∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
=================================
Doinik sabder methopath
Vol -293. Dt -26.02.2021
১৩ ফাল্গুন, ১৪২৭.শুক্রবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
" চলে না গিয়ে উপায় ছিল না। ... ট্রেন ছেড়ে দিল, আমি আমার পুরনো জীবন থেকে শিকড়গুলো উপড়ে নিলাম।’'
ডায়েরির পাতা উল্টালে নিজের সম্পর্কিত এই কথাগুলি অদ্ভুতভাবে উঠে আসে , শুধু শেকড়ের টানে 9 তারিখ ও ব্যক্তিগত নানান কারণে নাগরিক সভ্যতা আদব-কায়দা ছেড়ে তাকে চলে যেতে হয়েছিল প্রকৃতির মায়া ঘেরা শিলং প্রদেশ।
তিনি কলকাতার রায় পরিবারের প্রমদারঞ্জন রায় ও সুরমাদেবীর সন্তান (বিবাহপূর্ব নাম লীলা রায়)। তাঁর জন্ম ১৯০৮ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি রায় পরিবারের গড়পাড় রোডের বাড়িতে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (যাঁর পৈতৃক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়) ছিলেন প্রমদারঞ্জনের ভাই এবং লীলার কাকা। সেইসূত্রে লীলা হলেন সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের পিসি।
লীলার বাল্যজীবন কাটে শিলঙে যেখানকার লরেটো কনভেন্টে তিনি পড়াশোনা করেন।
"অক্ষত হৃদয়ে আমার তেইশ বছর বয়স হয়নি। ... আমার একজনকে ভালো লাগত। এবং আমাদের বাড়ির সকলেও তাকে ভালোবাসতে আরম্ভ করে দিয়েছিল। খুব যা-তা ছিল না সে, মাথায় লম্বা, রং ফর্সা, ব্যবহার মিষ্টি, সুকুমার, কমনীয়, সাহিত্যানুরাগী, সদ্বংশজাত, আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। আমি মনে মনে মুগ্ধ। ... কিন্তু যতই দিন যায় ততই বুঝি সে বড় ছেলেমানুষ, ব়ড় কোমল, আমার আরো কড়া ওষুধ দরকার।"
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজী পরীক্ষায় তিনি ইংরাজীতে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন। তিনি বহু সংখ্যক বাংলা গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস রচনা করে নানান পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। তিনি অনেক শিক্ষামূলক রচনা ও রম্যরচনা ইংরাজী থেকে বাংলায় অনুবাদও করেন।
১৯৩৩ সালে লীলা বিবাহ করেন দন্ত চিকিৎসক ডাঃ সুধীর কুমার মজুমদারকে। এই বিবাহে তাঁর পিতার প্রবল বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর স্বনির্বাচিত পাত্রকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। পিতৃপরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট থাকলেও পিতার সঙ্গে সম্পর্ক চিরকালের মতো ছিন্ন হয়। বিবাহিত জীবনে লীলা-সুধীর খুব সুখী দম্পতি ছিলেন। স্বামী আজীবন লীলার সাহিত্য চর্চায় উৎসাহী ছিলেন। তাদের এক পুত্র ডাঃ রঞ্জন মজুমদার ও এক কন্যা কমলা চট্টোপাধ্যায়।
তাঁর প্রথম গল্প লক্ষ্মীছাড়া ১৯২২ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় সন্দেশ পত্রিকা পুনর্জীবিত করলে তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ অবধি সাম্মানিক সহ-সম্পাদক হিসাবে পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ১৯৯৪-এ তার স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য অবসর নেন। তার সাহিত্যিক জীবন প্রায় আট দশকের।
পুরস্কার ও সম্মাননা
তাঁর প্রথম আত্মজীবনী 'আর কোনখানে'-এর জন্য ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্র পুরস্কার পান।
আনন্দ পুরস্কার
ভারত সরকারের শিশু সাহিত্য পুরস্কার
সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার
বিদ্যাসাগর পুরস্কার
