Friday, 30 April 2021

 

গানকে মন ও অনুভূতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯১৯ সালের ১লা মে জন্ম হয়েছিল এক অসামান্য প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের। যার গান আমাদের জীবনের প্রতিটি ভালোলাগা ও মন্দলাগার সাথে শুধু যুক্ত নয় একান্ত সম্পৃক্ত। প্রেম,ভালোবাসা,স্নেহ,ভক্তি,বন্ধুত্ব,উন্মাদনা সবরকম অনুভূতির প্রকাশই আমরা তাঁর গাওয়া গানগুলির মধ্যে পেয়ে থাকি। তাঁর গান আপামর দেশবাসীর মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু দেশ বললে ভুল হবে তিনি সমগ্র বিশ্বের কাছে পরিচিত। তাঁর নাম প্রবোধ চন্দ্র দে। যে প্রতিভার কোনো সীমা পরিসীমা গভীরতা আকুলতা ব্যাকুলতা নিয়ে কথা হবে না। কাওয়ালি ,গজল,ক্লাসিকাল,সেমিক্লাসিক্যাল,আধুনিক,রবীন্দ্র সঙ্গীত,এমনকি রক এন্ড রোল সবরকম গানেই তিনি আমাদের মন জয় করেছেন। শুধু বাংলায় নয় তিনি হিন্দি মারাঠি ভোজপুরি, পাঞ্জাবি,ওড়িয়া,সিন্ধি,নেপালি,আসামী,কোঙ্কনি,গুজরাটি ,মাগধী ,মালায়ালম ,ইত্যাদি ভাষায় ও গান গেয়েছেন।

তিনি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই পরিবারেইর এক জন সংগীতজ্ঞ ছিলেন।সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণ চন্দ্র দে। এনার সাহচর্যে মান্না দে বড়ো হয়ে ওঠেন, সঙ্গীতের প্রথম হাতে খড়ি ও এনার কাছেই হয়েছিল। বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াকালীন পর পর তিন বার তিনি ইন্টার কলেজ সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪২ সালে মান্না দে তার কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে এর সাথে মুম্বই চলে আসেন।এখান থেকেই তার কর্ম জীবন শুরু হয়। কর্ম জীবন শুরু হলেও সঙ্গীত শিক্ষা চলতে থাকে উস্তাদ আমান আলী খান এবং উস্তাদ আব্দুল রহমান খান এর কাছে।
পারিবারিক জীবন তিনি কেরলর মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে বিয়ে করেন। তাদের দুই কন্যা রয়েছে: শুরোমা (জন্মঃ ১৯ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে) এবং সুমিতা (জন্মঃ ২০ জুন ১৯৫৮ সালে) জন্মগ্রহণ করে। মান্না দে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় মুম্বাইয়ে কাটানোর পর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বেঙ্গালুরুর কালিয়ানগর শহরে বাস করেছেন। এছাড়াও, তিনি কলকাতায়ও বাস করেছেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেও তিনি বিভিন্ন সঙ্গীতবিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন।

১৯৪৩ সালে কৃষ্ণ চন্দ্র দে এর নির্দেশনায় ‘তাম্মানা’ ছবিতে তিনি প্রথম গান করেন। তাঁর গান সেই সময় এতো জনপ্রিয় হয় যে তিনি ১৯৫০ সালে শচীন দেব বর্মনের নির্দেশনায় ‘মশাল’ ছবিতে একক গান গাওয়ার সুযোগ পান। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। একের পর এক বাংলা ও হিন্দি এমনকি মারাঠি ছবিতেও তিনি গান গাওয়া শুরু করেন,শুধু তাই নয় এর সাথে সাথে তিনি সঙ্গীত পরিচালনার ও কাজ করেন। তার গাওয়া এবং নির্দেশনায় সবকটি গান বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি ৩বার জাতীয় পুরস্কার পান এছাড়া তিনি অজস্র সম্মান পেয়েছেন তার কাজের জন্য। 

তাঁর গান আমাদের সবরকম অনুভূতির সাথে জড়িত। আজকের জেনারেশন ও যেকোনো রকম আবেগকে বোঝাতে তার গান গেয়ে থাকে। যদি তার বাংলা গান গুলোকে নিয়ে আমরা একটু গভীরে যাই তাহলে দেখবো তার গাওয়া গান আমাদের অনুভূতিগুলোকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আসুন না এই রকম কয়েকটি গান নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

মান্না দের নাম মনে পড়লেই আমার মনে কিন্তু প্রথম যে গান টি আসে তা হলো” কফি হাউস এর সেই আড্ডা টা আজ আর নেই। আজ আর নেই”আড্ডা নামক বস্তুটি বাঙালীর নেই। বড়ো প্রিয় সবকিছু বাঙালিরা হারিয়ে বসতে চলেছে।

প্রিয় গানগুলি কয়টি -

কফি হাউসের সেই আড্ডা

ছোট হোক বড়ো হোক কিংবা বুড়ো হোক আড্ডা না হলে বাঙালী হয়ে ওঠা যায় না। কফি হাউস গানটি সেই আড্ডা প্রিয় বাঙালীর কথাই বলে। কফি হাউস ইন্টেলেক্চুয়াল রোমান্টিক বাঙালীর পীঠস্থান বললে বোধহয় ভুল কিছু বলা হবে না। চারমিনার ঠোঁঠে ,আর গলায় রাজনীতি,বিষ্ণু দে,যামিনী রায়,রবীন্দ্র নাথ ,এই নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছে এখানে অনেকেই। কত কবি ,লেখক,প্রেমিক রসদ খুঁজে পেয়ে এসেছে এই কফি হাউস এর আড্ডায়। গান টিতে এরকমই প্রেম বিরহ ,হতাশা প্রাপ্তি, সখ্যতা এইসব কিছু মিলিয়ে কোথায় যেন আমরা বার বার নিজেদের এই গানটিতে খুঁজে পাই।


সব খেলার সেরা বাঙালীর তুমি ফুটবল 

ফুটবল প্রীতি বরাবরই বাঙালীর মনে ঘর করে এসেছে। মোহন বাগান আর ইস্ট বেঙ্গল কে ভালো খেলে, এই তর্কের বোধহয় কোনো শেষ নেই। ফুটবুল প্রিয় বাঙালীর জন্যই বোধহয় মান্না দে গেয়েছিলেন “সব খেলার সেরা বাঙালীর তুমি ফুটবল ” ।

বাঙালির ফুটবল প্রীতি যত দিন থাকবে ততদিন এই গানটি ও আমাদের মনে থেকে যাবে।

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

“যদি প্রেম দিলে না প্রাণে “এই প্রেম বস্তুটি ছাড়া বঙ্গ সন্তান অসম্পূর্ণ। প্রেমের কথা আসলেই আমার মনে হয় সকলের মনে মান্না দে এর গাওয়া” হয়তো তোমারি জন্য হয়েছি প্রেমে যে বন্য”এই গানটি মনে পরে। কত প্রেমিক যে তার প্রেমিকাকে এই গানটি গেয়ে শুনিয়েছে তা হয়তো গুনে শেষ করা যাবেনা। তবে তার ফলাফল যে সবসময় মধুর হয়েছে এমনটি নয়। কিন্তু এমন রোমান্টিক বাংলা গান আমার মনে হয় খুব কমই আছে।


সে আমার ছোট বোন বড়ো আদরের ছোট বোন

“সে আমার ছোট বোন বড়ো আদরের ছোট বোন”এই গানটি আজ ও আমাদের চোখে জল এনে দেয়। স্নেহ,মায়া মমতা ভালোবাসার এক অসামান্য মেলবন্ধন এই গানটি। ভাই এবং বোনের এমন ভালোবাসার গল্প এমন মধুর ভাবে কোথায় শুনেছি আমরা বলতে পারেন? কত শিল্পীর জীবন হয়তো এভাবেই থেমে গিয়েছে। গানটির পরিণতি করুন হলেও গানটি আজ আমাদের মনে দাগ কাটে।

আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি

কোনো মন্দিরে যখন আমরা যাই তখন আমরা একটি গান প্রায় বাজতে শুনে থাকি। দূর্গা পুজো বা কালী পুজোর সময় প্যান্ডেলে এই গানটি প্রায়ই শোনা যায়।মনে পড়ছে কি গান টি?”আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি ”

আমাদের মনের শ্রদ্ধা ভক্তি যেন মান্না দে এর এই গানটির মধ্যে আমরা অনুভব করতে পারি। তাই কখনো কোনো এই গানটিও আমাদের চোখে জল এনে দেয়।

মান্না দে অসামান্য একজন সুরকার গীতিকার এবং গায়ক ছিলেন। তার সব গানের কথা হয়তো বলা হলো না। হয়তো বলে শেষ ও করা যাবে না কারণ এতটাই বিশাল তার গানের পরিধি। তবুও এই গানগুলি যেন আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমাদের সব অনুভূতি আর আবেগের বহিঃপ্রকাশ।


সাফল্য এবং খ্যাতি 

মান্না দে পদ্মশ্রী এবং পদ্মবিভূষণ খেতাবসহ অসংখ্য খেতাব অর্জন করেছেন।

১৯৬৯ হিন্দী চলচ্চিত্র মেরে হুজুর ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী (পুরুষ)

১৯৬৯ জাতীয় ছায়াছবি পূরস্কার Renaissance Sanskritik Parishadএর মধ্যে মধ্যপ্রদেশ

১৯৭১ বাংলা চলচ্চিত্র নিশি পদ্মে ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী (পুরুষ)

১৯৭১ ভারত সরকার পদ্মশ্রী পুরস্কার দেয়।

১৯৮৫ মধ্য প্রদেশ সরকার লতা মঙ্গেশকার পদক প্রদান করে।

১৯৮৮ রেনেঁসা সাংস্কৃতিক পরিষদ, ঢাকা থেকে মাইকেল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে।

১৯৯০ মিঠুন ফ্যানস এসোসিয়েশনের তরফ থেকে শ্যামল মিত্র পুরস্কার।

১৯৯১ শ্রী ক্ষেত্র কলা প্রকাশিকা, পুরী থেকে সঙ্গীত স্বর্ণচূড় পুরস্কার প্রদান।

১৯৯৩ পি.সি চন্দ্র গ্রুপ ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে পি.সি. চন্দ্র পুরস্কার।

১৯৯৯ কমলা দেবী গ্রুপ কমলা দেবী রায় পুরস্কার প্রদান করে।

২০০১ ‍আনন্দবাজার গ্রুপ আনন্দলোক আজীবন সম্মাননা প্রদান করে।

২০০২ বিশেষ জুরী বোর্ড কর্তৃক সঙ্গীতে অবদানের জন্য সারল্য যশোদাস পুরস্কার প্রদান করে।

২০০৩ পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক আলাউদ্দিন খান পুরস্কারে ভূষিত।

২০০৪ রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট সম্মাননা প্রদান।

২০০৪ কেরালা সরকার গায়ক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করে।

২০০৫ ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মবিভূষণ খেতাব প্রদান।

২০০৫ মহারাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক আজীবনকাল সম্মান প্রদান।

