Sunday 28 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
      জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
 
গিরিশচন্দ্র ঘোষ 
=================================Doinik Sabder Methopath
Vol -296. Dt -28.02.2021
১৪ ফাল্গুন, ১৪২৭. রবিবার
÷÷÷÷÷×÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷×÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

১৮৪৪ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি, কলকাতার বাগবাজারে গিরিশচন্দ্রের জন্ম। তিনি ছিলেন তাঁর পিতামাতার অষ্টম সন্তান। প্রথমে হেয়ার স্কুল ও পরে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি বিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। পবর্তীকালে ইংরেজি ও হিন্দু পুরাণে জ্ঞান আর্জন করেন।

কর্মজীবন 
১৮৬৭ সালে শর্মিষ্ঠা নাটকের গীতিকার হিসাবে নাট্যজগৎতে প্রথম যুক্ত। দু'বছর পরে সধবার একাদশিতে অভিনয় করে বেশ সুনাম অর্জন করে ছিলেন। কলকাতায় ন্যাশানাল থিয়েটার নামে তার একটি নাট্য কোম্পানি ছিল। ১৮৮৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নটী বিনোদিনীকে নিয়ে তিনি স্টার থিয়েটার, কলকাতা চৈতন্যলীলা নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। বিনোদিনীর ইচ্ছা ছিল যে নতুন থিয়েটার তৈরি হবে তা বিনোদিনীর নামে বি-থিয়েটার হবে । কিন্তু কিছু মানুষের প্রতারনার শিকার তিনি হন । যাঁদের মধ্যে তার নিজের অভিনয় গুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন । রামকৃষ্ণ পরমহংস এই নাটক দেখতে এসেছিলেন। এরপর উভয়েই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
কথিত আছে গিরিশ ঘোষের মন প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে এবং অদ্ভুত ভাবে চিন্তা করতে পারতো। তার চিন্তা কিংবা আইডিয়া বা শব্দাবলী তাৎক্ষনিক লিখে রাখার জন্য তিনি দেবেন্দ্রনাথ মজুমদারকে সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। দেবেন্দ্র সারাক্ষণ তার কাছে তিনটি পেন্সিল প্রস্তুত রাখতেন, দোয়াত কলম রাখতেন না। কারণ কলমে কালি ভরার মত সময়টুকুও নাকি তিনি পেতেন না। কোনও কথা বুঝতে না পারলে ফের জিজ্ঞেস করলে গিরীশবাবু রেগে যেতেন, কারণ তাতে তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটতো। তাই কোন শব্দ বুঝতে না পারলে তার নির্দেশ অনুযায়ী দেবেন্দ্র সেখানে ডট বসিয়ে যেতেন, যাতে পরে তা জেনে নিতে পারেন।



চলচ্চিত্র 
কাজী নজরুল ইসলাম গিরিশচন্দ্রের ভক্ত ধ্রুব উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত করেন। ১৯৫৬ সালে মধু বসুর পরিচালনায় গিরিশচন্দ্রের অবলম্বনে নির্মিত মহাকবি গিরিশচন্দ্র চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।

 

 নাটকগুলো-

পৌরানিক নাটক 
রাবণবধ (১৮৮১)
সীতার বনবাস
লক্ষ্ণণ বর্জন
সীতাহরণ
পান্ডবের অজ্ঞাতবাস
জনা (১৮৯৪)।

চরিত্র নাটক 
চৈতন্যলীলা
বিল্বমঙ্গল ঠাকুর
শঙ্করাচার্য

রোমান্টিক নাটক 
মুকুলমুঞ্জরা
আবু হোসেন

সামাজিক নাটক 
প্রফুল্ল(১৮৮৯)
মায়াবসান
বলিদান

ঐতিহাসিক নাটক 
সিরাজদ্দৌলা
মীর কাসিম
ছত্রপতি শিবাজী

উপাধি 
১৮৭৭ সালে মেঘনাদবধ কাব্যে রামচন্দ্র ও মেঘনাদ উভয় ক্ষেত্রে অভিনয় জন্য সাধারণী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাকে 'বঙ্গের গ্যারিক' আখ্যায় ভূষিত করেন।

গিরিশচন্দ্র সম্পর্কে অভিযোগ ছিল মদ্যপ ও স্বেচ্ছাচারী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম অন্তরঙ্গ শিষ্যে পরিণত হন। “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত” গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে, কিভাবে শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসার পর গিরিশচন্দ্রের নৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠতম শিষ্যদের একজন হয়ে ওঠেন৷।

মৃত্যু 
১৯১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই মহান অভিনেতা ও নাট্যকার কলকাতায় পরলোক গমন করেন।

বিশিষ্ট বঙ্গ সন্তান সংগীতস্রষ্টা, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যপরিচালক ও নট। বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণযুগ মূলত তাঁরই অবদান।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆



Saturday 27 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ধারা
পর্ব ৪
কাঁথি ২. দেশপ্রাণ ব্লক এর লৌকিক দেব দেবী
=================================
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Vol-295. Dt -27.02.2021
১৪ ফাল্গুন,১৪২৭. শনিবার
------------------------------------------------
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি দু'নম্বর ব্লক দেশপ্রাণ, স্বাধীনতা সংগ্রাম শিক্ষা-সংস্কৃতি শিল্প সমাজ কল্যাণ নিযুক্তি সম্প্রীতি ইত্যাদিতে প্রগতির প্রায় সর্বক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে আসীন ।এই ব্লকের অধিবাসীদের ধর্মীয় অবস্থান ও বৈচিত্রের মধ্যে যথেষ্ট ঐক্য আমরা লক্ষ্য করি ।বিশেষ করে কালী মাতা শীতলা মনসা শিব লক্ষীনারায়ন রাধাকৃষ্ণ জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা এরা যেমন রয়েছে তেমনি কিছু কিছু জায়গায় দরগা মসজিদ ঈদগাহ। হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি রক্ষায় বছরভর মেলা পার্বণ উৎসব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে প্রত্যেকে আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। জনগণের মধ্যে একটি মেলবন্ধন সংঘটিত হয় এই অঞ্চলের সমস্ত লৌকিক দেব দেবীরা বিভিন্নভাবে লৌকিক ও শাস্ত্রমতে পূজা-অর্চনা সহ নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সারা বছর পূজিত হয়ে আসছেন, তাদের একটি ইতিহাসময় তালিকা নিম্নে দেওয়া হল।
------------------------------------

Friday 26 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
।          লীলা মজুমদার
=================================
             Doinik sabder methopath
           Vol -293. Dt -26.02.2021
             ১৩ ফাল্গুন, ১৪২৭.শুক্রবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

" চলে না গিয়ে উপায় ছিল না। ... ট্রেন ছেড়ে দিল, আমি আমার পুরনো জীবন থেকে শিকড়গুলো উপড়ে নিলাম।’'
   ডায়েরির পাতা উল্টালে নিজের সম্পর্কিত এই কথাগুলি অদ্ভুতভাবে উঠে আসে , শুধু শেকড়ের টানে 9 তারিখ ও ব্যক্তিগত নানান কারণে নাগরিক সভ্যতা আদব-কায়দা ছেড়ে তাকে চলে যেতে হয়েছিল প্রকৃতির মায়া ঘেরা শিলং প্রদেশ।

তিনি কলকাতার রায় পরিবারের প্রমদারঞ্জন রায় ও সুরমাদেবীর সন্তান (বিবাহপূর্ব নাম লীলা রায়)। তাঁর জন্ম ১৯০৮ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি রায় পরিবারের গড়পাড় রোডের বাড়িতে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (যাঁর পৈতৃক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়) ছিলেন প্রমদারঞ্জনের ভাই এবং লীলার কাকা। সেইসূত্রে লীলা হলেন সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের পিসি।
লীলার বাল্যজীবন কাটে শিলঙে যেখানকার লরেটো কনভেন্টে তিনি পড়াশোনা করেন। 