ভুবনেশ্বরী পদক
ভুবনমোহিনী দাসী সুবর্ণ পদক
দেশিকোত্তম
ডি-লিট ।
১৯২২ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রথম গল্প "লক্ষীছাড়া" রচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। প্রথম গ্রন্থ "বদ্যিনাথের বাড়ি" (১৯৩৯)। 'চীনেলন্ঠন', 'শ্রীমতী', 'জোনাকি', 'আমি নারী', 'হলদে পাখির পালক', 'পাকদণ্ডী', 'পদি পিসির বর্মীবাক্স', 'বাতাস বাড়ি', 'খেরোর খাতা' প্রভৃতি গ্রন্থ তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি। 'বক বধ পালা', 'লঙ্কাদহন পালা,' তাঁর রচিত নাটক গুলির মধ্যে অন্যতম।
তাঁর সর্ব মোট ১২৫ টি বই প্রকাশিত হয়। যার মধ্যে রয়েছে একটি গল্প সংকলন, পাঁচটি সহ লেখিকা রূপে, নয়টি অনূদিত গ্রন্থ এবং ১৯ টি সম্পাদিত গ্রন্থ। তাঁর প্রথম গ্রন্থ বদ্যি নাথ এর বাড়ি (১৯৩৯) দ্বিতীয় প্রকাশনা ‘দিনদুপুরে’ (১৯৪৮)। তিনি শিশু সাহিত্যের পাশাপাশি, গোয়েন্দা গল্প, ভূতের গল্প লিখেছেন অনেকগুলি।
তার আত্মজীবনী মূলক রচনা ‘পাকদন্ডী’ তে শিলং থাকাকালীন শৈশবের স্মৃতি থেকে শুরু করে শান্তিনিকেতন এবং অল ইন্ডিয়া রেডিও তে কাজের স্মৃতি কে উল্লেখ করেছেন বেশ সুন্দরভাবে। তিনি বাংলাতে অনুবাদ করেছেন- জনাথন সুইফট এর ‘গালিভার ট্রাভেলস’ এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী’। লেখালেখির পাশাপাশি মিডিয়াতে তার কাজের অনেক অনুভব রয়েছে। অল ইন্ডিয়া রেডিও তে মহিলাদের নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান তিনি পরিচালনা করতেন। ১৯৭২ সালে তার ‘পদিপিসির বর্মী বাক্স’ চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়।
ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প মনিমালা, বাঘের চোখ, টাকা গাছ, লাল-নীল দেশ্লাই, বাঁশের ফুল, ময়না, শালিক, আগুনি বেগুনি, টিপুর ওপর টিপুনি, শিবুর ডায়েরি, ফেরারী, এই যে দেখা, শ্রীমতি, পেশা বদল এসব অনেক বিখ্যাত।
অ্যাডভেঞ্চার ও বিজ্ঞানের কল্পনায় তাঁর গল্পগুলি হয়ে উঠেছে অসাধারণ, চিত্তাকর্ষক।' শর্টকাট' তার বিশিষ্ট গল্প যেখানে আছে_ হরিচরণ সামন্ত, ভারতের জরিপ বিভাগের তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন, দক্ষ কর্মচারী, অথচ সংসারের অলিগলি, মন সুড়ঙ্গের হদিস জানা ছিল না বলেই সংসারে কাউকে খুশি করতে পারেননি। সংসার করা তার মতে অখাদ্য ব্যাপার, যেখানে অংক কষা ঠিক, উত্তর ভুল। সেই হরিচরণ একপ্রকার বাধ্য হয়েই পাড়ি দেন ভারতের উত্তর-পূর্ব কোনের অরণ্য ভূমিতে যেখানে সুযোগ পান সময়ের শর্টকাট ব্যবস্থার, যাতে করে তিনি ফিরে যেতে চান ১৫ বছর পূর্বের একটি বিশেষ মুহূর্তে। সেই সময়ে ফিরে গেলে তিনি মনে করতে পারেন দাদা শ্বশুর মশাইয়ের উইল এর কথা, যেটা তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ডবলুর পিছনে গুঁজে রেখেছিলেন। তাঁর এই ভুলে যাওয়া নিয়ে বাড়ি শুধু সকলের সঙ্গে মনোমালিন্য। আবার কখনও কখনও এই ধরনের গল্পগুলিতে বুদ্ধির দীপ্তি দিয়ে অলৌকিকত্বের রহস্যময় আবরণ টিকে সরিয়ে স্পষ্ট করে তোলেন। 'শর্টকাট 'গল্পেই আছে- 'বুনো' অশরীরী অপদেবতা, বনের অমঙ্গল শক্তি, যা ভর করলে মানুষ বনের মধ্যে পথ হারায়। সেখানে তিনি কথকের সংস্কার মুক্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে ই গল্পের ইতি টানেন_"বুনো-টুনো কিছু নয়, ব্যাপার হলো দিকভ্রম। দিকভ্রম হলে মানুষেরা তাদের মানসিক ভারসাম্য হারায়"। 'মাকু' উপন্যাসেও তেমনি অলৌকিকতার বাতাবরণ এর উপর যুক্তিবাদী মনের আলো ফেলে তাকে স্বচ্ছ করে তুলেছেন।