২০০৭ ওড়িষ্যা সরকার “প্রথম অক্ষয়” পুরস্কার প্রদান।

২০০৮ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট সম্মান প্রদান।

২০১১- ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মান প্রদান ২০১১- পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণ প্রদান। ২০১২- তার কৃতিত্বের জন্য ২৪ ঘণ্টা টিভি চ্যানেল আজীবন অনন্যা সম্মান প্রদান করে।

২০০৫ সালে বাংলাভাষায় তার আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ খ্যাতিমান আনন্দ প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পরে এটি ইংরেজিতে ‘মেমরীজ কাম এলাইভ’, হিন্দীতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠী ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে অনুদিত হয়েছে। মান্নাদে'র জীবন নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র ২০০৮ সালে মুক্তি পায়। মান্নাদে সঙ্গীত একাডেমী মান্নাদে’র সম্পূর্ণ আর্কাইভ বিকশিত ও রক্ষণাবেক্ষন করছে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা সঙ্গীত ভবনে মান্নাদে’র সঙ্গীত সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।

১৯১৩ সালের ২৪শে অক্টোবর এই অসামান্য প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হয়।। অমরলোকে যাত্রা করেন। রেখে যান তাঁর অসামান্য গানগুলি। এখন প্রতিটি বাঙালির মুখে মুখে সুরেলা হয়ে ওঠে নির্জনে দুজনে  বাড়িতে রাস্তায় সর্বত্র‌ই। 

সুস্থ থাকার বা প্রকৃত মনোভাব কে সুস্থ রাখার উপায় যদি জনপ্রিয় গান শোনা হয় । তাহলে মান্নাদের অনেক বেশি জনপ্রিয় গায়ক সঙ্গীত মুখর শ্রোতা ও বিশ্ববাসীর কাছে।  বিশ্ববাসীর কাছে তিনি যথার্থ গায়ক হয়ে উঠতে পেরেছেন।

আজ শুভ জন্মদিন ওনার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমরা গর্বিত ও আনন্দিত।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

Doinik sabder methopath

Vol - 359. Dt -01.05.2021

১৫ বৈশাখ,১৪২৮. শনিবার

=================================





পথ ও পথিক প্রসঙ্গ রবিমানসের গভীরতম বোধ থেকে উৎসারিত  সত্য, সুন্দর ও পরমেশ্বর অন্বেষণের ভাবনা।  শুধু আধ্যাত্মিকতা কিংবা ধর্মীয় ভাবনার প্রেক্ষাপটে নয়, মানুষের মধুরতম প্রেমের প্রেক্ষাপটেও পথ প্রসঙ্গ, নবমাত্রায় অনন্ত আনন্দিত রবীন্দ্রনাথের গানে। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যে অনন্ত প্রেম সেই উপলব্ধির উপায় ব্যক্তি আমি চির আনন্দের প্রবাহে নিয়ত প্রবহমান। জাগতিক মায়াময় জগৎসংসারের বন্ধনে আবিষ্ট মন যথার্থ মুক্তির দিশা খুঁজে পায়না-  সেই জীবন একমাত্র খোঁজার উপায় - পথ । কবি সেই পথ কে ভালবেসে গেয়ে ওঠেন -

###    গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
 আমার মন ভুলায় রে ....

বাংলাদেশের আউল, বাউল, দরবেশ, সুফি-সাধকরা কবিতা ও গানে পথ ও পথিকের কথা তুলে ধরেছেন বারে বারে। বাংলাদেশে জমিদারির কাজে এসে এই ধারাটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীরতর পরিচয় ঘটে। বাংলার বাউলদর্শন ও প্রেমধর্ম কবিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়, বিশেষ করে লালনের গান ও দর্শনের পরিচয়ে।পল্লীর নিরক্ষর বাউলরা মানুষের প্রতি ভালোবাসাকে ভর করে তাদের যে আধ্যাত্মিক জগৎ রচনা করেছেন, সেখানে পরমেশ্বর এসেছেন অরূপ রতন বা মানুষ রতন হয়ে। আর এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ
 "'আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
    তাই হেরি তাই সকলখানে'"
এই সহজিয়া তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে বলেন -

##।  ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে
         লুটিয়ে যায় ধুলায় রে ....

                            প্রাণের মানুষের সন্ধানে পথে পথে ঘুরে তিনি 'কাঙালবেশে দ্বারে দ্বারে', বহু দেশ ঘুরে পথপরিভ্রমণ করে খুঁজে না পেয়ে অবশেষে নিজের অন্তরেই সন্ধান পেয়েছেন যারে। তারেই তিনি নিজের কাছেই পরমাত্মারই অংশ মনে করেন
। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ধর্মবিষয়ক লেখায় তাই বলেছেন, 'পরম মানবের বিরাটরূপে যাঁর স্বতঃপ্রকাশ আমারই মধ্যে তাঁর প্রকাশ সার্থক হোক।' বাউলদের মতো কবি বলেছেন- 
আমি কোথায় পাব তারে
 আমার মনের মানুষ যে রে।
 হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
 দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।'
                       সর্বমানবাত্মার মুক্তির আনন্দের ভেতরেই রবীন্দ্রনাথের ধর্মদর্শন নিহিত রয়েছে। আবার তিনি বলেন -

## ও যে আমায় ঘরের বাহির করে
 পায়ে পায়ে পায়ে ধরে 
মরি হায় হায় রে .....

'পৃথিবীর লোক পথ দিয়া চলিয়া যাইতেছে। তাহারা সঙ্গে কিছুই লইয়া যায় না। তাহারা সুখ-দুঃখ ভুলিতে ভুলিতে চলিয়া যায়। ... ... আর কিছুই থাকে না, কিন্তু প্রেম তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে।' প্রেমকে পাথেয় করেই আমাদের মরমি কবি দীর্ঘ পথযাত্রা শুরু করেছেন - পরম সুন্দরকে পাওয়ার আশায়। হাফিজ, শেখ সাদী, রুমি, কবীরের দোহা কিংবা লালনের গানে মাশুকের উদ্দেশে আশেকের যে নিরন্তর ছুটে চলার - সাধক কবিদের পথের সন্ধানে ...ঘর ছেড়েছেন....পথের শেষ কোথায় জানতে চেয়েছেন! তেমনি রবীন্দ্রনাথের গান তত্ত্ব এসে আকীর্ণ করেনি, বরং নির্ভার গতি এনে দিয়েছে। আর বলেছে - 

##। ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায়রে
 যায়রে কোন চুলায় রে
 মরি হায় হায় রে .....

কবি সেই পরমপ্রিয়র উদ্দেশে অসীম আশায় উচ্চারণ করেন- '
মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে
 আঁধার করে আসে,
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।
 কাজের দিনে নানা কাজে
থাকি নানা লোকের মাঝে,
আজ আমি যে বসে আছি
 তোমারি আশ্বাসে।' 
         গীতাঞ্জলি পর্বে কবি সেই প্রিয়তমের চরণের ধ্বনি শোনেন। এক অপরিসীম গভীর নির্ভরতায় পথিকহীন পথে আবার সেই পরম পথিকের উদ্দেশে বলেন-
 কূজনহীন কাননভূমি
দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে,
একেলা কোন্‌ পথিক তুমি
 পথিকহীন পথের পরে।
হে একা সখা, হে প্রিয়তম,
রয়েছে খোলা এ ঘর মম,
 সমুখ দিয়ে স্বপনসম
 যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।"


### ওই যে কোন বাঁকে কি ধন দেখাবে
 কোন খানে কি দায় ঠেকাবে
 কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে
 ভেবেই না কুলায় রে ...
আমার মন ভুলায় রে 
গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
 আমার মন ভুলায় রে ....

                   রবীন্দ্রনাথের গানে শুনি, আসা-যাওয়ার পথের ধারে বসে মানুষের আসা-যাওয়া দেখতে দেখতে কবি বিষণ্ণ। পথিকরা বাঁশি ভরে যে সুর সঙ্গে করে আনে, তাই কবির মনপ্রাণ কেড়ে নেয়। তবু পথের ভাবনায় পথকেই ভালোবাসেন কবি। গানটিতে কবি বলেন-

সুরের সাথে মিশিয়ে বাণী দুই পারের এই কানাকানি

তাই শুনে যে উদাস হিয়া চায় রে যেতে বাসা ছাড়ি

কিংবা কবি যখন অন্তরের গভীরে ডুব দিয়ে নিজেকে শুধোন 'আসা যাওয়ার মাঝখানে/একলা চেয়ে আছ কাহার পথ-পানে', তখন পথটি রাস্তা না হয়ে অপেক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথের গানে পথ, পথের সাথী, পথিক অভিন্ন হয়ে উঠেছে। পথিক কোনো এক গন্তব্যে পৌঁছবে বলে ছুটে চলে। কিন্তু গন্তব্য কোথায় কিংবা পথের শেষ কোথায়, কে জানে? রবীন্দ্রনাথের গানে আমরা শুনি- চলার পথে যদি সেই পরম বন্ধু কিংবা পরানসখা সঙ্গে না থাকেন, তবে কী করে গন্তব্যে পৌঁছাবেন। প্রশ্নটির ভেতরে বেদনা ও নির্ভরতার যে অদ্বৈত ভাবনা প্রকাশিত, তা দূর করে দেয় পথচলার কষ্ট। বাংলার আউল-বাউল ও সুফি-সন্তরা পথের অপরিসীম ক্লেশের ভেতর দিয়ে তাদের পরমপ্রিয় বা অরূপ রতনকে পাওয়ার জন্য বিরামহীন ছুটে চলেন। তারাও জানেন না পথের শেষ কোথায়? এই পথের বেদনা ও পথশেষে প্রাপ্তির সংশয় পথিকদের বিষণ্ণ করে, তবুও তাদের পথযাত্রা শেষ হওয়ার নয়। ছুটে চলার খামতি ঘটে না। 'অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি ধ্রুবতারকার' এই লক্ষ্যে মহা অজানার পথে যাত্রা শুরু করেন।।

রবীন্দ্রনাথের গানে এই পথচলা খুব সহজ নয়। সেই দূরের আনন্দধাম অন্বেষণ করেন কবি ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে। কারণ কবি তো সেই পথ জানেন না। পথ চলতে চলতে সূর্য ডুবে যায়; অন্ধকারে ছেয়ে যায় পৃথিবী। তখন কবি সেই আঁধার পথচলায় বিশ্ববিধাতার কৃপা প্রার্থনা করেন। কবির অতৃপ্ত বাসনা তৃপ্ত করার জন্যই অদেখা আনন্দধামের পথে ছুটে চলা। কবির মনে তীব্র বেদনা ধ্বনিত হয় :তবে কি কোনোদিন পথের শেষ তার জানা হবে না! তবে এই সংশয়ে থেমে থাকেন না কবি। তিনি পরম বিশ্বাসে সংশয় জয় করে পথ চলেন। পথ চলেন আনন্দ, প্রেম, নির্ভরতা এবং চলার প্রসন্নতায়। কবির এই ভাবনাগুলো পাই গীতাঞ্জলি পর্বের কবিতা ও গানে। কবি সেই পরমপ্রিয়র উদ্দেশে অসীম আশায় উচ্চারণ করেন- 'মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে,/ আঁধার করে আসে,/ আমায় কেন বসিয়ে রাখ/ একা দ্বারের পাশে।/ কাজের দিনে নানা কাজে/ থাকি নানা লোকের মাঝে,/ আজ আমি যে বসে আছি/ তোমারি আশ্বাসে।' গীতাঞ্জলি পর্বে কবি সেই প্রিয়তমের চরণের ধ্বনি শোনেন। এক অপরিসীম গভীর নির্ভরতায় পথিকহীন পথে সেই পরম পথিকের উদ্দেশে বলেন- কূজনহীন কাননভূমি/ দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে,/ একেলা কোন্‌ পথিক তুমি/ পথিকহীন পথের পরে।/ হে একা সখা, হে প্রিয়তম,/ রয়েছে খোলা এ ঘর মম,/ সমুখ দিয়ে স্বপনসম/ যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।











