Wednesday 31 March 2021

আলোচনা পর্ব



বাংলা ছোটগল্পের রবীন্দ্রনাথ।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) ‘বেতাল পঞ্চবংশতি’ (১৮৪৭) নামে অনূদিত গ্রন্থটির ঘটনা উপস্থাপনায় প্রথম গল্পরসের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে বাংলা সাহিত্য প্রথম ছোটগল্পের আভাস পেয়েছিল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪) ও ‘রাধারাণী’ (১৮৭৫) গল্পে। পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মধুমতী’ এবং সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৪-১৮৮৯) ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’, ‘দামিনী’ প্রভৃতির মধ্যেও ছোটগল্পের একটা আভাস পাওয়া গিয়েছিল। তবে সাহিত্যকাঠামোর বিভিন্ন রূপের দৃষ্টিকোণ থেকে এর সবগুলিই ছিল উপন্যাসধর্মী রচনা। পরে স্বতন্ত্র প্রতিভা স্পর্শে ছোটগল্পকে সমৃদ্ধ করেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯)। তাঁর ভূত ও মানুষ, মুক্তামালা, মজার গল্প ও ডমরুচরিত গল্পগ্রন্থের মধ্যে ছোটগল্পের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া হয়। তবে তাঁর রচনায় উদ্ভট কাহিনীই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। স্বর্ণকুমারী দেবীর (১৮৫৫-১৯৩২) নবকাহিনী গ্রন্থের কোনো কোনো গল্পেও ছোটগল্প রচনার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ের আর একজন গল্পকার হলেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৬১-১৯৪০)। তিনি প্রেম ও রোমান্টিসিজমের মাধ্যমে ছোটগল্পে বিশেষত্ব দান করেন।

প্রকৃত অর্থে বাংলা সাহিত্যের সার্থক ছোটগল্পকার হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ মে, ১৮৬১-৭ আগস্ট, ১৯৪১)। তাঁর প্রথম গল্প ‘ভিখারিনী’ ১৮৭৪ সালে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও ‘দেনা-পাওনা’ (১৮৯০) গল্পটিই প্রথম সার্থক ছোটগল্প হিসেবে বিবেচিত হয় বাংলা সাহিত্যমহলে। ১৮৮৪-৮৫ সময়ের মধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’ ও ‘মুকুট’। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই তিনজনের সাহিত্যকর্মেই প্রভাব ছিল সংস্কৃত ভাষার। সাধারণ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে বাংলা ছোটগল্পের বন্ধ দরজা খুলে দিলেন দৃপ্ত প্রয়াসে। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখাই তিনি করলেন অবাধ বিচরণ।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মহৎ সাহিত্যিক হিসেবে প্রায় সব গুণই ধারণ করতেন রবীন্দ্রনাথ। তার উদার ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি যেকোনো পাঠককে দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে এক বিস্তৃত ও ধ্রুপদী উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায়। তাই দ্বিধাহীনভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তার ভেতর বাঙালির শৈল্পিক সৌন্দর্যবোধ ও মননশীলতার উপাদানসমূহের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই আকাশের রবির মতো উজ্জ্বল। বাঙালির চিরায়ত নিদর্শনে ধ্যানমগ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আপাদমস্তক মানবতাবাদী সাহিত্যিক। তাঁর সৃষ্টিকর্মে তিনি মানুষের জীবনজগতকে ফুটে তুলেছিলেন বাস্তবতার নিরিখে। তাঁর চারপাশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট, সুখ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া, প্রকৃতি-পরিবেশ, জীবনাচরণকে নিজে গভীরভাবে উপলব্ধি করে ঠাঁই দিয়েছিলেন নিজের সাহিত্যভাষায় বিশেষভাবে ছোটগল্পে। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য পা রেখেছিল বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে। ছোটগল্পকে তিনি করে তুলেছিলেন গণমুখী। আমরা তাঁর ছোটগল্পে যে সামাজিক বাস্তবতার উপস্থাপন দেখতে পাই, সেটা রবীন্দ্র সাহিত্যের অন্যান্য ধারা থেকে আলাদা। বিশ্বসাহিত্যের যে কয়জন শ্রেষ্ঠ গল্পকার রয়েছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

গ্রাম্যবধূ যেমন সুনিপুণ যত্ন-দক্ষতায় অধীর আগ্রহ ও ধৈর্যে অমলিন কাপড়ে সুঁইয়ের ফোঁড়ে-ফোঁড়ে স্বপ্নের মণিকোঠায় গেঁথে তোলে নকশি কাঁথা, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় সযতনে আপন মহিমা আর প্রতিভায় বিচরণ করে গেছেন। রবীন্দ্রপূর্ব বাংলা সাহিত্য কেবল স্বভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই আমাদের সাহিত্য বিশ্বজনীন বা সার্বজনীন হয়ে ওঠে ক্রমশ। বাঙালি জাতি ব্যক্ত করতে থাকে বিশ্বজনীন হওয়ার দ্ব্যর্থ প্রয়াস।

বাংলাসাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনার কৃতিত্ব যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের, অনুরূপভাবে বাংলা ছোটগল্পের সার্থক সূচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে। এই সার্থকতা এতোটাই উচ্চমানের যে, কোনো কোনো সাহিত্য বিশ্লেষক মনে করেন, শুধু ছোটগল্প সৃষ্টির জন্য রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যিক হিসেবে বিশ্বজনীন খ্যাতি ও স্বীকৃতি লাভের যোগ্যতা রাখেন। মানবজাতির অভিন্ন অনুভূতি ও প্রত্যাশার কথা মাথায় রেখেও স্বীকার করতে হবে, আমাদের জীবনাচার ও প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে পাশ্চাত্যের ভাবনার রয়েছে যোজনব্যাপী দূরত্ব। তাই বালজাক, চেখভ অথবা মোপাসাঁর ছোটগল্পের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথরচিত ছোটগল্পের তুলনা করতে গিয়ে অনেককে হিমশিম খেতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্পের অন্দরে-বাহিরে অবাক করা এক ভুবন তৈরি করে গেছেন যা কেবল বাংলা সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেছে তা নয়, সেই সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের অমিতাভ বিভারূপে বিরাজমান। কবিতা, গান, উপন্যাসসহ নাটকের যে দখল, তার ছোটগল্প সেগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। সময় আর সভ্যতার প্রয়োজনে নয় বরং রবীন্দ্রনাথ নিছক প্রকৃতি আর প্রেমের বাস্তবিক রূপ প্রকাশের তাগিদ থেকেই সৃষ্টি করেছেন তার প্রতিটি গল্প এবং যা পরবর্তীতে এক বিশাল মহীরূহরূপে বিরাজমান আমাদের সাহিত্য আসরে। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলীর অনেক চিঠিই এ মন্তব্যের স্বপক্ষ সমর্থন করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের প্রসঙ্গে ছিন্নপত্রাবলীর ১৪৯ নম্বর পত্রে লিখেছিলেন- ‘পুরোনো ইতিহাস ছিল তার হাড়গুলো বের করে; তার মাথার খুলিটা আছে, মুকুট নেই। তার উপরে খোলস মুখোশ পরিয়ে একটা পুরোপুরি মূর্তিমনের জাদুঘরে সাজিয়ে তুলতে পেরেছি তা বললে বেশি বলা হবে। ঢাল চত্তির খাড়া করে একটা খসড়া মনের সামনে দাঁড় করিয়েছিলুম, সেটা আমারই খেয়ালেরই খেলনা’। (পত্র-১৪৯; ছিন্নপত্রাবলী।)

গল্পকার রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্প সম্পর্কে সোনার তরী কাব্যের ‘বর্ষা যাপন’ কবিতায় বলেছেন- ‘ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা/ছোটো ছোটো দুঃখ কথা, নিতান্তই সহজ সরল/সহস্র বিস্মৃতি রাশি, প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/তারই দু’-চারটি অশ্রুজল’।