কোথাও লোমহর্ষক কাহিনী দিয়ে গল্পের শুরু হলেও শেষ হয় তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় দিয়ে। যেমন 'গুপের গুপ্তধন' গল্পে গুপ্তধন উদ্ধার করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে 'শুঁটকি মাছ'। 'হ্যাপার হিসাব' গল্পে অবস্থার বিপাকে পড়া মানুষজনের অতীত থেকে রত্ন উদ্ধারের বৃথা চেষ্টা, অন্যদিকে উন্নতি কে ধরতে গিয়ে ঘোর দুর্দিন ডেকে আনার কথাকে সহজ-সরল ভাষায় পরিবেশন তাঁর সাহিত্যিক হিসেবে অসাধারণ দক্ষতার পরিচায়ক। খালি, এইটুকু মনে রেখো_"যেদিন কাদা চিংড়ির ছ্যাচড়া মুখে রুচবে না, আর বাংলা ভাষা কানে মিষ্টি ঠেকবে না, সেদিন কিন্তু ঘোর দুর্দিন। উন্নতি হইতে সাবধান। শেষটা না পা পিছলে আলুর দম হয়।"
শেষ জীবনটা কলকাতাতেই কেটেছিল। পাঠক থেকে আত্মীয়ের ভিড়ে, লেখালিখি আর সম্পাদনার ব্যস্ততায়। একেবারে শেষ দিকে স্মৃতি প্রতারণা করেছিল ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে আপামর বাঙালির স্মৃতিতে শতায়ু লীলার চিরকালীন আসনটি পাতা হয়ে গিয়েছে।
ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে শুধু নয় শহর কেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাতে গড়ে ওঠা কৃষ্ণর মন পাড়ি দিচ্ছে প্রকৃতি ঘেরা মনোরম পরিবেশে প্রকৃতির অঙ্গনে বেড়ে উঠতে জীবনের মেরু বৃত্ত পেরিয়ে সেই কিশোরী মেয়েটি আজ আমাদের মধ্যে আর নেই।
" ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম থেকে... জানলায় দেখা যাচ্ছে বছর তেইশের এক যুবতীর মুখ, প্রত্যয়ী, অথচ বিষণ্ণ। খুব দ্রুত কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়া প্রয়োজন তার।"
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
লীলাদির কথা ভাবলে মনটা আজও ভাল হয়ে যায়। অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসার সেরা উপায় হল লীলাদির গল্প পড়া। খারাপ সময়কে হারিয়ে দিয়ে ভাল সময় ডেকে আনার এর চাইতে সহজ উপায় আর হয় না।
নবনীতা দেব সেন
বাংলা কেন, যে-কোনও সাহিত্যেই মেয়েদের লেখায় ব্যঙ্গরস, ব্যঙ্গকৌতুক খুব কম। তাই লীলা মজুমদারের লেখা বিশেষ ভাবে ভাল লাগত, এখনও লাগে। তাঁর শাণিত, বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা, প্রাণময়, সুস্থ রসিকতার কোনও তুলনা হয় না। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর, সেই কারণেই রসিকতার মধ্যে দিয়েও প্রতিবাদ করতে পারতেন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
লীলা মজুমদার ছিলেন অদ্ভুত ধরনের এক লেখক। ছোটদের জন্য লেখায় যে-মজা তিনি আনতেন, যা তিনি বোধ করি তাঁর পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছিলেন, আমাকে বরাবর খুব টানত। তাঁর বড়দের জন্য লেখাও আমি সমান আগ্রহে পড়েছি। আভিজাত্য বজায় রেখে রসকে উত্তীর্ণ করা, এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
বাণী বসু
লীলা মজুমদার নামটা শুনলেই মন আনন্দে ভরে ওঠে। সাহিত্য থেকে জীবনে একজন মানুষ আনন্দকে এতখানি মূল্য দিয়েছেন, এর উদাহরণ কমই আছে। সকলেই তো দুঃখ নিয়ে লিখতে ব্যস্ত। ছোটদের গল্পে যে-শব্দচয়ন বা নামকরণ, তারও জুড়ি নেই। গুপী বা পদিপিসি শুনলেই মাথায় একটা ছবি তৈরি যায়। ছোটদের মনটা উনি খুব ভাল বুঝতেন।
২০০৭ সালে র ৫ এপ্রিল তিনি তাঁর জীবনের সবকিছু রেখে চলে যান নিভৃতে অন্তর্লোকে, রেখে যান অমর কীর্তি সব শিশুসাহিত্য। শিশুমনের সবুজ সতেজ ভাবনার সঙ্গী হয়ে আজও বেঁচে আছে ।একটি পরিচিত নাম হয়ে লীলা মজুমদার।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