        



Thursday, 29 April 2021


 চৈতন্যদেব : বাংলা সমাজ ও সাহিত্য
 
  
  বাঙালি সংস্কৃতির দু’টি ধারার যে মিলন ঘটেছিল, এখানে তা কোমল ও ললিত ভাবধারায় সঞ্জীবিত হয়। প্রেম ও ভক্তির ভাবরসপ্রবাহে বাঙালি নিজের মুক্তিমন্ত্র শুনতে পায়। অন্যদিকে, রাজশক্তি হারিয়ে বাঙালি যে হীনমন্যতায় ভুগছিল, সে অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন না ঘটলেও, ভাবের দিক থেকে চৈতন্য মহাপ্রভু বাঙালিকে উদ্ধার করেন।

 মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আগমন ছিল বাংলা সাহিত্যের তথা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেই সময়কার অত্যাচারিত, অপমানিত বাঙালি জাতিকে সঙ্ঘবদ্ধ করারকারণে তিনি আজ ও বাঙালি জাতির কাছে পূজনীয়। তৎকালীন সময়ে বাঙালি সমাজ ও জাতির উপর চৈতন্যদেবের প্রভাব পড়েছিল তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে এখানে আমরা বাংলা সমাজ ও সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব তা নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করলাম।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্ধে (১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দ) বাংলাদেশে মহাপ্রভুর শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত এক যুগান্তকারী ঘটনা। মধযুগের এক ক্রান্তিলগ্নে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব। দেশের সমকালীন রাজনৈতিক অশান্তি ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে তিনি উদারনৈতিক যে কৃষ্ণপ্রেমকথা প্রচার করেন তা তথাকথিত Religion। শুধু হিন্দু ধর্ম নয়, সর্ব ধর্মের সংকীর্ণতার উর্দ্ধে তিনি সর্বমানবিক প্রেমধর্ম প্রচার করেন। জীবে দয়া, ঈশ্বরে ভক্তি এবং ভক্তি উদ্দীপনের জন্য নামসংকীর্তন – মূলত এই ত্রিবিধ আদর্শের উপর চৈতন্যধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত।
       তিনিই প্রথম মানুষকে স্বধর্মে গৌরবান্বিত করতে সচেষ্ট হন। ফলে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে বাঙালী জাতীর তিমির বিদার উদার অভ্যুদয় ঘটে। চৈতন্যদেবই মানুষের শিল্প সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিকাশ ও দার্শনিকতার ভিত্তি নির্মাণ করে মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসকে নতুন গতিতে আলোক তীর্থের অভিমুখে প্রেরণ করেন।এই দেবোপম মানুষটি বাংলাদেশে রাষ্ট্রিক ও সামাজিক সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে একদিকে যেমন প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। অন্যদিকে তেমন সমাজের তৃণমূল স্তরে নিজেকে মিশিতে দিয়ে সমগ্র সমাজকে ভক্তিধর্মে পরিপ্লাবিত করেছেন। এইভাবে জীবন্ত মানবতার পূজারী চৈতন্যদেব জাতীয় সংহতির পথ প্রস্তুত করেন। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –
             “আমাদের বাঙালীর মধ্য হইতেই তো চৈতন্য জন্মিয়াছিলেন। তিনি তো বিঘা কাঠার মধ্যে বাস করিতেন না। তিনি তো সমস্ত মানবকে আপনার করিয়াছিলেন। তিনি বিস্তৃত মানবপ্রেমে বঙ্গভূমিকে জ্যোতির্ময়ী করিয়া তুলিয়াছিলেন।”
      
        বাংলা সাহিত্যে তাঁর এই প্রভাবের ঐতিহাসিক ফলশ্রুতি সুদূর প্রসারিত। প্রাক-চৈতন্যযুগের সাহিত্যে যে স্থূলতা, কদর্যতা ও গ্রাম্যতা ছিল, তা চৈতন্যপ্রভাবে রুচিসম্মত ও শ্লীল হয়েছে। প্রাক-চৈতন্য পর্বে দেবতার মহিমাকীর্তনই ছিল সাহিত্যের উদ্দেশ্য ও পরিধি। চৈতন্যপ্রভাবে তা ‘দেবতাকে প্রিয় করি প্রিয়রে দেবতা’ হয়েছে। প্রাক-চৈতন্য পর্বের ভক্তিভাবের তুলনায় ঐশ্বর্যভাবের প্রাধান্য ছিল। চৈতন্যপ্রভাবে ভক্তিরস বাংলা সাহিত্যকে আপ্লুত করেছে। প্রকৃতপক্ষে চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাবেই বাংলা সাহিত্যে মানবতাবাদের জয় ঘোষিত হয়েছে। চৈতন্যপ্রভাবিত অধ্যাত্মভাব ও জীবনাবেগ সৃষ্টির জন্যই বৈষ্ণব কবিদের হাতে বাংলা ভাষা সূক্ষ্ম অনুভূতি ও বিচিত্রভাব প্রকাশের যোগ্য হয়ে ওঠে।

১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৭ শে ফেব্রুয়ারি নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র, মাতার নাম শচীদেবী। তাঁর বাল্যনাম ছিল নিমাই। ১৬ -১৭ বছর বয়সে তিনি বল্লভ আচার্যের কন্যা লক্ষ্মীদেবীকে বিবাহ করেন। লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যু হলে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীকে বিবাহ করেন।
এরপর গয়ায় পিতৃ পিণ্ডদানের জন্য গিয়ে বিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শন করেন। তাঁর চিত্ত এখানেই বৈরাগ্যে ভরে যায়। ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি বৈষ্ণবাচার্য কেশবভারতীর কাছে দীক্ষা নেন। এখান থেকেই তাঁর নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য – সংক্ষেপে শ্রীচৈতন্য। ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি অমৃতলোকে পাড়ি দেন। চৈতন্যের তিরোধান নিয়ে অনেক মত প্রচলিত আছে – সে রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি।

সমাজ জীবনে:

বাঙালীর সমাজজীবন ও সাহিত্য শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব খুবই ব্যাপক ও সূদূরপ্রসারী। তাঁর আবির্ভাবে বাঙালী জাতির চিত্ত জড়ত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে স্বচ্ছ ও বেগবতী ধারায় সমাজ জীবনকে নানা দিক থেকে বিচিত্রমুখী বিকাশের দিকে নিয়ে যায়। শ্রীচৈতন্যের আগমনের পূর্বে বাংলাদেশ প্রায় আড়ইশো বছরের মুসলিম শাসনে বিপর্যস্ত ও বিশৃঙ্খল ছিল। ব্রাহ্মণ সমাজে আদর্শনিষ্ঠা লুপ্ত হয়েছিল, অবৈষ্ণব সম্প্রদায়রা তান্ত্রিক ক্রিয়াধর্ম নিয়ে ব্যাভিচারে লিপ্ত ছিল।
                       মুসলমান শাসকদের নিষ্ঠুরতা ও হিন্দুসমাজের অন্তর্গত বর্ণবিভেদ, সম্প্রদায়ভেদ ও উচ্চনীচ জাতিভেদে পীড়িত হয়েছিল মানবাত্মা, বাঙালী জীবন বহুধা বিচ্ছিন্ন ঐক্যভ্রষ্ট ও একান্ত পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। ইতিমধ্যে হিন্দুসমাজ আত্মরক্ষার জন্য লৌকিক ও পৌরাণিক ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতির মধ্যে চেষ্টা করলেও এ সামাজিকতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সামাজিক নিষ্পেষণে হতমান নিম্নশ্রেণীভুক্ত হিন্দুরা ইসলামের শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা আত্মরক্ষার আশ্র খুঁজে পায়।
      গোটা হিন্দু সমাজটাকে ইসলামধর্ম গ্রাস করতে থাকে। সমগ্র হিন্দু জাতির এই মরণাপন্ন অবস্থায় চৈতন্যদেব ভক্তির ভাবাবেগে গানে গানে অচলায়তন ভাঙতে চাইলেন। জ্ঞানবৃদ্ধতা তারুণ্যের দ্বারা স্পন্দিত হল। তিনি প্রচার করলেন বিশুদ্ধ উদার মানবিকতার বাণী।
          তিনি প্রচার করলেন প্রতি মানুষের হৃদয় দ্বারে প্রেমের কাঙালরূপে ঈশ্বর নিত্য বিরাজমান, দ্বার খুললেই মিলন ঘটবে। তিনি ঘোষণা করলেন – ‘চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তিপরায়ণঃ’ – ‘মুচি হয়ে শুচি হয় যদি হরি ভজে।’ তাই যবন হরিদাস থেকে গুণ্ডা জগাই-মাধাই সকলকেই তিনি আপন বক্ষে স্থান দিলেন। নৃপতি হুসেন শাহ পর্যন্ত ঘোষণা করলেন –
“যেখানে তাঁহার ইচ্ছা থাকুন সেখানে।
আপনার শাস্ত্রমত করুন বিধানে।।

কাজি বা কোটাল কিবা হউ কোন জন।
কিছু বলিলেই তার লইব জীবন।।”

                           এইভাবে চৈতন্যদেব মানবিক মূল্যবোধের নতুন মন্ত্রে জাতি –বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে একাসনে বসার সুযোগ করে দিয়ে এক বিরাট সাম্য সংস্থাপনের আদর্শে বাংলা তথা ভারতবর্ষকে দীক্ষিত করলেন। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন ঠিকই বলেছিলেন –
          “প্রেম পৃথিবীতে একবার মাত্র রূপ গ্রহণ        করিয়াছিল, তাহা বাংলাদেশে।”
                এইভাবে তিনি সত্য ও প্রেমের করুণ-কোমল বিশ্বপ্লাবি অরুণোদয় ঘটিয়ে, সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষা, উন্নত রুচি, ত্যাগ, বিনয়, দয়া, ভক্তি, সরলতা ও সহিষ্ণুতা প্রভৃতি সদ্‌গুণগুলির প্রকাশে নতুন বলিষ্ঠ সমাজ তৈরীর মঞ্চ প্রস্তুত করে দিলেন।

সাহিত্যে :