বাস্তবিক অর্থে তিনি জীবনের বহুবিধ রূপ বর্ণনার সার্থক শিল্পী, মানব মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাঁর ছোটগল্পে সঠিক ধারার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। সাধারণ বাস্তবতা ও ব্যক্তি মানুষের অন্তঃবেদনার এক মনোরম বহিঃপ্রকাশ তাঁর ছোটগল্পে। একজন সার্থক শিল্পীর মতো জীবনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের অনুভূতির সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে শিল্পিত করেছেন। বিশেষ করে নারীর চাওয়া-পাওয়া ভালোলাগা, মন্দলাগা, তথা মনোবিশ্লেষণে তিনি একজন দক্ষ শিল্পী। তাঁর ছোটগল্পের নারী চরিত্রগুলো আমাদের সদাজাগ্রত চিরচেনা জগতের বাসিন্দা, আমাদের একান্ত কাছের আপনজন। বাঙালি নারী সমাজের নিপীড়নের নানা চিত্র শিল্পিত রূপে প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে নারী জীবন, বাস্তবতার স্পর্শে মহিমান্বিত রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। গ্রাম্য বিধবা, গৃহবধূ, কুমারী, বাল্যবধূ, তরুণী প্রভৃতির সমাবেশ গল্পগুলো অবিসংবেদীরূপে প্রত্যক্ষধর্মী হয়ে উঠেছে। ‘দেনাপাওনা’র নিরূপমা, ‘মানভঞ্জন’র গিরিবালা, ‘মহামায়া’ গল্পের মহামায়া; ‘মাল্যদান’ গল্পের কুড়ানি; ‘সুভা’ গল্পের সুভা আমাদের সবার অতি পরিচিত নারী চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে প্রত্যেকটি নারী চরিত্রই স্বমহিমায় ভাস্বর।

বাংলা সাহিত্যে বহু বিশেষণে বিশেষিত বাংলা ছোটগল্পের রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল বিষয় বাস্তব জীবন ও সমাজ সংসারের আলেখ্য। পল্লী গ্রামবাংলায় বেড়ে উঠা অতি সাধারণভাবে যেসব জনমানুষের চিত্র আঁকা হয়েছে, তাদের সবাইকে আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে পাঠক অবলীলায় মেনে নেয়। রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প লেখা শুরু করেন ১২৯৮ বাংলা সালে। তখন থেকে ১৩১০ সনের মধ্যে তাঁর বেশিরভাগ গল্প রচিত। তাঁর একটি বিখ্যাত গল্প ‘পোস্টমাস্টার’ ১২৯৮ সালে লেখা। এর কিছুদিন আগে থেকে তিনি জমিদারি দেখাশোনার ভার নিয়েছেন। তাঁর দিন কেটেছে পদ্মার উপরে নৌকায় ভেসে ভেসে শাহজাদপুর ও শিলাইদহে। আনন্দময় বৈচিত্র্যে ভরপুর এ সময়ের জীবনযাত্রা। তিনি পদ্মাবোটে চড়ে পাড়ি জমিয়েছেন আত্রাই, বড়াল, নাগর, করতোয়া, পদ্মা আর যমুনায়। তাঁর ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিপত্রে শিলাইদহ থেকে শাহজাদপুর ও পতিসরে যাওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়।

‘বোট ভাসিয়ে চলে যেতুম পদ্মা থেকে কোলের ইছামতিতে, ইছামতি থেকে বড়ালে, হুড়ো সাগরে, চলনবিলে, আত্রাইয়ে, নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সাজাদপুরের খাল বেয়ে সাজাদপুরে’। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত জমিদারি দেখতে মাঝে মধ্যেই নওগাঁর পতিসর আসতেন। তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এ জমিদারি কিনেছিলেন ১৮৩০ সালে। সেই জমিদারি দেখাশোনার জন্যেই ১৮৯১ সালে কবিগুরু প্রথম আসেন পতিসরে।১৮৯১ থেকে ১৯০১ -প্রায় একনাগাড়ে তিনি থেকেছেন পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার নির্জন প্রান্ত, নদী তীর, উন্মুক্ত আকাশ, বালুচর, অবারিত সবুজ মাঠ, ছায়া সুনিবিড় গ্রামে সহজ অনাড়ম্বর পল্লীজীবন, অভাবক্লিষ্ট অথচ শান্ত-সহিষ্ণু গ্রামবাসী কবি হৃদয় বিমুগ্ধ বিস্ময়ে, পুলকে, শ্রদ্ধায় ও বিশ্বাসে এসবের অপরিসীম সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করেছেন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পল্লীজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। পল্লীজীবনের নানা বেদনা আর আনন্দ যখন তাঁর মনকে অধিকার করে বসলো, তখন তাঁর ভাব ও কল্পনার মধ্যে আপনা-আপনি বিভিন্ন গল্প রূপ পেতে শুরু করলো।

১৮৯৪ সালের ২৭ জুন শিলাইদহ থেকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আজকাল মনে হচ্ছে, যদি আমি আর কিছুই না করে ছোটছোট গল্প লিখতে বসি তাহলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। গল্প লিখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আবার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধঘরের সঙ্কীর্ণতা দূর করবে এবং রৌদ্রের সময় পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াব’।

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, দিনাতিপাত ও সাধারণের জীবনদর্শনকে কাজে লাগিয়ে তুলে ধরা যাবে পুরো সমাজচিত্র এবং এর মাধ্যমেই সমৃদ্ধ হবে গোটা বাংলা সাহিত্য। যদিও পদ্মা বোটে, পাবনার শাহজাদপুর ও নওগাঁর পতিসরে জমিদারি তদারকির সুবাদেই রবীন্দ্রনাথের গল্পে উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজের উঁচু স্তর থেকে পুরোপুরি নিচুস্তরের মানুষের কথা, আচার-ব্যবহার-সংস্কৃতি আর নির্বিকার শুদ্ধ জীবনাচার। তাঁর পুরো সাহিত্য জীবনকে বিশ্লেষণ করলে ছোটগল্পের সময়টুকু যে খুব বড় তা নয় বরং ব্যাপক বর্ণাঢ্য ও সুগভীর দৃষ্টিভঙ্গিমার সার্থক উপমা। তাঁর গল্পের অধিকাংশ ঘটনা ও চরিত্র বাস্তব এবং কেবলমাত্র ভালোবাসার চাদরে মোড়ানো এসব চরিত্রের প্রকাশ। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটিও প্রণিধান আবশ্যক, ‘এগুলি নেহাত বাস্তব জিনিস। যা দেখেছি, তাই বলেছি। ভেবে বা কল্পনা করে আর কিছু বলা যেত, কিন্তু তাতো করিনি আমি’। (-রবীন্দ্রনাথের উক্তি, আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ)

রবীন্দ্রনাথের গল্পে অবলীলায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের মানুষ আর প্রকৃতি। তাঁর জীবনে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনাচার বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ছোটগল্পের চরিত্রগুলোও কী বিচিত্র! অধ্যাপক, উকিল, এজেন্ট, কবিরাজ, কাবুলিওয়ালা, কায়স্থ, কুলীন, খানসামা, খালাসি, কৈবর্ত, গণক, গোমস্তা, গোয়ালা, খাসিয়াড়া, চাষি, জেলে, তাঁতি, নাপিত, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, দারোগা, দালাল পণ্ডিতমশাই, নায়েব, ডাক্তার, মেথর, মেছুনি, মুটে, মুদি, মুন্সেফ, যোগী, রায়বাহাদুর, সিপাহী, বাউল, বেদে প্রমুখ। তাঁর গল্পের পুরুষ চরিত্র ছাড়া নারী চরিত্র অধিকতর উজ্জ্বল।

বিভিন্ন গল্পের চরিত্রের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একসময় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, ‘পোস্টমাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকতো। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে’।

সত্যিকার অর্থেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনাচারের সামগ্রিক উপমার সবিশেষ ফলাফল পেয়েছিলেন নিজেকে জমিদারিতে নিযুক্ত করে। ছোটগল্প লেখা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্পর্কেই করে গেছেন সহজ ও সাবলীল স্বীকারোক্তি, ‘আমি প্রথমে কেবল কবিতাই লিখতুম, গল্পে-টল্পে বড় হাত দিই নাই’।মাঝে একদিন বাবা ডেকে বললেন, ‘তোমাকে জমিদারির বিষয়কর্ম দেখতে হবে’। আমি তো অবাক; আমি কবি মানুষ, পদ্য-টদ্য লিখি, আমি এসবের কী বুঝি? কিন্তু বাবা বললেন, ‘তা হবে না, তোমাকে এ কাজ করতে হবে। ‘কী করি? বাবার হুকুম, কাজেই বেরুতে হলো। এই জমিদারি দেখা উপলক্ষে নানা রকমের লোকের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয় এবং এ থেকেই আমার গল্প লেখারও শুরু হয়’।

কেবল ছোটগল্প সৃষ্টিই নয় বরং তিনি তৎকালীন সময়ের চিত্র তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসী ও বিশ্বসাহিত্যকর্মীদের সামনে। আরও একটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর গল্পে, সেটিকে ভাষাশৈলীর চরম উৎকর্ষতা বললে ভুল হবে না- সেটি প্রকাশ ভঙ্গিমা। তাঁর গল্পগুচ্ছের সর্বমোট ১১৯টি গল্পের প্রকাশ ভঙ্গিমা ব্যতিক্রমধর্মী। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ যে কথা কবিতায়, গানে প্রকাশ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং যে কথা তিনি সাধারণ, সাবলীল ভাষায় বলতে পারেননি তাই ব্যক্ত করেছেন গল্পে। তারপরও জীবনাচার, ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে না গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ছোটগল্পের মারাত্মক যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে তিনি নিজেই সারথি ও নিজেই অর্জুন।

