Sunday, 7 August 2022

মহাপ্রয়াণ দিবস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। Vol -821. dt -08.08.2022. ২২ শ্রাবণ,১৪২৯. সোমবার। The bolgger in litareture e-magazine.

তুমি রবে নিরবে.....হৃদয়ে মম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


      যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে 

১৯৪১ সালের ২২শে শ্রাবণ ছিল রাখী পূর্ণিমার দিন। কিন্তু সেই পূর্ণিমার দিনেই, মধ্যাহ্নের একটু পরেই নেমে এসেছিল অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার - অস্তমিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আজ এই বিশেষ দিনটিতে তাঁর শেষ জীবনের কিছু স্মৃতি-

জীবনের শেষ দশ বছরে রবীন্দ্রনাথ পনেরোটি ও বেশি বই লিখেছিলেন। পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫) ও পত্রপুট (১৯৩৬) নামে গদ্যকবিতা-সংকলনগুলি এই সময়েই প্রকাশিত হয়। জীবনের এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্য নিয়ে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬), শ্যামা (১৯৩৯) ও চণ্ডালিকা (১৯৩৮) নামে প্রসিদ্ধ নৃত্যনাট্যত্রয়ীও এই সময়ই লিখিত হয়। এছাড়া তিনি দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪) নামে তিনটি উপন্যাসও রচনা করেন। জীবনের শেষ পর্বে কবি বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বিশ্বপরিচয়। এই গ্রন্থে তিনি জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানা তথ্যমূলক প্রবন্ধ রচনা করেন। তার এই সময়কার কবিতাগুলিতেও বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলির উপর আধারিত প্রকৃতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়। সে (১৯৩৭), তিনসঙ্গী (১৯৪০) ও গল্পসল্প (১৯৪১) গল্পগ্রন্থগুলিতেও বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী চরিত্রের নানা সমাবেশ লক্ষিত হয়।


ঋজু শালপ্রাংশু দেহের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন সুস্বাস্থ্য ভোগ করলেও জীবনের শেষ চার বছর দীর্ঘস্থায়ী পীড়ায় কষ্ট পেয়েছিলেন। তার মূল সমস্যা ছিল অর্শ। এই চার বছরে দুবার দীর্ঘসময় অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয় তাকে। ১৯৩৭ সালে একবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন কবি ; এই সময় কোমায় চলে গিয়ে মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেন অত্যন্ত কাছ থেকে। আর তখন থেকেই তার এই দীর্ঘকালীন অসুস্থতার সূত্রপাত। ১৯৪০ সালের শেষ দিকে আবার একই ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এবার আর সেরে ওঠেননি। এই সময়কালের মধ্যেই জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু কবিতা রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। এই কবিতাগুলির মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে মৃত্যুকে ঘিরে লেখা রবীন্দ্রনাথের কিছু অবিস্মরণীয় পঙক্তিমালা।
শান্তিনিকেতন থেকে সে বছরের ১৯শে সেপ্টেম্বর পূত্রবধূ প্রতিমা দেবীর কাছে গিয়েছিলেন দার্জিলিং পাহাড়ের কালিম্পং-এ। সেখানেই ২৬ তারিখ রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। দার্জিলিংয়ের সিভিল সার্জন বলেছিলেন তখনই অপারেশন না করলে কবিকে বাঁচানো যাবে না। প্রতিমা দেবী এবং মৈত্রেয়ী দেবী তখনই অপারেশন না করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন," লিখেছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের অধ্যক্ষ ও সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায়।

একটু সুস্থ হওয়ার পরে পাহাড় থেকে নামিয়ে কবিকে কলকাতায় আনা হয়। তারপরে তিনি ফিরে যান শান্তিনিকেতনে। অপারেশন করানো হবে কী না, তা নিয়ে যে একটা দোলাচল ছিল।

সারা জীবন চিকিৎসকের কাঁচি থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছেন, এবার বুঝি আর তা সম্ভব নয়। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি চলছেই। কিন্তু কিছুতে কিছু হচ্ছে না। শান্তিনিকেতনে ছিলেন তখন। এরই মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ বেশ কিছু গল্প লিখেছেন। সেগুলো পড়ে দারুণ আনন্দ পেলেন কবি। বললেন, আরও লিখতে। অবন ঠাকুর রানী চন্দকে গল্প বলে যান, রানী চন্দ সে গল্প শুনে লিখে ফেলেন। তারই কিছু আবার দেওয়া হলো রবীন্দ্রনাথকে। তিনি পড়লেন, হাসলেন এবং কাঁদলেন। রানী চন্দ এই প্রথম এমন করে রবিঠাকুরের চোখ থেকে জল পড়তে দেখলেন।
রানী চন্দ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ভাজন, শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী ও চিত্রশিল্পী এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের স্ত্রী।
চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের কথাই বললেন। রবীন্দ্রনাথের তাতে মত নেই। তিনি বললেন, ‘মানুষকে তো মরতেই হবে একদিন। একভাবে না একভাবে এই শরীরের শেষ হতে হবে তো, তা এমনি করেই হোক না শেষ। মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছেঁড়ি করার কি প্রয়োজন?’
কিন্তু যে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন তিনি, তার উপশমের জন্য দেহে অস্ত্রোপচার করতেই হবে—এই হলো চিকিৎসকদের মত। আর সেটা করতে হলে শান্তিনিকেতনকে বিদায় জানিয়ে চলে আসতে হবে কলকাতায়। তাই শেষবারের মতো শান্তিনিকেতন ছাড়লেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ২৫ জুলাই বেলা তিনটা ১৫ মিনিটে রবীন্দ্রনাথ এলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
খবরটা গোপন রাখায় স্টেশনে কিংবা বাড়িতে ভিড় ছিল না। পুরোনো বাড়ির দোতলায় ‘পাথরের ঘর’-এ তিনি উঠলেন। স্ট্রেচারে করে দোতলায় নিতে হলো তাঁকে। ২৬ জুলাই রবিঠাকুর ছিলেন প্রফুল্ল। ৮০ বছরের খুড়ো রবীন্দ্রনাথ আর ৭০ বছর বয়সী ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ অতীত দিনের নানা কথা স্মরণ করলেন। হাসলেন প্রাণখুলে। ২৭ জুলাই সকালে রবীন্দ্রনাথ মুখে মুখে বললেন একটি কবিতা, টুকে নিলেন রানী চন্দ। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তি হলো: ‘প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্ত্বার নতুন আবির্ভাবে, কে তুমি, মেলে নি উত্তর।’ ৩০ জুলাই ঠিক হয়েছিল তাঁর দেহে অস্ত্রোপচার হবে। কিন্তু সেটা তাঁকে জানতে দেওয়া হয়নি। তিনি ছেলে রথীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে অপারেশন হবে’। রথীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কাল-পরশু’। আবার রানী চন্দকে ডাকলেন কবি, লিখতে বললেন: ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী।’ ডা. ললিত এলেন একটু পরে। বললেন, ‘আজকের দিনটা ভালো আছে। আজই সেরে ফেলি, কী বলেন?’ হকচকিয়ে গেলেন কবি। বললেন, ‘আজই!’ তারপর বললেন, ‘তা ভালো। এ রকম হঠাৎ হয়ে যাওয়াই ভালো।’
বেলা ১১টায় স্ট্রেচারে করে অপারেশন-টেবিলে আনা হলো কবিকে। লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অপারেশন করা হচ্ছে। ১১টা ২০ মিনিটের দিকে শেষ হলো অস্ত্রোপচার। ভারী আবহাওয়া উড়িয়ে দেওয়ার জন্য কবি রসিকতা করলেন, ‘খুব মজা, না?’
শরীরে যথেষ্ট যন্ত্রণা হয়েছিল অপারেশনের সময়। কিন্তু তা বুঝতে দেননি কবি। সেদিন ঘুমালেন। পরদিন ৩১ জুলাই যন্ত্রণা বাড়ল। গায়ের তাপ বাড়ছে। নিঃসাড় হয়ে আছেন। ১ আগস্ট কথা বলছেন না কবি। অল্প অল্প পানি আর ফলের রস খাওয়ানো হচ্ছে তাঁকে। চিকিৎসকেরা শঙ্কিত। ২ আগস্ট কিছু খেতে চাইলেন না, কিন্তু বললেন, ‘আহ! আমাকে জ্বালাসনে তোরা।’ তাতেই সবাই খুশি। ৩ আগস্টও শরীরের কোনো উন্নতি নেই। ৪ আগস্ট সকালে চার আউন্সের মতো কফি খেলেন। জ্বর বাড়ল। ৫ আগস্ট ডা. নীলরতন বিধান রায়কে নিয়ে এলেন। রাতে স্যালাইন দেওয়া হলো কবিকে। অক্সিজেন আনিয়ে রাখা হলো। ৬ আগস্ট বাড়িতে উৎসুক মানুষের ভিড়। হিক্কা উঠছিল কবির। পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ডাকছিলেন, ‘বাবা মশায়!’ একটু সাড়া দিলেন কবি। রাত ১২টার দিকে আরও অবনতি হলো কবির শরীরের। ৭ আগস্ট ছিল ২২ শ্রাবণ। কবিকে সকাল নয়টার দিকে অক্সিজেন দেওয়া হলো। নিশ্বাস ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকল কবির। দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে তা একেবারে থেমে গেল।
জনারণ্যে পরিণত হয়েছে তখন ঠাকুরবাড়ি। কবিকে বেনারসি-জোড় পড়ানো হলো। কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, চাদর, কপালে চন্দন, গলায় মালা দিয়ে সাজানো হলো। রানী চন্দ কবির বুকের ওপরে রাখা হাতে ধরিয়ে দিলেন পদ্মকোরক। কবি চললেন চিরবিদায়ের পথে।

শ্রাবনবেলায় চির একলা এ প্রান্তরে রবি অস্তমিত হল সেই মূহুর্তে , সকলের অলক্ষ্যেই। কলিকাতার সেই বাইশে শ্রাবন শান্তিনিকেতনের বুকে আছড়ে পড়েছিল শ্রাবনের বারিধারার মত।

নশ্বর দেহের মৃত্যু ঘটতে পারে , কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়না । বাঙালির জীবনের প্রতিটি সুখদুঃখে মনে আর মননে তিনি আছেন চিরকালীন হয়ে !

 ".....দিনান্তবেলায় শেষের
ফসল নিলেম তরী-'পরে,
এ পারে কৃষি হল সারা,
যাব ও পারের ঘাটে॥
হংসবলাকা উড়ে যায়,
দূরের তীরে, তারার আলোয়,
তারি ডানার ধ্বনি বাজে মোর অন্তরে। 
ভাঁটার নদী ধায় সাগর-পানে কলতানে,
ভাবনা মোর ভেসে যায় তারি টানে।
যা-কিছু নিয়ে চলি শেষ সঞ্চয়
সুখ নয় সে, দঃখ সে নয়, নয় সে কামনা--
শুনি শুধু মাঝির গান আর
 দাঁড়ের ধ্বনি তাহার স্বরে...."

