Thursday, 28 July 2022

মহাপ্রয়াণ দিবস। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী । Vol -811. Dt -29.07.2022. ১১শ্রাবণ,১৪২৯. বৃহস্পতিবার। The blogger in literature e-magazine.

মহাশ্বেতা দেবী

"আমি সর্বদাই বিশ্বাস করি যে, সত্যকারের ইতিহাস সাধারণ মানুষের দ্বারা রচিত হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাধারণ মানুষ যে লোককথা, লোকগীতি, উপকথা ও কিংবদন্তিগুলি বিভিন্ন আকারে বহন করে চলেছে, তার পুনরাবির্ভাবের সঙ্গে আমি ক্রমাগত পরিচিত হয়ে এসেছি। ... আমার লেখার কারণ ও অনুপ্রেরণা হল সেই মানুষগুলি যাদের পদদলিত করা হয় ও ব্যবহার করা হয়, অথচ যারা হার মানে না। আমার কাছে লেখার উপাদানের অফুরন্ত উৎসটি হল এই আশ্চর্য মহৎ ব্যক্তিরা, এই অত্যাচারিত মানুষগুলি। অন্য কোথাও আমি কাঁচামালের সন্ধান করতে যাব কেন, যখন আমি তাদের জানতে শুরু করেছি? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার লেখাগুলি আসলে তাদেরই হাতে লেখা. "

২০১৬ সালের ২৩ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কোলকাতা বেল ভিউ ক্লিনিকে ভর্তি হন। সেই বছরই ২৮ জুলাই একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে তার মৃত্যু ঘটে তিনি মধুমেহ


পুরস্কার

১৯৭৯: সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (বাংলা): – অরণ্যের অধিকার (উপন্যাস)
১৯৮৬: সমাজসেবায় পদ্মশ্রী
১৯৯৬: জ্ঞানপীঠ পুরস্কার – ভারতীয় জ্ঞানপীঠ কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার
১৯৯৭: রামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার – সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সৃজনশীল যোগাযোগমূলক শিল্পকলা (“ভারতের জাতীয় জীবনে উপজাতিদের ন্যায়সম্মত ও সম্মানজনক স্থান অর্জনের দাবিতে শিল্পকলা ও আন্দোলনের মাধ্যমে সহানুভূতিপূর্ণ সংগ্রাম চালানোর” জন্য)
২০০৩: অফিসার দেল’ অর্ডার দেস আর্টস এত দেস লেটার্স
২০০৬: পদ্মবিভূষণ – ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা
২০০৭: সার্ক সাহিত্য পুরস্কার
২০০৯: ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন
২০১০: যশবন্তরাও চবন জাতীয় পুরস্কার 
২০১১: বঙ্গবিভূষণ – পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা

                 ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা শহরে মহাশ্বেতা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা মণীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মনামে লিখতেন। মণীষ ঘটকের ভাই ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। মহাশ্বেতা দেবীর মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন লেখক ও সমাজকর্মী। তার ভাইয়েরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ছিলেন। যেমন, শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর এবং শচীন চৌধুরী ছিলেন দি ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মহাশ্বেতা দেবীর বিদ্যালয়-শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঢাকা শহরেই। ভারত বিভাজনের পর তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠভবনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

মহাশ্বেতা দেবী ১০০টিরও বেশি উপন্যাস এবং ২০টিরও বেশি ছোটোগল্প সংকলন রচনা করেছেন। তিনি মূলত বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। তবে সেই সব রচনার মধ্যে অনেকগুলি অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার প্রথম উপন্যাস ঝাঁসির রানি ঝাঁসির রানির (লক্ষ্মীবাই) জীবনী অবলম্বনে রচিত। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। এই উপন্যাসটি রচনার আগে তিনি ঝাঁসি অঞ্চলে গিয়ে তার রচনার উপাদান হিসেবে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে তথ্য ও লোকগীতি সংগ্রহ করে এনেছিলেন।

১৯৬৪ সালে মহাশ্বেতা দেবী বিজয়গড় কলেজে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত কলেজ) শিক্ষকতা শুরু করেন। সেই সময় বিজয়গড় কলেজ ছিল শ্রমিক শ্রেণির ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই সময় মহাশ্বেতা দেবী একজন সাংবাদিক ও একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবেও কাজ চালিয়ে যান। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোধা ও শবর উপজাতি, নারী ও দলিতদের নিয়ে পড়াশোনা করেন। তার প্রসারিত কথাসাহিত্যে তিনি প্রায়শই ক্ষমতাশালী জমিদার, মহাজন ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি আধিকারিকদের হাতে উপজাতি ও অস্পৃশ্য সমাজের অকথ্য নির্যাতনের চিত্র অঙ্কন করেছেন। 

উত্তর-ঔপনিবেশিক গবেষক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক মহাশ্বেতা দেবীর ছোটোগল্পগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করে তিনটি গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন। এগুলি হল ইম্যাজিনারি ম্যাপস (১৯৯৫, রুটলেজ), ওল্ড ওম্যান (১৯৯৭, সিগাল) ও দ্য ব্রেস্ট স্টোরিজ (১৯৯৭, সিগাল)।
বহুবার ভারতের উপজাতি মানুষদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।[৩] ২০১৬ সালের জুন মাসে মহাশ্বেতা দেবীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়খণ্ড সরকার বিশিষ্ট আদিবাসী নেতা বিরসা মুন্ডার একটি মূর্তিকে শৃঙ্খলামুক্ত করে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের শাসনকালে গৃহীত শৃঙ্খলিত বিরসা মুন্ডার একটি আলোকচিত্রের ভিত্তিতে মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, বিরসা মুন্ডার জীবনকাহিনি অবলম্বনে ১৯৭৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী অরণ্যের অধিকার উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন।

মহাশ্বেতা দেবী পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) (সিপিআই(এম))-নেতৃত্বাধীন সরকারের শিল্পনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিশেষত, তিনি কৃষকদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে উর্বর কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে তা অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে শিল্পপতিদের দিয়ে দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেন। ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করেন। এই নির্বাচনে পরাজিত হয়ে সিপিআই(এম)-এর ৩৪ বছর ব্যাপী শাসনকালের অবসান ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে তিনি প্রথম জীবনে কয়েক বছর অতিবাহিত করেছিলেন। সেই শান্তিনিকেতনের বাণিজ্যিককরণের বিরোধিতা করেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের বিতর্কিত জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, লেখক ও নাট্যকর্মীকে একত্রিত করেন।

২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুট বইমেলায় ভারত দ্বিতীয় বারের জন্য অতিথি দেশ নির্বাচিত হয়। ভারতই প্রথম দেশ হিসেবে এই মেলায় দুইবার অতিথি দেশ নির্বাচিত হয়। এই মেলার উদ্বোধনী ভাষণে মহাশ্বেতা দেবী রাজ কাপুরের বিখ্যাত চিত্রগীতি "মেরা জুতা হ্যায় জাপানি" থেকে পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করে একটি আবেগময় ভাষণ দেন: {{cquote|সত্যই এটি এমন এক যুগ যেখানে ‘জুতা’টি (জুতো) জাপানি, ‘পাতলুন’টি (প্যান্ট) ‘ইংলিশস্তানি’ (ব্রিটিশ), ‘টোপি’টি (টুপি) ‘রুসি’ (রাশিয়ান), কিন্তু ‘দিল’... ‘দিল’টি (হৃদয়) সর্বদা ‘হিন্দুস্তানি’ (ভারতীয়)... আমার দেশ, ক্ষয়প্রাপ্ত, ছিন্নভিন্ন, গর্বিত, সুন্দর, উষ্ণ, আর্দ্র, শীতল, ধূলিধূসরিত, উজ্জ্বল ভারত। আমার দেশ।

১৯৪৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী বিশিষ্ট নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পথপ্রদর্শক। ১৯৪৮ সালে তাদের পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্ম হয়। নবারুণ ভট্টাচার্য পরবর্তীকালে ঔপন্যাসিক ও রাজনৈতিক সমালোচক হয়েছিলেন। মহাশ্বেতা দেবী একটি ডাকঘরেও চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার কমিউনিস্ট মনোভাবের জন্য তাকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য সাবান বিক্রয় এবং নিরক্ষরদের জন্য ইংরেজিতে চিঠি লিখে দেওয়ার মতো কাজও করেছেন। এরপর তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৬২ সালে তিনি অসিত গুপ্তকে বিবাহ করেন।

 উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি.

ঝাঁসির রানি (১৯৫৬, জীবনী)
দ্য কুইন অফ ঝাঁসি, মহাশ্বেতা দেবী (সাগরী ও মন্দিরা সেনগুপ্ত কর্তৃক অনূদিত)। এই বইটি হল রানি লক্ষ্মীবাইয়ের জীবনীগ্রন্থ। ঐতিহাসিক নথিপথ (প্রধানত রানির পৌত্র জি. সি. তাম্বে কর্তৃক সংগৃহীত) এবং লোককথা, কাব্য ও মুখে মুখে প্রচলিত কিংবদন্তিগুলি নিয়ে গবেষণার পর বইটি রচিত হয়। মূল বাংলা বইটি ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি অনুবাদটি ২০০০ সালে সিগাল বুকস, ক্যালকাটা থেকে প্রকাশিত হয়।
হাজার চুরাশির মা (১৯৭৪, উপন্যাস)
অরণ্যের অধিকার (১৯৭৯, উপন্যাস)
অগ্নিগর্ভ (১৯৭৮, ছোটোগল্প সংকলন)
মূর্তি (১৯৭৯, ছোটোগল্প সংকলন)
নীড়েতে মেঘ (১৯৭৯, ছোটোগল্প সংকলন)
স্তন্যদায়িনী (১৯৮০, ছোটোগল্প সংকলন)
চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর (১৯৮০, ছোটোগল্প সংকলন)
চলচ্চিত্রায়ন

সংঘর্ষ (১৯৬৮), লায়লি আসমানের আয়না ছোটোগল্পটি অবলম্বনে নির্মিত হিন্দি চলচ্চিত্র
রুদালি (১৯৯৩)
হাজার চৌরাসি কি মা (১৯৯৮)
মাটি মায় (২০০৬),' 'দায়েঁ ছোটোগল্পটি অবলম্বনে নির্মিত মারাঠি চলচ্চিত্র।
গাঙ্গোর (২০১০), চোলি কে পিছে ছোটোগল্পটি অবলম্বনে নির্মিত ইতালীয় চলচ্চিত্র .
====[][[}}][[{[]✓==°{}{=×¶{✓✓{}}[]]}]]]]]}]]]]]]}}




Wednesday, 27 July 2022

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। গারট্রুড স্টেইন।মার্কিন ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার ও শিল্প সংগ্রাহক। Vol -810 , ১০ শ্রাবণ ১৪২৯. Dt -27.07.2022. বুধবার। The blogger in literature e-magazine


গারট্রুড স্টেইন 


মৃত্যু _ জুলাই ২৭, ১৯৪৬ (বয়স ৭২) নোইলি-সুর-সিন, ফ্রান্স। 


১৯৩৩ সালে স্টেইন তার প্যারিসের জীবন নিয়ে একটি খণ্ড-স্মৃতিকথা দি অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যালিস বি. টোকলাস প্রকাশ করেন, যা তার সঙ্গী অ্যালিস বি. টোকলাসের বর্ণনায় বিবৃত হয়েছে। বইটি সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় এবং স্টেইনকে কাল্ট-সাহিত্যের তুলনামূলক অস্পষ্টতা থেকে মূলধারার দৃষ্টি আকর্ষণে ভূমিকা পালন করে। তার দুটি উক্তি সর্বত্র পরিচিতি লাভ করে: "গোলাপ হল গোলাপ হল গোলাপ হল গোলাপ" এবং "কোন কিছু নেই", দ্বিতীয় উক্তিটি তার ওকল্যাণ্ডের বাড়িকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়।[১]