প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণ একাত্মবোধ, জীবনের আপাততুচ্ছ ব্যাপারকেও পরম রমণীয় ও অপূর্ব রহস্যময় হিসেবে অনুভব করা, এসবের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, নিজেকে একান্তভাবে নির্লিপ্ত করে দিয়ে একমনে জীবনকে প্রকৃতির সব অভিব্যক্তির মধ্যে উপভোগ করা- এসবই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোতে অপূর্ব রসে অভিষিক্ত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজনীনভাবে আমৃত্যু গভীরভাবে ধ্যান-জ্ঞান বিলিয়ে দেওয়ার সাধনায় নিমিত্ত থেকে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। কখনও তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন কবিতায়, মানুষের জীবনের শোকগাথাকে তুলে ধরেছেন ছোটগল্প-উপন্যাসে, কখনও বিজয়মুকুটে আসীন হয়েছেন সঙ্গীতের মূর্ছনায়। মানবসত্তাকে বিশ্বপ্রকৃতির কাছে প্রকাশ করতে, বিশেষভাবে বাঙালিকে শেখাতে চেয়েছিলেন- সার্বজনীন হয়ে বিশ্বমানবতার পথে হাঁটতে। তাই রবীন্দ্রনাথ তার মহৎ সাহিত্যকর্মের জন্যই মানুষের কাছে বাঙালির পাঠকের কাছে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। বাংলা, বাংলা সাহিত্য আর রবীন্দ্রনাথ একই সত্তা। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার পরিপূর্ণতা অর্জন কখনই সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্যিক আশ্রয়। আমাদের জাতিসত্তার শেকড়ে প্রোথিত যে মূল মর্মবাণী তার পুরোটা জুড়েই কেবল রবীন্দ্রনাথ।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

Doinik sabder methopath

Vol -327.Dt -31.03.2017

======{========∆∆∆==============


Monday 29 March 2021

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

তাঁর জন্ম ১৮৯৯ সালে ৩০ মার্চ উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর শহরে নিজ মাতুলালয়ে। আদিনিবাস পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যস্থিত উত্তর কোলকাতার বরানগর কুঠিঘাট অঞ্চল।বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মা বিজলীপ্রভা দেবী। বন্দ্যপাধ্যায়দের আদি নিবাস ছিল কলকাতার উত্তরে বরানগরে। তারাভূষণ বিহারের পূর্ণিয়ায় ওকালতি করতেন। সেখান থেকে তিনি মুঙ্গেরে আসেন। সেই সুবাদে শরদিন্দুর স্কুলশিক্ষা মুঙ্গেরে। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর শরদিন্দু কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন।


তাঁর রচিত প্রথম সাহিত্য প্রকাশিত হয় তাঁর ২০ বছর বয়সে, যখন তিনি কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে করছিলেন। সেটা ছিল বাইশটি কবিতার সংকলন ‘যৌবন-স্মৃতি’। ১৯২৬ সালে পটনা থেকে আইন পাশ করার পর বাবার জুনিয়র হিসাবে শরদিন্দু ওকালতি শুরু করেন। কিন্তু মন পড়ে থাকে সাহিত্যচর্চায়। শেষ পর্যন্ত ১৯২৯-এ ওকালতি ছেড়ে সাহিত্যকেই জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেন শরদিন্দু। তিনি চন্দ্রহাঁস, ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন।


রচনা কর্ম :
ব্যোমকেশ বক্সী সিরিজ 
মূল নিবন্ধ: ব্যোমকেশ বক্সী
ব্যোমকেশের ডায়েরী (১৯৩৩)
ব্যোমকেশের কাহিনী (১৯৩৩)
ব্যোমকেশের গল্প (১৯৩৭)
দুর্গরহস্য (১৯৫২)
চিড়িয়াখানা (১৯৫৩)
আদিম রিপু (১৯৫৫)
বহ্নি-পতঙ্গ (১৯৫৬)
সসেমিরা (১৯৫৯)
কহেন কবি কালিদাস (১৯৬১)
ব্যোমকেশের ছ'টি (১৯৬২)
ব্যোমকেশের ত্রিনয়ন (১৯৬২)
মগ্নমৈনাক (১৯৬৩)
শজারুর কাঁটা (১৯৬৭)
বেণীসংহার (১৯৬৮)

সংকলন
শরদিন্দু অমনিবাস: প্রথম খণ্ড (১৯৭০)
শরদিন্দু অমনিবাস: দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৭১)
ব্যোমকেশ সমগ্র (১৯৯৫)
ঐতিহাসিক উপন্যাস 
কালের মন্দিরা (১৯৫৩)
গৌড়মল্লার (১৯৫৪)
তুমি সন্ধ্যার মেঘ (১৯৫৮)
কুমারসম্ভবের কবি (১৯৬৩)
তুঙ্গভদ্রার তীরে (১৯৬৫)
শিবাজী আর সদাশিব
বিষকন্যা
গল্প-সংকলন 
জাতিস্মর (১৯৩২)
চুয়াচন্দন (১৯৩৫)
বুমের‌্যাং (১৯৩৮)
কাঁচামিঠে (১৯৪২)
শাদা পৃথিবী (১৯৪৮)
এমন দিনে (১৯৬২)
শঙ্খ-কঙ্কণ (১৯৬৩)

শরদিন্দুর জীবনে সিনেমার, বিশেষ করে বম্বের সিনেমার, খুব বড় ভূমিকা ছিল। ভাবী, বচন, দুর্গা, কঙ্গন, নবজীবন, আজাদ, পুনর্মিলন— বম্বে টকিজ়ে সাতটি ছবির গল্প লিখেছিলেন শরদিন্দু।ইংরেজিতে লিখতেন, হিন্দিতে রূপান্তরিত করে নেওয়া হত। তিনি যে ছবিগুলিতে চিত্রনাট্যকারের কাজ করেছেন সেগুলি হল দুর্গা (১৯৩৯), কঙ্গন (১৯৩৯), নবজীবন(১৯৩৯) ও আজাদ (১৯৪০)। তার বিভিন্ন রচনা থেকেও সিনেমা তৈরি হয়েছে, যেমন নিম্নলিখিত বাংলা সিনেমাগুলি -

চিড়িয়াখানা - নির্দেশক সত্যজিত রায়
ঝিন্দের বন্দী - নির্দেশক তপন সিংহ
বিষের ধোঁয়া
দাদার কীর্তি - নির্দেশক তরুণ মজুমদার

১৯৩২ এ "সত্যান্বেষী"উপন্যাসে ব্যোমকেশের আত্মপ্রকাশ। প্রথমে শরদিন্দু অজিতের কলমে লিখতেন। কিন্তু পরে তিনি তৃতীয়পুরুষে লিখতে শুরু করেন। এছাড়া উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে আছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপন্যাস। যেমন 'কালের মন্দিরা', 'গৌর মল্লার', 'তুমি সন্ধ্যার মেঘ', 'তুঙ্গভদ্রার তীরে', ইত্যাদি। সামাজিক উপন্যাস যেমন 'জাতিস্মর', 'বিষের ধোঁয়া' বা অতিপ্রাকৃত নিয়ে তার 'বরদা সিরিজ' ও অন্যান্য গল্প এখনো বেস্টসেলার। শরদিন্দু ছোটগল্প ও শিশুসাহিত্য রচনাতেও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র সদাশিব মারাঠা বীর শিবাজীর অভিযানের সাথে সম্পৃক্ত।শরদিন্দু ১৯৩৮ সালে বম্বের বম্বে টকিজ এ চিত্রনাট্যকাররূপে কাজ শুরু করেন। ১৯৫২এ সিনেমার কাজ ছেড়ে স্থায়ীভাবে পুনেতে বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তী ১৮ বছর তিনি সাহিত্য চর্চায় অতিবাহিত করেন।