          "অক্ষত হৃদয়ে আমার তেইশ বছর বয়স হয়নি। ... আমার একজনকে ভালো লাগত। এবং আমাদের বাড়ির সকলেও তাকে ভালোবাসতে আরম্ভ করে দিয়েছিল। খুব যা-তা ছিল না সে, মাথায় লম্বা, রং ফর্সা, ব্যবহার মিষ্টি, সুকুমার, কমনীয়, সাহিত্যানুরাগী, সদ্বংশজাত, আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। আমি মনে মনে মুগ্ধ। ... কিন্তু যতই দিন যায় ততই বুঝি সে বড় ছেলেমানুষ, ব়ড় কোমল, আমার আরো কড়া ওষুধ দরকার।"
             কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজী পরীক্ষায় তিনি ইংরাজীতে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন। তিনি বহু সংখ্যক বাংলা গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস রচনা করে নানান পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। তিনি অনেক শিক্ষামূলক রচনা ও রম্যরচনা ইংরাজী থেকে বাংলায় অনুবাদও করেন।

১৯৩৩ সালে লীলা বিবাহ করেন দন্ত চিকিৎসক ডাঃ সুধীর কুমার মজুমদারকে। এই বিবাহে তাঁর পিতার প্রবল বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর স্বনির্বাচিত পাত্রকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। পিতৃপরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট থাকলেও পিতার সঙ্গে সম্পর্ক চিরকালের মতো ছিন্ন হয়। বিবাহিত জীবনে লীলা-সুধীর খুব সুখী দম্পতি ছিলেন। স্বামী আজীবন লীলার সাহিত্য চর্চায় উৎসাহী ছিলেন। তাদের এক পুত্র ডাঃ রঞ্জন মজুমদার ও এক কন্যা কমলা চট্টোপাধ্যায়।

তাঁর প্রথম গল্প লক্ষ্মীছাড়া ১৯২২ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় সন্দেশ পত্রিকা পুনর্জীবিত করলে তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ অবধি সাম্মানিক সহ-সম্পাদক হিসাবে পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ১৯৯৪-এ তার স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য অবসর নেন। তার সাহিত্যিক জীবন প্রায় আট দশকের।

পুরস্কার ও সম্মাননা 
তাঁর প্রথম আত্মজীবনী 'আর কোনখানে'-এর জন্য ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্র পুরস্কার পান।
আনন্দ পুরস্কার
ভারত সরকারের শিশু সাহিত্য পুরস্কার
সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার
বিদ্যাসাগর পুরস্কার
ভুবনেশ্বরী পদক
ভুবনমোহিনী দাসী সুবর্ণ পদক
দেশিকোত্তম
ডি-লিট ।
১৯২২ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রথম গল্প "লক্ষীছাড়া" রচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। প্রথম গ্রন্থ "বদ্যিনাথের বাড়ি" (১৯৩৯)। 'চীনেলন্ঠন', 'শ্রীমতী', 'জোনাকি', 'আমি নারী', 'হলদে পাখির পালক', 'পাকদণ্ডী', 'পদি পিসির বর্মীবাক্স', 'বাতাস বাড়ি', 'খেরোর খাতা' প্রভৃতি গ্রন্থ তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি। 'বক বধ পালা', 'লঙ্কাদহন পালা,' তাঁর রচিত নাটক গুলির মধ্যে অন্যতম।
তাঁর সর্ব মোট ১২৫ টি বই প্রকাশিত হয়। যার মধ্যে রয়েছে একটি গল্প সংকলন, পাঁচটি সহ লেখিকা রূপে, নয়টি অনূদিত গ্রন্থ এবং ১৯ টি সম্পাদিত গ্রন্থ। তাঁর প্রথম গ্রন্থ বদ্যি নাথ এর বাড়ি (১৯৩৯) দ্বিতীয় প্রকাশনা ‘দিনদুপুরে’ (১৯৪৮)। তিনি শিশু সাহিত্যের পাশাপাশি, গোয়েন্দা গল্প, ভূতের গল্প লিখেছেন অনেকগুলি।

তার আত্মজীবনী মূলক রচনা ‘পাকদন্ডী’ তে শিলং থাকাকালীন শৈশবের স্মৃতি থেকে শুরু করে শান্তিনিকেতন এবং অল ইন্ডিয়া রেডিও তে কাজের স্মৃতি কে উল্লেখ করেছেন বেশ সুন্দরভাবে। তিনি বাংলাতে অনুবাদ করেছেন- জনাথন সুইফট এর ‘গালিভার ট্রাভেলস’ এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী’। লেখালেখির পাশাপাশি মিডিয়াতে তার কাজের অনেক অনুভব রয়েছে। অল ইন্ডিয়া রেডিও তে মহিলাদের নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান তিনি পরিচালনা করতেন। ১৯৭২ সালে তার ‘পদিপিসির বর্মী বাক্স’ চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়।

ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প মনিমালা, বাঘের চোখ, টাকা গাছ, লাল-নীল দেশ্লাই, বাঁশের ফুল, ময়না, শালিক, আগুনি বেগুনি, টিপুর ওপর টিপুনি, শিবুর ডায়েরি, ফেরারী, এই যে দেখা, শ্রীমতি, পেশা বদল এসব অনেক বিখ্যাত।
অ্যাডভেঞ্চার ও বিজ্ঞানের কল্পনায় তাঁর গল্পগুলি হয়ে উঠেছে অসাধারণ, চিত্তাকর্ষক।' শর্টকাট' তার বিশিষ্ট গল্প যেখানে আছে_ হরিচরণ সামন্ত, ভারতের জরিপ বিভাগের তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন, দক্ষ কর্মচারী, অথচ সংসারের অলিগলি, মন সুড়ঙ্গের হদিস জানা ছিল না বলেই সংসারে কাউকে খুশি করতে পারেননি। সংসার করা তার মতে অখাদ্য ব্যাপার, যেখানে অংক কষা ঠিক, উত্তর ভুল। সেই হরিচরণ একপ্রকার বাধ্য হয়েই পাড়ি দেন ভারতের উত্তর-পূর্ব কোনের অরণ্য ভূমিতে যেখানে সুযোগ পান সময়ের শর্টকাট ব্যবস্থার, যাতে করে তিনি ফিরে যেতে চান ১৫ বছর পূর্বের একটি বিশেষ মুহূর্তে। সেই সময়ে ফিরে গেলে তিনি মনে করতে পারেন দাদা শ্বশুর মশাইয়ের উইল এর কথা, যেটা তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ডবলুর পিছনে গুঁজে রেখেছিলেন। তাঁর এই ভুলে যাওয়া নিয়ে বাড়ি শুধু সকলের সঙ্গে মনোমালিন্য। আবার কখনও কখনও এই ধরনের গল্পগুলিতে বুদ্ধির দীপ্তি দিয়ে অলৌকিকত্বের রহস্যময় আবরণ টিকে সরিয়ে স্পষ্ট করে তোলেন। 'শর্টকাট 'গল্পেই আছে- 'বুনো' অশরীরী অপদেবতা, বনের অমঙ্গল শক্তি, যা ভর করলে মানুষ বনের মধ্যে পথ হারায়। সেখানে তিনি কথকের সংস্কার মুক্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে ই গল্পের ইতি টানেন_"বুনো-টুনো কিছু নয়, ব্যাপার হলো দিকভ্রম। দিকভ্রম হলে মানুষেরা তাদের মানসিক ভারসাম্য হারায়"। 'মাকু' উপন্যাসেও তেমনি অলৌকিকতার বাতাবরণ এর উপর যুক্তিবাদী মনের আলো ফেলে তাকে স্বচ্ছ করে তুলেছেন।

 কোথাও লোমহর্ষক কাহিনী দিয়ে গল্পের শুরু হলেও শেষ হয় তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় দিয়ে। যেমন 'গুপের গুপ্তধন' গল্পে গুপ্তধন উদ্ধার করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে 'শুঁটকি মাছ'। 'হ্যাপার হিসাব' গল্পে অবস্থার বিপাকে পড়া মানুষজনের অতীত থেকে রত্ন উদ্ধারের বৃথা চেষ্টা, অন্যদিকে উন্নতি কে ধরতে গিয়ে ঘোর দুর্দিন ডেকে আনার কথাকে সহজ-সরল ভাষায় পরিবেশন তাঁর সাহিত্যিক হিসেবে অসাধারণ দক্ষতার পরিচায়ক। খালি, এইটুকু মনে রেখো_"যেদিন কাদা চিংড়ির ছ্যাচড়া মুখে রুচবে না, আর বাংলা ভাষা কানে মিষ্টি ঠেকবে না, সেদিন কিন্তু ঘোর দুর্দিন। উন্নতি হইতে সাবধান‌। শেষটা না পা পিছলে আলুর দম হয়।"