তার অন্যান্য বই হল তার বান্ধবী ফের্নহার্স্টসহ আরও কয়েকজন সমকামী নারীর প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে কিউ.ই.ডি. (১৯০৩), কল্পনাধর্মী ত্রিকোণ প্রেমের গল্প থ্রি লাইভস (১৯০৫-০৬), ও দ্য মেকিং অব আমেরিকান্স (১৯০২-১১)। টেন্ডার বাটন্স (১৯১৪) বইতে স্টেইন সমকামী নারীর যৌনতা নিয়ে মন্তব্য করেন।
অ্যালিস বেবেট টোলকাস তার জীবনের সঙ্গী ছিলেন। 
লেসবিয়ান গারট্রুড স্টেইন ছিলেন প্যারিসের সবচেয়ে পরিচিত বিত্তশালী নারী। গারট্রুড স্টেইন হলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ফ্রেন্ড ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’। অর্থসাহায্য থেকে শুরু করে হেমিংওয়ে দম্পতিকে প্রবাসজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য তিনি সাগ্রহে এগিয়ে এসেছেন, প্যারিসের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁকে পরিচিত করিয়েছেন। প্যারিসে লেখালেখির জগতে কেমন করে এগোতে হবে এবং এমনকি কেমন হতে হবে যৌনজীবন, হেমিংওয়েকে দিয়েছেন সে তালিমও। ১৯৩৩ সালে স্টেইন তার প্যারিসের জীবন নিয়ে একটি খণ্ড-স্মৃতিকথা দি অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যালিস বি. টোকলাস প্রকাশ করেন, যা তার সঙ্গী অ্যালিস বি. টোকলাসের বর্ণনায় বিবৃত হয়েছে। বইটি সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় এবং স্টেইনকে কাল্ট-সাহিত্যের তুলনামূলক অস্পষ্টতা থেকে মূলধারার দৃষ্টি আকর্ষণে ভূমিকা পালন করে। তার দুটি উক্তি সর্বত্র পরিচিতি লাভ করে: "গোলাপ হল গোলাপ হল গোলাপ হল গোলাপ" এবং "কোন কিছু নেই", দ্বিতীয় উক্তিটি তার ওকল্যাণ্ডের বাড়িকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। তার অন্যান্য বই হল তার বান্ধবী ফের্নহার্স্টসহ আরও কয়েকজন সমকামী নারীর প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে কিউ.ই.ডি. (১৯০৩), কল্পনাধর্মী ত্রিকোণ প্রেমের গল্প থ্রি লাইভস (১৯০৫-০৬), ও দ্য মেকিং অব আমেরিকান্স (১৯০২-১১)। টেন্ডার বাটন্স (১৯১৪) বইতে স্টেইন সমকামী নারীর যৌনতা নিয়ে মন্তব্য করেন। আজ এই কথাসাহিত্যেকের ১৪৬তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৭৪ সালের আজকের দিনে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সিলভেনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। মার্কিন ঔপন্যাসিক, কবি, ও নাট্যকার গারট্রুড স্টেইনের জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।



গারট্রুড স্টেইন ছিলেন একজন মার্কিন ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার ও শিল্প সংগ্রাহক।
৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৪ সালে এর ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌জন্ম ।
ন্আমদন্লেঘেনি, পেন্সিলভেনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিট্‌সবার্গের নিকটবর্তী আলেঘেনি ওয়েস্টে জন্মগ্রহণকারী স্টেইন ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যাণ্ডে বেড়ে ওঠেন এবং ১৯০৩ সালে প্যারিস চলে যান। বাকি জীবন তিনি সেখানেই কাটান। তিনি প্যারিস সালুনের মালিক ছিলেন, যেখানে সাহিত্য ও শিল্পকলার আধুনিকতাবাদী প্রধান ব্যক্তিত্বরা, যেমন পাবলো পিকাসো, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ. স্কট ফিট্‌জেরাল্ড, সিনক্লেয়ার লুইস, এজরা পাউন্ড, শেরউড অ্যান্ডারসন, অঁরি মাতিস, মিলিত হয়েছিলেন। 

পিট্‌সবার্গের নিকটবর্তী আলেঘেনি ওয়েস্টে জন্মগ্রহণকারী স্টেইন ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যাণ্ডে বেড়ে ওঠেন। স্টেইন ১৮৯৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে র‌্যাডক্লিফ কলেজ থেকে স্নাতক হন। কলেজে থাকাকালীন স্টেইন উইলিয়াম জেমসের অধীনে মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন করেছিলেন (এবং তার ধারণাগুলিতে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত থাকতেন)। তিনি মর্যাদাপূর্ণ জন হপকিন্স মেডিকেল স্কুলে মেডিসিন পড়তে গিয়েছিলেন। ১৯০৩ সালে স্টেইন তার ভাই লিওর সাথে থাকার জন্য ফ্রান্সের প্যারিসে চলে এসেছিলেন, সেখানে তারা পোস্ট-ইমপ্রেশনবাদী পেইন্টিং সংগ্রহ শুরু করেছিলেন । বাকি জীবন তিনি সেখানেই কাটান। স্টেইন এবং লিও ২৭ রুয়ে ডি ফ্লিউরাস-তে একটি বিখ্যাত সাহিত্য ও শৈল্পিক সেলুন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে সাহিত্য ও শিল্পকলার আধুনিকতাবাদী প্রধান ব্যক্তিত্বরা, যেমন পাবলো পিকাসো, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ. স্কট ফিট্‌জেরাল্ড, সিনক্লেয়ার লুইস, এজরা পাউন্ড, শেরউড অ্যান্ডারসন, অঁরি মাতিস নিয়মিত মিলিত হতেন। লিও ১৯১২ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে চলে আসেন। টোকলা এবং স্টেইন আজীবনের সহচর হয়ে ওঠেন। ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে স্টেইন বেশ কয়েক বছর ধরে লেখালেখি করেছিলেন এবং তাঁর অভিনব রচনাগুলি প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন: থ্রি লাইভ (১৯০৯), টেন্ডার বোতাম: অবজেক্টস, ফুড, রুমস (১৯১৪) এবং মেকিং অব আমেরিকানস: ইতিহাসের ইতিহাস পরিবারের অগ্রগতি (লিখিত ১৯০৬–১৯১১; প্রকাশিত ১৯২৫। 
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, স্টেইন তার নিজের ফোর্ড ভ্যান কিনেছিলেন এবং তিনি এবং টোকলা ফরাসীদের এম্বুলেন্স ড্রাইভার হিসাবে কাজ করেছিলেন। যুদ্ধের পরে, তিনি তার সেলুনটি বজায় রেখেছিলেন (যদিও ১৯২৮ সালের পরে তিনি বছরের বেশিরভাগ সময় বিলিগিন গ্রামে কাটিয়েছিলেন, এবং ১৯৩৭ সালে তিনি প্যারিসের আরও আড়ম্বরপূর্ণ স্থানে চলে এসেছিলেন। এবং আমেরিকান প্রবাসীদের জন্য উভয়ই হোস্টেস এবং অনুপ্রেরণার ভূমিকা পালন করেছিলেন। শেরউড অ্যান্ডারসন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং এফ স্কট ফিটজগারেল্ড হিসাবে ("লস্ট জেনারেশন" শব্দটি তৈরির জন্য তিনি কৃতিত্ব অর্জন করেছেন)। তিনি ১৯২৬ সালে ইংল্যান্ডে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন এবং তার একমাত্র বাণিজ্যিক সাফল্য, দ্য অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যালিস বি টোকলাস (১৯৩৩) প্রকাশ করেছিলেন, যা তিনি টোকলার দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছিলেন। স্টেইন ১৯৩৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফর করেছিলেন তবে তিনি ফ্রান্সে ফিরে এসেছিলেন। ১৯৪৪ সালে প্যারিস মুক্ত হওয়ার পরে, তিনি অনেক আমেরিকানদের সাথে দেখা করেছিলেন। তার পরবর্তী উপন্যাস এবং স্মৃতিকথা ছাড়াও, তিনি ভার্জিল থমসনের দুটি অপেরা: তিনটি আইন (১৯৩৪) ও দ্য মাদার অব ইউ অল (১৯৪৪) এর দুটি অপেরাতে লিবারেটস লিখেছিলেন। ১৯৪৬ সালের ২৭ জুলাই ফ্রান্সের নিউইলি-সুর-সেইনে মারা যান। যদিও স্টেইনের বিভিন্ন লেখায় সমালোচনামূলক মতামত বিভক্ত করা হয়েছে, তবুও তাঁর দৃঢ় ও মজাদার ব্যক্তিত্বের চিত্রটি সমকালীন সাহিত্যে তার প্রভাবের মতোই টিকে আছে। আজ এই কথাসাহিত্যেকের ১৪৬তম জন্মবার্ষিকী। 

কবর স্থান: সিমতিয়ের দু পের লাশেজ, প্যারিস, ফ্রান্স
প্রভাব রেখেছেন: পাবলো পিকাসো, পল সেজান, জর্জ সান্তায়ানা, অটো ভাইনিঙ্গার, উইলিয়াম জেমস
বাবা ও মা: ড্যানিয়েল স্টেইন, এমেলিয়া স্টেইন
ভাইবোন: লিও স্টেইন, মাইকেল স্টেইন।
==={{{{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}{}


Monday, 25 July 2022

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। মোহিতলাল মজুমদার - বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক সমালোচক। Vol -809. Dt -26.07.2022. ৯ শ্রাবণ,১৪২৯. মঙ্গলবার। The blogger in literature e-magazine.

মোহিতলাল মজুমদার

মৃত্যু ২৬শে জুলাই, ১৯৫২ সালে করোনারি থ্রম্বসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। কলকাতা। 
মোহিতলাল মজুমদার সৃজনধর্মী সাহিত্য সমালোচক ও প্রবন্ধকাররূপে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেন। তিনি একজন নিপুণ ও শব্দ সচেতন কবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশাতেই তার কাব্য আপন বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। নজরুল ইসলামের পূর্বে আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক প্রয়োগ তার রচনায়ই বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভাবে ও ভাষায় প্রচলিত কাব্যরীতিতে মোহিতলাল ছিলেন বিদ্রোহীস্বরূপ। বাংলা সাহিত্যের দেহাত্মবাদী কবি হিসেবে তার রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। তার কাব্যে ক্লাসিক্যাল ভঙ্গি এবং রোমান্টিক ভাবের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তার মানস-লক্ষ্মী কবিতার প্রথম কয়েকটি পঙ্‌ক্তি নিম্নরূপ--

আমার মনের গহন বনে
পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী
নারী-অপ্সরী সঙ্গোপনে!
ফুলেরি ছায়ায় বসে তার দুই চরণ মেলি
বিজন-নিভৃতে মাথা হতে দেয় ঘোমটা ফেলি,
শুধু একবার হেসে চায় কভু
নয়ন কোণে,
আমারি মনের গহন বনে।

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই তিনি বিতর্কিত সাহিত্য-প্রতিভার কাব্য আপন বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বঙ্গসাহিত্য প্রসঙ্গে মোহিতলাল সৃজনধর্মী ও সৃষ্টিশীল আলোচনা করে গেছেন। অনেক মাসিক পত্রিকায়, বিশেষ করে ভারতীতে কবিতা লিখতেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গদর্শন পত্রিকা তৃতীয় পর্যায়ে প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। শনিবারের চিঠির নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে 'কৃত্তিবাস ওঝা', 'চামারখায়-আম', 'সব্যসাচী', 'সত্যসুন্দর দাস' ছদ্মনামে লিখতেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকা

কাব্যগ্রন্থ

দেবেন্দ্র-মঙ্গল (১৯১২)
স্বপন-পসারী (১৯২২)
বিস্মরণী (১৯২৭)
স্মরগরল (১৯৩৬)
হেমন্ত-গোধূলি (১৯৪১)
ছন্দ চতুর্দশী (১৯৪১) (সনেট সঙ্কলন)
কাব্য মঞ্জুষা
তন্মধ্যে - 'দেবেন্দ্র-মঙ্গল' কাব্যগ্রন্থটি ছিল আত্মীয় ও কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রশস্তিমূলক ১৬টি সনেটের সঙ্কলন।