সাহিত্যিক ও বিশ্বভারতীর গ্রন্থনবিভাগের অধ্যক্ষ রামকুমার মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছিলেন কবি নিজে এই ভাবে নিজের শেষটা চাননি। "তাঁর ইচ্ছা ছিল কোনও জয়ধ্বনি ছাড়া সাধারণভাবে শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির কোলেই তিনি যেন মিশে যেতে পারেন। তাঁর শেষ ইচ্ছাটা আর রাখা যায়নি।"

আরও একটা বাইশে শ্রাবণ এসে গেল। ভেজা মাটিতে শিকড় ছুঁয়ে কচি পাতা সূর্যের আলো স্পর্শ করল।


১৯৩০ সালের ২৫ অক্টোবর ইন্দিরাদেবীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘আমার শ্রাদ্ধ যেন ছাতিম গাছের তলায় বিনা আঢ়ম্বরে বিনা জনতায় হয় – শান্তিনিকেতনের শালবনের মধ্যে আমার স্মরণের সভা মর্ম্মরিত হবে, মঞ্জরিত হবে, যেখানে যেখানে আমার ভালোবাসা আছে, সেই সেইখানেই আমার নাম থাকবে।’’
কবিরই দেওয়া নাম "আকাশবাণী"। রেডিও সে দিন শান্তিনিকেতনকে জানিয়েছিল কবির চলে যাওয়া। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কবির মৃত্যু ও নিমতলায় দেহ সৎকারের ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের পশ্চিম তোরণের কাছে একটি ভবনে রেডিও ছিল। সে দিন যেন বিশ্বাস করতে পারেনি শান্তিনিকেতন আকাশবাণীর দেওয়া সেই সংবাদ। কিন্তু কবির শেষ ইচ্ছে পূরণ করেছিল শান্তিনিকেতন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ-সহ অনেকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পাঠভবন গ্রন্থাগার থেকে উপাসনা মন্দির পর্যন্ত ‘সমুখে শান্তি পারাবার-ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’ --গানটি সমবেত কন্ঠে গাইতে গাইতে গিয়েছিলেন। অথচ এই গানটা গাওয়ার কথা ছিল 'ডাকঘর' নাটকের একটি বিশেষ প্রযোজনায়। ফকিরের চরিত্রে অভিনয়ের কথা ছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কিন্তু সেই প্রযোজনা শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়নি। অমলের মৃত্যুর পরে এই গান গাওয়া হবে বলে ঠিক করেও কবিই নাকচ করে দিলেন। সে দিন তাঁরই চাওয়া ছিল, এ গান যেন তাঁর স্মরণসভায় গাওয়া হয়। সে দিন বিশেষ উপাসনা মন্দির পরিচালনা করেছিলেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন। সেখানেও এই গানটিই গাওয়া হয়। শালবীথিতে মৃত্যুর ইচ্ছে পূরণ না হলেও দিন কয়েকের মধ্যেই কবির স্নেহধন্য শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ কর পিতলের কলসিতে করে চিতাভস্ম নিয়ে শান্তিনিকেতনে আসেন। যা এখনও রবীন্দ্রভবনে সযত্নে সংরক্ষিত।
কবি চলে যাওয়ার দশ দিন পরেই ৩২ শ্রাবণ রবিবার, ইংরেজির ১৭ অগস্ট, ১৯৪১ সালে সকাল ৬.৩০ মিনিটে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাতিমতলায় ক্ষিতিমোহন সেন ও বিধুশেখর শাস্ত্রী আদি ব্রাহ্মসমাজ মতে শ্রাদ্ধবাসর পৌরহিত্য করেন। শ্রাদ্ধবাসরে কঠোপনিষদ থেকে যম ও নচিকেতার অংশটি পাঠ করেন মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী। পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদন করেন রথীন্দ্রনাথ ও সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। উপস্থিত সকলকে কবিগুরুর শেষ বয়সের ছবি, শেষ কবিতা ও সমুখে শান্তি পারাবার গানটি মুদ্রিত হরফে দেওয়া হয়। এর পরে বিশ্বভারতীর তরফ থেকে দরিদ্রদের অন্ন ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়।

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। গদ্যকার রামরাম বসু। Vol - 820. Dt -07.08.2022. ২১ শ্রাবণ,১৪২৯. রবিবার। The bolgger in litareture e-magazine.



রামরাম বসু। 
         
                     
মৃত্যু - ৭ ই আগস্ট,১৮১৩ কলকাতা।


অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব। তার জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়। তিনি বাংলা, সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন ; কিছু ইংরেজিও জানতেন। প্রথম দিকে তিনি ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য আসা মিশনারি পাদ্রীদের বাংলা শেখাতেন। পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে তিনি মুন্সি ও সংস্কৃত ভাষার সহকারী শিক্ষকের চাকরি পান। তার রচিত রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা মৌলিক গদ্যগ্রন্থ ও ছাপাখানায় মুদ্রিত প্রথম বই। বইটি ১৮০১ সালের জুলাই মাসে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এটি ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া তিনি বাঙালা ভাষায় কয়েকটি খ্রিস্টধর্ম বিষয়ক বই লেখেন, রামায়ণ ও মহাভারত সম্পাদনা করেন ও উইলিয়াম কেরিকে বাইবেল অনুবাদে সহায়তা করেন।

১৭৯৩ সালে উইলিয়াম কেরি কলকাতায় এলে রামরাম বসু কেরির মুনশি নিযুক্ত হন। ১৭৯৫ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখে কেরি মালদহ মদনবাটি নীলকুঠির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হলে তিনিও সঙ্গে যান। ১৮০০ সালে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন মুদ্রাযন্ত্র ও বাংলা বিদ্যালয় স্থাপন হলে তিনি এই বছরের জুন মাসে নিযুক্ত হন।[২] ১৮০১ সালের ৪ মে রামরাম বসু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে দ্বিতীয় পণ্ডিতের পদে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে নিযুক্ত হন। শিক্ষকতার পাশাপাশি রামরাম বসু অনুবাদ ও সাহিত্য রচনা করেছেন। 'গসপেল মেসেঞ্জার'গ্রন্থটি 'হরকরা' নামে কবিতায় অনুবাদ করেন। পরে এটি ওড়িয়া ও হিন্দিতেও অনূদিত হয়। এরপর ১৮০০ সালে 'জ্ঞানোদয়' ও 'খৃষ্টবিবরণামৃতং' নামে কবিতায় খ্রিষ্টচরিত রচনা করেন। তবে তার প্রধান কীর্তি ১৮০১ সালে প্রথম বাংলা গদ্যে রচিত ষোড়শ শতাব্দীর 'বারো ভুঁইয়ার' অন্তর্গত বাঙালি জমিদার প্রতাপাদিত্যের জীবনী - 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র'। তিনি স্বয়ং রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর হওয়ার কারণে এই গ্রন্থে ঐতিহাসিক ও লোকশ্রুতির সমাহার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করতে পেরেছেন।  এরপর'লিপিমালা' নামে আর একটি গ্রন্থ। এটিও বাংলা গদ্যে ১৮০২ সালে শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হয়। রামরাম বসু উইলিয়াম কেরির বাংলা শিক্ষক ছিলেন। তিনি কেরির বাংলা বাইবেলের পরিমার্জনা করেছিলেন 


জন টমাস ১৭৯২ সনে লিখে গিয়েছেন, তখন রামরামের বয়স হবে আনুমানিক ৩৫ বছর। ১৭৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টমাস ইংল্যান্ডে ফেরার আগ পর্যন্ত রামরাম তাঁর মুন্সি হিসেবে কাজ করেন। পরে ১৭৯৩ সালের নভেম্বর মাসে টমাস যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা, পাদ্রী, শিক্ষাবিদ; তখন আধুনিক বাংলা গদ্য ও অভিধানের প্রধান পরিকল্পনাকারী উইলিয়ম কেরী এবং তাঁর পরিবার নিয়ে বঙ্গদেশে ফিরে আসেন। তখন তাঁর সুপারিশে কেরী রামরামকে তাঁর বাংলা মুন্সি হিসেবে নিযুক্ত করেন। এ থেকেই শুরু হয় কেরীর সঙ্গে রামরাম বসুর সম্পর্ক। দেশীয় লোকেদের মধ্যে খৃষ্টধর্ম প্রচারের কেরী রামরামকে তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী করে তুলেছিলেন। রামরামও যিশুর মাহাত্ম্য সম্পর্কে কবিতা, গান লিখে মিশনারীদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। রামরাম খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ না করলেও খ্রীষ্টধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে ভালো রকম জানতেন। তিনি ‘গসপেল মেসেঞ্জার’ নামে একটি পুস্তিকা সম্পাদনা করেন এবং হিন্দুধর্ম ও সমাজের কুপ্রথা ও ধর্মবিশ্বাসকে সমালোচনা করে মিশনারীদের জন্য পুস্তক প্রস্তুত করে দেন, একটি গানের বইও লিখে দেন।

প্রথমবার ১৭৯৬ সাল পর্যন্ত রামরাম কেরীর কাজ করেন, কিন্তু এক বিধবার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখার অভিযোগে কেরী তাঁকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেন। কেরী তাঁর কাছ থেকে সামান্য বাংলা শিখে দুর্বল জ্ঞান নিয়েই তাঁর সাহায্যে বাইবেল অনুবাদ করতে আরম্ভ করেন। ১৮০০ সালে উইলিয়ম ওয়ার্ড এবং যশুয়া মার্শম্যানকে সঙ্গে নিয়ে কেরী যখন শ্রীরামপুর মিশন এবং প্রেস গড়ে তোলেন, তখন দ্বিতীয়বারের জন্যে রামরাম কেরীর অধীনে কাজ করতে আরম্ভ করেন। এবারে তাঁর কাজ হয় খ্রিস্টধর্ম সংক্রান্ত সাহিত্য রচনা এবং অনুবাদ করা।


লিপিমালা’ পুস্তক শ্রীরামপুরে কাষ্ঠনির্মিত মুদ্রাযন্ত্রে মুদ্রিত হয়েছিল। বিলাত থেকে আনীত এই মুদ্রা যন্ত্রটি কলকাতায় নিলামে বিক্রি হয়েছিল। বাংলায় বাইবেল অনুবাদ ছাপাবার ইচ্ছায় উডনি সাহেব এটি ক্রয় করেছিলেন মাত্র ৪৬ পাউণ্ডে। তিনি এটি কেরীকে দান করেন। মুদ্রাকর ওয়ার্ডের তত্ত্বাবধানে এবং কলকাতা থেকে ক্রীত হরফ সাজিয়ে কেরীর উদ্যোগে ও রামরাম বসুর সহায়তায় বাংলায় বাইবেল অনুবাদ ‘ধৰ্ম্মপুস্তক’ ১৮০১ সালে প্রকাশিত
হল।’ধৰ্ম্মপুস্তক’ (১৮০২) ও ‘লিপিমালা’ পুস্তক’ (১৮০২) দ্বয়ের হরফের উচ্চতা একই (৩ মিমি.) এবং হরফের আকারও এক।
‘লিপিমালা’ গ্রন্থের ৫ পৃষ্ঠা ব্যাপী ভূমিকা আছে। গ্রন্থারম্ভে সিদ্ধিদাতা পরম ব্রহ্মকে লেখক স্মরণ করেছেন। ভূমিকার শেষে ৬ পঙক্তির পদ্য আছে। শেষ দুই পঙক্তিতে ভাদ্র মাসে ১১৯৫
বর্ষে (১৮০২) গ্রন্থ রচয়িতার নাম আছে :
শতাদিত্য বসু বর্ষ পশু শ্রেষ্ঠ মাস।
পরম আনন্দে রাম করিল প্রকাশ।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রচয়িতা ভণিতায় গ্রন্থ রচনার কাল ও আত্মপরিচয় দিতেন। সেই রীতিটি রামরাম বসু কিছুটা বজায়।
রেখেছেন। তার প্রথম গ্রন্থ ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ (১৮০১)-এর প্রারম্ভের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তিনি আত্মপরিচয় জ্ঞাপনের কিছুটা ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তিনি নিজেকে রাজা প্রতাপাদিত্যের স্বজাতি‌ ও উত্তর পুরুষের একজন হয়ে যে রাজার বিবরণ অধিক জ্ঞাত
ছিলেন তা জানাতে দ্বিধা করেন নি।
লিপিমালা প্রথম বাংলা পত্রসাহিত্য। বাংলা
অঙ্ক পুস্তকের আদি নমুনা আছে ১৫ পৃষ্ঠার
অঙ্কমালা’-য়। মধ্যযুগে পুথিতে রচিত মুকুন্দর ‘চন্ডীমঙ্গল’ কাব্যের প্রথম মুদ্রিত রূপ লিপিমালায় আছে। পুথিতে রচিত চৈতন্যজীবনী কাব্যের খসড়া ও আদি মুদ্রিত রূপও এই গ্রন্থে আছে। বহুমুখী জ্ঞান-কোষের প্রথম বাংলা রচনা লিপিমালা।
‘এটি স্হির কথা, বাঙ্গালা গদ্যের প্রাচীনতর
নমুনা যতই থাকুক না কেন, রাম বসুই
আধনিক গদ্য সাহিত্যের স্রষ্টা। তাঁহার পূর্বে
বাঙ্গালা ভাষায় আধুনিক ছন্দের গদ্যে
প্রতাপাদিত্যচরিতের মত একখানি
সৰ্ব্বাঙ্গসুন্দর পুস্তক কেহ লেখেন নাই।…।
– রাম বসুর
লিপিমালাও একখানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ।
– দীনেশচন্দ্র সেন
‘বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনেক মহারথীর সঙ্গে নিতান্ত পদাতিক রামরাম বসুর স্থান হইয়াছে। কিন্তু কোন্ বিচারের মাপকাঠিতে ? তাঁহার রচিত রাজা প্রতাপাদিত্য-চরিত্র বাঙলা অক্ষরে মুদ্রিত বাঙালী রচিত প্রথম মৌলিক গদ্যগ্রন্থ। ইহা সামান্য সাফল্য নয়, এক হিসাবে সফলতার চরম।…
…পথভ্রষ্ট রাম বসু মিশনারীদের সঙ্গে না জুটে ওয়ারেন হেস্টিংস ও ক্লাইভের দলে ভিড়লে বাংলা দেশের অভিজাত সমাজ আর একটা রাজা-মহারাজার পদবীগৌরব লাভ করত। কিন্তু প্রতিভা এমন শক্তি যে, পথভ্রষ্ট হলেও পথ কেটে নিতে ভােলে না, রাম বসুর
প্রতিভাও পথ কেটে নিয়েছে—বাংলা গদ্য রচনারীতির পথ।