চৈতন্যের আবির্ভাবে শুধু সমাজ জীবনে নয় বাংলা সাহিত্যেও ঋতু পরিবর্তন হল, নতুন ফসলে সমৃদ্ধ হল সাহিত্য। যদিও তিনি নিজে একটি গ্রন্থও রচনা করেননি। তাঁর প্রভাবে মধ্যযুগের দেবমুখী সাহিত্যে মানবতন্ত্রী মনোভাব প্রাধান্য পেল।
       চৈতন্য-পূর্ব বৈষ্ণবপদাবলী সাহিত্যে লৌকিক প্রেমানুভূতিই ছিল প্রধান। চৈতন্যজীবনের আলোকপাতে তা আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হল। রাধা-কৃষ্ণ জীবাত্মা –পরমাত্মার প্রতীকে পরিণত হল। ফলে চৈতন্য পরবর্তীকালে গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, বলরাম দাস, নরহরি চক্রবর্তী, নরোত্তম দাস প্রমুখ কবিরা পদাবলী সাহিত্যে মানবরস ও ভক্তিভাবুকতার যক্তবেণী রচনা করলেন।
             আসলে শ্রীচৈতন্যদেব নিজের জীবন চর্চা ও ধর্মসাধনার মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার তাৎপর্যকে পরিস্ফুট করেন। তিনি ছিলেন রাধাকৃষ্ণের যুগলবিগ্রহ – অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ, বহিরঙ্গে রাধা। তিনিই প্রথম রাধাভাবের রাধানুগা ভক্তির দ্বারা পদাবলী সাহিত্যকে অনুপ্রাণিত করেন। পদকর্তা নরহরি সরকার লিখেছেন –
     "গৌরাঙ্গ নহিত কি মেনে হইত
      কেমনে ধরিত দে।
রাধার মহিমা প্রেমরসসীমা
জগতে জানাত কে।"

তাঁকে নিয়ে পদাবলী সাহিত্যে ‘গৌরচন্দ্রিকা’ বিষয়ক পৃথক রসপর্যায়ের সৃষ্টি হয়।

       চৈতন্যদেবের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে প্রথম জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত ঘটে। মুরারী গুপ্তের কড়চা স্বরূপ দামোদরের কড়চা, বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতনভাগবত’, জয়ানন্দ ও লোচন দাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ উৎকৃষ্ট চৈতন্যজীবনী কাব্য ‘ লক্ষণীয় তখনও বক্তিস্বাতন্ত্র্যের যুগ আসেনি।


চৈতন্যের প্রভাবে মঙ্গলকাব্যের কবিরাও বিশুদ্ধ পদ রচনা করেছেন। অন্যদিকে বৈষ্ণবপদাবলীর আদর্শে স্বতন্ত্র গীতিকাব্য শাক্ত পদাবলীর উদ্ভব ঘটল। বাউল সঙ্গীতেও বৈষ্ণবভাব অল্পাধিক প্রবেশ করল।

অনুবাদ সাহিত্যেও চৈতন্যদেবের প্রভাব কম নয়। রামায়ণ ও ভাগবত পরিবেশ, চরিত্র ও কাব্যরসের উপর চৈতন্যের প্রভাব যথেষ্ট। কাশীরাম দাস বৈষ্ণব ভক্ত ছিলেন।

শাক্ত পদাবলি

চৈতন্য মহাপ্রভুর সার্বভৌম প্রভাব ও তাঁর প্রবল ভাবের জোয়ারে শাক্তসাহিত্য তার স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ রক্ষা করতে পারেনি। কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন, শাক্ত পদাবলির বাৎসল্য রসের পদগুলিতে ও উমাসংগীতে (আগমনী ও বিজয়া গান) চৈতন্য-প্রভাবিত বৈষ্ণব গীতিকবিতার কোমল স্নিগ্ধতা অনুভূত হয়।

লোকসাহিত্য

বাংলার সুদূর গ্রামাঞ্চলের লোকসংগীতেও চৈতন্য মহাপ্রভুর ভাববিহ্বল দেবোপম জীবনের প্রভাব সুস্পষ্ট। মৈমনসিংহ গীতিকার বিষয়বস্তুতে চৈতন্যদেবের সমন্বয়বাদ ফুটে উঠেছে। শুধু তাই নয়, বাউলের গানে যে ‘মনের মানুষ’-এর অনুসন্ধান রয়েছে, তার মূলেও চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীতে কবি মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণবভাবাবেগে অনুপ্রাণিত হয়ে যথাক্রমে ‘ব্রজাঙ্গনা’ ও ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী রচনা করেছেন। এই ভাবে তিনি সমগ্র বাংলা সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাই লিখেছেন-
            “বর্ষাঋতুর মতো মানুষের সমাজে এমন একটা সময় আসে যখন হাওয়ার মধ্যে ভাবের বাষ্প প্রচুর পরিমানে বিচরণ করিতে থাকে। চৈতন্যের পর বাংলাদেশের সেই অবস্থা আসিয়াছিল। তখন সমস্ত আকাশ মেঘের রসে আর্দ্র ছিল। তাই দেশে সে সময় যেখানে যত কবির মন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়াছিল সকলেই সেই রসের বাষ্পকে ঘন করিয়া কত অপূর্ব ভাষা এবং নতুন ছন্দে, কত প্রাচুর্যে এবং প্রবলতায় তাহাকে দিকে দিকে বর্ষণ করিয়াছিল।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik sabder methopath
Vol -358. Dt -30.4.2021
১৬ বৈশাখ, ১৪২৮. শুক্রবার
========={{{=========={{{{{=========





শান্তা দেবী (নাগ) 



জন্ম ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে এপ্রিল কলকাতায়। পিতা প্রখ্যাত সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা মনোরমা দেবী। এঁদের আদি নিবাস ছিল বাঁকুড়ার পাইকপাড়ায়। শান্তার প্রথম পনেরো বৎসর কাটে এলাহাবাদে। সেসময় সেখানে মেয়েদের ভালো স্কুল না থাকায় তাঁর ও তাঁর কনিষ্ঠা ভগিনীর লেখাপড়া শুরু হয় গৃহশিক্ষক পিতৃবন্ধু নেপালচন্দ্র ও ইন্দুভূষণ রায়ের কাছে। ব্রাহ্মসমাজ-নেতা পিতার গৃহে উদার স্বাধীনতা এবং 'প্রবাসী' ও 'মডার্ন রিভিউ' পত্রিকার সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক পরিবেশের মধ্যে বড়ো হয়ে ওঠেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে পিতা কলকাতায় ফিরলে তিনি কলকাতার বেথুন স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে বি.এ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ্মাবতী স্বর্ণপদক লাভ করেন। বাংলা, ইংরাজী, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় এবং অর্থনীতি ও গণিতে বিশেষ পারদর্শিনী ছিলেন।

                     কলেজে পড়ার সময় ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে দুই বোন মিলে শ্রীশচন্দ্র বসুর Folk Tales of Hindustan গ্রন্থটি "হিন্দুস্থানী উপকথা" নামে অনুবাদ করে খ্যাতি অর্জন করেন। বইটির চিত্তাকর্ষক ছবিগুলি উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর আঁকা। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় দুই বছর পিতার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে থাকার সময় তিনি নন্দলাল বসুর কাছে অঙ্কন শিক্ষা করেছেন। দেশে বিদেশে তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। দুই বোন মিলে সংযুক্তা দেবী নামে প্রথম উপন্যাস "উদ্যানলতা" রচনা করেন। উপন্যাসটিতে কলকাতায় নারীজাগরণের প্রথম উন্মেষের ছবি পরিস্ফুট হয়েছে। এটি পরে The Garden Creeper নামে অনূদিতও হয়েছে। বিবাহের পর স্বামীর সঙ্গে বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার বিষয় 'প্রবাসী' পত্রিকায় লিখেছেন। যেমন 'মহেঞ্জাদড়োর কথা', জাপানের ডায়েরি' প্রভৃতি। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক কালিদাস নাগের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।আমেরিকা প্রবাসে তিনি মিনেসোটার ম্যাকালেস্টর কলেজে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। তিনি "প্রবাসী" র সম্পাদকীয় বিভাগে নানা দায়িত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। "ভারত-মুক্তিসাধক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও অর্ধ শতাব্দীর বাংলা" গ্রন্থটির জন্য তিনি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী দাসী স্বর্ণপদক লাভ করেন।  তাঁর গল্প উপন্যাসে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের , বিশেষকরে নারীজীবনের অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা ও আধুনিক চিন্তার ইতিহাসের উন্মেষ পর্বের নানা চিহ্ন দেখা যায়। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -



  • শিশুপাঠ্য -
    • সাত রাজার ধন (সীতা দেবীর সাথে)
    • হুক্কা হুয়া (১৯২০)
    • কেমন জব্দ


  • উপন্যাস -
    • স্মৃতির সৌরভ (১৯১৮)
    • জীবনদোলা (১৯৩০)
    • অলখ ঝোরা (১৯৩৪)
    • দুহিতা (১৯৩৪)
    • চিরন্তনী


  • গল্প ও অন্যান্য রচনা-
    • ঊষসী (১৯১৮)
    • সিঁথির সিঁদুর (১৯১৯)
    • বধূবরণ (১৯৩১)
    • দেওয়ালের আড়াল
    • পঞ্চদর্শী

ভ্রাতার মৃত্যুর পরে তাঁর লেখা "শোক ও সান্ত্বনা" বইটি মৃত্যুচিন্তার এক অসাধারণ দলিল। "পূর্বস্মৃতি" নামে এক স্মৃতিমূলক রচনা করেছেন। তাঁর ও সীতা দেবীর অনেক গল্প ইংরাজীতে সীতা দেবী অনুবাদ করেছেন। সেই গল্পগুলি টেলস অব বেঙ্গল নামে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

পুরস্কার-  ভুবনমোহিনী দাসী স্বর্ণ পদক।



 শান্তা দেবী ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে মে পরলোক গমন করেন।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

Doinik Sabder Methopath

Vol -357. Dt -29.04.2021

১৫ বৈশাখ,১৪২৮. বৃহস্পতিবার

=================================

Tuesday, 27 April 2021

বাঙলা ভাষা
হুমায়ুন আজাদ

"শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, তুমি-আমি, দুর্বিনীত দাসদাসী-
একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আমাদের ঘিরে শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝংকার।
তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়-
হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে-শোভায়।

লকলকে চাবুকের আক্রোশ আর অজগরের মতো অন্ধ শেকলের
মুখোমুখি আমরা তুলে ধরি আমাদের উদ্ধত দর্পিত সৌন্দর্য:
আদিম ঝরনার মতো অজস্র ধারায় ফিনকি দেয়া টকটকে লাল রক্ত,
চাবুকের থাবায় সুর্যের টুকরোর মতো ছেঁড়া মাংস
আর আকাশের দিকে হাতুড়ির মতো উদ্যত মুষ্টি।

