশে, বিস্ফোরণে । সঙ্গে থাকে জীয়ন যে অমঙ্গলের এই অকূল সমুদ্রে শিশু বলেই এক বিন্দু শুদ্ধতা । তার তো সংলাপ নেই, সে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খায়নি; সে পতিত নয় । সন্দীপনের অন‍্যতম প্রধান সংকট যে তিনি নিজের অবিশ্বাসকেও বিশ্বাস করেন না । কিন্তু 'হিরোশিমা মাই লাভ' যাঁরা পড়বেন তাঁদের সৌভাগ্য লেখকের অবিশ্বাস এখানে কপটতা করে পথভ্রষ্ট হয়নি; নিজেকে বিশ্বাস করেছে । 'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট' উপন্যাসের শেষদিকে যেমন একটি খুনি ও জনৈক বেশ‍্যা লাজারাস পঠনে মনোযোগী, এই লেখা শেষদিকে সেভাবেই হাত রাখে ইতিহাসের জ্বরতপ্ত ললাটে । যে পাখিটির আঙুল দিয়ে গান গাওয়ার কথা ছিল সে যখন উপায়হীন, সারা বুক আঁচড়ে রক্ত ঝরায়, স্বেচ্ছাচারী সেই উন্মাদ কিশোর যখন সনাক্ত করে, তখন সন্দীপন পাখিটিকে উড়িয়ে দেন না বরং নতমুখে অপরাধ স্বীকার করে নেন । ভুলের থেকে, পাপের থেকে, অন্ধ দুর্দশার থেকে পুনরুত্থানের সম্ভাবনা চেতনায় রয়ে গেছে তাহলে! বৃষ্টিশেষের কনে-দেখা আলো ছড়িয়ে পড়ে হিরোশিমার ধ্বংসস্থলে । তুলনামূলক সমালোচনায় স্মরণ করা যেতেই পারে টমাস মান -এর 'ম্যাজিক মাউন্টেন' বা কমলকুমার মজুমদার প্রণীত 'গোলাপ সুন্দরী' প্রসঙ্গ । সে বিষয়ে মুখর না হয়েও আমার বরং বিনীতভাবে মনে হয় যেমন ছিলেন বোদলেয়ার যুগপৎ হিন্দু ও ইয়াঙ্কি, হিরোশিমার মনোপ্রবণতাও তেমন দ্বান্দ্বিক অর্থাৎ বিপরীতের সমন্বয়ধর্মী । সন্দীপন এখানে যুগপৎ আক্রমণকারী ও আক্রান্ত, ঘাতক ও শহিদ, হিংস্র ও স্নেহপরায়ণ, বিচারক ও দণ্ডিত । অমিত্রাক্ষর ছন্দ যেমন বিষণ্ণভাবে শেষ হয়, সন্দীপন অনুরূপভাবে প্রবীণ ও বিধুর হয়েছেন হিরোসিমায় । নেই সেই শাহরিক চাতুরালি, বিদায় নিয়েছে প্রদর্শনবাদ । একজন বাঙালি পুরুষ যখন দূর সিন্ধুতীরে শবানুগমন করেন আমাদের অস্তিত্ব জুড়ে বেজে ওঠে স্নানশব্দ । মণীষার আমিষগন্ধ, সময়ের নৃত‍্যরত গোড়ালি—বর্ণমালার তত্ত্বাবধানে কি বিরাট অগ্নিশিল্পের আয়োজন! প্রশ্ন থেকে যায় সরলরেখা-প্লট-ন‍্যারেশনে থমকে থাকা আমাদের মগজের পরিকাঠামো সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের রাতের কড়া নাড়ার ধ্বনি শুনতে পাবে তো ?

উপন্যাস: হিরোসিমা, মাই লাভ
প্রথম প্রকাশ: শারদীয় আজকাল ১৩৯৫ (১৯৮৮)

[সংযুক্ত ছবিগুলির জন‍্য কৃতজ্ঞতা প্রবীর চক্রবর্তীকে]
={{{{{{{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}}}}}}}}==