সিনেমা ও ব্যোমকেশ বক্সী পর্ব এবং অন্যান্য

* সত্যান্বেষী aka The Seeker of Truth (1931)
* পথের কাঁটা aka The (Thorns in the Path) Gramophone Pin Mystery (1932)
* সীমান্ত হীরা aka The Hidden Heirloom (1932)
* মাকড়সার রস aka The Venom Of The Tarantula (1933)
* অর্থমনর্থম aka Where There’s a Will (1933)
* চোরাবালি aka Quicksand (1933)
* অগ্নিবাণ aka Calamity Strikes (1935)
উপসংহার aka An Encore for Byomkesh (1935)
* রক্তমুখী নীলা aka The Deadly Diamond (1936)
* ব্যোমকেশ ও বরোদা aka Byomkesh and Barada (1936)
* চিত্রচোর aka Picture Imperfect (1951)
* দুর্গ রহস্য The Mystery of the Fortress(1952)
 চিড়িয়াখানা aka The Menagerie (1953)
* আদিম রিপু aka The Ancient Enemy (1955)
* বহ্নি-পতঙ্গ (1956)
* রক্তের দাগ aka Bloodstains (1956)
* মনিমন্দন aka The Jewel Case (1958)
* অমৃতের মৃত্যু aka The Death of Amrito (1959)
* সাইলো রহস্য aka Phantom Client (1959)
অচিন পাখি aka The Avenger (1960)
* কহেন কবি কালিদাস aka Thus spoke Kavi Kalidasa (1961)
* অদৃশ্য ত্রিকোন aka The Invisible Triangle (1961)
* খুঁজি খুঁজি নারী aka The Will that Vanished (1961)
* অদ্বিতীয় aka Unique (1961)
* মগ্নমৈনাক (1963)
* দুষ্টচক্র aka The Crooked Circle (1963)
* হেঁয়ালির ছন্দ aka The Rhythm of Riddles (1964)
* রুম নম্বর দুই aka Room Number 2 (1964)

* ছলনার ছন্দ aka Man in a Red Coat (1965)
* শজারুর কাঁটা aka The Quills of the Porcupine (1967)
* বেণীসংহার (1968)
* লোহার বিস্কুট aka Iron Biscuits (1969)
* বিশুপাল বধ (অসমাপ্ত) aka The Slaying of Bishupal (1970)

সিনেমার রাইটার হিসাবে তাঁর কীর্তি:
Bengali:-
*ঝিন্দের বন্দী (1961) —Directed by Tapan Sinha
*চিড়িয়াখানা (1966) —Directed by Satyajit Ray
*শজারুর কাঁটা (1974) -directed by Manju Dey
*দাদার কীর্তি —Directed by Tarun Majumdar
সত্যান্বেষী (2013), Directed by Rituparno Ghosh
*ব্যোমকেশ ফিরে এলো (2014) —Directed by Anjan Dutt
*সজারুর কাঁটা (2015) —Directed by Saibal Mitra
*ব্যোমকেশ বক্সী (2015) —Directed by Anjan Dutt

*বহ্নি পতঙ্গ (2015) —Directed by Arindam Sil
*মনচোরা (2015) —Directed by Sandip Ray
*ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা (2016) -Directed by Anjan Dutta

*ব্যোমকেশ পর্ব (2016) -Directed by Arindam Sil
*বারোদা ও বহুরূপী (2016) -Directed by Neelotpal Sinharoy
*ব্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ (2017) -Directed by Anjan Dutt
*ব্যোমকেশ গোত্র (2018) -Directed by Arindam Sil
*বিদায় ব্যোমকেশ (2018) -Directed by Debaloy Bhattacharaya

Hindi:-
*Bhabhi (1938) directed by Franz Osten
*Vachan (1938) directed by Franz Osten
*Trishagni (1988) directed by Nabendu Ghosh
*Detective Byomkesh Bakshi (2015) directed by Dibakar Banerjee।


১) তিশগ্নি' নামে একটি পুরস্কারপ্রাপ্ত হিন্দি ছবি লেখকের ঐতিহাসিক ছোটগল্প 'মরু ও সঙ্ঘ'র চিত্ররুপ। 
২)তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার (উপন্যাস 'তুঙ্গভদ্রার তীরে'র জন্য), 
৩) শরৎস্মৃতি পুরস্কার,
৪) মতিলাল পুরস্কার প্রভৃতি 
          পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭০ সালে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
      Doinik sabder methopath
      দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
     Vol -326. Dt -30.03.2021
         ১৬ চৈত্র, ১৪২৭. মঙ্গলবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷{{{{{{{{{{{(÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
"
"মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এ বিশ্বাসী উৎপল দত্ত চেয়েছিলেন নাটকের মাধ্যমে সামাজিক জীবনের বদল ঘটাতে। ফলে তাঁর নাটকে বাস্তবতা এসেছে তীক্ষ্ণ এবং অনাবৃত্ত রূপে। জগৎ ও জীবনের কোমল সুন্দর মুহূর্তের প্রতি তাঁর কোন আস্থা ছিল না। আর ছিলনা বলেই তাঁর অঙ্কিত চরিত্রগুলির মধ্যে রুক্ষতা ও রূঢ়তা লক্ষ্য করা যায়। সেই কারণেই তাঁর নাটকের সংলাপ‌ও তীক্ষ্ণ , যা পরিবেশের সঙ্গে চরিত্রের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।"

                        উৎপল দত্তের জন্ম ২৯ মার্চ , ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ। সম্পূর্ণ নাম উৎপলরঞ্জন দত্ত। পারিবারিক ধর্মগুরু তাঁর ডাকনাম রেখেছিলেন শঙ্কর । জন্মস্থান সম্পর্কে সামান্য হলেও বিতর্ক রয়েছে। জানা যায় বাংলাদেশের বরিশাল জেলার কীর্তনখোলায় তাঁর জন্ম। যদিও পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল কুমিল্লা জেলায়। অথচ তিনি নিজে তাঁর জন্মস্থান মামার বাড়ি শিলং - এ বলে উল্লেখ করে গিয়েছেন । সে যাইহোক উৎপল দত্তের বাবা হলেন গিরিজারঞ্জন দত্ত ও মা হলেন শৈলবালা রায় (দত্ত) । পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে উৎপল দত্ত ছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান।
                        তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল শিলং শহরের সেন্ট এডমন্ড স্কুলে । তারপর বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ স্কুলে। পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ।যে কোন ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে সমকাল, পারিবারিক পরিমণ্ডল সর্বোপরি প্রতিভা খুব গুরুত্বপূর্ণ। উৎপল দত্তের ক্ষেত্রে এই তিনের নিখুঁত মেলবন্ধন তাঁকে তাঁর প্রতিভার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। উৎপল দত্তের জীবনী পর্যালোচনায় জানা যায় তাঁদের বাড়ির সদর দরজায় নাকি তাঁর মায়ের হাতে তৈরি এমব্রয়ডারি করা শেক্সপিয়ারের 'হ্যামলেট' নাটকের সংলাপ ঝুলত। মেজদা মিহিররঞ্জন কিশোর উৎপলকে শেক্সপিয়ারের নাটকের গল্প পড়ে শোনাতেন। বাড়িতে রেকর্ড চালিয়ে নাটক শোনার চল ছিল। সুতরাং বোঝাই যায় উৎপল দত্তকে তাঁর স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর পারিবারিক উপাদান কম ছিল না।
দাম্পত্য সঙ্গী - শোভা সেন (বি. ১৯৬০–১৯৯৩)
সন্তান - বিষ্ণুপ্রিয়া দত্ত।
                 নাট্যকার রূপে আবির্ভাবের পূর্বে তিনি অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন ১৯৪৭ সালে  জিওফ্রে কেন্ডালের শেক্সপিয়ার ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানিতে যোগ দেন। শুধু শেক্সপিয়ারের নাটক নয় বার্নাড শ, গোল্ডস্মিথ প্রভৃতি নাট্যকারের নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৪৯ এ লিটল থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন এবং উপলব্ধি করেন সমকালীন রাজনৈতিক সামাজিক ও প্রাকৃতিক দুর্বিপাকময় পরিস্থিতি,  যার মধ্যে ছিল দেশ বিভাগ তেভাগা আন্দোলন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্যা মহামারী দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি। এমন পরিস্থিতিতে নতুন সমাজ গড়ার পরিকল্পনা তিনি দীক্ষিত হন মার্কসবাদে। ১৯৫১ সালে তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্কৃতিক নাট্যসংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত হোন- নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে. গণনাট্য সংঘের প্রথম বাংলা নাটক 'সাংবাদিক" রচনা করেন ১৯৫২ সালে। এটি অনুবাদ মূলক নাটক। এছাড়া  তিনি অনুবাদ করেছিলেন শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ মার্চেন্ট অফ ভেনিস মিডসামার নাইটস ড্রিম জুলিয়াস সিজার, জার্মান নাট্যকার ভোলিফ প্রফেশর মামলক , ম্যাক্সিম গোর্কির লোয়ার ডেপথস এর অনুবাদ নীচের মহল প্রভৃতি। তাাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক ১৯৫৮ তে প্রকাশিত হয়  ছায়ানট ।পরবর্তীতে অনেক নাটক তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে অভিনয়ের মাধ্যমে -        "  বর্গী এলো দেশে টিনের তলোয়ার সূর্যশিকার ব্যারিকেড  টোটা ,দুঃস্বপ্নের নগরী লেলিন কোথায় এবার রাজার পালা তিতুমীর দাঁড়াও পথিকবর শৃংখল ছাড়া অগ্নিশয্যা  নীল সাদা লাল একলা চলো দৈনিক বাজার পত্রিকা লাল দুর্গ ক্রুশবিদ্ধ ফুলবাবু জনতার আফিম ফেরারী ফৌজ অজয় ভিয়েতনাম মানুষের অধিকার দিন বদলের পালা টিনের তলোয়র ,ঘুম নেই প্রভৃতি।
              নাটক নির্বাচন নাটকসম্পাদনা ভূমিকা বন্টন মহড়া আলো-শব্দে মঞ্চ সাজসজ্জা সঙ্গীত প্রভৃতি দিক থেকে সমন্বিত করে তিনি যে নাট্য পরিবেশনা র দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাতে এক যুগের দর্শক তাঁর কাছে ঋণী। সমালোচনা, প্রযোজনা ও পরিচালনায় কৃতিত্ব নয় অভিনেতা হিসেবেও তাঁর উজ্জ্বল চরিত্র, মঞ্চ সাফল্য পেয়েছে, দর্শকের মন জয় করেছে।  
উৎপল দত্ত অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র –
বিদ্যাসাগর (১৯৫০), মাইকেল মধুসূদন (১৯৫০), চৌরঙ্গী (১৯৬৮), ভুবন সোম (১৯৬৯), গুড্ডি (১৯৭১), ক্যালকাটা ৭১ (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), ঠগিনী (১৯৭৪), যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪), কোরাস (১৯৭৪), পালংক (১৯৭৫), অমানুষ (১৯৭৫), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), গোলমাল (১৯৭৯), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), আঙ্গুর (১৯৮২), পার (১৯৮৪), পথভোলা (১৯৮৬), আজ কা রবিনহুড (১৯৮৭), আগন্তুক (১৯৯১), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩) ইত্যাদি।