শাঁইশাঁই চাবুকে আমার মিশ্র মাংসপেশি পাথরের চেয়ে শক্ত হয়ে ওঠে
তুমি হয়ে ওঠো তপ্ত কাঞ্চনের চেয়েও সুন্দর।
সভ্যতার সমস্ত শিল্পকলার চেয়ে রহস্যময় তোমার দু-চোখ
যেখানে তাকাও সেখানেই ফুটে ওঠে কুমুদকহ্লার
হরিণের দ্রুত ধাবমান গতির চেয়ে সুন্দর ওই ভ্রূযুগল
তোমার পিঠে চাবুকের দাগ চুনির জড়োয়ার চেয়েও দামি আর রঙিন
তোমার দুই স্তন ঘিরে ঘাতকের কামড়ের দাগ মুক্তোমালার চেয়েও ঝলোমলো
তোমার ‘অ, আ’ –চিৎকার সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর

তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চন্ডীদাস
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম

শাঁইশাঁই চাবুকের আক্রোশে যখন তুমি আর আমি
আকাশের দিকে ছুঁড়ি আমাদের উদ্ধত সুন্দর বাহু, রক্তাক্ত আঙুল,
তখনি সৃষ্টি হয় নাচের নতুন মুদ্রা;
ফিনকি দেয়া লাল রক্ত সমস্ত শরীরে মেখে যখন আমরা গড়িয়ে পড়ি
ধূসর মাটিতে এবং আবার দাঁড়াই পৃথিবীর সমস্ত চাবুকের মুখোমুখি,
তখনি জন্ম নেয় অভাবিত সৌন্দর্যমন্ডিত বিশুদ্ধ নাচ;
এবং যখন শেকলের পর শেকল চুরমার ক’রে ঝনঝন ক’রে বেজে উঠি
আমরা দুজন, তখনি প্রথম জন্মে গভীর-ব্যাপক-শিল্পসম্মত ঐকতান-
আমাদের আদিগন্ত আর্তনাদ বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের
একমাত্র গান।"

হুমায়ুন আজাদ


 জন্ম ২৮শে এপ্রিল, ১৯৪৭ (১৪ই বৈশাখ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), রাড়িখাল, বিক্রমপুর.একজন বাংলাদেশী কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং কলাম প্রাবন্ধিক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০ টি'র বেশী। ধর্ম, প্রথা, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, নারীবাদিতা, রাজনৈতিক বক্তব্য এবং নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য তিনি ১৯৮০'র দশক থেকে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

হুমায়ুন আজাদ রাড়িখালের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। মেধাবী ছাত্র আজাদ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন; উভয় ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ।

তাঁর স্ত্রী লতিফা কোহিনুর। তাঁর দুই কন্যা মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং একমাত্র পুত্র অনন্য আজাদ। বাঙলাদেশে যখন মৌলবাদ বিস্তারলাভ করতে থাকে, বিশেষ করে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত, তখন ২০০৪ এ প্রকাশিত হয় হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' বইটি। বইটি প্রকাশিত হলে মৌলবাদীরা ক্ষেপে ওঠে, তারা মসজিদে মসজিদে হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। বইটিতে উঁনি মৌলবাদীদের, ফ্যাসিবাদীদের চিত্রের শৈল্পিক রূপ দেন, মুখোশ খুলে ফেলেন ফ্যাসিবাদী জামাতের।

কবি হিসাবে স্মরণীয় না-হলেও হুমায়ুন আজাদ আমৃত্যু কাব্যচর্চ্চা করে গেছেন। তিনি ষাটের দশকের কবিদের সমপর্যায়ী আধুনিক কবি। সমসাময়িক কালের পরিব্যাপ্ত হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, বিবমিষা, প্রেম ইত্যাদি তার কবি সত্বার প্রধান নিয়ামক। প্রথম কাব্যগন্থের নাম অলৌকিক ইস্টিমার যা প্রথম প্রকাশিত হয় পৌষ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দে (জানুয়ারি ১৯৭৩)। কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন ১৯৬৮- ৭২ এর রাতদিনগুলোর উদ্দেশে। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ জ্বলো চিতাবাঘ প্রথম প্রকাশিত হয় ফাল্গুন, ১৩৮৬ বঙ্গাব্দে (মার্চ ১৯৮০)। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রথম প্রকাশের সময় বৈশাখ ১৩৯২ বঙ্গাব্দ (এপ্রিল, ১৯৮৫)। কাব্যগ্রন্থটি বাংলাভাষার সাম্প্রতিক সময়ের দুইজন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলন কে উৎসর্গিত। ১৩৯৩ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে (মার্চ ১৯৮৭) প্রকাশিত হয় তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ '’যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল'’। তার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে প্রকাশিত হয় ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে (ফেব্রুয়ারি ১৯৯০)। এর আট বছর পর ১৪০৪ এর ফাল্গুনে (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮) প্রকাশিত হয় তার ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু। কাব্যগ্রন্থটি কবি তার 'প্রিয় মৃতদের জন্য' উৎসর্গ করেন। সপ্তম কাব্যগ্রন্থ পেরোনোর কিছু নেই প্রকাশিত হয় ১৪১০ বঙ্গাব্দের মাঘ(ফেব্রুয়ারি, ২০০৪) মাসে। এটিই হুমায়ুন আজাদের জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ কাব্যগ্রন্থ। তবে হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর বঙ্গাব্দ ১৪১১ এর ফাল্গুনে (ফেব্রুয়ারি,২০০৫) এই সাতটি কাব্যগ্রন্থ সহ আরো কিছু অগ্রন্থিত ও অনূদিত কবিতা নিয়ে তাঁর কাব্যসমগ্র প্রকাশিত হয়।

২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে ঘাতকদের আক্রমণের শিকার হন তিনি। বিদেশে নিবিড় চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি কিছুটা সুস্থ হন। এর কিছুদিন পরেই জার্মান সরকার তাকে গবেষণা বৃত্তি প্রদান করে। ২০০৪-এর ৭ আগস্ট জার্মান কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান। ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট রাতে একটি পার্টি থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আবাসস্থলে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হুমায়ুন আজাদ। ১২ আগস্ট ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর মরদেহ কফিনে করে জার্মানি থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে ইসলামি প্রথায় জানাযার নামাজশেষে তাঁর মরদেহ জন্মস্থান রাড়িখালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই ইসলামি প্রথায় সমাহিত করা হয়।

কাব্যগ্রন্থঃ

অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩)
জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০)
সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫)
যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল (১৯৮৭)
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০)
হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩)
আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৯৪)
কাফনে মোড়া অশ্রু বিন্দু (১৯৯৮)
কাব্য সংগ্রহ (১৯৯৮)
পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪)
এছাড়া -
নারী (১৯৯২), দ্বিতীয় লিঙ্গ (২০০১) এবং পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪) তাঁর ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক তিনটি গ্রন্থ যথা, বাংলা ভাষার শত্রুমিত্র (১৯৮৩), Pronominalization In Bengali (১৯৮৩), বাক্যতত্ত্ব (১৯৮৪)। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ: বাঙলা ভাষা (দু-খন্ড, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫), আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৯৪), মুহম্মদ আবদুল হাই রচনাবলী (তিন খন্ড, ১৯৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা (১৯৯৭); তাঁর ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক দুটি গ্রন্থ, তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান (১৯৮৮), অর্থবিজ্ঞান (১৯৯৯)।

হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য-সমালোচনা ও মননশীলতার প্রকাশ লক্ষ করা যায় শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা (১৯৮৩) বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৮৮), ভাষা-আন্দোলন : সাহিত্যিক পটভূমি (১৯৯০), নারী (১৯৯২), নরকে অনন্ত ঋতু (১৯৯২), প্রবচনগুচ্ছ (১৯৯২), সীমাবদ্ধতার সূত্র (১৯৯৩), আধার ও আধেয় (১৯৯৩), আমার অবিশ্বাস (১৯৯৭), নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৯৯), আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম (২০০৩) প্রভৃতি গ্রন্থে।

ভাষাশৈলীতে তিনি বুদ্ধদেব বসু-র দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর স্বকীয়তা অনস্বীকার্য। সাহিত্যে ভাবের ও ভঙ্গির প্রকাশে তিনি স্বতন্ত্র। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল (১৯৯৪), সব কিছু ভেঙে পড়ে (১৯৯৫), মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ (১৯৯৬), যাদুকরের মৃত্যু (১৯৯৬), শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার (১৯৯৭), রাজনীতিবিদগণ (১৯৯৮), কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ (১৯৯৯), নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু (২০০০), ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ (২০০১) ও শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা (২০০২) উপন্যাসগুলিতে তাঁর নিজস্ব ভাবনা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের সমাজ ও সংস্কৃতির নানা সংঘাতের কথা বিধৃত হয়েছে।

সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে তাঁর প্রতিভা ও মননের এক অসাধারণ দিক উন্মোচিত হয়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা কিছু গ্রন্থে, যেখানে তাঁর ব্যঞ্জনাধর্মী ভাষা সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। লাল নীল দীপাবলি (১৯৭৬), ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না (১৯৮৫), কতো নদী সরোবর (১৯৮৭), আববুকে মনে পড়ে (১৯৮৯), বুকপকেটে জোনাকিপোকা (১৯৯৩), আমাদের শহরে একদল দেবদূত (১৯৯৬), অন্ধকারে গন্ধরাজ (২০০৩) প্রভৃতি বইয়ে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। হুমায়ুন আজাদের কবিস্বভাব ফুটে উঠেছে নিম্নলিখিত কাব্যগুলিতে, যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল (১৯৮৭), আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), কাব্যসংগ্রহ (১৯৯৮), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮)।



পুরস্কার 
বাংলা একাডেমি পুরস্কার ১৯৮৬ সামগ্রিক অবদান 
অগ্রণী ব্যাংক-শিশু সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮৬ শিশু সাহিত্য 
মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার ২০০৪
একুশে পদক ২০১২ ভাষা ও সাহিত্য মরণোত্তর।




মৃত্যু ১১ই আগস্ট, ২০০৪, মিউনিখ, জার্মানি.

কবিতা 
১.
ভালো থেকো
 


ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।

ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।

২.
ফুলেরা জানতো যদি
(মুলঃ হেনরিক হাইনে)

ফুলেরা জানতো যদি আমার হৃদয়
ক্ষতবিক্ষত কতোখানি,
অঝোরে ঝরতো তাদের চোখের জল
আমার কষ্ট আপন কষ্ট মানি ।

নাইটিংগেল আর শ্যামারা জানতো যদি
আমার কষ্ট কতোখানি-কতোদুর,
তাহলে তাদের গলায় উঠতো বেজে
আরো ব হু বেশী আনন্দদায়ক সুর ।

সোনালী তারারা দেখতো কখনো যদি
আমার কষ্টের অশ্রুজলের দাগ,
তাহলে তাদের স্থান থেকে নেমে এসে
জানাতো আমাকে সান্ত্বনা ও অনুরাগ ।

তবে তারা কেউ বুঝতে পারেনা তা-
একজন,শুধু একজন,জানে আমার কষ্ট কতো;
আমার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছে যে
ভাংগার জন্য-বারবার অবিরত ।

৩.
গোলাপ ফোটাবো
 

ওষ্ঠ বাড়িয়ে দাও গোলাপ ফোটাবো,

বঙ্কিম গ্রীবা মেলো ঝরনা ছোটাবো।
যুগল পাহাড়ে পাবো অমৃতের স্বাদ,
জ্ব’লে যাবে দুই ঠোঁটে একজোড়া চাঁদ।
সুন্দরীর নৌকো ঢুকাবো বঙ্গোপসাগরে,
অতলে ডুববো উত্তাল আশ্বিনের ঝড়ে।
শিউলির বোঁটা থেকে চুষে নেবো রস,
এখনো আমার প্রিয় আঠারো বয়স।
তোমার পুষ্পের কলি মধুমদগন্ধময়,
সেখানে বিন্দু বিন্দু জমে আমার হৃদয়।

৪.