শেষ জীবনটা কলকাতাতেই কেটেছিল। পাঠক থেকে আত্মীয়ের ভিড়ে, লেখালিখি আর সম্পাদনার ব্যস্ততায়। একেবারে শেষ দিকে স্মৃতি প্রতারণা করেছিল ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে আপামর বাঙালির স্মৃতিতে শতায়ু লীলার চিরকালীন আসনটি পাতা হয়ে গিয়েছে।
ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে শুধু নয় শহর কেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাতে গড়ে ওঠা কৃষ্ণর মন পাড়ি দিচ্ছে প্রকৃতি ঘেরা মনোরম পরিবেশে প্রকৃতির অঙ্গনে বেড়ে উঠতে জীবনের মেরু বৃত্ত পেরিয়ে সেই কিশোরী মেয়েটি আজ আমাদের মধ্যে আর নেই।

" ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম থেকে... জানলায় দেখা যাচ্ছে বছর তেইশের এক যুবতীর মুখ, প্রত্যয়ী, অথচ বিষণ্ণ। খুব দ্রুত কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়া প্রয়োজন তার।" 

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

লীলাদির কথা ভাবলে মনটা আজও ভাল হয়ে যায়। অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসার সেরা উপায় হল লীলাদির গল্প পড়া। খারাপ সময়কে হারিয়ে দিয়ে ভাল সময় ডেকে আনার এর চাইতে সহজ উপায় আর হয় না।

নবনীতা দেব সেন

বাংলা কেন, যে-কোনও সাহিত্যেই মেয়েদের লেখায় ব্যঙ্গরস, ব্যঙ্গকৌতুক খুব কম। তাই লীলা মজুমদারের লেখা বিশেষ ভাবে ভাল লাগত, এখনও লাগে। তাঁর শাণিত, বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা, প্রাণময়, সুস্থ রসিকতার কোনও তুলনা হয় না। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর, সেই কারণেই রসিকতার মধ্যে দিয়েও প্রতিবাদ করতে পারতেন।


শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

লীলা মজুমদার ছিলেন অদ্ভুত ধরনের এক লেখক। ছোটদের জন্য লেখায় যে-মজা তিনি আনতেন, যা তিনি বোধ করি তাঁর পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছিলেন, আমাকে বরাবর খুব টানত। তাঁর বড়দের জন্য লেখাও আমি সমান আগ্রহে পড়েছি। আভিজাত্য বজায় রেখে রসকে উত্তীর্ণ করা, এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।


বাণী বসু

লীলা মজুমদার নামটা শুনলেই মন আনন্দে ভরে ওঠে। সাহিত্য থেকে জীবনে একজন মানুষ আনন্দকে এতখানি মূল্য দিয়েছেন, এর উদাহরণ কমই আছে। সকলেই তো দুঃখ নিয়ে লিখতে ব্যস্ত। ছোটদের গল্পে যে-শব্দচয়ন বা নামকরণ, তারও জুড়ি নেই। গুপী বা পদিপিসি শুনলেই মাথায় একটা ছবি তৈরি যায়। ছোটদের মনটা উনি খুব ভাল বুঝতেন।
২০০৭ সালে র ৫ এপ্রিল তিনি তাঁর জীবনের সবকিছু রেখে চলে যান নিভৃতে অন্তর্লোকে, রেখে যান অমর কীর্তি সব শিশুসাহিত্য। শিশুমনের সবুজ সতেজ ভাবনার সঙ্গী হয়ে আজও বেঁচে আছে ।একটি পরিচিত নাম হয়ে লীলা মজুমদার।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Thursday 25 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা
পর্ব -০৩

মালঝিটা অঞ্চলের লৌকিক দেব দেবী
=================================Doinik Sabder Methopath
Vol -293. Dt -25.02.2021
১২ ফাল্গুন ১৪২৭. বৃহস্পতিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
কটক মহালের অন্তর্গত মালঝিটা দণ্ডপাট এর গড় ব্রজলাল চকের  অন্তর্গত অরঙ্গা নগরও  সুজা মুঠা নামাঙ্কিত নন্দীগ্রাম ৩ নম্বর ব্লক বর্তমানে বহুল প্রচলিত মঠ চন্ডীপুর। কোন এক সময় জমিদার বেরা বাবুদের চন্ডী মাতার মন্দির ছিল একটি বড় পুকুর ছিল নাম চন্ডীতলা পুকুর সেই থেকে চন্ডীতলা আরো পরে চন্ডিপুর বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা ক্রমে ক্রমে মঠ চন্ডিপুর নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পদস্পর্শ মহতমা গান্ধীর আগমন সুভাষচন্দ্র বসুর অবস্থান এই প্রাচীন জনপদ গৌরবান্বিত করেছে। ব্লক এর উত্তরে হলদি নদী দক্ষিনে ভগবানপুর ২ ব্লক পূর্বে নন্দীগ্রাম 2 নম্বর ব্লক পশ্চিম ভগবানপুর 1 নম্বর ব্লক অবস্থিত. ১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত 114 টি মৌজা ১১১টি  গ্রাম 134 গ্রাম সংসদ ।এখানকার লোক সংখ্যা প্রায় 1 লক্ষ 88 হাজার 119 জন।
চন্ডিপুর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার মানুষজন মূলত ধর্মীয় ভাবনায় পূজো পার্বণ করে থাকেন প্রত্যেক হিন্দুর মধ্যে ইতিহাস বিবর্তনের ধারা বহমান সূর্যোদয়ের পূর্বে ঊষাকাল থেকে সূর্য অস্তমিত হওয়া তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালায় শঙ্খ ঘন্টা সহযোগে সবই নিয়মিত করে আসেন কার্তিক ও ফাগুন মাসে ভোরবেলায় সাজানো সংক্রান্তি একাদশী পূর্নিমা-অমাবর্ষা মেনে চলা নাগপঞ্চমী মনসা মায়ের পুজো শ্রাবণী পূর্ণিমায় দীপান্বিতা কোজাগরী পূর্ণিমা পৌষ মাসে বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজো লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়া সবকিছুই এই অঞ্চলে প্রচলিত আছে মেয়েদের মধ্যে এবার পুজো অর্চনা পুষ্পাঞ্জলী প্রচলিত এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন লৌকিক দেব দেবী অবস্থান কোথাও খোলা আকাশের নিচে কোথাও গাছের তলায় কোথাও শানবাঁধানো কোথাও মন্দির কোথাও খোলামঞ্চ বছরের বিভিন্ন সময় লোকাচার মেনে শাস্ত্র মেনে নানা পূজো পার্বণ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে মানুষজনের আনাগোনা দোকানদার সবমিলিয়ে এলাকায় একটি ধর্মীয় ভাবনার প্রকাশ চলে আসছে লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারা ধরে লৌকিক দেব দেবী উদ্ভব বিস্তার পূজা-পার্বণ এই অঞ্চলের মানুষজন করে থাকেন বিশেষ করে প্রাচীন নানা প্রসঙ্গ কে সামনে রেখে এই পূজা অর্চনা হয়ে আসে আমরা এই অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় যেসব দেব-দেবীর মন্দির পূজা অর্চনা হয়ে থাকে তার একটি তালিকা নিম্নে দেওয়ার চেষ্টা করলাম

এমনই আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ধারা বা পর্ব এগিয়ে চলবে দৈনিক শব্দের মেঠোপথ পত্রিকার উদ্যোগে প্রতিদিন একটি অঞ্চলের অঞ্চলের লৌকিক দেব দেবী পূজো পার্বণ উৎসব-অনুষ্ঠান সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা থাকবে আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে এজাতীয় আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্র সমীক্ষা গুলি।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Wednesday 24 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
          আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা 
                  পর্ব -২
খেজুরির লৌকিক দেব দেবী
       ( খেজুরি২ ব্লক এলাকা)