প্রবন্ধগ্রন্থ

আধুনিক বাংলা সাহিত্য (১৯৩৬)
সাহিত্যকথা (১৯৩৮)
বিবিধ কথা (১৯৪১)
বিচিত্র কথা (১৯৪১)
সাহিত্য বিতান (১৯৪২)
বাঙলা কবিতার ছন্দ (১৯৪৫)
বাঙলার নবযুগ (১৯৪৫)
জয়তু নেতাজী (১৯৪৬)
কবি শ্রীমধুসূদন (১৯৪৭)
সাহিত্য বিচার (১৯৪৭)
বঙ্কিমবরণ (১৯৪৯)
রবি-প্রদক্ষিণ (১৯৪৯)
শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্র (১৯৫০)
জীবন জিজ্ঞাসা (১৯৫১)
বাঙলা ও বাঙালী (১৯৫১)
কবি রবীন্দ্র ও রবীন্দ্র কাব্য (প্রথম খণ্ড ১৯৫২, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৫৩)
বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস (১৯৫৫)
বিবিধ প্রবন্ধ
বঙ্কিম বরণ (১৯৪৯)

গ্রন্থপঞ্জী

বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, সুকুমার সেন, ৪র্থ খণ্ড, ১ম সংস্করণ, বর্ধমান সাহিত্য সভা, কলকাতা, ১৯৫৮ইং
বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল, আজাহারউদ্দীন খান, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ

 পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত বলাগড় গ্রাম জন্ম ২৬শে অক্টোবর, ১৮৮৮।তাঁর বাবার নাম নন্দলাল মজুমদার এবং তাঁর মাতার নাম হেমমালা দেবী। নন্দলাল ছিলেন কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের জ্ঞাতি ভাই৷ মোহিতলালের কৈশোর এবং বিদ্যালয়জীবন বলাগড় গ্রামেই অতিবাহিত হয়। তিনি চব্বিশ পরগণা জেলায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি কিছুদিন কাঁচড়াপাড়ার কাছে হালিশহরে মায়ের মামাবাড়িতে অবস্থান করে সেখানকার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। মোহিতলাল চার-পাঁচ বছর বয়সে কাশীরাম দাসের মহাভারতের সঙ্গে পরিচিত হন। নয় বছর বয়সে তার রোমান্স পাঠে আগ্রহ জন্মায়। বারো-তেরো বছর বয়সে পলাশীর যুদ্ধ এবং মেঘনাদ বধ কাব্য পড়ে শেষ করেন।
বলাগড় বিদ্যালয় থেকে ১৯০৪ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৯০৮ সালে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে বি.এ পাস করেন। কিন্তু অসুবিধায় পড়ে এম.এ পড়া ছেড়ে দেন। ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার তালতলা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯১৪ সালে সরকারি জরিপ বিভাগে কানুনগো পদে চাকরি গ্রহণ করেন। তিন বছর তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পুনরায় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা কর্মে নিয়োজিত থাকেন। ১৯৪৪ সালে অধ্যাপনার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন মোহিতলাল। তারপর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। পরে বঙ্গবাসী কলেজে গিরিশ সংস্কৃতি ভবনে অধ্যাপনায় যোগ দেন। 
             মানসী পত্রিকাতে তার সাহিত্যজীবনের সূত্রপাত হয়। বীরভূমি পত্রিকায় কবিতা প্রবন্ধ অনুবাদ প্রকাশ করেন। দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে তার কাব্যচর্চায় দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব দেখা যায়। এছাড়াও, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় এর কবিতার ছন্দোমাধুর্য তাকে মুগ্ধ করেছিল। মোহিতলাল কিছুকাল ভারতী গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক ছিলেন। তিনি শনিচক্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্র পরবর্তী কাব্যে কবি মোহিতলালের স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য-সমালোচক হিসাবেও তার সবিশেষ খ্যাতি ছিল। ভাষারীতির বিশুদ্ধতা নিয়ে তার প্রবল আগ্রহ ও নিষ্ঠা ছিল।কবি ও প্রবন্ধকাররূপে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেন। 


Sunday, 24 July 2022

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ। Vol -808. Dt - 25.07.2022. ৮ শ্রাবণ, ১৪২৯. সোমবার। The blogger in literature e-magazine

স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ

মৃত্যু - ২৫ জুলাই ১৮৩৪ (বয়স ৬১)হাইগেট, ইংল্যান্ড

১৭৭২ সালের ২১ অক্টোবর ইংল্যাণ্ডের ডেভনশায়ারের অটারি সেন্ট মেরিতে স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের জন্ম হয়। তাঁর বাবা রেভারেণ্ড জন কোলরিজ ছিলেন কিংস স্কুলের এক সুপণ্ডিত স্কুলশিক্ষক এবং সেন্ট মেরি গির্জার এক যাজক। জন কোলরিজের দশম সন্তান কোলরিজ শৈশব থেকেই অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ, অন্তর্মুখী, নির্জনতাপ্রিয় এবং সংবেদনশীল ছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই তিনি ‘আরব্য রজনী’, ‘বাইবেল’ পড়ে ফেলেছিলেন।
১৭৮১ সালে বাবার মৃত্যুর পরে লণ্ডনের ক্রাইস্ট হাসপাতালে কোলরিজের শিক্ষা শুরু হয়। পরে ১৭৯১ সালে তিনি ভর্তি হন কেমব্রিজের জেসাস কলেজে। এই সময় চিকিৎসাশাস্ত্র ও অধিবিদ্যায় তাঁর গভীর আগ্রহ জন্মায়। হোমার এবং পিণ্ডারের রচনা তিনি অনায়াসে আবৃত্তি করতে পারতেন। প্রাবন্ধিক চার্লস ল্যাম্ব তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন এবং তিনি কোলরিজকে একজন ‘ইন্সপায়ারড চ্যারিটি বয়’ রূপে দেখতেন। কেমব্রিজে পড়াকালীন আরেক বন্ধু জন ইভান্সের বোন মেরির প্রেমে পড়েন কোলরিজ এবং এই প্রেমজনিত হতাশা আর রিপাবলিকান মতাদর্শের উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচরণে তাঁর প্রথাগত পড়াশোনায় ছেদ ঘটে। ১৭৯৪ সালের শেষ দিকে কোনো ডিগ্রি না নিয়েই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন।

কোলরিজের কর্মজীবন কখনোই সেভাবে স্থায়ী হয়নি। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে তিনি লণ্ডনে গিয়ে সৈনিকের পেশা গ্রহণ করেন। এর অনেক পরে ১৮০০ সালে লণ্ডনের ‘মর্নিং পোস্ট’ নামক সংবাদপত্রে রাজনৈতিক সংবাদলেখকের কাজে যোগ দেন তিনি। কিন্তু আর্থিক সচ্ছলতা তিনি কোনোদিনই উপভোগ করতে পারেননি। তবে তাঁর কর্মজীবনের এ ছিল পেশাগত অধ্যায়, আসলে তাঁর কর্মজীবনের পরিচিতি তাঁর লেখায়, সাহিত্যচর্চায়। ১৭৯৩ সালে তাঁর লেখা প্রথম দুটি কবিতা ‘অ্যাবসেন্স : অ্যান ওড’ ও ‘অ্যাবসেন্স : এ পোয়েম’ প্রকাশিত হয় ‘দ্য উইকলি এন্টারটেনার’-এ। ঠিক এর পরের বছর ১৭৯৪ সালে কোলরিজ লেখেন একটি নাটক ‘দ্য ফল অফ রোবস্‌পীয়র’ যা কোনোদিনই অভিনীত হয়নি। ১৭৯৬ সালে ব্রিস্টলের এক প্রকাশক জোসেফ্‌ কট্‌ল কোলরিজের কাব্যগ্রন্থ ‘পোয়েমস অন ভেরিয়াস সাবজেক্টস’ প্রকাশ করলে লণ্ডনে একজন উঠতি কবি হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এর আগে ১৭৯৪ সালে ‘মর্নিং ক্রনিক্‌ল’-এ প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর লেখা ‘সনেটস অন এমিনেন্ট ক্যারেক্টারস’। প্রখ্যাত ইংরেজ রোমান্টিক কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঙ্গে তাঁর নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। ১৭৯৮ সালে কোলরিজ এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থের যুগ্ম রচনা সংকলন ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’ প্রকাশ পায় যা ইংরেজি রোমান্টিক কাব্যান্দোলনের জন্ম দেয়। বলা হয় এই বইতে যে ভূমিকা লিখেছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ সেটাই রোমান্টিকতার ধারণাকে বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। সারা ফ্রিকারের প্রেমে পড়ে তাঁকে নিয়ে কোলরিজ লিখে ফেলেন ‘দ্য ইউলিয়ান হার্প’ ও ‘টু দ্য নাইটিঙ্গেল’ নামে দুটি বিখ্যাত কবিতা। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও তাঁর বোন ডরোথির সান্নিধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা তিনি এই সময়েই লিখে ফেলেন যা তাঁকে পরবর্তীকালে স্মরণীয় করেছে। ‘দ্য রাইম অফ দ্য অ্যান্সিয়েন্ট ম্যারিনার’, ‘ক্রিস্টাবেল (প্রথম অংশ)’ এবং ‘কুবলা খান’ তাঁর লেখা এসময়ের অন্যতম বিখ্যাত রচনা। ১৭৯৮ সালে নেদারস্টোয়িতে থাকার সময় কোলরিজ লেখেন ‘ফ্রস্ট অ্যাট মিডনাইট’ নামের একটি আত্মজীবনিমূলক কবিতা।

এরপরে স্থানবদল করে ১৮০০ সাল নাগাদ কোলরিজ কেস-উইকের গ্রেটা হলে থাকতে শুরু করেন যেখানে ক্রিস্টাবেলের দ্বিতীয় ভাগ লেখা শুরু হয় তাঁর। ইতিমধ্যে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। যন্ত্রণা উপশমের জন্য তিনি নিরন্তর আফিম সেবন করতে থাকেন। ফলে শারীরিক আর মানসিক দূর্বলতা তাঁকে ক্রমশ গ্রাস করে। এই পর্বে ১৮০২ সালে কোলরিজ লেখেন বিখ্যাত ‘ডিজেকশন : অ্যান ওড’ কবিতাটি। বন্ধু ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং আরো অনেকের পরামর্শে লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে তিনি বেশ কিছু বক্তৃতা দিয়েছিলেন সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে। ১৮১৩ সালে ব্রিস্টলের ড্রুরি লেন থিয়েটারে ইংরেজ কবি বায়রনের সহযোগিতায় কোলরিজের লেখা ট্র্যাজেডি ‘রিমর্স’ প্রভূত সাফল্যের মুখ দেখেছিল। আর ১৮১৭ সালে যখন কোলরিজের কাব্যগ্রন্থ ‘সিবিলাইন লীভ্‌স’ এবং আত্মজীবনিমূলক গদ্যগ্রন্থ ‘বায়োগ্রাফিয়া লিটারেরিয়া’ প্রকাশ পায় সমস্ত সমালোচক, কাব্যতাত্ত্বিকদের মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকেন তিনি। এত কিছুর মধ্যে তাঁর দাম্পত্যজীবন ছিল অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত এবং যন্ত্রণাদায়ক। বারবার প্রেমে পড়েছেন কোলরিজ এবং প্রেম না পাবার যন্ত্রণা হতাশা তাঁকে গ্রাস করেছে। প্রথমে সারা ফ্রিকারকে বিবাহ করলেও দাম্পত্য সুখকর হয়নি, পরে ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্ত্রী মেরি হাচিনসনের বোন সারা হাচিনসনের প্রেমে পড়লেও বিবাহ করতে পারেননি কোলরিজ। পরবর্তীকালে চরম আর্থিক অনটনের সময়ে সারা হাচিনসনের আর্থিক সাহায্য কোলরিজকে যথেষ্ট অবলম্বন জুগিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, বন্ধু উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থকে নিয়ে ১৮০৭ সালে তিনি একটি প্রশস্তিমূলক কবিতা লেখেন ‘টু উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ’ নামে।