তিনি অভিনয় করেছেন -
 মামলক ( প্রফেসর মামলক), ওথেলো (ওথেলো) ভক্ত প্রসাদ (বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ) বেনীমধব  (টিনের তলোয়ার ), স্ট্যালিন (স্ট্যালিন) ,মধুসূদন (দাঁড়াও পথিকবর) প্রভৃতি ।

     নাট্যচর্চা কে প্রসারিত করতে তিনি এপিক থিয়েটার এবং প্রসেনিয়াম নামে দুটি থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। 
          তিনি জানতেন -"নাটক মানে সংগ্রাম নাটক সংগ্রামের হাতিয়ার'। জগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল . তাই ছাঁচে ঢালা দুর্বলতাহীন অবিমিশ্র নিখাদ বীর চরিত্রের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা তাই লোহার ভীম একাঙ্ক নাটকের সুলতান খানেের মুখে সেই সংলাপ বসিয়েছিলেন - "ক্ষুধার কাছে ইজ্জত দাঁড়াতে পারে না" এই নাটকের মঞ্চ নির্দেশ বর্ণনা   ইবসেনীয়  নাট্যরীতি কে মনে করিয়ে দেয় । তাাঁর একাঙ্ক নাটক গুলিতে সমাজ ও রাজনৈতিক দর্শন , ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ময় সংলাপ নাটকগুলোকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। তাাঁর 
ঘুম নেই, মে দিবস, ইতিহাসের কাঠগড়ায়, দ্বীপ, কাকদ্বীপের এক মা , লৌহমানব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি কিছু যাত্রাপালা লিখেছিলেন।  যেমন
 রাইফেল, জালিওয়ালাবাগ, দিল্লি চলো, সন্ন্যাসীর তরবারি, মাও সে তুং, মুক্তি দীক্ষা, অরন্যের ঘুম ভাঙছে, স্বাধীনতার ফাঁকি, দামামা ঐ বাজে, নীল রক্ত, জয়বাংলা, সমুদ্র শাসন, ঝড়, বৈশাখী মেঘ, তুরুপের তাস, সীমান্ত, সাদা পোশাক, কুঠার ও বিবিঘর। 
 লোকনাট্য গণবাণী তরুণ অপেরা এবং তাঁর নিজস্ব যাত্রাদল এই সমস্ত যাত্রাপালা অভিনয় করেছে । আর  তাঁর একটি সাংগঠনিক দিক ছিল  
- ১৯৬৪ তেে সত্যজিৎ রায় কে সভাপতি করে তিনি  ব্রেখট সোসাইটি গঠন করেন। প্রসেনিয়াম ১৯৬২ ও এপিক থিয়েটার ১৯৬৫  নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করেে প্রকাশ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ গুলো হল - 



   বাংলা নাট্য জগৎ ও বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের অসাধারণ শিল্পী উৎপল দত্ত এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব ।যিনি অসামান্য ব্যক্তিত্ব ঐতিহ্যের প্রতীক। অসাধারণ পাণ্ডিত্য সৃজনশীলতার বস্তুবাদী জীবন দর্শনে বিশ্বাসী ।শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত পরিশ্রমী এক নাট্যকর্মী। যার উৎকর্ষ বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলা নাট্যজগতে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে । তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক নাট্যকার অভিনেতা পরিচালক ও সংগঠক।


 মৃত্যু - ১৯৯৩ খ্রীস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
      দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
      Doinik Sabder Methopath
     Vol -325. Dt -29.03.21
      ১৫ চৈত্র,১৪২৭. সোমবার
======{{{{======{{{{{======={{{{{{=====

Sunday 28 March 2021

প্রকৃত নাম আলেক্সেই মাক্সিমোভিচ পেশকভ। রুশ লেখকের জন্ম ১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ,মধ্যরাশিয়ার ভোলগা নদীতীরবর্তী নিজনি নোভ্গরদ শহরে। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছিলেন।পিতা মাক্সিম সাভ্ভাতেভিচ পেশকভ ছিলেন আস্ত্রাখান শহরের স্টিমশিপ কারখানার ছুতারমিস্ত্রি। মা ভারভারা ভাসিলিয়েভনা পেশকভা। লেখকের চার বছর বয়সের সময় কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পিতার মৃত্যু ঘটে। সহায়সম্বলহীন মা তাঁদের দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নিজ পিত্রালয়ে চলে আসতে বাধ্য হন। পথের মধ্যে স্টিমারে মৃত্যু ঘটে ছোট ভাইটির। একমাত্র জীবিত সন্তান গোর্কিকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর মা আশ্রয় নেন পিতা-ভ্রাতাদের কাছে। গোর্কির কৈশোরের একটি পর্যায় কেটেছে নানাবাড়িতে। অন্ধকারময় একটি কৈশোর। এখানে কিশোরের জন্য একমাত্র মানসিক আশ্রয় ও শান্তির জায়গা ছিলেন তার দিদিমা। কুরুশ-কাঁটায় সুতার কাজে খুবই দক্ষ ছিলেন দিদিমা। সেইসঙ্গে রুশ লোককথা, লোককাহিনী, রূপকথা আর লোকসংগীতের এক অফুরন্ত স্মৃতিভাণ্ডার ছিলেন তিনি। কুরুশ বুনতে বুনতেই তিনি কিশোর নাতিকে শোনাতেন সেইসব লোকজ গল্পগাথা-সংগীত। দিদিমার মুখে শোনা ছড়া, লোককথা, রূপকথা, লোককাহিনীর কারণেই সম্ভবত গোর্কির সাহিত্যের এক বিরাট অংশ জুড়ে রূপকথা ও লৌকিক উপাদানের এত প্রাচুর্য। আন্তন চেখভকে এক চিঠিতে গোর্কি লিখেছিলেন—‘দশ বছর বয়স থেকে আমাকে নিজের রাস্তা বেছে নিয়ে চলতে হয়েছে। লেখাপড়া যে শিখব, তার জন্য কোনো পয়সাকড়ি ছিল না। আমি কেবল জীবন আর কাজ গলাধঃকরণ করেছি। এর বাইরে আর কিছুই করতে পারিনি, আর জীবন তার কিল-চড়-ঘুষি মেরে আমাকে তাতিয়ে রেখেছে"। এরপর শুরু হয় তার কঠিন জীবন।