=================================
      Doinik Sabder Methopath
      Vol -292. Dt -24.02.2021
        ১১ ফাল্গুন, ১৪২৭. বুধবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
প্রায় পাঁচশো বছর আগে খেজুরির ভূস্তর বসবাসযোগ্য হলে হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে প্রথমে বসতি স্থাপন করে জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ । মাছ ধরে জীবনধারণ যাদের উদ্দেশ্য ছিল ।পরবর্তী সময়ে আসে চাষী সম্প্রদায়ের মানুষ। চাষ করে যারা জীবিকা নির্বাহ করত। সাধারণভাবে জেলে কৈবর্ত ও হেলে কৈবর্ত সহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নানান মানুষ ধীরে ধীরে এই বন্দর এলাকায় বসবাস শুরু করেন।  হিজলি ও খেজুরি দুটি বন্দর গড়ে ওঠে সময়ের বিবর্তনে। মানুষজনের বিশ্বাস ও আশা ভরসা কে সামনে রেখে গড়ে ওঠে ধর্মভাবনা।  এই ধর্ম ভাবনার বিষয় জুড়ে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষেরা গড়ে তোলেন তাদের লৌকিক দেব দেবীর নানান ইতিহাস। যাদেরকে ঘিরে সারা বছর নানান অনুষ্ঠান পূজো পার্বণ লেগেই থাকে খেজুরি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মানুষের মধ্যে জাত পাত ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়। মিলনের পর্ব গড়ে ওঠে । নানান জীবিকার মানুষ অংশ নেয় এইসব উৎসব অনুষ্ঠানে। তাদের জীব-বৈচিত্র, আর্থসামাজিক পরিমণ্ডল ও ভালোলাগার বিষয়গুলিকে সামনে রেখে।
   পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহাকুমার অধীনে খেজুরি থানা. হুগলি নদীর মোহনার সামান্য উত্তর দিকের পশ্চিম তটবর্তী অঞ্চল খেজুরি।এই থানার দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে রসুলপুর নদী, ওপারে কাঁথি দু'নম্বর ব্লক। ওই থানার উত্তর দিকে নন্দীগ্রাম থানা ও পশ্চিম ভূপতি নগর থানা। পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে হুগলি নদীর স্রোতধারা চারিদিকের সীমা বন্দি এই বিভাগটি হুগলি মোহনার জলরাশির মধ্য থেকে উত্থিত একটি ভূমি ভাগ। এই ভূখণ্ডটির জন্ম প্রায় 400 বছর আগে ।বসবাসযোগ্য হওয়ার পর এখানে মুসলমান রাজত্ব চলে কয়েক দশক ব্যবসা সূত্রে ওলন্দাজ পর্তুগিজ ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে শত বৎসর চালান স্বাধীনতা আন্দোলন থানা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী এলাকাটি তপশিলি এলাকা হিসেবে পরিচিত হয় ।১৯৮১ সালে খেজুরি থানা দুটি ব্লকে বিভক্ত হয়- খেজুরি ১ ও খেজুরি ২ ব্লক.
    মূলত হিন্দু মুসলমান ধর্মের মানুষজনের বসবাস থাকলেও দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে আচার-আচরণ ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে কিছু ভাগ আছে মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি বিভাজন যেমন আছে তেমনি হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব কৈবর্ত কায়স্থ পৌন্ড্রক্ষত্রিয় ধোপা নাপিত হাড়ি মাহিষ্য করণ ভট্টাচার্য সম্প্রদায়ও রয়েছে এসব কে কেন্দ্র করে জাতিদের দ্বন্দ্ব একসময় তীব্র ছিল ।এর প্রভাব ধর্মচর্চায় পড়েছে।  মুসলমানদের মধ্যে রয়ে গেছে দুটি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যার প্রভাব মসজিদে আমরা লক্ষ্য করি। প্রথম শনিবার এক মুসলমান সম্প্রদায় ওখানে গিয়ে ধর্ম পালন করে অন্য সম্প্রদায় তৃতীয় শনিবার গিয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করেন। হিন্দুদের ক্ষেত্রে জাত পাতের ভেদাভেদ কে কেন্দ্র করে উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের ভেদাভেদ সৃষ্টি হওয়ায় মন্দির গড়া নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ ছোট-বড় এসব এখনো রয়ে গেছে তবুও মানুষের মধ্যে ধর্ম ভাবনার প্রবল প্রকাশ লক্ষ্য করি নানান ধর্মীয় উৎসবের মধ্য দিয়ে,লোক উৎসবের মধ্য দিয়ে।
      প্রাচীন খেজুরির ধর্মভাবনা থেকে আধুনিক খেজুরির জনগণ কিভাবে নিজেদেরকে প্রাণিত করেছে,  উদ্বুদ্ধ করেছে তার একটি ইতিহাস রচনার প্রয়োজন। সেই কথা মাথায় রেখে খেজুরি 2 ব্লক এলাকার 5 টি অঞ্চলে পূজিত লৌকিক দেব দেবীর একটি তালিকা প্রকাশ করা হলো।

আগামী দিনে এইসব দেবদেবীর উদ্ভব, মহিমা পুজোর পদ্ধতি, বিশ্বাস ও সংস্কার, ভক্তদের অভিব্যক্তি সহ নানান বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে। 


Tuesday 23 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
        জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
=================================
      Doinik Sabder Methopath
      Vol -291. Dt -23.02.2021
         ১১ ফাল্গুন, ১৪২৭. মঙ্গলবার
++++++++++++++++++++++++++++++++++
কালিপ্রসন্ন ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৪০ সালে উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত "সিংহ" পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন নন্দলাল সিংহ। তার পিতামহ জয়কৃষ্ণ সিংহ ছিলেন হিন্দু কলেজের একজন পরিচালক। কালীপ্রসন্নের মাত্র ছয় বছর বয়সে তার পিতা মারা যান। বাবু হরচন্দ্র ঘোষ, যিনি নিম্ন আদালতের বিচারক ছিলেন, পিতার মৃত্যুর পর তার অভিভাবক হিসাবে নিযুক্ত হন।

শিক্ষাজীবন 
বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ হিসাবে পরিচিত, তত্‍কালীন হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ । ১৮৫৭ সালে তিনি কলেজ ত্যাগ করেন। তিনি বাড়িতেই তার ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি মিস্টার ক্রিকপ্যাট্রিক (ইংরেজি: Mr.Kirkpatrick) নামক একজন ইউরোপীয় শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে তার ইংরেজির জ্ঞান উন্নত করেছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি একজন লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক, একজন লোকহিতৈষী, একজন সামাজিক কর্মী, এবং শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির একজন মহান পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অবদান রেখে গেছেন।

তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনকালে, কালীপ্রসন্ন অবিশ্বাস্য বহুমুখী গুণাবলির একজন মানুষ ছিলেন। খুব অল্প বয়স থেকে তিনি অদ্ভুত স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন, মাত্র একবার দেখলে কিংবা শুনলেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তার বাংলাভাষা চর্চার জন্য বিদ্যোৎসাহিনী সভা প্রতিষ্ঠা এই ক্ষমতার অদ্ভুত ক্ষমতার একটি সাক্ষ্য বহন করে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই তরুণের অনেক বৃদ্ধ সহযোগীদের সঙ্গে একাত্মতা এবং এই ধরনের বিনোদনমূলক থিয়েটারের সংগঠন হিসাবে তাদের এই কাজে ব্রতী করতে পারা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। হুতোম প্যাঁচার নক্‌শা হল তার সেই অমর সৃষ্টি যেখানে ঊনবিংশ শতকের কলকাতার বাবু সম্প্রদায়ের একটি পরিষ্কার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তার উপন্যাস সেই সময় (Those Days) লেখার সময়, প্রতীকী হিসাবে কালীপ্রসন্ন চরিত্রের পুনঃনির্মাণ করে নবীনকুমার নামে সমকালিক চরিত্রের অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়েছেন।