প্রমথনাথ বিশী
রামরাম বসু-র (১৭৬০-১৮১৩) জন্মস্থান চুঁচুড়ায় এক কায়স্থ বংশে। তিনি ১৭৮৭ সালে মুন্সীপদে নিযুক্ত হন। তিনি টমাস ও কেরি সাহেবকে বাংলা শিখিয়েছিলেন।বাইবেলের সর্বপ্রথম বঙ্গানুবাদে রামরাম বসুর সহায়তা সর্বাধিক ছিল। যিশু সম্বন্ধে বাংলা ভাষায় বসু মহাশয় যে গানটি রচনা করেন সেটির ইংরেজি তর্জমা প্রায় অর্ধ শতকব্যাপী মিশনারি পর্বে বাংলার গীর্জাগুলিতে ধ্বনিত হয়েছে।‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ (১৮০১) ও ‘লিপিমালা’ (১৮০২)—এই দুখানি মৌলিক বাংলা গদ্য গ্রন্থের রচয়িতা এবং বাংলা গদ্যরীতির দিশারীরূপে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আসন চিরস্থায়ী।

<<*,,,,,,{==========================}==

Friday, 5 August 2022

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। সাহিত্যিক কিশোরী চাঁদ মিত্র। Vol - 819. Dt -06.08.2022. ২০ শ্রাবণ ,১৪২৯. শনিবার। The blogger in literature e-magazine

কিশোরীচাঁদ মিত্র 


 ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ ই আগস্ট কলকাতায় প্রয়াত হন। তাঁর স্ত্রী কৈলাসবাসিনী দেবী তার একটি আত্মজীবনী রচনা করেছেন। 


নীলবিদ্রোহের সময় ও ভারতসভা প্রতিষ্ঠার সময় তিনি স্বাজাত্যবোধের পরিচয় প্রদান করেছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল-

"সরকারি চাকরিতে .... গাত্রবর্ণ বা আভিজাত্য নয় .... যোগ্যতাই মাপকাঠি হওয়া উচিত।"



রচনা কর্ম:

হিন্দু কলেজ
দি মিউটিনী
দি গভর্নমেন্ট অ্যান্ড দি পিপল
মেময়ার অফ দ্বারকানাথ টেগোর
ওড়িশা পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট।

জন্ম ২২ মে ১৮২২ কলকাতায়। পিতা রমনারায়ণ মিত্র। তিনি কলকাতায় কাগজ ও হুন্ডির ব্যবসায়ী ছিলেন। তাাঁর আদি নিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার পানিসেহালা গ্রামে।  প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক প্যারীচাঁদ মিত্র ছিলেন কিশোরীচাঁদের অগ্রজ। কিশোরীচাঁদ প্রথমে কলকাতার হেয়ার স্কুল ও পরে হিন্দু কলেজে পড়াশোনা করেন এবং কলেজে ইংরাজী সাহিত্যের কৃতী ছাত্র ও ইয়ং বেঙ্গল দলের অন্যতম সদস্য ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে কলেজ ত্যাগ করেন।


কিছু দিন তিনি ডাফ স্কুলের অবৈতনিক শিক্ষক, এশিয়াটিক সোসাইটির সহ-সম্পাদক এবং সরকারি কেরানি পদে কাজ করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডেপুটি ম্যাজিসেট্রটের পদে নিযুক্ত হয়ে আট বৎসর কাল তৎকালীন রামপুর বোয়ালিয়া অধুনা রাজশাহীতে অতিবাহিত করেন এবং নানা জনহিতকর কাজে যুক্ত ছিলেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার পুলিশ ম্যাজিসেট্রট হন এবং 'বার্নেস পিকক্' কর্তৃক আনীত বিচারব্যবস্থার সংশোধনীকে ইংরেজগণ কালাকানুন আখ্যা দেয় এবং এর বিরোধিতা করে। এই আইনে এ দেশীয় বিচারপতিদের শ্বেতাঙ্গদের বিচার করার অধিকার ছিল। কিশোরীচাঁদ বার্নেসের সংশোধনীর সমর্থনে আন্দোলন করেন। ফলে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর তিনি কর্মচ্যুত হন।  

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে কিশোরীচাঁদ 'ইন্ডিয়ান ফিল্ড' নামে সাপ্তাহিক ইংরাজী পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা শুরু করেন। এই পত্রিকা ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু প্যাট্রিয়ট এর সঙ্গে যুক্ত হয়। তিনি হেয়ার মেমোরিয়াল সোসাইটি, বেথুন সোসাইটি, সোসাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন এর সাথে যুক্ত ছিলেন। 

১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে 'হিন্দু থিওজফিক্যাল সোসাইটি' এবং ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সভা'র প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমটি স্বল্পকাল স্থায়ী হলেও, তিনি দ্বিতীয়টির সহায়তায় স্ত্রী শিক্ষা, কৃষি ও শিল্পের প্রসার, বাল্য বিবাহ নিবারণ, বিধবা বিবাহ প্রচলন ইত্যাদি বহু সামাজিক সংস্কার সাধিত হয়েছে। তিনি 'কলকাতা রিভিউ', হিন্দু প্যাট্রিয়ট , 'বেঙ্গল স্পেকটাটর' এবং 'বেঙ্গল ম্যাগাজিন' পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতেন। তাাঁর রচনা নৈপুণ্যের প্রথম পরিচয় "রাজা রামমোহন রায় " শীর্ষক প্রবন্ধ। তিনি বাংলার ভূম্যধিকারী পরিবারবর্গের ইতিবৃত্ত বিষয়ে বহু তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধও লেখেন। যেমন -
Raja Rammohan Roy’, ‘Zamindar and Ryot’, ‘Hindu College’, ‘The Mutiny’, ‘The Government and the People’, ‘Memoir of Dwarakanath Tagore’ এবং ‘Orissa Past and Present’। 
তিনি কয়েকটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সেগুলি হচ্ছে: Hare Memorial Society, Bethune Society, Social Science Association এবং Hindu Theosophical Society। 
১৮৪৬ সালে কিশোরীচাঁদ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন। তখন ভারতীয়দের জন্য এ পদ ছিল খুবই মর্যাদাসম্পন্ন। এ পদে তিনি রামপুর-বোয়ালিয়ায় (বর্তমান রাজশাহী) আট বছর চাকরি করেন। তখন তিনি অনেক জনকল্যাণমূলক কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি জমিদার ও স্থানীয় জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে রাস্তাঘাট ও সেতু তৈরি করান, পুকুর খনন করান এবং দাতব্য চিকিৎসালয় ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করান।

১৮৫৪ সালে কিশোরীচাঁদ কলকাতার পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ পদে থাকাবস্থায় তাঁকে চাকরি হারাতে হয়। উপনিবেশিক বিচারব্যবস্থার দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করায় তিনি ইংরেজ কর্মকর্তাদের বিরাগভাজন হন। কোম্পানি সরকারের আইনে এ দেশীয় বিচারকদের ইউরোপীয়দের বিচার করার এখতিয়ার ছিল না। কিশোরীচাঁদ এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। রামপুর-বোয়ালিয়ায় চাকরি করার সময় তিনি ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় ‘Bengal Ryot’ শিরোনামে বেনামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন।



কিশোরীচাঁদ মিত্রের চরিত মন্মথনাথ ঘোষের প্রথম রচনা। রচনাটি কর্মবীর কিশোরীচাঁদ মিত্র শিরোনামে গ্রন্থাকারে ১৯২৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় সমগ্র রচনাটির ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সমগ্র রচনায় বিশিষ্ট এই গ্রন্থপ্রণেতা কর্মবীর কিশোরী চাঁদকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কর্মবীর কিশোরীচাঁদ মিত্র লেখকের কথায় ‘প্রস্তাবটির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হইবার পর কিশোরীচাঁদ মিত্রের ত্রিশ-চল্লিশটি বক্তৃতা এবং অন‌্যান‌্য উপকরণ সংগ্রহ করিয়াছি। সেগুলির যথাযোগ‌্য সদব‌্যবহার করতে পারি নাই’। লেখকের এই আক্ষেপের কথা মনে রেখেই পুনর্মুদ্রিত এই গ্রন্থে কিশোরীচাঁদ মিত্রের যেসব রচনা ও বক্তৃতার সন্ধান পাওয়া গেছে তাঁর তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে। আলালের ঘরে দুলাল রচয়িতা প‌্যারীচাঁদ মিত্রের অনুজ কিশোরীচাঁদ মিত্রের ইংরাজিতে লেখা ডায়েরি বা রোজনামচার আংশিক ব‌্যবহার গ্রন্থটিকে প্রাঞ্জল করেছে। কিশোরীচাঁদের সহধর্মিনী কৈলাসবাসিনীর আত্মকথা অত‌্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে বইটির সংযোজন অংশে ব‌্যবহৃত হয়েছে। দুঃষ্প্রাপ‌্য এই রচনার পুনর্মুদ্রণ ‘শুধু কিশোরীচাঁদের জীবনীর পরিপূরক নয়, উনিশ শতকে বাঙালি সমাজের অন্তঃপুরে অন্তরঙ্গ চিত্রহিসেবে আত্মকথাটি মূল‌্যবান। 
========={{={{{{{{{{{{{{====={{{{===={{{{{{{



Thursday, 4 August 2022

মহাপ্রয়াণ দিবস। মহারাজ নন্দকুমার। ব্রিটিশ আমলে তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ফাঁসির সাজা পান। Vol -818. Dt -05.08.2022. ১৯ শ্রাবণ,১৪২৯. শুক্রবার। The blogger in literature e-magazine


মহারাজ নন্দকুমার

বাংলার গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে ১৭৭৫ সালের ৫ই আগস্ট কলকাতায় বর্তমান বিদ্যাসাগর সেতুর নিকটে নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয়. 

ওয়ারেন হেস্টিংস সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ঘটনাচক্রে স্যার এলিজা ইম্পে ছিলেন তাঁর স্কুলের বন্ধু। তাই বহু ঐতিহাসিক এই মত পোষণ করেন যে, মহারাজ নন্দকুমারকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছিল।নন্দকুমারের ফাঁসিকে বহু ঐতিহাসিক ‘আইনি হত্যা’ বলে থাকেন। 

আকবরের সময় থেকে জমিদারি প্রথা চালু হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা তমলুকের জমিদারির মধ্যে থাকা তমলুক পরগনার অন্তর্গত ছিল বাসুদেবপুর এলাকা। প্রখ্যাত গবেষক যুধিষ্ঠির জানার (মালীবুড়ো) লেখা ‘বৃহত্তর তাম্রলিপ্তের ইতিহাস’ থেকে জানা যায়, ১৭৪০ সাল নাগাদ তমলুকের রাজা ছিলেন নরনারায়ণ রায়। নরনারায়ণের মৃত্যুর পরেই রাজপরিবারে গৃহবিবাদের জেরে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে কয়েক বছরের খাজনা বাকি পড়েছিল তাম্রলিপ্তের রাজার। সে সময় মুর্শিদাবাদের নবাব মসনদি মহম্মদ খান তাঁর প্রিয় বন্ধু খোজা দিদার আলি বেগকে ১৭৫৭ সালে তমলুকের জমিদারির দায়িত্বভার তুলে দেন। দিদার আলি বেগ তমলুকের জমিদারির ভার নেওয়ার ফলে তমলুকের রাজবংশ পদুমবসানের সাবেকি রাজবাড়ি ছেড়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে বহিচবেড়ের গড়ে আশ্রয় নেন।

দিদার আলি বেগ ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তমলুকের জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পরে মীর জাফর বাংলার নবাব হন। ১৭৬৫ সালে ইংরেজ কোম্পানী বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি ভার পায়। এ সময় বাংলার শাসন কর্তা হয়ে এসেছিলেন লর্ড ক্লাইভ। এদিকে তমলুক রাজ পরিবারের সেই দুঃসময়ে রাজা নরনারায়ণের মহিষী রানি সন্তোষীপ্রিয়া, রাজা কৃপানারায়ণ রায়ের মহিষী কৃষ্ণপ্রিয়া যুক্তভাবে তাঁদের জমিদারি ফিরে পাওয়ার জন্য কোম্পানীর কাছে আবেদন করেছিলেন। তাঁদের এই কাজে তত্ত্বাবধান করেছিলেন মহারাজ নন্দকুমার ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ।