প্রথমে একটি শৌখিন জুতার দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখানে সারা দিন শ্রম দিতে হতো তাকে। এরপর কিশোর পেশকভ কাজ নেন কয়েদি বহনের জাহাজে। তার কাজ ছিল জাহাজের কর্মচারীদের বাসন-কোসন ধোয়া।

সেখানে ভোর ছয়টা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত তাকে ঘাম ছুটাতে হতো। পেটের দায়ে ভালো কাজের আশায় পেশা বদলাতে থাকেন পেশকভ। কিন্তু কোথাও শান্তি পাননি।

অবশেষে পেশকভ শান্তি খুঁজে পান বইয়ের পাতায়। তিনি ছিলেন বইয়ের পোকা। অভাব-অনটন, হাড়ভাঙা পরিশ্রম- এত কিছুর মধ্যেও থামেনি তার বই পড়া। রুশ কবি পুশকিনের একটি কবিতার বই তাকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।

দরিদ্রতা পেশকভের পিছু ছাড়েনি। এক পর্যায়ে তিনি কাজ নেন একটি রুটির কারখানায়। সেখানে সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত একটানা কাজ করতে হতো। দারিদ্র্যের কশাঘাত আর দিনের পর দিন ঘামঝরা শ্রমের ধকলে মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি।

জীবন হয়ে পড়ে তার কাছে অর্থহীন। তিক্ত জীবনের অবসান ঘটাতে পিস্তল কেনেন তিনি।

সময়টা ১৮৮৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর। পেশকভের বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। নদীর তীরে গিয়ে নিজের বুকেই গুলি করলেন পেশকভ। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

চিকিৎসকরা তার জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। নিঃসন্দেহে এটা ছিল তার দ্বিতীয় জীবন। নব-উদ্যমে জীবন শুরু করেন পেশকভ। সেই থেকে লেখালেখির গোড়াপত্তন। ধারণ করেন নতুন নাম- মাক্সিম গোর্কি। রুশ ভাষায় ম্যাক্সিম অর্থ সর্বাধিক আর গোর্কি অর্থ তেতো।

প্রথাগত রচনার বাইরে গোর্কির লেখায় প্রাধান্য পায় সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনালেখ্য। ১৮৯৮ সালে তার লেখা প্রবন্ধ ও গল্প নিয়ে একটি সংকলন ‘রেখাচিত্র ও কাহিনী’ প্রকাশিত হয়।

বইটি প্রকাশের পর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গোর্কির খ্যাতি। ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয় তার সার্থক উপন্যাস ফোমা গর্দিয়েভ। ১৯০১ সালে বিপ্লবী ছাত্রদের হত্যার প্রতিবাদে গোর্কি রচনা করলেন ‘ঝোড়ো পাখির গান’ নামের কবিতা। ওই কবিতা হয়ে ওঠে বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্র। তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিবাদের মুখে তাকে ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয় সরকার।

ক্রমে গোর্কি হয়ে ওঠেন লেনিন আদর্শের কর্মী, লেখনীর মাধ্যমে মানবিক সমস্যার চিত্র তুলে ধরার সুদক্ষ শিল্পী। গোর্কিকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। নির্বাসনে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পাঠানো হয় ক্রিমিয়ার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

সুস্থ হয়ে নাটক লিখতে শুরু করেন গোর্কি। ১৯০২ সালে লিখলেন লোয়ার ডেপথ। এই নাটকের পর গোর্কির পরিচিতি রাশিয়ার সীমা পেরিয়ে ছড়িয়ে যায় সমগ্র ইউরোপে। গোর্কি হয়ে ওঠেন ইউরোপের বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর।
সমসাময়িক কথাসাহিত্যিক লিওনিদ লিওনভকে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— ‘আমি দেখতে ভালোবাসি মানুষের বেড়ে ওঠা।’ সেই মানুষের বেড়ে ওঠা দেখার সবচেয়ে ভালো সময় ছিল এই ভ্রমণকাল।

লেখনীর কারণে জীবনে বহুবার জার শাসকের রোষানলে পড়েছিলেন গোর্কি। বারবার তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। আবারও গ্রেফতার হতে পারেন এমন খবর পেয়ে দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

অবশেষে তিনি জার্মানি ও ফ্রান্স হয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯০৭ সালে সেখানে বসেই তিনি রচনা করেন তার বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস মা। এ উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি নাম লেখান অমরত্বের খাতায়।

পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত ও বিক্রীত উপন্যাসের নাম ‘মা’। পৃথিবীর সকল দেশে, সকল ভাষাভাষীর মধ্যে, সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘পাভেল’ নাম্নী যুবকের সন্ধান পাওয়া যাবে। অনেকেরই ধারণা নেই যে, এটি ‘মা’ উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র পাভেলের নামানুসারে রাখা হয়ে থাকে। ‘মা’ উপন্যাসের পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত প্রভাবের এটি একটি দিক। সারা পৃথিবীর কোটি কোটি শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির লড়াইতে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে ‘মা’ উপন্যাস। এখনো এই চিন্তাধারা বহমান। পাশাপাশি শৈল্পিক বিবেচনাতেও এই উপন্যাসকে পাঠ করতে হয় রুশ তথা সারা পৃথিবীর সাহিত্যপ্রেমীদের। সাহিত্যিক মতাদর্শ হিসেবে একসময় আবির্ভূত হয়েছিল ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদ’। সেই মতাদর্শের পরিপূর্ণ ধারক সাহিত্যিক-মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯০৬-০৭ সালে রচিত এই উপন্যাসটিকে।




প্রথম লেখা প্রকাশের ১০ বছরের মধ্যেই মাক্সিম গোর্কি রাশিয়ার সাহিত্যজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। লেভ তলস্তয় ও আন্তন চেখভের মতোই তাঁর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা হয়ে দাঁড়ায় আকাশছোঁয়া। এমনকি গোর্কি তখন যে পোশাক পরতেন, সেই পোশাকটিও সমাজের অনেক স্তরের স্টাইলিস্ট মানুষের কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। তিনি পরতেন নীল রঙের গলাবন্ধ কোর্তা, বোতাম-আঁটা হাতা, চাষাভূষাদের কানাততোলা বুটজুতা। সেই পোশাক হয়ে ওঠে ব্যক্তিত্বের প্রতীক। অথচ তখনো তিনি ‘মা’ উপন্যাস রচনা করেননি।


১৯০৬ সালে জার সরকারের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে তিনি প্রথমে রাশিয়া ছেড়ে ফিনল্যান্ডে চলে যান। পরে সুইজারল্যান্ড হয়ে আমেরিকায়। সেখানেই রচিত হয় অবিস্মরণীয় ‘মা’ উপন্যাসটি।

বস্তুত রুশ সাহিত্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে প্রতিভার মিছিল। তারপরও রাশিয়ার সাহিত্যজগতে মাক্সিম গোর্কির স্থান অনেক উঁচুতে। সাধারণ মানুষ যেমন তাঁর রচনা পাঠ করেছে গভীর সহমর্মিতার সঙ্গে, তেমনই বিদগ্ধ সমালোচকরাও তাঁকে স্থান দিয়েছেন অনেক উঁচুতে। রুশসাহিত্যের প্রথম লেখক হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ইভান বুনিন। সেই বুনিনের চাইতে সমকালীন গোর্কিকে অনেক ওপরের স্তরের লেখক বলে দাবি করতেন রুশবাসী। এই প্রসঙ্গে নন্দনতাত্ত্বিক মারিয়া তস্ভেতায়েভা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন—‘নোবেল পুরস্কার। ২৬ তারিখে অনুষ্ঠান। উপস্থিত থাকব বুনিনের সম্মানে। প্রতিবাদের দায় এড়িয়ে যেতে হচ্ছে। প্রতিবাদ আমি করছি না। আমি শুধু বলতে চাই যে আমি একমত নই। কেননা বুনিনের চাইতে নিঃসন্দেহে বড় তো বটেই—অনেক বড়, অনেক মানবিক, অনেক বেশি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়ও বটে—গোর্কি। গোর্কি একটি যুগ, বুনিন একটি যুগের অবসান। কিন্তু যেহেতু এটা রাজনীতি, যেহেতু সুইডেনের রাজা কমিউনিস্ট গোর্কির গলায় পদক ঝোলাতে পারেন না, অগত্যা...’