১৮০৪ সাল থেকে ১৮০৭ সালের মধ্যে স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ ‘দ্য ফ্রেণ্ড’ নামে একটি রাজনীতি ও কবিতা-বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ইংরেজি সাহিত্য জগতে রোমান্টিক যুগের সূচনা করে কোলরিজ রোমান্টিকতার একটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিলেন। ১৮১৭ সালে প্রকাশিত ‘বায়োগ্রাফিয়া লিটারেরিয়া’ গ্রন্থে তিনি কল্পনা (Imagination) আর কাল্পনিকতা (Fancy)-র মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। কোলরিজের মতে কাল্পনিকতা হল একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া যার কাজ হল ইন্দ্রিয়লব্ধ চিত্রকল্প (Image)কে একত্রিত করা আর কল্পনা হল একপ্রকার সঞ্জীবনী শক্তি যার কাজ বৈপরীত্যের মিলন।মুখ্য এবং গৌণ এই দুই প্রকার কল্পনার কথা বলেছেন কোলরিজ। ফলে খুব সহজ করে বলতে গেলে কোলরিজের তত্ত্বে কল্পনা হল বোধ, স্মৃতি, অনুষঙ্গ, অনুভূতি আর বুদ্ধির সংশ্লেষ। অতিপ্রাকৃতের রহস্য নিয়ে কোলরিজ যে কাব্যচর্চা করেছেন তার ফলে নিজের কাব্যচর্চায় ‘willing suspension of disbelief’-এর প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। এর অনেক আগে কোলরিজ তাঁর ইংরেজ কবি বন্ধু রবার্ট সাদির সঙ্গে দার্শনিক গডউইনের নৈরাজ্যবাদী চিন্তার অনুকরণে একটি কমিউন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যেখানে বারোজন সুশিক্ষিত পুরুষ বাস করবে বারোজন নারীকে নিয়ে এক বৈষম্যহীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীন জীবনে। সেই জন্যেই সাদি আর কোলরিজ বিবাহ করেন যথাক্রমে এডিথ ফ্রিকার ও সারা ফ্রিকারকে।
ফরাসি বিপ্লব ও বাস্তিল দূর্গের পতনকে কেন্দ্র করে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ কোলরিজ লিখেছিলেন ‘ওড টু দ্য ডিপার্টিং ইয়ার’ যা প্রকাশ পায় ১৭৯৬ সালে। আবার ফ্রান্স কর্তৃক সুইজারল্যাণ্ড আক্রান্ত হলে মোহভঙ্গ ঘটে কোলরিজের, তিনি হতাশচিত্তে লেখেন ‘দ্য রিক্যান্টেশন : অ্যান ওড’ যা ১৭৯৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় ‘মর্নিং পোস্ট’ পত্রিকায়। এছাড়াও তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা হল ‘ফিয়ারস ইন সলিচিউড’। একদিকে অতিপ্রাকৃত রহস্যময়তা, প্রকৃতিকেন্দ্রিক ভাবুকতা অন্যদিকে তীব্র কল্পনাশক্তি, ইন্দ্রিয়ময়তা ছিল কোলরিজের কবিতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু কবিতায় এবং বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘সঙ্গীত শতক’ কাব্যগ্রন্থে কোলরিজের কবিতার প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাঁর রচিত অখ্যাত কিছু গদ্য ‘দ্য ওয়াচম্যান’, ‘অন দ্য কন্সটিটিউশন অফ দ্য চার্চ অ্যাণ্ড স্টেটস’, ৬ খণ্ডের ‘মার্জিনালিয়া’, ‘টেবল টক’ (১৯৯০), ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘ওপাস ম্যাক্সিমাম’ ইত্যাদি সবই তাঁর মৃত্যুর পরে ক্যাথলিন কোবার্নের সম্পাদনায় দুই মলাটের মধ্যে সংকলিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

দাম্পত্যসঙ্গী -সারাহ ফ্রিকার।
সন্তান -সারা কোলরিজ, বারকেলি কোলরিজ, ডেরওয়েন্ট কোলরিজ, হার্টলে কোলরিজ।


 একজন ইংরেজ কবি, সাহিত্য সমালোচক এবং দার্শনিক যে, তাঁর বন্ধু উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের সাথে ইংল্যান্ডের রোম্যান্টিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি লোক কবিদেরও (Lake Poets) সদস্য ছিলেন। কোলরিজ সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলো তার দ্য রাইম অফ দ্য অ্যান্সিয়েন্ট ম্যারিনার (The Rime of the Ancient Mariner) এবং কুবলা খান (Kubla Khan) কবিতার জন্য।বায়োগ্রাফিয়া লিটারেরিয়া (Biographia Literaria) তাঁর সৃষ্ট একটি অন্যতম সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। 



শেক্সপিয়ারের উপর তার সমালোচনামূলক কাজ ছিলো খুবই প্রভাবশালী, তাছাড়া তিনি ইংরেজি ভাষী সংস্কৃতিতে জার্মান ভাববাদী দর্শনের সূচনা করতে সাহায্য করেছিলেন। 

তিনি রোমান্টিক হলেও তার Romanticism- এর মূল ভিত্তিই হলো ‘IMAGINATION,’-এ ক্ষেত্রে তার ‘DEJECTION- কবিতাটি থেকে কবিতাটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক-


 DEJECTION

01. There was a time when, though my path was rough, 
This joy within me dallied with distress, 
And all misfortunes were but as the stuff 
Whence Fancy made me dreams of happiness: 
For hope grew round me, like the twining vine, 
And fruits, and foliage, not my own, seemed mine. 
But now afflictions bow me down to earth: 
Nor care I that they rob me of my mirth; 
But oh! each visitation 
Suspends what nature gave me at my birth, 
My shaping spirit of Imagination. 
For not to think of what I needs must feel, 
But to be still and patient, all I can; 
And haply by abstruse research to steal 
From my own nature all the natural man— 
This was my sole resource, my only plan: 
Till that which suits a part infects the whole, 
And now is almost grown the habit of my soul.

Samuel Taylor Coleridge
Biographia Literaria, 
Edited by J. Sawcross, 
introduction, Page-xxxvi-xxxvii

In nothing does this loss of imaginative power exhibit itself more clearly than in the languor of his feelings in face of the beauties of nature. Even as he writes, he is gazing with indifference at the glories of the sun set’-Biographia Literaria vol-1

Introduction


 02. And still I gaze—and with how blank an eye!
And those thin clouds above, in flakes and bars,
That give away their motion to the stars;
Those stars, that glide behind them or between,
Now sparkling, now bedimmed, but always seen:
Yon crescent Moon, as fixed as if it grew
In its own cloudless, starless lake of blue;
I see them all so excellently fair,
I see, not feel, how beautiful they are! 

S. T. Coleridge
Biographia Literaria,
vol-1 Edited by J. Shawcross, 
introduction, Page-xxxvi-xxxvii.

 

উদ্ধৃত কবিতাটির দুটি পংক্তি- যেখানে তিনি বলেছেন- ‘আমার চতুর্দিক থেকে জন্মিত প্রত্যাশালতা আমাকে বেষ্টিত করে। এবং যে প্রত্যাশার ফলমূল, পত্র পল্লব কিছুই আমার নয়, মনে হয় আমার মতো।’ -(ইংরেজী থেকে অনুবাদ- লেখক) । এর পরের আরো দুটি পঙক্তিতে তিনি আবার বলেছেন- ‘কিন্তু আমার শারীরিক দুর্বলতা, যন্ত্রণা আমাকে পৃথিবীর কাছে নত করে দিয়েছে। কিন্তু আমি ভ্রুক্ষেপ করি না যে তারা আমার আনন্দোচ্ছ্বাসকে হরণ করতে পারবে।’ -( ইংরেজী থেকে অনুবাদ- লেখক)। 


 কিন্তু আহ! প্রতিটি ঈশ্বর প্রদত্ত উপদ্রব 
স্থগিত করে দেয়
আমার জন্ম লগ্নে প্রকৃতি আমাকে যা প্রদান করেছে 
আমার কল্পনাবৃত্তির অনুপম অধিত্বকে। -(ইংরেজী থেকে অনুবাদ- লেখক)। 

উদ্ধৃত কবিতাংশটুকুর মর্ম উদ্ধারে অতি তীক্ষ্ম অনুসন্ধানী দৃষ্টি এবং উপলব্ধি দিয়ে বোধ-গ্রাহ্য করতে চাইলে তীব্রভাবে প্রকট হয়ে ওঠে কোলরিজের এক প্রকারের অতিমাত্রিক বিষন্নতার প্রতিভাস। যদিও তিনি লিখেছেন তিনি অত্যন্ত স্বাতন্ত্র্যের সাথে সূর্যাস্তের অপার মহিমা স্থির দৃষ্টিতে অবলোকন করেন। কিন্তু তার পরেও উল্লেখিত কবিতায় তিনি বিষন্নতাকে অস্বীকার করেন নি। যেখানে তিনি উন্মুক্ত বিশাল নীল আকাশের এক ফালি চাঁদের অবস্থানকে কল্পনা করেছেন- মেঘহীনতারকাবিহীন নীল সরোবরে স্থির এবং জন্মিত বলে। তার কাছে সব কিছুকেই মনে হয়েছে- সব কিছু চমৎকার, কত সুন্দর। নক্ষত্র বিহীন নির্মেঘ, নীলোক্ত মহাশুন্যের স্থির একটি চন্দ্রফালির অপরূপ সৌন্দর্যের মমতা তার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেছে এবং এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই । কিন্তু এরই পাশাপাশি  তিনি বলেছেন- ‘I see, not feel’-অর্থাৎ তিনি দেখেছেন মাত্র, মোটেই হৃদয়িক উষ্ণ অনুভব দিয়ে উপলব্ধি করেননি। তার দেখা এবং উপলব্ধি করণের মধ্যাঞ্চলবর্তী যে বিশাল এলাকা- সে এলাকাটিই বস্তুত আবৃত কোন কিছুর প্রতি তার অনাসক্ত বিষন্নতায়। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে তিনি যে কবিতাটি লেখেন এবং যার নামকরণ তিনি করেছেন ‘DEJECTION’’ -যার কিছু উদ্ধৃতি উপরের অংশে প্রদান করা হয়েছে। কবিতাটি লিখবার পর তিনি নিজের অভিজ্ঞতার প্রতি দুঃখবোধ করেছেন, বিলাপ করেছেন এবং তিনি ওই কবিতাটির মধ্যে এক প্রকারের আধ্যাত্মিক সত্যকে প্রত্যক্ষ করেছেন। যা তিনি চাননি। কিন্তু তাকেই তিনি তার অভিজ্ঞতার বিকাশ ঘটিয়ে উন্মোচিত করেছেন। আর এরই প্রেক্ষিতে-


 He feels that he has lost his `shaping spirit of imagination, and that henceforth, he must be content with the prose of  life, the investigation of the actual and the natural, considered strictly as such. For the spiritual in himself, if it be not dead, is yet lost to consciousness, and without it he lacks the key to the spiritual in nature.’ S.T.Coleridge, Biographia Literaria,vol-1 Edited by J. Shawcross, introduction, Page-xxxvi-xxxvii. 