মীর জাফরের আমলে মহারাজা নন্দকুমার মহিষাদল পরগনার দেওয়ান নিযুক্ত হয়েছিলেন। মীরজাফরের চেষ্টায় দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে নন্দকুমার ‘মহারাজা’ উপাধি পেয়েছিলেন। লর্ড ক্লাইভও নন্দকুমারকে সুনজরে দেখতেন। মহারাজা নন্দকুমার ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের প্রচেষ্টায় রাণী সন্তোষপ্রিয়া ও রাণী কৃষ্ণপ্রিয়া ফের তমলুকের জমিদারি ফিরে পেয়েছিলেন।


নন্দকুমার ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের এই উপকারের পুরস্কারস্বরূপ তমলুকের রানিরা মহারাজা নন্দকুমারকে ছয়খানি ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহকে আটটি গ্রাম উপহার দেন। মহারাজা নন্দকুমার পান তালুক বাসুদেবপুর। এই বাসুদেবপুর তালুকের মধ্যে মহারাজা নন্দকুমার দু’টি শিব মন্দির তৈরি করেছিলেন ও একটি হাট বসিয়েছিলেন। হাটের পাশে একটি জলাশয় খনন করিয়েছিলেন। নন্দকুমার হাটের পাশে সেই পুকুর আজও ‘দেওয়ান পুকুর’ নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে এলাকার বাসিন্দাদের উদ্যোগে সেই হাটের সংলগ্ন এলাকাতেই গড়ে উঠেছে বাসুদেবপুর মহারাজা নন্দকুমার প্রাথমিক ও হাইস্কুল।


মহারাজা নন্দকুমারের স্মৃতি বিজড়িত বাসুদেবপুর এলাকার হাটটি ক্রমশ ‘নন্দকুমারের হাট’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই নন্দকুমারের হাটকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে নন্দকুমার বাজার। নন্দকুমার ব্লক এলাকা নিয়ে গবেষণা করেছেন মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক সুস্নাত জানা। সুস্নাতবাবুর মতে, ‘‘প্রাচীন এই জনপদের মধ্যেই রয়েছে তমলুক রাজবংশের বহিচবেড়গড় আর দেবী বর্গেশ্বরীর মন্দির। বাসুদেবপুর গ্রামে রয়েছে মহিষদল রাজপরিবারের খনন করা কাছারিপুকুর ও জোড়া শিবমন্দির।’’


ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা আনার জন্য এই এলাকার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। এলাকার সন্তান বিপ্লবী সুশীল ধাড়া, বরদাকান্ত কুইতি প্রমুখ ছিলেন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অন্যতম অগ্রণী। ১৯১৫ সালে বিপ্লবী বাঘা যতীন নন্দকুমার এলাকার কুমরআড়া গ্রামে হেমদা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। নন্দকুমারের কল্যাণ চক হাইস্কুলের তিন ছাত্র ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহিদ হয়েছিলেন। বর্তমানে বাসুদেবপুর, খেজুরবেড়িয়া, প্রমহংসপুর, শ্রীধরপুর প্রভৃতি নন্দকুমার বাজার হিসেবে পরিচিত।


এখানে গড়ে উঠেছে নন্দকুমার থানা, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ২০০৩ সালে তমলুক-দিঘা রেলপথ চালুর সাথে চালু হয় নন্দকুমার রেল স্টেশন। ২০০৭ সালে নন্দকুমারে গড়ে উঠেছে মহারাজা নন্দকুমার মহাবিদ্যালয়। ব্লকের সদর নন্দকুমার বাজার এলাকাকে ঘিরে গড়ে ওঠা জনবসতি দ্রুত বাড়ছে। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তথা প্রাক্তন বিধায়ক ব্রহ্মময় নন্দের মতে, ‘‘পূর্বতন বাসুদেবপুর তালুকের এলাকাই বর্তমানে নন্দকুমার ব্লক এলাকা নামে পরিচিত। মহারাজা নন্দকুমারের স্মৃতি বিজড়িত মন্দির সহ নানা নিদর্শন এই অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। এইসব ঐতিহাসিক নিদর্শনের সংরক্ষণ খুবই জরুরি।’’

রাজস্ব আদায়ের দেওয়ান থেকে তিনি নিজ দক্ষতার গুণে হয়েছিলেন ‘মহারাজা’। আর ব্রিটিশদের হাতে ফাঁসির শাস্তি পাওয়া সেই মহারাজা নন্দকুমারের স্মৃতিই বয়ে চলেছে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার।

১৭০৫ সালে বর্তমান বীরভূম জেলার নলহাটি থানার ভদ্রপুর গ্রামে নন্দকুমার জন্মগ্রহণ করেন।

মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ১৭৬৪ সালে নন্দকুমারকে ‘মহারাজা’ উপাধি প্রদান করেছিলেন।

 তিনি রাধামোহন ঠাকুরের নিকট বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। 

তিনি অভিযোগ করেন যে, হেস্টিংস তাকে দশ লক্ষ টাকার এক-তৃতীয়াংশ ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন। তিনি এও দাবি করেন যে, হেস্টিংসের বিরুদ্ধে তার অভিযোগের প্রমাণস্বরূপ একটি চিঠি রয়েছে।


জেলা সদর তমলুক শহরের অদূরে এই এলাকার নন্দকুমার নামকরণের পিছনে লুকিয়ে আছে এক ইতিহাস। একদা বঙ্গোপসাগরের উপকূলে গড়ে ওঠা প্রাচীন তাম্রলিপ্ত বন্দরে ভিড়ত বাণিজ্যতরী। সে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। ধীরে ধীরে সমুদ্রের লোনা জলে প্লাবিত হয় গোটা এলাকা। তাম্রলিপ্তের পূর্ব দিকে রূপনারায়ণ আর পশ্চিমে কাঁসাই, হলদি নদীর মাঝের এই অঞ্চলে ক্রমশ জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। ইতিহাস গবেষকদের মতে, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবর দিল্লির সিংহাসনে বসে সমগ্র বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা দখল করে নিজের অধিকারে আনেন। আর সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সময় তমলুক পরাধীন হয়।


মহারাজ নন্দকুমার সমাজে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাই তার ফাঁসি স্থানীয় জনসাধারণের মনে আতঙ্কের সঞ্চার ঘটায়।এর ফলে বহু বাঙালি কলকাতা ছেড়ে বেনারসের মতো জায়গায় চলে যায়।[৩]


ঐতিহ্য

সম্পাদনা

তার জন্মস্থান বীরভূম জেলার ভদ্রপুর গ্রামে তার সম্মানে ভদ্রপুর মহারাজা নন্দকুমার হাই স্কুল স্থাপন করা হয়েছে।

ভদ্রপুর গ্রামের নিকটে অবস্থিত আকালি গ্রামে তিনি কালী মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এটি অত্যন্ত বিখ্যাত মন্দির এবং প্রতি বছর হাজার-হাজার দর্শনার্থী এখানে আসেন। এটি ব্রাহ্মণী নদীর তীরে অবস্থিত।

২০০৭ সালে পূর্ব মেদিনীপুরে তার সম্মানে মহারাজা নন্দকুমার মহাবিদ্যালয় নামে একটি কলেজ স্থাপন করা হয়েছে।

কলকাতার একটি রাস্তার নাম হল মহারাজা নন্দকুমার রোড।

পূর্ব মেদিনীপুরের একটি অঞ্চলের নামও হল নন্দকুমার।

রচনা কর্ম:

Sir James Stephen, The Story of Nuncomar (2 vols., 1885)

H Beveridge, The Trial of Nanda Kumar (Calcutta, 1886)






Wednesday, 3 August 2022

স্মরণীয় প্রয়াণ দিবস। সাহিত্যিক মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। Vol -816. Dt -04.08.22. ১৮ শ্রাবণ,১৪২৯. বৃহস্পতিবার। The blogger in literature e-magazine

 বন্দ্যোপাধ্যায় মানবেন্দ্র


করোনা সংক্রমণের কারণে তিনি ৪ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কলকাতায় মারা যান।

"সে কোন কালের ঘটনা। তখনও অবধি দৌড় সরলা এরেন্দিরা আর পেদ্রো পারামো অবধি। বইয়ের তাকে এমন ভাবে সাজিয়ে রাখি বই দুটো যাতে কেউ বাড়িতে এলেই দেখতে পায়। অনুবাদ যিনি করেছেন, তাঁর বিভাগে পড়তে এসে এক রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তে তাঁকে দেখে বুঝলাম মানববাবুকে কল্পনা করা আমার দুঃসাধ্য ছিল। নিপুণ ফ্রেঞ্চ কাট। বাদামি কর্ডুরয়ের ট্রাউজ়ারের ওপরে টকটকে চে গেভারা টি শার্ট। একটা লম্বা বিদেশি ছাতার বাঁকানো বাট ওঁর বাঁ কাঁধে আটকে ঝুলছে। হাতে চোস্ত চুরুট (কিউবার, নিশ্চিত)। গালে মাছিটি বসলে পিছলে যায়। কসমোপলিটানিজ়মের হদ্দমুদ্দ কেতায় থ খেয়ে গেলুম।

তার পর বিভাগের লাইব্রেরিতে দেখি তাকের পর তাক। উনি। লাতিন আমেরিকার কবিদের, সাহিত্যিকদের অনুবাদ। গিফটের আলমারি বলে যে আলমারিটি, তাতে ওঁর বিভাগকে উপহার দেওয়া অগুনতি বই। প্রথম পাতায় কেনার স্থান। ভ্যাঙ্কুভার, মাদ্রিদ, প্রাহা। নীচে দস্তখত: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি বাঙালি পাঠককে ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’ নামক হাত আয়নার ভিতরে একটার পর একটা দরজা খুলে নিয়ে যান সাহিত্যের এমন এক ‘জ্বলন্ত প্রান্তর’-এর দিকে, সেখানে উন্মোচিত হতে থাকে একটার পর একটা দেশ, মহাদেশ। বিপুল সাহিত্যবিশ্বের বহুত্বের মধ্যে আমাদের দিশেহারা হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না। আমরা ভেবে কূল পেলাম না, কী পরিমাণ মেধা থাকলে ও প্রাণিত হলে কারও পক্ষে এতগুলি দেশের ও মহাদেশের এত অগুনতি লেখকের ঠিকুজি কুলুজি জানা সম্ভব? অনুবাদ করার জন্য তাঁদের লিখনের ও রাজনীতির আঁতের ব্যাপার আত্মস্থ করা সম্ভব?" (ঈপ্সিতা হালদার)

তিনি খগেন্দ্র মিত্র স্মৃতিপুরস্কার পান ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে বিদ্যাসাগর পুরস্কারে ভূষিত করে। অনুবাদে তার কৃতিত্বের জন্য মূলত পাবলো নেরুদা, লাতিন আমেরিকার উপন্যাস সমূহ, হুয়ান রুলফোর কথাসমগ্র, শার্ল পেরোর রূপকথা, মিরোস্লাভ হলুবেরের কবিতা, নিকানোর পাররার কবিতা, পিটার বিকসেল, একাধিক স্প্যানিশ গল্প ইত্যাদি অনুবাদের জন্য ভারতীয় সাহিত্য একাদেমি তাঁকে অনুবাদ পুরস্কার-এ ভূষিত করেছিল।

গ্রন্থসমূহ

ভেদ বিভেদ (১ম ও ২য়)
দেশে ফেরার খাতা
লাতিন আমেরিকার উপন্যাস সংগ্রহ
লাতিন আমেরিকার গল্প সংগ্রহ
মুখোশ ও মৃগয়া
বাংলার ছয় মণীষী
মিরোস্লাভ হোলুভের শ্রেষ্ঠ কবিতা 
খেলা অমনিবাস (১ম ও ২য় খন্ড)
খেলা সমাচার
আষাঢ়ে বই
এই শহরে চোর নেই
চারজনের চিহ্ন
ঘণ্টা বাজে দূরে
আত্মহত্যার অধিকার ও অন্যান্য
নিকানোর পাররার শ্রেষ্ঠ কবিতা ও প্রতিকবিতা
চেশোয়াভ মিউশ শ্রেষ্ঠ কবিতা
বাস্তবের কুহক ও কুহকের বাস্তব
গণ্ডি
কাঁচের ঘর
মৌচাক ঢিল
চন্দ্রাহত
হরবোলা
সোনার দুয়ার
রহস্যময় রোমাঞ্চকর
যে পুতুল পালিয়ে গেল
বিঙ্গো ও আকাট
আন্ডারসেনের গল্প
এক যে আছে মায়াপুরে
চোরকাঁটা
আত্মাহত্যার অধিকার এবং অন্যান্য সনদ
জুল ভের্ন অমনিবাস (৪ খণ্ড)
ল্যাম্পপোস্টের বেলুন
আলিবাবার গুহা


কুড়িয়ে ছড়িয়ে দেশ-বিদেশের লোককথা
কবিতা যারা পড়ে না তাদের জন্য কবিতা
স্রষ্টা যখন সর্বপ্রথম বানিয়েছিলেন প্রাণী
ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটে জয়ের প্রস্তুতি পর্ব.....