কালীপ্রসন্ন ১৮৫৪ সালে বাগবাজারের লোকনাথ বসুর কন্যার সঙ্গে বিবাহ করেন, কিন্তু কয়েক বছর পর তার স্ত্রী বিয়োগ হয়। কিছুদিন পরে, কালীপ্রসন্ন রাজা প্রসন্ননারায়ণ দেবের পৌত্রী এবং চন্দ্রনাথ বসুর কন্যা শরত্‍কুমারী দেবীকে বিবাহ করেন।

রচনা কর্ম :

বাবুনাটক (১৮৫৪)
বিক্রমোর্বশী নাটক (১৮৫৭)
সাবিত্রী-সত্যবান নাটক (১৮৫৮)
মালতী-মাধব নাটক (১৮৫৯)
হিন্দু পেট্রিয়ট সম্পাদক মৃত হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্মরণার্থ কোনো বিশেষ চিহ্ন স্থাপন জন্য বঙ্গবাসিবর্গের প্রতি নিবেদন (১৮৬১)
হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬১)
পুরাণ সংগ্রহ বা কালীসিংহের মহাভারত (মহাভারত অনুবাদ, ১৮৫৮-৬৬)
বঙ্গেশ বিজয় (১৮৬৮)
শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা (১৯০২)

কালীপ্রসন্ন বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা, পরিদর্শক,সারবত্ত্বা প্রকাশিকা ও বিভিধার্থ সংগ্রহ প্রভৃতি পত্রিকার মত পত্রিকাগুলির সম্পাদনা অথবা প্রকাশনা করেছিলেন। পরিদর্শক পত্রিকাটি ছিল একটি বাংলা দৈনিক যেটা শুরু করেছিলেন জগন্মোহন তর্কালঙ্কার এবং মদনগোপাল গোস্বামী। সংবাদপত্রটির উন্নতির জন্য, কালীপ্রসন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। সংবাদপত্রটির মান সেই সময় এগিয়ে ছিল, এবং কৃষ্ণদাস পাল লিখেছিলেন, "তিনি একটি প্রথম শ্রেণীর স্বদেশীয় দৈনিক সংবাদপত্রও শুরু করলেন, যার মত আমরা এখনো দেখিনি"। সুপরিচিত স্থানীয় ভদ্রলোক বাবু রাজেন্দ্রলালের দ্বারা বিভিধার্থ সংগ্রহ প্রথম সম্পাদিত হয়েছিল। তার পরে পত্রিকাটি কালীপ্রসন্ন সিংহের তত্ত্বাবধানে পুনর্জাগরিত হয়েছিল। ১৮৬২ সালে তার সবচেয়ে প্রশংসিত রচনা হুতোম প্যাঁচার নক্‌শা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি এই বইয়ে হুতোম প্যাঁচা ছদ্মনামে এক রসাত্মক পদ্ধতিতে তত্‍কালীন মধ্যবিত্ত সমাজের কার্যকলাপের সমালোচনা করেছিলেন। তৎকালীন কলকাতার আচার ব্যবহার, পালা-পার্বণ, সভা-সমিতি প্রভৃতি সামাজিক উৎসব এবং নানা ঘটনা হুতোম প্যাঁচার নক্‌শায় সরসভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। হুতোম প্যাঁচার নক্‌শা ছিল কথ্য ভাষায় লেখা প্রথম বাংলা বই। এই বইতে কোন কোন মান্য ব্যক্তির প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছিল তাই এর প্রতিবাদে এইরকমের দু-একটি বইও লেখা হয়েছিল। তিনি তত্তবোধিনী পত্রিকা, সম্প্রকাশ, মুখার্জ্জীস ম্যাগাজিন, বেঙ্গলি এবং হিন্দু প্যাট্রিয়ট -এর মত পত্রিকাগুলিকেও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন।
এছাড়াও ১৮৬৩ সালে কালীপ্রসন্ন সিংহকে অবৈতনিক শাসক (ইংরেজি: Honorary Magistrate) ও ন্যায়পাল (ইংরেজি: Justice of Peace) হিসাবে নিয়োগ করা হয়। তিনি একদা কিছু সময়ের জন্য কলকাতার মুখ্য পুরশাসক (ইংরেজি: Chief Presidency Magistrate) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কলকাতার পুরাধ্যক্ষ (ইংরেজি: Municipal Commissioner) নির্বাচিত হন। তাঁর ব্যয়ের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলনা এবং তাঁর দানেরও কোন শেষ ছিলনা, যার ফলে কালীপ্রসন্ন তার জীবনের শেষ কয়েক দিন সময় বিপুল আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে কাটিয়েছিলেন।

মৃত্যু 

তিনি তাঁর বিশাল অবদান পিছনে ফেলে রেখে, মাত্র ২৯ বছর বয়সে ২৪শে জুলাই ১৮৭০ ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোক গমন করেন। 
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Sunday 21 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য


ভূদেব মুখোপাধ্যায়


              হুমায়ুন কবির
=================================
Doinik Sabder Methopath
     Vol -290. Dt -22.02.2021
      ৯ ফাল্গুন, ১৪২৭. সোমবার
≠================================

তিনি ১৮২৭ সালের  ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর কলকাতার ৩৭, হরিতকী বাগান লেনের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন৷ হুগলি জেলার খানাকুল থানার অন্তর্গত নতিবপুর গ্রাম তাঁদের আদিনিবাস৷ তিনি প্রথমে সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনা করেন । তারপর তিনি হিন্দু কলেজে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হন। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি মাসিক ৪০ টাকা বৃত্তি পেতেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার সহপাঠী ছিলেন । তার পিতার নাম বিশ্বনাথ তর্কভূষণ। 
১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজ ত্যাগ করেন এবং কিছুদিন হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয়ে এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত চন্দননগর সেমিনারীতে শিক্ষকতা করেন। ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা মাদ্রাসায় ইংরাজি বিভাগের দ্বিতীয় শিক্ষক হিসাবে সরকারী শিক্ষাবিভাগে যোগ দেন। ১৮৬৪ সালে তিনি বিদ্যালয়সমূহের অতিরিক্ত বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাজে যোগ দেন। এরপর তিনি বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসের প্রথম শ্রেনীতে উন্নীত হন। এরপর তিনি হান্টার কমিশনের (এডুকেশন কমিশন) সদস্য হিসাবে ২৩ জুলাই ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। 
১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষার উপরে শিক্ষাদর্পণ নামে দু আনা দামের মাসিক পত্রিকা পরিচালনা করেন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে চুঁচুড়া থেকে সরকারী পত্রিকা এডুকেশন গেজেট এবং এবং সাপ্তাহিক বার্তাবহ পত্রিকা সম্পাদনা করেন । তার বহু প্রবন্ধ ও বই সাপ্তাহিক বার্তাবহ পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী। তার রচিত স্বপ্নলব্ধ ভারতের ইতিহাস বইতে কাল্পনিক ঘটনার সাহায্যে তিনি ভারতের জাতীয় চরিত্রের দুর্বলতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করেন। তার রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস বইতে সফল স্বপ্ন এবং অঙ্গুরীয় বিনিময় নামে দুটি গল্প ছিল। এগুলি ছিল বাংলা ভাষায় লিখিত দ্বিতীয় উপন্যাসধর্মী রচনা। প্রথম উপন্যাসধর্মী রচনা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নববাবুবিলাস (১৮৫২)। অঙ্গুরীয় বিনিময় গল্পটির কাহিনী কিছুটা ইতিহাস থেকে নেওয়া হলেও গল্পটিকে মৌলিক রচনার পর্যায়ে ফেলা যায়। বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের এখানেই সূত্রপাত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে অঙ্গুরীয় বিনিময় গল্পের কিছুটা প্রভাব আছে। ভূদেব মুখোপাধ্যায় রচিত অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পারিবারিক প্রবন্ধ, সামাজিক প্রবন্ধ, আচার প্রবন্ধ, বিবিধ প্রবন্ধ, পুষ্পাঞ্জলি, এবং বিদ্যালয় পাঠ্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ক্ষেত্রতত্ত্ব, পুরাবৃত্তসার, বাঙলার ইতিহাস, ইংল্যান্ডের ইতিহাস, রোমের ইতিহাস প্রভৃতি। 