S. T. Coleridge- এর ‘Biographia Literaria’-গ্রন্থটির সম্পাদক J. Shawcross-এর উদ্ধৃত কথাগুলি তার মৌলিক সত্ত্বাকে আঘাত করেছে এভাবে। তিনি তার নিঃসীম কল্পনাগামীতা অথবা কল্পনাবৃত্তিকেও তার নিজ কল্পনায় স্থিত অধিত্বের উন্মেষগত অস্তিত্বকেও হারিয়ে ফেলেছেন। তাকে এখন এক প্রকার অতি সাধারণ বীক্ষণ সাধ্য নিরস, ছন্দহীন গদ্যময় জীবন, সে জীবনের প্রকৃতিগত সত্য অনুসন্ধান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
তাঁর অভ্যন্তরে যে ধর্ম ভিত্তিক অধিত্ব্যবাদকে তিনি তারই রচিত কবিতার মাধ্যমে অন্তরঙ্গভাবে উপলব্ধি এবং উদ্ধার করেছেন-যদি তার মৃত্যু না ঘটে তবে তার সচেতনতাকেও তিনি হারিয়ে ফেলবেন। যার মাধ্যমে তিনি প্রাকৃতিক অধিত্বের  দ্বারোদঘাটন করবেন তার মূল চাবিটির অভাবেই ওই অধিত্বের দ্বারোদঘাটন আর তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না।  এবং 
 To such a pass has he been brought by the deadening force of private affliction, health and the other materializing influences, all which, if not explicity referred to it in the personal lament are yet implied in the reflections with which it is entwined
এই কল্পনাবৃত্তির অধিত্ব যাকে Imagination- হিসেবে গ্রহণ করেছেন কোলরিজ এবং যার ওপর অবিচলভাবে বিশ্বস্ত থাকবার চেষ্টা করেছেন। সেই Imagination এর infinite influences, all which-ই যখন অগ্রাহ্য হয়ে যায় তার কবিতার নিগুঢ় অভ্যন্তরে তখন তাকেই তিনি উপলব্ধি করেন তার ব্যক্তিগত ‘consciousness’ এর অভাব হিসেবে । এবং তখনই তিনি আক্ষেপ করেন, ক্ষোভে ফেটে পড়তে চান। তার বিশ্বাসিত কবিতার সংজ্ঞা- ‘Poetry is the spontaneous overflow of powerful feeling-it takes it’s origin from emotion recollected in tranquility’- থেকে চ্যূত হয়ে যান। তখন তার মনে এক প্রকার উদ্বাহী ধারণা তাকে নিম্নগামীতার দিকে অনিরুদ্ধ ভাবে প্রলুদ্ধ করতে থাকে। আর সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় তার- Dejection বা বিষন্নতা। আর এই বিষন্নতার ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে কোনক্রমেই তিনি নিজেকে নিজের মৌলিক অবস্থানে পুনঃস্থাপিত করতে পারেন না। কোলরিজের অনেক দুর্বলতা, অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে এটাই বোধ করি সবচাইতে বেশি অধিগম্য দুর্বলতা। হয়তো নিজের কাছে নিজেরই এক প্রকার অভিশংস- যা তার সহ্যসীমার সীমায়তিকে লংঘন করে যায় বার বার। 
কোলরিজ তাঁর প্রাপ্ত বয়স্ক জীবন ব্যাপী উদ্বেগ ও বিষণ্ণতার বিকলাঙ্গে ভুগেছিলেন; ধারণা করা হয় যে তিনি বাইপোলার ডিসর্ডারে ভুগেছিলেন যা তার জীবনকালে অসনাক্তই রয়ে গেছে। কোলরিজ দুর্বল স্বাস্থ্যে ভুগেছিলেন যার উৎপত্তি হয়েছিলো তার বাত জ্বর ও শৈশবকালীন অসুস্থতা থেকে। এই সব অসুস্থতার কারণে তাকে আফিমের আরক (laudanum) দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছিলো যার ফলে সারা জীবন তার মধ্যে আফিমের আসক্তি প্রতিপালিত হয়।

তিনি অনেক পরিচিত শব্দ ও শব্দগুচ্ছ (words and phrases) উদ্ভাবন করেছিলেন যার মধ্যে প্রখ্যাত হচ্ছে suspension of disbelief । এমারসন এবং আমেরিকান অতীন্দ্রিয়বাদে তাঁর বিশেষ প্রভাব ছিলো।

কুবলা খান কবিতাটির শুরু তিনি করেছেন এভাবে- 


 In Xanadu did Kubla Khan
A stately pleasure-dome decree:
Where Alph, the sacred river, ran
Through caverns measureless to man
Down to a sunless sea.
So twice five miles of fertile ground
With walls and towers were girdled round;
And there were gardens bright with sinuous rills,
Where blossomed many an incense-bearing tree;
And here were forests ancient as the hills,
Enfolding sunny spots of greenery.

But oh! that deep romantic chasm which slanted
Down the green hill athwart a cedarn cover!
A savage place! as holy and enchanted
As e’er beneath a waning moon was haunted
By woman wailing for her demon-lover!
And from this chasm, with ceaseless turmoil seething,
As if this earth in fast thick pants were breathing,
A mighty fountain momently was forced:
Amid whose swift half-intermitted burst
Huge fragments vaulted like rebounding hail,
Or chaffy grain beneath the thresher’s flail:
And mid these dancing rocks at once and ever
It flung up momently the sacred river.
Five miles meandering with a mazy motion
Through wood and dale the sacred river ran,
Then reached the caverns measureless to man,
And sank in tumult to a lifeless ocean;
And ’mid this tumult Kubla heard from far
Ancestral voices prophesying war!
The shadow of the dome of pleasure
Floated midway on the waves;
Where was heard the mingled measure
From the fountain and the caves.
It was a miracle of rare device,
A sunny pleasure-dome with caves of ice!

A damsel with a dulcimer
In a vision once I saw:
It was an Abyssinian maid
And on her dulcimer she played,
Singing of Mount Abora.
Could I revive within me
Her symphony and song,
To such a deep delight ’twould win me,
That with music loud and long,
I would build that dome in air,
That sunny dome! those caves of ice!
And all who heard should see them there,
And all should cry, Beware! Beware!
His flashing eyes, his floating hair!
Weave a circle round him thrice,
And close your eyes with holy dread
For he on honey-dew hath fed,
And drunk the milk of Paradise.
কবিতাটিতে অত্যন্ত প্রগাঢ়তা দিয়ে সুগভীর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বোধের মাতৃকতা দিয়ে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করলে নিজের অন্তর্লোকাশ্রিত Imagination এর কোলরিজ সৃজিত কুবলা খানের স্বর্গসৌধের প্রতিবিম্বন চিত্তচৈতন্যে আপনা আপনি একটা অলৌকিক কল্পলোকের সৃষ্টি করে। সামান্যতম মুহুর্তের জন্য হলেও একটা তন্দ্রাচ্ছনতা একটা নিগুঢ় মোহময় পৃথিবীর আবেষ্টনীতে নিজেকে আবিষ্ট করে রাখে। কবিতাটি সরাসরি তাঁর পাঠককে মুহূর্তের মধ্যেই নিত্য সাধারণ বাস্তবতা থেকে, বাস্তবতা সংশ্লিষ্টতা থেকে একটি অতিঘোর স্বপ্নরাজ্যে স্থাপিত করে। কবিতাটি তাঁর আশ্চর্যতম শিহরণ জাত কল্পনাবৃত্তির অপরিমিত শক্তি দিয়ে দৃশ্যতঃ অথবা মোহগ্রস্ততার মধ্যে দিয়ে পাঠককে গোটা বিষয়টিকে প্রত্যক্ষ অধিগম্যতায় নিমজ্জিত করে। এসব ছাড়াও কবিতাটির মধ্যে আরও ভিন্ন মাত্রার কিছু গুনাবলীর মিশ্রণ যা একজন মানুষকে তার নির্দিষ্ট স্থান এবং কাল থেকে hypnotize করার মত করে অতিদূর লোকে অনায়াসেই নিয়ে যেতে পারে। যার মাত্রাগত দিকটি অবলীলায় সাধারণ সীমাবদ্ধতাকে অতি সহজেই অতিক্রম করতে পারে। সাধারণ প্রচলিত রীতি পদ্ধতির বাইরে একজন মানুষকে অলৌকিকত্বের প্রতি অত্য্শ্চার্য জাদুকরী কৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে অনুগত অথবা ভীতিযুক্ত করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কবিতাটির কোন কিছুই চাক্ষুসমান হয় না। সবই থেকে যায় স্বপ্নলোকের নির্ধারিত নিরুদ্ধ সীমার গভীরে। আর এখানেই এস. টি কোলরিজের স্বর্গ হারানোর বহুমাত্রিক যন্ত্রণা, ব্যর্থতা আর বিষন্নতা। কবিতাটির কয়েকটি পঙক্তির মাধ্যমে কবি বিমোহিত হয়ে যান। 


 It was a miracle of rare device,
A sunny pleasure-dome with caves of ice!

A damsel with a dulcimer
In a vision once I saw:
It was an Abyssinian maid
And on her dulcimer she played,
Singing of Mount Abora.
Could I revive within me
Her symphony and song,
To such a deep delight ’twould win me,
That with music loud and long,
I would build that dome in air,
That sunny dome! those caves of ice!
And all who heard should see them there,
And all should cry, Beware! Beware!
His flashing eyes, his floating hair!
Weave a circle round him thrice,
And close your eyes with holy dread
For he on honey-dew hath fed,
And drunk the milk of Paradise.

একটি Dulcimer- নামীয় বিশেষ বাদ্য যন্ত্রের মাধ্যমে একটি আবিসিনীয় বালিকার কন্ঠে গীত মাউন্ট এ্যাবোরা নামক একটি সংগীতকে শ্রবণ করে মাত্র একটিবার তাকে দেখে। তিনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন আমি কি তার বাদ্যযন্ত্রের সুমধুর সুর এবং কন্ঠনিঃসৃত সঙ্গীতকে আমার গভীর অন্তরে উজ্জীবিত করব। এই গভীর উৎফুল্লতা যা আমাকে জয় করে নিয়েছে তার উচ্চকিত এবং দূরগামী সঙ্গীতের মাধ্যমে। এই উৎফুল্লতা দিয়ে আমি শুনেও স্বর্গসম প্রাসাদ নির্মাণ করতে পারি নির্মাণ করতে পারি সূর্যালোকিত স্বর্গীয় প্রাসাদ বরফাবৃত গুহা সমূহের মধ্যেও। 


===={{{{{=={}{={{=}={{{={=}{{={=}={={{{{={==

Saturday, 23 July 2022

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। রায়বাহাদুর কৃষ্ণদাস পাল। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার প্রতিষ্ঠিত সম্পাদক। Vol -807. Dt -24.07.2022. ৬ শ্রাবণ,১৪২৯. রবিবার। The blogger in literature e-magazine


কৃষ্ণদাস পাল রায়বাহাদুর


"আমরা এমন এক সহকর্মীকে হারালাম, যাঁর কাছ থেকে আমরা সকলে তার সহযোগিতা লাভ করেছি,আমি সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বীকার করি।.... কৃষ্ণদাস পাল তার নিজের প্রচেষ্টায়, বুদ্ধিমত্তায় আলঙ্কারিক সম্মাননা অর্জন করেছিলেন। তার বৌদ্ধিক জ্ঞান ছিল উচ্চমানের, তার বক্তৃতা যারা শুনেছে সকলেই সপ্রশংস স্বীকার করেছেন এবং কাউন্সিলে তার ভাষণ প্রকৃতই ইংরেজি ভাষায় উপর পূর্ণদক্ষতার পরিচায়ক।"
(((প্রয়াণে লর্ড রিপন এর শোকবার্তা))

১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে জুলাই ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। 


১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড এলগিন কলকাতায় তার পূর্ণাবয়ব মর্মর মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন।