            জন্ম ১৯৩৮ সালে ২৫ এপ্রিল 
অধুনা বাংলাদেশের সিলেটে। তুলনামূলক সাহিত্য, ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব, ললিতকলার ইতিহাস নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয় ও পোল্যান্ডের ভাসভি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি প্রথম অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন মায়ানমারের রেঙ্গুনে। পরে পড়াতে আসেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে।


কবিতা, শিশুসাহিত্য, উপন্যাস,ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস প্রভৃতি বহুক্ষেত্রেই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের ইতিহাসে তার অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায় একক প্রচেষ্টায় দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব ইউরোপের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলি বাংলায় অনুবাদ করেছেন।  তিনি ১৯৭০ সালে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না, সরলা এরেন্দিরা অনুবাদ করেন। লাতিন আমেরিকার কবিতা ও ছোটগল্প এবং রুশ সাহিত্য অনুবাদ করেছেন তিনি। মৌলিক রচনার পাশাপাশি এডগার অ্যালেন পো, আর্থার কন্যান ডয়েল, জুল ভের্ন অনুবাদ করে বাংলা শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখেন তিনি।
 এ ছাড়া মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদনার কাজও করেছেন। তার সম্পাদিত 'হরবোলা' ও 'জিয়নকাঠি' প্রভৃতি ছোটদের গল্প সংকলন ছাড়াও দেশবিদেশের শিশুসাহিত্য নামক গ্রন্থমালায় তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের শিশুসাহিত্যকে বাংলায় উপস্থিত করেছেন। 

বিশ্বসাহিত্যের হদিশ পেতে বাঙালিকে আর ইংরেজির দ্বারস্থ হয়ে থাকতে হয়নি, মানববাবুর অসীম কর্মক্ষমতায় বাংলা ভাষাতেই সেই চর্চা সম্পন্ন করা গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই অনুবাদের মধ্য দিয়ে তিনি তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য বলে একটা রাজনৈতিক মেল সন্ধান করার পথ দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন, কী ভাবে লাতিন আমেরিকার বা আফ্রিকার নানা দেশের লেখক ও কবিরা লিখেছেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্যে, মিলিটারি শাসনে, সেন্সরশিপের নিগড়ের মধ্যে, নির্বাসনে বসে। কী পরিমাণ অধ্যবসায় ও মনন থাকলে এ হেন সৃষ্টিশীলতা সম্ভব, এই ভেবে চমকে ওঠা যায় বার বার। মাঝে মাঝে কেউ কেউ আসেন, অনায়াস মেধায় গড়ে দিয়ে যান সম্ভার, যাতে কয়েক প্রজন্ম পাঠক ও গবেষক রসদ পেয়ে যান।
মানববাবু শুধু অনুবাদক ছিলেন না। তাঁর অনুবাদে নিহিত ছিল সুতীব্র সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বীক্ষা, অনূদিত সাহিত্য ও অনূদিত লেখক-কবিকে তার সামাজিক পটভূমি-সহ পেশ করার অ্যাকাডেমিক গভীরতা, অজানা লেখার কৃৎকৌশলকে পেশ করার বিশ্লেষণী ধরতাই। মানববাবু বাঙালি পাঠকের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন, তাঁর অনাবিল, স্বাদু, মেধাবী, শ্লেষাত্মক ও মমত্বসম্পন্ন এক নতুন বাংলা ভাষা, যে ভাষা তাঁর অনুবাদের। লেখক থেকে লেখকে বদলে যাওয়া কাহিনি ফাঁদার কৃৎকৌশল তিনি ধরে ফেলছেন অবলীলায়। আবার যার মধ্য দিয়ে এক উপনিবেশিত দেশের মানুষ আমরা, লাতিন আমেরিকা আর আফ্রিকার উপনিবেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি, যাতে তৈরি হয় এক তুলনামূলকতার বোধ, জীবনে ও সাহিত্যে। মার্কেস তাঁর নোবেল পুরস্কার ভাষণে লাতিন আমেরিকার নিঃসঙ্গতার কথা বলেছিলেন, যা মানববাবুই অনুবাদ করেন বাংলায়। মানববাবু বিশ্বাসই করাতে চেয়েছিলেন যে, সাহিত্যে সাহিত্যে যোগ ছাড়া এই নিঃসঙ্গতা কাটানো সম্ভব নয়।

একই দর্শনে বাঙালি পাঠকের হাতে এসেছে, পাঁচ খণ্ড অনুবাদ, আধুনিক ভারতীয় গল্প এই শিরোনামে, মানববাবুর সম্পাদনায়। তাতে আত্মতৃপ্ত বাঙালির ভাষা সাহিত্যের কূপমণ্ডূকতা তছনছ করে নানান ভারতীয় ভাষায় নানা মহান লেখকের তাক লাগানো সব ছোট গল্পই শুধু এসে পৌঁছয়নি, এ বিষয়ে মনন চর্চার হদিশ তিনি রেখে গিয়েছেন প্রতিটি খণ্ডে। সেই দিক থেকে দেখলে এই খণ্ডগুলি ভারতীয় তুলনামূলক সাহিত্যের দিকে যাওয়ার একটি ধাপ তো বটেই। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকেই আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য মানববাবুর বিশেষ উৎসাহে তুলনামূলক সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। যার ফলে তামিল, তেলুগু, মালয়ালম, কন্নড়, গুজরাতি, অহমিয়া ইত্যাদি সাহিত্যের সমাহার হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় সাহিত্য। ভারত বলতে তখন ভাষার সঙ্গে ভাষার যোগ, কথোপকথন। একক ভাষার সাহিত্য বলে বিচ্ছিন্ন কোনও অভিব্যক্তিকে পড়ার আর উপায় থাকে না। কোনও গোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন ও পৃথক করে দেখার উপায় থাকে না।

===={={{{}}}}}}}={}}{={}[}°^^=^৳√π°^°=°====

Tuesday, 2 August 2022

বিশেষ প্রতিবেদন। বাউলের ব্যাকুলতায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাগ - রাগিনী। Vol -816. Dt -03.08.2022. ১৭ শ্রাবণ,১৪২৯. বুধবার। The blogger in literature


বাউলের ব্যাকুলতায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাগ - রাগিনী 

               রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋতু সৌন্দর্যের কবি। তাঁর ঋতু-সাহিত্যে যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তা শুধু আকাশে-বাতাসে, মেঘে-বর্ষণে, ফুলে-পল্লবেই প্রকাশ পায় এমন নয়, সে বৈচিত্র্য মানুষের শৈশব-কৈশোর, যৌবন-বার্ধক্যেও সমান। ঋতুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একদিকে দেখেছেন তার কঠোর রূপ, অন্যদিকে দেখেছেন রস-কোমলতা, সৃষ্টির স্নিগ্ধতা। দারুণ গ্রীষ্মে একদিকে যেমন ‘প্রখর তপন তাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে, বায়ু করে হাহাকার’, তার পরেই সেখানে আসে চাঁপাফুলের ছোঁয়া, বকুলমালার গন্ধ। বৈশাখের রুদ্রতা ও কোমলতা দিয়ে তিনি কামনা করেছেন সমস্ত গ্লানি দূর করে পবিত্র ও নির্মল এক পৃথিবীর।রবীন্দ্র-পূর্ব বাংলায় ষড়ঋতুর ব্যবহারিক দিকটাই তত্কালীন কবিদের কাব্যে প্রাধান্য পেয়েছিল, আলাদাভাবে ঋতুবৈচিত্র্য বর্ণনার প্রয়াস তেমন একটা দেখা যায়নি। রবীন্দ্রনাথ সেই বাঁধা পথে না গিয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতির স্পর্শ নিয়ে এসেছেন। ফলে প্রকৃতিগাথা হয়ে উঠেছে জীবন্ত। রবীন্দ্রনাথের গানে প্রতিটি ঋতু যেন তাদের নিজ নিজ চিত্র, ধ্বনি, বর্ণ ও গন্ধ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এ গানগুলো যেন বাংলার প্রকৃতির চিরকালের মর্মবাণী। তাঁর অন্যান্য গানের মতো প্রকৃতির গানেও তিনি বিশ্ববোধ ছড়িয়ে দিয়েছেন। ‘কুসুমে কুসুমে’ তিনি তাঁর অন্তরাত্মার ‘চরণচিহ্ন’ দেখেছেন, তাঁর আগমনে পৃথিবীর বুকে ‘আকুলতা ও চঞ্চলতা’ অনুভব করেছেন। ‘আকাশভরা সূর্য তারা’ এবং ‘বিশ্বভরা প্রাণের’ মাঝখানে ‘বিস্ময়ে’ নিজেকে আবিষ্কার করেছেন।প্রতিটি ঋতু একেকটি দার্শনিক তাত্পর্য নিয়ে রবীন্দ্রসংগীতে উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রীষ্মের গানে দারুণ দাহনবেলার রসহীনতার চিত্র যেমন আঁকা হয়েছে, বৈশাখী ঝড়কে তেমনি জীর্ণতার অবসানে নতুনের আগমনের পূর্ব সংকেতরূপে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রভাবনায় বৈশাখী ঝড় কেবল বাইরের প্রকৃতিতেই আসে না, হৃদয়ের ভেতরেও সে ঝড় তোলে। গ্রীষ্মের মধ্যে তিনি একদিকে দেখেছেন এর কঠোর রূপ, বৈরাগীর বেশ, অন্যদিকে তার রস-কোমলতা ও সৃষ্টির স্নিগ্ধতায়ও মুগ্ধ হয়েছেন।গীতবিতানে গ্রীষ্মের গান ১৬টি, যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৬০ থেকে ৭২ বছর বয়সের মধ্যে রচনা করেছেন। গীতবিতানে দেওয়া ক্রমানুসারে—

১. নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা; 

২. দারুণ অগ্নিবাণে রে; 

৩. এসো এসো হে তৃষ্ণার জল; 

৪. হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে; 

৫. এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ; 

৬. নমো নমো হে বৈরাগী; 

৭. মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি; 

৮. ওই বুঝি কালবৈশাখী; 

৯. প্রখর তপন তাপে; 

১০. বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া; 

১১. বৈশাখ হে মৌনী তাপস; 

১২. শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙবে ব’লে; 

১৩. হে তাপস, তার শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে; ১৪. মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে; 

১৫. তপস্বিনী হে ধরণী; 

১৬. চক্ষে আমার তৃষ্ণা। 

তাঁর প্রথম গ্রীষ্মের গান ৬০ বছর বয়সে রচিত ‘দারুণ অগ্নিবাণে রে’ এবং শেষ গান ৭২ বছর বয়সে রচিত ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা’। এ ছাড়া অন্যান্য পর্যায়ের বেশ কিছু গানেও গ্রীষ্মের আবহ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব সংগীত সৃষ্টিকে প্রেম, প্রকৃতি, পূজা প্রভৃতি পর্যায়ে ভাগ করলেও প্রায় সব গানকেই আত্মনিবেদনের গান বললে অত্যুক্তি হয় না। জীবনের যত দিক আছে, যত রকম অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা, রবীন্দ্রনাথের গানে তার প্রায় প্রতিটির প্রতিফলন রয়েছে। তাই আমাদের মন সব অবস্থায় আশ্রয় পায় তাঁর গানে। জীবনকে গানের মধ্য দিয়ে এমন করে উপলব্ধি করার অভিজ্ঞতা সম্ভবত আর কোনো রচয়িতার গানে অনুভব করা যায় না।।

রবীন্দ্রনাথের গানে দেশি আদর্শের সুস্পষ্ট ছাপ। তাঁর শিল্পীসত্ত্বা ও ব্যক্তিত্ব প্রায় অভিন্ন। জীবনের এক তীব্র মুহূর্তে হঠাৎ পেয়ে গেলেন আনুষ্ঠানিক সম্প্রদায়গত ধর্মাচরণের বাইরে এক সরল উদার আন্তরিকতার ধর্ম যা আত্মভোলা গানের সুরে নিজেকে অনায়াসে প্রকাশ করে। একে তিনি গ্রহণ করে আত্মস্থ করেছেন দীর্ঘ বছর দশেক কাল ধরে। তারপর হঠাৎ দেশব্যাপী প্রাণোচ্ছ্বাসের সঙ্গে একাত্মতাবোধের ঐকান্তিকতায় বাউল সুরাশ্রিত স্বদেশি গানের প্লাবনোচ্ছ্বাস। রবীন্দ্রনাথ যাকে তাঁর সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য বলে গ্রহণ করেছিলেন তার ধারা প্রধানত দুটি মার্গ বা ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীত এবং দেশ বা লোকসঙ্গীত। লোকসঙ্গীত সহজ ও সাবলীল। গানের ভাব প্রকাশিত হয় কথায়। সুর ও ছন্দ তাকে প্রাণবান করে তোলে। তাল সাধারণত সহজম সুর তিন থেকে সাতটি পর্দায় বিন্যস্ত। এর গায়কেরা পুঁথিগত বা সাঙ্গীতিক বিদ্যায় রীতিমত শিক্ষিত না-ও হতে পারেন। সাধারণত এঁরা যাকে বলে ‘গাইতে গাইতে গাইয়ে’।