নোবেল পুরস্কার পাননি মাক্সিম গোর্কি। তার চাইতে বড় পুরস্কার পেয়েছেন। সে পুরস্কার হচ্ছে বিশ্ব মানবতার মুক্তিযাত্রার সহযোদ্ধার স্বীকৃতি।
রাশিয়ার আরেক দিকপাল লেখক আন্তন চেখভ লিখেছিলেন—‘আমি শুধু খোলাখুলিভাবে অকপটে মানুষকে বলতে চেয়েছিলাম—নিজেদের দিকে একবার দেখুন, দেখুন-না কী বিশ্রী আর বিরস জীবনযাপন করছেন আপনারা! সবচেয়ে বড় কথা, লোকে যেন বুঝতে পারে, আর বুঝতে যখন পারবে তখন অবশ্যই তারা নিজেদের জন্য গড়ে তুলবে আর-এক জীবন, আরো ভালো এক জীবন। আমি তা দেখতে পাব না, কিন্তু আমি জানি তা হবে সম্পূর্ণ অন্যরকম—যেমন আছে তার মতো নয়। আপাতত তা যখন নেই, তখন আমি মানুষকে বলব, একবার বোঝার চেষ্টা করুন, কী বিশ্রী আর বিরস জীবনযাপন করছেন আপনারা।’

আন্তন চেখভ যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল মাক্সিম গোর্কির ‘মা’-এর পথচলা। নিজেদের বিশ্রী জীবন বদলানোর সর্বাত্মক যুদ্ধে শরিক হয়েছে এই উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা। ‘মা’ উপন্যাসের মাধ্যমে বিশ্বের উপন্যাসসাহিত্যে আর একটি নতুন ধারার সংযোজন হয়েছে। মাক্সিম গোর্কিই পৃথিবীতে প্রথম লেখক, যিনি সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবী শ্রমিকদের সংগ্রামের চিত্র অঙ্কন করেছেন। আর এই চিত্র ধারণ করে, পৃথিবীতে এই ধারার প্রথম উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে ‘মা’।

   মৃত্যু - ১৮ জুন ১৯৩৬.।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
     Doinik Sabder Methopath
       দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
      Vol -324. Dt -28.03.2021
        ১৪ চৈত্র,১৪২৭. রবিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷||||||||||÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷



Friday 26 March 2021

                     মল্লিকা সেনগুপ্ত
১.
" হাজার বছর ধ’রে কেন তুমি সূর্য দেখতে দাওনি
যে মাটিতে তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ তাঁর অপমান ক’রো না
পুরুষ আমি তো কখনো তোমার বিরুদ্ধে হাত তুলিনি।”
২ ।
"মেয়েটির কাছ থেকে একদিন তোমরা
কেড়ে নিয়েছিলে বেদ পড়বার সুযোগও
তোমরা বললে মেয়েরা শুধুই ঘরণী
মেয়েদের ভাষা, শূদ্রের ভাষা আলাদা".
৩.
"কখনো বিপ্লব হ’লে
পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য হবে
শ্রেণীহীন রাষ্ট্রহীন আলোপৃথিবীর সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে ? "
৪.
"পুরুষের দেহে এক বাড়তি প্রত্যঙ্গ
দিয়েছে শ্বাশত শক্তি, পৃথিবীর মালিকানা তাকে
ফ্রয়েড বাবুর মতে ওটি নেই বলে নারী হীনমন্য থাকে
পায়ের তলায় থেকে ঈর্ষা করে পৌরুষের প্রতি।”
৫.
" সুপুরুষ এসেছিল, আসেনি নারীরা
আমি সিন্ধুর মেয়ে, যোদ্ধা ও মানুষ
কালো মেয়েদের পায়ে তামার গগন
এত দীপ্যমান চোখে ঘোড়সওয়ারেরা
গর্ভে অগ্নি ঢেলে দিল, জন্মাল কার্তিক …”
৬.
"গণিকালয়, মীনবাজার তৈরী করে কারা ?
প্রতিযুগেই ইন্দ্র কেন উর্বশীর অধীশ্বর হন ?”

                       "শুধু মেয়েদের জন্যই কবিতা লিখেছেন মল্লিকা৷ তাঁর কবিতায় বার বার কথা বলেছে হাঘরে আর দেবদাসীরা৷ যদিও মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতা সম্পর্কে একটি লাইনও লেখা হলে মেয়েদের কথাই আগে চলে আসে কারণ যখন কবিতা লিখতে এসেছিলেন মল্লিকা তখন হাঘরেদের নিয়ে কবিতা লেখার কলমের অভাব ছিল না, কম পড়েছিল মেয়েদের কথা বলতে পারে এমন কলম।"

*** মধুর কবিতার বিরুদ্ধে, কৃত্তিবাস, জানুয়ারি, ১৯৯৯ , তিনি বলেছেন -

" চিনি বনাম নুন, অতিমধুর বনাম অনতিমধুরের চিরাচরিত দ্বন্দ্ব আজও মরে যায়নি। শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে বাংলা কবিতা যেন এক প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড়িয়েছে, যেন শিবির বিভাজনের উত্তাপ ভেসে আসছে হাওয়ায় – মধুর কবিতা না রক্তমাংসে নোনা কবিতা- আসলে এভাবে কোনও বিভাজন হয় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই ঠিক করে নিতে হবে বাংলা কবিতাকে তারা গুড়ের নাগরি বানাবে না রক্তমাংসে গড়া প্রাণের সন্তান।”


জন্ম ২৭ মার্চ ১৯৬০ কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

তাঁর কবি জীবন শুরু ১৯৮১ সালে এবং সেই থেকে তিনি ১১টি কবিতার বই, দুটি উপন্যাস এবং বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা কেন্দ্রে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। 
৯০ এর দশকে তিনি অপর্ণা সেন সম্পাদিত 'সানন্দা' পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদনা করতেন। 
       দাম্পত্য সম্পর্ক প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক , বাংলা কবিতা একাডেমির সম্মানিত সভাপতি সুবোধ সরকার 'এর সঙ্গে।

                 নারীজীবনকে, তার যন্ত্রণা, লড়াই ও মহিমাকে তিনি আগেই কবিতায় ধরেছিলেন পঞ্চাশ, ষাট আর সত্তর দশকের বেশ কয়েকজন মহিলা কবি৷ কিন্তু তাঁরা কেউই বিষয় ও ভাষায় তার মতো অতখানি স্পষ্ট ছিলেন না৷ আর্থসামাজিক কারণেই তাঁরা অতখানি স্পষ্ট হতে পারেননি৷ প্রথাগত ভাবে কবিতা বলতে বাঙালি যা বোঝে সেই শুদ্ধ কবিতা রচনার দায়ও অনেক সময়েই তাঁদের প্রতিবাদের পায়ে পরিয়েছিল বেড়ি, তাঁদের রাগকে করে তুলেছিল সাংকেতিক৷ এই দায় তিনি বহন করেননি৷ অবশ্য একেবারেই করেননি বললে ভুল বলা হবে৷ ‘চল্লিশ চাঁদের আয়ু’কে তো বটেই এমনকী ‘আমি সিন্ধুর মেয়ে’কেও গত শতাব্দীর পঞ্চাশ বা ষাট দশকের মহিলা কবিদের কবিতার অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে৷ নতুন মল্লিকার দেখা মিলল যে বইটিতে সে বইটির নাম ‘অর্ধেক পৃথিবী’৷ ‘কবিতা সমগ্র’-এর ভূমিকায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছেন, ‘১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় মল্লিকার ‘অর্ধেক পৃথিবী’৷ এই গ্রন্থে তার কিছু কিছু কবিতা অন্যদিকে মোড় নিয়েছে৷’ ‘অর্ধেক পৃথিবী’তে তিনি আর শুদ্ধ কবিতার ঘরানায়  তাঁর কবিতাকে পঙ্গু করে রাখেননি, বর্শাফলকের মতো তাঁর কাব্যভাষা ছিন্ন করেছে সাংকেতিক কুয়াশা, আলো ফেলেছে এমন কিছু কিছু বিষয়ের উপর, যে বিষয়গুলি তাঁর আগে আর অন্য কোনও কবির কলমে ঠাঁই পায়নি৷  কিন্তু এতখানি স্পষ্ট ভাষার গতি  ? কবিতাগুলির ধারাবাহিক পাঠ থেকে এটা বেশ বোঝা যায় যে দিন যত গিয়েছে কবি ততই চেয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে তাঁর কবিতা কেবল একটি মেয়ের বন্ধুই নয়, হয়ে উঠুক তার হাতিয়ারও, আর কে না জানে হাতিয়ার যতই ধারালো , ‘ততই কার্যকরী!’ একথা মানতেই হবে যে আজকের তরুণী কবিরা যে ভাষায় কবিতা রচনা করেন সেই ভাষাটির নির্মাণে মল্লিকা সেনগুপ্তর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷তাই কবি সংযুক্তা দাসগুপ্তের ভাষায় "তার কবিতায় নারীস্বত্বা কেবলমাত্র অন্তর্ভূতি সচেতনতা হিসেবেই থেকে যায় না, সেটা প্রস্ফুটিত হয় সমস্ত প্রান্তিক নারীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক স্বতস্ফুর্ত প্রতিবাদ।" 