জীবন

কলকাতার কাঁসারিপাড়ায় এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র পাল। কৃষ্ণদাস কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতে পাঁচ বছর ও তৎকালীন হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজে তিন বৎসর (১৮৫৪ - ৫৭) পড়াশোনা করেন এবং সেসময়ে তাাঁর সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহ জন্মে। ডি.এল. রিচার্ডসনের ছাত্র হিসাবে ইংরাজী সাহিত্যে তিনি বিশেষ দক্ষতা লাভ করেন। 
কলেজে ছাত্রাবস্থায় 
"ক্যালকাটা লিটারারি ফ্রি ডিবেটিং ক্লাব" প্রতিষ্ঠা করেন। 
১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে তাাঁর রচিত 'দি ইয়ং বেঙ্গল ভিন্ডিকেটেড' প্রবন্ধ সে যুগে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। 
হরিশচন্দ্র মুখার্জি সম্পাদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার আদর্শে 'দি ক্যালকাটা মান্থলি' ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন।সহযোগী ছিলেন শম্ভুচন্দ্র মুখার্জি। 
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চ সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব ও মনীষীদের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সম্পাদক হন। 
ঠিক সেই সময়ই হিন্দু প্যাট্রিয়টের হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকাল প্রয়াণের কয়েক মাস পর তিনি ওই পত্রিকার সম্পাদক হন। 
একাদিক্রমে ২৩ বৎসর সম্পাদনায় তৎকালীন রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব বিস্তার লাভ করে। 'ইমিগ্রেশন বিল ', 
'ইলবার্ট বিল', '
ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট' ইত্যাদি আইন প্রনয়ণের সময় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় চা-শ্রমিকদের পক্ষে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে ও দেশীয় ডেপুটি ম্যাজিসেট্রটদের সপক্ষে বিস্তর প্রবন্ধ রচনা করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
 চা-শ্রমিকদের নির্যাতন-ব্যবস্থা র প্রতিবাদে কৃষ্ণদাস 'ইমিগ্রেশন বিল'কে 'দ্য স্লেভ ল' অব ইন্ডিয়া' বলে অভিহিত করেন। 
ক্রমে তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও রাজনীতি হিসাবে পরিচিত হয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সম্পাদক থেকে স্থায়ী সম্পাদক হন। 

১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'জাস্টিস অফ দ্য পিস' নিযুক্ত হন এবং কলকাতা পুরসভার কমিশনার হন। 
১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য হন এবং এখানেই তাঁর ব্যবহারিক জ্ঞান ও সংযম পরবর্তী লেফটেনান্ট গভর্নর দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। 
১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভাইসরয়ের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত হন।
 'বেঙ্গল টেন্যান্সি বিল' নিয়ে বিতর্কের সময় কৃষ্ণদাস জমিদার-শ্রেণীর প্রতিভূরূপে ভারতবর্ষীয় ব্যবস্থাপক সভা'র সদস্য মনোনীত হন।  
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে রায়বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং তিনি "রায় কৃষ্ণদাস পাল বাহাদুর" হিসাবে পরিচিত হন।  
১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমান্ডার অব ইন্ডিয়ান এম্পায়ার (সি আই ই) হন।



হিন্দু প্যাট্রিয়ট ও কৃষ্ণদাস পাল:


 ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ ই জানুয়ারি গিরিশচন্দ্র ঘোষের সম্পাদনায় মধুসূদন রায় প্রকাশ করেন এবং এটি প্রতি বৃহস্পতিবার তার কলাকার স্ট্রিটস্থিত প্রেস হতে প্রকাশ হতে থাকে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে কিছুদিন কাশীতলা হতে মুদ্রিত হয়। সেসময়ের 'বেঙ্গল রেকর্ডার' -এর সংবাদদাতা হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হিন্দু প্যাট্রিয়টে যোগদেন এবং ক্রমে সম্পাদকীয় বোর্ডে উন্নীত হন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু প্যাট্রিয়টের মুখ্য সম্পাদক হন। এক বছর পর তিনি তার দাদা হারাণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নামে স্বত্ব কেনেন ও সংবাদপত্রটির পূর্ণ মালিকানা গিরিশচন্দ্র ঘোষের থেকে তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হারানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নামে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু গিরিশচন্দ্র ঘোষ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লিখতে থাকেন। তারপর হিন্দু প্যাট্রিয়ট ছেড়ে "দি বেঙ্গলি" নামে ইংরাজী সংবাদপত্র শুরু করেন। 
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকাল মৃত্যুতে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে। কালীপ্রসন্ন সিংহের আর্থিক সহায়তায় রক্ষা পায়। গিরিশচন্দ্র ঘোষ তিন বৎসর আগে হিন্দু প্যাট্রিয়টের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেও, তিনি হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের শোকাহত মা ও অসহায় বিধবা পত্নীর জন্য পুনরায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পুনরায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি হিন্দু প্যাট্রিয়ট ত্যাগ করলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংবাদপত্রের মালিকানা নেন এবং কৃষ্ণদাস পাল (১৮৩৮ - ১৮৮৪) সম্পাদক হন।

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে কিশোরীচাঁদ মিত্র প্রতিষ্ঠিত "ইন্ডিয়ান ফিল্ড" নামের ইংরাজী সংবাদ সাপ্তাহিকটি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে "হিন্দু প্যাট্রিয়ট" এর সাথে মিশে যায় ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণদাস পালের মৃত্যুর পর লখনউ-এর দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত লখনউ টাইমস্-এর সম্পাদক রায়বাহাদুর রাজকুমার সর্বাধিকারী (১৮৩৯-১৯১১) এর সম্পাদক হন। পত্রিকাটি ৭১ বৎসর চলেছিল। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়।
==================================


Friday, 22 July 2022

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। নৃপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় - বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক। Vol -806. Dt -23.07.2022. ৫ শ্রাবণ, ১৪২৯. শনিবার। The blogger in literature e-magazine

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়।


বহুমুখী প্রতিভাধর এই ব্যক্তিত্ব ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জুলাই পরলোক গমন করেন।বিচিত্র কর্মময়জীবনে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু, ১৯৬৩ সালে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই প্রতিভাবান মানুষটির মৃত্যু হল। তাঁর মৃত্যুতে 'জনসেবক' পত্রিকা লিখল: ''প্রখ্যাতনামা সাহিত্যকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়...লোকান্তর গমন করিয়াছেন।...কল্লোল যুগের অবিস্মরণীয় সাহিত্যকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় বাংলা জীবনী নূতন রচনা শৈলীর সৃষ্টি করিয়াছেন। অপরূপ বাংলা লিখন ভঙ্গি এখনও পর্যন্ত অননুকরণীয়।"

শোক-সংবাদের শেষের কথাটি কী সিনেমায়, কী সাহিত্যে এখনও অব্দি ধ্রুব সত্যি; তাঁর 'লিখনভঙ্গি' এখনও 'অননুকরণীয়'। তাই তো তিনি কায়িক মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর আজও একান্ত স্মরণীয়...


উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি :

গরমিল
উত্তরফল্গুনী
সংলাপ ও চিত্রনাট্যের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হলো-

বিচার
স্বামীজি
শাপমোচন
শশীবাবুর সংসার
দাদাঠাকুর
সাত পাকে বাঁধা প্রভৃতি। 
কলকাতা বেতারের সাথে আদিযুগ হতে যুক্ত ছিলেন। 'বিদ্যার্থীমণ্ডল', 'পল্লীমঙ্গল আসর' এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। দীর্ঘদিন দাদামণি নামে জনপ্রিয় গল্পদাদুর আসর' পরিচালনা করেছেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম পুরী থেকে সরাসরি রথযাত্রার বেতার ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন। তিনি গল্পভারতী নামক মাসিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাকালীন (১৯৪৫ - ৫২) সময়ের সম্পাদক ছিলেন তিনি। [২] কল্লোল পত্রিকার সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মৌলিক ও অনুবাদ রচনা নিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রচুর। আবেগদীপ্ত ছন্দময় ভাষায় জন্য তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। 
এছাড়া ও

মহীয়সী মহিলা
সান ইয়াৎ সেন
শতাব্দীর সূর্য
মা ( গোর্কির উপন্যাস- অনুবাদ)
সেক্সপীয়ারের কমেডি
সেক্সপীয়ারের ট্রাজেডি
নূতন যুগের নূতন মানুষ
কুলী ( মুলকরাজ আনন্দের উপন্যাস-অনুবাদ)
নানাকথা
এইচ জি ওয়েলসের গল্প
মজার গল্প (ছোটগল্প-১৯২৮)
জনক জননী (উপন্যাস-১৯৪৮)
প্রভৃতি। 
এছাড়া জয়দেব-রচিত গীতগোবিন্দ -এর বঙ্গানুবাদ করেছিলেন তিনি এবং এটি পাঠকসমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ব্যক্তিজীবন

জন্ম ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগর ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের ফুটিগোদা গ্রামে। পিতা প্রফুল্লচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা সুশীলা দেবী। প্রাথমিক পড়াশোনা গ্রামের স্কুলেই। পরে কলকাতায় এসে বেলেঘাটার বঙ্গবাসী স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ এবং সেখান থেকেই ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে সিটি কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ ও ইংরাজী সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক হেরম্বচন্দ্র মৈত্রর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হওয়ায় বার্ষিক পরীক্ষায় বসতে পারেননি। ফলে তার প্রথাগত ছাত্রজীবন শেষ হয়।
বড় হয়ে ওঠার সময়কালে নৃপেন বাবাকে দেখে বাবার আদর্শকেই নিজের আদর্শ-পথ বলে গ্রহণ করতে লাগলেন। স্বপ্ন দেখতে লাগলেন শিক্ষক হবার, সমাজের জন্য কিছু করার। সেই শিক্ষকতার পাঠ শুরু করে দিলেন ম্যাট্রিক পাশ করার পর নিজের খরচ নিজে চালানোর ব্রত হিসেবে। শুরু করলেন গৃহশিক্ষকতা। ভর্তি হলেন সিটি কলেজে। গৃহশিক্ষকতা ও পড়াশোনার পাশাপাশি বাঙালির ছেলের যেটা জন্মগত বিদ্যে, টুকটাক সেই সাহিত্যের চর্চাও চলতে লাগল।

কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সন্তানদের পড়াতে তাঁর বাড়িতে যেতেন নৃপেন। সেখানেই একদিন আলাপ হয়ে গেল কাজী নজরুলের সঙ্গে। আলাপে বেরিয়ে এল নৃপেনের লেখালেখির প্রতি আসক্তির কথা। নজরুল তখন 'ধূমকেতু' নামে এক বৈপ্লবিক পত্রিকা বের করতে শুরু করেছেন। তার মধ্য দিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন, অধিকার আদায়ের মন্ত্র দিচ্ছেন, যুব সমাজের মধ্যে বিপ্লবের আগুন জ্বালানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। কথায় কথায় বুঝলেন নৃপেনের মধ্যেও সেই আগুন আছে। ব্যস, তাঁর ইচ্ছেয় নৃপেন ধূমকেতু-গোষ্ঠীর একজন হয়ে গেলেন, লিখতে শুরু করে দিলেন 'দিকশূল' ছদ্মনামে।
সিটি কলেজে বিএ পড়তে পড়তে আলাপ হল সহপাঠী শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বন্ধুত্ব হল। 'কল্লোল' পত্রিকা যখন বাংলা সাহিত্যে নতুন বন্দর তৈরি করার উদ্যোগ নিল, তখন বন্ধু শৈলজার সূত্রে নৃপেনও সেখানে এসে ভিড়লেন। শিক্ষকতার স্বপ্নের বিবর্তন ঘটল। শুরু হয়ে গেল তাঁর পরিপূর্ণ সাহিত্য-জীবন। 'দেবব্রত বসু' ছদ্মনামে অনুবাদ করলেন ম্যাক্সিম গোর্কির যুগান্তকারী উপন্যাস 'মা'। অনুবাদটি বাংলা সাহিত্যে বেশ সাড়া ফেলে দিল। উৎসাহিত হয়ে এরপর একে একে অনুবাদ করলেন মূলক রাজ আনন্দের 'কুলী' ও 'দুটি পাতা একটি কুঁড়ি'-র মতো বিতর্কিত ও বহু আলোচিত দুটি উপন্যাস। অনুবাদ সাহিত্যে তিনি নিয়ে এলেন নতুন জোয়ার। শুরু করলেন বিতর্কিত, বৈপ্লবিক এবং মেহনতি মানুষের কথা বলা বিশ্ব সাহিত্যের অনুবাদের কাজ। বিদেশি সাহিত্যকে স্বদেশি ছাঁচে ঢেলে তার ভাবে ও ভাষায় নিয়ে এলেন সুখপাঠ্য-সাবলীলতা। এই সুখপাঠ্য-সাবলীলতাই হয়ে উঠল তাঁর নিজের লেখারও বৈশিষ্ট্য।