বাউল সম্প্রদায়ের গান এক ধরনের আবেগময় একটানা সুর, মাঝে মাঝে বেশ ছন্দোবহুল সঙ্গে নৃত্যের আবেগ। বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলেছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, সুফি ধর্ম। বৈষ্ণব সহজিয়া ধর্মের সঙ্গে মূল সাধনাঙ্গ এক হওয়ায় সহজিয়া মুসলমান ফকিরদের মিলনে ১৬২৫ খ্রীষ্টাব্দে তক বাউলধর্মের উদ্ভব। মুসলমান ফকিরাই বাউল সাধনার আদি প্রবর্তক বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে বাউলসাধনা শিষ্টজন নিন্দিত ও ধর্মের নামে ইন্দ্রিয়সেবা মাত্র। কিন্তু উভয় বাংলায় বাউল গান ধর্মসঙ্গীত হিবাসেই পরিচিত। এই গানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। বিশিষ্ট বাউল কবি বা গীতিকারা হলেন লালন ফকির, মদন, পাগলা কানাই, ঈশান, গঙ্গারাম, দীনু, পাঞ্জু শাহ, যাদুবিন্দু। হাউড়ে বাউল, গগন, চণ্ডী বাউল, ফটিক, গোঁসাইচাঁদ, এরফান আলি, বাখের শাহ।

রবিঠাকুর মনে করতেন লোকসঙ্গীতের চেয়ে বাউল গান অনেক ছন্দবহুল। এর সুরের পার্থক্য দেখাযায় প্রথম কলির সঙ্গে দ্বিতীয় কলির। কীর্তন ও বাউলের সুর বৈঠকি গানের একেবারে গা ঘেঁষে গিয়েও তাকে স্পর্শ করে না। ওস্তাদের আইন অনুসারে এটা অপরাধ, কিন্তু বাউলের সুর যে একঘরে। রাগরাগিণী যতই চোখ রাঙাক, সে কীসের কেয়ার করে!


রবীন্দ্রনাথের গান প্রথম থেকেই কিছুটা কাব্যপ্রভাবিত এবং ওস্তাদিগানের তানকর্তব বা লয়বৈচিত্র্য তিনি প্রায় সজ্ঞানে পরিহার করেছেন। অর্থাৎ তাঁর গান প্রথম থেকেই অনেকটা দেশি আদর্শ অনুসারী। বাউল গান সম্পর্কে লিখিতভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রথম আগ্রহের প্রকাশ দেখি ১২৯০ সালে(১৮৮৩-৮৪ খ্রিষ্টাব্দে) ভারতী পত্রিকায় যখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। বাউল গানের একটি সংগ্রহ পুস্তক সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি দেশবাসীর দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করেন। তার আহ্বানে ভারতীতে কিছু গান ছাপাও হয়। কিন্তু তা শুধুই কথা, সুর ছাড়া। সাতাশ বছর বয়সের মধ্যে তার প্রায় ৪০০ গান রচনা হয়ে গেছে। এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি দেশি সুরে অর্থাৎ কীর্তনের ও রামপ্রসাদী সুরে, যা তৎকালে কলকাতা অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে প্রচলিত বাউল সুর একটিও নেই। তারপর ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত দেশি সুরে যে সমস্ত গান রচিত হল তার মধ্যেও দেখি প্রধানত কীর্তন, রামপ্রসাদী ও বাংলাদেশে প্রচলিত বিভাস বা যোগীয়া বিভাস। বাউল সুর মাত্র দুটি গানে – ১) “তোমরা সবাই ভালো”,

 এবং

 ২) “খেপা, তুই আছিস আপন খেয়াল ধরে”। 

অন্য একটি সাক্ষ্য অনুসারে তাঁর প্রথম বাউল সুরের রচনা ‘বিসর্জন’ নাটকের (রচনা- পৌষ, ১২৯৬ সাল) “আমারে কে নিবি ভাই”।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, এই সময় আকস্মিক বন্যার ন্যায় কয়েকদিনের জন্য কূল ছাপাইয়া গীতধারা উৎসারিত হইল এবং স্বদেশি যুগের এই গানগুলি অধিকাংশই হইতেছে বাউল সুরে বাঁধা। সাতাশ বছর বয়স পর্যন্ত কোনও বাউল সুরের গান নেই, তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত মাত্র খান দুয়েক গান রচনা, তারপর বঙ্গভঙ্গের সময় বয়স যখন চুয়াল্লিশ বছর হঠাৎ অকস্মাৎ বন্যা - রহস্যটা কী? আমাদের ধারণা, ব্যাপারটা দেখতে যতোই আকস্মিক হোক, এর পিছনে অনেকগুলি ঘটনা ক্রিয়াশীল যার কিছুটা বিশ্লেষণ ছাড়া রহস্যের ব্যাখা অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের অন্তজীবন ও বহির্জগতের ঘটনা এবং তার প্রতিক্রিয়া সব কিছুই এর সঙ্গে জড়িত।

স্বদেশের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা সদাজাগ্রত ঔৎসুক্য থেকেই প্রথম যৌবনে বাউল গান বিষয়ে আগ্রহ- একথা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতামালায় ‘Religion of Man’ এর একটি স্থানে তাঁর অতীত অভিজ্ঞতায় বাউল সম্প্রদায় ও গান সম্পর্কে যে উল্লেখ পাচ্ছি, অত্যাশ্চর্য স্বীকারোক্তি হিসেবে এবং আমাদের প্রসঙ্গের দিক থেকেও তা অত্যন্ত মূল্যবান। তিনি বলছেন, পিতা কর্তৃক ব্রহ্মসমাজের সম্পাদক পদে নিযুক্ত হয়ে প্রধানত গান রচনা দ্বারা তিনি সমাজের উপাসনা পরিচালনা করছিলেন কিন্তু তৃপ্ত হচ্ছিলেন না । 

          After a long struggle with the feeling that I was using a mask to hide the living face of truth, I gave up my connection with our church. About this time one day I chanced to hear a song from a beggar belonging to the Baul sect of Bengal… it was alive with an emotional sincerity… Since then I have often tried to meet these people and sought to understand them through their songs’.


                বাউল সুরের গান “তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে”, “যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক”, “নিশিদিন ভরসা রাখিস”। বাউল সুরের গানগুলিতে প্রধানত পূর্ববঙ্গের বাউলদের প্রভাব স্পষ্ট। সাধারণ লোকসংগীতের মতো তিন চার বা পাঁচ সুরের গান এগুলি নয়। এতে পুরো সাতটি সুরই খেলা করছে এবং মধ্যে কোমল সুরেরো ব্যবহার দেখা যায়। স্বদেশি আন্দোলনের প্রেরণাতেই গানের সুরে বাউলের ব্যপক প্রয়োগ। কিন্তু সুরে বাউল হলেও কথায় আছে জাতীয় উদ্দীপনার বাণী, যা বাউল আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। কেবল মিলটুকু আছে সহজ সরল আন্তরিকতায়। তেমনি বাউল সুরের প্রয়োগ হচ্ছে একান্ত মানবিক প্রেমের গানে, ঋতুসঙ্গীতে, এমনকি গীতিনাট্যেরও গানে। আবার খাঁটি বাউল তত্ত্বাদর্শে রচিত গানও আছে। যেমন- “আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে”, “আমি তারেই খুঁজে বেড়াই”, “আমি কান পেতে রই”। এমনকি, আছে দেহতত্ত্ব-ভাবানুসারী গান। যথা- “নিত্য তোমার যে-ফুল ফোটে ফুল বনে”। বাউল গানের আর একটা বিষয়গত বৈশিষ্ট্য হল ‘মনের মানুষ’, যাকে  ‘মনোবেড়ি’ দিয়ে বাঁধতে হয়, যথা ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’ অথবা ‘আমি কোথায় পাবো তার আমার মনের মানুষ যে রে।” রবীন্দ্রনাথের গানেও আছে- “আমার মন যখন জাগিল নারে, তোর মনের মানুষ এলো দ্বারে”। বাউলের ভাষায় দেখি- “তাই তুমিও বাঁধা, আমিও বাঁধা মুক্তি কোথায় পাই।” আড় রবীন্দ্রনাথে কবিতায় – “মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি? মুক্তি কোথায় আছে? আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন পরে বাধা সবার কাছে।“ ভষায় বক্তব্য অসামান্য মিল। আর একটি বিখ্যাত বাউল গানে পাচ্ছি কবির যিনি পরমগুরু তিনি “যুগযুগান্তে ফুটায় মুকুল তাড়াহুড়া নাই।” এযেন রবীন্দ্রনাথেরই কথা , তাঁরই প্রতিধ্বনি। কবি নিজেকে বলতেন ‘কবি-বাউল’। তাঁর নানা নাটকে বাউল বারবার অবতীর্ণ নিজেই বাউলের অভিনয় করতে ভালো বাসতেন। বিভিন্ন প্রবন্ধে বাউলের অসংখ্য উল্লেখেও দেখি ঐ প্রভাবের উজ্জ্বল স্বাক্ষর।


রবীন্দ্রনাথের হাতে বাউল গানের ঢং অপেক্ষাকৃত বিচিত্র হয়ে উঠেছে। অস্থায়ী ও অন্তরা এবং তার পুনরাবৃত্তির বদলে মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছে বাউল সুরে ধ্রুপদী আদর্শ অনুযায়ী চার ‘তুক’ বা অংশ বিভক্ত গান। অনেক বিশেষজ্ঞই স্বীকার করেছেন – রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চারী’ এক অতুলনীয় সৃষ্টি। বাউলসুর-প্রধান গানের সঞ্চারীতে তিনি প্রাচীন রাগ-রাগিণী বা কীর্তনের সাহায্য নিয়েছেন। উদাহরস্বরূপ,

 “বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা’ গানটির সঞ্চারীতে পাওয়া যাচ্ছে

 ‘দেশ’ রাগের রূপ। বিপরীত দৃষ্টান্তে-

 “তুমি একলা ঘরে বসে বসে কী সুর বাজালে।”

          গানটির কাঠামো মোটামুটি ‘কেদার রাগে। কিন্তু এর দ্বিতীয় পদে ‘বাউলের সুর লেগেছে, এনে দিয়েছে উদাস ভাবের করুণ বিহ্বলতা’। “রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার যাবার আগে” গানটি বাউল সুরের একটি বিশিষ্ট গান। এর মধ্যে লক্ষ্য করা যাবে- বাউলের সঙ্গে পিলু রাগিণী মিশ্রিত, আরম্ভে বাউল, গানের সুনির্দিষ্ট ভাগ নেই, সুরযোজনাও বাঁধাধরা নিয়মে হয়নি। কথা অনুযায়ী সুরের সন্নিবেশ প্রথম অংশ সুর বেদনা প্রকাশের অনুকূল, পরবর্তী অংশে উন্মাদনার ভা পরিস্ফুট। বাউলের মধ্যে ঝুমুরের প্রভাব- “ওরে বকুল পারুল।”

আর একটি গান “আমি কান পেতে রই” বাউল তত্ত্বাদর্শে রচিত। ভাষা ও সুরের অত্যাশ্চর্য সম্মিলন। সুরের দিক থেকেও বাউল ও সারির মিশ্রণ। 

রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতই প্রথম দিকে বলেছেন যে তাঁর গান অবিকৃত ভাবে গাইতে হবে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমারকে তাঁর গানে variation করার অনুমতি না দিয়ে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘হিন্দুস্থানী সঙ্গীতকার, তাঁদের সুরের মধ্যকার ফাঁক গায়ক ভরিয়ে দেবে এটা যে চেয়েছিলেন।তাই কোনো দরবারী কানাড়া্র খেয়াল সাদামাটা ভাবে গেয়ে গেলে সেটা নেড়া-নেড়া না শুনিয়েই পারে না।কারণ দরবারী কানাড়া তানালাপের সঙ্গেই গেয়, সাদামাটা ভাবে নয়। আমার গানেতো আমি সেরকম ফাঁক রাখিনি যে সেটা অপরে ভরিয়ে দেওয়াতে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠব।’ (‘সঙ্গীতচিন্তা’) অর্থাৎ এখানে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে নিজের গানের তফাৎ নির্দেশ করেছেন। হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে স্বাধীনতা সঙ্গীতকার নিজেই দিয়ে রাখেন শিল্পী কে, যেহেতু তাঁর সৃস্টি একটি বিশেষ সুরসমষ্ঠির উপর ভিত্তি করে রচিত গান এবং যা দাঁড়িয়ে থাকে গায়ক বা গায়িকা কেমন করে সেই বিশেষ সুরের ধরনটিকে ফুটিয়ে তুলছেন তার ওপর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দাবি ছিল যে তাঁর গানের প্রত্যেকটির নিজস্ব ও সম্পূর্ণ রূপ আছে। অন্যদিকে তিনি তাঁর ‘সঙ্গীতের মুক্তি’ প্রবন্ধে লিখছেন ‘এইখানে য়ুরোপের সঙ্গীত-পলিটিক্সের সঙ্গে আমাদের সঙ্গীত-পলিটিক্সের তফাত। সেখানে ওস্তাদকে অনেক বেশি বাঁধাবাঁধির মধ্যে থাকিতে হয়। গানের কর্তা নিজের হাতে সীমানা পাকা করিয়া দেন, ওস্তাদ সেটা সম্পূর্ণ বজায় রাখেন। তাঁকে যে নিতান্ত আড়ষ্ট হইয়া থাকিতে হইবে তাও নয়, আবার খুব যে দাপাদাপি করিবেন সে রাস্তাও বন্ধ। য়ুরোপে প্রত্যেক গান একটি বিশেষ ব্যক্তি, সে আপনার মধ্যে প্রধানত আত্মমর্যাদাই প্রকাশ করে। ভারতে প্রত্যেক গান একটি বিশেষ-জাতীয়, সে আপনার মধ্যে প্রধানত জাতিমর্যাদাই প্রকাশ করে।’ এই দুটি লেখা পাশাপাশি রেখে পড়লে তো মনে হয় গানের রূপায়ণের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ হয়ত য়ুরোপীয় রীতিকেই আদর্শ মানতে চেয়ে ছিলেন। প্রত্যেকটি গানের যে নিজস্ব একটি রূপ আছে, যা তাকে অন্য একটি গানের থেকে আলাদা করে এবং যা একটি composition হিসেবে স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং যা কোন বিশেষ গোষ্ঠির সুরসমষ্টির মধ্যে পড়ে না। কিন্তু প্রত্যেক গানের অবিকৃত রূপের খোঁজ আমারা পাব কি করে? সহজ উত্তরটা হল স্বরলিপি দেখে। সেইটেই য়ুরোপীয় পদ্ধতি। কিন্তু রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সেখানে গন্ডগোল আছে। তার অনেকগুলি কারণ।

প্রথমতঃ একাধিক রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটির বেশি স্বরলিপি চালু আছে। ধরুন ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানটি। এই গানটি একটি জনপ্রিয় গান। কিন্তু এর তিনটি স্বরলিপি বাজারে পাওয়া যায়। একটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের করা, একটি সরলা দেবীর(রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি) করা এবং তৃতীয়টি দিনু ঠাকুরের করা। তিনটি স্বরলিপিতে সামান্য হলেও বিভেদ আছে। অতএব অবিকৃত একক রূপের নির্ধারণ করা এক্ষেত্রে সম্ভব নয়। সেইরকম আবার ‘তবু মনে রেখ’ গানটির ও চারটি স্বরলিপির খোঁজ মেলে। সেগুলি প্রায় এক হলেও হুবহু এক নয়। এবার ধরুন ‘এ পরবাসে রবে কে’ গানটি। এটির অনেকগুলি রেকর্ড বাজারে পাওয়া যায়। তার মধ্যে যদি কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের রেকর্ডটি শোনেন এবং অমিয়া ঠাকুরের গাওয়া গানটি (এটি সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির জন্য রেকর্ড করান) শোনেন, তা হলে দেখবেন, ‘কে রবে সংশয়ে’ এই অংশে, কণিকা ‘-শয়ে’-তে মধ্যম থেকে কোমল নিখাদ( ম-ণ) অবধি একটি মীড় টেনেছেন, স্বরলিপিতেও তাই আছে, কিন্তু অমিয়া ঠাকুর তা করেন নি। দুজনেই তো সমান মান্য। একজন শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনে শৈলজারঞ্জনের শিষ্যা, আর অন্যজন ঠাকুরবাড়ির বউ, এবং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর গান ভীষণ ভালোবাসতেন ও তাঁকে নিজে শিখিয়েছেন! এবারে দেখা যাক রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যান্য প্রিয় গায়ক-গায়িকারা কেমন করে গেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের লেখা গান, ‘স্বপন যদি ভাঙ্গিলে’ ( রামকেলী রাগে নিবদ্ধ), এই গানটি বিষ্ণুপুর ঘরানার বিখ্যাত গায়ক রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী গেয়েছেন শুদ্ধ আকারে বিস্তার করে এবং তান করে, তবে রামকেলি রাগের রূপ অবিকৃত রেখে। সে গান রেকর্ডের অনুমতি তো রবি ঠাকুরই দিয়েছেন। এবং পরবর্তী কালে সেই গান শুনেই ওস্তাদ ভি ভি ঝলওয়ার গানটির স্বরলিপি করেছেন। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে, গান গাওয়া আগে, পরে স্বরলিপি এসেছে । কিন্তু, সেই বিস্তারের তো স্বরলিপি নেই! গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের গাওয়া, নটমল্লার রাগে ‘মোরে বারে বারে ফিরালে’ গানটিতেও, স্বাধীন সুরবিহারের নজীর মিলবে। তেমনি আবার ‘বুঝি ঐ সুদুরে’ গানটির কোন স্বরলিপি প্রথমে ছিল না। রবীন্দ্রনাথ একবার বসন্ত উৎসবের জন্য গানটি লেখেন (সাহানা দেবীর কাছে একটি হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় গান শুনে) এবং সাহানা দেবীকে শেখান। এই গানটি পরে সাহানা দেবী রবীন্দ্রভারতীর জন্য রেকর্ড করে দেন, যা থেকে স্বরলিপি করা হয়। অর্থাৎ এখানেও আগে গাওয়া গানটি ও পরে তার স্বরলিপি। এদের সবাইকে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত পছন্দ করতেন এবং উচ্চশ্রেণীর সঙ্গীতশিল্পী বলে মনে করতেন। এইসব ক্ষেত্রে কিন্তু গানের রূপটি পুরোপুরি গায়ক বা গায়িকা নির্ভর হয়ে রইল । এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেই দিলীপকুমারের সঙ্গেই আলোচনায় পরের দিকে বলছেন, ‘আমিতো একথা বলি নি যে, কোনো বাংলা গানেই তান দেওয়া চলে না। অনেক বাংলা গান আছে যা হিন্দুস্থানী কায়দাতেই তৈরী, তানের অলংকারের জন্য তার দাবি আছে। আমি এ রকম শ্রেণীর অনেক গান রচনা করেছি। সেগুলিকে আমি নিজের মনে কত সময়ে তান দিয়ে গাই।’(‘সঙ্গীতচিন্তা’) তাহলে কী উনি নিজেই নিজের বিরুদ্ধাচরণ করলেন? তা বোধহয় নয়। কারণ পরের দিকে আবার দিলীপ কুমারের সঙ্গে আলোচনায় উনি সে প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শেষ কথা সুরবিহার সম্বন্ধে। ইংরেজী improvisation কথাটির তুমি বাংলা করেছ সুরবিহার-এও আমি ভালবাসি । এতে যে গুণী ছাড়া পায় তাও মানি । আমার অনেক গান আছে যাতে গুণী এরকম ছাড়া পেতে পারেন অনেকখানি। আমার আপত্তি এখানে মূলনীতি নিয়ে নয়। তার প্রয়োগ নিয়ে।


===={{{{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}====




Monday, 1 August 2022

মহাপ্রয়াণ দিবস। জনপ্রিয় ভাস্কর্য রামকিঙ্কর বেইজ। Vol - 815. Dt -02.08.2022. ১৬ শ্রাবণ,১৪২৯. মঙ্গলবার। The bolgger in litareture e-magazine

রামকিঙ্কর বেইজ 


১৯৮০ সালের ২৩ শে মার্চ, বেইজকে পি জি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি প্রোস্টেট গ্রন্থির রোগে ভুগছিলেন এবং ক্ষুধা পাওয়ার সমস্ত ধারণা হারাতেন। চিকিৎকরা শান্ট অপারেশন করেছেন। তার চিকিৎসার ব্যয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং বিশ্বভারতীর অধ্যক্ষ বহন করেছিলেন। ২ আগস্ট কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। শান্তিনিকেতনে তাঁর ভাগ্নে  মরদেহ দহন করেন। তিনি হাসপাতালে থাকার সময় তাঁর শেষ ভাস্কর্য দুর্গামূর্তিটি গড়েছিলেন। যা আজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। 

 বাঁকুড়া শহরের যুগীপাড়ায় এক পরমানিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ২৫ মে ১৯০৬। তার পদবী বেইজ, সংস্কৃত বৈদ্য ও প্রাকৃত বেজ্জ-র পরিবর্তির রূপ। তাঁর পিতা ছিলেন চণ্ডীচরণ বেইজ।

মধ্যকৈশোরে রামকিঙ্কর অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি আঁকতেন। মেট্রিক ক্লাস (বর্তমানে যা মাধ্যমিকের সমতুল্য) পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর ষোলো বছর বয়সে তিনি বাঁকুড়ার বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের নজরে পড়ে যান। চার বছর পরে তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র হিসেবে যোগ দেন।[৪] আচার্য নন্দলাল বসু ছিলেন তার শিক্ষক। রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখকে সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিলেন। চারুকলায় ডিপ্লোমা অর্জন করে তিনি বিশ্বভারতীর ভাস্কর্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে বৃত হন। ১৯৭১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী জহর দাশগুপ্ত শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন তার ছাত্র।


তাঁর জীবনকথা নিয়ে সাহিত্যিক সমরেশ বসু (কালকূট) 'দেখি নাই ফিরে' নামে বৃহদায়তন উপন্যাস রচনা করেন। যার চিত্রাংকন করেছিলেন শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য।


রামকিঙ্কর বাইজ জীবনের প্রাকৃতিক উৎসকে সাড়া দিয়েছিল।মানব ব্যক্তিত্ব, দেহের ভাষা এবং সাধারণ মানব নাটকে খুব আগ্রহী ছিলেন। আধুনিক পশ্চিমা শিল্প এবং প্রাক ও উত্তর-শাস্ত্রীয় ভারতীয় শিল্প তার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল। তিনি স্থানীয় উপাদানগুলি সুবিধার্থে ব্যবহার করেছিলেন এবং একজন মডেলার এবং কার্ভারের দক্ষতার সংমিশ্রণে কাজ করেছিলেন। তার চিত্রগুলিও তার ভাস্কর্যগুলির মতো প্রকাশবাদী মাত্রা গ্রহণ করে, যা শক্তি এবং প্রাণশক্তি দিয়ে পূর্ণ। বাইজ যখন ঠাকুরের প্রতিকৃতি তৈরি করছিলেন, তখন এক বৈঠকের সময়, প্রবীণ কবি তাকে বাঘ হিসাবে এই বিষয়টির কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রক্তে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এর পরে, বাইজের নিজস্ব কথায়, তিনি "পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি"।

তাঁর কয়েকটি ভাস্কর্য কলাভবন, শান্তিনিকেতন, প্রয়াত রানী চন্দ সংগ্রহ ও চারুকলা একাডেমী, কলকাতা, এইচ.কে. সহ বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষিত এবং প্রদর্শিত রয়েছে কেজরিওয়াল কালেকশন এবং কর্ণাটকের চিত্রকলার পরশহাট, বেঙ্গালুরু, ললিত কালা আকাদেমি, নয়াদিল্লি, ন্যাশনাল গ্যালারী অফ মডার্ন আর্ট, নয়াদিল্লি, রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লি, জেন এবং কিতো ডি বোয়ার, দুবাই এবং নয়াদিল্লির দিল্লী আর্ট গ্যালারী।

রামকিঙ্কর ছিলেন প্রথম ভারতীয় শিল্পী যিনি আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্প অধ্যয়ন করে সেই শৈলী নিজের ভাস্কর্যে প্রয়োগ করেন। তাকে ভারতীয় শিল্পে আধুনিকতার জনক ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী মনে করা হয়।
পুরস্কার - ১৯৭০খ্রিষ্টাব্দে তিনি পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন। 



শেষ বিকেলের আলো এসে খেলা করছে জাফরি ছুঁয়ে লাল মেঝেতে। সেই নরম আলোয় কোণার্ক বাড়ির বারান্দায় একলা বসে লিখছিলেন কবি। ঠিক তখনই কিঙ্কর এলেন।
কার মূর্তি গড়েছ কিঙ্কর?’’