আমাদের মা

আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।

৫.

সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে



আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।

আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
চলে যাবে সেই সব উপকথাঃ সৌন্দর্য-প্রতিভা-মেধা;
এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বাধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।

আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে,
কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের স্বর
গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।


∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik sabder methopath
Vol -356. Dt -28.04.2021
১৪ বৈশাখ,১৪২৮. বুধবার
=================================

Monday, 26 April 2021


.        
       শরৎচন্দ্র পণ্ডিত ( দাদা ঠাকুর)

"জেলা বীরভূম রামপুরহাট মহকুমার নলহাটি থানার এলাকায় ধর্মপুর নামে একটি পল্লীগ্রাম আছে৷ ধর্মপুর কাশিমবাজারের দানশীলা রাণী আন্নাকালী দেবীর মহালের অন্তর্গত৷ রাণীমা উক্ত ধর্মপুরের "পণ্ডিত" উপাধিধারী রাঢ়ীশ্রেণী ব্রাহ্মণ বংশের এক গৃহস্থকে গ্রামখানি পত্তনী বন্দোবস্ত দেন৷..
               (সেরা মানুষ শরচ্চন্দ্র )
        পারিবারিক বিবাদের ফলে শরচ্চন্দ্রের পিতামহ ঈশানচন্দ্র পণ্ডিত তাঁর সাতপুরুষের ভিটেমাটি ত্যাগ করে মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার দফরপুরে এসে বসবাস শুরু করেন৷  এই দফরপুরই শরচ্চন্দ্রের পৈতৃক বাসস্থান৷
শরচ্চন্দ্র মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার দফরপুর গ্রামে বাস করতেন। তাঁর জন্ম মাতুলালয়ে বীরভূম জেলার নলহাটি থানার অন্তর্গত সিমলাদ্দি গ্রামে ১৮৮১ সালে ২৭ এপ্রিল । পিতা দরিদ্র ব্রাহ্মণ হরিলাল পণ্ডিত। শৈশবেই তিনি পিতা-মাতাকে হারান। কিন্তু তাঁর পিতৃব্য রসিকলাল তাঁকে কোনদিনই তাঁদের অভাব বুঝতে দেন নি। তাঁর স্নেহ-ভালবাসা বেড়ে ওঠা দরিদ্র পরিবারের সন্তান শরচ্চন্দ্র জঙ্গিপুর হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে বর্ধমান রাজ কলেজে এফ.এ. ক্লাসে ভর্তি হন কিন্তু আর্থিক কারণে পড়া শেষ করতে পারেননি।
   "আমার ছাপাখানার আমিই প্রোপাইটর, আমি কম্পোজিটর, আমি প্রুফ রিডার, আর আমিই ইঙ্ক-ম্যান। কেবল প্রেস-ম্যান আমি নই। সেটি ম্যান নয় - উওম্যান অর্থাৎ আমার অর্ধাঙ্গিনী। ছাপাখানার কাজে ব্রাহ্মণী আমাকে সাহায্য করেন, স্বামী-স্ত্রীতে আমরা ছাপাখানা চালাই।"
        পণ্ডিত প্রেস' ছাপাখানা সম্পর্কে বলেছেন । মাত্র ২১ বৎসর বয়সে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে 'হস্তচালিত ছাপাখানাটি রঘুনাথগঞ্জে স্থাপন করেন। তাঁর একক প্রচেষ্টায় 'জঙ্গীপুর সংবাদ' নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করতে থাকেন। এই পত্রিকা বাংলার বলিষ্ঠ মফস্বল সাংবাদিকতার প্রথম উদাহরণ। পণ্ডিত প্রেসে তিনিই ছিলেন কম্পোজিটর,প্রুফ রিডার, মেশিনম্যান। সমস্ত কিছুই একা হাতে কর‍তেন। 


       আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি।
প্রাক স্বাধীনতার সময় কলকাতার রাস্তায় গান গেয়ে 'বোতল পুরান' পুস্তিকাটি ফেরি করতে গেলে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে আসে, তাদের জন্য তৎক্ষণাৎ বানিয়ে ইংরেজিতে গান ধরলেন তিনি।
       " আই অ্যাম কামিং ফ্রম মুর্শিদাবাদ
বাট নট ফ্রম বারহাম্ পোর,
হ্যাড আই কাম ফ্রম দ্যাট ভেরি প্লেস
অল মাইট হ্যাভ শাট্ আপ দ্য ডোর,
দে মাইট হ্যাড থট্ দ্যাট্ হ্যাভ কাম
ফ্রম দ্য ফেমাস অ্যাসাইলাম,
আই অ্যাবোড ইন সাচ এ প্লেস
হুইচ ইজ নাউ ইন ফুল ডিসট্রেস্। .... 
দ্য ম্যজিস্ট্রেট হ্যাজ ইন্ডেন্টেড মি
টু এন্টারটেন্ ইওর এক্সেলেন্সি।_"

         "বিদুষক'পত্রিকা  তাঁর সম্পাদনায়়় প্রকাশিত হতো নিজের রচিত নানা হাসির গল্প ও হাস্য কৌতুক। কলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের হাতে পত্রিকাগুলো তিনি দিল্লি করতেন অথবা বিক্রি করতেন। পরিচিত মহলে তাঁর নাম "দাদা ঠাকুর".
হিন্দি ও ইংরেজিতেও কাব্য লিখেছেন তিনি। তার ব্যাঙ্গাত্বক কবিতাগুলি ছিল সমাজের অত্যাচারী কুপ্রথার বিরুদ্ধে জলন্ত প্রতিবাদ স্বরূপ। স্বয়ং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাকে শ্রদ্ধা করতেন।




সম্মান ও স্বীকৃতি 
তাঁর জীবন নিয়ে ৬০ এর দশকে একটি ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের জীবিতকালে। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস। এছাড়া অন্যান্য শিল্পীরা হলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জী, সুলতা চৌধুরী ও তরুণ কুমার। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্যে ছবি বিশ্বাস জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনা করেছেন হাসির গানের লেখক এবং গায়ক নলিনীকান্ত সরকার। বইটির নাম ‘‌দাদাঠাকুর’‌। আরও অনেকের স্মৃতিতে ধরা আছে তাঁর ছবি। উল্লেখযোগ্য একটি বই লিখেছেন তরুণ চক্রবর্তী— ‘‌কথাসাগরেষু’‌। ধরা–‌বাঁধা জীবনী নয়। জীবনপঞ্জি ছড়িয়ে আছে ইতস্তত কিন্তু প্রধানত সঙ্কলিত হয়েছে দাদাঠাকুর সম্পর্কে অজস্র কাহিনি। সেই সঙ্গে তাঁর বিদগ্ধ শব্দ–‌খেলা এবং সরসোক্তি অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘‌পান’‌ (‌Pun)‌‌ এবং ‘‌উইট’‌ (‌Wit)‌— এই দুইয়ের সমন্বয়ে তাঁর স্মরণীয় বাক্‌–কলা উঠে এসেছে বইটিতে। এখানেই বইটির প্রধান আকর্ষণ। সঙ্গে আছে দাদাঠাকুরের চরিত্রের তেজ‌দীপ্ত প্রসন্নতার ঝলক। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বার একটি কারণ অবশ্য ছিল কলকাতা বেতার–‌কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালের সম্পর্ক। সেই সূত্রে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম, পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠজন। প্রমথনাথ বিশী তাঁকে বলেছিলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ হিউমারিস্ট। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সমকালের সাহিত্যিক এবং সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে তাঁর ছিল সমানে–‌সমানে বন্ধুত্ব। ভাষার ওপর ছিল অসাধারণ দখল। যে কোনও আড্ডায় ছিলেন মধ্যমণি। সে গল্প সবারই জানা— শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘‌দাদাঠাকুর’‌–‌কে দেখে বললেন— এই যে ‘‌বিদূষক শরৎচন্দ্র’‌। দাদাঠাকুর–‌এর উত্তর ছিল— এই তো দেখছি ‘‌চরিত্রহীন শরৎচন্দ্র’‌। 


তিনি চটি বা জুতো পায়ে দিতেন না। হওড়া স্টেশন থেকে নগ্নপদে— নিজেকে বলতেন খলিফা (‌খালি পা)‌— হেঁটে আসতেন তখনকার বেতার–‌কেন্দ্র গর্স্টিন প্লেসে। প্রশ্নটি এখানেই, বিলাসবর্জন করবার সঙ্গে পায়ে চটি না পরার কি সত্যিই সম্পর্ক আছে?‌ খালি পায়ে শহরে–‌বাজারে পথচলা স্বাস্থ্যসম্মত নয়.
মৃত্যু ২৭ এপ্রিল ১৯৬৮ (বয়স ৮৭)
জঙ্গীপুর, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ .
==============={=================


প্রবোধচন্দ্র সেন


 জন্ম ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে এপ্রিল অবিভক্ত বাংলার বর্তমানে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার চুলতা গ্রামে। পিতার নাম হরদাস সেন ও মাতার নাম স্বর্ণময়ী সেন। তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা গ্রামের পাঠশালা ও স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর তাঁর স্কুল ও কলেজ জীবন অতিবাহিত হয় কুমিল্লা শহরে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্সে নিয়ে বি.এ পাশ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এম.এ পাশের পর তিনি রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর ও পরে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর ইতিহাস প্রীতির মূলে ছিল স্বদেশপ্রেম। ছাত্রাবস্থায় তিনি অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। রাজদ্রোহী সন্দেহে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে অন্যান্য কারাবন্দীদের সাথে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পান। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রবোধচন্দ্র সেন কর্মজীবন শুরু করেন খুলনার হিন্দু একাডেমী (বর্তমানে দৌলতপুর কলেজে) ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা দিয়ে। দীর্ঘ দশ বৎসর অধ্যাপনার শেষে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে বিশ্বভারতী বিদ্যাভবনে রবীন্দ্র-অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হলে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিক উৎসবকালে রবীন্দ্রভবনের প্রথম রবীন্দ্র-অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ হন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে অবসরগ্রহণ করার পর বিশ্বভারতীর সম্মানসূচক এমেরিটাস অধ্যাপক হন।
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য  ছন্দ বিষয়ক গ্রন্থগুলি হল  - বাংলা ছন্দের রবীন্দ্রনাথের দান, ছন্দ গুরু রবীন্দ্রনাথ। ছন্দ পরিক্রমা। ছন্দ জিজ্ঞাসা। বাংলা ছন্দ সমীক্ষা। বাংলা ছন্দ চিন্তার ক্রমবিকাশ। ছন্দ সোপান ।বাংলা ছন্দ সাহিত্য। বাংলা ছন্দের রূপকার রবীন্দ্রনাথ। নতুন ছন্দ পরিক্রমার। বাংলা ছন্দ শিল্প ও ছন্দচিন্তা অগ্রগতি।।
বাংলা ছন্দের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা ও পরিভাষা রচনা করে রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত ছান্দসিক অভিধা প্রাপ্ত হন তিনি। এমনকি রবীন্দ্রনাথের ছন্দ গ্রন্থটি সম্পাদনা করে তিনি বিদগ্ধ মহলে সমাদৃত হয়েছেন । এছাড়া ইতিহাস শিক্ষা সমাজ বাংলা সাহিত্য রবীন্দ্র সাহিত্য বিষয়ে তাাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।