এ-সময় শৈলজানন্দ সাহিত্য থেকে বাংলা সিনেমার জগতে পদার্পণ করলেন। 'ছায়া' নামের সিনেমাসংক্রান্ত পত্রিকা প্রকাশ করে শৈলজা হলেন সম্পাদক, নৃপেনকে করলেন তাঁর সহযোগী। এবং এর মধ্য দিয়েই নৃপেনও পা রাখলেন বাংলা সিনেমার জগতে। ১৯৪২ সালে নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত 'মহাকবি কালিদাস' ছায়াছবিতে কালিদাসের ভূমিকায় অভিনয় করে ফেললেন। অভিনয় প্রশংসিত হল। কিন্তু, তার চেয়েও বেশি প্রশংসিত হল এই সময় লেখা তাঁর 'কাশীনাথ' নামের চিত্রনাট্য। বাংলা ছায়াছবির জন্য এটাই তাঁর প্রথম লেখা চিত্রনাট্য।
বাংলা ছায়াছবির কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য তাঁর হাতে পড়ে সাবলীল, সুন্দর, সুষ্ঠু, নির্মেদ, চরিত্রপযোগী এবং যুগোপযোগী হয়ে উঠল। 'রাণী রাসমণি', 'দুই ভাই', 'শেষ পর্যন্ত', 'সাত পাকে বাঁধা', 'ত্রিধারা', 'উত্তর ফাল্গুনী'-র মতো কালজয়ী ছবিগুলো তারই উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর চিত্রনাট্যে নির্মিত 'দাদাঠাকুর' ও 'ভগিনী নিবেদিতা' ছবি দুটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেল।

শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেন। ছোটদের জন্য সম্পাদনা করলেন 'গল্পভারতী' পত্রিকা। তাদের জন্য লিখলেন 'মহিয়সী মহিলা', 'শতাব্দীর সূর্য', 'সেক্সপীয়রের ট্রাজেডী', 'সেক্সপীয়রের কমেডী', 'রাক্ষস খোক্কস'-এর মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থমালা। এছাড়া 'শেলী', 'সুভাষচন্দ্র', 'জওহরলাল', 'জয়দেব' প্রভৃতি বরেণ্য সাহিত্যিক ও দেশনেতার জীবনী রচনার মধ্য দিয়েও সমৃদ্ধ করলেন শিশু সাহিত্যের ভাণ্ডার।

আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ আমৃত্যু। সেখানেও তিনি রাখলেন স্বকীয় এবং উল্লেখযোগ্য অবদান। ছোটদের জন্য 'বিদ্যার্থী মণ্ডল' এবং 'গল্পদাদুর আসর' এই দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা তাঁরই কীর্তি। সদিচ্ছে থাকলে বিনোদনের বেতারকে যে ছোটদের কাছে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলা যায়, এটা তিনি প্রমাণ করে দিলেন। হয়ে উঠলেন ছোটদের সবার প্রিয় 'গল্পদাদু'।


                  নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ গল্প, উপন্যাস প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন এবং তার বিচরণ ছিল বিজ্ঞান, ইতিহাস ধর্ম ইত্যাদি নানা বিষয়ে। বিশেষকরে শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে তার অবদান স্মরণীয়। ছোটদের জন্য বিশ্বের ক্লাসিক কাহিনির অসাধারণ বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। চলচ্চিত্র জগতে অনেকগুলি বাংলা চলচ্চিত্রের অসামান্য চিত্রনাট্য রচনা ছাড়াও, অনেকগুলির কাহিনী, সংলাপ এমনকি গীতিকার, অভিনেতারূপে কাজ করেছেন। একাধারে ছিলেন ভারতীয় বাঙালি চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার, গীতিকার, চিত্রপরিচালক ও অভিনেতা এবং অন্য দিকে অনুবাদক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক এবং বেতারের অনুষ্ঠান সঞ্চালক। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সংস্কৃতিজগতে অন্যতম বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন তিনি। শিশু সাহিত্যে তার অবদান ছিল বিশেষভাবে স্মরণীয়। 
====✓=======✓========✓=======✓==





Thursday, 21 July 2022

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। প্রাণতোষ ঘটক। মাসিক বসুমতী পত্রিকার সম্পাদক। Vol -805. Dt -22.07.2022. ৫ শ্রাবণ, ১৪২৯. শুক্রবার। The blogger in literature e-magazine

প্রাণতোষ ঘটক
 (২৪-৫-১৯২৩ – ২২-৭-১৯৭০)। 

কলিকাতার টাউন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। এম.এ. ও আইন পড়তে পড়তে বসুমতী’ পত্রিকায় যোগ দেন। এই সময় গল্প ও উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। রচিত ‘পঙ্গপাল’ গ্ৰন্থটি তাকে লেখকসমাজে প্ৰতিষ্ঠা দেয়।

 ‘মাসিক বসুমতী’র ভার নিয়ে তিনি পত্রিকাটির সম্পূর্ণ নূতন রূপ দেন এবং ঐ পত্রিকায় বাঙলাদেশের আধুনিক ও প্রতিষ্ঠিত অনেক লেখক ও শিল্পীদের আমন্ত্রণ করে আনেন। 


সতীশচন্দ্র ছিলেন একজন গোড়া হিন্দু ও রামকৃষ্ণ ভক্ত| স্বাভাবিক ভাবেই শাস্ত্র ও ধর্ম সম্বন্ধীয় বহু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে 'মাসিক বসুমতী'তে| সতীশচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৩৫১-এর ১৩ই বৈশাখ| তার মৃত্যুর পর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সাহিত্যিক অধ্যাপক যামিনীমোহন কর| সহযোগী হিসাবে পেয়েছিলেন সতীশচন্দ্রের জামাতা প্রাণতোষ ঘটককে| এই সময়ে পত্রিকার একটি দিক পরিবর্তন ঘটে| নতুন যুগের লেখকদের লেখা অনেক বেশী সংখ্যায় ছাপা হতে থাকে|

কবিতা লিখেছেন জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সজনীকান্ত দাস, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে এবং আরও অনেকে| উপন্যাস বেরিয়েছে গজেন্দ্রকুমার মিত্রের 'রাত্রির তপস্যা' ; সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের 'স্রোত বহে যায়' ; প্রতিভা বসুর 'সেতুবন্ধ' ; বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের 'স্বর্গাদপি গরিয়সী' ; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ঝড় ও ঝরাপাতা' ; পঞ্চানন ঘোষালের 'রক্তনদীর ধারা' ; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নগরবাসী', 'মাটি' ; রঞ্জনের (নিরঞ্জন মজুমদার) 'শীতে উপেক্ষিতা' ও 'অন্তরা' ; বিক্রমাদিত্যের (অশোক গুপ্ত) 'দেশে দেশে' ; আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের 'পঞ্চতপা' ও 'নার্স মিত্র' ; সতীনাথ ভাদুড়ীর 'মীনাকুমারী' প্রভৃতি| যাযাবরের (বিনয় মুখোপাধ্যায়) বিখ্যাত উপন্যাস 'দৃষ্টিপাত' প্রকাশিত হতে থাকে ১৩৫২-এর শ্রাবণ সংখ্যা থেকে| গল্প লিখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, অন্নদাশঙ্কর রায়, নরেন্দ্র মিত্র, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ| প্রবন্ধ লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, মেঘনাদ সাহা ও অন্যান্য বহু বিশিষ্ট লেখক| সুভাষচন্দ্র বসুর কিছু মূল্যবান লেখা স্থান পেয়েছে ১৩৫২-এর শ্রাবণ সংখ্যায়|

কিছু কিছু অনুবাদও বেরিয়েছে, যেমন 'দি গুড আর্থ'-এর অনুবাদ করেছেন শিশিরকুমার সেনগুপ্ত ও জয়ন্ত কুমার ভাদুড়ী; লু রচিত 'কুঙ ই-চি' অনুবাদ করেছেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়; এডগার এলেন পো-র 'একটি অদ্ভুত ঘটনা' -অনুবাদক অজিত কুমার গঙ্গোপাধ্যায়; নিখিল সেন অনূদিত জেমস জয়েসের লেখা অবলম্বনে 'প্রথম প্রেম'; উইলিয়ম ফকনারের 'সন্ধ্যাসূর্য্য'-অনুবাদক মৃণালকান্তি মুখোপাধ্যায়|

যামিনীমোহনের সম্পাদনাকালে কিছু নতুন বিভাগের সূচনা হয়েছে, যেমন 'রঙ্গপট', 'অঙ্গন ও প্রাঙ্গণ', 'পত্রগুচ্ছ' ইত্যাদি| যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘মাসিক বসুমতী’-র এক সময়ে দূরত্ব তৈরী হয়েছিল; যামিনীমোহন কর ও প্রাণতোষ ঘটকের সম্পাদনার শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথের রচনা আবার পত্রিকায় স্থান পেয়েছে| ১৩৫৪-এর বৈশাখে ছাপা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে’, রবীন্দ্রনাথের প্রদত্ত ভাষণের অমিয় চক্রবর্ত্তী কর্ত্তৃক শ্রুতিলিখিত অপ্রকাশিত রচনা ‘মানব সাধনা’| বৈশাখ সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছে ক্ষিতিমোহন সেনের প্রবন্ধ ‘মানবতা-ধর্ম্ম ও রবীন্দ্রনাথ’| জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় বেরিয়েছে প্যারীমোহন সেনগুপ্তের প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ মহাকবি কি না’, আষাঢ় সংখ্যায় ‘অঙ্গন ও প্রাঙ্গণ’ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে কিরণশশী দে’র রচনা ‘রবীন্দ্রনাথের গান’; শ্রাবণ সংখ্যায় লেখা হয়েছে নৃপেন্দ্রগোপাল মিত্রের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবিতা ‘রবীন্দ্রনাথ’|

১৩৫৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা থেকে প্রাণতোষ ঘটক একাই সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন| এই সময়ে কয়েকটি নাম করা ধারাবাহিক রচনা 'মাসিক বসুমতী'তে প্রকাশিত হয়| এর মধ্যে রয়েছে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের 'পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ' ও 'পরমাপ্রকৃতি শ্রীশ্রীসারদামণি', 'অখণ্ড অমিয় শ্রীগৌরাঙ্গ' ; মনোজ বসুর 'চীন দেখে এলাম' ও 'সোবিয়েতের দেশে দেশে' ; সজনীকান্ত দাসের 'আত্মস্মৃতি' ; রাহুল সাংকৃত্যায়নের 'ভলগা থেকে গঙ্গা' (অনুবাদ) ; পরিমল গোস্বামীর 'স্মৃতিচিত্র' ; সম্পাদক প্রাণতোষ ঘটকের 'আকাশ পাতাল'|
১৩৬০-এর ভাদ্র সংখ্যা থেকে চালু হয় একটি অধ্যায় 'চারজন'| এর মাধ্যমে একটি প্রচেষ্টা ছিল চারজন কৃতী বাঙালীর সঙ্গে পাঠকবর্গের পরিচয় ঘটানো, যাদের সম্বন্ধে অনেকেরই হয় ত জানা নেই| আর একটি বিভাগ 'ছোটদের আসর' ছোট ছেলেমেযেদের কাছে খুবই প্রিয় ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল| এতে লিখতেন যাদুকর পি.সি.সরকার, হেমেন্দ্রকুমার রায়, ইন্দিরা দেবী, শৈল চক্রবর্ত্তী, হরিনারায়ন চট্টোপাধ্যায়, মণীন্দ্র দত্ত, যামিনীমোহন কর প্রমুখ|