‘‘আমি ওটাকে জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারি নে। স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ওই মূর্তি আমার কাছে এসেছিল।’’
সেই মূর্তির মধ্যে কি কোনও প্রাণী আছে?’’

‘‘আছে। অথচ যেন নেই!’’

মুখ না ঘুরিয়ে রবীন্দ্রনাথ কথা বলছিলেন ওঁর সঙ্গে। ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আমি যেন একটি মেয়ের মূর্তি দেখেছি, মুখ নামানো।’’

কিঙ্কর মিতস্বরে বললেন, ‘‘হয়তো সে কাউকে চুমো খেতেই মুখ নামিয়েছে।’’

রবিঠাকুরের সামনে চুমু খাওয়ার কথাটা বলে ফেলে খুব অস্বস্তি হল কিঙ্করের। গলা শুকিয়ে কাঠ।

গ্রীষ্মের ছুটি চলছিল শান্তিনিকেতনে, কিন্তু বাড়ি যাননি রামকিঙ্কর। তাঁর দিনমান কাটছিল নিভৃত শালবন, রোদ রাঙা শুনশান গোয়ালপাড়ার মেঠো আলপথ, মেথরপল্লির কল-কল্লোলে রঙ-তুলি-ক্যানভাস নিয়ে।

মহার্ঘ্য সব রাত পেরিয়ে যায় অন্ধকারে, স্পর্শের নির্মাণে। আশ্রমে খোলা আকাশের নীচে, কংক্রিটের ঢালাইয়ে তেমন নির্মাণ দেখেই কিঙ্করের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে গুজবে মুখর শান্তিনিকেতন। এক ভোরে নিজে সেই ভাস্কর্য দেখে এলেন রবীন্দ্রনাথ।

কবির ডাক পেয়েই কিঙ্করের মনে হয়েছিল, এই বুঝি তাঁকে শান্তিনিকেতনের ছেড়ে যেতে হবে।

কানে বাজছে মাস্টারমশাই নন্দলালের কথা।— ‘‘রাতের স্বপ্নগুলোকে মনে রেখো কিঙ্কর। ভুলে যেও না। তেমন হলে, স্বপ্ন ভেঙে গেলে, উঠে স্বপ্নের কথা লিখে রাখবে। কোনও স্বপ্নই ভুলে যেও না। স্বপ্নে ছবি আসে কিঙ্কর, প্রতিমা আসে। স্বপ্ন আঁকবে!’’

রবীন্দ্রনাথ এবার ফিরে তাকালেন অন্যমনস্ক কিঙ্করের দিকে। বললেন, ‘‘একটি পাখি কি উড়ে যেতে চায় আকাশে? পাখা তার যেন সেইরকম তুলে দিয়েছে।’’

কিঙ্করের চোখের পাতা ভিজে এল। তিনি মুখ তুললেন না। খুব আস্তে কেবল বললেন, ‘‘একটি মেয়ে পাখি হয়তো তার বুকের নীচেই আছে!...’’
কবি আর কিঙ্করের কথায় কথায় একসময় বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে নামল। আকাশে সন্ধাতারা। দূরের হাওয়ায় ভেসে আসছে এস্রাজি পকড়। ছড় টেনে কেউ একমনে বাজিয়ে চলেছে কবির বাহারে গাঁথা ধামার, ‘এত আনন্দধ্বনি উঠিল কোথায়’। এর পরও কথা এগিয়েছিল দু’জনের। দুই শিল্পীর।

কী কথা?

বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী সাগরময় ঘোষ লিখেছেন সেই কথালাপ, ‘‘রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করকে ডেকে বললেন, শোন, কাছে আয়। তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি— সামনে।’’

এর পর আর কখনও ফিরে দেখেননি কিঙ্কর। হাওয়ার উজানে এগিয়েছেন তিনি। আর এগোতে গিয়েই নিয়ত তাঁকে দুঃখ-দহনে পুড়তে হয়েছে!
মাস্টারমশাই শ্রদ্ধেয় নন্দবাবু ছিলেন ভীষণ গোঁড়া। তিনি ছিলেন জ্যান্ত মডেল ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। বলতেন ও-সব পশ্চিমে চলে। কিন্তু আমি তার উপদেশ মেনে চলিনি। মডেল ব্যবহার করেছি।’’

নিজের মাস্টারমশাই সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হয়েও এ কথা কিঙ্করই বলতে পারেন।

খুব অল্প বয়সেই রামকিঙ্কর মূর্তি গড়া শিখেছিলেন কুমোরপাড়ার অনন্তজ্যাঠাকে দেখে দেখে। দু’চার আনার বিনিময়ে নিষিদ্ধ পল্লির রমণীদের মূর্তি গড়তে গড়তেই তাঁর ভাস্কর্যের সহজপাঠ।

এই সময়ই স্বদেশি মেলায় তেল রঙে জাতীয় কংগ্রেসের পোস্টার এঁকেও হাত পাকিয়েছেন তিনি। শিল্পের প্রতি অপার নিষ্ঠার মনটি সেই তখনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

১৯২৫-এ বাঁকুড়ার যোগীপাড়া থেকে ম্যাট্রিক না দিয়েই ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে শান্তিনিকেতন চলে এলেন কিঙ্কর। পিছনে পড়ে রইল বাঁকুড়ায় তাঁর বাল্যস্মৃতির গাঁ-ঘর, দারিদ্রে দীর্ণ‎ পরিবার-পরিজন আর কাদামাটির কুমোরপাড়া।

শান্তিনিকেতনের কলাভবনে তাঁর কাজের নমুনা দেখে নন্দলাল প্রথম দিনই বললেন, ‘‘তুমি সবই জানো, আবার এখানে কেন?’’ একটু ভেবে তারপর বলেন, ‘‘আচ্ছা, দু-তিন বছর থাকো তো।’’

থেকে গেলেন কিঙ্কর। নাগাড়ে সাড়ে পাঁচ দশক শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে মৃত্যুর কিছু দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘সেই দু-তিন বছর আমার এখনও শেষ হল না!’’

কলাভবনে কিঙ্করই প্রথম অয়েলে কাজ করেছেন। সে নিয়েও বিতর্কের শেষ ছিল না। প্রথমে আপত্তি করলেও পরে নন্দলাল মেনে নেন ছাত্রের যুক্তি। রামকিঙ্কর রঁদা, সেজান ও পরবর্তী কিউবিস্ট ছবির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাজে কিউবিস্ট প্রভাব নিয়েও নন্দলালের সঙ্গে বিরোধ ছিল। সে বিরোধ‎ মিটেও যায়।

রং-তুলি-কাঁকড়ে কাজ শিখতে শিখতে একদিন কলাভবনের পাঠ শেষ হল। শুরু করলেন স্বাধীনভাবে শিল্পের সাধনা। স্বপ্ন থেকে আসা সে সব সৃষ্টির উল্লাসে, মিশিয়ে দিলেন নিজের গোপন-গহন উল্লাস!

নিত্য ভাঙা-গড়ার খেলায় তাঁর সহজিয়া জীবন নিয়ে ক্রমশই জলঘোলা হল শান্তিনিকেতনে। তাঁর দরাজ গলার রবীন্দ্রনাথের গান শুনল না কেউ! বরং শান্তিনিকেতনী তর্ক তুলল তাঁর জীবনচর্যা নিয়ে। কিঙ্করের তখন ঘরে-বাইরে ‘জীবন্ত মানুষের নেশা। 

""জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে, এটা সত্যি। কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউ এসেছে মানসিক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। কিন্তু ছাড়িনি কাউকে। ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব।...আমার মডেলরা আমার বহু স্কেচে, ছবিতে, মূর্তিতে, বেঁচে আছে। মডেলরা তো এভাবেই বেঁচে থাকে।’’

ষাটের দশকের মাঝামাঝি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বন্ধু সমীর সেনগুপ্তকে নিয়ে এক বাসন্তিক বিকেলে হাজির হলেন শান্তিনিকেতন।

রিকশা থামল অনিবার্য ভাবে বাংলা মদের দোকান ‘আকর্ষণী’-তে। রিকশায় উঠল দু’ বোতল বাংলা। গন্তব্য রতনপল্লি, রামকিঙ্করের ডেরা।

‘‘কিঙ্করদা, ও কিঙ্করদা...’’

শক্তির হেঁড়ে গলায় হাঁক শুনে লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে বাইরে এলেন রামকিঙ্কর। মুখে সেই চিরচেনা হাসি।

‘‘আরে কবি এসেচিস—আয়, আয়, কিছু এনেচিস তো হাতে করে?...’’

এর পরের আসরের বর্ণনা দিতে সমীর লিখেছেন, ‘‘শুয়োরপোড়া এল, ফুরিয়ে গেল, একটি রিকশওলাকে ধরে আরও দুটো বোতল আনানো হল, সঙ্গে ছোলাভাজা, সে দুটোও ফুরিয়ে গেল। আবারও দুটো আনানো হল বেশি পয়সা দিয়ে, তখন রাত দশটা বেজে গেছে। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, অফুরন্ত বাংলা মদ, অফুরন্ত বিড়ি, অফুরন্ত কথা, স্খলিত গলায় অফুরন্ত রবীন্দ্রনাথের গান।’’

ঢের রাতে ঘুম ভেঙেছিল সমীরের। অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে কোনও মতে চৌকাঠ পেরিয়ে দেখলেন, রামকিঙ্কর একটা টুলের উপর বসে রয়েছেন। উপর থেকে একটা লন্ঠন ঝুলছে। লুঙ্গিটা কোমর থেকে যে খুলে পড়েছে কিঙ্করের, সে খেয়াল নেই! সম্পূর্ণ নগ্ন! আর তাঁর সামনে একটা অসমাপ্ত মাটির ভাস্কর্য। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছেন কিঙ্কর।
যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না।
রবীন্দ্রনাথের মতো রামকিঙ্করও চাননি শেষ সময় কলকাতায় চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হোক।

সর্বক্ষণের সঙ্গিনী, মডেল রাধারানি— যাঁর সঙ্গে কিঙ্করের দীর্ঘ জীবনের সম্পর্ক, তিনিও জানিয়েছিলেন, ‘‘উনি যেতে চাননি, ওঁর ভাইপো দিবাকর সই করে দিল। জোর করে ওরা নিয়ে গেল।’’

দিবাকরবাবু অবশ্য অন্য দাবি করেছিলেন, ‘‘ওঁরা আমার সই চাইছেন। একটা লিখিত অনুমতি চাইছেন। কিন্তু আমার দেবার ইচ্ছে নাই।’’

কিন্তু ডাক্তারবাবুদের কথায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে ‘সই দিতে হল’। একরকম জোর করে কিঙ্করকে কলকাতায় আনা হয়। শান্তিনিকেতন থেকে আসার দিন তাই জড়ানো গলায় স্বজনদের বলেছিলেন, ‘‘যাচ্ছি শান্তিনিকেতন ছেড়ে। যাচ্ছি— কিন্তু আর ফিরব না। রবীন্দ্রনাথও ফেরেননি।’’

শিল্পীর যাবার বেলার কথাই সত্যি হল। কলকাতাতেই চলে গেলেন, রবিঠাকুরের ভাস্কর!

মৃত্যুর দু’দিন আগে তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ছাত্রের হাত ধরে কিঙ্কর বললেন, ‘‘মানিক, একটা রিকশা ডেকে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও!’’

সে-ফেরা আর হল কই?

একসময় চিতা নিভে গেল।

ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে চাঁদের শশ্মান। ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে ওপারে খোয়াই, বন-বনান্ত, কোপাই পেরিয়ে গগনতল ছুঁয়ে থাকা দিগন্ত।

একটু পরেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। মেঘের গুমোট কেটে সুদূর নীলিমায় দেখা দিল একফালি চাঁদ।

শেষ হল দাহ।

রামকিঙ্কর চলে গেলেন।
==={{{{{{{{{{{√৳৳®=π^=}}✓™©$৳°==[][====



শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ।‌ একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। Dt -26.11.2024. Vol -1059. Tuesday. The blogger post in literary e magazine.

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়   (২৬ নভেম্বর ১৮৯০ — ২৯ মে ১৯৭৭)  একজন বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ.  মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্...