ভারতীয় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য - বাঙলার হিন্দু রাজত্বের শেষ মুখ। রামায়ণ ও ভারত সংস্কৃতি,  ভারতাত্মা মহাকবি কালিদাস ,বাংলার ইতিহাস সাধনা  গ্রন্থগুলি। তিনি ভারতাত্মা মহাকবি কালিদাস গ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রদত্ত বঙ্কিমচন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। তাাঁর বাংলার ইতিহাস সাধনাা গ্রন্থটি 
বাংলা  ভাষায় হিস্টিরিয়োগ্রাফির আকর গ্রন্থ।
রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ -"ভারত পথিক রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তা ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত ইচ্ছামন্ত্রের দীক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি.।
ইতিহাসের পটভূমিতে রবীন্দ্রসাহিত্যের আলোচনা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে এদিক থেকে তিনি যথার্থ রবীন্দ্র বিষয়ক গবেষক। 
তথাগত বুদ্ধ দেব ও তার বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ও শ্রদ্ধায় তিনি যে গ্রন্থগুলো রচনা করেছিলেন তা স্বদেশ প্রেম মানবপ্রেম এর সমন্বয় অবিস্মরনীয় -ধর্মবিজয়ী অশোক ও ধম্মপদ পরিচয় গ্রন্থ দুটি। 
আধুনিক বাংলা ছন্দ প্রবন্ধে গদ্য কবিতার ভাষা সম্বন্ধে তিনি সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন -"গদ্য কবিতার ভাষাকে বলা যায় স্পন্দমান গদ্য । অসাধারণ গদ্য হচ্ছে নিস্পন্দ গদ্য অবশ্যই একেবারে স্পন্দনহীন নয় তবে স্পন্দন পরায়নতা সাধারন গদ্যর বৈশিষ্ট্য নয় বলেই তাকে নিস্পন্দ বলা যায় যেমন জগতের কোনো বস্তুই একেবারেই তাহসীন নয় তথাপি যেসব বস্তুর তাপ আমাদের অনুভূতিতে ধরা পড়েনা সেগুলিকে আমরা তাপহীন বলেই গণ্য করি।"
এমনই প্রবন্ধ রচনায় যার স্বাতন্ত্র্য বৈদগ্ধ্যে ও পরিবেশনার নৈপুণ্য জ্ঞানগর্ভ আলোচনা কে সমৃদ্ধ করে তিনি ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন তাই তার ভাষা যুক্তিসঙ্গত উদাহরণ বিষয়ের প্রানবন্ততায় স্বচ্ছন্দ। লেখকের বাংলা সাহিত্যে আপন কৃতিত্বে আজ‌ও চিরভাস্বর হয়ে আছেন।
                           বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রবোধচন্দ্র সেন বিভিন্ন সময়ে অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে আছে প্রফুল্ল-স্মৃতি পুরস্কার (১৯৬৯), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'বঙ্কিম পুরস্কার' (১৯৭৫) 'ভারতাত্মা কবি কালিদাস' গ্রন্থের জন্য, কেশবচন্দ্র গুপ্ত স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৮), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'দেশিকোত্তম উপাধি (১৯৮০), কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডিলিট (১৯৮৩), উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডিলিট (১৯৮৩)। এশিয়াটিক সোসাইটি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে মরণোত্তর "রবীন্দ্রশতবার্ষিকী স্মারক পদক প্রদান করে।

প্রবোধচন্দ্র সেন ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে প্রয়াত হন।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik sabder methopath
Vol -355. Dt -27.04.2021
১৩ বৈশাখ,১৪২৮. মঙ্গলবার
={{{======{{{======={{{======={{{=====





Sunday, 25 April 2021

কাজী আবদুল ওদুদ     

জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। পিতা কাজী সৈয়দ হোসেন। তিনি পেশায় ছিলেন রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার। মাতা খোদেজা খাতুন। তিনি বলেন -" পিতৃকুল ও মাতৃকুল দুই-ই মধ্যবিত্ত। মাতৃকুল কিছু সঙ্গতিসম্পন্ন ।পূর্বপুরুষেরা অসাধারণ কেউ ছিলেন না। প্রায় নিরুদ্বেগে গ্রাম্য জীবনযাপন করেছেন। আমার পিতামহ লেখাপড়া জানতেন না। ভদ্রলোকের ছেলে তাই নিজের হাতে চাষ করতেন না। তবে জীবিকা নির্বাহ করতেন কৃষি সাহায্যেই। চিন্তাভাবনা ধার ধারতেন না। ঋণ করে ইলিশ মাছ খেতে তার বাঁধতো না। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পরিশ্রমের ফাঁকে নিরুদ্বেগে নিদ্রা উপভোগ করতেন। আমার পিতামহী ছিলেন অসাধারণ পার্সি জানা মৌলবির মেয়ে, কিন্তু ধর্মভীরু, বুদ্ধিমতী, কর্মকুশলা ও কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্না তার চাইতে অনেক বেশি ।”



কাজী আবদুল ওদুদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ১৯১৫ সালে আই-এ এবং ১৯১৭ সালে বি এ পাস করেন। সেই সময় রূপগঞ্জ থানার ছোট দারোগার শ্বশুর মশায়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন ওদুদ সাহেব। সেখানে একদিন তিনি শুনতে পেলেন, যার বাড়িতে তিনি আছেন, সেই ভদ্রলোক এবং তার বন্ধুরা রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি ‘থেকে গান গাইছেন। গানের কথা আর সুর শুনে ওদুদ মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ‘গীতাঞ্জলি’ কিনে এনে গান গাওয়ার অভ্যাস শুরু করলেন ওদুদ। গ্রাহক হলেন সবুজপত্র পত্রিকার ।এই সময় কালে সবুজপত্র প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘বিবেচনা ও অবিবেচনা’ প্রবন্ধটি ওদুদ সাহেবের রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। এরপর তিনি থাকতে শুরু করলেন সরকারি বেকার হোস্টেলে। সেখানে তখন থাকতেন শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হকের বড় ছেলে মোহাম্মদ আফজাল উল হক। পরবর্তী সময়ে হক সাহেব মুসলিম পাবলিশিং হাউজ এবং মুসলিম ভারত পত্রিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রকাশ করেছিলেন।হোস্টেলে থাকার সময় হাতে লেখা পত্রিকার ভেতর দিয়ে ওদুদ সাহেবের লেখালেখির হাতে খড়ি। ‘শ্রী দীক্ষিত’ ছদ্মনামে ওই পত্রিকায় ওদুদ সাহেব লিখতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় ওদুদ সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু , দিলীপ কুমার রায়, রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখকে। এই সময় বেকার হোস্টেলেই তার সঙ্গে আলাপ হয় মুজাফফর আহমেদের। সেই আলাপের প্রসঙ্গ নিয়ে মুজাফফর আহমেদ পরবর্তীকালে দেশ পত্রিকায় লিখছেন: “কাজী আবদুল ওদুদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯১৩ সালে। তিনি চৌকস ছাত্র ছিলেন কিন্তু সাহিত্যের প্রতি, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল (দেশ- ১২ আষাঢ়, ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ)।
১৯২৭ ওদুদ সাহেব প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তার পাঠ্যসূচির অন্যতম বিষয় ছিল সংস্কৃত। স্কুলের বাইরে শিখেছিলেন আরবি-ফারসি। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন ওদুদ।
১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পলিটিক্যাল ইকোনমিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এমএ পাস করার অব্যবহিত পরেই তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিছুদিন একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর ১৯২০ সালে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলার প্রভাষকের পদে যোগদান করেন এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪০ সালে বাংলা সরকার প্রাদেশিক টেক্সটবুক কমিটির সেক্রেটারি ও রীডারের পদ সৃষ্টি করলে তিনি উক্ত পদে নিয়োগ লাভ করে কলকাতায় শিক্ষাদফতরে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উক্ত পদের সঙ্গে রেজিস্টার অব পাবলিকেশন্স পদটি যুক্ত করে। কাজী আবদুল ওদুদ এ গুরুত্বপূর্ণ পদে এগারো বছর কর্মরত থাকার পর ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯১৬ সালে তিনি তার চাচার বড় মেয়ে জামিলা খাতুনকে বিয়ে করেন। জামিলা খাতুন ১৯৫৪ সালে মারা যান।
ভারত বর্ষ’ পত্রিকায় ১৩২৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের ‘বিরাজ বৌ’ উপন্যাসের উপরের আলোচনা লেখেন কাজী আবদুল ওদুদ। সম্ভবত ছাপার অক্ষরে সেটি ছিল তার প্রথম লেখা।

কলেজে অধ্যয়নকালেই কাজী আবদুল ওদুদ সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ছাত্র অবস্থায়ই তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ মীর পরিবার (১৯১৮) এবং উপন্যাস নদীবক্ষে (১৯১৯) প্রকাশিত হয়। এমএ পাস করার পর তিনি কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আবাসিক ভবনে কিছুদিন অবস্থান করেন। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এখানেই। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সাহিত্যিকদের আড্ডা বসত। যুদ্ধফেরত নজরুলের উপস্থিতিতে সে আড্ডা আরও বেগবান হয়ে ওঠে। কাজী আবদুল ওদুদের লেখক জীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে এ কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্যেই। তবে তাঁর চিন্তা ও চেতনাকে পরিণতি দান করে ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজ (১৯২৬)। সাহিত্য-সমাজের মুখপত্র শিখার প্রতিটি সংখ্যার পরিকল্পনা ও প্রকাশনায় আবুল হুসেনের সঙ্গে তাঁর সক্রিয় প্রয়াসপ্রযত্ন ছিল। তবে কাজী আবদুল ওদুদের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে সংকল্প (১৩৬১) ও তরুণপত্র (১৩৭২) নামে দুটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন প্রথমটির সম্পাদক এবং দ্বিতীয়টির সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি।

প্রবন্ধ 
শাশ্বত বঙ্গ(১৯৫১)
সমাজ ও সাহিত্য (১৯৩৪)
রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৩৩৪)
হিন্দু-মুসলমান বিরোধ (১৯৩৬)
নব পর্যায় (২খণ্ড)

অন্যান্য বই 
মির পরিবার (গল্প), ১৯১৮
পথ ও বিপথ (নাটক), ১৩৪৬
আজাদ (উপন্যাস), ১৯৪৮
নদীবক্ষে (উপন্যাস), ১৯৫১


তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত জনপ্রিয় বাংলা অভিধান – ব্যবহারিক শব্দকোষ

কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যাল‌য়ের অধ্যাপক হাবিব আর রহমানের সম্পাদনায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কাজী আবদুল ওদুদের ‘নির্বাচিত রচনা’ প্রথম খণ্ড। ঢাকার বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ৬ খণ্ডে ‘কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী’ বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এ বাংলায় সে রকম কিছু ছিল না। একাধারে সাহিত্যবোদ্ধা এবং চিন্তানায়ক ওদুদের নির্বাচিত রচনার সুবৃহৎ এই সংকলন আশা করা যায় এ বঙ্গে সে অভাব কিছুটা দূর করবে। আমাদের এই বিস্মৃতি তো আগ্রহের অভাব থেকেই। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, এ বাংলায় মুসলমান সমাজেও ওদুদকে নিয়ে আগ্রহ প্রায় নেই। অথচ ওদুদের মুসলিম সমাজ সংস্কার প্রচেষ্টার ঘোর সমালোচক ‘মোস্তাফা চরিত’ রচয়িতা মোহম্মদ আকরাম খাঁকে নিয়ে আগ্রহের অভাব দেখি না।

মুসলমান সমাজের সংস্কার প্রচেষ্টা আর হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয় সাধনা করতে গিয়ে ওদুদকে সারাটা জীবন সইতে হয়েছে লাঞ্ছনা— তাঁর নিজের সমাজ থেকে তো বটেই বাইরে থেকেও। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু চিনেছিলেন তাঁকে। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ-বিভীষিকার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ওদুদকে দু’কূলের সেতু হিসেবে দেখেছিলেন। ১৯৩৫ সালে কবির আমন্ত্রণে ওদুদ বিশ্বভারতীতে ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’ বিষয়ে তিনটি বক্তৃতা দেন। সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতামালা পরে বই হয়ে প্রকাশিত হয় বিশ্বভারতী থেকে, রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা সমেত। আজ সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস আর অসম্প্রীতি গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, বাংলাও বাদ নেই। এই সংকটের সময়ে তাঁর লেখাগুলো অত্যম্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
" আমার বুদ্ধিমত্তা তিনি পছন্দ করতেন। কিন্তু আমি যে শান্তশিষ্ট এটি খুব পছন্দ করতেন মনে হয় না। আমি যদি আরও অনেক বেশি উপার্জন করতে পারতাম, আত্মীয়-স্বজনকে দিতে পারতাম- তবে তিনি খুশি হতেন। আমার মা ছিলেন অতিশয় দৃঢ় চরিত্রের ও প্রপর বুদ্ধিসম্পন্না, কিন্তু কর্তৃত্ব ও অবিলাসিনী। তার বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতা দেখে আমার ঠাকুরমা তাকে সংসারের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন তার বিবাহের অল্পকাল পরেই। আমৃত্যু শাশুড়ি বৌ ভাব ছিল।” (আমার জীবন কথা- কাজী আবদুল ওদুদ )

অন্নদাশংকর লিখছেন, “কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন জাতিতে ভারতীয়, ভাষায় বাঙালি, ধর্মে মুসলমান, জীবন দর্শনে মানবিকবাদী, মতবাদে রামমোহনপন্থী, রাজনীতিতে গান্ধী ও নেহরুপন্থী, অর্থনৈতিক শ্রেণি বিচারে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, সামাজিক ধ্যানধারণায় ভিক্টোরিয়ান লিবারেল। কোনও চরমপন্থায় তার বিশ্বাস ছিল না।”
তিনি চেয়েছিলেন, সামাজিক আদান-প্রদান, বিবাহ ইত্যাদি সব জায়গায় সহজ হবে ধর্ম এবং আইন। এই প্রসঙ্গে কাজী আবদুল ওদুদ মনে করতেন, যেটি সেই সময়ের পক্ষের সংগত এবং যে আইন সকলের পক্ষে মান্য তাই প্রচলিত থাকবে। কাজী আবদুল ওদুদের এই উদার এবং গভীর চিন্তাশীল ভাবনা কেবলমাত্র বিস্ময়ের বিষয় তাই নয়, আজকের দিনেও তা গভীরভাবে ভাবনার দাবি রাখে ।

কাজী আবদুল ওদুদ আচারে নিষ্ঠাবান এবং পোশাকে মুসলমান ছিলেন। অথচ কোনোরকম ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা বা অপর ধর্মের প্রতি বিন্দুমাত্র বাতরাগ তাঁর চিন্তার জগতে মুহূর্তের জন্যও ঠাঁই পায়নি।‌
মারা গেছেন: ১৯ মে, ১৯৭০, কলকাতা।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik sabder methopath
Vol -354 /1. Dt -26.04.2021
১২ বৈশাখ,১৪২৮. সোমবার
===============[===============



নারায়ণ সান্যাল
শিশু সাহিত্য থেকে সায়েন্স ফিকশন, শিল্প সমালোচনা, স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ, মনস্তত্ত্ব, প্রযুক্তি, উদ্বাস্তু সমস্যা, ইতিহাস,পশু পাখি বিষয়ক বই থেকে সামাজিক উপন্যাস পর্যন্ত ছিল তাঁর অবাধ বিস্তার।
রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের বাাঁশি কবিিতায় হরিপদ কেরানির মত আরেক হরিপদ চক্রবর্তীকে আমরা দেখি উদ্বাস্তু সমস্যায় ভাঙ্গাগড়া জীবন নিয়ে বল্মীক উপন্যাসে।  পুত্রবধূ কামিনী এছাড়া পরিবারের বাবলু নমিতা ভূষণ লতিকা নতুন জীবনযাত্রায় জর্জরিত সমাধানের স্পষ্ট ইঙ্গিত নিয়ে এগিয়ে গেছেন । লেখক অভিজ্ঞতা ও 
মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে  প্রকাশ করেছেন।   বিশেষ করে তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস বকুলতলা পি এল ক্যাম্প জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দেয়।  এমনই অনেক গ্রন্থের রচয়িতা নারায়ণ সান্যাল সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গির কথাকার। 

যার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে শিল্পচেতনা বিজ্ঞানচেতনা সমাজবিজ্ঞান অন্যতম সাহিত্যকীর্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁর বিখ্যাত রচনা অজন্তা ইলোরা অজন্তা স্থাপত্যের বিবর্তন সূত্রের বিশ্লেষণ সৌন্দর্যের অপরূপ বর্ণনা । এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে এ প্রসঙ্গে সাহিত্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন -"লেখকের দেওয়ার নামই বিদগ্ধ পাঠক সাধারণের মুগ্ধতা ধ্বনিত করে এরকম গ্রন্থের দৃষ্টান্ত একান্ত বিরল।  সেই বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে অপরূপা অজন্তা আজ‌ও তা সত্যিই অপরুপা দুর্লভ নিষ্ঠা অধ্যবসায় ও পান্ডিত্যের সঙ্গে রচনা নৈপুণ্যের সমাহারে প্রায় কিংবদন্তি কল্পনার অজন্তার প্রামাণ্য পরিচায়িকাটি স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি হয়ে উঠেছে।"


                  লেখকের আদি নিবাস ছিল নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর। ওখানেই তিনি ১৯২৪ সালে ২৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। কৃষ্ণনগরে জন্ম হলেও তিনি কলকাতায় শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন। ম্যাট্রিক পাশ করেন আসানসোল ই আই আর বিদ্যালয় থেকে। স্কুলের খাতায় নাম ছিল নারায়নদাস সান্যাল। ১৯৪৮ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি.ই. সম্পন্ন করেন। তিনি ইন্সটিট্যুট অব ইঞ্জিনিয়ার্স (ইন্ডিয়া)-এর ফেলো ছিলেন। ১৯৮২ সালে সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছিলেন।। স্ত্রী: সাবিতা সান্যাল
সিনেমা: যদি জানতেম, অশ্লীলতার দায়ে, সত্যকাম, Pashanda Pandit, Punnagai
সন্তান: মৌ সান্যাল তালুকদার, অনিন্দিতা বসু, Tirtharenu Sanyal

রচনা কর্ম:

বকুলতলা পি এল ক্যাম্প বিষের কাটা বল্মীক কাঁটায় কাঁটায় অজন্তা অপরূপা জাপান থেকে ফিরে নক্ষত্রলোকের দেবাত্মা নেতাজির রহস্য সন্ধানে আমি নেতাজীকে দেখেছি অগ্নিকন্যা মমতা মান  মানে কচু প্রভৃতি।

দীপন’ পত্রিকার সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল তাঁর। প্রতিভার মূল্যায়নে এই পত্রিকার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।

তিনি অজন্তার বিষয়েই লিখুন অথবা বৌদ্ধ যুগের পুনর্নির্মাণ বিষয়েই ভাবুন, সব সময়ই সংশ্লিষ্ট ‘উপাদান’ সংগ্রহ করে নিতেন। এত যত্ন ও শ্রম রম্যকাহিনির জন্য সতত প্রয়োজনীয় নয়। অবাক করা তাঁর বিষয়বৈচিত্র্য: ফরাসি ভাস্কর রদ্যাঁ ও কলিঙ্গের দেবদেউল কিংবা মিথুনচিত্র যদি তাঁর মনোহরণ করে তবে চমৎকৃত হই যে বাস্তুবিদ্যা বা হাতেকলমে এসটিমেট করার বিষয়ে তিনি মোটেই অন্যমনস্ক নন। উপন্যাস ও কথাসাহিত্য থেকে ভ্রমণসাহিত্য, কিশোর-আখ্যান, গোয়েন্দা-কাহিনি, সুভাষ বসু রহস্য, কোনও কিছুতেই তাঁর ক্লান্তি নেই। বিজ্ঞানাশ্রয়ী কথকতা যেমন করেছেন, তেমন ‘অরিগামি’ বা কাগজ ভাঁজের খেলা তাঁকে ভাবিয়েছে। এমনকি ‘অগ্নিকন্যা মমতা’ যখন তিনি লেখেন (১৯৯৮), তখনও ভবিষ্যৎ মুখ্যমন্ত্রীর প্রসাদ পাওয়ার আশায় লেখেননি। তাঁর সমর্থন বিশ্বাসের দিক থেকেই। বস্তুত দোষ ও গুণ সত্ত্বেও নারায়ণ সান্যালের মধ্যে এমন অভিজাত অন্তরাল বাসা বেঁধেছিল যে তিনি প্রচারিত হলেও প্রচারমাধ্যমের প্রতি আনুগত্য দেখালেন না। না হলে প্রভূত আলোচনা ও পুরস্কারপ্রাপ্তি তাঁর করতলধৃত আমলকি হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়।


পুরস্কার :
রবীন্দ্র পুরস্কার - অজন্তা অপরূপা-১৯৬৯
বঙ্কিম পুরস্কার - রূপমঞ্জরী-২০০০
সত্যকাম চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনির পুরস্কার পান বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টঅ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে।

মারা গেছেন: ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৫, কলকাতা
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik sabder methopath
Vol -354. Dt -26.04.2021
১২ বৈশাখ,১৪২৮. সোমবার
=================================