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ এই সময়ে প্রকাশিত হয়েছে; যেমন জয়দেব রায়ের 'রবীন্দ্রনাথ ও পাশ্চাত্ত্য সঙ্গীত' (চৈত্র, ১৩৫৭) ; তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রনাথ ও সাহিত্যের বাস্তবতা' (ভাদ্র, ১৩৬০) ; সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রনাথ ও অসমীয়া সাহিত্য' (চৈত্র, ১৩৬৭) ; শশীভূষণ দাশগুপ্তের 'টলস্টয়, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ' (আষাঢ়, শ্রাবণ, ১৩৬৮) ; ডঃ নরেশচন্দ্র ঘোষের 'রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা' (কার্ত্তিক, ১৩৬৮) ; চিত্তরঞ্জন দেবের ''য়েট্‌স ও রবীন্দ্রনাথ' (মাঘ, ১৩৭২) প্রভৃতি|

'মাসিক বসুমতী'র কয়েকটি বিভাগের উল্লেখ করতেই হয়| একটির উল্লেখ আগেই করা হয়েছে, সেটি হল 'অঙ্গন ও প্রাঙ্গণ'| এখানে শুধু মহিলা লেখকেরাই বিভিন্ন বিষয়ে তাদের লেখা প্রকাশ করতেন| লেখিকাদের মধ্যে রয়েছেন - আশা দেবী, বেলারাণী দেবী, অমিয়া দেবী, ক্ষণপ্রভা ভাদুরী, সুলতা সেনগুপ্তা, কিরণশশী দে, রুচিরা বসু, আশাপূর্ণা দেবী, শান্তি দেবী, বিভাবতী বসু প্রমুখ| অবশ্য এরা পরবর্তী কালে সবাই যে সাহিত্যক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক ছিলেন এমন নয়| অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হল 'আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি' ও 'সাময়িক প্রসঙ্গ'| 'সাময়িক প্রসঙ্গে' সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশিত হত| বিখ্যাত ব্যক্তিদের পরলোক গমনের খবরও সংযোজিত হত মাঝে মাঝে, সঙ্গে থাকত সংক্ষিপ্ত পরিচিতি| শোক সংবাদ পরিবেশনের জন্য 'অশ্রু-অর্ঘ্য' নামে একটি বিভাগ তৈরী হয়েছিল পরে| 'আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি'তে থাকত সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা| অনেক মাসিক পত্রিকা তখন রাজনৈতিক-প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলত, সম্ভবত সাহিত্য-পত্রিকার বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য| হয় ত এ কারণেই 'মাসিক বসুমতী' বিশুদ্ধ সাহিত্য-পত্র হিসাবে অনেকের কাছে মর্য্যদা লাভ করে নি| হতে পারে, তবে কোন পাঠক যদি সাহিত্যের বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের রসাস্বাদন করতে বা বিশ্ব পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হতেন তবে 'মাসিক বসুমতী' ছিল অবশ্য পঠনীয় ও সংগ্রহযোগ্য| দৃষ্টান্ত স্বরূপ ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ ও ‘আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি’ - এই দুটি বিভাগে আলোচিত কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে| 'সাময়িক প্রসঙ্গে' আলোচিত কিছু বিষয় হল 'ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা' ; 'কলিকাতার মেয়র নির্ব্বাচন' ; ‘বোম্বাই ডকে বিস্ফোরণ’ ; ‘মংপুতে রবীন্দ্র স্মৃতিপূজা’ ; 'ফরিদপুর অনাথ আশ্রম' ; 'বাঙ্গালী-ছাত্রদের জন্য বৃত্তি' ; 'কাঁথি কলেজে সরকারী সাহায্য' ইত্যাদি| 'আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি'তে প্রকাশিত কিছু বিষয় হল 'আমেরিকা কোন পথে?' ; 'ইন্দোচীনের স্বাধীনতা সংগ্রাম' ; 'চীনের আর্থিক দুর্গতি' ; 'কোরিয়ার ভবিষ্যৎ' ; 'হিটলার কোথায়?' ; 'অর্থনীতিক দাসত্ব' ; 'পদানত ও অধিকৃত জার্মানী' ; 'কংগ্রেস ও গান্ধীজী' ইত্যাদি| সূচীপত্রে বিষয়-বিভাগের মাঝে মাঝেই পরিবর্তন ঘটত| 'আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি'র পরিবর্তে 'রাজনীতি প্রসঙ্গ' পরিবেশিত হয়েছে কোন কোন সময়ে| তবে প্রকাশনা কালের শেষের দিকে সূচীপত্র সম্বলিত পৃষ্ঠার মধ্যে বিজ্ঞাপনের উপস্থিতি পীড়াদায়ক।
বসুমতী সাহিত্য মন্দির'-এর প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় রামকৃষ্ণ ভক্তদের অন্যতম| ‘কথামৃত’তেও উপেন্দ্রনাথের নাম উল্লেখিত হয়েছে| তার পুত্র সতীশচন্দ্রও ছিলেন রামকৃষ্ণ ভক্ত| সঙ্গত ভাবেই ঠাকুর রামকৃষ্ণ বিষয়ক বহু রচনা পত্রিকাতে স্থান পেয়েছে| প্রাণতোষ ঘটকের সম্পাদনাকালে যেমন 'বসুমতী'র উল্লেখযোগ্য মানোন্নয়ন ঘটে, পত্রিকার জনপ্রিয়তা অধোগতি শুরু হয় কিন্তু তার সময় থেকেই| ১৩৭০ বঙ্গাব্দের কাছাকাছি সময়ে পত্রিকার উৎকর্ষও নিম্নমুখী হয়েছিল| এক সময়ে জনপ্রিয় লেখকেরা তাদের রচনা-সম্ভার দিয়ে যে পত্রিকাটি অলঙ্কৃত করেছিলেন - ছাপা হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আজকাল পরশুর গল্প' ; শৈলজানন্দের 'কয়লাকুঠি' ; যাযাবরের 'দৃষ্টিপাত' ; অচিন্ত্যকুমারের ‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ' ; শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চুয়াচন্দন', 'রক্তসন্ধ্যা', 'সীমান্ত হীরা' এবং অন্যান্য বহু খ্যাতিমান লেখকদের সাড়া জাগানো গল্প ও উপন্যাস - কালের গতিতে সেই পত্রিকাটিই ক্রমশঃ স্তিমিত হয়ে পড়ে| জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে 'মাসিক বসুমতী'তে সন্নিবেশিত হয়েছে 'মাসিক রাশিফল', 'সচিত্র বোম্বাই সমাচার' প্রভৃতি বিভাগ, এমন কি যৌন বিজ্ঞান বিভাগটিও| ১৩৭৭-এর শ্রাবণ মাসে সম্পাদক প্রাণতোষ ঘটকের মৃত্যু ঘটে| পরবর্তী সম্পাদক হন বিজনকুমার সেন, কিন্তু পত্রিকার প্রচার সংখ্যা আর ঊর্দ্ধমুখী করা যায় নি|

সতীশচন্দ্রের একক সম্পাদনা কালে 'মাসিক বসুমতী' পত্রিকার নাম পরিবর্তিত হয়ে হয়েছিল 'সচিত্র মাসিক বসুমতী'| তবে এই নাম বরাবর পত্রিকায় ছাপা হয় নি, কিন্তু বিপুল সংখ্যক ছবি স্থান পেয়েছে প্রতি সংখ্যায়| চিত্রসূচীও বিষয়ানুক্রমিক সাজানো হয়েছে, কিন্তু প্রতি সংখ্যাতেই একই রকম বিভাগে বিভক্ত হয় নি| 'মাসিক বসুমতী' প্রকাশিত হত বর্ষ সংখ্যা অনুসারে প্রতি বর্ষে দুটি খণ্ড হিসাবে| বৈশাখ থেকে আশ্বিন প্রথম খণ্ড এবং কার্ত্তিক থেকে চৈত্র দ্বিতীয় খণ্ড| একটি বর্ষের প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত চিত্রের বিভাগগুলি ছিল এই রকম - 'সুরঞ্জিত চিত্র' (১৮) ; 'দেবদেবীর চিত্র' (৪) ; 'দেশনায়কগণের চিত্র' (২৯) ; 'বিশিষ্টগণের চিত্র' (২৭) ; 'ভারতীয় নারীচিত্র' (২) ; 'বিভিন্ন দেশের নর-নারী' (১০৪) ; 'কাহিনীর চিত্র' (৭) ; 'ঐতিহাসিক চিত্র (১০) ; 'অভিনয়-চিত্র' (৮) ; 'বৃক্ষলতা চিত্র' (৯) ; প্রাণী-চিত্র' (৭) ; 'ব্যঙ্গচিত্র' (১) ; 'সাময়িক চিত্র' (১৯) ; 'বৈজ্ঞানিক চিত্র' (৭৫) ; ‘দৃশ্য চিত্র’ (যেমন রামকৃষ্ণ মন্দির, কাটমুণ্ডু সহর ইত্যাদি) (১৪৬)| অর্থাৎ ছ'টি সংখ্যায় প্রকাশিত চিত্র সংখ্যা ৪৬৬, তবে অধিকাংশই ফটোগ্রাফ| ছবি এঁকেছেন মিঃ টমাস, পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী, কমলাকান্ত ঠাকুর, ইন্দুভূষণ সেন, হেমেন্দ্রকুমার মজুমদার, অতুল বসু, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোপাল ঘোষ, ঠাকুর সিং প্রমুখ চিত্রশিল্পী| মিঃ টমাস ও ঠাকুর সিং-এর অঙ্কিত কিছু চিত্র নিয়ে শালীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে, যথারীতি 'শনিবারের চিঠি' প্রকাশ করেছে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য|

প্রাণতোষ ঘটকের মৃত্যুর পর অস্থায়ী সম্পাদক বিজনকুমার সেন অনেক চেষ্টা করেও 'মাসিক বসুমতী'র প্রকাশনা চালিয়ে যেতে পারেন নি| পত্রিকাটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়| নানা বৈচিত্রের, বিভিন্ন ধরণের ও স্বাদের লেখা প্রকাশ করার জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় 'মাসিক বসুমতী'কে একটি 'অদ্ভুত সমন্বয় পত্রিকা' নামে চিহ্ণিত করেছেন; মনে হয় মূল্যায়নটি পত্রিকাটির চরিত্র বিশ্লেষণে যথার্থ| ধর্ম ও রাজনীতি, উদার ও রক্ষণশীল ইত্যাদি নানা বিপরীতধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়েছে 'মাসিক বসুমতী'তে, যা সচরাচর দেখা যায় না| দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বহু লেখকের সমাবেশ ঘটিয়ে নানা বিষয়ের রচনা প্রকাশের মাধ্যমে বিভিন্ন রুচি ও মতাবলম্বী পাঠকদের মনোরঞ্জন করে 'মাসিক বসুমতী' সাময়িক পত্রের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে থাকবে। 


সম্পাদক প্রাণতোষ ঘটকের
রচিত উল্লেখযোগ্য গ্ৰন্থ:
 ‘আকাশ পাতাল’, 
‘রাজায় রাজায়’, ‘
মুক্তাভস্ম’, 
‘খেলাঘর’, 
‘তিনপুরুষ’ প্রভৃতি।
 ‘রত্নমালা’ নামে একটি নূতন ধরনের অভিধানও তিনি প্ৰণয়ন করেছিলেন।

====={{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}}}=====

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ।‌ একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। Dt -26.11.2024. Vol -1059. Tuesday. The blogger post in literary e magazine.

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়   (২৬ নভেম্বর ১৮৯০ — ২৯ মে ১৯৭৭)  একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ.  মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্...