হিন্দি ভাষার উন্নতির জন্য তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন। স্কুল পরিদর্শক থাকাকালীন বিহারে বহু হিন্দি স্কুল স্থাপন, বাংলা বইয়ের হিন্দি অনুবাদ প্রকাশ ও মূল হিন্দি বই লেখায় তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তারই প্রস্তাবে বিহারের আদালতে ফারসির পরিবর্তে হিন্দি ব্যবহার শুরু হয়। সংস্কৃত ভাষার উন্নতির জন্য তিনি তার পিতার নামে বিশ্বনাথ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছিলেন এবং চতুষ্পাঠীর শিক্ষকদের বৃত্তিদান করতেন। এছাড়াও বিশ্বনাথ চতুষ্পাঠী এবং মায়ের নামে ব্রহ্মময়ী ভেষজালয় স্থাপন করেছিলেন।

১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিআইই উপাধি পান। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সভ্য ছিলেন। ভূদেব ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দীর্ঘ পাঁচ বছর শিক্ষাবিষয়ক মাসিক পত্রিকা শিক্ষাদর্পণ ও সংবাদসার পরিচালনা করেন এবং ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারি পত্রিকা এডুকেশন গেজেট (১৮৫৬)-এর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 

ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা গদ্যের বিশিষ্ট শিল্পী। তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর বিশিষ্ট কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থ হলো: পারিবারিক প্রবন্ধ (১৮৮২), সামাজিক প্রবন্ধ (১৮৯২), আচার প্রবন্ধ (১৮৯৫), বিবিধ প্রবন্ধ (১৮৯৫) ইত্যাদি

১৫ মে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
==================================

বাংলাদেশের ফরিদপুরের কোমরপুর গ্রামে ১৯০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর কবিরুদ্দিন আহমদ তাঁর পিতা। নওগাঁ কে.ডি. স্কুল থেকে ইংরেজিতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক (১৯২২) পাস। অতঃপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি। এই কলেজ থেকে ইংরেজিতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে তৃতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. (১৯২৪), ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এ. অনার্স (১৯২৬) এবং ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম. এ. (১৯২৮) ডিগ্রি লাভ। সরকারি বৃত্তি পেয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ইংল্যান্ড গমন (১৯২৮)। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একসেটর কলেজে ভর্তি। অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সেক্রেটারি নির্বাচিত। অক্সফোর্ড থেকে দর্শন, ইতিহাস ও অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বি. এ. অনার্স ডিগ্রি লাভ (১৯৩১)।১৯৩১ সালে এশিয়া বাসীর মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম অক্সফোর্ডের মর্ডান গ্রেটস পরীক্ষায় প্রথম হন। তিনিই প্রথম এশিয় যিনি অক্সফোর্ডের হাবার্ট স্পেন্সারের প্রথম বক্তৃতা দেন এবং প্রথম এশিয়া সাহিত্য সম্মেলন প্রথম এশিয়া সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। ভারত সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা মন্ত্রী রাজ্যসভার সদস্য প্রভৃতি পদে তিনি কাজ করেছেন। তিনি দুবার শিক্ষা মন্ত্রী দায়িত্ব মর্যাদার সঙ্গে পালন করেছেন। প্রথমবার ডক্টর জহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভায়। পরে তিনি আরেকবার। এছাড়াও তিনি বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিভাগের দায়িত্ব সামলেছেন যথার্থ সম্মানের সঙ্গে।
রচনা কর্ম :
  প্রবন্ধ গ্রন্থ - 
   ইমানুয়েল কান্ট (১৯৩৯), বাঙলার কাব্য (১৯৪২), মার্কসবাদ (১৯৪৮), শিক্ষক ও শিক্ষার্থী (১৯৫৭), শরৎ সাহিত্যের মূল তত্ত্ব (১৯৫৮), মীর্জা আবু তালিব খান (১৯৬১)
Poetry, Monads and Society (1941)
Muslim Politics in Bengal (1943)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৪৫), দিল্লি-ওয়াশিংটন মস্কো (১৯৬৪) প্রকৃতি।
    কাব্যগ্রন্থ : 
                 স্বপ্নসাধ,  সাথী
    উপন্যাস :
                    নদী ও নারী (১৯৬১)
    সম্পাদনা : 
          ত্রৈমাসিক সাহিত্যয পত্রিকা চতুরঙ্গ এর সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি কৃষক , নবযুগ নয়াবাংলা পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।

প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর মননশীল ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা সাহিত্যকে নতুন পথ দেখিয়েছে। তিনি তাঁর প্রবন্ধে সর্বদা চেষ্টা করেছেন যুক্তির শৃঙ্খলা ও তথ্যের সমাহার সুখপাঠ্য করে তুলতে। যেমন -
   ১)  মানব কল্যাণ বিষয়ে  -
     " সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে সমস্ত পৃথিবী সংঘটিত না হলে যে মানুষের কল্যাণের কোন সম্ভাবনা নাই এ বিষয়ে বর্তমান চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বোধহয় সকলেই একমত ।"
২) সমাজ বাস্তবতা বিষয়ে -
      " যতদিন মানুষ মানুষকে শোষণ
 করবে ততদিন আন্তর্জাতিক ও আন্তর্জাতিক শোষণের শেষ নেই। যতদিন মানুষ মানুষকে দাস করে রাখবে ততদিন মানুষের দুঃখ দৈন্যের অবসান হতে পারে না।"
৩) জাতীয়তাবোধ 
     " অনেকেই ভাবেন যে ইউরোপের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এশিয়া বুঝি স্থান পায়না - তাঁরা ভুলে যান যে ইউরোপের নেতৃত্ব অত্যন্ত সাম্প্রতিক।"
৪) দার্শনিক প্রত্যয় 
     " প্রতি দেশেই আমরা দেখি যে একদিকে বিলাসের প্রাচুর্য ও প্লাবন এবং অন্যদিকে অভাব যন্ত্রণার নিদারুণ নিপীড়ণ। সমাজের এ অসুস্থ অবস্থায় সমাজের শান্তি থাকতে পারে না এবং সমাজের মধ্যে অন্তর্নিহিত অশান্তি রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংঘর্ষে তাই আত্মপ্রকাশ করে।"
৫) ভারতবর্ষের মুক্তি প্রসঙ্গ 
       " স্বাধীন ভারত বর্ষ তাই কেবলমাত্র ভারতবাসীর জন্য নয় বরং সমস্ত পৃথিবীর কৃষক-শ্রমিকের মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় . ভারতবর্ষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্থিতি ভারতবর্ষের ইতিহাস ঐতিহ্য ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সংগঠন এই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করে বর্তমান পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপ নির্ণয় করতে হবে । কারণ সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন ভারতবর্ষেই হবে ভবিষ্যৎ বিশ্ব সমাজতন্ত্রের ভিত্তি।"
১৯৬৯ সালে ১৮ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
================================

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
     আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

====={====={======{======{======{==
    Doinik Sabder Methopath
     Vol - 289. Dt -21.02.2021
       ৮ ফাল্গুন, ১৪২৭. রবিবার
÷÷÷×÷××××××××××××÷÷÷÷÷÷÷÷÷×××׶÷÷÷
"মোদের গরব মোদের আশা
 আ মরি বাংলা ভাষা …..."
বা
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো
একুশে ফেব্রুয়ারি"....