পুরস্কার ও সম্মাননা :
১৯৯৮ ভারত সরকারের জুনিয়র রাইটার ফেলোশিপ।
১৯৯৮ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সুকান্ত পুরস্কার।
২০০৪ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি অনীতা-সুনীল বসু পুরস্কার।

মৃত্যু : ২৮ মে ২০১১ কলকাতা।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -323. Dt -27.03.2021
১৩ চৈত্র, ১৪২৭. শনিবার
===============$$$$$$============


   

মহাদেবী ফারুকাবাদে ২৬ই মার্চ ১৯০৭, এক কায়স্থ আইনজীবি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা গোবিন্দ প্রসাদ বর্মা আর মাতা হেমা রানী। তাঁর জগমহন আর মনমহন নামে দুটি ভাই ও শ্যামা নামে একটি বোন ছিল।ইন্দোরবাসী ডঃ স্বরূপ নারায়ন বর্মার সঙ্গে অনেক ছোট বেলায় মহাদেবী বর্মার বিবাহ হয়।মহাদেবী বর্মা এলাহাবাদ বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে বি এ পাশ করেন, এবং ১৯৩৩ সালে এম এ পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর এলাহাবাদে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

                       শিশুকালে তিনি আত্মজীবনী লেখেন "মেরা বচপন কি দিন"। অপেক্ষা কৃত উদারমনস্ক পরিবারে তার আনন্দের ছোটবেলা্র কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।মাতা হেমাদেবী তাকে সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করতেন।প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তাকে কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করা হয় পরে ক্রস্থয়েট মহিলা কলেজে ভর্তি হন ।সেখানে ছাত্রীনিবাসে একতার শক্তি সম্পর্কে অবগত হন ।এই সময় থেকেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন।
ছায়াবাদী ঘরানার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি মহাদেবী বর্মা ।তিনি চিত্রকর হিসাবেও খ্যাতিলাভ করেন।তিনি অসংখ্য ছোট গল্প লেখেন।"গিল্লু" গল্পটির জন্য তিনি অনেক সমাদর পান ।          তাঁর গ্রন্থগুলি হল -

নীহার (১৯৩০)
রেশমী (১৯৩২)
নীরজা (১৯৩৪)
সন্ধ্যাগীত (১৯৩৬)
দীপশিখা (১৯৩৯)
                       অগ্নিরেখা (১৯৯০)                    (এটি তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়)


                       অসাধারণ সাহিত্যকর্মের জন্য অল্পকিছুদিনের মধ্যেই তিনি হিন্দী সাহিত্যজগতে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন । ১৯৩৪ সালে হিন্দী সাহিত্য সম্মেলনে নীরজা গ্রন্থটির জন্য "সেক্ষরীয় পুরস্কার" লাভ করেন ।১৯৩৬ সালে তিনি জানপীঠ পুরস্কার পান "যাম" কবিতা সংকলনটির জন্য। এছাড়াও তিনি "পদ্মভূষণ" "পদ্মবিভূষণ " এবং "সাহিত্য একাদেমী পুরস্কার"ও পেয়েছেন।

মৃত্যু - ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৭।

মহাদেবী বর্মাজী হিন্দি সাহিত্যের একজন মহান কবি ও সুবিখ্যাত লেখিকা, নারী শিক্ষার প্রসারেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। উনাকে আধুনিক হিন্দি কাব্যধারার "ছায়াবাদ" ঘরাণার একজন উল্লেখযোগ্য কবি অনেকে মনে করে থাকেন।





∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik sabder methopath
Vol - 322.Dt -26.03.2021
১২ চৈত্র,১৪২৭. শুক্রবার
============≠{{{(({{∆∆∆}}}}}}}========


Thursday 25 March 2021

গুণময় মান্না

তিনি জন্মগ্রহণ করেন ২৫ মার্চ ১৯২৫,।আড়গোড়া , ঘাটাল পূর্ব মেদিনীপুর।পিতার নাম দীননাথ মান্না, মাতা প্রাণবালা। এদের পরিবারে তখন লেখাপড়ার বিশেষ চল ছিল না। মাত্র চার বৎসর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। বেশ কয়েক বৎসর তাঁর পাঠশালায় না গিয়ে কেটে গেছে। এই সমস্ত কারণে তাঁর পড়াশোনার শুরু ও অগ্রগতি বিলম্বিত হয়। কিন্তু তাঁর মা প্রাণবালার উৎসাহে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। মা'র অনুরোধে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক রাসবিহারী আচার্য বিনা বেতনে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে প্রাথমিক শেষ পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে শিলাই নদী পেরিয়ে ভর্তি হন ঘাটাল বিদ্যাসাগর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে। সরকারি বৃত্তি পেয়ে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বেলুড়মঠে রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দির থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ. পরীক্ষায় পাশ করে বৃত্তি লাভ করেন । ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স সহ বি.এ পাশ করেন। বঙ্কিমচন্দ্র সুবর্ণ পদক ও স্যার আশুতোষ জন্ম বার্ষিক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা সাহিত্যে এম. এ পাশ করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পি. এইচ.ডি. লাভ করেন। বিষয় ছিল রবীন্দ্র কাব্যরূপের বিবর্তন রেখা।
        তাঁর কর্মজীবন শুরু ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ঘাটাল বিদ্যাসাগর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে মাত্র ছয় মাসের শিক্ষকতা নিয়ে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন কাঁথির প্রভাতকুমার কলেজে, ১৯৫৮ - ৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বহরমপুর গার্লস কলেজে এবং ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপনা হতে অবসর নেন।
ছাত্রাবস্থা হতেই তিনি লেখালেখিতে লিপ্ত থেকেছেন । তাঁর প্রথম উপন্যাস লখিন্দর দিগার প্রকাশিত হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে। বাংলায় তথাকথিত জনপ্রিয় লেখক না হলেও, তাঁর 'কটা ভানারি', 'জুনাপুর স্টীল' ও 'লখীন্দর দিগার' এই তিন উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন । তাঁর প্রবন্ধ ও গল্পগুলিও ভিন্নমাত্রার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী প্রসঙ্গ এসেছে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ও তার পরের তাঁর লেখা গল্পে। তাঁর ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'শালবনি' উপন্যাস ইংরাজী ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। অনুবাদক পাপড়ি শ্রীরমন। তাঁর রচিত উপন্যাস ছোটগল্প ও প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলি হল -

উপন্যাস-

লখীন্দর দিঘার ( ১৯৫০)
কটা ভিনারি (১৯৫৪)
জুনাপুর স্টীল (পূর্ব খণ্ড) (১৯৬০)
জুনাপুর স্টীল (উত্তর খণ্ড) (১৯৬২)
বিদ্ধবিহঙ্গ ( ১৯৬৬)
জননী (১৯৬৮)
অসামাজিক (১৯৭২)
শালবনি (১৯৭৮)
মুটে (১৯৯২)
ঘরানা ( ১৯৯৭)
বিদ্রোহী স্বর(১৯৯৯)
গঙ্গাপ্রবাহিনী (২০০৬)
ছোটগল্প-

নতুন প্রেমকথা ( ১৯৮৫)
এক গুচ্ছ গল্প ( ১৯৯৭)
প্রবন্ধ-

রবীন্দ্রনাথ ( ১৯৬৬)
রবীন্দ্র -কাব্যরূপের বিবর্তন রেখা (১৯৬৬)
গদ্যের সৌন্দর্য (১৯৭৪)
রবীন্দ্ররচনার দর্শনভূমি (১৯৯৩)
বাঙলা উপন্যাসের শিল্পাঙ্গিক : আধুনিক যুগ (১৯৯৫)
             তিনি এম.এ পড়ার সময়ই উমা দেবীকে বিবাহ করেন। তাঁদের চার পুত্র এবং তিন কন্যা। এঁরা সকলেই কৃতি ও উচ্চশিক্ষিত। অবসরের পর তিনি বহরমপুরে বাড়ি করে বসবাস করতে থাকেন। 

১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার গুণময় মান্নাকে বঙ্কিম পুরস্কারে সম্মানিত করে।





মৃত্যু : ২৮ এপ্রিল ২০১০ (বয়স ৮৫)
বহরমপুর মুর্শিদাবাদ.
=======≠======∆∆∆∆==============
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik sabder methopath
Vol -321.Dt.-25.03.2021
১১ ঢৈত্র, ১৪২৭. বৃহস্পতিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷∆∆∆∆∆÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