বাংলা ভাষার প্রতি যথার্থ সম্মান জ্ঞাপক যেসব আন্দোলন হয়েছিল তার মধ্যে ১৯৫২ সালে ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গ, ১৯৫৬ সালে পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চল এবং ১৯৬১ সালে অসম করিমগঞ্জ শিলচর ইত্যাদি সংঘটিত আন্দোলন ই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চরম প্রকাশ ঘটে। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালামসহ কয়েকজন ছাত্রযুবা হতাহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ভাষাশহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি।
১৯৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে 'বাংলা ভাষা প্রচলন বিল' পাশ হয়। যা কার্যকর হয় ৮ মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে।
কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে।সে সময় সেক্রেটারী জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে এ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ শে জানুয়ারী রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন। পরে রফিক, আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজিভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড”-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং চিঠির একটি কপি ইউএনওর কানাডীয় দূত ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করা হয়।

১৯৯৯ সালে তারা জোশেফের সাথে ও পরে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন, আনা মারিয়া পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫ টি সদস্য দেশ – কানাডা , ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে। তারপর বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দানে ২৯টি দেশ অনুরোধ জানাতে কাজ করেন।

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়  এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ। - এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। মে মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

জেলার অন্যান্যয জায়গার মতো খেজুরী সাহিত্য সম্মিলনীর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন (৭তম বর্ষ ) পালিত হলো, নানান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে।

হেঁড়িয়া,২১ ফেব্রুয়ারি : হেঁড়িয়ার উদাখালী বাসস্ট্যান্ডে খেজুরী সাহিত্য সম্মিলনীর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালিত হলো মাতৃভাষা বিষয়ক আলোচনা, কবিতা -ছড়া পাঠ, আবৃত্তি , সংগীতের মধ্য দিয়ে। সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠনের সভাপতি সুমন নারায়ন বাকরা। স্বাগত ভাষণ দেন ড. বিষ্ণুপদ জানা। মাতৃভাষা বিষয়ক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন পার্থসারথি দাশ, স্বপন মন্ডল,সুদর্শন সেন,দূর্গা দাস, ধীরেন্দ্রনাথ প্রধান,জয়দেব মাইতি , কানাইলাল জানা, বৃন্দাবন দাস অধিকারী , কুন্তলকান্তি মন্ডল, শক্তিপদ মাইতি প্রমুখ । মাতৃভাষা বিষয়ক স্বরচিত কবিতা-ছড়া পাঠে অংশগ্রহণ করেন অজিত জানা, সমরেশ পড়্যা, সুনীল দাস, নিশিকান্ত ভূঞ্যা,প্রদীপ শাসমল, রবীন্দ্রনাথ দাস অধিকারী। সংগীত পরিবেশন করেন মধুমিতা গিরি ও সুভাষচন্দ্র ঘোড়াই। ড. বিষ্ণুপদ জানা সম্পাদিত ' শব্দের মেঠোপথ ' পত্রিকার ' হৃদয় রঙে অমর ২১ ' বিশেষ সংখ্যাটি ও খেজুরী সাহিত্য সম্মিলনীর দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করেন ড. রামচন্দ্র মন্ডল ও ড. প্রবালকান্তি হাজরা। 
প্রকাশিত হয় শব্দের মেঠোপথ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা" হৃদয়ের রঙে অমর ২১" (২য় বর্ষ) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে । সম্পাদনা ড. বিষ্ণুপদ জানা।. মোট জেলাসহ কলকাতার ৩৩ জন কবি ভাষা দিবস কে মনে রেখে তুলিতে  রক্তের টান দিয়েছেন । 
       যারা লিখেছেন - 
       অজিত জানা অঞ্জন কুমার দাস অনিমেষ মন্ডল অভিজিৎ সাউ অমিত কাশ্যপ কাজী শামসুল আলম খুকু  ভূঞ্যা,   গোবিন্দ মোদক চন্দন মাইতি জয়দেব মাইতি, তপন কুমার গোস্বামী দুর্গাদাস মিদ্যা নন্দিনী সর্কার ড. নির্মল কুমার বর্মন নীতা সরকার বনশ্রী রায় দাস , বিকাশ চন্দ বিশ্বজিৎ রায় ভগীরথ সর্দার মোনালিসা পাহাড়ি রজত দাস রাজিব ঘাঁটি লক্ষীকান্ত মন্ডল শুভময় দাস শুভ্রাশ্রী মাইতি শ্রাবণী বসু সঞ্জয় সোম  সমরেশ সুবোধ পড়িয়া সাতকর্ণী ঘোষ সুবীর ঘোষ ও সুব্রত ঘোষ। 
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Saturday 20 February 2021

দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
       যাত্রাপালা একাল সেকাল
=================================
     Doinik sabder methopath
Vol 288. Dt - 20.02.2021
   ৭ ফাল্গুন, ১৪২৭ । শনিবার
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাবো না’- মান্নাদের কণ্ঠে বিখ্যাত গান| কিন্তু যাত্রার আকর্ষণ এমনি যে না গিয়েও পারা যাবে না। বাংলার জনজীবনের এমনই এক অবিচ্ছেদ্য বিনোদন ছিল যাত্রা।


বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বাঙালির এককালের বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ যাত্রাপালা। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, হাতের মুঠোয় বিনোদনের সহজলভ্যতা, অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আবর্তে পড়ে বাঙালির লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য এই যাত্রাপালা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। একই কারণে উঠে যাচ্ছে সার্কাস-পুতুল নাচ। গ্রামীণ মেলাগুলো তেমন আর জমছে না। এখন আর সন্ধ্যা নামলেই মেলা থেকে লাউড স্পিকারে আর ভেসে আসে না- ‘হৈ হৈ কান্ড, রৈ রৈ ব্যাপার...অদ্য রজনীর বিশেষ আকর্ষণ...’।

যাত্রাপালা দেখার জন্য দর্শকরা রাতভর বিনিদ্র থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আর অপেক্ষায় প্রহর গোণেন না। শীতে মেলা বসবে, যাত্রাপালা আসবে—সেই প্রতীক্ষায় থাকে না আর গ্রামের মানুষ। এখন যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ মানেই কদর্য নৃত্য-জুয়া-হাউজির ধুন্ধমার কারবার। ফলে যাত্রার কথা মনে হলে পুরান, ইতিহাস, মহর্ষী ব্যক্তিত্ব বা লোকজ সাহিত্যে বিখ্যাত চরিত্রের কথা আর মানস পটে ধরা দেয় না, উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে স্বল্প পোশাকে কথিত প্রিন্সেসদের উদ্বাহু- নাচ-গানের অশালীন দৃশ্য। মূলত: যাত্রাদলের অতি মুনাফালোভী মালিকদের খপ্পরে পড়ে গত তিন দশকে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে এই শিল্প। দুই দশক আগেও সারাদেশে তিন শতাধিক যাত্রাদল ছিল। কমতে কমতে এখন সর্বোচ্চ টিকে আছে মাত্রা ৩০ টি। যাত্রার এই করুণ দশার কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন এই শিল্পের মানুষগুলো। বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে তাদের অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরকার যাত্রা শিল্পের জন্য নীতিমালা ও নিবন্ধনের ব্যবস্থা করলেও এই শিল্পের মরণদশা কাটছে না। সারাদেশে অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে যাত্রাপালার অনুমোদন। কোন কোন জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনুরোধে ডিসি এবং এসপি’রা অনুমোদন দিলেও যাত্রা-পুতুল নাচের নামে অশ­ীল-নোংরা নৃত্য, জুয়া-হাউজির আসর বসানোর কারণে স্থানীয় জনগণের চাপের মুখে তা আবার বন্ধ করে দেয়া হয়।

বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে এবং বাংলাদেশের ‘যাত্রাসম্রাজ্ঞী’ বলে খ্যাত জ্যোত্স্না বিশ্বাস বলেন, যাত্রা শিল্পের অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ অসাধু যাত্রাপালা ব্যবসায়ীদের ‘প্রিন্সেস’ আমদানি আর জুয়া-হাউজি চালু । তারা বলেন, এই শব্দগুলো আগে যাত্রা দলে ছিল না। ১৯৭৮-৭৯ সালের পর এই অশ­ীলতার সূচনা হয়েছিল মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। তাদের কাছেই চিরায়ত যাত্রাপালার মৃত্যু ঘটে। প্রিন্সেস নৃত্য শুরু হয় রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের যাত্রা প্যান্ডেলে।
নব্বইয়ের দশকে প্রিন্সেসদের দাপট চলে। এ কারণে শুরু হয় যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞা তারপর আবার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার— সাপ নেউলের খেলায় শেষতক এই শিল্পের পতন ঘটে।

তারা বলেন, যাত্রাপালায় অশ­ীলতা ঢুকে পড়ায় সাধারণ দর্শকরা যাত্রাপালা থেকে বিমুখ হয়েছে। তবে সুস্থ যাত্রাপালা দেখতে এখনো দর্শকের অভাব হবে না।

দেশ অপেরা’র মালিক মিলন কান্তি দে বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। দেশে যেখানে ৩০০-এর বেশি যাত্রা দল ছিল, এখন ৩০টি দলও সংগঠিত হচ্ছে না। প্রায় তিন বছর ধরে যাত্রাপালা বন্ধ। যাত্রার মতোই সার্কাস এবং পুতুল নাচও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কারণ সবখানেই অশ­ীলতার প্রকোপ। তিনি বলেন, যাত্রাপালার সোনালী সময় ছিল ৬০-৭০-৮০ দশকে। ১৯৮৭-৮৮ যাত্রাদলের সংখ্যা বেড়ে তিন শতাধিক হয়। শিল্পকলা একাডেমিতে ১১১ টি দল নিবন্ধন করেছে। তবে টিকে আছে ৩০ টির মতো। গত বছরও ৫৭ টি দল ছিল। প্রতি বছর কমছে।

জানা যায়, বাংলাদেশে আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত সাত মাস যাত্রার ভরা মৌসুম। যাত্রার মৌসুম শুরু হয় দুর্গা পূজায় আর শেষ পয়লা বৈশাখে। এ বছর কোনো যাত্রাপালা হয়নি। শুধু সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলোতে শ্রমিকদের আয়োজনে কয়েকটি পালা হয়েছে। গত বছরও ছিল একই অবস্থা।

যাত্রাশিল্পের নেতারা জানান, ১৯৭৫ সালের পর থেকেই যাত্রাপালা আয়োজনের ওপর বিধিনিষেধ আসতে থাকে। মাঝের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল ব্যতিক্রম। এই সময় অবস্থা ছিল সবচেয়ে ভালো। তারপর থেকে আবার বিধিনিষেধ বাড়তে থাকে। তাদের বক্তব্য, ‘প্রশাসন এখন যাত্রার নামই শুনতে চায় না।’

শিল্পকলা একাডেমি প্রতিবছর যাত্রা দলের নাম নিবন্ধনের জন্য প্রত্যেক দলের কাছ থেকে টাকা নেয়। কিন্তু তারাও যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে বিশেষ কিছুই করে না। স্বাধীনতার পর থেকে সাকল্যে পাঁচবার জাতীয় পর্যায়ে যাত্রা উত্সবের আয়োজন করেছিল শিল্পকলা একাডেমি। প্রথম জাতীয় যাত্রা উত্সব হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, আর শেষবার হয়েছে ১৯৯৫ সালে। এ ছাড়া শিল্পকলা একাডেমি ঢাকায় বাছাই করা সাতটি দল নিয়ে সপ্তাহব্যাপী যাত্রা উত্সব করেছিল তিনবার। ২০০৬ ও ২০০৮ সালে, তারপর সর্বশেষ হয়েছে ২০১০ সালে। এরপর থেকে যাত্রা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির আর উত্সাহ চোখে পড়ে না।

মিলন কান্তি জানান, যাত্রাশিল্পের সঙ্গে বহু লোকের জীবিকাও জড়িত। প্রতিটি দলে শিল্পী, কলাকুশলী মিলিয়ে অর্ধ শতাধিক লোক থাকে। এ হিসাবে তিন শতাধিক যাত্রা দল অন্তত ১২ থেকে ১৫ হাজার লোকের জীবিকার সংস্থান ছিল। পালা মঞ্চস্থ না হওয়ায় এসব মানুষ বেকার হয়ে পড়েন। অনেকেই চলে গেছেন অন্য পেশায়। অনেক দক্ষ অভিনেতা—অভিনেত্রী, গায়ক বাদক, পালাকার চলে গেছেন দল ছেড়ে।

জানা যায়, যাত্রাপালার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। যাত্রা’র সূচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর আগে। তখন মানুষ দেব-দেবীদের বন্দনা করতো। তখন দল বেঁধে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ‘যাত্রা’ করার থেকে এর নাম ’যাত্রা’। ১৫০৯ সালে যাত্রার সাথে শ্রী চৈতন্য দেবের সময়ে যাত্রায় অভিনয় যুক্ত হয়। ‘রুক্ষ্মীনি হরন’ প্রথম যাত্রা পালা। অষ্টম ও নবম শতকেও এদেশে পালাগান ও পালার অভিনয় প্রচলিত ছিল। শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পু্ল্র, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, শ্রীহট্টসহ সমগ্র ভূখণ্ডে পালাগান ও কাহিনিকাব্যের অভিনয় প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় বা কোনো উত্সবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে রীতি সেখান থেকেই যাত্রা শব্দটি এসেছে। এদেশে শিবের গাজন, রামযাত্রা, কেষ্টযাত্রা, সীতার বারোমাসী, রাধার বারোমাসী প্রচলিত ছিল। অষ্টাদশ শতকে যাত্রা বাংলা ভূখণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারী, সুবল দাস ছিলেন যাত্রার জগতে প্রসিদ্ধ। উনবিংশ শতকে পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক যাত্রা খুব জনপ্রিয়তা পায়। উনবিংশ শতকের শেষে এবং বিশশতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেমমূলক কাহিনির অভিনয় শুরু হয়। বিখ্যাত সাহিত্যিক মীরমোশাররফ হোসেনও পালা লিখেছেন। তিনি বেহুলা নিয়ে যাত্রাপালা লেখেন। সে সময় গ্রামে গঞ্জে বিষাদসিন্ধুর কাহিনি নিয়েও যাত্রা অভিনয় হতো। কারবালার কাহিনি নিয়ে যাত্রা পালা লেখা হতো।

উলে­খযোগ্য যাত্রা পালার মধ্যে রয়েছে: রূপবান-রহিম বাদশাহ,সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, গুনাইবিবি, দুর্গামনি, কমলা রানীর বনবাস, কাজল রেখা, মলুয়া, ভেলুয়া সুন্দরী,, বীরাঙ্গনা সখিনা, গ চম্পাবতী, বনবিবি ইত্যাদি। জনপ্রিয়তা পায়: মাইকেল মধুসূদন, দেবদাস, রক্তাক্ত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বিজয় এনেছি, মা মাটি মানুষ, সোনার বাংলা, সোজন বাদিয়ার ঘাট, লালন ফকির, ঈশাঁখা, রক্তাত্ত প্রান্তর, একযে ছিলেন মহারানী, দাতা হাতেম তাই, এই দেশ এই মাটি, বিদ্রোহী বুড়িগঙ্গা, বর্গী এলো দেশে, বাংলার মহানায়ক ইত্যাদি পালা।

দেশে পুতুলনাচের অবস্থাও বিপন্ন। ‘রয়েলবীণা পুতুলনাচ’ আর ‘বাণীবীণা পুতুলনাচ’ নামে দুটি দল মোটামুটি টিকে আছে।

এদিকে বাংলা র যাত্রাশিল্পী অমর বলেন, খুব করুণ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। তিন বছর আগে দল নিয়ে শেষবার পালা করেছি । তারপর থেকে সবাই বসা। আমাদের অপেরায় কাজ করে ৪০ জন। এদের সবার রোজগার এখান থেকে। পালা না হওয়ায় কিভাবে এ মানুষগুলো বেঁচে আছে ভাবুন। আরেকজন যাত্রাশিল্পী  বললেন, যাত্রাশিল্পে আগে সিস্টেম ছিল বেতন আকারে। খারাপ অবস্থার কারণে ‘ নো ওয়ার্ক নো পে’ হিসেবে কাজ করেন সবাই। দুই বছর আগে সিজনে কাজ করেছি। তাতে আমার আয় হয়েছিল ৫৫ হাজার টাকা। সেই টাকা কয়দিন চলে। অনেকদিন বেকার থাকার পর টঙ দোকান দিয়ে ব্যবসা করছি। পেট চালাতে হবে তো। আমাদের কেউ কেউ বেঁচে থাকার তাগিদে রিকশাও চালাচ্ছেন। আমরা জানি আর সুদিন ফিরবে না। সুতরাং যাত্রাপালা করার শখ- পেশা দুইটাই ত্যাগ করেছি।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